হায়াত পত্রখানা পকেট থেকে বের করে বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, চিঠিটি কে লিখেছে?

হায়াত ট্রেনে-ভ্যানে-হেঁটে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে 888sport app থেকে বাড়ি ফিরেছে। তার মা পাখা হাতে বাতাস করছে, অন্য হাতে শরবতের গ্লাস। কোথায় শরবত খেয়ে দেহমন ঠান্ডা করে ঠান্ডা মাথায় কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবে, তা না করে মাস্টারের ছেলে মাস্টারের মতো আচরণ করছে।

তহুরা বেগম বিরক্ত হয়ে বলল, তোর বাবায় লিখেছে। ক্যান, কী হইছে?

হায়াত এবার অবাক হয়ে বলল, এটা কেমন কথা, শিক্ষকের কেন এত ভুল হবে? এক চিঠিতে পাঁচটা বানান ভুল, সাধু-চলিত ভাষার মিশ্রণ। ক্ষমার অযোগ্য। আমি একজন স্বনামধন্য প্রুফরিডার, আর আমার বাবার এমন ভুল! তুমি বলো মা, এ কি মেনে নেওয়া যায়?

তহুরা উদ্বেগের স্বরে বলল, আহা, মাথা গরম করিস না। তোর বাবা আবার করলো কী? শরবতটা খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর। তারপর কথা বল।

হায়াত রাগের সঙ্গে মায়ের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে এক চুমুকে শরবত শেষ করলো। এমন সময় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অংকের মাস্টার হায়াতের বাবা মকবুলের গলাখাঁকারি শোনা গেল। সঙ্গে উচ্চকণ্ঠের জিজ্ঞাসা, হায়াত কী আইছে?

ঠান্ডা শরবতের গুণে নাকি মকবুল মাস্টারের উচ্চকণ্ঠের আওয়াজে হায়াতের মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে হায়াত নম্রস্বরে বলল, আব্বা, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়া আলাইকুম আসসালাম। সাইকেলটি একপাশে ঠেস দিয়ে রেখে বললেন, তোমার জন্য বাজারে গেছিলাম। শহরে একা থাকো, কী খাও না খাও, যা খাও সব তো ভেজাল। তোমার শরীর-স্বাস্থ্য দেখে আন্দাজ করছি।

হায়াত পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা চেপে ধরলো। বের যে করবে সে সাহস হলো না।

আপনি অসুস্থ জেনে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ফেলে চলে এলাম। এখন দেখছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ।

তুমি কাজের মানুষ। কাজের জন্য বাবা-মা, বাড়িঘর, গ্রাম সব ভুলতে বসেছো। বাড়ি আসো না, বাবা-মায়ের মন যে তোমার জন্য কাঁদে সেও তুমি বোঝো না। মিথ্যা না লিখে উপায় কী?

খোলা আঙিনায় গাছের ছায়ায় বসেছে বাবা-ছেলে। হায়াত পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাবার চিঠি আঁকড়ে ধরে। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছে। বাবা অপ্রস্তুত হবেন, রেগে যেতে পারেন।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুই এতো মনমরা ক্যান? কী হইছে খুলে বল। তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না।

হায়াতের মাথার ভেতর বানান ভুলের চক্র ঘুরছে। এত বানান ভুল করো কেন? তুমি না শিক্ষক? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁর আনন্দিত মুখ দেখে হায়াতের খুব মায়া হলো।

বাবা বললেন, তোর সুখ মানে আমাদের সুখ। 888sport appয় থাকিস, তোর কোনো পছন্দ থাকলে আমাদের বলতে পারিস।

হায়াত হকচকিয়ে গেল, পছন্দ! কিসের পছন্দ? কী ভেবে মৃদু হেসে বলল, যাঁরা শুদ্ধ বানান শুদ্ধ বাক্য বাংলা ভাষায় লেখেন তাঁদের পছন্দ করি।

হায়াত আগে এমন ছিল না। 888sport appয় চাকরি পাওয়ার পর থেকে ওর আচরণে এমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তা ক্রমাগত বাড়ছে। বিয়ে না দিলে এ-অসুখ থেকে মুক্তি নেই।

হায়াতের কথা শুনে মকবুল মাস্টারের আক্কেলগুড়ুম। হায়াত সুস্থ আছে তো? মা বাবার চেয়ার ধরে দাঁড়িয়েছিল। হায়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবা, তোমার বিয়ের জন্য আমরা কন্যা দেখেছি। মেয়ে এসএসসি পাশ করেছে। দেখতে ভালো। খুবই লক্ষ্মী মেয়ে, নামাজি, সংসারী। তুমিও দেখো। পছন্দ না হওয়ার মতো মেয়ে নয়। আমার আর তোমার বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।

