ফজলুর শুধু মনে আছে বাসটা চলছিল একটা বাঁশঝাড়ের গা ঘেঁষে, ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্য দিয়ে। বাঁশঝাড়ে ভূত থাকে বলে দাদি ভয় দেখাতেন, ভয়টা সে পেতও, তবে সন্ধ্যার আঁধার নামলে। কিন্তু সেদিন বাসটা চলছিল ভরদুপুরে, তাছাড়া সে বসেছিল মার হাত ধরে। মা অনেক হাসতেন, তার হাসি ফজলুর সব ভয় দূর করে দিত। ভয় ছিল না বলে ফজলু বাঁশঝাড়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। একসময় নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিল, যেমন ঘুমিয়ে পড়েছিল বাসের ড্রাইভার, অথবা সেরকমই আমাদের ধারণা। একটা শব্দে তার ঘুমটা ভেঙেও গেল। শব্দটা ছিল তার ছয় বছরের জীবনের ওপর একটা পাহাড় ভেঙে পড়ার।
পাহাড় ভাঙার জন্য দাদি বজলুকে, অর্থাৎ ফজলুর বাবাকে দোষ দিতেন। কেন সে ভরা বর্ষায় বন্ধুর বিয়ে খেতে ছেলে-বউসহ একটা ভাঙা বাসে চড়ে নিয়ামতপুর রওনা হবে? সেই বন্ধুকে দাদি কখনো চোখে দেখেননি, এমনি দূরে দূরে থাকত লোকটা। অনেকদিন ধরে সৌদিতেও ছিল লোকটা। দশদিনের ছুটিতে এসে কেন বজলুকেই ডাকতে হবে বিয়েতে যেতে?
দাদি বলেন, ফজলুর বাবা-মার লাশ লোকটাই অবশ্য বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল; ফজলুকেও – অথবা যেটুকু ফজলু তখনো জাগা ছিল। দাদির ধারণা, ফজলু যে কোনোদিন মানুষ হয়নি, সেটি ওই বর্ষাদিনে তার জীবনের ওপর একটা পাহাড় ভেঙে পড়ার জন্য।
তোরে আমি অনেক চেষ্টা করছি ফজলু, মানুষ করতে। পারলাম না, দাদি ফজলুকে বললেন। আমাদের হিসাবে হাজার তিনশোবারের মতো।
ফজলু পুকুর থেকে বালতি ভরে পানি তুলে একটা কাটা ড্রামে রাখছে। ড্রামের পাশে দাদির প্রিয় গরুটা ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে গোসল দিতে হবে। গরুটা একটা গাভী, দাদি যার একটা নাম দিয়েছেন, ফুলি। তার কড়া বাদামি চামড়ায় সাদা কিছু দাগ, দেখলে মনে হয় কোনো বুনো ফুল। গাভীটা বিষণ্ণ, তার বাছুরটা মারা গেছে। ফজলু সকাল সকাল গাভীটার দুধ দুইয়েছে। সেই দুধ কিছু গরম করে সে খেয়েওছে। এখন তাকে গোসল দিলে তার বিষণ্ণতা কমবে। দাদি তাকে বলেছেন।
পাড়ার লোক ফজলুকে ভয় পায়। ছেলেটা একটা গুন্ডা, তার মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব, কাউকে সে পরোয়া করে না, এমন কথা প্রতিবেশী ইন্তাজ আলি সবাইকে বলেন, বিশেষ করে ফজলুদের বাড়ির তিনটি মরাগাছ তিনি লোক লাগিয়ে লাকড়ির জন্য কেটে নেওয়ার পর সে যেভাবে তার বাড়িতে গিয়ে তা-ব চালিয়েছিল, তারপর। পাড়ার লোক অবশ্য এখন খুশি, ফজলু নারায়ণগঞ্জ থাকে। মাঝেমধ্যে আসে, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বেরোয় না। আগে যখন গ্রামে ছিল, মানুষ তার সামনে পড়তে চাইত না। ফজলুর এক মামা, যিনি পুলিশে চাকরি করতেন, এবং চাকরি চলে গেলে বাড়িতেই থাকেন, তাকে গুন্ডা থেকে ‘মানুষ’ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এই মামাই তাদের দেখাশোনা করেছেন, তাদের বাড়িটা যে দখল হয়ে যায়নি, সেটিও তার জন্য। ফজলু সেজন্য মামার সামনে বেয়াদবি করে না; কিন্তু তার কোনো কথা শোনার দায় তার আছে, তা বিশ্বাস করে না।
একটা মানুষের সামনেই শুধু ফজলু কখনো মেজাজ দেখায় না এবং তিনি হচ্ছেন তার দাদি। তার জীবনের ওপর পাহাড় ধসে পড়ার পর তাকে টেনেটুনে তুলেছেন দাদি। তাকে আগলে রেখেছেন। তাকে সঙ্গ দিয়েছেন। সেবা দিয়েছেন। তার দিকে তাকিয়ে দাদি বললেন, বাপের মতো অত চওড়া-লম্বা হইতে গেলি কেনরে ফজলু? চওড়া লম্বা ছিল বইলা তো জানালায় আটকায়া গেল, বাইর হইতে পারল না।
গরুটার গা ডলতে ডলতে ফজলুর মন কিছুটা খারাপ হলো। বাছুরটা মুখে ফেনা তুলে আচমকা মরে গেল। ফজলু নারায়ণগঞ্জ ছিল। খবর পেয়ে বাড়ি আসতেই দাদি বললেন, ফুলির বাচ্চাটা মইরা গেছেরে ফজলু, এই দুঃখে ফুলিও যদি এখন যায়?
ফুলি কি বাসে করে বাচ্চাটাকে নিয়ে নিয়ামতপুর যাচ্ছিল?
