বগি নাম্বার এক্সট্রা-ক

আগুন নেভানো মাটির চুলায় চুপ মেরে বসে থাকা এনামেলের হাঁড়ির মতো নির্বিকার 888sport promo codeটির মুখ। এমন বিষণ্ন গোমড়া মুখ দেখে মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক, না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। বিশেষত আমার মতো তথাকথিত গায়ে পড়ে বকবক করা মানুষের। কয়লা ধুইলে যেমন ময়লা যায় না, মা বলতেন, এতো বড় চাকরি করিস, তবু যার-তার সঙ্গে বকবকানির স্বভাব তোর যায় না। মাকে বলতাম, আমার এই স্বভাবটা যাক আমি চাইও না। মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। মা বলতেন, একেবারে তোর মহসিন মামার স্বভাব। এই স্বভাবই তো তাকে খেয়েছে। মনে মনে আমার অদৃশ্য মাকে নিশ্চিন্ত করি, তোমার মেয়েকে এখনো কোনো বড় আপদ-বিপদ খেতে পারেনি মা।

আপাতত সহযাত্রী 888sport promo codeর সঙ্গে ভাব জমানোর গলিঘুপচি খুঁজতে থাকি। খুব শ্রমসাধ্য নয়, সাধারণ একটু বাড়তি মনোযোগ দিলেই মানুষের আগ্রহের জায়গা আবিষ্কার করে ভাব জমানো যায়। এই 888sport promo codeর মুখে গভীর বিষাদ আর রূঢ় কাঠিন্যের মিশ্রণ; কিন্তু মোটেই তা তার লাবণ্যকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। যা পেরেছে তা হলো, জগতের যাবতীয় আগ্রহকে দূরে রাখার ইস্পাত দেয়াল তৈরি করেছে।

888sport slot gameে পাশের সিটে মনমতো সঙ্গী না হলে মেজাজ খারাপ হয় আমার। মা যতই বলুক মামার স্বভাব পেয়েছি, মামার স্বভাব আসলে কী আমি ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই তো মামা চলে গেলেন। নিজে নিজেকে যা বুঝি, টুকটাক লেখালেখি করি বলেই হয়তো মানুষের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার অপার আগ্রহ অনেকটা ইলেকশন করতে ইচ্ছুক প্রার্থীর মতো। পারলে ভাইয়ের মতো গলাগলি করি। মানুষকে আবিষ্কারের মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। প্রায়শই মানুষ খুব ভেতর থেকে নিঃসঙ্গতার মতো গোপন কষ্ট নিয়ে বাস করে। একটু আগ বাড়িয়ে দুর্বলতম জায়গাটির আঁচ পেয়ে চোঙায় ফুঁ দিলেই হলো। মাকে দেখতাম, ভেজা ভেজা লাকড়ি দিয়ে রান্নার সময় আগুন বাড়ানোর জন্য চোঙা দিয়ে চুলায় ফুঁ দিতেন, ভেতরের ছাইছাপা আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠতো, মানুষেরও তাই। মন খুলে তারা কথা বলতে থাকে। একেবারে ভেতরের গোপনতম বেদনার কথাটিও বলে দেয়, তখন তার মুখটা গনগনে আগুনের আঁচে মায়ের মুখের মতো টকটকে হয়ে ওঠে। মানুষ বেদনাই গোপন করে, আনন্দ নয়। আমি বিস্ময়ে আবিষ্কার করি, কত মানুষ কত বিচিত্র বেদনা গোপনে পুষে রাখে ভেতরে। যথাযথ সহমর্মিতার স্পর্শ না পেলে হয়তো একজীবন সে-বেদনা অব্যক্তই থেকে যায়। মাঝেমধ্যে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়, হয়তো লেখার উপাত্ত খুঁজতে কেবল মানুষের বেদনা খুঁজি। সত্যিকারের সহমর্মী কি আর হতে পারি? 