হায়াতকে নিয়ে বাবা-মা পরদিন পাত্রী দেখতে রওনা হলেন। বিয়ের জন্য হায়াতের এটা প্রথম পাত্রী দেখা। সে নার্ভাস বোধ করছে। পাত্রীর দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে। মাঝে মাঝে পানি খাচ্ছে। পাত্রী আড়চোখে পাত্রকে বারকয়েক দেখে নিয়েছে। হায়াত নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে তাকাতে তার ভারি লজ্জা। পাত্রীর মুখের দিকে না তাকিয়ে যেটুকু দেখা যায়, পাত্রীর   শাড়ি, হাতের চুড়ি, পায়ের স্যান্ডেল এসব দেখেছে। পাত্রীর মা বললেন, ভাইসাহেব, চলেন আমরা পাশের ঘরে বসি। ওরা দুজন কথা বলুক।

ঘর ছেড়ে সকলে চলে গেল। পাত্র তবু নতমুখে পাত্রীর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পাত্রী মৃদু হেসে বলল, ঘরে কেউ নেই। এখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনি পুরুষ মানুষ, এত লজ্জা কেন?

এ-কথায় হায়াতের মানসম্মান ডুবতে বসেছে। আত্মরক্ষার জন্য তার পৌরুষ জেগে উঠল। সে মাথা তুলে পাত্রীর মুখের দিকে তাকাল। শ্যামলবরণ ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী একটি মেয়ে কী ব্যাকুল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জলে ভাসা কালো দীঘল দুটি চোখ, তার স্নিগ্ধ জলে যেন জীবনের সব প্রশান্তি লুকিয়ে আছে। কোনো লেখকের প্রুফ দেখতে গিয়ে এই বাক্যটি তার মনে ধরেছে। আজ সে সেই বর্ণনার ছবি দেখতে পেল।

পাত্রী করুণ কণ্ঠে বলল, আমি কালো। কালো মেয়েদের কেউ পছন্দ করে না। আপনারও পছন্দ হয়নি, তাই না?

পাত্র এর কোনো উত্তর দিলো না। পকেট থেকে কাগজ ও বলপেন বের করে পাত্রীর হাতে দিয়ে বলল, আপনি এসএসসি পাশ করেছেন?

পাত্রী বলল, জি।

আমি যা বলবো আপনি তা লিখবেন। স্কুলে শ্রুতিলিখন লিখেছেন?

পাত্রী মাথা নেড়ে জানাল শ্রুতিলিখন সে জানে।

পাত্র বলল, ভালো করে শুনে তারপর লিখবেন। সময় দশ মিনিট। দুবার বলবো। বানান-বাক্য নির্ভুল হওয়া চাই। রেডি?

পাত্রী ভয় পেল। এর আগে পাত্রী দেখা পরীক্ষায় চারবার বসেছে। এমন পরীক্ষা দিতে হয়নি। এসএসসি পরীক্ষায় সে একবারে পাশ করেছে। এসএসসি পরীক্ষায় সিলেবাস আছে। বিয়ে পরীক্ষায় কোনো সিলেবাস নেই। ভীতকণ্ঠে বলল, বলেন।

পাত্র শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ পাত্র দ্বিতীয়বার বলতে যাবে, পাত্রী মৃদুকণ্ঠে বলল, আমার লেখা হয়ে গেছে। লেখার কাগজটি পাত্রের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

হায়াত লেখার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল, একেই বোধহয় বলে মুক্তাক্ষর! কী সুন্দর লেখা! স্পষ্ট গোটা গোটা ছাপার অক্ষরের মতো নিখুঁত। কোনো বানান ভুল নেই,

দাড়ি-কমা সব নির্ভুল। পাত্রী গভীর উদ্বেগে বেদনার চোখে হায়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে পাশ করবে তো?

বিস্ময় কাটতে হায়াতের কয়েক মুহূর্ত সময় নিল, তারপর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, হয়েছে। অতি নিখুঁত। আমি মুগ্ধ!

পাশের ঘর থেকে উভয় পক্ষের অভিভাবক ছুটে এলেন। পাত্রের বাবা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? অমন চিৎকার করে উঠলি কেন?