তবে ফজলু জানে, কারো মারা যাওয়ার দুঃখে যদি কেউ মারা যেত, তবে সে-ই তো অনেক আগে যেত। অনেক বছর মার মুখটা তার যখন-তখন মনে ভেসে উঠত, তার হাসিটা কানে বাজত। তখন সে ঠিক থাকতে পারত না। চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে থাকত – ফুলি এখন যেমন থাকে, চোখে পানি নিয়ে – না হয় বাইরে গিয়ে পুকুরের কোনার বাঁশঝাড়টাতে একটার পর একটা রাগী ঢিল মারত।
একসময় ঝিম মারা থেকে বেরিয়ে সে রাগের ঝাপটায় পড়ল। রাগটা কার ওপর, সে জানে না। হয়তো বাঁশঝাড়গুলির ওপর,
অথবা বাঁশঝাড়ে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকা ভূতগুলির ওপর। একসময় তার বিশ্বাস হলো নিয়ামতপুর যাওয়ার পথের বাঁশঝাড়ের ভূতগুলিই তার ওপর ভেঙেপড়া পাহাড়টা কেটেছিল, এজন্য এক সন্ধ্যায় সে সাইকেল চালিয়ে ওই বাঁশঝাড়ে গিয়ে তা-ব করেছে। ঢিল ছুড়েছে। বাঁশ কেটেছে। কচি বাঁশে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছে। তাতে আগুন না জ্বললেও ধোঁয়া হয়েছে বেশ। রাতঘুমে থাকা পাখিগুলি জেগে উঠে হইচই করেছে।
ঘণ্টাদুয়েক বাঁশঝাড়ে তুফান তুলে সে ফিরেছে। সাইকেলটা বন্ধু মনুকে ফেরত দিয়ে বাড়িতে এসে দা-টা রান্নাঘরের দেয়ালে গুঁজে পুকুরে নেমে গোসল করেছে। গোসল করতে করতে তার চোখে ভেসেছে একটা ডোবা। ফজলুর ওপর নেমে আসা পাহাড়টা ওই ঝিরঝির বৃষ্টিদিনের বাসটাকে এক ধাক্কায় বাঁশঝাড়ের উল্টোদিকের ডোবায় ফেলে দিয়েছিল। গত তিন-চার বছরে তাকে কয়েকবার নিয়ামতপুর যেতে হয়েছে। তার বাবার বন্ধু তাকে টাকা-পয়সা দিয়েছেন, জামা-জুতা দিয়েছেন, একবার দাদির জন্য শাড়ি দিয়েছেন। ফজলু নিয়েছে, কিন্তু দাদি ছুঁয়েও দেখেননি সেই শাড়ি। সেটি গেছে রইসুন বুয়ার ভাগে। রইসুন বুয়া আরেক মানুষ, যিনি ফজলুর রাগটা তেমন দেখেননি। নিয়ামতপুরে যাওয়া-আসার পথে ফজলু শুধু বাঁশঝাড়ের দিকেই তাকিয়ে থেকেছে। কোনো ডোবার দিকে তার চোখ যায়নি।
ফুলির গা ডলতে ডলতে ফজলু খেয়াল করল, গাইটা চোখ বুজেছে, এবং চোখের কোনা বেয়ে পানি পড়ছে। ফজলু বুঝল, গাইটা এখন তার মতোই 888sport sign up bonusর ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচাতে চোখ বোজার রাস্তা নিয়েছে।
গরুর কি কোনো 888sport sign up bonus থাকে? থাকলে কি তার মতো টুকরো টুকরো, এলোমেলো?
দাদি বসে ডাঁটাশাক বাছছেন। ডাঁটাশাক ফজলুর প্রিয় খাবার। আর ট্যাংরা মাছ। রইসুন বুয়ার হাঁটতে কষ্ট হয়, তারপরও ট্যাংরা মাছ এনে দিয়ে গেছেন, সাত সকালে। দাদি জিজ্ঞেস করলেন, তুই যেহানে থাহিস, জায়গাটার নাম কী?
বন্দর। অনেকবার কইছি দাদি।
হ। তা বন্দরে কোনো সুন্দর মাইয়া নাই? চোহে পড়ে না? এই প্রশ্নটা দাদি তাকে গত কয়েকমাসে অন্তত ত্রিশবার জিজ্ঞেস করেছেন। ফজলু হাসল, বলল, চোহে পড়লে তোমারে জানাইমু, দাদি।
হ। এই গেরামের, আশপাশের কুনু গেরামের, কুনু মাইয়া তো তোরে বিয়া করব না।
বিষয়টা ফজলুর জন্য স্বস্তির। সে কথা বাড়ায় না।
পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বাজে। ফজলু ধরে, এবং ফুলিকে চোখ বুজে 888sport sign up bonusর ঝাপটা সামলাতে দিয়ে একটু দূরে হেঁটে যায়। ফোন করেছে তার বন্দরের বন্ধু, নাম খাদেম। সে বলল, ওরে ফজলু, ভালো খবর। ম্যানেজ করা গেছে। অহন সব মোটামুটি কিলিয়ার। তুই আইতে পারিস।
ঠিকাসে, ফজলু বলল।
শুন, শুন, কথা আছে, খাদেম বলল, মনুরে ছুটাইবার রাস্তা পাওয়া গেছে। অবশ্য তাতে খরচ দেড় লাখ। বস আধা দিবেন, বাকিটা আমাগো ম্যানেজ করতে হইব। তোর ভাগে পড়ছে দশ। টেহাটা কাইল লাগব। একটা নম্বর এসেমেস কইরা দিতাছি। ওই নম্বরে বিকাশ কইরা দিস। দুইবারে করিস, সকালে একবার, বিকালে আরেকবার।
খাদেমরে, আমার টাকা নাই। একশ টাকাও নাই। দশ হাজার কইত্থে দেই? কাতর কণ্ঠে বলল ফজলু।
না দিলে বস রাগবো। বস রাগলে মনুও ফৌত। তুইও। তোরে কিলিয়ার করতে বসের কত লাগছে জানিস তো। আইচ্ছা রাখি।
খাদেম ফোন রেখে দিলে ফজলু চিন্তায় পড়ল। গ্রামে তার একটাই বন্ধু, মনু। ফজলুকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার পর মনুই তাকে সঙ্গ দিয়েছে। সিনেমা দেখতে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গেছে। মনু মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে পালায়। তার মা আছে, আবার সৎমাও আছে। সৎমা এক খতরনাক মহিলা, তার বাবাকে পোষ মানিয়ে একটা ফাউল মানুষ করে ফেলেছে। মনু এসব কথা যখন ফজলুকে বলেছে, তার গলায় অবশ্য রাগ ছিল না। কারণ তার মা আছেন। কিন্তু রাগের বদলা মনুর গলায় একটা দুঃখ বেজেছে। এখন সেটা নেই। দুই বছর ধরে বন্দরে থাকতে থাকতে, ফজলুর সঙ্গে মেসের একটা ঘর ভাগ করতে করতে, তার মনে রাগ এসেছে। একদিন বাড়ি এসে সৎমাকে বলেছে, আমার মারে আর একটা খারাপ কথা কইলে আফনারে আর আফনার পোলাডারে আমি ডোবায় ফালাইয়া চুবাইমু। চুবাইয়া চুবাইয়া দম আটকাইয়া মারমু, বুঝলেন?
