ফনেচাচা : দ্বিতীয় পর্ব

আমাদের গ্রামে কোনো শিক্ষালয় ছিল না। তাই বাবাকে (শওকত ওসমান) ছোটবেলায় কাদামাটি ভেঙে পাশের গ্রাম নন্দনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হতো। নন্দনপুর আমাদের ঘর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার তো হবেই। সম্ভবত ১৯২৬ সালে আমাদের পাড়ার অদূরে পুবদিকে স্থাপিত হয় সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসা, অর্থাৎ প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি। বাবা তাঁর লেখাপড়ার শেষের দিকে এই সুযোগ পেয়েছিলেন।

আমাদের এই মাদ্রাসাটি তখন ছিল একতলা পাকা ভবন। অনেকটা তৃতীয় বন্ধনীর মতো। পুব-পশ্চিমা টানা লম্বা শ্রেণিকক্ষ। দুই মাথায় আবার দুটি বাহু। সামনে পাকা দেয়ালের ওপর লোহার গ্রিল। খুব সুদর্শন ফটক। গ্রামের চেহারা পাল্টে যায় এই ভবনটি নির্মিত হওয়ায়। দেয়ালের পাশে ভেতরে ছিল টানা বাগান। নয়নতারার শোভা ঝকমক করত। সাদা আর বেগুনি ফুলের নাম তখন জানতাম না। কেউ জানত না। আমরা ছোটবেলায় এই ফুলকে তাই বলতাম মাদ্রাসাফুল। এখন হাসি পায়। গ্রামে মুসলিম অধ্যুষিত বলে কোনো বাড়িতে ফুলের বাগান নেই। দূরে হিন্দুবাড়িতে পুজোর জন্যে ফুল দরকার, তাই বাগান দেখা যেত। তখন গাছ বা বাগান বলতে গরিব মানুষগুলো বুঝত লাউমাচা বা ঝিঙে-চিচিঙ্গে-কুমড়ো মাচা। সবই আনাজ বা তরকারি কেন্দ্রিক। আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল পুঁইশাকের মাচা। দু’রঙের পুঁইশাক হয়। বেশিরভাগ সবুজ। ক্বচিত দু-একটা গাঢ় বেগুনি রঙের। ওর পাতাও কিছুটা রঙিন। বেশ সুন্দর দেখতে। এখনো আমি কল্পনায় আমার দাদি বা ঠাকুরমাকে শাক তুলতে দেখি। কখনো শুধু পাতা তুলতেন। শাক তোলার পর মুখে একটা তৃপ্তির হাসি লক্ষ করতাম। সে-হাসি ছিল বড় অমলিন। দারিদ্র্যপীড়িত সেই মানুষগুলো ছিল অল্পে খুশি। দিন-দুনিয়ার মধ্যে দুটো খাওয়াপরাকে তারা সবচেয়ে দাম দিত। এর বেশি পেতে নেই বা চাইতে নেই – এরকম একটা চিন্তা এদের মধ্যে বদ্ধ ছিল। আর সেজন্যে এদের মনে দুঃখবোধ ছিল কম। সবই কপাল বলে মেনে নিত। তার মধ্যে কিছু পেলে আনন্দে তাদের চোখ নেচে উঠত। অল্পে তুষ্ট। এটাই লোকজীবন।

ফনুচাচার নেশা ছিল বড়শিতে মাছ ধরা। আমি ছিলাম সঙ্গী। আস্তে আস্তে আমার হাতেও ছিপ উঠল। কঞ্চির মাথায় সুতো বেঁধে মাঝখানে ফাতনা বাঁধা। তারপর ময়দা গুলে চার বানানো। পুকুরে ছিপ ফেলে অপেক্ষা করা। কখন মাছ ঠোকর দেবে। মাছ ছিল খুব চালাক। সহজে টোপ গিলত না। দুটো ঠোকর দিয়ে সরে যেত। আমি উত্তেজিত। এখনি হয়তো টান মারবে। আর ডুবে যাবে ফাতনা। আমি দেব টান। মাছ উঠবে। মাছ মানে পুঁটিমাছ। তা-ও খুব ছোট সাইজের। কিন্তু ধরার আনন্দটা ছিল রুইমাছ ধরার মতো। মাছ ধরা পড়লে তালপাতার শিরা নিয়ে মুখ আর কানকো দিয়ে প্রবেশ করিয়ে জলে ডুবিয়ে রাখা।