পাত্র লজ্জায় নতমুখ হয়ে মৃদু স্বরে বলল, আব্বা, আমার পছন্দ হয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ। সেই রাতে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পাঁচ দিন পর হবে। হায়াতের ছুটি পনেরো দিন। এর ভেতর বিয়ে সম্পন্ন করে তাকে 888sport appয় ফিরে যেতে হবে। নানা প্রকাশনী থেকে এখনই ফোন আসা শুরু হয়ে গেছে।

বাসরঘরে বিস্ময় নিয়ে পাত্রী রিজিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি সেদিন অমন চিৎকার করে উঠলেন কেন?

আমি যাকে খুঁজে ফিরেছি আপনি সেই। আপনি এত সুন্দর, মুক্তাক্ষরের মতো আপনার হাতের লেখা! সেই আনন্দে।

লোকটি কী সুন্দর করে কথা বলছে। সে অতি সাধারণ একটি কালো মেয়ে। সে সুন্দর – এ-কথা অন্য কেউ বললে উপহাস মনে করত। আজ যখন তার বর বলল, মনে হলো, লোকটি মুখে নয়, অন্তর থেকে কথা বলছে। সোজা-সরল মানুষ। রিজিয়ার চোখ জলে ভিজে ওঠে।

চোখ মুছে রিজিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, বউকে স্বামী কি আপনি করে বলে? আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। না বললে আমার গুনাহ হবে, লোকজন হাসাহাসি করবে। আমার খুব কষ্ট হবে।

হায়াত চোখ নামিয়ে নিল। মৃদুস্বরে বলল, নতুন তো, আপনার সঙ্গে দেখা-পরিচয় ছিল না। এখন বলতে তাই লজ্জা লাগছে। দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

এমন সময় হায়াতের সেলফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে হায়াত আনন্দে কাঁপতে লাগলো, তার কথা আটকে যাচ্ছে।

জি স্যার, ঠিকই শুনেছেন। হঠাৎ করে হয়ে গেল। বাবা মরণাপন্ন শুনে ছুটে এলাম, এসে দেখি আমার বিয়ে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আপনারটা ফাইনাল করে রেখে এসেছি। এক ফর্মা বাকি। সাতদিন পর 888sport appয় ফিরছি। আপনার মেহেরবানি স্যার। হায়াত কেঁদে ফেলল।

রিজিয়া ভয়ে হায়াতকে জড়িয়ে ধরল। আঁচলে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, কী হয়েছে, কোনো দুঃসংবাদ? আপনি কাঁদবেন না। আপনার কান্না দেখে আমার কান্না আসছে। রিজিয়া স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল।

রিজিয়ার চোখের জলে হায়াতের পাঞ্জাবি ভিজে তার হৃদয় স্পর্শ করেছে। পরম মমতায় সে রিজিয়ার মুখখানি তুলে তার চোখের জল মুছিয়ে দিলো। মৃদু হেসে বলল, পাগলি আমার, আমি কাঁদছি খুশিতে। কে ফোন করেছিল জানো?

না।

হুমায়ূন স্যার। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। আমার বিয়ের খবর শুনে ফোন দিয়েছেন। তাঁর কাজ আমার হাতে। আমি না ফেরা পর্যন্ত স্যারের বই বের হবে না। পাঁচ দিন পর 888sport appয় ফিরে স্যারের বইয়ের কাজ ধরব। স্যার বললেন, বিশ দিন তোমার হানিমুন ছুটি। তারপর তুমি 888sport appয় আসবে। কত বড় দিলের মানুষ ভেবে দেখো। সেই খুশিতে চোখে পানি এলো।

ও আল্লাহ, হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে! আমি স্যারের মস্ত ভক্ত। কী যে ভালো লেখেন! স্যারের বই পড়ি, নায়ক-নায়িকার দুঃখে আমার চোখের পানিতে বালিশ ভেজে। মন খারাপ হয়। আবার পড়তে ইচ্ছে করে। এত বড়ো লেখক আপনারে ফোন করেছেন! আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে।

রিজিয়া হঠাৎ উপুড় হয়ে হায়াতকে কদমবুসি করল।

হায়াত খুশির আনন্দে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ সালাম কেন?