এক্সট্রা ক-বগিটি পরে সংযুক্ত বলেই কি না কে জানে অনেক পরে টিকিট কেটেও ঠিক মাঝামাঝি সবচেয়ে সুবিধাজনক আসনটাই পাওয়া গেছে। মাঝামাঝি টেবিলের এই আসনটাতে বসলে মনে হয় রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের সঙ্গে কফি খেতে খেতে আড্ডা পিটাচ্ছি, এই ফারুকীর মনোগামী আসলে আহামরি কোনো নির্মাণ নয় কিংবা রূপান্তর টেলিফিল্মে আদতে এমন কিছু নেই যে, অভিনয় করার জন্য অভিনেতা জোভানকে মাফ চাইতে হবে শেষ পর্যন্ত! আচ্ছা, ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা কি বিশ^কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?  স্নিগ্ধা তাপানুকূলে জানালার ভারী গ্লাস ভেদ করে বাইরের ব্যস্ত হল্লা একদম ভেতরে ঢুকতে পারে না। পরিবেশটা পুরোই রেস্টুরেন্ট। সহযাত্রীরা সমমনা হলে সত্যি বেশ জমতো আড্ডা।

কিন্তু সামনের দুই সিটে বসা একজন, বয়স উনিশ-বিশ হবে। কানে হেডফোন লাগানো, মেসি স্টাইলে কাটা চুলের উঠতি এই যুবক কী গান শুনে যে এভাবে পায়ের ওপর পা তুলে দোলাচ্ছে আমি ঠিক আঁচ করতে পারছি না। আচ্ছা এই জেনারেশন কার গান শোনে? কী যেন বিটিএস না কী, একটা কোরিয়ান দলের নাকি অন্ধ ভক্ত এই জেনারেশন। আমরা বাসায় বোনেরা ঝগড়া এড়াতে লটারি করে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতাম, তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারোনি …। আমি বুঝি না ট্রেনে ওঠা মাত্রই কেন এদের গান শুনতে হবে? গান বাড়িতে শোনা যায় না? যত্তসব। আরেকজনের অবস্থা আরো কাহিল, ডাক্তার দেখানোর মতো প্রায়। রিলস দেখে একা একা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, যেন অসুস্থ কোনো উন্মাদ। হেমায়েতপুর নিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে একা একা হাসতে শিখিয়েছে। সঙ্গী লাগে না এখন মানুষের। 

শেষ হুইসেল বাজার পর আড়মোড়া ভেঙে ট্রেন ধীরে ধীরে নড়তে-চড়তে থাকলে পাশে বসা 888sport promo codeটি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে কাউকে কল দিয়ে জানান ট্রেন ছেড়েছে। রাত নয়টা নাগাদ পৌঁছাবে। তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করি, কাকে ফোন দিলেন তিনি। ছেলে, বর, নাতি … পুরুষ কেউ একজন তো হবেই। হয়তো স্টেশনে নিতে আসবে। কত হবে মহিলার বয়স? ৭০-৭৫-এর বেশি নয়। নিশ্চয়ই ছেলেকে ফোন করেছেন। তাঁর স্বামীর বয়সও কমপক্ষে আশির কাছাকাছি হবেই। বেশিও হতে পারে। রাত নটায় নিশ্চয়ই আশি বছরের বৃদ্ধ কেউ তাকে নিতে স্টেশনে আসবে না। নাকি হবিগঞ্জ তার বাড়িই নয়। কোনো আত্মীয়পরিজনের কাছে যাচ্ছেন তিনি … একা। বেড়াতে কিংবা কোনো কাজে।

কফি, কফি বলতে বলতে ইউনিফর্ম পরা রেলওয়ে কর্মচারী কাছে এলে আমি চিনি ছাড়া এক কাপ কফির অর্ডার করি, 888sport promo codeটিকে জিজ্ঞেস করি, আপনি খাবেন? তিনি মাথা নেড়ে যেন সব ব্যাপারেই তাঁর না-বাচক মনোভাবটি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন। মূলত এটি আমার খুব কমন প্রাথমিক অ্যাপ্রোচ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রেনে উঠলে পাশের যাত্রীকে কফি খাবেন জিজ্ঞেস করেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হই। কিন্তু এই 888sport promo codeকে কব্জা করা সহজ হবে না, এই ধারণা হয়ে যায়। 888sport slot gameের দীর্ঘ ছয়-সাত ঘণ্টা সময় কী করে কাটবে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। ইচ্ছে করে মোবাইলে নেট নেইনি, স্ক্রিন টাইম কমানোর পণ করেছি। এই প্রতিদিন বিচিত্র বিষয়ে হাজার হাজার বিশেষজ্ঞের মতামত পড়তে পড়তে বিরক্তি এসে গেছে। এক মানবসম্পদের ওপর পড়তে পড়তে, জানতে জানতে বছরের পর বছর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, দেশে-বিদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ করতে করতে, বক্তৃতা ঝাড়তে ঝাড়তে চুল পাকিয়ে ফেললাম,

