কদিন থেকে একটু বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে অয়নকে। পঁয়ষট্টির নিপাট ভদ্রলোক। অন্তর্মুখীন ব্যক্তিত্ব। এখন আরো অভ্যন্তরে। নানা কাজে ফজলকে বেশ কয়েকবার ওর আবাসে অবস্থান …। অন্য ঋতুতে সমস্যা নেই; কিন্তু গ্রীষ্মে হুগলির মহকুমা শহর আরামবাগে না আছে বাগ-বাগিচা, না আরাম। সারা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্বলন্ত। যদিও শহর ঘেঁষে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর। মাইক্রো প্রভাব পড়তে পারত, কিন্তু চরের বালি ধুধু করছে – মরীচিকা সৃষ্টি করে। এরই পাশে পাকা রাস্তায় সকাল থেকে বসে বাজার। জিয়ল মাছের আকাল। সেই একঘেয়ে চাষের কার্প, রুই-কাতলা। চুনো-চানাও চোখে পড়ে না। অয়ন বন্ধুকে মাছের বাজার দেখাতে এসে সাধের চিঁয়োমাছ না পেয়ে ব্যাজার।
বর্ষা ছাড়া নদীর ছোট মাছ মিলবে না। খেদ অয়নের।
এটা এখন সর্বত্র। 888sport appsেও একই চিত্র। নদীর মাছ পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া সব নদীর উৎস তোমাদের ভূখ–, তাই অবস্থা আরো করুণ। চাষের জন্য তোমরা জল নিচ্ছ, আমরা পাই ঝড়তি-পড়তিটুকু। কপাল চাপড়ান ছাড়া উপায়ান্তর …
ব্যাপারটা রাজ্যের অনুমতিসাপেক্ষ। তাই কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে পৃথকভাবে আপনাদের কিছু করা মুশকিল। দুই পক্ষের সহমত লাগবে। কেন্দ্র রাজি হলেও রাজ্যের মতামত জরুরি। এবং বলতে পারেন মূল শক্তি রাজ্যের।
তা ঠিক আছে। ফেডারেল ব্যবস্থায় এটাই দস্ত্তর।
এটা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিক। পাকা রাস্তা ধরে পশ্চিমের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত রোঁদ। বানের ধাক্কা পড়ে না বলে পূর্বপ্রস্ত্ততির কোনো চিহ্ন নেই। না হয় কংক্রিট বস্নক যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যেত বা সুচারু রূপে বাঁধান। ক্ষয়ে যাওয়া তীর স্বাভাবিক রূপে বিদ্যমান। কিছু বুনো গুল্ম মাথা তুলে আছে। মানানসই।
বাজারের পর প্রধান ডাকঘরের পাশ দিয়ে গলিটা অতিক্রম করলে আরামবাগের মহাসড়ক। প্রশস্ত। আইল্যান্ড ও নিয়নশোভিত। অ্যাভিনিউ রূপ। বড় নগরের আদল।
গলির মধ্যে ত্রিতল ভবনের দোতলার অর্ধচন্দ্রাকার ব্যালকনিতে তারা প্রভাত-পত্র মেলে বসে। রোববার বলে অয়নের স্ত্রী নমিতা চায়ের সরঞ্জাম নিজ হাতে সাজায়।
বাজার কেমন দেখলেন?
ভালো। তবে মাছ খুশি করতে পারল না। বরং আমাদের গ্রাম সবলসিংহপুরের বাজার এর চেয়ে ভালো।
পুকুর বেশি?