আমাদের নতুন পুকুরে তেমন মাছ ছিল না। কারণ মাছের পোনা ছাড়বে কে? কারো সামর্থ্য নেই। আর থাকলেও এজমালি পুকুর মানে অনেক ভাগিদার। তাই মিলিতভাবে কখনো কাজ হতো না। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, তেমনটাই ছিল নতুন পুকুরের অবস্থা। শুধু বান এলে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের নলটা দিয়ে যখন জল ঢুকত, দেখতাম পুকুরের মাছ সব স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতরাচ্ছে। শুধু এই সময় ওদের দেখা মিলত। দু-একটা রুই বা কাতলাকে লাফাতে দেখা যেত। পুঁটিমাছ নজরে পড়ত বেশি।

নতুন পুকুরে মাছ না পেলে আমরা পুবপাড়ার দিকে যেতাম। ওখানে খাঁ পাড়ার বড় পুকুর ছিল। অনেকটা ছোটখাট একটা দিঘি। আমরা ওখানে ছিপ নিয়ে যেতাম। আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। পুকুরের জল অনেকটা স্বচ্ছ। জলের নিচে বালি তাই দেখা যেত। এই বালির মধ্যে থাকত বেলেমাছ। আমরা বলতাম ভোলামাছ। এখানে ভোলা মানে শিবঠাকুর নয় … বেলেমাছ বড়শির টোপ গিলে চুপ করে বসে থাকে। দৌড় দেয় না। আমরা বড়শি উঠিয়ে দেখি মাছ উঠে এসেছে। এতই ভোলা প্রকৃতির এই বেলেমাছ। ওর ভোলামাছ নামটা আমার খুব পছন্দ। অবশ্য ওরা বালিতে থাকার জন্য বেলেমাছ বলাটা ন্যায়সংগত। দুটো নামই সার্থক। তবে পূর্ববাংলায় বেলে বা বাইল্যামাছ একচেটিয়া। ভোলামাছ কেউ বলে না। ভুলে যদি কখনো 888sport appsে ভোলামাছ বলে ফেলি মাছ-বিক্রেতা হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তখন শুধরে নিই। বালি, বাইল্যা কত করে?

বাংলায় অঞ্চলভেদে মাছের বিভিন্ন রকম নাম। পশ্চিমবঙ্গে কাতলা তো পূর্ববঙ্গে কাতল। রুই হলো রুহিত। একেবারে বইয়ের মতো শুদ্ধ ভাষা। পূর্ববাংলায় এখনো শুদ্ধ উচ্চারণ বা তৎসম নাম বেশি।

একটা ঘটনা বলি। আমি একবার এক বান্ধবীর সঙ্গে গেছি নেত্রকোনায়। বান্ধবীর নাম মমতা। ওরা দত্ত পরিবার। ওদের বাড়ি শহরে বড়বাজারের পাশে। একবার ওদের মামাবাড়ি গেছি গ্রামে। তখন বিকেল। হেমন্তকাল। মাঠে মাত্র ছোট ছোট সর্ষে গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। সবাই ঘর থেকে মাঠের দিকে বেড়াতে যাবো। সবাই বেরিয়ে গেছে। আমি শুধু ভেতরে। এই সময় ওর দিদিমা ঘরে প্রবেশ করে বললেন, বুলবন, নিকাশ হও, নিকাশ হও।