ঘর-সংসার করার ফুরসত মিললো না। তবু এখনো মনে হয়, কিছুই জানা হলো না। আর ফেসবুকে সব বিশেষজ্ঞের ভিড়। নেহায়েত অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, নইলে ছেড়েই দিতাম। সহযাত্রী 888sport promo codeর সঙ্গে কথা বলার আশা ছেড়ে দিয়ে বাবাকে নিয়ে ভাবতে বসি। এই শহরে বাবাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে গিয়েছিলাম প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু না হলে হয়তো শহরটাই আমাদের ছাড়তে হতো না। বাবা খুব ভোরে গেট খুলে হাঁটতে বের হতেন, তারপর বাসায় ফিরে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে প্রায়ই গভীর প্রশান্তি নিয়ে মাকে বলতেন, এই শহরেই জায়গা কিনে বাড়ি বানিয়ে থেকে যাবেন বাবা। প্রকৃতি এক হিসেবি বুড়ো। ঠিক বাবাকে এই শহরেই থেকে যাওয়ার সমস্ত জাল নিপুণভাবে গুটিয়ে দিলো। কী নিরিবিলি শান্ত দিঘির শহর ছিল, পাড়ায় পাড়ায় কেবলই পুকুর আর পুকুর, যেন জলে ভাসা একটা পদ্ম। রাস্তা জুড়ে বিশাল সব গাছ। কড়ই গাছ, অশ্বত্থ গাছ …। কী বিশাল তাদের কাণ্ড! আমার মতো দশটা আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারতো পুরো বিকেল। যখন পাড়ার সবাই ছোটাছুটি করে বউ লুকানো খেলতাম, সযত্নে লুকিয়ে রাখতো আমাদের! কখনো মনে হয়নি সেই শহরটি আমার নয়, আমাদেরকে কোনো দিন পুকুরপাড়ের টিনের চালার বাংলোবাড়িটা ছেড়ে যেতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে রান্নাঘর-লাগোয়া পেয়ারা গাছ আর টিনের বেড়া ডিঙিয়ে শেকড় মেলে দেওয়া আমগাছটা আমাদের ঠিকানা থাকবে না, কল্পনাতেও আসেনি কখনো। সেই আমগাছের নিচে ঝড়ের দিনে পাড়ার ছেলেমেয়েদের দল হুমড়ি খেয়ে নামতো আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতায়।

এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে হঠাৎ শরীরটা খুব খারাপ লাগছে বলে ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন বাবা। আমরা সব শক্তি খরচ করে প্রাণপণে তালপাতার পাখা, নিউজপ্রিন্টের পত্রিকা দিয়ে বাতাস করে বাবার ঘাম শুকিয়ে বাবাকে স্বাভাবিক করতে চাইলাম। মা দৌড়ে গেলেন চাপকল চেপে এক গ্লাস ঠান্ডা জল আনতে। বাবার ঘাম শুকালো ঠিক, কিন্তু বাবার শরীরটা অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা হয়ে গেল। নিথর হয়ে পড়ে থাকা এই দেহটি যে আমাদের কত সহস্র রূঢ়তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে দিয়ে গেল, সেই সন্ধ্যায় আমরা টেরই পাইনি।