হুমায়ূন স্যার আপনারে ফোন করেছেন। তিনি তো আর যারে-তারে ফোন করতে পারেন না, সম্মানিত মানুষদের ফোন করেন। আমার নামাজ-রোজা আল্লাহ সব কবুল করেছেন। না হলে আপনার মতো সম্মানিত মানুষের সঙ্গে আমার মতো নগণ্য একটি মেয়ের বিবাহ … রিজিয়া লজ্জায় বাকি কথা শেষ করতে পারল না।

হায়াত ফুলশয্যার খাটে আয়েশ করে বসল। রিজিয়ার হাত ধরে তার পাশে বসালো। রিজিয়ার শরীরে অনাস্বাদিত রোমাঞ্চে কাঁপন জাগল। হার্টবিট দ্রুত হলো। তার বলতে লজ্জা লাগছে, লাইট বন্ধ করে দিই।

হায়াত রিজিয়ার হাত ধরে বলল, তুমি যে হুমায়ূন স্যারের বই পড়ে এত আনন্দ পাও, এই বইটি কীভাবে পাঠকের হাতে আসে তা জানো?

রিজিয়া দুপাশে মাথা নাড়িয়ে জানাল, না।

হুমায়ূন স্যার, মিলন স্যার, ইউনিভার্সিটির বড় বড় অধ্যাপক, লেখক বই লিখে প্রকাশের জন্য নামিদামি প্রকাশকদের হাতে দেন। স্যারদের বই কম্পিউটারে টাইপ করে, তারপর আমার মতো প্রুফরিডারদের হাত তুলে দেওয়া হয়। কম্পোজ ঠিক হয়েছে কি না, কোনো অংশ বাদ গেছে কি না, বানান, টাইপের ফন্ট ঠিক আছে কি না লেখকের পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। সব সংশোধন করে বইটিকে নিখুঁত করে পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি।

রিজিয়া হাই তুলছে। তার ঘুম পাচ্ছে।

ভুল কম্পোজ করলে পাণ্ডুলিপি দেখে সেটা সংশোধন করা সহজ। অনেক সময় লেখকও ভুল করেন। সেই ভুলকে প্রিন্টিং মিস্টেক বলে চালিয়ে দেয়। আমি হায়াত মাহমুদ, বাংলাবাজারের সেরা প্রুফরিডার, বড় বড় সকল প্রকাশক আমাকে নিয়ে টানাটানি করে। আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। হায়াত রিজিয়ার দিকে ঝুঁকে গোপন কথা বলার মতো ফিসফিস করে বলল, হুমায়ূন স্যার, মিলন স্যার – তাঁদের ভুল আমি শুদ্ধ করে দিই। তাঁরা কোনোদিন জানতেও পারেন না। আমি চারটি ডিকশনারি না দেখে কারো ভুল বানান, বাক্য গঠন শুদ্ধ করি না।

যাকে উদ্দেশ করে এত কথা, রিজিয়া বেগম তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নাক-ডাকা শোনা যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে এক মাস দ্রুত শেষ হয়ে এলো। অনেক লেখক হায়াতকে ছাড়া অন্য প্রুফরিডারকে দিয়ে কাজ করান না। অনেক কাজ জমে আছে। বইমেলার সময় এসে যাচ্ছে। হাতে মাত্র তিন মাস সময়। প্রকাশকরা প্রায় প্রতিদিন সেলফোনে ডাকাডাকি করছেন। এবার 888sport appয় ফিরতে হবে।

এক মাস আগেও রিজিয়া বেগমকে সে চিনত না। এখন তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। অন্তরের কোথায় যেন বিপন্ন দুঃখ তাকে সজোরে পিছু টেনে ধরেছে। এই মেয়েটির প্রতি এত মায়া কোথা থেকে এলো? সাত দিন ধরে রিজিয়া বেগম বিদায়কান্না শুরু করেছে। সে একা থাকতে পারবে না। তাকেও সঙ্গে করে 888sport appয় নিয়ে যেতে হবে।

বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। রিজিয়া 888sport appয় গেলে বাবা-মাকে দেখবে কে? হায়াত বরং মাঝে মাঝে বাড়ি আসবে। বাবা-মা, রিজিয়া সকলের সঙ্গে দেখা হবে।

চার মাসেও হায়াত গ্রামের বাড়ি আসতে পারল না। বাবা ফোন করে, বউ ফোন করে, সবাইকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে রাখে – সামনের মাসে দুদিনের জন্য হলেও বাড়ি আসবে। বউ অভিমানে কেঁদে কেঁদে বলে, তুমি বাবা হচ্ছো – এ-খবর শুনেও তোমার বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে না? তুমি এত নিষ্ঠুর কেন?

