ওরা এসেছে। হ্যাঁ নিশ্চয় ওরা। আনন্দে তোলপাড় করল বুক। কত দিন ওদের দেখিনি, আজ তিন তিনটে বছর ওরা আমার চোখের অন্তরাল। অনেক অনেকদিন পরে দেখা হবে ওদের সঙ্গে। আব্বা, আম্মা, বাচ্চু, মুন্নি – আমার ছোট ছোট ভাই বোনেরা। তাই আপিস থেকে যখন সাক্ষাৎকারের ‘শ্লিপ’ এলো, তখনই অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে উঠেছে মনটা। হবারই কথা। যে আসন্ন মলিন মুহূর্তে শুরু হয়েছিলো আমার বন্দী জীবন, তারপর হতে দিবা-রাত্রির কক্ষ থেকে ঝরে পড়েছে, খসে পড়েছে পাকা ফসলের মত, উড়ে গেছে কালের মহাশূন্যে।
এই তিনটে বছর কেটেছে আমার চতুর্দেয়ালের এই পাষাণপুরীতে; আত্মীয়স্বজন প্রিয়জনের দর্শন বঞ্চিত এক জীবন। এই দীর্ঘদিন ধরে যে সব ছবি আমার মনের পটে আনাগোনা করেছে, সে তো তাদেরই, আমার একান্ত প্রিয়জনদের। দিন ও রাত্রির দুঃসহ মুহূর্তগুলিতে যখনই তাদের কথা ভেবেছি, তখনই ভুলে গিয়েছি সকল দুঃখ ও লাঞ্ছনা। এখন ৫৩ সালের শুরু, আমি জন্মেছিলুম সেই তিরিশ সালের ডিসেম্বর। সেদিন সেলের বারান্দায় বসে আমি ভাবছিলুম এই পেরিয়ে আসা জীবনের মাইলখণ্ডগুলির কথা। আর হিসেব করেছি সে দিনগুলি কাটলো এই বন্ধদুনিয়ায়। তিন বছর আগে কলেজের ফর্মপূরণ করতে গিয়ে বয়স লিখিয়েছিলাম কত কম। সুতরাং ভুলতে পারিনি অভাব অনটনের মধ্যেও প্রিয়জনদের হাসিমাখা মুখ, আব্বা আম্মার স্নেহময় দৃষ্টি, ভালবাসা : আমার অতি স্নেহের বোন মুন্নি বাচ্চু কাউকেই নয়।
জেল অফিস যাবার পথে ভাবছিলাম, দীর্ঘদিনের না দেখার পর আজকের এই প্রথম সাক্ষাৎকার কি ধরনের হবে। আব্বার গম্ভীর মুখেও কি একটুখানি হাসি ফুটে উঠবে না? আম্মার মুখের ছবিটা কি হয়ে উঠবে না পিকাসোর সেই ছবির মতো। আজ দীর্ঘদিন পরে অন্ধকার ঘরটাতে তাদের প্রথম দর্শনে হয়ত আমাকে একটু বিব্রত মনে হতে পারে। না, আমি হাসবো। তাঁদের দেখেই হাসবো। কান পর্যন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত হাসি। সে হাসি হবে অদম্য। তারপর মুন্নি, গভীর আদরে দু’হাত দিয়ে ওকে টেনে নেব নিজের কাছে। ওর একটুখানি পায়রা মুখটা তুলে বলবো : ‘মুন্নি’! –
‘ভাইয়া’, বলে সে আঁকড়ে ধরবে আমাকে। ওরই মধ্যে বলা হয়ে যাবে অনেক অনেক কথা। আমাদের শৈশবের আর বাল্যের অনেক কথা, যা কেবল আমরা দুই ভাই বোনেই জানি। আব্বা আম্মা চেয়ে রইবেন হাসিমুখে। জেল আপিসের কপালে সতর্ক প্রহরীর দৃষ্টির মতো দুটো বিজলী বাতি ঝকঝক করছে রোদে। সঙ্গের সান্ত্রী বললে, ‘চলুন ভাই, একটু তাড়াতাড়ি চলুন।’ … কাঠের বড় দুয়ারের বুকে ছোট্ট দুয়ারটা গেল খুলে।
যে ঘরে আমায় নিয়ে যাওয়া হোল, সেখানে আগেই ওরা বসে ছিলেন। আব্বাকে দেখেই চিনলাম, অনেক বদলে গেছেন আব্বা। আগের সেই চেহারাই আর নেই। জেলের ডিপুটি বললেন, আপানার ইন্টারভিউ; আম্মা আসেন নি; কেবল আব্বা বাচ্চু, মুন্নি। আব্বার দিকে চেয়ে আমি হাসলাম, হাসতে গিয়েই মনে হোল এ যেন সেই অর্থহীন হাসি। আবার হাসলাম, বড় মলিন ও হাসি।
পা ছুঁয়ে আব্বাকে সালাম করেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। আব্বা বললেন, ‘শরীর তো খুবই খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’
‘খুব খারাপ আর কোথায়’, আমি বললাম, ‘ভালো স্বাস্থ্য আমার কোন কালেই ছিল না। আজকাল এক আধটু ব্যায়াম করছি। শরীর তো আমার আজকাল ভালোই যাচ্ছে। আমার স্বাস্থ্যের জন্যে আপনারা ভাববেন না মোটেই।’ ছোটভাই বাচ্চু, তার বড় বড় চোখদুটো তুলে ধরে বললো, ‘ভাইয়া তুমি আর আমাদের বাড়ি যাবে না!’