তিন বোনকে নিয়ে মায়ের সেই যুদ্ধটা মনে পড়লে এখনো চোখে জল চলে আসে। আমরা তিন বোন, ভাই নেই। এই সুযোগে দাদাজানের বিশাল সম্পত্তি চাচারা আত্মসাৎ করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাবা বেঁচে থাকতেই তুচ্ছ সব অজুহাতে বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা এমনভাবে নষ্ট করলো যে, মারা যাওয়ার পর বাবার মৃতদেহটা পর্যন্ত দেখতে এলো না কেউ। অফিস কলিগ আর পাড়া-পড়শিদের সহায়তায় অকাল বৈধব্যের শোক পাথরচাপা দিয়ে মা বাবাকে এই শহরে কবর দিয়েছিলেন। দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আহাজারি ভুলে রাত না ফুরাতেই ভাবতে বসেছিলেন, মেয়েদের নিয়ে এখন তিনি কোথায় যাবেন! মৃত্যু আর তৎসংক্রান্ত শোকের বাহুল্য যে কেবল পরিবারের সামনে একটা গোছানো ভবিষ্যতের সম্ভাবনাতেই সম্ভব, পরবর্তীকালে দিনে দিনে তা উপলব্ধি করেছি। মায়ের শোক করার ফুরসত মেলেনি, চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই মাকে চোখবাঁধা ষাঁড়ের মতো ছুটতে হয়েছে, কারণ মা যে পথ চেনেন না কিছুরই। এরকম ছোটাছুটি দেখে পাড়া-পড়শিরা পিঁড়ি পেতে মায়ের সমালোচনা করতে বসেছে। অথচ অফিসে বাবার পাওনা টাকাগুলো পেতে কতদিন যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে মাকে। সক্কাল সক্কাল এক হাঁড়ি ভাত আর এক হাঁড়ি ডাল রান্না করে রেখে বেরিয়ে পড়তেন মা। হেঁটেই। রিকশা ভাড়ার টাকা কই? সেই সময়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন চোখে অশ্রু জমেছে টের পাইনি।

দু-ফোঁটা গড়িয়ে পড়তেই এতক্ষণ ধরে রাখা কাঠিন্যের পর্দা ছিঁড়ে তিনি জানতে চাইলেন, কাঁদছো? আমি চোখ মুছে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি খুব সহজ-স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কোথায় যাচ্ছো? বললাম, হবিগঞ্জ। বাবার কবর জিয়ারত করতে। কবর জিয়ারত?  মহিলাটি হঠাৎ কেমন চমকে যায়। আমি চমকটির সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে কথা জমানোর ছুতো খুঁজে পাই। আপনিও হবিগঞ্জ যাচ্ছেন? হ্যাঁ-বোধক মাথা নেড়ে তিনি উদাস দৃষ্টি বাইরে মেলে দেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্নিগ্ধা কম্পার্টমেন্টের বন্ধ জানালায় হোঁচট খায় বলেই দৃষ্টি ফেরানোর সময় চোখাচোখি হয়ে যায় আবার। তাঁর চোখও কি অশ্রুসিক্ত দেখি?

এবার একেবারে খুব চেনা ঘরের মায়ের মতো মমতা নিয়ে জানতে চান, আমার খিদে পেয়েছে কি না। কী আপন মায়াময়  কণ্ঠ। আমার এতদিনের অভ্যাস ছন্দ ফিরে পায়, তাঁর সঙ্গে এবার গল্প জমবে বেশ, তিনি সহজ চেনা মানুষ হয়ে উঠছেন। আমি তাঁকে আবিষ্কারের ষড়যন্ত্র মোটেই বুঝতে না দিয়ে খাওয়ার আগ্রহ দেখাই। সত্যি খিদে পেয়েছে।

তিনি পোঁটলা খুলে নুডলস, পুডিং আর ফ্লাস্ক থেকে চা বের করেন। বোঝা যায়, তিনি নিজেই যে কেবল গোছানো তা নয়, কেউ খুব যত্ন করে এসব গুছিয়ে দিয়েছে। সাধারণত কোনো একা 888sport promo codeকে নিজের জন্য গুছিয়ে এত খাবার নিয়ে কোথাও 888sport slot game করতে এর আগে দেখিনি আমি। 888sport promo code, সে আমি নিজেও বাদ নই এর থেকে। নিজের ওপর অর্পিত ঘরে বাইরের দায়িত্ব-কর্তব্য সব নিপুণভাবে গুছিয়ে দিই, গুছিয়ে রাখি কিন্তু নিজের জন্য সময় নেই। আজো তো না খেয়েই রওনা করেছি।

