888sport app download apk latest version : সম্পদ বড়ুয়া
পথ বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে তার। যখনই সে এক পা সামনে এগোয়, ধুলায় আচ্ছন্ন ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী রাগত চেহারা নিয়ে তার পেছনে উঠে আসে আর ধীরে ধীরে একসময় তা থিতু হয়ে বসে। তবে ধুলার একটা পাতলা আবরণ বাতাসে থেকে গিয়ে ধোঁয়ার মতো চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে হাঁটতে থাকে, যদিও ধুলোবালি আর পায়ের নিচে মাটির দিকে তার তেমন মনোযোগ নেই। প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হচ্ছে, পথের কষ্ট আর বৈরিতা সে বারবার টের পাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, সে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে, বরং একেবারে উল্টো; সে সামনে বরাবর চোখ রেখে হাঁটছে যেন যে-কোনো সময় একটা পরিচিত দৃশ্য তার সামনে আসে যা তাকে বন্ধুর মতো সম্ভাষণ জানাবে, বলবে – সে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু রাস্তা বিছিয়েই থাকল অনেক দূর পর্যন্ত।
সে লাফ দিয়ে দিয়ে দ্রুত পা ফেলছে। তার পরনে একেবারে ছেঁড়া আর জরাজীর্ণ পুরনো সাদা কোটটার পাশ ধরে বাঁ-হাতটা ইচ্ছেমতো দোল খাচ্ছে। ডান হাতটা কনুই পর্যন্ত এসে বাঁক নিয়ে পিঠের দিকে হালকাভাবে ঝুলে থাকা একটা ছোট্ট বান্ডিলের ফিতার সঙ্গে ধরা আছে। সুতি কাপড়ে ভালো করে জড়ানো বান্ডিলটার ওপর একসময় লাল ফুলের ছাপ থাকলেও এখন তা একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তার পায়ের ছন্দের সঙ্গে মিল রেখে তা এপাশ-ওপাশ দোল খাচ্ছে। ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক থাকার বছরগুলোতে যে তিক্ততা আর কষ্ট সে পেয়েছে সেগুলোর চিহ্নই ওই বান্ডিলে রাখা আছে। বাড়ির পথে যেতে যেতে সে মাঝেমধ্যে সূর্যের দিকে তাকায়। লতাগুল্মে 888sport app জমির প্রান্তে সে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় যেখানে শস্য, ভুট্টা, শিম, মটরশুটি রুগ্ণ চেহারা নিয়ে এমনভাবে হাজির হয়েছে যেন সবকিছু তার কাছে অপ্রিয়। সারা দেশটাই মনে হচ্ছে নিষ্প্রভ, একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর। কামাউর কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তার মনে পড়ে গেল, কেনিয়ায় মউ মউ জরুরি অবস্থার আগে গিকিয়ো সম্প্রদায়ের অতিকর্ষণে বিক্ষিপ্ত বসতি এলাকার এলোমেলো চেহারাটা এলাকার বিস্তৃত সবুজ মাঠের তুলনায় কতটা যে মলিন।
পথ এবার বাঁ-দিকে বেঁকে গেছে। কামাউ ক্ষণিকের জন্য দ্বিধায় পড়ে যায়। পরে সে মনস্থির করে ফেলে। এই প্রথমবার তার চোখ ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন সে ওই পথ ধরে চলতে শুরু করে, যে-পথ তাকে দুই পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ উপত্যকা পেরিয়ে গ্রামে নিয়ে যাবে। শেষে যখন সে বুঝতে পারল যে বাড়ির কাছাকাছি এসেছে, তার ক্লান্ত পথিকের উদাস দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য তার চোখ থেকে চলে গেল। অনেক দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পর মনে হবে, সবকিছু তাকে কিছু সময়ের জন্য