আমি তো অবাক। দিদিমা বলে কি! নিকাশ হও! অর্থাৎ বেরোও।

নিকাশ শব্দটা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। বুঝি এটা তদ্ভব শব্দ অর্থাৎ নিষ্কাশনের সংক্ষিপ্ত রূপ – নিকাশ।

জোর গলায় দিদিমাকে বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এখনি নিকাশ হব।

সুন্দরী উজ্জ্বল ফর্সা দিদিমা মুচকি হাসেন। কয়েকদিন থাকলে দিদিমার সঙ্গে প্রেম করা যেত। পরে এই কথাটা নিয়ে মমতার সঙ্গে অনেক হাসিঠাট্টা হয়। নিকাশ হও নিয়ে।

আমার ঠাকুরমা মানে দাদি নিজ হাতে পুঁইশাক গাছ লাগাতেন। তাঁর হাতের পয় ছিল। গাছ মরত না। সব হিলহিলিয়ে বেড়ে উঠত। লতার সঙ্গে ভাষাও লতিয়ে যায় : হিলহিলিয়ে, মানে ঘুরপাক খেয়ে পেঁচিয়ে দ্রুত বেয়ে ওঠা। পুঁইমাচা বাংলার গৃহস্থবাড়ির এক সৌন্দর্য। এখন পুঁইশাক মাঠে চাষ হয়। গোড়াসমেত চলে আসে বাজারে। আমি গোড়া কেটে টবে লাগিয়ে দেখেছি, বেশ সুন্দর গাছ হয়। একটু যত্ন নিয়ে সামান্য সার দিলে ভালো শাক পাওয়া যায়। নিজের টবের শাক-রান্না, এর স্বাদই আলাদা।

তো ফনেচাচার কথা। চাচা সম্ভবত ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আমি একদিন চাচার সঙ্গে মাদ্রাসা ভিজিটে গেলাম। পরিচিত হওয়ার জন্যে। একসময় আমাকেও তো এখানে আসতে হবে।

চাচার সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণিতে গিয়ে পাশাপাশি বসি।

কোন শিক্ষক ছিলেন মনে করতে পারছি না। তবে খুদে মানুষটি প্রথমেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বসে।

তিনি কাছে ডেকে নিলেন।

ফনেচাচা আমাকে নিয়ে সব বয়ান করলেন। বাবার নাম শুনে শিক্ষক পুলকিত হন। বাবা তখন বাংলায় ভিআইপি হয়ে উঠেছেন। লোকে তাকে সবাই সম্বোধন করত কবিসাহেব বলে।

আমার মনে পড়ে, এই শিক্ষক আমাকে হেড মাস্টারমশাইয়ের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি মোটামুটি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পেলাম।

হেডমাস্টারমশাই আমাকে আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

ঘরে ফিরে মাকে সব ফিরিস্তি দিই। মা খুশি। তখনো কোনো বিদ্যালয়ে না যাওয়া সন্তানের ভিআইপি ট্রিটমেন্টের জন্যে। তবে বিদ্যালয়ে না গেলে কী হবে, আমি ওই বয়সে সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায়ের সব কাব্যচর্চা করে ফেলেছি। কিছু কিছু ছড়া-888sport app download apk ছিল মুখস্থ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো ছিলই। এমনকি কবি আহসান হাবিবের ছোটদের 888sport app download apk পড়েছি। বাবা পুজোবার্ষিকী কিনে দিতেন। তাতেই একসঙ্গে সবাইকে পেয়ে যেতাম। দেব 888sport live football কুটীর এক্ষেত্রে ছিল সর্বাগ্রে। বাবার ছোটভাই হলে কী হবে, ফনেচাচা ততটা ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন না। অনেকটাই গড়পড়তা ভালো মানুষ। যাদের আমরা মধ্যম দলে ফেলি। না তুখোড়, না হাবাগোবা। তবে মানুষটা ছিলেন কম কথাবলা ও অমায়িক ভদ্রলোক। নিপাট ভদ্রলোক বললে যা বোঝায় তেমনটা।