ফাউল মানুষ বাবা ঘরের দাওয়ায় বসে মনুর রাগী গলা শুনেছেন। এই রাগ তিনি কোনোদিন দেখেননি। একে তাৎক্ষণিক সামাল দেওয়াটাও তার জ্ঞানের ভেতর নেই। তিনি চুপ করে থাকলেন।
মনু তার মাকে একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিল। সে মাকে বলল, একদিনও যদি তোমারে একটা বদ কথা কয়, আমারে জানাইও মা। চললাম।
সেই থেকে মনুর মা স্বস্তিতে আছেন। ফাউল মানুষটাও মাঝেমধ্যে তার বিছানায় আসেন; কিন্তু মা স্বস্তিতে গেলেও মনুর রাগটা থাকল। এটি সে ফজলু থেকে সারা জীবনের মতো কর্জ নিয়েছে।
বন্দরের তারা মিয়ার ক্যাডার বাহিনীতে মনুই প্রথম নাম লিখিয়েছে, নারায়ণগঞ্জে সিনেমা দেখতে এসে খাদেমের সঙ্গে তার পরিচয়ের সুবাদে। তারা মিয়ার ক্যাডার হলেও তাদের বস আরেকজন, যিনি থাকেন নারায়ণগঞ্জে এবং বন্দরে আসেন মাঝে মধ্যে, শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে। তার স্পিডবোট আছে। গাড়িও আছে। তাকে কেউ ডাকে ডন সাহেব, কেউ জিয়া সাহেব। তারা মিয়া তাকে সমীহ করেন। লোকটার নিশ্চয় অনেক টাকা, কারণ মনুদের চার-পাঁচজনকে তিনি ভালোই পয়সা দেন। তারা মিয়া লোকটা কিপ্টা। হাড্ডি কিপ্টা, কিন্তু বস হাতখোলা হওয়ায় তারা মিয়াকে মনুরা ছেড়ে যায়নি। বসের কেন তারা মিয়াকে দরকার, যেখানে তাকে পুলিশও দেখলে সালাম দেয়, হেসে হেসে কথা বলে, থানায় ডেকে চা খাওয়ায়, এ-প্রশ্নটি মনু একদিন করেছে খাদেমকে। উত্তরে খাদেম বলেছে, বড় দালানের খুঁটি লাগে না মনু? বন্দুক সগিরের পিস্তল লাগে না?
