‘ছোটবেলায় সিলেট ডিস্ট্রিক্ট জেলের সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। আমার বন্ধু গৌস সুলতানের বাবা ছিলেন জেলের ডাক্তার। সেই সুযোগে অনেক কয়েদির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তারা সবাই বেতের জিনিসপত্র বানাত। সেগুলো জেলের সামনের রাস্তার পাশে ‘কেইন শপ’-এ বিক্রি হতো। কেন জানি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেই ছোটবেলাতেই, যে, কয়েদিদের তৈরি চেয়ার-মোড়ায় কখনো বসবো না। বড়ো হলে এসব সামগ্রী কিনব না। কয়েদিদের তৈরি সুন্দর জিনিসকেও আমার মনে হতো বিষণ্ন, যেন চোখের জলে বোনা। … মণ্ডলের ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে ছোটবেলার ওই সিদ্ধান্তটা কেন জানি হঠাৎ খুব তীব্রতা নিয়ে মনে এল।’
ওপরের অংশটি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি গল্প ‘জিহ্বা-কাটা মানুষ’ থেকে নেওয়া। গল্পের কথক হিসেবে নিজেকেই হাজির করেছেন তিনি, পরিচয়ও দিয়েছেন নিজেরই, এবং দেখুন প্রিয় পাঠক, মানুষকে কী মমতার চোখে দেখতেন তিনি! কয়েদি মানে তো শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীই, অথচ তাদের তৈরি জিনিসকে তাঁর মনে হতো বিষণ্ন, মনে হতো চোখের জলে বোনা! কয়েদিদের চোখের জল আর কজনই বা দেখে, তাও কল্পনার চোখে! ওরকম করে দেখতে হলে একটা মায়াভরা সংবেদনশীল মন থাকতে হয়। আর ওই যে মণ্ডলের ফ্যাক্টরির কথা বলা হলো, ওটা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। সেখানে গিয়ে তাঁর একই অনুভূতি ফিরে এলো। অর্থাৎ, ওই পোশাকগুলো যেন মেয়েদের চোখের জলে বোনা, যেন ওরা পোশাকশ্রমিক নয়, বরং কয়েদি। ওদের শাস্তিটাও ভয়াবহ। যেন সকলের জিহ্বা কেটে নেওয়া হয়েছে, প্রতিবাদের আওয়াজ তুললে কেবল গোঁ গোঁ শব্দ বেরোয়। তাঁর অনেক গল্পেই মানুষের প্রতি এই গভীর মায়াভরা হৃদয়ের দেখা পাই।
এই মায়া কি কেবল গল্পেই ছিল? অনেক সময়ই মানুষের 888sport live chatীসত্তা আর ব্যক্তিসত্তা মেলে না। 888sport live chatে গভীর দরদ তৈরি করেন, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে খুব নিষ্ঠুর – এরকম মানুষও দেখা যায়। সৈয়দ মনজুর ছিলেন একইসঙ্গে 888sport live chatী এবং ব্যক্তিমানুষ হিসেবে দরদি। এই ধরনের মানুষ অন্যের দুঃখ-বেদনার ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ান, যেন একেকজন বুদ্ধ বা যিশু। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা গিয়েছেন, অল্প সময়ের জন্যই হোক আর দীর্ঘ সময়ের জন্যই হোক, তাঁরা দেখেছেন কী উদার এবং সংবেদনশীল এক মানুষ ছিলেন তিনি। একটা বড়ো গুণ ছিল তাঁর – অকুণ্ঠ অ্যাপ্রিসিয়েশন করতে পারার দুর্লভ গুণ। কারো লেখা ভালো লাগলে, কারো কোনো কথা পছন্দ হলে, কারো কোনো কাজে মুগ্ধ হলে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, প্রশংসা করার উপলক্ষ খুঁজতেন তিনি। সেজন্য সবাইকে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করতেন, সবার মধ্যেই কিছু না কিছু প্রশংসাযোগ্য কাজ খুঁজে পেতেন। সবার জন্য তাঁর দরজা ছিল খোলা। মতাদর্শের ভিন্নতার জন্য, কিংবা অন্য কোনো কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দিতেন না, বরং কেউ কাছে আসতে চাইলে তাকে আরো কাছে টেনে নিতেন। আর সেজন্যই ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মানুষ তাঁকে ভালোবাসতো অকুণ্ঠভাবে। কারো সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চাইতেন না, মুখে লেগে থাকতো মৃদু একটা হাসি, কণ্ঠে আন্তরিক স্বর, সচরাচর বিরক্ত হতেন না কারো ওপর, কাউকে দুঃখ দিতে চাইতেন না, কারো অকল্যাণ কামনা করতেন না, মানুষের নানা সংকট এবং সীমাবদ্ধতাকে দেখতেন সহমর্মিতার চোখে। তাঁর কাছে গেলে মন শান্ত হতো, কারণ তাঁর হৃদয় ছিল শুদ্ধ এবং অসূয়াবিহীন। এই ধরনের মানুষকে আমার সন্ত বলে মনে হয়। তাঁর এই সন্তত্বের প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি।