কী যেন উপমাটা, চাঁপাকলির মতো আঙুল। এই বয়সেও  নিভাঁজ, নিখুঁত হাতখানা। আমাকে প্লেট সাজিয়ে দিতে দিতে আমি লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখি। এক হাতে গ্ল­াস আর অন্য হাতে জলের বোতল নিয়ে বসে থাকেন তিনি, জলজ্যান্ত মমতাময়ী। এই 888sport promo codeকে যেন ভালো না বেসে পারা যায় না কোনোমতেই।

তিনি কথা শুরু করেন এবার। সাগ্রহ নয়, কেমন নিরাসক্তভাবেই। খুব যে জানার আগ্রহ তেমন তাড়া নেই কণ্ঠস্বরে। কাঁদছিলে কেন? বাবার কথা মনে পড়ছিল খুব। মনে পড়ছিল ছেলেবেলার শহরটির কথা … বলতে বলতে নস্টালজিয়ায় ডুব দিই আমি। কী কী বলতে থাকি ভুলে যাই। হঠাৎ সম্বিত পেয়ে মূল তথ্যটা জানাই। জার্মানির বার্লিন শহরে পোস্টিং হয়েছে আমার। চলে যাচ্ছি বছর কয়েকের জন্য। যাওয়ার আগে বাবাকে দেখে যাই। মানুষের জীবন। বলা তো যায় না, যদি আর না ফিরি!

বালাই ষাট, এসব কেন বলছো? একশ বছর বাঁচো মা। মাত্র কয়েকটা মিনিটে মানুষ এমন অচেনা খোলনলচে পালটে একেবারে ঘরের আপনজনের মতো হয়ে উঠতে পারেন? আমি যথারীতি সুযোগটা নিই। কৌতূহলকে রিলের সুতার মতো ছেড়ে দিই … না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই আমার। কেন নেই? আসলে এর কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। মা বলতেন, মহসিন মামার স্বভাব পেয়েছে। অযাচিত কৌতূহল।  তার কাছে প্রাথমিক কয়েকটি বিষয় জানতে চাই, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন, কতদিন থাকবেন?

আমাকে বুঝতে না দেওয়ার সযত্ন চেষ্টা করলেও আমি ঠিকই বুঝি এই প্রশ্নগুলো তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন, জানালেন তাঁর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে। মুম্বাই যাবেন চিকিৎসা করাতে। 888sport appsের ডাক্তার বলেছে এই বয়সে অপারেশন, কেমো, রেডিওথেরাপি ইত্যাদির ঝামেলা শরীর সইতে পারবে কি না কে জানে। তবু ছেলে, ছেলের বউ, আমেরিকা প্রবাসী মেয়ে, অশীতিপর স্বামী সবার ইচ্ছা, চেষ্টা তো করতে হবে। তাঁকে যেতেই হবে মুম্বাইয়ে চিকিৎসার জন্য। মেয়ে আসছে আমেরিকা থেকে, ছেলেও সঙ্গে যাবে। 888sport app টু মুম্বাই টিকিটও কাটা শেষ।