‘তোমাদের বাড়ী?’ আমি হেসে ওর গালে একটা চুমো খেয়ে বললাম, ‘কি করে যাব ভাই? আমি কি নিজের ইচ্ছেয় এখানে রয়েছি।’ ওর থুতনিটা নেড়ে দিলাম আমি। আমার কথাগুলো সে বুঝতে পারে নি, তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আবার পরিষ্কার করে বললাম, ‘আমাকে যে ধরে রেখেছে ভাই।’ ‘কারা?’ গভীর প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠলো ওর দুচোখে। ‘কারা?’ জবাব দিতে গিয়েই দেখলাম প্রশ্নটা কত বড়। কারা আমার বন্দীত্বের জন্যে দায়ী। আমার বন্ধুদের মধ্যে হয়তো এ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা চালাতে পারি, এই বন্দীত্বের সাথে সম্পর্ক দেখাতে পারি সারা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নের। কিন্তু আমার শিশু ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়া কি শক্ত। কয়েক মুহূর্ত আমার মুখ দিয়ে কোন জবাব বেরুলো না। শেষে অদূরে উপবিষ্ট গোয়েন্দা অফিসারটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘ওই ওরা।’
আমার আঙুল অনুসরণ করে বাচ্চুর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো যথাস্থানে। একটি ভয় ও ঘৃণামিশ্রিতভাব ফুটে উঠলো ওর চোখে। অত্যাচারীকে সামনে পাওয়া নিরস্ত্র মানুষের মুখের মতোই ফ্যাকাশে হয়ে গেল বাচ্চুর মুখ। ও তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এই সুযোগে আমি মুন্নির দিকে নজর দিলাম। মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে আমার চেয়ারের হাতল ধরে।
‘মুন্নি’, আমি ওকে ডাকলাম, হাত বাড়িয়ে দিলাম সেই আগের মুন্নিকে নেবার জন্যে। কিন্তু কতো বড় হয়েছে মুন্নি। সেই আগের মুন্নিই যেন আর নেই। আমার মনের মধ্যে মুন্নির যে ছবিটা গত তিন বছর ধরে পুুষে রেখেছি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা। আমার প্রসারিত হাত গুটিয়ে নিলাম।
‘ভাইয়াকে সালাম করলে না তোমরা। বড় ভাইকে সালাম করতে হয় না?’ আব্বা বললেন ওদের। আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেল মুন্নি। আমি ওকে মাঝপথেই ধরে ফেললাম, আর সংকোচে এতটুকু হয়ে গেল মুন্নি। বুঝলাম শুধু দেহেই নয়, মনেও বেড়ে উঠেছে সে।
কিন্তু এই কি সেই মুন্নি যার কচি মুখখানি আমার দুঃসহ বন্দীজীবনে অহরহ মনে পড়েছে। ওর মনটাও কি ঠিক এমনি বদলে গিয়েছে? ওর মনের মধ্যে আমার জন্যে অমন ভালবাসা কি এখনও রয়েছে বেঁচে, যা ছিল আশেপাশের বাপ-মায়েদের কাছে, তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে উদাহরণের বস্তু।
‘ভাইয়াকে মনে ছিল তোমার মুন্নি’, আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে। সরমে রাঙা হয়ে উঠলো মুন্নি, চোখ নামিয়ে ঘাড় নেড়ে বললো, ‘ছিল।’ আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মুন্নির বয়স কত হোল আব্বা?’