ফজলু জানে, বসের সাম্রাজ্য শীতলক্ষ্যা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জকে পেছনে ফেলে 888sport app পর্যন্ত ছড়ানো। তবে বন্দর তার কাছে পয়া। এখানে অনেক জমি এখন তার দখলে, যার বেশিরভাগ তারা মিয়ার ক্যাডারেরা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বসের সঙ্গে তারা মিয়ার পার্থক্যটা ফজলু বুঝেছে এভাবে : বসের যেখানে বন্দরে একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে, তারা মিয়ার আছে কিনা ঝুট ব্যবসা, যে-কাজে তার নির্ভরতা আবার ক্যাডারদের ওপর। খাদেম বলে, এখন অবশ্য তারা মিয়ার ইয়াবা ব্যবসা ঝুট ব্যবসা থেকেও বেশি পয়মন্ত।
বস এবং তারা মিয়া সম্বন্ধে মনুর উৎসাহটা বেশি। ফজলুর আবার কোনো মানুষকে নিয়ে উৎসাহটা কম। কারো সম্পর্কে কথা উঠলে সে শোনে, মনে মনে নোট করে নেয়, ব্যস। তাছাড়া, এখন ভাবাভাবির সময়টা কম। কারণ একটু সমস্যা যাচ্ছে তারা মিয়ার ক্যাডারদের। থানার ওসি পাল্টালে কিছুদিন তাদের দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। এই তিনমাস যেমন। থানায় নতুন ওসি এসেছেন, একদিন বস থানায় গিয়ে ওসির সাক্ষাৎ না পেয়ে তারা মিয়ার গদিতে বসে গজর গজর করেছেন। তারা মিয়ার সিমেন্ট ব্যবসা, খুবই নিরীহ ধরনের, তাও একদিন ওসি এসে দেখে গেছেন। তাকে বলেছেন সাবধান হয়ে যেতে। তিনি তারা মিয়াকে চোখে চোখে রাখবেন। যেদিন একটা পা বিপথে ফেলবেন তারা মিয়া, তাকে আইনের দড়ি দিয়ে বাঁধবেন।
তারা মিয়া বিগলিত হেসেছেন। এই হাসিটা অভিনয়ের, কিন্তু অভিনয়টা এমনই নিপুণ, ওসিও বুঝলেন না। তিনি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। ওসি চলে গেলে তারা মিয়া যা বললেন তা ওসির কানে গেলে কী হতো কে জানে। তিনি চোখ সরু করে বললেন, আমার পথ তো একটাই ওসি সাহেব। দেখি এই পথ আপনি কতদিন আগলে রাখতে পারেন।
ঝুট ব্যবসায় মারামারি, এমনকি খুনাখুনিও হয়। কিন্তু তারা মিয়া এই ব্যবসা করেন শান্তিতে। কারণ তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। নতুন ওসি আসার পর প্রতিদ্বন্দ্বী এলো, একদিন মারধরও হলো। তাতে মাথা ফেটে একজন হাসপাতালে গেল, পেটে গুলি লেগে আরেকজন গেল 888sport app মেডিক্যালে। গুলিটা খাদেমের পিস্তলের। পিস্তলটা তাকে ভাড়ায় দিয়েছে বন্দুক সগির, যাকে প্রটেকশন দেন বন্দরের এক সরকারি দলের নেতা।
পুলিশ এসে হানা দিলো। খাদেম পালাল। মনু ধরা পড়ল। ফজলুকে নারায়ণগঞ্জ একটা কাজে পাঠিয়েছিলেন তারা মিয়া, সে বেঁচে গেল। বন্দর না ফিরে সে সোজা বাড়ি গেল।
খাদেম তাকে ফোনে জানাল, বাড়িতেই যেন থাকে, আর অকারণে বাইরে না যায়। ওসির প্রমোশন হয়েছে, বন্দর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারেন। গেলে একটা কিছু হবে, না হলে রূপগঞ্জ না হয় আড়াইহাজারে বস তাদের একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
বছরখানেক আগে একটা জমি দখল করতে গিয়েছিল তারা মিয়ার ক্যাডারদল। তাদের সঙ্গে ছিল বন্দুক সগির। লোকটা ছোটখাটো, কিন্তু বিরাট তার তেজ। জমিটা ছিল সোনার, এর জন্য বস অনেকদিন চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এরকম জমি সহজে দখলে আসে না। দখলের ব্যবস্থাটা সেজন্য বস পাকাপোক্ত করে রেখেছিলেন, শুধু একটা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। আরেকটা পার্টি নেমেছিল মাঠে, যাদের হাতটা ছিল অনেক লম্বা। পুলিশ শুধু না, প্রশাসনেও সেই হাত পৌঁছেছিল।
জমিতে পৌঁছানোর আগেই খাদেম ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। সে বন্দুক সগিরকে বলেছিল, ভাইজান, আইজকা থাক। আইজ প্যাঁচটা বড়।
সগির শোনেনি।
পুলিশ সগিরকে ধরেছিল, ফজলুকেও। আরো দু-একজনকে। খাদেম পালানোতে ওস্তাদ। সে পালিয়েছিল। বসকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল সবাইকে ছাড়িয়ে নিতে। জীবনে প্রথম জেলের ভাত খেয়েছে ফজলু। দাদি অবশ্য কিছুই টের পাননি। প্রতিদিন দাদিকে ফোন করে সে। সূর্য ওঠা-ডোবার মতোই নিয়মে। জেলে বসেও প্রতিদিন তার কথা হয়েছে দাদির সঙ্গে। ব্যবস্থাটা তারা মিয়া করে দিয়েছেন।
তারপরও অন্তত আধামণ চালের জেলের ভাত তাকে খেতে হয়েছে।
অবাক কা-, ফজলু বেরিয়ে দেখল, জমিটাতে বিরাট সাইনবোর্ড, যাতে বড় করে কোম্পানির নাম লেখা। কোম্পানির নাম ডন ভ্যালি। খাদেম বলে, এটা রিয়াল ইস্টেট।
হেলাফেলা, মোড়ামুড়ি বস পছন্দ করেন না, ফজলু জানে। জেল থেকে মনু তাকে ফোনে বলেছে, জেলে এবার বিপদ। গেল বছর কিছু লোককে মেরে তক্তা করেছিল তারা মিয়ার ক্যাডাররা। তাদের দুজন এখন একই জেলে। তারা মনুকে বলেছে বাড়িতে মিলাদ পড়াতে। তার জান এবার শেষ।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হতে হবে, মনু বলেছে, যা পারো তোমরা করো।
আর আজ সকালে খাদেমের ফোন। এখন সে কী করে? হাতে আছে একটা দিন। সে কি পিয়ারু মামার কাছে যাবে? পিয়ারু-পুলিশ মামার কাছে? নাকি বাবার বন্ধুর বাড়ি যাবে নিয়ামতপুর? দাদির হাতে টাকা নেই। তাকে যত টাকা সে দিয়েছে, তার কিছু তিনি খরচ করেছেন, বাকিটা জমিয়েছেন। কিন্তু কোথায় রেখেছেন, ফজলু জানে না। তারপরও দাদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ফজলু শ-পাঁচেক টাকা চাইলে নিশ্চয় দাদি দিতেন, কিন্তু একসঙ্গে দশ হাজার সে কী করে চায়।
দুপুরে তার জন্য দাদি ভাত বেড়ে দিলে সে অবশ্য কথাটা তুলেছে। জরুরি দরকার, সে দাদিকে বলেছে।
টাকা দিলে তুই কই যেন কুনখানে থাহিস সেইখানে চইলা যাবি?