একেবারে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করে গেছে। এই যে দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি উপত্যকা, তার চারপাশের বৃক্ষরাজি, সবুজ ঝোপঝাড় আর লকলকিয়ে ওঠা গাছ – এসবের সঙ্গে আশপাশে গ্রামের এক বিরাট বৈপরীত্য রয়েছে। কারণ এখানে সবুজ ঝোপঝাড় আর বৃক্ষেরা বেড়ে উঠছে। এর মানে এই যে, হোনিয়া নদী এখনো বয়ে যাচ্ছে। নদীর দিকে না তাকানো পর্যন্ত এ-সত্যটা সে খুব একটা বিশ্বাস করতে পারছে না আর তাই সে দ্রুত পা চালায়। নদীটি তার জায়গাতেই আছে আর এখনো প্রবহমান। এই হোনাই নদীতে সে প্রায়ই স্নান করতো। পুরো ন্যাংটো হয়ে এর শীতল স্বচ্ছ জলে ঝাঁপ দিত। যখন সে দেখত শীলাখণ্ডের চারপাশে সাপের মতো এর চলাচল, শুনত এর ক্ষীণ কুলুকুলু ধ্বনি, তখন তার প্রাণ উষ্ণতায় ভরে উঠত। তার সকল সত্তা জুড়ে একটা বেদনাঘন আনন্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে আর ক্ষণিকের জন্য সেইসব দিনকে আকুলভাবে কামনা করছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সে। সম্ভবত নদী তার মনের এসব কষ্টের বিষয় আঁচ করতে পারেনি; ভাবতে পারেনি নদী-তীরবর্তী যে বিশাল পৃথিবীটা পড়ে আছে সেটা একসময় এই বালকের কাছে সবটুকু ছিল। যতই সে হোনাইয়ের কাছাকাছি যাচ্ছে, ততই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অন্য কোনো কিছুর তুলনায় একে তার আত্মীয় মনে হচ্ছে।
নদীর ধারে দলবেঁধে মহিলারা জল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সে খুব উৎসাহ বোধ করল কারণ পাহাড়ের এই উঁচু অবস্থান থেকে মহিলাদের মধ্যে দু-একজনকে সে চিনতে পেরেছে। সেখানে মধ্যবয়সী মহিলা ওয়ানজিকো আছে যার বধির ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর এ-ঘটনা ঘটেছে তার নিজের গ্রেফতার হওয়ার আগে আগে। মহিলাকে গ্রামে সবাই ভালোবাসে। সবার কাছে সে সদা হাস্যময়ী। সবার জন্য সে খাবারের ব্যবস্থা করত। তারা কি কামাউকে সাদরে গ্রহণ করবে? একটা বীরোচিত অভ্যর্থনা কি সে পাবে? তার ধারণা সেরকমই। এই পাহাড়ি উপত্যকায় সে কি সবসময় সবার প্রিয় ছিল না? এ-এলাকায় ভূমি অধিকারের জন্য সে সংগ্রাম করেনি? তার এখন ইচ্ছে হচ্ছে দৌড় দিয়ে চিৎকার করে বলতে, ‘আমি এসেছি, আমি তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি।’ কিন্তু সে থেমে গেল। কারণ সে তো এখন একজন পুরুষ।
‘তুমি ভালো আছো তো?’ মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন বলে ওঠে। অন্যরা ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন তার আগমন তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। কেন? এতদিন ক্যাম্পে ছিল বলে? তার উৎসাহে ভাটা পড়ায় সে দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চায়, ‘তোমরা কি আমাকে মনে করতে পারছো না?’ তারা আবার ওর দিকে তাকালো। তাদের দৃষ্টিতে নিরুত্তাপ আর রুক্ষ ভাব, মনে হচ্ছে অন্য সবকিছুর মতো, তারাও যেন ইচ্ছা করেই তাকে চিনতে বা আপন করে নিতে অস্বীকার করছে। শেষমেশ ওয়ানজিকোই তাকে চিনতে পারলো। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কোনো প্রাণ বা উচ্ছ্বাস নেই যখন সে বললো, ‘ও, তুমি তো কামাউ? আমরা ভেবেছি তুমি …।’ মেয়েটি আর কথা বললো না। মেয়েটির মধ্যে সে ভিন্ন কিছু বিষয় লক্ষ করলো – বিস্ময়? ভয়? সে ঠিক বলতে পারলো না। তার দিকে সবাই ত্বরিত শাণিত দৃষ্টি মেলে দেখছে। বুঝতে পারলো, কোনো একটা গোপন বিষয় তাদের সবাইকে ঘিরে রেখেছে, যাতে তার প্রবেশাধিকার নেই।