তা নয়। মু–শ্বরীতে বেশ জল আছে। দ্বারকেশ্বরের মতো নয়।
আপনাদের সৌভাগ্য।
আরামবাগ আমাদের মহকুমা, কিন্তু দুর্ভাগ্য।
শহরে লোকও বেশি।
আরে, আমাদের গ্রামেও বিশ হাজারের মতো। আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। বরং খানাকুল অঞ্চল একটু হালকা। ওদিকে
কৃষ্ণনগর আর রাধানগরে আবার জনতা।
আপনাদের রাজহাটিও কম নয়। একটা টাউনশিপ তো গড়ে উঠেছে।
ছেলেবেলায় দেখা রাজহাটি বন্দর এখন বন্দর হয়ে না উঠলেও চেনা যায় না। বেশ বড় বড় সব পাকা দোকান। পুরো আধুনিক। আমার ভালো লেগেছে মাছের বাজার। সব মাছ জ্যান্ত।
অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয়নি। এবার পুজোর ছুটিতে ভাবছি রাজা রামমোহনের বাড়ি দেখতে যাব। যাব যাব করে যাওয়া হয়ে উঠছে না।
আপনি এখনো যাননি! ওটা তো বাংলার কেন সারা ভারতের মহিলাদের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। অবশ্য কষ্ট চলে গেলে কষ্টের কথা কে-ই বা মনে রাখে।
না, তা নয়। হয়ে ওঠেনি। মক্কার মানুষ …
যথার্থ। আমিই তো গত বছর মাত্র ঘুরে এসেছি।
খানাকুলবাসী হিসেবে আপনার আত্মীয়তা বেশি। আমরা আরামবাগে থেকে একটু আরামি হয়ে গেছি।
জীবনের গতি বিচিত্র। ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। আরামি হোন, হারামি না হলেই হলো। আজকাল ধর্ম নিয়ে যে-বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে, সর্বত্র।
নমিতার উজ্জ্বল আনন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
আপনারা চা খান। আমি ওদিকটা একটু দেখি।
নমিতার প্রস্থানটা হঠাৎ হওয়ায় ফজলের খটকা।
তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই অয়ন মুখ খোলে।
আমরা একটা চিন্তার মধ্যে আছি।
যেমন?
যদিও আমরা মুখার্জি-ব্যানার্জি পরিবার, আমাদের পরিবার কিন্তু গোঁড়ামিমুক্ত ছিল। সব সময়। ইদানীং আমাদের ছোট ছেলে অমলের মধ্যে বেশ পরিবর্তন দেখছি। একটু বেশি বেশি ওদিকে ঝুঁকে পড়েছে।
ফজলের মনে পড়ে, 888sport appয় গুলশানের হলি আর্টিজানের কথা। বেশিদিন হয়নি। জঙ্গি সব ইয়াং ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মহৎ কোনো কাজে নয়, হত্যাযজ্ঞে শামিল! জীবনকে এত নেতিবাচক কাজে ব্যয় করা? কোথায় ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন … দেশমাতৃকা, মানবতা, আত্মবিকাশ এসব তুচ্ছ হয়ে গেল!
তোমার ছেলে তো 888sport apkের ছাত্র।
হ্যাঁ। আমার মনে হয় আমি যে লিটারেচার নিয়ে পড়েছি তা আমাকে অনেক মানবিক করেছে। 888sport apk কি টেকনোক্র্যাট করছে? মানবতার বিকাশ ঘটাচ্ছে না?
এটা তো একটা ধাঁধা হয়ে দাঁড়াল। 888sport apk চেতনা বাড়াচ্ছে, না কারিগর বানাচ্ছে? চিন্তাশূন্য কারিগর? বাড়িতে এত উদার পরিবেশ তাহলে ভিন্নধারায় যাওয়ার উৎস কি বলে মনে করো?