হ। ফজলু আসেত্ম করে বলেছে।
দাদিকে দেখলে মনে হতে পারে ভুলাভালা মানুষ, কেউ ঠকালেও বোঝেন না, লোকের চালাকি ধরতে পারেন না; কিন্তু আমরা জানি দাদি সহজ মানুষ নন। তিনি বোঝেন। ফজলু কোনো কারণে একটা বিপদে আছে, তিনি সেটা টের পেয়েছেন। দাদির মন। মাস দুই নাতিটা আছে তার সঙ্গে, তার মনটা ভরে আছে। টাকা দিলে সে চলে যাবে। তিনি উদাসীনভাবে বললেন, হাতে টাকা নাইরে ফজলু। যা ছিল আছিয়ারে কিছু দিছি। কিছু জমা আছে সুফিয়া বইনের কাছে।
আছিয়া ফজলুর চাচাত বোন। পিয়ারু চাচার বড়ভাই আজমত মুন্সির মাদ্রাসা পাশ মেয়ে। বিধবা। জীবনটা কাটে কষ্টে। ফজলু তাকে দেখেছে কদাচিৎ।
দাদির ওপর ফজলুর কখনো রাগ হয় না, আজো হলো না, তবে তার রাগ গিয়ে পড়ল আছিয়ার ওপর। আছিয়া বুবুকে দাদি বলেছিলেন তার কাছে চলে আসতে। দুই ছেলেমেয়েসুদ্ধ। কিন্তু আছিয়া পড়ে থাকল শ্বশুরবাড়ি, আধাপেটা খেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার সয়ে। ফজলুর ইচ্ছা হয় একদিন বুবুর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওই দুই বুড়া-বুড়িকে সাইজ করে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
দাদি বললেন, ফুলিটা গোসল কইরা আরাম পাইল ফজলু। কিন্তু তারপর ঘাস-বিচালি কিছুই খায় নাই। উপোস করতেছে। ফুলিটার বুকে দুধ, ছাওয়ালটা নাই। সকালে দুধ দুইলে ওর পরানটা কান্দে। শূন্য হয়। ফুলি বাঁচবে না।
খাওয়া শেষ করে উঠানে নামল ফজলু। বদনার পানি ঢেলে হাত ধুলো। ফুলিকে চোখে পড়ল। সজনেগাছের নিচে বসে আছে ঝিম মেরে। 888sport sign up bonusর ঝাপটা কি একটা গাইকেও এমন উদাসী করে দেয় যে কিছু খেতে তার ইচ্ছা হয় না?
ফজলু যেমন মিষ্টি খায় না। খেতে না পেরে মরে গেলেও, এবং আধাসের ম-া অথবা রসগোল্লা পৃথিবীর শেষ খাদ্য হলেও, না, সেদিন থেকে, যেদিন তাকে দাদি বলেছিলেন, তোর মা মিষ্টির পোকা ছিলরে ফজলু, মিষ্টি পাইলে আর কিছু না খাইলেও তার চলত।
ফুলির বোজা চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে একটা চিন্তা তার মাথায় এলো। মনে মনে একটা হিসাব করল। দাদি ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুমাতে যাবেন, তিনটার দিকে। তার আগেই তার চিন্তাটা পাকা করতে হবে। আজ হাটবার। প্রতি মাসের শেষ মঙ্গলবার হাটটা খুব জমে। আজ শেষ মঙ্গলবার।
দুই
হাটের যেখানটায় গরুর বেচাকেনা হয়, সেখান পর্যন্ত ফুলিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে একবারও কোনো সমস্যা হলো না ফজলুর। দাদি ঘুমিয়ে গেলে ফুলিকে যখন সে জাগিয়ে তুলল, এবং ফুলি উঠে দাঁড়াল, সে যেন বুঝল তাকে নিয়ে ফজলুর কোনো মতলব আছে। ফজলু ভেবে দেখেছে, না খেয়ে ফুলি যখন মরেই যাবে, তাকে হাটে নিয়ে বিক্রি করে দিলেই তো হলো। এমনিতে ফুলি তরতাজা, একটা তিন-সাড়ে তিন বছরের গাই যেমন হয়। গরুর দাম এখন ভালো, কম করে হলেও পঞ্চাশ-ষাট হাজার তো পাওয়া যাবেই। দশ হাজার বিকাশ করে বাকিটা রেখে দিলেই হবে। ফুলিকে দাদি ভুলে গেলে তার হাতে টাকাটা একসময় সে তুলে দেবে।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর খদ্দের পাওয়া গেল। খদ্দের ইমামগঞ্জের। ফজলু স্বস্তি পেল। সে তাকে চেনে না, ফজলুও তাকে চেনে না। খাদেমের দেওয়া নম্বরে সে আজ পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবে। বাকিটা কাল সকালে। তারপর সে বাসে উঠবে বন্দরের পথে।
যতক্ষণ ফুলিকে ধরে ফজলু দাঁড়িয়ে ছিল, ফুলি ঝিম মেরেই ছিল। কিন্তু খদ্দেরের হাতে তাকে তুলে দিলে ফুলির মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিলো। সে বুঝতে পারছিল না, তার চেনা পৃথিবীর বাইরের একজন মানুষ কেন তাকে ধরেছে। ফজলুই বা কেন এটি করতে দিচ্ছে। খদ্দেরটা একটা দড়ি লাগিয়েছে ফুলির গলায়, এবং দড়িটা যেন তাকে বাস্তবে জাগিয়ে দিলো। একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি মেলল সে ফজলুর দিকে। তারপর তার চাঞ্চল্য চলে গেল। একটা অবসাদ যেন নামল তার শরীরে। চোখ দুটি বন্ধ করে দিলো। ফজলু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। কেন জানি তার ধারণা হলো ফুলির সঙ্গে তার আর চোখাচোখি হবে না। হলোও না। ফজলু দাঁড়িয়ে থাকলেও খদ্দেরের তাড়া ছিল, সে চলে গেল।
ফুলি চোখ খুলল না। অথবা খুলল এমন চিকন করে, মাটির দিকে, যেন ফজলুর ছায়াটাও তার চোখে না লাগে।
বাড়ি ফিরে ফজলু দেখল, দাদি দাওয়ায় বসে আছেন। তার প্রিয় বেতের মোড়ায়। তার সামনে যেতে যেতে সে তার বিলাপ শুনল।
বিলাপের সুরে দাদি বললেন, তুই কই ছিলিরে ফজলু? আমার ফুলিটা চইলা গেছে।
চইলা গেছে? কোথায়? অবাক হওয়ার ভান করল ফজলু।
জানি না। দাদি বললেন, তারপর চোখ বুজলেন।
ফজলুর কেন জানি খুব রাগ হলো। না দাদির ওপর না, নিজের ওপরও না। কিসের ওপর তাও সে জানে না। কিন্তু তার রাগ হলো, সবাই কেন তাকে দেখে চোখ বুজবে? দাদি কি সব বুঝেছেন? তিনি কি জানেন ফুলি যায়নি, তাকে ফজলুই নিয়ে গেছে?