‘মনে হয় আমি আর তাদের কেউ নই’ – এই তিক্ত অনুভূতিটা নিয়ে সে ভাবতে থাকে। তবে তারা তাকে নতুন গ্রামের কথা শোনালো। সেই পাহাড়ি এলাকার চারপাশে হালকাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুঁড়েঘরগুলো এখন আর চোখে পড়ে না।
অনেকটা তিক্ত ধারণা আর প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি নিয়ে সে তাদের ছেড়ে সামনে চলতে শুরু করে। পুরনো গ্রামটাও তার জন্য বসে থাকেনি। তবে পুরনো বাড়ি, বন্ধুবান্ধব আর চারপাশের পরিবেশের কথা ভেবে মনের ভেতর একধরনের 888sport sign up bonusকাতরতা অনুভব করে। সে ভাবে তার বাবার কথা, মার কথা, আর … আর … সাহস পায় না সেই মেয়েটির কথা ভাবতে। কিন্তু হয়তো এসবের জন্যই মুথোনি, ঠিক আগে যেমন ছিল, তেমনি তার মনে ফিরে ফিরে আসে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তাকে কাছে পাওয়ার একটা প্রচণ্ড টান অনুভব করে, সারা শরীরে বয়ে যায় উষ্ণ শিহরণ। সে দ্রুত পা চালাতে থাকে। বউয়ের কথা মনে পড়ার পর থেকে সে গ্রামের মহিলাদের বিষয়টা একেবারে ভুলে গেল। বউয়ের সঙ্গে সে মাত্র দু-সপ্তাহ কাটিয়েছে। তারপর কলোনিয়েল ফোর্স তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অন্য অনেকের মতো তাকে তড়িঘড়ি করে বিনাবিচারে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। সেই সময়টায় সারাক্ষণ সে শুধু নিজের গ্রামের কথা, সুন্দরী বউটার কথা ভেবেছে।
কয়েদখানায় অন্যরাও তার মতো ছিল। তারা তাদের বাড়িঘর ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে আলাপ করত না। একদিন সে মুরাঙ্গা থেকে আসা অন্য এক আটক বন্দির পাশেই কাজ করছিল। হঠাৎ এনজরোগে নামে সেই বন্দিটা পাথর ভাঙার কাজ থামিয়ে দিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে। ক্লান্ত আর অবসাদগ্রস্ত তার চোখদুটো যেন কোনো সুদূরের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কী হলো ভাই? তোমার কী হয়েছে?’ কামাউ জানতে চাইল।
‘আমার বউ। আমি যখন তাকে রেখে আসি তখন সে সন্তানসম্ভবা। তার এখন কী অবস্থা – আমার কোনো কিছু জানা নেই।’
আরেকজন আটক বন্দি তার সামনে এসে মুখ খুললো – ‘আমার হয়েছে কী, আমার বউকে পেটে বাচ্চাসহ রেখে এসেছি। তখনো তার ডেলিভারি হয়নি। আমরা সবাই খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু ওইদিনই আমাকে গ্রেফতার করা হলো …’
তারা এভাবেই কথা চালিয়ে যেত। সবাই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকত – তাদের বাড়ি ফেরার দিনটি কবে আসবে। তাদের জীবন তখন নতুন করে শুরু হবে।