একবার এক ঘরোয়া আড্ডায় তাঁকে এক বিশেষ প্রশ্ন করেছিলাম। অবশ্য একটা নয়, প্রশ্ন ছিল দুটো। কিন্তু এর মধ্যে একটা ছিল হাস্যরসাত্মক, সকলকেই করা যায়, এরকম। আরেকটা ছিল গম্ভীর এবং বিশেষভাবে নির্বাচিত মানুষকে করার জন্য। তো, হাস্যরসাত্মক প্রশ্নটি ছিল এরকম : জীবনে ক’বার প্রেমে পড়েছেন – বিয়ের আগে এবং পরে। এ-প্রশ্নের উত্তর অনুমিতই ছিল। তিনি যে ভাবির কথা বলবেন, মানে তাঁর স্ত্রীর কথা বলবেন, তা আমরা জানতাম। আড্ডায় এরকম হয়। শুধু যে গুরুগম্ভীর-সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ হয় তা নয়, হাসিঠাট্টাদুষ্টুমিও চলে। আমরা, তাঁর ‘তরুণ’ বন্ধুরা, তাঁর পত্নীপ্রেম নিয়ে কিছুক্ষণ ঠাট্টা করলাম। তিনিও হাসিমুখে স্বীকার করে নিলেন, তাঁর পত্নীপ্রেম অপরিমেয়, এই ক্ষেত্রে কোনো আপস নেই। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা কী? এই প্রশ্নের একটা ভূমিকা আছে, আমি সেটিই আগে বললাম। যিশুর সর্বব্যাপী ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে বললাম, সারাজীবন যিনি এরকম বিস্তীর্ণ-সর্বব্যাপী ভালোবাসার কথা বললেন, তাঁর মৃত্যুটা হলো করুণ-মর্মান্তিক-ভয়াবহভাবে। ক্রুশ বহন করে নিয়ে যেতে হলো বধ্যভূমিতে; অপমানিত-লাঞ্ছিত-নিপীড়িত এক মানুষ তিনি তখন, খোদার পয়গম্বর আর নন। সেমেটিক ধর্মগুলোতে যাঁদের পয়গম্বর হিসেবে মানা হয়, তাঁদের আর কারো এরকম নিষ্ঠুর-করুণ-অপমানজনক মৃত্যু হয়নি। কেন এমন হলো? সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় যে পয়গম্বর, যাঁর অন্তর ভালোবাসায় পূর্ণ, কেবল মানুষই নয়, সকল পশুপাখি-কীটপতঙ্গের জন্যও তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে, সর্বব্যাপী ভালোবাসায় বিহ্বল হয়ে যিনি বলেন – ‘সবচেয়ে ক্ষুদ্র জীবের জন্যও ঈশ^র সর্বদা উন্মুখ হয়ে আছেন’, সেই মানুষটিকে এভাবে মরতে হলো কেন? যে সর্বশক্তিমান, নিখুঁত ঈশ্বরের কল্পনা আমরা করি, তাঁর জন্য অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। তিনি কি পারতেন না তাঁর প্রিয়তম পয়গম্বরকে এরকম করুণ মৃত্যু থেকে বাঁচাতে? নিশ্চয়ই পারতেন, নইলে তিনি আর সর্বশক্তিমান কেন? তাহলে বাঁচালেন না কেন? এর মধ্যে কী ইঙ্গিত আছে? তিনি যে বলেন, ইহাতে বিশ্বাসীদের মধ্যে আছে নিদর্শন, সেই নিদর্শনটা কী? কী সেই ইশারা? পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না, তবে আমার মনে হয়, তিনি বলতে চেয়েছেন : দেখ, আমার নির্বাচিত অতিপ্রিয় মানুষটিকেও এরকম ভয়ংকর যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। অতএব নিশ্চিত থাকো, তোমাদের সবাইকেই ক্রুশ বহন করতে হবে। সবার কাঁধেই চাপিয়ে দেওয়া হবে ক্রুশ বহনের দায়। সবার ক্রুশ একরকম হবে না। কারোটা ভারী, কারোটা হয়তো ততটা ভারী নয়। প্রিয়জনের মৃত্যুশোক, জটিল-দুরারোগ্য বা নিরাময়ের অযোগ্য অসুখবিসুখ, অভাব-দারিদ্র্য, গ্লানি-অপমান এসবই একেকটা ক্রুশ।
এটুকু হলো ভূমিকা, এরপর করলাম সেই প্রশ্নটি। বললাম, সব মানুষকেই যেহেতু ক্রুশ বহন করতে হয়, আপনিও নিশ্চয়ই সেরকম কিছু বহন করছেন। সেটি কী?