একবার শীতকাল প্রায় আসছে, এমন সময়ের কথা। এককথায় বলা যায় হেমন্তকাল। উত্তরদিকের মাঠে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধানক্ষেতে মাঝে মাঝে ইঁদুরের গর্ত, আর গর্তের মুখে মাটির ঢেলা। ইঁদুরের দাঁত খুব ধারাল। সুঁচোলো হলেও শক্ত জিনিস কাটতে পারে। কাঠের বাক্স কেটে ফেলে। শুধু লোহা বা সিমেন্ট কাটতে পারে না।

ফনেচাচা একটা কোদাল নিল, তারপর আমাকে বলল, চলো মাঠে যাই। ধান কাটা হয়ে গেছে। অনেক ইঁদুর ধানের শীষ গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ভবিষ্যতে খাবে বলে।

চাচার কাঁধে কোদাল। আমি সঙ্গী। চললাম উত্তরের মাঠে।

মাঠে গিয়ে দেখি আরো দু-একজন হাজির। তাদের হাতেও কোদাল। সবার উদ্দেশ্য এক। ইঁদুরের গোলা খুঁজে বের করে ধান সংগ্রহ। আসলে এটা একটা লুট। বেচারি ইঁদুর কত কষ্ট করে কতদিন ধরে জমিয়েছে – আর আমরা নিমেষে তার সমস্ত পরিশ্রমে জল ঢেলে দিলাম, না গোলায় আগুন দিলাম। যাই বলি, তা লুট। মহাজনের গোলা লুট করার মতো।

মাঠে একজন এরকম একটা গোলা পেয়েছে। সে গোছা গোছা ধান তুলছে। বের করছে আর একটা থলিতে ভরছে। আমরা কোনো থলি আনিনি। আগে পাই তো! তখন থলি আনা যাবে। কাছেই। এক ভোঁ দৌড় দিয়ে ছুটে চলা। আর

সে-উৎসাহ ম্যারাথন রেসকেও ছাপিয়ে যাবে।

ইঁদুরের বাসা থেকে ধান সংগ্রহ – এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। গোছা গোছা ধানের শীষ কী চমৎকার করে সাজানো। একেবারে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কারিগরের মতো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছিলাম এই ধান সংগ্রহের ছবি।

পরের ধন দেখে কী হবে। এবার আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। সব গর্তে যে ধান পাওয়া যাবে এমনটা নয়। বেশিরভাগ ফাঁকা। দশটায় একটাতে মেলে। তা-ও না মিলতে পারে। এটা একটা আন্দাজ করা। যে পায় সে ভাগ্যবান। না হয় মাটি খোঁড়া সার।

আমরা এবার একটা ইঁদুরের গর্তের মাটি তোলা দেখে খুঁড়তে শুরু করি। মাটি কোপানোর কাজ ফনেচাচার। আমার গায়ে অত জোর নেই। তবে দু-এক কোপ দিতে পারি। আর তাতেই কত বাহাদুরি। ঘরে ফিরে মাকে জানানো। অবশ্যই ফলাও করে। মা বুঝতেন সব। ছেলে বলতে বলতে হাঁফাচ্ছে, মানে কাজ নয়, উৎসাহটা প্রবল। তাই কথা দম ফেলার সঙ্গে ওঠা-পড়া করছে। তিনি মাতৃসুলভ গম্ভীরভাবে হাসতেন। মুখে শুধু একটা ভাবের পরিবর্তন হতো, এই যা। আমিও বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতাম।

তো আমাদের ইঁদুরের গর্তে অভিযান চলছে। পরপর তিনটে বাসা ব্যর্থ। চাচা প্রায় হাল ছেড়ে দেয় আর কী। আমি ফনেচাচাকে উৎসাহ দিয়ে বলি, চাচা, আর একটা দেখো। এরপর আমরা চলে যাব।