কামাউকে যখন তার বউকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল, তখন তাদের কোনো সন্তান ছিল না। কনে-পণ দেওয়ার কাজটাও তখন সে শেষ করতে পারেনি। তবে এখন সে বাড়ি যাবে, নাইরোবিতে গিয়ে কাজের সন্ধান করবে আর মুথোনির মা-বাবাকে কনে-পণের বাকি টাকা পরিশোধ করবে। সত্যিকার অর্থে জীবনটা নতুন করে শুরু করতে হবে। তাদের আশা একটা ছেলে হবে এবং তাকে নিজের বাড়িতেই লালনপালন করবে। চোখের সামনে এসব আশার আলো নিয়ে সে দ্রুত পা চালায়। তার দৌড়াতে ইচ্ছে করছে – না, না, বাড়িতে দ্রুত ফেরার জন্য উড়তে পারলে ভালো হতো। পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি সে চলে এসেছে। তার বড় ইচ্ছে ভাইবোনদের কারো সঙ্গে যদি পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তারা কি তাকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে? তখন সে কিন্তু তাদের কোনোভাবেই সবকিছু বলবে না – যেমন তাকে কীভাবে মেরেছে, তার অতীত ইতিহাস তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, রাস্তার কাজে কঠোর পরিশ্রম করা আর রাস্তা বানানোর জন্য পাথর আনার সময় সার্বক্ষণিক প্রহরীর নজরে থাকা যে কি না কাজে একটু শিথিলতা দেখলেই লাথি মারার জন্য সদাপ্রস্তুত ছিল – এসব আর কী। সত্যিই সে অনেকভাবে অপমানিত হয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধ করেনি। এসবের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? তার মন আর যৌবনের সকল শক্তি, তেজ বিদ্রোহ করেছিল, ক্রোধ আর তিক্ততা নিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
সাদা লোকগুলো একদিন অবশ্যই বিদায় নেবে!
একদিন তার নিজের মানুষেরা মুক্ত হবে।
তখন – তখন সে কী করবে জানে না। তবে যাই হোক, বুকে তিক্ততা নিয়েই নিজেকে আশ্বস্ত করে, কেউ আর তার পৌরুষকে তাচ্ছিল্য করতে পারবে না।
পাহাড়ে ওঠার পর এবার সে থেমে গেল। নিচে বিস্তৃত সমতলভূমি। তাদের নতুন গ্রামটি সামনে দেখা যাচ্ছে – সারি সারি নিবিড় শক্ত মাটির কুঁড়েঘরগুলো দ্রুত অপস্রিয়মাণ সূর্যের নিচে এই বিস্তীর্ণ সমতলভূমির ওপর গুটিসুটি মেরে আছে। বেশ কিছু কুঁড়েঘর থেকে কালো নীল ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছে এবং একটা অন্ধকার কুয়াশার আবরণ সৃষ্টি করে গ্রামের ওপর ভাসছে। দূরে সেই গভীর রক্ত-লাল অস্তগামী সূর্য আঙুলের মতো লম্বা আঁকাবাঁকা আলো পাঠিয়ে পাতলা আবরণ বানিয়েছে আর দূরের পাহাড়গুলোকে আচ্ছাদিত করে ধূসর কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
গ্রামে প্রবেশের পর সে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে অনেক নতুন মুখের দেখা পেল। তাদের সম্পর্কে তার জানার খুব আগ্রহ। শেষে সে তার বাড়িটা খুঁজে পেল। উঠানে ঢোকার পথে এসে সে দাঁড়ালো আর বুকভরে নিশ্বাস নিল। এটা তার বাড়ি ফেরার মুহূর্ত। তার বাবা একটা তিনপায়া চৌকির ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার। বৃদ্ধ বাপটাকে দেখে কামাউর মন করুণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু ছেলের ফিরে আসাটা তাকে যেন দেখতে না হয় –
‘বাবা!’
বৃদ্ধ লোকটি কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ছেলের দিকে অদ্ভুত এক শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কামাউর আর তর সয় না। সে বিরক্ত আর ভেতরে ভেতরে রুষ্ট হয়ে ওঠে। বাবা কি তাকে দেখতে পায়নি? তার আচরণ নদীর ধারের সেইসব মহিলার মতোই কি নয়, যাদের কামাউ আসার পথে দেখতে পেয়েছিল?