হবিগঞ্জ কেন যাচ্ছেন, কই থাকবেন আবশ্যিক এই প্রশ্নগুলো  888sport app পড়ে যায় অনেক গল্পের আড়ালে। ব্রেস্ট ক্যান্সার এখন ভালো হয়ে যায়, আমি কতজনকে দেখেছি … হিসাব দিতে থাকি। ফাহিমা ভাবি, নিশাত আপা … অনেক কয়টা নাম। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে তিনি জীবনকে ভালোবাসার গন্ধ ছড়ান, হ্যাঁ রে মা। সব জানি আমি। হয়তো ভালো হয়ে যেতাম। কিন্তু এই বয়সটা চিকিৎসা নেবে কি না এটাই ডাক্তারদের ভয়। আমারও ভয়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা তো কিছুই শুনতে রাজি নয়।  কতক্ষণ পরপর তার হাতের মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। দৃঢ় স্বৈরশাসকের মতো কণ্ঠে তিনি বলেন, না একদম ভাবতে হবে না। আমি একাই পারবো। একদম ভাববে না। হ্যাঁ গাড়ি থাকলেই চলবে। বুঝতে পারি, উদ্বিগ্ন ছেলেমেয়েকে আশ্বস্ত করছেন তিনি বারবার। কী পারবেন তিনি একা একা, জিজ্ঞেস না করে শরীরে ঘাতক ব্যাধি নিয়েও মনে এক সুখী 888sport promo codeকে আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি।

বাড়িটিতে অন্যলোকের বাস, যে-বাড়িটিতে আমরা ছিলাম। টিনের চালা দেওয়া বাংলোবাড়িটি নেই। থাকবে না এই বাস্তবতা জেনেই তো এসেছি। এখন এখানে হাইরাইজ ভবন। আমাদের একটা পরিবারের জায়গায় কুড়ি-বাইশটি পরিবার। হঠাৎ দেখি, দেয়ালের পাশে সেই আমগাছ – একি! সত্যি গেটের দেয়ালের পাশে কাঁচামিঠা আমগাছটি এখনো আছে। ঝড়ের রাতে পাল্লা দিয়ে আম কুড়ানো আমগাছটি এত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ঝড়-ঝাপটায়ও কাটা পড়েনি।

দু-দুটো মৃতদেহ শোয়ানো হয়েছিল এখানে, এই গাছটির নিচে। একটা বাবার, আরেকটা মহসিন মামার। বাবা চোখের সামনে চলে গিয়েছিলেন, আর মহসিন মামার মৃতদেহ কড়া পুলিশ পাহারায় কফিনবন্দি অবস্থায় 888sport app থেকে নিয়ে এসেছিল পুলিশের গাড়ি। বাবার ঠান্ডা দেহ ছুঁয়ে আমরা কাঁদতে পেরেছিলাম। মামার দেহটা আমরা দেখতেও পাইনি। শুনেছি কেবল গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। মামিকেও দেখতে দেওয়া হয়নি মামার মৃতদেহটি। আমার নতুন মামি।

মা সহ্যই করতে পারতেন না নতুন মামিকে। কতই বয়স তখন আমার? পাঁচ-ছয় হবে। স্পষ্ট মনে পড়ে, কোনার ঘরে অনাহূতের মতো সারাদিন বসে থাকতো মামি। মামা মামিকে একা ফেলে দুদিন পরপর 888sport app দৌড়াতেন। আর হাওয়ায় রটতো মামার কতশত গল্প। বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল মহসিন মামার। যুদ্ধফেরত দুজনের বেশ চমৎকার সখ্য। মা বেঁচে থাকতে কেবল তোতা পাখির মুখস্থ বুলির মতো সেই গল্পই বলতেন বারবার, বারবার। শেখ কামালের সঙ্গে বার্লিন যুব সম্মেলনে গিয়েছিলেন মহসিন মামা। আজ আবার সেই বার্লিনেই যাচ্ছি আমি। মা বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, তোর মহসিন মামার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিনি তো আগেই বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ বার্লিন। তোকে সে দেশেই পড়তে পাঠাবেন। মা হয়তো বুঝতে চাইতেন না, আমি পড়তে নয়, পড়াতে যাচ্ছি বার্লিনে। আমিও সত্য বলে মায়ের আপন আনন্দে বাদ সাধতাম না। আমি বার্লিন যাচ্ছি, মহসিন মামার দিনমান গল্পের মতো বার্লিন, এতেই যে কী খুশি হতেন মা। পড়তে নাকি পড়াতে তাতে কীই বা আসে-যায়! বেঁচে থাকা যে মহসিন মামার দিন মায়ের বকাঝকা ছাড়া কাটেনি, মৃত্যুর পর সেই মহসিন মামা মায়ের কাছে হিরো। 

