প্রাচ্যের সক্রেটিস

কাজল রশীদ

‘জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, এই তিন না জানে বরাহ।’ জানে না বলেই দম্ভটা অনেক বেশি। আস্ফালনটাও সকলের নজরে পড়ার মতো। তাতে কিছুই যায়-আসে না লীলাবতীর। প্রাতিস্মিক এক মেয়ে। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল, তাই রীতিনীতিও বড্ড বিস্ময়কর। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। জোয়ার-ভাটার চিরন্তন রীতির মতোই দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, প্রীতি সব কেমন করে যেন পাশাপাশি অবস্থান করে। কেউ আপস করে, কেউ শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়ায়। কেউ যায় যুদ্ধে কেউ যায় ভিক্ষায়। প্রথমটাই বেছে নিয়েছে লীলাবতী। বাইরে নয়। গৃহে, আপনজনের সঙ্গে। বাইরের কারো সঙ্গে লড়াই বা যুদ্ধ করার চেয়ে, শতভাগ কঠিন এ যুদ্ধ। ‘মৃত্যুরে ডরায় না বীর’ – শাশ্বত এ সত্য যেন চয়ন করা হয়েছে লীলাবতীর জীবন থেকে। মিথ্যে আভিজাত্য আর অহমিকার সঙ্গে আপস করেনি সে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ক্ষুদ্র জীবন নয়, সত্যের ধ্বজা উঁচু করেছে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় মৃত্যুকে বরণ করে হয়েছে সক্রেটিসের প্রতিচ্ছবি। হেমলক পান করতে হবে নিশ্চিত জেনেও সত্য বলতে পিছপা বা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। কারণ তারও হয়তো প্রতীতি ছিল সক্রেটিসের উক্তিতে, ‘I to die, you to live, only God knows which is better.’
খনা নাটক দর্শনে খনার চেতনায় পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হতে হতে বারবার মনে পড়ছিল ‘সক্রেটিসে’র কথা। খনারূপী লীলাবতী কিংবা লীলাবতী রূপী খনার জীবনও একই সমান্তরালে প্রবহমান। একজন পাশ্চাত্যের, আরেকজন প্রাচ্যের। গর্ব হচ্ছিল এই ভাবনায় যে, আমাদেরও একজন সক্রেটিস আছেন, যা জাগ্রত করার প্রত্যক্ষ নায়ক নাটকের দল ‘বটতলা’। যাদের প্রযোজনা খনা শুধু নাটক হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে তারও অধিক কিছু। যার রেশ থেকে যায়, নাটক দেখার পরেও। আলো-অাঁধারির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়েও নাটকের খনা আমাদের ভাবায়, আলোড়িত করে। ‘A Nation Known by its Theatre’, এই অমোঘ সত্য সকল নাটক ধারণ করে না। অথচ এটাই প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত, যা অনেকেই করে না, কিংবা করতে পারে না। নবীন নাট্যদল ‘বটতলা’ সেটাই পেরেছে, যথাযথ স্বাক্ষর রেখেছে। তাঁরা আমাদের শেকড়ের এমন এক সময় ও চরিত্রকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন, যিনি সক্রেটিসের মতোই বরণীয় ও 888sport app download for androidীয়। ট্র্যাজেডিতেও একই রকম, শুধু স্থান ও সময়ের প্রভেদ। বটতলা খনা প্রযোজনায় খনাকে নতুন করে তুলে ধরেছে। চেতনায় অজস্র প্রশ্নের অবতারণার পাশাপাশি কতিপয় সুড়ঙ্গও নির্মাণ করেছে, যা অন্ধকারে ঠাসা নয়। দূরবর্তী আলোয় আশাজাগানিয়া।