ততক্ষণে পরিবেশটা বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। কেউ আর হাস্যরসের মুডে নেই, সবাই বিষণ্ন, গম্ভীর। মনজুরভাইও গম্ভীর হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন : একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধের সময়, তাঁরও যুদ্ধে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি সেই সময় সিলেটে ছিলেন, নিজেদের বাড়িতে। একই মহল্লায় থাকতেন তাঁর এক বন্ধু, বয়সে কয়েক বছরের বড়, যিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গেই যাওয়ার কথা ছিল মনজুরভাইয়ের। কিন্তু সেই সময় তাঁর বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর বন্ধুকে বলেন, বাবা একটু সুস্থ হলেই আমি রওনা হবো। কিন্তু তাঁর বন্ধু বললেন, তুমি একা কোথায় যাবে? আমি এসে নিয়ে যাবো। দুজনে মিলে পরামর্শ করে মাসখানেক পরের একটা দিনও ঠিক করলেন। এদিকে মহল্লায় তখন রাজাকারদের আনাগোনা বেড়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করছে, তরুণরা বাড়িতেই আছে নাকি যুদ্ধে গেছে! পাকিস্তানি হানাদারদের অবর্ণনীয় নিপীড়নও চলছে দেশজুড়ে। এরই মধ্যে, মাসখানেক পর তাঁর বন্ধু মহল্লায় এলেন তাঁকে নিয়ে যেতে। রাজাকাররা দৃষ্টি রেখেছিল, তিনি আসার পর ধরা পড়লেন রাজাকারদের কাছে, পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়া হলো তাঁকে এবং নির্মম অত্যাচার করে তাঁকে হত্যা করা হলো।
দীর্ঘ সময় ধরে এই মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করে মনজুরভাই বললেন, ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। যদি নিজে যেতাম, যদি আমাকে নেওয়ার জন্য তাকে আসতে না বলতাম, তাহলে ও ধরাও পড়তো না, এভাবে মরতেও হতো না। ওর এই মৃত্যুর জন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারিনি।
বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। চোখ ভিজে উঠলো জলে।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। তারপর তাঁর হাত ধরে বললাম, সরি মনজুরভাই, কথাটা জিজ্ঞেস করা আমার উচিত হয়নি।
তিনিও আমার হাত ধরলেন, বললেন, না ঠিক আছে। ক্যাথারসিসের প্রয়োজন আছে।
তিনি ক্যাথারসিসের কথা বলতেন মাঝে মাঝে।
ক্যাথারসিস হলো তীব্র, গভীর, বিষাদময়, বেদনাবহ কোনো অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে খানিকটা রিলিফ পাওয়ার উপায়। বলতেন, মানুষের জীবনে ক্যাথারসিসের প্রয়োজন আছে। কিন্তু নিজের বেদনা, ক্লান্তি, বিষাদ, বিপন্নতা নিয়ে কথা বলতেন না। হয়তো অন্যদের বিচলিত করতে চাইতেন না বলে বলতেন না। অন্যদের বেদনার ভার যিনি বা যাঁরা নিজেদের কাঁধে বয়ে বেড়ান, তাঁরা নিজের বেদনা প্রকাশ করেন না। আমরাও কতগুলো অস্বস্তিকর বিষয় এড়িয়ে যেতাম সবসময়, এমনকি তাঁর প্রয়াণের পরও এড়িয়ে যাচ্ছি। নইলে তো প্রশ্ন করতেই পারি, পঁচাত্তর বছর বয়সেও তাঁকে এত ব্যস্ত থাকতে হতো কেন? কেনই-বা উপার্জনের চিন্তা করতে হতো? এই বয়স তো অবসরের এবং একইসঙ্গে সৌখিন কাজ করার। কিন্তু তিনি আরো অনেক কাজের সঙ্গে ক্লাস নিতেন দুটো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি ছুটির দিনেও। ক্লাস নিতে পছন্দ করতেন তিনি, ভালোবাসতেন শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে। 