‘বয়স তো কারো পড়ে থাকে না বাবা। আমরাও তো বুড়ো হয়ে গেলাম। তোমারও তো এখন পরিণত বয়স। তুমি ছিলে আমাদের আশা ভরসা। তা তুমিই রইলে জেলে বসে। তোমার এই ছোট ছোট ভাইবোন। তা হবে বই কি ওর বয়েস – বারো তো হয়ে এলো। মেয়েছেলে বাড়তে দেরি লাগে না। আর দু’দিন পরেই তো বিয়ের বয়েস হবে। এদের শিক্ষা, ওর বিয়ে শাদী এসবের দায়িত্ব তো তোমারও।’ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন আব্বা।
বিয়ের কথায় আমি যেন চমকে উঠলাম। যতই বয়স হোক, বিয়ের বয়স হতে ওর এখনো ঢের দেরি। ততদিন দুনিয়াই পালটে যাবে। আব্বার যতো কথা। কিন্তু আব্বার ইঙ্গিতটা আমি বুঝলাম। আর তুমি আছো জেলে বসে কথাটি মনে মনে বার বারই আবৃত্তি করলাম আমি। কিন্তু চুপ করে রইলাম।
‘মুন্নি তুমি এখন কোন ক্লাসে পড়?’ আমি ওকে জিজ্ঞেস করি।
‘সিক্স ভাইয়া’, মুন্নি বললে।
‘সিক্স! অনেক পড়ে ফেলেছো তুমি।’ আমার আম্মার পড়াশুনা নাম-লেখা অবধি। গোঁড়া পরিবারে মার জন্ম। আমার নানা নানী যদিও ‘শিক্ষার জন্য চীন দেশেও যাবে’, রাসুলুল্লার এই বাণী জানতেন, তথাপি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখবার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন নি। আজকাল তো লেখাপড়া না জানা মেয়েদের ‘দুলাই’ জুটবে না। তাই মুন্নিরা কিছুটা এগিয়েছে বই কি! ছোটবেলাতেই আমি আব্বাকে বলতাম, বড় হয়ে আমি উকিল হব আর মুন্নি হবে লেডী ডাক্তার। আমার উকিল হওয়ার পথে বাধার দেওয়াল। কিন্তু মুন্নিই কি পারবে লেডী ডাক্তার হতে?
হঠাৎ মুন্নির দিকে তাকাতে কত কথাই না আমার মনে পড়ে যায়! বাল্যের অসংখ্য 888sport sign up bonus আমার মনের দুয়ার খুলে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়তে চায় যেন! ‘আচ্ছা মুন্নি, আমাদের কাকাতুয়াটা আছে তো!’
‘না ভাইয়া, ওটা মরে গেছে অনেক আগে।’ পাখীটা মরে গিয়েছে। মরে যাওয়াটা অসম্ভব কোন ঘটনা নয়। একটুও দুঃখ হোল না আমার শুনে। অথচ ছোটবেলা থেকে পাখী আমার কতো প্রিয়। গাছের ফুল, উড়ন্ত পাখী আর সবুজ গাছপালা দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে উঠতাম আর জেগে উঠত আমার মধ্যে এক অনন্ত জিজ্ঞাসা।
মনে পড়ে যায়, আমার ছিল পাখী পোষার দুরন্ত খেয়াল। গাছে গাছে সারাদিন পাখীর ছানা খুঁজে বেড়াতাম আমি। কত পাখীশিশুকেই না আমি সংগোপনে হরণ করেছি নীড় থেকে, মাতৃহীন করেছি তাদের আর পুষে রাখতে চেয়েছি খাঁচায়। কিন্তু বাঁচে নি একটাও। একবার মনে পড়ে, কোত্থেকে একটা শালিকের বাচ্চা নিয়ে এলাম ধরে। তারপর দিন আমার পাখী নিয়েই কাটে।
আগে মুন্নির সঙ্গে যেখানে দিন কাটতো, সেখানে পাখীর ছানা ভাগ বসালো। আমাদের রান্নাঘরের পেছনে ছোট্ট এক ফালি বাগান করেছিলেন আব্বা। সেখানে আহার দিতাম পাখীটাকে। দুধের সঙ্গে রুটির টুকরো মিশিয়ে পাখীটাকে খাওয়ানোতেই আমার সারা পড়ার সময়টা কাটতো। কিন্তু পাখীটা গেল মরে। খুবই আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন। তারপর বহুদিন আর কোন পাখী পুষিনি। একদিন শেষে ভোরবেলায় ছুটতে ছুটতে নিয়ে এলাম একটি পাখীর ছানা। বাড়ীতে ঢুকেই ডাক দিলাম : ‘মুন্নি, মুন্নি -’
মুন্নি দৌড়ে এলো, পাখীটা দেখে ওর মুখটা হয়ে গেল এতটুকু।
‘খুশি হলিনে বুঝি?’ আমি ওকে বলেছিলাম। মুন্নি জবাব দেয়নি। আমি ওকে বললাম, ‘যা শিগগিরি পানি নিয়ে আয়।’ মুন্নি দৌড়ালো পানি আনতে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল তবু মুন্নি আর আসে না। আমি ওকে গাল পেড়ে ডেকেছিলাম, ‘অ হারামজাদী মুন্নি, এতক্ষণ কি করছিস?’