অবাক, সে কোথায় ছিল এতক্ষণ, একবারও দাদি জিজ্ঞেস করলেন না। তাকে শুধু বললেন, ফুলিটা চইলা গেল। তুইও কি যাবি?
এ-কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন তার ভুলাভালা দাদি?
আমি একটু খুইজ্জ্যা দেহি, দাদি? সে বলল।
দাদি বন্ধ চোখেই একটুখানি হাসলেন। বললেন, ফুলি চইলা গেছে। এখন তুইও চইলা যাবি। তয় যা।
তিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বলল, যদি না যাই দাদি, ক্যামনে কী হইব? খামু কী?
খাওনের অভাব হইবে নারে ফজলু, দাদি বললেন। তোর তাগড়া শরীর। বাপদাদার ভিটা আছে। একটুখানি জমি আছে, একটা পুকুর আছে।
ফুলি যেখানে বসে বসে ঝিমাচ্ছিল গতকাল, দাদি ঠিক ওই জায়গায় বসেছেন মোড়া পেতে।
তৈরি হয়ে তার রংওঠা ব্যাগটা কাঁধে ফেলে দাদির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, কেউ যাইতে চাইলে তারে আটকানো যায় নারে ফজলু। তোর বাপেরে পারি নাই। তোরেও পারমু না। যা।
ফজলু হাঁটা দিলো।
কিছুদূর গিয়ে সে তার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে মাটিতে রাখল। তারপর একটা গাছের সঙ্গে মাথা ঠুকল। এবার রাগটা তার নিজের ওপর।
কপাল দিয়ে রক্ত বেরুলো। রক্ত মিশল চোখের পানির সঙ্গে।
চার
বন্দরে মেসঘরে পৌঁছল সে বেলা বারোটায়। বেশ ক্ষুধা লেগেছে, কিন্তু ফুলির মতো সে একটা সিদ্ধান্ত নিল, আজ কিছুই খাবে না।
খাদেম তাকে জিজ্ঞেস করল, কপাল ফাটল ক্যামনে?
ফজলু উত্তর দিলো না। খাদেমও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করে নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে বেরুতে হবে আজ রাতে। বস পইপই করে বলে দিয়েছেন, কাজটা ঠিকঠাক করতে হবে।
কী কাজ?
পরে বলব। এখন খা। খাইয়া ঘুমা। তিনটায় উঠিস। তিনটায় মিটিং, খাদেম বলল, তারপর চলে গেল।
ফজলু খেলও না, ঘুমালও না। শুধু বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকল।
তিনটায় মনু এলো। জেলে থেকে সে শুকিয়ে গেছে। রংটাও কালো হয়ে গেছে। মনুর পেছন পেছন উত্তম এলো – উত্তম বসের খাস মানুষ। ওর সঙ্গে পিস্তল থাকে। ফজলু বুঝল আজকের কাজটা সহজ নয়। উত্তম যেখানে যায়, খবর তৈরি করে দিয়ে আসে।
থানার ওসি চলে গেছেন। এখনো নতুন ওসি আসেন নাই। বস এই সময়টা বেছে নিয়েছেন তার কাজের জন্য। খাদেম জানালো বসের সোনার মতো দামি জমিটা সাত কোটি টাকায় রফা করেছিলেন এক পেপার মিলের সঙ্গে। কিন্তু সেটা কাল হঠাৎ দখলে নিয়েছে গোদনাইলের হাজি এহসান। লোকটা ঘাঘু। বন্দুক সগিরকে সে কৌশলে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে সেখানে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন উত্তম ভরসা।
উত্তমের কথা শুনে মনে হলো, লাশ পড়বে। মনু শিউরে উঠল। ফজলু অবশ্য উত্তমের কথা শুনেছে আবার শোনেওনি। তার মন পড়ে আছে দাদি আর ফুলির বোজা চোখে। সে ঠিক জেনেছে, দাদি সব বুঝেছেন। সব বুঝে দাদি রেগে বাড়ি মাথায় তুললে সে খুশি হতো, তাকে চেলা কাঠ দিয়ে পেটালে সে আরাম পেত, তিনি দাওয়ায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদলে তার স্বস্তি হতো। কিন্তু দাদি এসব কিছু না করে শুধু চোখ বুজেছেন।
কেন?