চাচা শেষ গর্তটা খুঁড়তে লাগল। দু-তিন কোপ দিয়ে মাটি সরানো হলো। আর কয়েকটা ধানের শীষ দেখা গেল! চাচা চেঁচিয়ে ওঠে, দেখ, দেখ, ধানের শীষ দেখতে পেয়েছি। মনে হয় এটার ভেতর আছে।

আমি হাত লাগাই। দ্রুত মাটি সরাতে থাকি। আর চোখে আনন্দ ধরে না। দেখি কী সুন্দর করে থরে থরে ধানের শীষ সাজানো। আমরা সঙ্গে কিছু আনিনি। শুধু চাচার কাছে একটা গামছা ছিল সেটা মাটিতে বিছানো হলো। ধান বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছে। বেশ বড় গোলাঘর। শেষ হতে চায় না। চাচা উৎসাহ নিয়ে কুপিয়ে চলেছে – আর আমি খুদে হাত খুব নরমভাবে ধানের শীষের গুচ্ছ তুলে গামছায় রাখছি।

একসময় ধানের শীষের গোলা শেষ। আমরাও হল্লাক হয়ে পড়েছি। বিশেষ করে ফনেচাচা। পাতলা ছোটখাটো মানুষ। আর আমি সাগরেদও খুব ছোট। দুজনে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে গামছায় ধান বেঁধে ঘরে ফিরি।

দাদি বললেন, প্রায় পনেরো সের হবে। চাল হবে দশ সেরের মতো।

আমাদের মনে হলো আরব্য 888sport alternative linkের সিসিম ফাঁক করে সোনাদানা নিয়ে ফিরেছি। গরিবের ঘরে দশ সের চাল

সোনাদানাই বটে।

আশপাশের অনেকেই দেখতে এলো আমাদের ধন-দৌলত। আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প যেন ঘটে গেছে। আমরা ইঁদুরের জমানো অসময়ের সঞ্চিত ধন নিয়ে এসে আসলে ভালো করিনি, কিন্তু এই জগতে সবাই একে অপরের ধন দখল করে বড় হয়। সম্মান পায়। গরিবের কথা কেউ মনে রাখে না। যেমন আমরা যে বেচারা ইঁদুর দম্পতি এই ধান জমা করেছিল, ক্ষণকালের জন্যে হলেও তাদের কথা মনে করিনি। জগৎ বড় নিষ্ঠুর নিয়মে বাঁধা। কেউ যখন কাঁদে, তখন আর একজন হাসে। ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। এরকম কত কথা আছে। সবই প্রকৃতির বিধান। প্রকৃতি শুধু নির্বিকার। তার নির্মিত বিধানের বাইরে যায় না। বা যেতে পারে না। ব্যতিক্রম আছে কি না জানা নেই। হয়তো আছে বা থাকতে পারে। যাকে আমরা অলৌকিক ক্ষমতা বলি।

ফনেচাচার সঙ্গে আর একদিন আমি মাদ্রাসায় গেলাম। তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। নতুন মুখ দেখে শিক্ষক আকৃষ্ট হন।

চাচা আমার পরিচয় দিলেন। কিন্তু শিক্ষক আমাকে নিয়ে একেবারে হেডমাস্টারের দরবারে।

স্যার, আমাদের কবিসাহেবের ছেলে। জিলানীর ভাইপো।

নাম মনে নেই এইসব শিক্ষকের। তারা আমাকে খুব আদর করলেন।

বাড়ি ফিরে মাকে সব জানাই। মা’র মুখে হাসি। বলল, একটা ছড়া আবৃত্তি করতে পারতে।

আমাকে তো বলেনি।

তা অবশ্য ঠিক। না বললে কী করে করবে। যাক, তোমার মাদ্রাসা ভালো লেগেছে। আমার জবাব, হ্যাঁ।

তোমাকে আগামী বছর এখানে ভর্তি করে দেব।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ঝামটিয়া! তাহলে ঝামটিয়ায় থাকব কি করে!

এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল।

মাদ্রাসায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। উপলক্ষ মনে নেই। হয়তো ছিল প্রাইজ দেওয়ার অনুষ্ঠান।

আমাকেও ফনেচাচা মাদ্রাসায় নিয়ে গেলেন। হেডমাস্টার নিয়ে যেতে বলেছেন। আমাকে দিয়ে তিনি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করাবেন।

এক শিক্ষকের ওপর অনুষ্ঠানসূচির ভার। তিনি আমাকে সেই পরিচিত ছড়াটি শেখালেন কীভাবে আবৃত্তি করব।

ছড়াটি হলো :

মৌমাছি মৌমাছি,

কোথা যাও নাচি নাচি

দাঁড়াও না একবার ভাই

ঐ ফুল ফোটে বনে

যাই মধু আহরণে

দাঁড়াবার সময় তো নাই।

এর পরের অংশ হলো –

পীপিলিকা, পীপিলিকা,

দলবল ছাড়ি একা

কোথা যাও যাও ভাই বলি;

শীতের সঞ্চয় চাই,

খাদ্য খুঁজিতেছি তাই

ছয় পায়ে পিলপিল চলি।

এই ছড়াটি আমি ঘরে ফিরে বারবার পড়তে লাগলাম। উচ্চৈঃস্বরে। মাঝে মাঝে মা গলা থামাতে বলতেন। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছি – বলতেন তিনি। আমি দূরে গিয়ে আবার জোর গলায় আবৃত্তি করে চলি : মৌমাছি মৌমাছি … কোথা যাও নাচি নাচি … আমি নিজেও নাচতাম। যদিও বড় হওয়ার কালে নাচের সঙ্গে সম্পর্ক হয়নি। সংগীতের সঙ্গে হাতেখড়ি হয়েছে বাবার এসরাজ নিয়ে। সেটা ভিন্ন পর্বের তথ্য। এখানে টেনে আনা ঠিক হবে না।

 তো, এসে গেল সেই প্রাইজ দেওয়ার অনুষ্ঠানের দিন। আমার বুক সকাল থেকেই কাঁপছে। স্টেজে উঠতে হবে। ওরে বাবারে, কত লোক থাকবে! যদি ভুলে যাই … বোকার মতো হাঁ করে চেয়ে তাকি!

যাক মনে মনে আল্লাহ-রাসুলের নাম নিলাম। ভগবানকেও ডাকতে ছাড়িনি। মামাবাড়ি ঝামটিয়ার প্রভাব।

মামাবাড়ি হিন্দু আর বাবাবাড়ি মুসলমান … এখন ভাবলে বড় ভালো লাগে। কী সুন্দর দিন কাটাইতাম … কারো সঙ্গে কারো কোনো বিবাদ ছিল না। তখনো পাকিস্তান হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির আগের জামানার কথা বলছি। মুসলমান নিজেদের রাষ্ট্র পেল, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মিটমাট হলো না। সারা বৃহত্তর ভারতজুড়ে
হিন্দু-মুসলিম সমস্যা লেগেই আছে। বরং দিন দিন বাড়ছে। তাহলে মানুষের অগ্রগতি কি ভূতের পায়ের মতো? পেছন দিকে?

বিষাদ সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন হলে এই নিয়ে তিন পৃষ্ঠা লিখে ফেলতেন … রে হিন্দু-রে মুসলমান … আমি শুধু ইশারা দিলাম। বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।

গরমকাল। বেলা বড়। সবলসিংহপুর মাদ্রাসার অনুষ্ঠান ঠিক সময়মতো শুরু হলো। বেলা পাঁচটায়। রোদের ঝাঁজ কম। প্যান্ডেল করা হয়েছে বাগানে। প্রথমে 888sport app download bd প্রদানের পালা। যারা বিভিন্ন শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে তাদের হাতে 888sport app download bd তুলে দেওয়া হলো। বেশিরভাগ ছিল বই।