মুন্নি জল নিয়ে এলো মুখ ভার করে। পাখীর ছা’টা ওর হাতে দিয়ে আমি বললুম, ‘তুই ধর আমি রুটি মেশাই।’ হঠাৎ মুন্নি আমাকে বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া তোমার কষ্ট হয় না। খালি পাখী এনে বেঁধে রাখো। একটুও দয়া মায়া নেই তোমার।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘তুই তো বলবিই। মেয়েছেলে যখন, তোর তো হবেই কষ্ট।’
কথাটা শুনে সে চুপ করে রইল। শেষে বলল, ‘তুমি ত খালি ঘুরে বেড়াও। পাখীর বাচ্চাটাকে বেঁধে রাখলে তার কষ্ট তুমি বুঝবে কি করে? তুমি যদি থাকতে ওই খাঁচার মধ্যে তবেই বুঝতে।’
‘মানুষ আবার খাঁচায় থাকে নাকি?’ আমি বলেছিলাম, ‘তোকে আর বেশী মুরুব্বিগিরি করতে হবে না। তুই -।’
কথাই আর শেষ হোল না হঠাৎ দেখি পাখীর বাচ্চাটা ওর হাত থেকে বেরিয়ে এসেই ছুটতে শুরু করেছে। ভাল করে তখন উড়তে শেখেনি। পিছু নিলাম। কিন্তু দেখতে দেখতে পাখীটা বাড়ীর পেছনে ঝোপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর পাওয়া গেল না তাকে। রেগে মারতে শুরু করেছি দুমদাম। শেষে ওর কান্নায় মা এসে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রাত্রে আব্বার কাছে নালিশ। আব্বা বললেন, ‘তোদের একটা ‘কাকা’ আনিয়ে দেব।’ সেই কাকাতুয়া।
আব্বা চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘এবার আমার কথা শোন।’ কথাটা বলেই আব্বা থামলেন, যেন তাঁর কথাগুলি গুছিয়ে নেবার জন্যেই। ‘দেখ, তুমি হচ্ছ আমাদের বড় ছেলে। বাপ মায়ের মনে বড় ছেলেকে ঘিরে কত আশা-ভরসা থাকে সেটা তোমাকে বলে দেবার দরকার নেই। আজকে আমি শুধু তোমার সঙ্গে দেখা করতেই আসি নি। আমি এসেছি তোমার কাছে শেষ আরজ নিয়ে।’ আব্বা থামলেন। বেদনায় মুখটা কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে তাঁর।
‘তোমার জন্যে তোমার মা পাগলের মতো হয়ে গেছে! ওর মুখে দিনরাত কেবল তোমার কথা। তোমার ভাইবোনদের দিনরাতের জিজ্ঞাসা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আর আমার স্বাস্থ্য তো দেখছোই, এভাবে চললে আর বেশীদিন বাঁচবার ভরসা নেই। সে ক্ষেত্রে কবরের এপারে তোমার সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই। বসে নিশ্চিন্ত সময় কাটানোর সময় নেই। বাবা হয়ে আমি আজ তোমার কাছে আরজ গোজার করেছি : তুমি ফিরে এসো। এ পথ নয়। যাদের সংস্থান আছে, তারাই করবে রাজনীতি। আমার সম্বল চাকরি। আমাদের ওসব পোষায় না। তোমার মা বোনের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।’ আব্বা আবার চুপ করলেন। ধরে আসা গলাটা একটু যেন বিশ্রাম দিলেন, নচেৎ হয়তো বাধ মানবে না।
‘আমি কর্তৃপক্ষের কাছে গেছিলাম। তারা বললেন, তুমি রাজনীতি করবে না লিখে দিলে সহজেই মুক্তি পেতে পার। তোমার কাছে এ আমার অনুরোধ আরজ। আমার শেষ আপীল। তোমার মধ্যে আমাদের জন্যে এক ফোঁটা দরদও যদি থাকে তবে তুমি একথা রাখবে। লিখে দাও তুমি।’ আব্বা চুপ করলেন।
আব্বার কথাগুলি আমার বুকেও তুফান তুলেছে। আব্বার এক একটি শব্দ এক একটি হাতুড়ীর ঘা হয়ে পড়লো আমার বুকে।
চুপ করে রইলাম তবু। আব্বার কথায় জল এসে গেছে মুন্নির চোখে। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল : ‘চল না ভাইয়া, আমাদের সঙ্গে চল না।’
বাচ্চু এখন ঘুরে ঘুরে বোধহয় অফিসটা দেখছিলো। আব্বার কথা সে শোনে নি। কেবল মুন্নির কথাই ওর কানে গিয়েছে। হঠাৎ সে বলে উঠলো : ‘ও মা, আপা কিস্সু জানে না। ভাইয়াকে ধরে রেখেছে, যাবে কি করে!’