মায়ের ধারণা, মামার শোকেই বাবার হার্ট অ্যাটাক করেছে। তিন মেয়ের পিতা আমার বাবা মায়ের ভাই মহসিন মামাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। মামার আব্দারে এক ব্র্যান্ডের ট্রানজিস্টার রেডিও, পছন্দের রসমালাই কত কিছু বাবার অভাবী হাত ধরে ঘরে আসতো শুধু মহসিন মামার জন্য। আমরা চেয়ে না পেলেও মহসিন মামা চেয়েছে আর বাবা আনেননি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।

 যুদ্ধফেরত মহসিন মামার জন্য তখন যেখানে-সেখানে বিব্রত হতে হতো আমাদের। মা তার উড়নচণ্ডী স্বভাব একদম পছন্দ করতেন না। বাবার সঙ্গে তেড়েফুঁড়ে ঝগড়া বাধাতেন – তোমার প্রশ্রয়ে পুলাডা নষ্ট হইতাছে। যুদ্ধমুদ্ধ শেষ। দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে। এখন গুণ্ডামি ছাইড়া একটু পড়াশোনা কর, যেন ভালো একটা চাকরি হয়! তা না। কী আবাহনী চক্র বানায়, কী নাট্যচক্র বানায়!

কিন্তু যেদিন নতুন মামিকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলো মহসিন মামা সেদিনের পর থেকে পাড়ায় আর আমাদের মুখ দেখানোর জো থাকলো না। সবাই বলতে থাকলো, মামিকে জোর করে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে মহসিন মামা। মহসিন মামার বউকে আমরা ডাকতাম নতুন মামি। মা কোনোদিন মামির সঙ্গে ভালো করে কথা বলেননি। কিন্তু মামি ছিলেন আমাদের কাছে এক জীবন্ত বিস্ময়। 888sport app থেকে আসা ফুলপরি। মামির চুল বাঁধা, মামির স্নানগ্লাস, মামির যত্ন করে চোখে কাজল দেওয়া, গালে রোজ আর ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো আর সিøভলেস ব্লাউজে ব্রুস পিন দিয়ে শাড়ির আঁচল আটকানো আমরা তিন বোন পাশে বসে হা করে দেখতাম। যত্ন করে খোঁপা বেঁধে মামি তাতে গুঁজে দিতেন রিনিঝিনি বাজতে থাকা কাঁটা। কী স্বর্গীয় গন্ধ মামির মাথার তেলের…। মামি আমাদেরও সাজিয়ে দিতেন মাঝে মাঝে।

মামা ফেরার আগে আগে সাজতেন মামী। মামা একটা গন্ধরাজ ফুলের ভাঙা ডাল নিয়ে মামির খোঁপায় গেঁথে দিতেন। একদিন মামা আর মামির সঙ্গে সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। ঠিক সেই সিনেমায় দেখা দৃশ্যটার মতো দৃশ্য বাসায় তৈরি হতে দেখে আমাদের কখনোই মনে হতো না মামা মামিকে জোর করে ভাগিয়ে এনেছেন।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে একটা স্বপ্নের স্বদেশ আগপাশতলা অন্ধকারে ঢেকে গেলে আমাদের বাসাটাও অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। আলো না জ্বালিয়ে সারারাত বারান্দার হাতল চেয়ারে থ মেরে বসে থাকতেন বাবা। কিচ্ছু খাননি তিনদিন। খাবার কথা বললেই বলতেন, কেমন বেইমান! নিজের বাপরে কেউ মাইরে ফালায়! মাকে কতবার দেখেছি আমাদের ভাত বেড়ে দিতে, বাজার থেকে কিনে আনা ক্ষারে কাপড় কাঁচতে কাঁচতে শুধু বারবার আঁচলে চোখ মুছতেন। সেবার তিনদিন নিখোঁজ ছিলেন মহসিন মামা। মামা তো প্রায়ই লাপাত্তা থাকেন। কেউ তলিয়ে ভাবেনি কিছু। কিংবা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর গভীর শোকের কাছে মহসিন মামার না ফেরার ঘটনাটা তুচ্ছই ছিল।