হায়াত প্রতিবাদ করে না। বলতে পারে না, তাদের আগত সন্তানকে স্বাগত জানাতে প্রতি মাসে টাকা বাঁচিয়ে খেলনা, জামা কিনে সকলের অলক্ষ্যে তার বাক্সে লুকিয়ে রাখে। রাতে ঘুমানোর আগে রিজিয়ার কথা, তাদের সন্তানের কথা মনে পড়ে। চোখে জল জমে। রুমমেটের চোখে যেন ধরা পড়ে না যায়, চোখ লুকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। তার কেনা জামা-জুতা পরে, খেলনা নিয়ে বাচ্চাটা যখন খেলবে, সেই দৃশ্য ভেবে তার সব দুঃখ দূর হয়ে যায়। অন্তর আনন্দে হেসে ওঠে।

বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে বাবার ফোন এলো, শ্বশুরের ফোন এলো। শ্বশুর এর আগে তাকে কখনো ফোন করেননি। রিজিয়ার শরীর ভালো না। সে এখন হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা শুরু করতে স্বামীর অনুমতি লাগবে। সকল কর্ম ফেলিয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিজিয়ার জীবন বাঁচাইতে চলিয়া আসো।

ফোনে হুমায়ূন স্যারকে পাওয়া গেল না। মিলন স্যার সব শুনে বললেন, আপনি এখনই চলে যান। আমি প্রকাশকদের আপনার অবস্থা জানাবো। এই বিপদে টাকা দরকার হতে পারে। লজ্জা না করে আমাকে জানাবেন।

রিজিয়ার ছ-মাস চলছে। পুকুরঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে। উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রিজিয়ার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। হায়াত বাসায় না গিয়ে উপজেলা হাসপাতালে গেল। শ^শুরকে পাওয়া গেল। তিনি রাগের সঙ্গে জানালেন, ডাক্তার বলেছে জেলা শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। রোগীর পাশে শাশুড়ি বসেছিলেন। হায়াতকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বেড ছেড়ে চলে গেলেন। তার বাবা-মাকে কোথাও দেখা গেল না।

হায়াত রোগীর বেডের পাশে বসে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকল, রিজিয়া … রিজিয়া …। রিজিয়া কোনো সাড়া দিলো না। রিজিয়ার হাত ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। আমার জন্য তোমার আজ এই অবস্থা।

হায়াতের অবাধ্য চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় রিজিয়ার হাতে পড়তে লাগল। রিজিয়ার দু-চোখ জলে ভরা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কোনো কথা বলছে না। চোখের দৃষ্টি অন্ধের মতো। ভিন্ন দিকে স্থির, যেন সে হায়াতকে দেখতে পাচ্ছে না।

জেলা হাসপাতালে সাত দিন চিকিৎসার পর পেটের বাচ্চাসহ রিজিয়া মারা গেল। হায়াত পাশে বসে ছিল। এ কদিন রিজিয়া সারাক্ষণ নীরবে কেঁদেছে। হায়াত তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেছে, এখন কেমন আছো? সব ঠিক হয়ে যাবে। রিজিয়া কোনো উত্তর দেয়নি। মনে হয়েছে, কথা বলতে পারে না। মৃত্যুর এক দিন আগে রিজিয়া হঠাৎ কথা বলল, আপনে বড় ভালো মানুষ। আপনার কোনো দোষ নাই। সবই আল্লার হুকুম।

হায়াত তার গ্রামের বাড়ি গেল না। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করল না। জেলা শহর থেকে সোজা 888sport appয় ফিরে গেল। আগের মতো কাজে মন দিতে পারে না। তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা গরম করে। একদিন হুমায়ূন স্যারের অন্যতম প্রধান প্রকাশক হায়াতকে অফিসে ডেকে পাঠালেন, বললেন, হুমায়ূন স্যার আপনাকে স্নেহ করেন। তাঁর বইয়ের প্রুফ আপনে দেখলে স্যার নিশ্চিত বোধ করেন। স্যার অভিযোগ করেছেন, আপনি নাকি  তাঁর পাণ্ডুলিপি ফলো করেন না? আপনার মতো বানান পরিবর্তন করেন। কখনো কখনো তাঁর বাক্যবিন্যাসও পরিবর্তন করেন!