সন্ধ্যার মধ্যেই খবর এলো, সর্বনাশ! ওসি ফিরেছেন, কিন্তু ঠিক কী কারণে খাদেম বলতে পারল না। মধু নামের উত্তমের এক সঙ্গী বলল, ওসি কঠিন মানুষ, একটা মেরামতি চালাচ্ছিলেন বন্দরে, সেইটা শেষ করতে ফিরে এসেছেন। এক সপ্তা থাকবেন।
উত্তমের, খাদেমের ফোন বাজতেই থাকল। একজন কেউ জানালো বন্দুক সগিরকে নিয়ে পুলিশ বন্দরে এসেছে, আরেকজন বলল, ডন সাহেব নারায়ণগঞ্জ ফিরে গেছেন। খাদেম নিজেই একটা নাম্বারে ফোন করে শুনল, বসের এক ইস্পিশাল ক্যাডারকে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়েছে এহসানের লোকজন। লোকটা বাঁচে কিনা সন্দেহ।
এহসানের লোকজনকে নিয়ে অবশ্য ভয় নেই তারা মিয়ার ক্যাডারদের। 888sport app থেকে কঠিন কিছু লোক তিনি আনিয়েছেন, তারাই তাদের সামাল দেবে। তাদের ভয়টা ওসিকে নিয়ে। এ লোক তার মেরামতির কাজে কাউকে তোয়াক্কা করে না।
তারা মিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন করলেন খাদেমকে, বললেন কিছু একটা করতে। পুলিশ তার গদি ঘিরে রেখেছে।
খাদেম বেরিয়ে গেল। মধুও গেল। উত্তমও একসময় উঠল। যাওয়ার আগে সে ফজলুকে বলল নিতাইবাবুর আড়তের পেছনের খালটা পার হয়ে ইনাম মার্কেটের গেটে কিসলুর চায়ের দোকানে চলে যেতে। সে মনুকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
ফোনটা খোলা রাখিস, সে বলল।
কিন্তু বাড়ির সামনের গলিটার মোড়েও হয়তো উত্তম পৌঁছাতে পারল না, পুলিশের বাঁশি বাজা শুরু হলো। একই সঙ্গে দ্রুতপায়ে দৌড়াদৌড়ি। দরজা খুলে ফজলু দেখল, গলিটায় সাত-আট পুলিশ। দুই পুলিশ তাদের মেসবাড়ির দিকেই আসছে। তাদের হাতে বন্দুক উঁচু করে ধরা। গলিতে আলো নেই, কিন্তু একটা ফাজিল চাঁদ উঠে আলোর অভাবটা অনেকটা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ফজলু দাঁড়িয়ে পড়ল। তার ভেতর থেকে একটা তাড়া আসছে, পালা, পালা, ডাইনে দৌড় দে। না-হয় ঘরে ঢুইকা পিছনে যা, পিছনের পাঁচিল বাইয়া পালা। কিন্তু তার পা গলির ইট আর খোয়ায় আটকে গেছে। পা নড়ে না। সে দেখল দুই পুলিশ দৌড়ে আসছে বন্দুক তাক করে। পুলিশ নিশ্চয় জানে তারা মিয়ার ক্যাডাররা কোথায় থাকে। ওসি তো জানতেন। এই দেড়তলা আধাপাকা দালানে, চার কামরার মেসবাড়িতে।
চাঁদের আলোটা স্থির, দুধ-ঘোলা সাদা। গলির রাস্তার দুই দিকে দুটা নিমগাছ, কে কবে লাগিয়েছিল কে জানে, কিন্তু কেউ কাটে না, গাছ দুটা নাকি গলিটার হাওয়া পরিষ্কার করে। নিমগাছের পাতায় চাঁদের আলো তিরতির করে। উলটো দিকের গাছটার নিচে দু-একটি ভাঙা চেয়ার, তক্তা, কেরোসিন কাঠের বাক্স। মোক্তার অ্যান্ড সন্সের পরিত্যক্ত তৈজসপত্র। দোকানটা মেরামত হয়েছে কদিন আগে, আবর্জনাগুলি সরানো হয়নি। সেই আবর্জনার ওপার থেকে হঠাৎ একটা ছায়া রাস্তাটা পার হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা গরু। কড়া বাদামি পিঠ আর গা, চাঁদের আলোয় কিছুটা অস্পষ্ট, কিন্তু সেই অস্পষ্টতার মধ্যেও সাদা সাদা কিছু অবিন্যস্ত টুকরো আভা জেগেছে, যা দেখলে হঠাৎ বুনোফুল বলে মনে হতে পারে।
ফুলি! ফজলু নিজেকেই বলল। ফুলি এখানে কী করে এলো? এও কি সম্ভব? নাকি চাঁদের আলো তার চোখে বিভ্রম ছড়িয়েছে?