রাস্তায় ন্যাংটো, আধা ন্যাংটো ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। তারা একে অন্যের দিকে ধুলো ছুড়ে মারছে। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, মনে হচ্ছে চাঁদের আলো এসে পড়বে।
‘বাবা, আমাকে কি তোমার মনে পড়ছে না?’ তার মনের ভেতর আশা নিবু-নিবু। নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তখনই সে দেখল বাবা হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছে আর পাতার মতো কাঁপছে। এবার ছেলের দিকে অবিশ্বাস্যভাবে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে-চোখে রয়েছে ভয়ের অভিব্যক্তি। তার মা সামনে এলো, ভাইরাও এসেছে। তারা তার চারপাশে এসে ভিড় জমালো। বৃদ্ধা মা তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
‘আমি জানতাম আমার ছেলে ঠিক ফিরে আসবে। আমি জানতাম সে মারা যায়নি।’
‘কেন? আমি মারা গেছি কে বললো?’
‘ওই কারানজা, নিজগুর ছেলে।’
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কামাউর কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সে বুঝতে পেরেছে কেন তার বাবা কাঁপছিল। নদীর ধারে মহিলাদের আচরণও তার কাছে এখন পরিষ্কার। কিন্তু একটা বিষয় তাকে খুব ভাবাচ্ছে – সে তো কখনো কারানজার সঙ্গে একই ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকেনি। যাই হোক, সে তো ফিরে এসেছে। এখন সে দেখতে চায় তার প্রিয় মুথোনিকে। এখনো সে কেন বেরিয়ে আসছে না? কামাউ চিৎকার করে বলতে চায় – ‘আমি এসেছি মুথোনি, আমি এখানে।’ চারদিকে দৃষ্টি মেলে সে তাকালো। মা কিন্তু ছেলের মনের ভাব বুঝতে পেরেছে। বৃদ্ধা তার নিজের মানুষের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে শুধু বলল – ‘মুথোনি চলে গেছে।’
কামাউ অনুভব করল তার পেটের ভেতরটা যেন ঠান্ডায় জমে গেল। গ্রামের কুঁড়েঘর আর নিষ্প্রাণ জমিজমার দিকে সে চেয়ে থাকল। অনেক প্রশ্ন তার করার ইচ্ছে কিন্তু সাহস হয় না। মুথোনি চলে গেছে – এটা সে এখনো বিশ^াস করতে পারছে না। তবে নদীর ধারে মহিলাদের চোখের চাহনি, তার মা-বাবার মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে মুথোনি চলে গেছে।
‘মেয়েটি আমাদের কাছে ভালো মেয়ের মতোই ছিল’ – তার মা ব্যাখ্যা করছে। ‘সে তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিল, অনেক ধৈর্য ধরে সকল কষ্ট সহ্য করেছে। তখনই কারানজা এলো আর বললো, তুমি মারা গেছো। তোমার বাবা তাকে বিশ্বাস করেছে। তোমার বউও তা বিশ্বাস করেছে। সে এক মাস তোমার জন্য শোকে কাতর ছিল। কারানজা নিয়মিত আমাদের বাড়ি আসতো। সে তো তোমার বয়সী, তুমি জানো এবং সে আমাদের সামাজিক গোত্রেরই। তখন বউয়ের একটা সন্তান জন্মালো। আমরা তাকে রাখতে পারতাম। কিন্তু জমিজমা কই? খাবার কোথায়? তাছাড়া ভূমি সংহতকরণের পর থেকে আমাদের নিরাপত্তার শেষ ভরসাটুকুও চলে গেল। আমরা কারানজাকে তোমার বউয়ের সঙ্গে যেতে বলেছি। অন্য মহিলাদের অবস্থা আরো শোচনীয় – তারা শহরে গেছে। শুধু দুর্বল আর বৃদ্ধরা এখানে পড়ে আছে।’
কামাউ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার পেটের ভেতর যে-শীতল ভাবটা ছিল সেটা ধীরে ধীরে তিক্ততায় পর্যবসিত হচ্ছে। সবার প্রতি বিরূপ ধারণা তার মনে – বাবা, মা, সবার। সকলেই তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সবাই তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে এ-কাজ করেছে। আর কারানজা তো সবসময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সত্যি বলতে কী, পাঁচ বছর তো কম সময় নয়। কিন্তু কেন মুথোনি চলে গেল? তারাও কেন তাকে যেতে দিলো? সে এসব নিয়ে কথা বলতে চায়। হ্যাঁ, কথা বলতে চায় আর সবকিছুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চায় – নদীর ধারের ওই মহিলাদের, পুরো গ্রাম এবং গ্রামে যারা বাস করে সবার বিরুদ্ধে। কিন্তু সে পারে না। এ না-পারার কষ্ট যেন তার নিশ্বাস চেপে ধরেছে।