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপকদের ক্লাস নিতে হয় না, কিন্তু তিনি এই পদে নিয়োগ পাওয়ার পর নিজেই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে, অন্তত একটা কোর্স তিনি পড়াতে চান, এবং পড়াতেনও। শিক্ষকতার প্রতি এ তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ। কিন্তু সেটি যদি বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে? বৈষয়িক মানুষ ছিলেন না তিনি, নিতান্তই সাধারণ জীবন-যাপন করতেন, কিন্তু একটা ভদ্রস্থ জীবনযাপন করতে হলে যতটুকু লাগে ততটুকু আয় তো তাঁর ছিল না। তদুপরি ছিল ক্যান্সার-আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়। ফলে শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে এখানে-ওখানে কাজ করতে হয়েছে। কাজ তিনি ভালোবাসতেন, এ-কথা সত্যি, কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপও মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। শুধু তাই নয়, রোগ-বালাইও নিশ্চয়ই ছিল, নইলে এমন হঠাৎ করে চলে যাবেন কেন? কাউকে জানতে দিতেন না নিজের সমস্যা-সংকটের কথা, অসুখবিসুখের কথা, ফলে এই আকস্মিক প্রয়াণ বিমূঢ় করে দিলো আমাদের। কখনো ভাবিনি, এত আকস্মিকভাবে চলে যাবেন তিনি। আড্ডায়, অনুষ্ঠানে, আয়োজনে এত প্রাণবন্ত থাকতেন, এত উচ্ছল থাকতেন যে কখনো মনেই হয়নি, কোনো অসুখ-বিসুখ আছে তাঁর। বরং মনে হতো, তিনি আমাদের চেয়েও তরুণ এবং কর্মচঞ্চল।
তো, সেদিন মনজুরভাইয়ের কাছে সেই ব্যক্তিগত ক্রুশ বহনের বিষাদময় ‘গল্প’ শুনে আমার মনে পড়েছিল আরেক কথা888sport live chatী মাহমুদুল হকের কথা। তিনিও ঠিক এরকমই এক বেদনা বয়ে বেড়িয়েছেন আমৃত্যু। আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন মাহমুদুল হকও, গল্প করতেন প্রচুর। শুধু মুখের কথায় দৃশ্যমান করে তুলতেন পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের 888sport appর ছবি, 888sport live footballজগতের ছবি, ওপার বাংলার ছবি। আর এসব গল্পে বারবার ফিরে আসতো তাঁর শিক্ষক শহীদ সাবের আর মায়ের গল্প। অসামান্য প্রতিভাবান লেখক শহীদ সাবের অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলেন আর হারিয়ে গিয়েছিলেন 888sport live footballজগৎ থেকে, শেষ পর্যন্ত শহিদ হলেন একাত্তরে – এসব গল্প তাঁর কাছেই শুনেছি। বহুবার বলেছেন – ‘একাত্তরে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর, সম্ভবত ২৭ বা ২৮ মার্চ হবে, কারফিউ একটু শিথিল করেছে, আমি তোমার ভাবিকে বড়োভাইয়ের বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছি। যাওয়ার পথে সচিবালয়ের দেওয়াল ঘেঁষে শহীদ সাবেরকে বসে থাকতে দেখলাম। প্রায় উলঙ্গ, চেহারা উদ্ভ্রান্ত। আমার কেন যেন মনে হলো, তিনি আর বাঁচবেন না। সময়টাই তো অমন ছিল, বেঁচে থাকাই ছিল বিশেষ ঘটনা। পশুপাখির মতো মানুষ মারছে পাকিস্তানিরা। তোমার ভাবিকে বললাম, ‘স্যার মনে হয় আর বাঁচবেন না, উনাকে উদ্ধার করা দরকার। তোমাকে রেখে ফিরে যাওয়ার সময় স্যারকে নিয়ে যাবো।’ কিন্তু ফেরার পথে তাঁকে আর পাইনি। এর মাত্র দুদিন পর সংবাদ অফিস পাকিস্তানিরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। শহীদ সাবেরও পুড়ে মারা যান। জানো, আমার কেবলই মনে হয়, আমি যদি তাঁকে ওইদিন নিজের বাসায় নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে তিনি এভাবে মরতেন না। তাঁর মৃত্যুর জন্য আসলে আমিই দায়ী, বুঝেছ!’ ব্রেকডাউন অফ কমিউনিকেশনের কথা বলেছিলেন একবার – ‘আমাদের প্রায় সবার জীবনে ঘটে, আমার জীবনেও ঘটেছে, বোধহয় শহীদ সাবেরের জীবনেও ঘটেছিল। নইলে এমন একজন মানুষ এভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাবেন কেন? ক্লান্ত তিনিও হয়েছিলেন, কিন্তু ক্লান্তিটা দূর করেছিলেন পাগল হয়ে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল। খুব সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে এই পৃথিবীতে সুস্থ থাকা কঠিন। তাঁর সঙ্গে তো আমার দেখা হয়, এইসব কথা তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন।’ তাঁর মুখে ‘তাঁর সঙ্গে তো আমার দেখা হয়’ শুনে আমি একটু চমকে উঠতাম। কার সঙ্গে দেখা হয়? কার কথা বলছেন তিনি? জিজ্ঞেস করলে দ্বিধাহীনভাবে বলতেন – ‘শহীদ সাবেরের সঙ্গে! উনি তো আসেন, প্রায় প্রতিদিনই আসেন। অবশ্য দিনে খুব একটা আসেন না, আসেন রাতে, কথাবার্তা বলে ওই ডিভানে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন! মনে হয় খানিকটা বিরক্ত। বিরক্ত অবশ্য হবারই কথা! বোঝো না, তাঁর হাত ধরে আমি লেখক হয়ে উঠেছি, অথচ, অজানা কারণে তিনি যখন ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন তাঁর খোঁজও নিইনি। আর ওই দিন, মানে শেষ যেদিন তাঁকে দেখলাম, সেদিন তাঁকে যদি নিয়ে আসতাম …’ – বলতে বলতে আবার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসতো তাঁর। আর আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, একজন মানুষ কতটা সংবেদনশীল হলে শিক্ষকের মৃত্যুর দায় অকারণে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বয়ে বেড়াতে পারেন! শহীদ সাবেরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই নিজেকে দায়ী করতেন তিনি, অথচ এর জন্য আদৌ তাঁর কোনো দায় ছিল না।
এ হলো সেই ক্রুশ বহনের ‘গল্প’, কে যে কোন ক্রুশ বয়ে চলেছেন, কেউ তা জানে না।
সৈয়দ মনজুর তাঁর তিন পর্বের জীবন 888sport alternative linkে শাহীন নামের এক চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, যে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় নিজের অনিচ্ছাকৃত উপস্থিতির জন্য অনুতাপে দগ্ধ হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি মাথা পেতে নেয়। এই চরিত্রটি নিয়ে আমি লিখেছিলাম : ‘যে হৃদয় অনুতাপে দগ্ধ হয়, এমনকি অপরের কৃত অপরাধের সময় নিজে কেবল উপস্থিত থাকা বা প্রত্যক্ষদর্শী হবার জন্য যে-মানুষ অনুতাপে পোড়ে, সেই হৃদয় হয়ে ওঠে পরিশুদ্ধ, পবিত্র। সে তখন স্বেচ্ছায় কারাদণ্ড বেছে নেয়, অপরাধের দায়ে নয়, অনুতাপের তীব্র দহনে। এ যেন এক যিশু, যিনি কোনো অপরাধ না করেও নিজের শীর্ণ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পৃথিবীর সমান ভারী এক ক্রুশকাঠ, কারণ ওই ক্রুশে ছিল সমগ্র মানবজাতির পাপের ভার। বদ্ধভূমি পর্যন্ত সেই ক্রুশ বয়ে নিয়ে যেতে যেতে তিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন, উপহাস ও বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন, হাসি-তামাশার পাত্র হয়েছেন, তবু থেকেছেন নির্বিকার, অবিচল। প্রত্যেক অনুতপ্ত মানুষই অন্যের পাপের ভার কাঁধে তুলে নেয়, স্বেচ্ছায়, ক্রুশের মতো করে। শাহীনও নিয়েছিল। আর তাই, আমরা দেখবো, পরের জীবনে অতি সামান্য ভুলকেও তার মনে হবে খুনের মতো গুরুতর অপরাধ, এবং 888sport alternative linkের শেষে গিয়ে নিজেকেই নিজে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেবে সে।’
তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা। কত বিষয় নিয়ে যে আমাদের কথা হতো, তার ইয়ত্তা নেই। একেবারে তুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে জীবন ও জগতের গভীর-জটিল বিষয়, সব। আরেকটা উদাহরণ দিই। একবার আলাপ হচ্ছিল শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে। আমরা দুজনই যেহেতু দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতা করছি, নানা মজার গল্প আর 888sport sign up bonusচারণ হলো বেশ কিছুক্ষণ। আলাপের এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, শিক্ষকরা আসলে তাঁদের শিক্ষার্থীদের কী শেখান? প্রশ্নের ধরন দেখেই তিনি বুঝে ফেললেন, উত্তরটি প্রচলিত ধারার হবে না। বললেন, আগে তুমি বলো। আমি বললাম, জ্ঞান নয়, আদর্শ শিক্ষকরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের উপহার দেন প্রজ্ঞা। তিনি উদাহরণ চাইলেন। আমি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের উদাহরণ টেনে বললাম, একবার তিনি তুরস্কে গিয়ে দেখলেন, বইয়ের দোকানে শেলফের অর্ধেকটা জুড়ে ধর্মীয় বই, বাকি অর্ধেকে কমিউনিজমের বই। এটুকু হলো তথ্য। অর্থাৎ, তুরস্কের বইয়ের দোকানে এভাবে বই সাজানো থাকে, এটা কেবল তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তথ্যটাকে যদি কেউ বিশ্লেষণ করেন, তাহলে বুঝবেন, তুরস্কের পাঠকসমাজে এই দুই ধরনের বইয়ের চাহিদা প্রায় সমান। এই বিশ্লেষণের পর তথ্যটা কেবল তথ্য থাকে না, পরিণত হয় জ্ঞানে। মজার ব্যাপার হলো, অধ্যাপক রাজ্জাক আরেকটু এগিয়ে ভেবেছেন, যে-দেশের বইয়ের দোকানে এই দুই ধরনের বই পাশাপাশি থাকে এবং তাদের চাহিদা থাকে প্রায় সমান, সেই দেশের সমাজ-জীবনে টেনশন থাকবে তা তো বলা বাহুল্য। মানে, বইয়ের দোকানে দুই বিপরীত ধরনের বই পাশাপাশি থাকার অর্থ হলো সমাজে টেনশন থাকার লক্ষণ। এইটুকু হলো প্রজ্ঞা। অর্থাৎ তথ্য থেকে হলো জ্ঞান, জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞা। তিনি বললেন, তার মানে, তথ্যকে প্রসেস করলে হয় জ্ঞান, আর জ্ঞানকে প্রসেস করলে হয় প্রজ্ঞা, এই তো? হ্যাঁ, আমি ঠিক এই কথাটিই বলতে চেয়েছিলাম, আমার আলাপ শুনে তিনি সেটির সংক্ষেপায়ন করলেন, সারাংশ করে দিলেন। এও তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয়। তো, আদর্শ শিক্ষকরা কেবল তথ্য সরবরাহ করেন না, কেবল জ্ঞানও বিলান না, বরং অর্জিত প্রজ্ঞা উপহার দেন। আমরা একমত হলাম।