সে চাঁদটার দিকে তাকাল। চাঁদের ওপর কিছু সাদা মেঘ হালকা চাদর বিছিয়েছিল। সেই চাদর এখন সরে গেছে। চাঁদটা তাজা। যেমন তাজা গরুটাও। গরুটার দিকে চোখ নামাতে হলো ফজলুর। এটি এখন মাথাটা শক্ত করে সামনে মেলে বেশ তেজে এগিয়ে যাচ্ছে দুই পুলিশের দিকে, যেন তার মাথাটা ঢাল, অথবা একটা কামানের নল।
পুলিশ দুজন ভড়কে গেল। তারা গরুটার দিকে তাকাল। তারা বুঝতে চেষ্টা করল, কেন তাদের দিকেই এটি ধেয়ে আসছে। তারা বন্দুক চালাতে পারত, বন্দুক তো তাক করাই ছিল। কিন্তু তারা গ্রামের ছেলে, একটা গাভীকে বন্দুকের গুলিতে মারার কথা ভাবতে পারে না। তারা বরং গাভীটা থেকে দূরে সরে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু গাভীটা তেজি, তার চোখে পানি নেই, তার শরীরেও অবসাদ নেই। সে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল। গলিতে কয়েকজন পথচারী ছিল, মোক্তার অ্যান্ড সন্সের কর্মচারী ছিল। তারা অবাক হয়ে দেখল, গাভীটা এক পুলিশের সামনে গিয়ে মাথা তুলে তার বন্দুকে একটা হালকা টোকা দিলো। তারপর জিভ বের করে বন্দুক ধরা হাতটা চাটতে লাগল।
মোক্তার অ্যান্ড সন্সের এক কর্মচারী শব্দ করে হাসল। বলল, পুলিশভাই, গরুটা আপনারে পছন্দ করেছে।
পুলিশটার জন্য বিব্রতকর অবস্থা। অন্য পুলিশটাও এই অবাক দৃশ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের চোখ এখন গাভীটার দিকে। সেটি এখন স্থির দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। অন্য পুলিশটার দিকে তাকিয়ে যেন জানতে চাইছে, তোমার হাতটাতে একটু আদর করে দিলে রাগ করবে?
চাঁদের আলোয় দুই পুলিশ, একটি গাভী, কিছু মানুষ যেন একটা শান্ত ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর চাঁদের সামনে ক্ষক্ষরের দেয়াল তুলে দিতে একটা মেঘ এগিয়ে এলো। হেলতে দুলতে।
এই দৃশ্য দেখার জন্য ফজলু অবশ্য আর দাঁড়িয়ে ছিল না। গাইটা তেজি ভাব নিতেই তার পায়ে চাঞ্চল্য এসেছে, সে ঘরে ঢুকে দুপুরে কাঁধে ঝুলিয়ে আনা ব্যাগটা তুলে নিয়েছে, যার ভেতরের একটা পকেটে এখনো কাল হাটে পাওয়া বাকি টাকাগুলি আছে। তারপর পেছনের পাঁচিল টপকে হাওয়া হয়ে গেছে।
বন্দর পার হতে হতে সে চাঁদটার দিকে আবার তাকিয়েছে। চাঁদটা ক্ষক্ষরের পাঁচিলের পেছনে বন্দি। আলোটা অস্পষ্ট। আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের হুটোপুটি।
পাঁচ
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল ফজলুর। সে জানে দাদি ততক্ষণে উঠে যাবেন, নামাজ পড়বেন, কিছুক্ষণ উঠানে হাঁটবেন। হয়তো নিচুস্বরে বিলাপ করবেন – তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের জন্য, হয়তো ফুলি এবং ফজলুর জন্য। অথবা চুপ করে মোড়াটাতে বসে থাকবেন।
গত সন্ধ্যার ঘটনা ফজলুকে বিমূঢ় করে রেখেছে। যে-গাইটা তাকে বাঁচিয়ে দিলো দুই পুলিশের হাত থেকে, সে কোত্থেকে এলো। সে কি ফুলি? যদি ফুলি হয়, দুনিয়ায় এর থেকে অসম্ভব কথা আর কে কবে শুনেছে?
মেসবাড়ি থেকে পালিয়ে সে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছে, খবর নিয়েছে। তার মোবাইলে ফোন করেছে মনু, বলেছে খাদেম মারা পড়েছে, বস আটক হয়েছে। মনু বলেছে, তুই পালা। বন্দরে আর জীবনে না। মনু যাবে চাঁদপুর। তার এক মামার ইলিশের আড়ত আছে সেখানে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে ফজলুর ইচ্ছা হয়েছে, একটা গাছে তার মাথাটা ঠুকবে। কিসের জন্য, সে বলতে পারবে না। ঠুকতে ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু ঠুকল না, কারণ কপালে রক্ত জমলে দাদি দেখলে ভয় পাবেন। এমনিতেই গতকালের রক্তের দাগটা কপালে আছে।
দাদি রক্ত ভয় পান। বাবা-মার লাশ যখন বাড়িতে আসে, তার পুলিশ মামা তাকে বলেছেন, তাদের গায়ে রক্ত ছিল। রক্ত দেখে দাদি জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
বাড়িতে ঢুকতেই দাদিকে দেখা গেল। তিনি বেতের মোড়া পেতে বসে আছেন ফুলি যেখানে ঝিম মেরে থাকত সেখানে। ফজলুর বুকটা একটা মোচড় দিলো। হালকা পায়ে সে এগোল। কিন্তু সামনে তাকাতেই তার চোখটা কপালে উঠল। ফুলি! নাকি অন্য কোনো গাই? একটু এগিয়ে সে দেখল গাইয়ের চামড়াটা কড়া বাদামি, ভোরের হালকা আলোতেও যা বোঝা যাচ্ছে। এবং এখানে-সেখানে সাদা দাগ। যেন বুনোফুল। গাইটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটা টুকরিতে ঘাস, বিচালি। কিন্তু সে খাচ্ছে না, শুধু তার চোয়াল নড়ছে।
ফজলুর পায়ের শব্দে দাদি তাকালেন। গত সন্ধ্যার চাঁদটার মতো একটা আলোময় হাসি দিয়ে বললেন, ফজলু, তুই আইলি? দ্যাখ। আমার ফুলিও ফিরা আইছে। যা, এখন পুকুরে গিয়া একটা ডুব দিয়া আয়। তোর পেটে ক্ষুধা, ফুলিটার মতো। তুই কাইল থাইক্ক্যা কিছু খাস নাই। তুই খাইলে ফুলিও খাইব।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.