‘তোমরা … তোমরাই আমার নিজের যা, তা ছুড়ে ফেলে দিয়েছো ?’ কামাউ ফিসফিস করে বলে।
‘শোনো … , সোনা আমার, সোনা …।’
আকাশজুড়ে বড় হলদে চাঁদ সবকিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বুকভরা তিক্ততা নিয়ে অন্ধের মতো কামাউ দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। হোনিয়া নদীর কাছে এসে সে থামলো। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সে দৃষ্টি প্রসারিত করল। তার চোখ সামনে নদীর দিকে নয়, বরং সেই আশা-ভরসার দিকে যা ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে গেছে। নদী দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে নিরন্তর একঘেয়ে কুলুকুলু ধ্বনি। বনের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকা আর পোকামাকড় অবিশ্রান্ত আওয়াজ করছে। উপরে আকাশে চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। গায়ের কোটটা সে খুলে ফেলার চেষ্টা করল। যে ছোট্ট বান্ডিলটা এতক্ষণ শক্ত করে ধরে রেখেছিল তা পড়ে গেল। ওটা গড়িয়ে গড়িয়ে নদীর তীর বেয়ে নিচে নেমে গেল। কী হচ্ছে তা বোঝার আগেই কামাউ দেখল বান্ডিলটা নদীর জলে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য সে স্পৃষ্ট হলো, ভাবলো ওটা ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু কী আর দেখাবে তার … হায়, এত তাড়াতাড়ি সে ভুলতে বসেছে? তার বউ তো চলে গেছে। এসব ছোট ছোট জিনিস যা অবাক করার মতো তাকে তার বউয়ের কথা মনে করিয়ে দিত এবং যা সে এত বছর সযত্নে রেখে দিয়েছে, সব চলে গেল। সে জানে না কেন, তবে যে কারণেই হোক, তার মনে হলো, সে ভারমুক্ত হয়েছে। ডুবে মরার চিন্তাটা তাকে ছেড়ে গেল। সে আবার তার কোটটা গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলল – ‘সে কেন আমার জন্য অপেক্ষা করবে? সব পরিবর্তন কেন আমার জন্য প্রতীক্ষায় থাকবে?’
নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো : আফ্রিকান ঔপন্যাসিক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গোর (১৯৩৮-২০২৫) জন্ম কেনিয়ার কামাদুরায়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এবং শিক্ষাবিদ। মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ এ-লেখক লেখালেখির জন্য প্রায় এক বছর জেল খেটেছেন। তাঁর শিক্ষাজীবন কেটেছে কেনিয়ায়। উগান্ডার কাম্পালার ম্যাকারেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 888sport live footballে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, ইয়েল (Yale) বিশ্ববিদ্যালয় ও ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তাঁর লেখা নাটক The Black Hermit সবাইকে মুগ্ধ করেছে। উল্লেখযোগ্য রচনা – Weep Not Child (1964), The River Between (1965), Grain of Wheat (1977)।
তিনি তাঁর প্রথম 888sport alternative link Weep Not Child-এর জন্য ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কোর ফার্স্ট প্রাইজ পান। ২০০১ সালে তিনি ননিনো আন্তর্জাতিক 888sport live football 888sport app download bd লাভ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, 888sport live football শুধু একটি দেশের সংস্কৃতি নয়, মানুষের সৃজনশীলতার অনেকগুলো প্রকাশভঙ্গির একটি, যা মূলত সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লেখালেখির একপর্যায়ে এসে তিনি ইংরেজি ছেড়ে দিয়ে নিজ ভাষা গিকুই (Gikuya)-তে 888sport live football রচনা শুরু করেন। Devil on the Cross বইটি তাঁর নিজের অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রথম 888sport alternative link। ২০২৫ সালের ২৮শে মে নগুগি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.