কিন্তু যেদিন সন্ধ্যায় মামার লাশ এলো, আমাদের থ মারা স্তব্ধতা কাটানোর আগেই তড়িঘড়ি কবর দিতে হয়েছিল মামাকে। পুলিশ চাপ দিচ্ছিল। লাশ থেকে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছিল, ফুলেও নাকি উঠেছিল, চেনার উপায় ছিল না। সবাই যখন এসব বলাবলি করছিল, পুলিশ মামার মৃতদেহ গাড়িতে তুলে নিয়ে সোঁ করে ছুটে যাচ্ছিল কবরস্থানের দিকে, মামিও সেই ফাঁকে কখন কার সঙ্গে চলে গিয়েছিল বাড়ি থেকে আমাদের মনেই নেই কিংবা খেয়ালও করিনি আমরা।

আমরা মামির লিপস্টিক, রোজ পাউডার আর সেন্টের শিশি ভাগাভাগিতে মত্ত ছিলাম। হয়তো মত্তই থাকতাম আরও কিছুকাল যদি না মাস না-ফুরাতেই বাবার মৃত্যু হতো। আমার বাবা ভাইদের চরম স্বার্থপরতায় মুষড়ে পড়েছিলেন। মহসিন মামা বলতে অজ্ঞান ছিলেন। তার ওপর সীমাহীন নির্ভরতা আর অপত্য স্নেহ ছিল বাবার। মামার মৃত্যুটা হয়তো সইতে পারেননি বাবা।

দশ বছরের চুক্তিতে জার্মানি যাচ্ছি, আদৌ আর ফিরবো কি না জানি না। দেশে কোনো পিছুটান নেই। আম্মা নেই তাও দশ বছর অতিক্রান্ত। বনানীতে মাকে শেষবারের মতো বিদায় বলে এসেছি।

হোটেল রুম থেকে পরদিন সকাল সকাল বের হই। বাবাকে একবার বিদায় বলে আসি। কবর জিয়ারত করে শহরের সেই প্রাথমিক স্কুলটা দেখার খুব ইচ্ছা আমার, যেখানে আমার অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা শুরু।

কবরস্থানটি এখন আর পরিবেশ দেখে চেনার উপায় নেই। একসময় যখন চারদিকে জলাভূমি ছিল, আজ সেখানে সারি সারি হাইরাইজ বিল্ডিং। খোলা মাঠ পেরিয়ে যেখানে রেললাইন চোখে পড়তো, সেখানে টাইলসে মোড়া ঝাঁ-চকচকে তিনতলা কবরস্থান মসজিদ। রেললাইনের অস্তিত্বও নেই।

ভাগ্যিস কবরস্থান লেখা সাইনবোর্ড ছিল চোখে পড়ার মতো। নইলে বেঁচে থাকা মানুষের বিলাসের দাপটে, মৃতরা কোণঠাসা হয়ে আছে অসহায়ের মতো। কবরস্থানে ঢোকার পথে সেই 888sport promo codeর সঙ্গে আবার দেখা। ভূত দেখার মতো চমকে উঠি আমি। আপনি?

নির্মল হাসিতে জড়িয়ে ধরলেন তিনি আমাকে, হ্যাঁ আমি তোমার নতুন মামি। তুমি তোতন। তোমাকে ট্রেনেই চিনতে পেরেছি আমি, সারাদিন সাজুগুজুর জন্য আমার পেছন পেছন ঘুরতে …।

তাঁর বুকে এখনো সুগন্ধি তেলের মতো অপার মমতার গন্ধ। বুক থেকে আমাকে ছাড়িয়ে মৃদু গলায় বলেন তিনি, ডাক্তার আমার ফিরে আসার নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। হয়তো আর ফিরেই আসবো না আমি। শেষবারের মতো তোমার মামাকে একবার দেখতে এসেছি, সবাইকে বলেকয়েই এসেছি। মানুষটা খুব ভালোবাসতো আমাকে। জীবনে সব পেয়েছি মা; কিন্তু এমন ভালোবাসা আর পাইনি। পঞ্চাশ বছর পর তাকে জানাতে এসেছি, খুব শিগগিরই তার কাছে যাচ্ছি আমি।