ভারী ভাল লাগল বাচ্চুর কথাটা। হৃদয়ের মধ্যে আমার যে অশান্ত ঝড় বইছে, তার মধ্যে আমার বক্তব্য কিভাবে কতখানি পেশ করা যায় তাই আমি ভাবছিলাম। আব্বার কথার জবাবে আমি বলতে যাচ্ছিলাম আমার কথা, আব্বার মতোই আবেগমাখা কণ্ঠে। বাচ্চু যেন আমার হয়েই কথা বললো। বাচ্চুকে কাছে টেনে নিয়ে মুন্নির দিকে চেয়ে বললাম : ‘ওরা আমাকে ধরে রেখেছে। কি করে যাব তোমাদের সঙ্গে।’ কথাটা বললাম, কারণ আব্বাও বুঝবেন আমার বক্তব্য।
আব্বা আমার অপ্রত্যক্ষ উত্তরটা গ্রহণ করলেন।
‘আমি জানি, তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে।’ আব্বা বললেন। ‘তোমার বিদ্যা বুদ্ধি অন্য দশটা ছেলের চাইতে একটু বেশীই। তোমাকে আমি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে আসি নি।’ আব্বা চুপ করলেন। আব্বার চিঠিগুলির কথা আমার মনে পড়ে যায়। তাঁর চিন্তাধারা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে বেরুতো চিঠিগুলি থেকে। আব্বার প্রত্যেকটি কথার জবাবে আমিও চিঠি লিখেছি।
‘যুক্তি দিয়ে তোমাকে বোঝাব সে আশা আমার নেই। আমি কেবল বলতে এসেছি যে তুমি আমাদের বড় ছেলে। আমাদের সমস্ত আশাভরসা তোমাকে নিয়েই। আমাদের সমস্ত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে তোমার খামখেয়ালীতে। তোমার মা বাবাই যদি মরে গেল, তবে কি হবে রাজনীতি দিয়ে। পলিটিক্স তোমাকে ভাত দেবে, না কাপড় দেবে।’
ভাবতে লাগলাম কি বলি। আব্বার জীবনটা কি কষ্টের তা আমি জানি। তাঁর জীবনের ব্যর্থতার বেদনা আমায় ভাবায়। অশেষ দুঃখ ও বেদনার মধ্যেও আব্বা কোনদিন একটা মিথ্যে বলেন নি। অনেক লোভ এবং প্রলোভনের মধ্যেও আব্বা সাত্ত্বিকের জীবনযাপন করেছেন। আব্বাকে চিঠি লিখতে গিয়েও একটি কথা আমার কেবলই মনে হয়েছে : আব্বা ও আমার মধ্যেকার সম্পর্কটা যেন সমস্ত ঝড় ঝঞ্ঝাকে উপেক্ষা করে অটুট থাকে। আব্বাকে কষ্ট দিতে আমার কখনো ইচ্ছে হয় নি। আজও ভাবতে লাগলাম কি জবাব দেওয়া যায় আব্বার কথার। ইচ্ছে হল বলি : পলিটিক্সের জন্যে মানুষ জন্ম
নেয় নি। মানুষের জন্যেই পলিটিক্স। যে রাজনীতি মানুষের জন্য, একান্তভাবে মানুষের জন্য, সেই রাজনীতির একজন ছাত্র হচ্ছি আমি। মানুষের সুখ আর সমৃদ্ধি, শান্তি জীবনের ওপর থেকে বাধার পাষাণ পাথর সরিয়ে দেওয়াই তো মানুষের রাজনীতি। বলতে গেলাম আব্বাকে সাধারণ কথার মধ্য দিয়ে।
‘দয়া করে রাজনীতি আলোচনা করবেন না : তাহোলে কিন্তু আমাকে ‘ইন্টারভিউ’ বন্ধ করে দিতে হবে।’ অফিসারটি বললে। আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
‘এখনি তোমার কোন জবাব আমি চাই নি। আমার
কথাগুলো তুমি একটু অন্তর দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করো। আজই তুমি একটা কথা বলে দেবে সেটা আমি চাই না। সেটা আমি আশা করেও আসিনি। কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তোমার আম্মাকে নিয়ে আসবো। তখন যেন না ক’রো না।’
বুকের মধ্য থেকে একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল যেন। তবুও যে কথাটা বলবার জন্যে মনের মধ্যে তৈরী করে রেখেছি, সেটা বলতে না পারার অতৃপ্তি রয়েই গেল মনের মধ্যে। ভাবলাম ভাল করে ভেবেচিন্তে চিঠি লিখবো আব্বাকে।
‘তোমার পড়াশুনা চলছে কেমন?’ আব্বা শুধালেন। বিষয়ান্তর আমার ভালই লাগলো। উৎসাহের সাথে বললাম : ‘খুব ভাল নয়; সুযোগ সুবিধের বড় অভাব।’
‘তোমার প্রতি সবারই খুব আশা ছিল যে পড়াশুনায় তুমি খুব উন্নতি করবে, সবার মুখ আলো করবে।’
আব্বার মনের গোপনে আমাকে নিয়ে কত আশা আকাক্সক্ষাই না ছিল। আব্বা জানেন, পঁচিশ বছর কলম-পেশা বৃত্তির পর মৃত্যুর সময় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য কোন খড়কুটোই রেখে যেতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে আমিই ছিলাম আব্বার ভরসার ষষ্ঠি। তাঁর সন্তান-সন্ততিদের জন্য জীবন্ত ওয়াসিয়ৎনামা।
জবাব দিলাম না কোন। ‘888sport free bet loginের দরকার আছে?’ আব্বা শুধালেন।
‘না’, বললাম, ‘আপনি যা পাঠিয়েছেন তাতেই হবে।’
বাচ্চু এতক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আব্বার কথাগুলি গিলছিল। কি বুঝছিল, তা সেই জানে। হঠাৎ তার দিকে চাইতেই ভারী লজ্জা পেয়ে গেল সে।
আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম; ‘বাচ্চুকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন তো আব্বা?’