স্বাধীনতা-উত্তর 888sport appsের মঞ্চনাটকে প্রাণের দীপ্তি ছড়ান মুক্তিযুদ্ধ-ফেরত কতিপয় নাট্যানুরাগী তরুণ। তাঁরা দল গঠন করে (নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জন্ম অবশ্য স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৮-তে। মঞ্চাভিনয় স্বাধীনতার পর। আলী যাকেরের নির্দেশনায় বাদল সরকারের বাকী ইতিহাস দিয়ে সূচনা)। নব-নব প্রযোজনায় থিয়েটারকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। শুরু হয় গ্রুপ থিয়েটারচর্চা। বেগবান হয়ে ওঠে 888sport appsের মঞ্চনাটকের গতি-প্রকৃতি, যার ঢেউ লাগে বদ্বীপ-ভূমের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। বিশেষ করে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে (এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ভূমিকা অবশ্য অনেকাংশেই 888sport appর মতো)। 888sport appsের নাট্যচর্চায় স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রকাশিত রামেন্দু মজুমদার-সম্পাদিত থিয়েটার পত্রিকাও গুরুত্বপূর্ণ এক কান্ডারি। একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিকলগ্নে কিংবা বিংশ শতাব্দীর বিদায়ক্ষণে 888sport appsের নাট্যচর্চায় নব-নব সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। মাহেন্দ্রক্ষণের এই যোজন-বিয়োজনের দোলায় মঞ্চনাটকে আসে আমূল পরিবর্তন। তুলনামূলকভাবে নবীন দলগুলো প্রযোজনা-মানে নিজেদের অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায়। জ্যেষ্ঠ দলগুলোও পরিবর্তনের হাওয়ায় চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
এই সময়ের নানামুখী সৃজন উৎকর্ষতার গৌরবোজ্জ্বল এক স্মারক খনা, যার প্রযোজক দল বটতলা। নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার। রচনা সামিনা লুৎফা নিত্রা। বটতলা-প্রকাশিত স্যুভেনিরে আলোচ্য নাটকের কাহিনি সংক্ষেপ অংশে বলা হয়েছে : এক বিদুষী ‘খনা’, যার অন্য নাম লীলাবতী। তার গল্পটা অনেক পুরনো, কিংবদন্তির ঘেরাটোপে বন্দি। তবু যেটুকুর তল খুঁজে পাওয়া যায় তাতে বোধহয় যে, তিনি এক বিদুষী জ্যোতিষী, স্বামী মিহিরও একই বৃত্তিধারী। শ্বশুর যশস্বী জ্যোতিষী বরাহ মিহির। পুত্রজায়ার যশ, খ্যাতি ও বিদ্যার প্রভাব দর্শনে বরাহের হীনমন্যতা ও ঈর্ষা। শ্বশুরের নির্দেশে লীলাবতীর জিহবা কর্তন ও তার ‘খনা’ হয়ে ওঠার গল্প পেরিয়েছে প্রজন্মের সীমানা। খনার বচনের মাঝে টিকে থাকা শত বছরের আগের জল, মাটি, ফসল আর মানুষের গন্ধমাখা জ্ঞান আর সত্যটুকু কি সত্যি লীলাবতীর? নাকি এ সত্য-তথ্য সবই এ ভূখন্ডের বৃষ্টি, পলি আর জল-হাওয়ার সাথে মিশে থাকা যুগান্তরের সামষ্টিক জ্ঞানের সংকলন? লীলাবতী শুধুই কি একজন 888sport promo code বলে তার পরিণতি নির্মম, নাকি তিনি 888sport promo code হয়ে মিশেছিলেন চাষাভুষোর সনে; সে-ই তার কাল? পুরুষতন্ত্র, না শ্রেণি-কাঠামো; নাকি উভয় দাঁড়ায় লীলাবতীর বিপ্রতীপে? মিহির বা প্রাকৃত লোকালয় কারো পরোয়া না করা জীবনত্যাগী নেশার ঘোর তাকে নিয়ে যায় দিগন্তের ওপার। খনার সত্য শুধু থেকে যায় কৃষকের মুখে। তবু প্রশ্ন থাকে, খনার সত্যই কি একক সত্য? নাকি আজকে নির্ভুল যা কাল তা হতে পারে অসত্য? শুধু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর যে মৃত্যুনেশা তাঁর সে-নেশা কি একরোখা জেদ? খনা নিজেই নিজেকে করেন সম্মুখীন প্রশ্নের।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে 888sport appর মঞ্চে খনার জীবনকে আশ্রয় করে দুটি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। অন্যটির নাম লীলাবতী আখ্যান। লিখেছেন নাসরীন মুস্তাফা। নির্দেশনা দিয়েছেন লিয়াকত আলী লাকী। প্রযোজনা করেছে লোকনাট্য দল!