এরপর দ্বিতীয় পর্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সূচি ঘোষণা করা হলো। ছড়ায় আমার নামও উচ্চারিত হলো। নিজের কানে নিজের নাম শুনে একটু ঘাবড়েই গেলাম। আনন্দ না হয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো। আর কি ব্যাপার প্রথমেই ডাক পড়ল আমার। আর আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আমি মাদ্রাসার ছাত্র নই। অতিথি888sport live chatী বলা চলে।

যেভাবে মাদ্রাসার শিক্ষক আমাকে শিখিয়েছিলেন সেভাবেই সব উপস্থাপন করি :

কাজের লোক : কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।

মৌমাছি মৌমাছি … দাঁড়াও না একবার ভাই …

এরপর এলো পীপিলিকা … তারাও এলো দল বেঁধে …

কেন জানি নির্ভয়ে পুরো 888sport app download apkটি আবৃত্তি করে গেলাম। একটুও তোতলামি আসেনি। নিজেই অবাক হলাম নিজের

কৃতিত্বে। চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গরমের দিনে বিকেল আর সন্ধ্যাটা মনোরম। হাওয়ায় তাপ নেই। শরীর জুড়িয়ে যায়। আর আমি তখন হাওয়ায় ভাসছি।

এটা আমার জীবনে প্রথম পাবলিক আপিয়ারেন্স। কয়েকশো দর্শকের সামনে আবৃত্তি করা।

এরপর আরো চমক ছিল। যারা দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিয়েছে তাদের জন্যেও আছে 888sport app download bd। প্রথমেই আমার নাম।

888sport app download apk আবৃত্তির জন্যে …

আমি 888sport app download bd পেলাম।

 সেটি একটি লম্বা নিবযুক্ত হ্যান্ডেল। দোয়াতে এই কলম ডুবিয়ে লিখতে হয়। নিবটা বেশ লম্বা ও সুচোলো। মাঝখানে একটা বৃত্তাকার ফাঁক, নিবটা চেরা। নিবকে আমরা বলতাম নিপ।

তখনকার দিনে এই হ্যান্ডেলের দাম ছিল ছ’পয়সা।

সেই ছ’পয়সার 888sport app download bd আমাকে সম্মান দিলো সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসার পক্ষ থেকে। আমি ছাত্র নই। বহিরাগত। ভাড়াটে 888sport live chatীর মতো। যাদের হায়ার করতে হয়। এখনো যখন এই ঘটনার কথা ভাবি, মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, আমি এই সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসার কোনোদিন ছাত্র হইনি। আমার বাবা এখানে পড়েছেন। পড়েছেন চাচা জিলানীও; কিন্তু আমার স্কুলে ভর্তি হওয়া মামাবাড়ি ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে এর পাশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও নির্মিত হয়েছে। দোতলা টানা পাকা বাড়ি। এই অঞ্চলের জন্যে খুবই উপযোগী। না হয় এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ব্যাহত হতো। কারণ হাই স্কুল খালনায়। খালনা ঝামটিয়া থেকে প্রায় ছ-সাত কিলোমিটার দূরে। বিশেষ করে মেয়েদের লেখাপড়ার এখানেই ইতি।

মনে পড়ে, আমার বড়খালার বড় মেয়ে মমতাজবুবু খালনা গিয়ে লেখাপড়া করতেন। বুবুর ফর্সা গোলাপি রং এখনো মনে পড়ে। তার তখন বাড়তি বয়স, কী সুন্দর। আমি মনে মনে ভাবতাম, মমতাজবুবুকে বিয়ে করব। সেই ছ-সাত বছর বয়সে অনেক দূর এগিয়ে ভেবেছি। মুসলিম পরিবারে জ্ঞাতি ভাইবোন বিয়েতে কোনো বাধা নেই। যাকে আজকে নৃতত্ত্বের ভাষায় বলা হয় এনডোগেমি বা অন্তর্গোত্র বিবাহ।