দু-বছর ছেলে চেন্নাইয়ে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল। ওখানে হোস্টেলে মাদ্রাজি ছেলেদের সঙ্গে থাকত। ওখান থেকে ফিরে আসার পর থেকে দেখছি চলাফেরা অন্যরকম। দেব-দেবীর মূর্তি কিনছে। বাড়িতে নানা জায়গায় বসাচ্ছে। আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে মানানসই হয় না এমন জায়গাতেও মূর্তি বসাচ্ছে।
ইন্টারেস্টিং।
না রে দাদা, চিন্তার বিষয়। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হতে। আর ওর প্রচেষ্টা ধর্মীয় আবহাওয়া পুরো বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করা।
ঠিক বলেছ, চিন্তার বিষয় বটে। তোমার মনে পড়ে, আমরা আর্টসের ছাত্ররা অবধারিতভাবে লজিক নিতাম। একে তো ভালো নম্বর ওঠে। তাছাড়া তর্কবিদ্যা শিক্ষা হয়। হয় অ্যারিস্টটলীয় যুক্তির সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ করে সিলোজিসম বা ন্যায়-যুক্তি। অবভারসান, কনভারসান, কন্ট্রাপোজিশন কতরকম যুক্তির ধারা।
হ্যাঁ, আমারও কম্বিনেশান ছিল লজিক।
আমি ডিডাকটিভ লজিকে ছিয়াশি পেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল দর্শন পড়ব। শেষ পর্যন্ত সোসিওলজিতে চলে গেলাম।
বাংলা 888sport live footballকে অনেকে নাক সিটকায়; আমি কিন্তু মনে করি লাভবান হয়েছি। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলার ইতিহাস জানা হয়েছে। না হয় তা হতো না।
বিকেলে দুজন আরামবাগ শহর দর্শনে বেরোয়। সন্ধ্যার দিকে একটি আবাসিক এলাকায় প্রবেশ। বিবেকানন্দ আবাসিক। সব নতুন ভবন। আধুনিক স্থাপত্যের ধারায়। রাস্তা প্রশস্ত। সুন্দর বাঁধান।
ফজল বলেই বসে, অয়ন, আবাসিকটা তো সুন্দর। আমাকে দুটো রুম ভাড়া নিয়ে দাও না, মাঝে মাঝে 888sport app থেকে দিন-পনেরো কাটিয়ে যাব।
এখানে সবাই বসবাসের জন্যে বাড়ি বানায়। ভাড়া দেবে কিনা জানি না। তবে দেখব।
এক বড় ভবনের সামনে গিয়ে অয়ন কলিংবেল চাপ দেয়।
একহারা প্রায় সত্তর বছর বয়সী একজন দরজা খুলেই সহাস্য আহবান জানায়।
আসুন অয়নবাবু … সঙ্গে …
আমার দাদা, 888sport app থেকে।
আরে আপনার কথা অনেক শুনেছি। দেখা করতে যেতাম আগামীকাল সকালে।
বউদি প্রয়াণের পর আসা হয়ে ওঠেনি …
ঠিক আছে … অনেকদিন থেকে ভুগছিলেন।
অয়ন ফজলের সঙ্গে সুরেশবাবুর আলাপ করিয়ে দেয়।
খুব খুশি হলাম, আপনি এসেছেন … খবরটা শুনে কষ্ট হচ্ছে …
কী করা যাবে বলুন। ভগবান যার কপালে যা লিখে রেখেছেন … মানতে তো হবে। তবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। বেড-শোর হয়ে গিয়েছিল … আপনারা বসুন।
বসার ঘরটা বেশ সাজানো। হয়তো একসময় বাড়ির কর্ত্রী এসব সাজাতেন … আজ তার বিহনেও তেমনি আছে … শুধু মানুষটা নেই। এই অনিত্য জীবন নিয়ে মানুষের কত গর্ব। কত চাহিদা। সব ফেলে যেতে হয়। শূন্য হাতে আসা, শূন্য হাতে যাওয়া … রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apkর লাইনটা মনে পড়ে, আকাশে রয়ে গেল নীলাঞ্জন রেখা … নীল আকাশে নীল রেখা … মানেটা কী? পটভূমির কোবাল্ট বস্নুর জলরঙের ওপর কি কন্টি বা ক্রেয়নের দাগ? রবীন্দ্রনাথ তো আবার চিত্রকরও বটে। ভাবতে থাকে ফজল।