সাম্প্রতিক সময়ে ‘খনা’কে নিয়ে টিভিতে একটি দীর্ঘ ধারাবাহিকও প্রচার হয়েছে। ওপার বাংলার চ্যানেল জি-বাংলায়। 888sport appsে খনাকে নিয়ে ‘live chat 888sport’ তৈরি হচ্ছে, এরকম আলোচনাও মুখে মুখে ফিরেছে। যদিও তার প্রামাণ্য কোনো নজির এখনো মেলেনি। বর্তমানে ‘খনা’ ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছে। আগ্রহও বাড়ছে তাকে ঘিরে। এমনটাই প্রত্যাশিত, কেননা এভাবেই খনাকে নতুন রূপে আবিষ্কার করা সম্ভব হবে, যার মধ্যে দিয়ে খনার প্রাসঙ্গিকতা ও অপরিহার্যতাও মূল্যায়িত হবে।
বটতলার প্রযোজনা খনা আমাদের ভাবিয়েছে, সুখ-দুঃখের সাথি করেছে, জীবন-কর্ম-দর্শন থেকে শিক্ষার উপাদান ও উপকরণ জুগিয়েছে, যা আমাদের যুগপৎভাবে আনন্দিত ও ব্যথিত করেছে। যে-কোনো নাটকের সার্থকতা বুঝি এখানেই, নাটকের ঘটনা যখন আমাদেরকে একাত্ম করে নেয়। ‘মেক বিলিভে’র জায়গাটা এমনভাবে তৈরি হয়, আমরা প্রায় ভুলে যাই নাটকের চরিত্র আর বাস্তবের চরিত্রের প্রভেদ। বিস্মরিত হই আমি, আমরা ও নাটকের কুশীলব সম্পর্কে। তখন তাদের ভূমিকা ও উদ্দিষ্ট নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
লীলাবতী যখন বলে : ‘আজ আমার পূর্ণিমায় ভাসার সাধ হয়েছে। বৃষ্টি আমার সাথে কখনো এত শত্রুতা করে না। সেই সবুজ বৃষ্টির দ্বীপের মতো ভেলায় চিৎ শুয়ে পূর্ণিমায় ভেজার রাত আজ। জলের ভেলা না পেলেও উঠোনে আসন বিছিয়ে আজ হবে জ্যোৎস্নার শয্যা। আকাশের যে কি দুঃসহ ভার। দেখেছেন কখনো পিতা? প্রাচীন এ পৃথিবীর বুকের ওপর তার চেয়েও প্রাচীন আকাশ কেমন উপুড় হয়ে চেপে বসে আছে। উলটে তাকে দেখলে বড় ভয় জাগে বুকে। মনে হয় চেপে আসছে শোধ নিতে অনন্তকাল ঝুলে থাকার। চলুন পিতা আজ জ্যোৎস্নাভাসা আকাশ দেখি।’
আমরা লীলাবতীর এই কথনে বিশ্বাসী হয়ে উঠি। কিংবা প্রত্যেকে হয়ে উঠি একেকজন লীলাবতী। যাদের সাধ হয় পূর্ণিমায় ভাসার। বিশ্বাসও করি আজ বৃষ্টি হবে না।
লীলাবতী প্রকৃতিকন্যা। প্রকৃতির মতোই কখনো চঞ্চল-অস্থির, কখনোবা সৌম্য-শান্ত। যখন যে বিচার করে গ্রহ-নক্ষত্ররাজি তখন সে একরকম। যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তখন আরেক রকম। কৃষকের সোঁদামাটির গন্ধে পাগলপারা লীলাবতী সর্বরূপে আবির্ভূত হন আমাদের সম্মুখে।
চরিত্রাভিনেত্রীও মোহনীয় ভঙ্গিমায় তেমনটি করে দেখান। আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হই।
লীলা বলে : ‘তার মানে এই নয় যে, ভালোবাসি না আকাশ, তপন, মেঘের ভেলা, তৃণ, বৃক্ষরাজি, বুক ভরে টেনে নেওয়া বর্ষার প্রথম বৃষ্টি স্পর্শে জেগে ওঠা মাটির বুকের সুবাস। তার মানে নয় যে, প্রিয়তমের প্রতি ধাবমান ভালোবাসা থেমেছে, কিংবা হয়েছে শীতল, হারিয়েছে স্পর্শের কোমলতা বা বুভুক্ষা। হারায়নি ভালোবাসা গান, বাঁশি আর সুরের ধারায়; ভালোবাসা বেঁচে আছে আমায় প্রিয়তম নক্ষত্রের আলোকমালায়। শুধু তার চেয়ে বড় কিছু, অন্যরকম যার প্রতি ভালোবাসা তুল্য নয় এদের কারো। সেই সত্যকে বড় ভালোবেসেছি রানীমা। জীবনের বিনিময়েও তারে পরিত্যাগ অসম্ভব।’
আমরাও তেমনটাই বোধ করি। একজন চরিত্রাভিনেত্রীর অভিনয় শক্তি প্রকাশিত হতে দেখে মুগ্ধ হই।