আব্বা বললেন : ‘হ্যাঁ।’
‘কোন স্কুল?’
‘বাচ্চু, ভাইয়াকে তোমার স্কুলের নাম বলো না।’
‘আমি বলতে পারি না’, বাচ্চু বলল।
মুন্নিসহ আমি হেসে উঠলাম ওর কথায়।
‘ওমা কি বোকা ছেলে তুমি, বাচ্চু, নিজের স্কুলের নামটাও জান না।’
লজ্জা পেয়ে বলল, ‘জানি।’ বোকা আখ্যা নিতে সে রাজী নয়। বলল, ‘আমি জানি, বলবো না, না।’
আমি হেসে উঠলাম। এবার আব্বা একটুখানি হাসলেন। অবস্থা অনেকখানি হালকা হয়ে গেল।
আমার চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়ালো মুন্নি। আমার দিকে এক নজর চেয়েছিল। মুখটা মলিন ব্যথাভরা। ওর দিকে তাকালেই আমার নিজের কথা মনে পড়ে যায়। কৈশোরের দিনগুলি আর আসবে না।
‘কি, কথা বলছিস না যে বড়ো?’ আমাদের পুরাতন ‘তুই’ বলা আবার এসে গিয়েছে।
‘কি বলবো?’
বুঝতে পারি, কথা বলার মত ভাষা আজ ওর নেই। অনেকদিন পর প্রথম দেখার প্রাথমিক সংকোচ কেটে গিয়েছে। কেবল ওর বড় বড় নীল চোখ দুটি বিস্ময়ে ব্যথায় তাকিয়ে আছে। ও যেন কত কথাই ভাবছে। মানুষের জীবনে সে কথার অনেক দাম আছে।
আব্বা ইতিমধ্যেই জেল অফিসারের সঙ্গে আমাদের খাওয়া পরা, পড়াশুনার সুযোগ সুবিধা নিয়ে আলাপ জুড়েছেন। হয়তো আমাদের ছেলেমানুষি কথা বলার সুযোগ দেবার জন্যেই। নিরিবিলি পেয়ে আমি ওর কাছ থেকে খবর নিতে শুরু করলাম।
‘আমার জন্যে তোর মন কাঁদে না?’
মুন্নি একটু লজ্জা পেল। প্রশ্নটা ঠিক এভাবে করা উচিৎ হয়নি। বাচ্চু বললে, ‘জানো ভাইয়া, মুন্নি আপা খালি তোমার জন্যে কাঁদে। কান্না ছাড়া আর কিস্সু জানে না। ও যতো কাঁদে আম্মা ওকে আরও বেশী ভালবাসে। আমি কাঁদি না কি না, তাই আম্মা আমাকে -।’
মুন্নি বাধা দিয়ে বলল, ‘বাচ্চু। অতটুকু ছেলে, এতকথা শিখেছে ভাইয়া। খালি বুড়োমী করবে।’
বাচ্চু প্রতিবাদ করলো : ‘বারে, আমার কি দোষ? তুমি কাঁদ না? আল্লার কসম ভাইয়া -’
মুন্নিকে লজ্জার হাত থেকে রেহাই দেবার জন্যে জিজ্ঞাসা করলাম – ‘আচ্ছা বাচ্চু, তুমি কাঁদ না যে!’
‘আমি যে ব্যাটা ছেলে!’
ওর কথার ধরন দেখে এবার মুন্নিও না হেসে পারল না।
‘তুমি কেঁদ না কখনো। কাঁদলে মনটা ছোট হয়ে যায়। যারা কাঁদে তারা বড় হতে পারে না।’
বাচ্চু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল : ‘আমি জানি।’
আমি হেসে ওকে বললাম, ‘বাচ্চু, তুমি আব্বার কাছে যাও তো।’
কিছু বুঝতে না পেরে একবার মুন্নির দিকে তাকিয়ে আব্বার চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ও চলে গেলে আমি মুন্নির হাত ধরে বললাম, ‘কাঁদিস কেন মুন্নি?’ মুন্নি হঠাৎ সত্যি কেঁদে ফেলল।
‘আহা আবার কান্না’, আমি বললাম, ‘ছি বোন কাঁদিস না।’
‘ভাইয়া আমার বদদোয়ার জন্যেই তুমি জেলে গিয়েছ।’ মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে বললে।
‘তোমার বদদোয়ায় জন্যে?’ অবাক মানি।
‘সেই যে তুমি আমার চুলের ঝুঁটি ধরে মেরেছিলে তোমার বন্ধুকে বাড়ী নেই বলে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে – তখন তো আমি আল্লার কাছে মোনাজাত করেছিলাম তোমার যেন জেল হয়।’
আমার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ে।
অতীতের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। বাড়ীতে আমাদের গৃহবিবাদের মধুর 888sport sign up bonusগুলি মনে করবার চেষ্টা করি।