এই সময় চা এসে যাওয়ায় ফজলের চিন্তায় ছেদ। বর্তমান জগতে ফেরত। রাজনীতির প্রাধান্য। তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম … ত্রিভুজ আলোচনা। শহরের নামি চিকিৎসাবিদ মনোজিতের নামও উচ্চারিত। তার শরীর খারাপ। সবাই চিন্তিত। এমন মানবদরদি মানুষের জন্য সবাই উৎকণ্ঠিত। অনেক রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। কাউকে ফেরত যেতে হয় না। হেরোডটাসের ছাত্র – চিকিৎসা মানবসেবা, ব্যবসা নয়।
গল্পে গল্পে বেশ কিছু সময় ভালো কাটল সবার। বিশেষ করে সদ্য পত্নীবিয়োগ সুরেশবাবুর। মনটা ভার কমাল।
অয়ন এবার উঠতে চায়।
চলি, সুরেশবাবু। আপনি আসবেন।
ঠিক আছে। আসব। আবার আসবেন।
সময় পেলে আসা যাবে, ফজলের আশ্বাস।
ঘরে ফিরে কাপড় ছেড়েই খাবার টেবিলে ডাক।
টেবিলে ফজল আর অয়ন।
নিচে অমল এবং নমিতা সরাসরি রেড অক্সাইড দেওয়া পরিচ্ছন্ন মেঝেয় বসে পড়ে। অয়নের মা এখনো শক্ত আছেন, তদারকি করছেন।
রাতের খাবার সবকিছু হালকা।
ফজলের ভাতের মাপ বাচ্চাদের মতো। গৃহিণী ধরে ফেলেছেন। সেই অনুযায়ী থালায় এক বাটি। উপুড়। পোস্ত-মাখানো ঘেঁট। বাটিতে মুরগি। আর এক বাটিতে ডাল। রাতে পাঁপড়টা বাদ।
গল্পে গল্পে আহার। তাই সময় ব্যয়।
খাওয়া শেষে ফজল ওঠার অনুমতি চায়। সে খাবারে হাত স্পর্শ করেনি। কাঁটা-চামচ সহায়।
অনুমতি পেয়ে খাবারঘর পার হয়ে দোতলার সিঁড়িতে মধ্যপথে।
এই সময় অমল বেরিয়ে এসে বলে, জেঠু, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি …
নো হেজিটেশান, বলে ফেল …
আপনি ওপরে গিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন। এমন অদ্ভুত প্রতিপাদ্য আশা করেনি ফজল। আমি তো হাত দিয়ে খাইনি!
তবু মুরগি খেয়েছেন তো!
ফজলের অবাক হওয়ার পালা আরো বৃদ্ধি পেল।
ঠিক আছে বাবা, তুমি যখন বলছ, হবে।
বলে সে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।
সে কোনার বাথরুমে প্রবেশের পূর্বেই অয়নের আগমন।
দাদা, দাদা, দাঁড়ান।
থামে ফজল।
আপনি কেন হাত ধোবেন!
দেখ, বাবুটি অনুরোধ করল …
ও তো লজিক পড়েনি।
ফজলের মনে হলো, তাই তো, তারা ইন্টারমিডিয়েটে লজিক পড়েছে। বিশেষ করে তাদের সময় ‘ভোলানাথের তর্কবিদ্যা’ বইটা বিখ্যাত পাঠ্যপুস্তক ছিল। ডিডাকটিভ-ইনডাকটিভ দুটোই। সে অবশ্য ইংরেজি বই পড়ত।
আপনার তো জানা আছে ফর্মাল ট্রুথ আর ম্যাটেরিয়াল ট্রুথ।
হ্যাঁ, তা জানা আছে …
তার কথা শেষ করতে দিলো না অয়ন, বলে, আরো আছে, ফ্যালাসি অব ফোর টার্মস। ইউ টাচ দ্য স্পুন, দ্যাট স্পুন টাচ দ্য চিকেন, সো ইউ টাচ দ্য চিকেন … ফর্মালি ইট ইজ ট্রু … কিন্তু অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিতে এটা ফর্মাল ট্রুথ হলেও ম্যাটেরিয়াল ট্রুথ নয়। তাছাড়া দ্যাট স্পুন একটা বাড়তি টার্ম … সুতরাং সিলোজিসমের শর্ত অনুযায়ী এটা সম্পূর্ণ রূপে ফ্যালাসি অব ফোর টার্মস। আপনার হাত ধোয়া অবান্তর।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.