অথচ তিনিই যখন জ্যোতিষচর্চায় ব্যাপৃত হন, নাটকে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে : ‘লীলাবতী ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার গণনায়। সত্যি কি এমন দুর্যোগ আসন্ন? নাকি ভুল হলো কোথাও? ‘যদি বর্ষে আগনে রাজা যায় মাগনে’ – এ তো ভয়াবহ ভবিষ্যৎ। মিহিরের সাথে পরমর্শ করা। প্রয়োজন অতিসত্বর। রাজা ধর্মকেতু ও রাজ্যের মঙ্গল-অমঙ্গল জড়িত এর সাথে।’
এবার কিন্তু আমাদের কাছে ব্যাপারটা মেকি মনে হয়। চিন্তা, অস্থিরতা, সংশয়, সন্দেহ এসবের কোনোকিছুই যথাযথভাবে প্রকাশিত হয় না।
আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটা খর্ব হয়ে আসে। এরকম বেশকটি মুহূর্ত রয়েছে যেগুলো আরো দীপ্তিময় ও ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ হতে পারত। বরাহ, মিহির ও লীলার দ্বন্দ্বও যেন দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে না। পুরো নাটকে মিহিরের ব্যথাতুর হূদয়ের পরিচয় আমরা পাই না। যেভাবে লীলাবতীর পাই। বরাহ এই নাটকের মন্দ চরিত্র। গতানুগতিক মন্দ নয়। কিন্তু সেসবের কোনো ছাপ দৃষ্ট হয় না নাটকজুড়ে।
মহাভারতের দ্রোনাচার্য হলো খনার কালের বরাহ মিহির। যে সুযোগসন্ধানী, কূটকৌশলী। ছলে-বলে-কৌশলে নিজের আসন ধরে রাখাতেই তার বীরত্ব। এরকম মানুষ কোনোকালেই না-প্রেমিক, না-স্বামী, না-পিতা, না-গুরু। এদের একটাই পরিচয়, এরা দাম্ভিক, আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। বরাহ চরিত্রাভিনেতার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা প্রত্যাশিত ছিল। প্রতিটি চরিত্রের একটি নিজস্ব রং থাকে। সেই রং আগাগোড়া ধরে রাখা জরুরি, যা অনেকাংশেই ধরে রেখেছিলেন খনা, অন্যেরা নয়। অথচ একটু সচেতন ও সতর্ক হলেই প্রত্যেকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল। এমনটা হলে পুরো প্রযোজনাতে ছন্দময় এক দ্যোতনার জন্ম দিত, যা প্রযোজনা মানকে নিয়ে যেত ধ্রুপদ স্তরে।
শ্রেণিসংগ্রামের প্রতীক কিংবা পুরুষশাসিত সমাজের নির্যাতিত 888sport promo codeর প্রতিচ্ছবি শুধু নয়, খনা একই সঙ্গে অনেক চরিত্রের প্রতিভূ। এগুলোও যদি বিবেচনায় রাখা যেত তবে প্রযোজনাটি হয়ে উঠত আরও বেশি আবেদনময় ও নান্দনিক।
নাটক প্রসঙ্গে বলা যায়, নাট্যকার খনাকে কীভাবে দাঁড় করতে চেয়েছে তা কখনো কখনো অস্পষ্ট মনে হয়। খনা কি সংগ্রাহক? আমরা দেখি খনার বচন বলে যেসব কথা আমরা জানি, সেগুলো সে অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করছে। বলা হচ্ছে, খনা প্রকৃতির কাছে থেকে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে সবকিছু দীক্ষা নিচ্ছে, শিখে, বুঝে জেনে নিচ্ছে। কিন্তু আমরা একেক সময় একেক রূপে পাই, যার সমন্বয় বা একটি ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয় না।
খনা একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। সুতরাং তার উপস্থাপনে অনেক বেশি সতর্ক ও সাবধানি হওয়া প্রয়োজন। ‘খনা’ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি আজো বহাল। কেউ কেউ মনে করেন, খনার বচন একজনের নয়, অনেকের। কেউ বলেন, খনা একজন চরিত্র নয়, অনেক বেশি কয়েকজন। চন্ডীদাস সমস্যার মতোই খনা সমস্যাও প্রবল। আবার খনার জন্মস্থান নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বরাহ মিহিরই বা কে? তার জন্মস্থানই বা কোথায়? এমনও শোনা যায়, বরাহ মিহির থেকেই নাকি বর্তমানের 888sport apps ভূখন্ডের ‘মেহেরপুর’ জেলার নামকরণ হয়েছে। এসবই অনুমাননির্ভর তথ্য।