আমি গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে পুরোপুরি অংশ নিচ্ছি। বাড়ীতে আমার ছাত্রবন্ধুরা আসতো প্রায়। এটা কেউ পছন্দ করতেন না। সাদা পোষাকের লোক এসে বাড়ীর লোকদের মনে আমার সম্পর্কে সন্দেহজনক সব কথা বলে যেত। তাই এক একবার আমাকে নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হতো বাড়ীতে। তিরস্কার শুনতে হতো, দেখানো হতো ভয়; – ‘তোর তো জেল হবে’, ‘কোনদিন এসে ধরে নিয়ে যাবে পুলিসে’, – এ সব কথা স্বভাবতই বাড়ীর সবার সামনেই হতো। ছোটরাও বাদ যেত না। মুন্নি জিজ্ঞেস করতো ‘আচ্ছা ভাইয়া তোমার জেল হবে কেন? তুমি চুরি কর? চোরেরাই তো জেলে যায়।’ আমি বলতাম, ‘আজকাল যারা চোর ধরে তারাই যায় জেলে।’ কিন্তু আমি জানতাম না কবে আমার জন্যে আল্লার কাছে মোনাজাত করেছিল। আর সে আজও মনে রেখে দিয়েছে। সেটা মনে করে ওর শিশু মনে ব্যথার অন্ত নেই, চোখ থেকে বর্ষণের অন্ত নেই।
ওর দিকে চেয়ে দেখলাম। চোখের জল ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কান্নার ভাব মুখময়। আব্বাও চেয়ে আছেন মুন্নির দিকে। বললেন ; ‘মুন্নি মা, কেঁদ না। ছি এত লোকের সামনে বুঝি কাঁদে?’
তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ভাবখানা এমনি যেন বলতে চান কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে পাথর ছেলেটার মনে যদি একটু মায়ামমতার সঞ্চার করতে পারে তো মন্দ কি?
আমি ওকে প্রবোধ দিতে গিয়ে বলি, ‘তোমার মোনাজাতের জন্যেই আমি জেলে গিয়েছি, একথা বলল কে?’
‘আমি জানি’, মুন্নি বললে, ‘আম্মা বলেন, ছোটবেলার দোয়া আল্লা শোনেন।’ আমি ওকে কি করে বোঝাই যে ওর মোনাজাতের কোন হাতই নেই এ ব্যাপারে।
ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে গেছে। অফিসারটি তাকালো ঘড়ির দিকে। আব্বাও তাকালেন।
‘আর তো সময় নেই,’ আব্বা বললেন।
‘হ্যাঁ’, অফিসারটি সায় দিল।
বুকের ভেতরটা আমার ধক্ করে উঠলো। বেশ তো ছিলাম, বেশ তো লাগছিল। মুন্নি আব্বার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আব্বা পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর চোখ মুছে দিলেন।
বললেন, ‘পরের বারে তোমার আম্মাকে নিয়ে আসবো। তোমাদের কদ্দিন অন্তর দেখা করবার অনুমতি দেয়?’
মুন্নির চেহারা অনেকক্ষণ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। বাচ্চু আমার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আব্বাকে বললাম : ‘আম্মাকে আমার সালাম বলবেন। বলবেন আমি ভাল আছি; যেন আমার জন্যে চিন্তা না করেন।’
‘ভাল যা আছ তাতো দেখতেই পাচ্ছি। আমি ভাবছি তোমার এই চেহারা দেখলে তোমার মা শেষে কি-ই না করে বসেন।’
‘আবার আসার সময় আমার বাহার নানীকে নিয়ে আসবেন।’
অফিসারটি আবার ঘড়ির দিকে চাইল।
বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে, সাক্ষাৎ শেষ। কতদিন পরে দেখা! আর মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। হঠাৎ মুখ দিয়ে কথা ফোটে না। আত্মসংবরণ করতেই পাঁচ মিনিট যায় কেটে। বিশ মিনিটের সাক্ষাৎ করে এখনি আবার ফিরে যেতে হবে, ‘নতুন বিশে।’
‘সায়েব এবার তো উঠতে হবে।’ অফিসার তাগিদ দিলে, ‘আরো ক’জনার ইন্টারভিউ করাতে হবে। তারা তো এসেই গেল।’
আমি আব্বার দিকে তাকালাম।
মুন্নি আর বাচ্চু আমার দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মুন্নির পিঠে হাত রেখে বললাম, ‘কাঁদিস না বোন। চিরদিন তো আর এরা ধরে রাখতে পারবে না।’ আব্বা উঠলেন। এগিয়ে এলেন আমার কাছে। মাথা নীচু করে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম তাঁকে। উঠে দাঁড়াতেই দেখি আব্বার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে ফোঁটা ফোঁটা পানি।
আব্বা বাচ্চু আর মুন্নির হাত ধরলেন।
বাচ্চু আব্বার আচ্কানের কোণা ধরে টানতে টানতে বলতে লাগলো, ‘আমি যাব না। আমি ভাইয়ার সঙ্গে থাকবো।’