হায়াত নম্রস্বরে বলল, স্যার, ভুল সকলের জন্য ভুল। শুদ্ধ করা আমার কাজ।

হুমায়ূন স্যারের পাণ্ডুলিপিতে যা থাকবে তা-ই ফলো করবেন। আপনাকে পাণ্ডিত্য ফলাতে হবে না।

হায়াত বলল, স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভুল বানান লিখেছেন। হুমায়ূন স্যারকে এত লেখা লিখতে হয় যে, উনারও ভুল হতে পারে। আমাদের কাজ শুদ্ধ করা। আমি না দেখার ভান করতে পারি না।

মালিক রেগে বলল, আপনি মহাপণ্ডিত, লেখকের চেয়ে বড় লেখক। জনপ্রিয় ও নামী লেখকদের কাছে আপনার চাহিদা থাকায় নিজেকে মহাজ্ঞানী মনে করেন। হুমায়ূন স্যারের ভুল ধরেন। আপনাকে আমার দরকার নাই।

ধীরে ধীরে হায়াতের কাজের পরিধি কমে এলো। বেস্টসেলার লেখকদের সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল। লেখকরা বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রুফরিডাররা লেখক নন, কিন্তু শুদ্ধ বানানরীতি অনুসরণ করে ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে শুদ্ধ বই লাখ লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। যদি একটি ভুল বানান, ভুল বাক্য প্রুফরিডার না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান, লাখ লাখ পাঠক অশুদ্ধকে শুদ্ধ মনে করবে। রবীন্দ্রনাথের বই হলেও হায়াত ভুল শুদ্ধ করবে। সে নির্বিকার থাকতে পারে না। প্রুফরিডার হচ্ছে বাংলা 888sport live footballের প্রহরী।

হায়াতের এখন আগের মতো কাজের তাড়া নেই। চারদিকে তাকানোর অফুরন্ত অবসর। দোকানগুলির সামনে দিয়ে কতবার চলাচল করেছে, আজই প্রথম চোখে পড়ল। দোকানের সাইনবোর্ডে হায়াতের দৃষ্টি আটকে গেল। এ কী বানান, ‘কাবাব গড়’। ‘এইখানে জাতিয় পরিচয় পত্রের ভূল সুদ্দ করা হয়’। হায়াতের সহ্য হলো না। পরদিন রংতুলি নিয়ে সেই দোকানে হাজির হলো। দোকানের মালিককে নরম গলায় বলল, স্যার, আপনার দোকানের সাইনবোর্ডে বানান ভুল আছে।

আমার দোকানের সাইনবোর্ডে ভুল আছে তাতে আপনার কী? রঙ্গ করে হেসে বলল, এইটা স্কুল না, তেহারির দোকান।

লোকে ভুল দেখে ভুল শিখবে। আমি ঠিক করে দিই? কোনো টাকা দিতে হবে না।

হায়াত রংতুলি দিয়ে ঘর বানানটি শুদ্ধ করে লিখে কী যে আনন্দ পেল! গভীর আবেগে লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইল। কবি যেমন 888sport app download apk লেখে, 888sport live chatী যেমন ছবি আঁকে, হায়াত তেমনি অবর্ণনীয় আনন্দের কয়েক মুহূর্ত তার লেখা শুদ্ধ বানানের দিকে তাকিয়ে রইল।

হায়াতের পোশাক শরীর স্বাস্থ্য দেখে অভাবী মানুষ মনে হয়। কিন্তু কথাবার্তা আচরণ পাগলাটে বুদ্ধিমান। কথাটা খাঁটি ‘ভুল লিখলে ভুল শিখবে’, শিক্ষিত মানুষের মতো কথা।

হায়াত তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, যাই ভাই। ঘুরে দেখি আরো কোনো সাইনবোর্ডে ভুল বানান আছে কি না। ঠিক কইরা যাই।

দোকানের মালিক জিজ্ঞেস করল, আমরা ব্যবসা করি লাভের জন্য। আপনে এই কাম কইরা লাভ কী, পেট চলে কেমনে?

হায়াত বলল, আপনে আমার বন্নির কাস্টমার, ফ্রি। এরপর খুশি হয়ে যে যা দিবে তাই নিব। লাভের দরকার নাই। কাজটা করে শান্তি পাই। একটা প্যাট চলে যাবে। আল্লাহ তো আছে।

মালিক হাঁক ছাড়লো, এক প্যাকেট তেহারি আনো। হায়াতের হাতে দিয়ে বলল, আপনেরে আমার খুব পছন্দ হইছে। ‘ভুল লিখলে ভুল শিখবে’ বড়ই খাঁটি কথা। আপনার কামের লগে আমি আছি। রাইত দশটা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। যেদিন রোজগার না হয়, খাওন না থাকে, আল্লাহর দোকান মনে কইরা আমার দোকানে চইলা আসবেন।