এরপর আলাপ গড়ালো, আদর্শ শিক্ষক আমরা কাকে বলবো সেদিকে। যিনি শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ান তাঁকেই? আমরা আবারো একমত হলাম যে, ভালো পড়ানো আদর্শ শিক্ষক হওয়ার অন্যতম শর্ত সন্দেহ নেই, কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়। ভালো শিক্ষক মাত্রই শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তোলেন, কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল আনন্দমুখরই করেন না, বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে শেখান; প্রশ্নমুখর করে তোলেন, নিজের বিষয়ের বাইরে গিয়ে আরো নানা বিষয় নিয়ে আগ্রহী এবং কৌতূহলী করে তোলেন; কেবল জ্ঞানই বিতরণ করেন না, প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন শ্রেণিকক্ষকে।
আমি এর সঙ্গে যোগ করে বলতে চাই, একজন আদর্শ শিক্ষকের সামাজিক প্রভাব এমন সর্বব্যাপী হয় যে, শ্রেণিকক্ষের বাইরেও আরো বহু মানুষ তাঁকে শিক্ষক হিসেবেই মান্য করেন। যেমন সৈয়দ মনজুর আমার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন, তিনি পড়াতেন ইংরেজি 888sport live football আর আমি পদার্থ888sport apkের ছাত্র, তবু তাঁকে সবসময় শিক্ষক হিসেবে মান্য করে এসেছি, যদিও তাঁর নির্দেশে সবসময় ‘ভাই’ বলে ডাকতে হয়েছে, ‘স্যার’ বলে ডেকে বকাও খেয়েছি কয়েকবার। আরেকটি বিশেষ গুণ থাকে একজন আদর্শ শিক্ষকের। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনোরকম বিভাজন করেন না। শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী ইত্যাদির বিভিন্নতা তিনি মানেন না, তাঁর কাছে সবাই সমান। এমনকি ভালো ছাত্র খারাপ ছাত্র বলেও কিছু নেই তাঁর কাছে, নেই ব্যাকবেঞ্চার বলে কেউ। সবার জন্য সমান মনোযোগ, সমান ভালোবাসা। সৈয়দ মনজুর ছিলেন সেই ধরনের শিক্ষক।
লেখক হিসেবে যেমন, তেমনই শিক্ষক হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে এবং সর্বোপরি ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন গড় মানুষের চেয়ে অনেক উচ্চস্থানে। ভালোবাসতে জানতেন তিনি, বুদ্ধ বা যিশুর মতো সর্বব্যাপী ভালোবাসা। মানুষের জন্য তো বটেই, সকল প্রাণ এবং প্রকৃতির জন্য তাঁর ছিল গভীর দরদ, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা আর ভালোবাসায় ভরা একটা হৃদয়। এক গল্পে তিনি লিখেছিলেন : ‘মা বলতেন, শালপাতা কুড়োতে নেই, মরা শালপাতাদের ঝরে পড়ার জায়গাতেই সমাধিস্থ হতে দেয়া উচিত। তাদের জড়ো করে আগুন লাগানো এক অমানবিক বীভৎসতা, ঝরাপাতাদের আগুনে পোড়ালে বৈশাখের বজ্রপাতে মানুষকে মরতে হবে ধু ধু মাঠের মধ্যে।’ ঝরাপাতাদের জন্যও যাঁর হৃদয়ে এত প্রেম, মানুষের জন্য, প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য তাঁর প্রেম কত গভীর ছিল তা কি আর বলে দিতে হয়! হ্যাঁ, তিনি বাঁচতেন প্রেমে এবং প্রার্থনায়। সবার জন্য, সব কিছুর জন্য তাঁর ভেতরে ছিল এক অনিঃশেষ মঙ্গল-কামনা। কিন্তু নিজের উচ্চতা তিনি বুঝতে দিতে চাইতেন না। সাধারণ হয়ে মিশে থাকতেন আমাদের মতো অতি-সাধারণদের সঙ্গে। একজন সন্তের পক্ষেই এরকম হওয়া সম্ভব। আমি তাই তাঁকে সবসময় সন্ত বলেই ভেবেছি। না, তাঁর প্রয়াণের পরে নয়, জীবদ্দশাতেই, আমার 888sport alternative link সংগ্রহ-এর উৎসর্গপত্রে, ‘আমাদের কালের সন্ত’ বলে অভিহিত করেছিলাম তাঁকে। এই ধরনের মানুষ চলে গেলে পৃথিবীটা অনেকখানি বিবর্ণ হয়ে যায়, নিজেকে অনাথ আর অসহায় বলে মনে হয়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.