আব্বা ওর কথায় কান না দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তিন তিনটে বছর কেটে গেল, তুমি আমাদের মধ্যে নেই। ওরা বলছে রাজনীতি করবে না বললেই ওরা ছেড়ে দেবে। তোমার একগুঁয়েমিই কি বড় হবে? বাবা মায়ের প্রাণের কষ্ট একটুও বুঝবে না? যে মা দশ মাস তোমাকে পেটে ধরেছেন, কেঁদে কেঁদে তার চোখ অন্ধ হয়ে গেল – তার দিকে চাইবে না তুমি?’ মুন্নি নীরবে কাঁদছে।
বাচ্চু বলছে : ‘আব্বা আমি যাব না; আমি ভাইয়ার সঙ্গে থাকবো।’
আব্বা আবার বলতে লাগলেন, ‘আজ আর সময় নেই, অন্যদিন যখন আসবো, তখন যেন না কোরো না।’
আব্বা আমাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, ‘আল্লা আমাদের জন্যে তোমার প্রাণে একটু রহম দিন।’
অফিসারটি উঠে দাঁড়িয়েছে, বললে, ‘মৌলবী সাহেব, এবার তো -’
আব্বা আর একবার আমার দিকে চেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। আব্বা হাত দিয়ে ধরেছেন মুন্নি ও বাচ্চুকে।
বাচ্চু তখনও কাঁদছে, ‘আব্বা আমি যাব না। যাব না; ভাইয়ার সঙ্গে -’
মুন্নি কেঁদে উঠলো, ‘ভাইয়া আমি কিন্তু সত্যি তোমার জেল চাই নি। কেবল রাগের মাথায় বলেছিলাম।’
আব্বা ওদের কথায় কান দিলেন না। দু’হাতে দুজনকে ধরে এগিয়ে গেলেন। তারপর আমার দৃষ্টির সামনেই জেলখানার বড় গেট খুললো! ওরা তখনো কাঁদছে, ‘আব্বা আমি যাব না; ভাইয়ার সঙ্গে থাকবো।’ রিকশাটা কখন অদৃশ্য হয়ে গেল টেরও পাইনি। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল কান্না। ওদের দিকে চেয়ে চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো – আব্বা তুমি আমায় ভুল বুঝ না। আম্মা, মুন্নি, বাচ্চু তোমরা আমায় ভুল বুঝ না। তোমরা প্রিয়জন। প্রাণের চেয়ে প্রিয়, প্রাণ দিয়ে ভালবাসি তোমাদের। ইচ্ছে হল হৃদয়ের পুঞ্জীভূত সমস্ত আবেগ দিয়ে বলি : মুন্নি, বাচ্চু তোমাদের ভালবাসি। মুন্নি কেঁদ না। কিন্তু বলতে পারলাম না কিছুই। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম আমাদের কুঠুরিগুলিতে। আমাকে ঘিরে দাঁড়াল আমার বন্ধুরা, অনেক অনেক বন্ধু তারা। তাদের দিকে চেয়ে আমার মনে হল, আমি একা নই। একা নয় আব্বা ও আম্মারা। বাচ্চু মুন্নিরা একা নয়। অনেক আব্বা অনেক আম্মা, অনেক বাচ্চু। তাদের প্রাণভাঙা কান্নায় আল্লার আসন যদি নাও টলে ওঠে, তবু তাদের শোক থেকে যে বহ্নির উদ্গিরণ হবে তা গ্রাস করবে এই বন্দী দুনিয়াকে। তারপর সেই ধ্বংস ও প্লাবনশেষে আমরা আবার মিলিত হবো। মিলিত হবে আব্বা, আম্মা, বাচ্চু, মুন্নি, আমরা সবাই আর সেই মিলনের আনন্দে, সেই সত্যিকার মিলনের পরম মুহূর্তে আমাদের সবার মুখেই ফুটে উঠবে হাসির রোশনাই। সেদিন আমরা প্রাণভরে হাসবো।
মুন্নি, সেদিন আমি হাসবো। বাচ্চু, সেদিন তুমি হাসবে।
শহীদ সাবের
জন্ম ১৯৩০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওয়ের, বর্তমান ইসলামাবাদ ইউনিয়ন, পাহাশিয়াখালী সিকদারপাড়ায়। কথা888sport live chatী। তিনি ছিলেন ভাষাসংগ্রামী। ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) বিএ পাশ করেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকে ছিলেন শিক্ষক। পরবর্তীকালে সাংবাদিকতায় থিতু হন। বাংলা একাডেমি 888sport app download bd, কক্সবাজার সমিতির কক্সবাজার পদক, কক্সবাজার 888sport live football একাডেমি 888sport app download bd, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-নগদের ভাষাসৈনিক সম্মাননাসহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে বংশাল রোডস্থ দৈনিক সংবাদ কার্যালয়ে। সেই আগুনে পুড়ে শহিদ হন সংবাদ অফিসে ঘুমিয়ে থাকা শহীদ সাবের।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.