খালনার পাশ দিয়ে বড় খালটা বেশ চওড়া, তাই নদী নদী ভাব। এখানে কাঠের একটা পুল ছিল। নদীর ওপারে ট্যাক্সি থাকত। যারা বাগনান স্টেশন যেত, তাদের জন্যে অপেক্ষা করত। সেই সময়কার ট্যাক্সি মানে একটা কালো মোটরগাড়ি। ভেতরে কাঠের বেঞ্চ বসানো। শুধু ড্রাইভারের পাশে বসার সৌভাগ্য হলে গতি জুটত। এই বেঞ্চে গাদাগাদি করে আটজন বসত। সে এক মজার যাত্রা। তবু তাতেই কী শান্তি। ধানের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে পঙ্খিরাজ। বাগমান স্টেশন হলো গন্তব্য। দূরত্ব প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলো হবে।

বাগনান স্টেশন জমি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে। গাড়ি ঢালের শেষে থেমে যেত। ডানপাশে কয়েকটা চা আর মুদি দোকান।

মোটরগাড়ি পৌঁছার কয়েক মিনিট পর রেলগাড়ি ঝমাঝম করে পৌঁছত। একটা বিশাল দৈত্য যেন এসে দাঁড়াল। আমাদের সেই বালক বয়সে সবকিছু বড় লাগত। আসলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত জগৎকে নিজের ক্ষুদ্রতা দিয়ে মাপে। তাই সবকিছু বড় মনে হয়। বড় হয়ে গেলে নিজের কাছেই নিজে হাসির পাত্র হয়ে যায়। অনেক কিছু যা আগে খুব বড় মনে হতো পরে দেখা গেল তা অত বড় ছিল না। ওটা যেমন ছিল তেমন আছে শুধু মানুষটা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা মানবসমাজে সর্বজনীন।

ফনেচাচার বদৌলতে আমি সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসার সঙ্গে পরিচিত হলাম। আর পুরো সবলসিংহপুর জয় করে নিলাম। কিন্তু এখন বুঝি দেশভাগের ফলে আমার সেই কুঁড়ি কবেই শুকিয়ে গেছে। ফুল পশ্চিবঙ্গে ফোটেনি। ওখানে ছিল কুঁড়ি। পূর্ববাংলায় এসে হলো বিকশিত। মানবসমাজে স্থানান্তর-গমন নতুন ব্যাপার নয়। যুগে যুগে মানুষ নানা কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। যেমন বর্তমানে 888sport appsে প্রায় পনেরো-ষোলো লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত। গাজায় চলছে একই খেলা। মার্কিন মুল্লুক থেকে কত মানুষ বিতাড়িত হচ্ছে। অথচ একসময় তারা আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে গেছে। যাকে বলে কিডন্যাপ। মানুষের জীবন অনেকটা পানার মতো। ভেসে চলেছে। প্রকৃতির ছোবলে মানুষ অহরহ স্থানবদল করে। যুদ্ধ আর একটা বড় কারণ। মনে পড়ে ১৯৭১ সালে এক কোটি বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে আশ্রয় নিয়েছিল। এটা মাত্র পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। অনেকেই এটা ভুলে যাননি।

ফনেচাচার সঙ্গে আমার অল্পদিনের বাল্যকাল। দেশভাগের ফলে বাবার কর্মস্থল সরকারি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে স্থান লাভ করে। তাই আমরা – ভাইবোন ও মা চট্টগ্রাম গমন করি। ফনেচাচা আর দাদি রয়ে গেলেন সবলসিংহপুরে।

 বেশ কয়েক বছর পর ফনেচাচা চট্টগ্রাম আসেন। সঙ্গে দাদি বা ঠাকুরমা। সে এক ভিন্ন অধ্যায়।