তারপরও যদি কোনোভাবে এসব বিষয়কে ধরা যেত আলোচ্য প্রযোজনায় তবে প্রযোজনাটি পুরোপুরি ঋদ্ধ ও ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠত। ‘খনা’ সাধারণ একজন মানুষ নয়। সুতরাং তার হাত ধরে তার প্রসঙ্গে বিবিধ প্রসঙ্গ আসাই সংগত। এবং সেটাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারাটাই একজন নাট্যকার-নির্দেশকের প্রকৃত কুশলতার পরিচয়। খনার কান্না শুধু একজন 888sport promo codeর কান্না নয়, তার কান্নায় সত্য হারানোর বেদনা রয়েছে, স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গের চাতুরীপনা রয়েছে, দেশকে ভালোবাসার যন্ত্রণা রয়েছে। আপন শ্রেণিকে ভালোবাসার অঙ্গীকার রয়েছে, সর্বোপরি রয়েছে একজন সাহসী ও সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন মানুষের মাথা উঁচু করে কথা বলার নির্ভীকতা। যার মধ্যে দিয়ে খনা হয়ে ওঠেন প্রাচ্যের সক্রেটিস। বটতলায় খনা সেই সত্যকে তুলে ধরেছে। আমরা বটতলার সূত্রে খনার হাত ধরে আমাদের ঐতিহ্যে ফিরে যাই, শেকড়মন্থনে খুঁজে পাই এমন একজন মানুষকে, যিনি বহু বছর আগেই বলেছেন : ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’। তিনি সত্য প্রতিষ্ঠায়, সাম্যবাদের জন্য, কৃষকের স্বার্থরক্ষায়, প্রকৃতিকে ভালোবেসে, শ্রেণিসংগ্রামকে আবক্ষ ধারণ করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। যার তুলনা মেলে কেবল সক্রেটিসের হেমলক পানের সঙ্গে। জীবন-কর্ম ও দর্শনের নিরিখে তিনি হয়ে ওঠেন প্রাচ্যের সক্রেটিস। যিনি জবান (জিহবা কর্তন করা হয়েছিল তাঁর) দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, অমরত্ব দিয়ে গেছেন সক্রেটিসের মতোই তাঁর বাণীসমূহকে। যা খনার বচনরূপে কৃষিপ্রধান এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় আজও জীবন্ত ও প্রাণময়। তাই তো শতক-সহস্রকের চৌকাঠ পেরোনোর পরও আজও সেই বাণী কৃষকের কাছে অমৃততুল্য – ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত। যদি বর্ষে আগনে, রাজা যায় মাগনে। আষাঢ় নবমী শুক্ল পখা, কিসের এত লেখাজোকা। যদি বর্ষে মুষলধারে, মধ্য সমুদ্রে বগা চরে। যদি বর্ষে ছিটেফোঁটা, পর্বতে হয় মীনের ঘটা। যদি বর্ষে রিমিঝিমি, শস্যের ভার না সহে মেদিনী। হেসে সূর্য বসেন পাটে, চাষার বলদ বিকোয় হাটে। ষোল চাষে মুলা তার অর্ধেক তুলা, তার অর্ধেক ধান বিনা চাষে পান। থেকে গরু না বায় হাল, তার দুঃখ চিরকাল। থোড় তিরিশে ফুল বিশে, ঘোড়ামুখো তেরো দিন দেখে শুনে ধান কিন্। আষাঢ়ে রোয়া শ্রাবণে পোয়া, ভাদ্রে যুবা, আশ্বিনে বুড়া, কার্তিকে দেয় উড়া। উত্তম ক্ষেতি যে হাল চষে, মধ্যম ক্ষেতি যে সঙ্গে রহে। ঘরে বসে পুছে বাত, ইবার যা-তা উবার হাভাত।’ এসব কি শুধুই কথার কথা? নাকি প্রতিটি বাক্য একেকটি দর্শন। যে-দর্শনে কৃষক খুঁজে পায় তার করণীয় সম্পর্কে। যদিও আমাদের শাস্ত্রবিদরা খনাকে দেন না দার্শনিকের মহিমা ও মর্যাদা। তবু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে খনার বচন থেকে যায়। এখানেই খনার বিশিষ্টতা। যা তাঁকে পরিগণিত করে প্রাচ্যের সক্রেটিস হিসেবে। 