আশীষ লাহিড়ী
অরবিন্দ পোদ্দার বঙ্কিম-মানসের বিকাশকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথম পর্বে তাঁর ‘অপরিমেয় প্রাণপ্রাচুর্য ও আনন্দবেগের’ পরিচয় মেলে। দ্বিতীয় পর্বে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘নিগূঢ় বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ এবং নিরপেক্ষ বিশেস্নষণ ক্ষমতা।’ কিন্তু ওই দ্বিতীয় পর্বেরই শেষভাগে ‘অতীত আকর্ষণ’ এবং ‘সম্মুখ-দৃষ্টি’র একটা সমন্বয় গড়ে উঠতে থাকে। তৃতীয় পর্বে, যার সূত্রপাত মোটামুটি ১৮৮০ সালে, সেই সমন্বয় ভাবনার ‘প্রচার-ক্রিয়া’ই হয়ে ওঠে প্রধান।১ জীবন888sport sign up bonusতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রচার (১৮৮৪) বাহির হইতেছে।… এই সময়ে কলিকাতায় শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্কিমবাবুর মুখেই তাঁহার কথা প্রথম শুনিলাম।… সেই সময় হঠাৎ হিন্দুধর্ম পাশ্চাত্য 888sport apkের সাক্ষ্য দিয়া আপনার কৌলীন্য প্রমাণ করিবার যে অদ্ভুত চেষ্টা করিয়াছিল তাহা দেখিতে দেখিতে চারিদিক ছাড়াইয়া পড়িল। ইতিপূর্বে দীর্ঘকাল ধরিয়া থিয়সফিই আমাদের দেশে এই আন্দোলনের ভূমিকা প্রস্ত্তত করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু বঙ্কিমবাবু যে ইহার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগ দিতে পারিয়াছিলেন তাহা নহে।’
ওই একই পর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারা পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু বাঙালি ভদ্রসমাজে প্রবল প্রভাব বিসত্মার করে আর সেই প্রভাব বিসত্মারের প্রধান বাহন ছিলেন ব্রাহ্মরাই – শুধু কেশব সেন বা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নন, আরো অনেকেই। অথচ বঙ্কিম কিন্তু ওই ভক্তিবিহবল উন্মাদনার দ্বারা আদৌ প্রভাবিত হননি। বঙ্কিম-প্রকল্পিত পেশি ও যুক্তিনির্ভর হিন্দুত্বের সঙ্গে, অনুশীলনধর্মের সঙ্গে, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তিনির্ভর হিন্দুত্বের সংঘাতটাই এখানে আমাদের আলোচ্য। এর জন্য আমরা নির্ভর করব শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎকারের শ্রীম-প্রদত্ত প্রত্যক্ষ বিবরণটির ওপর।
অনুঘটক সহ-ডেপুটি
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র কলকাতায় তরুণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধরলাল সেনের (১৮৫৫-৮৫) শোভাবাজার অঞ্চলের বেনিয়াটোলার বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হন। তখন বঙ্কিমের বয়স ছেচলিস্নশ। এর আগে ১৮৮২ সালে তাঁর রাজসিংহের অসম্পূর্ণ প্রথম সংস্করণটি বেরিয়েছে। ১৮৮২ সালেই বেরিয়ে গেছে আনন্দমঠ, ১৮৮৪ সালের এপ্রিলে দেবী চৌধুরাণী। ১৮৮৪-তেই বই আকারে বেরিয়েছে মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত। 888sport apkরহস্যের দ্বিতীয় সংস্করণও ওই সালে প্রকাশিত। আবার ওই সাল থেকেই প্রচারে কৃষ্ণচরিত্র ধারাবাহিকভাবে বেরোতে শুরু করেছে। সৃজন-জীবনের পূর্ণতার লগ্নেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের, যাঁর অনুঘটক অধরলাল সেন।
উচ্চশিক্ষিত (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ এবং ‘ফ্যাকাল্টি অব আর্টসে’র সদস্য), সংস্কৃতিমান অধরলাল সেনের বয়স তখন ২৯-৩০। শ্রীম জানিয়েছেন, হিন্দুদের জাতিবিভাগ অনুযায়ী তিনি সুবর্ণবণিক। প্রথম জীবনে নাসিত্মক, পরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে বিমোহিত হন। ‘ঠাকুর অধরের জিহবায় ইষ্টমন্ত্র লিখিয়া দেন এবং ভাবাবিষ্ট অবস্থায় অধরের বক্ষ ও মসত্মক স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ ও স্নেহ কিন্তু তাঁকে অপঘাত মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারেনি। ‘সরকারি কাজে অধরকে ঘোড়ায় চড়িতে হইত। এই ব্যাপারে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে একাধিকবার সাবধান করিয়াছিলেন। কিন্তু ত্রিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ একদিন ঘোড়ার পিঠ হইতে পড়িয়া যাওয়াতেই তাঁহার মৃত্যু হয়। সেই সময়েও শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে দেখিতে আসিয়া অশ্রম্নপূর্ণ নেত্রে তাঁহাকে স্পর্শ করেন।’২ অধরলালের বাড়িতে বঙ্কিম-শ্রীরামকৃষ্ণ সাক্ষাতের অল্পকাল পরেই এ-দুর্ঘটনা ঘটে।
শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম নিষ্ঠাবান ‘গৃহীভক্ত’ অধরলাল সেন ‘সমসত্ম দিন অফিসের খাটুনির পর মুখে ও হাতে একটু জল দিয়াই প্রায় প্রত্যহই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন’ করবার জন্য নিজের বেনিয়াটোলার বাড়ি থেকে ‘প্রায় দুই টাকা গাড়িভাড়া’ দিয়া দক্ষিণেশ্বর যেতেন। সেখানে পৌঁছেই শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করে তিনি ‘মা-কালীকে দর্শন করিতে যাইতেন। পরে মেঝেতে পাতা মাদুরে শুয়ে ‘অল্পক্ষণমধ্যে নিদ্রাভিভূত হইতেন। রাত ৯-১০টার সময় তাঁহাকে উঠাইয়া দেওয়া হইত।’৩ তারপর তিনি বাড়ি ফিরতেন। পরদিন আবার অফিস যেতেন। এরকম ভাবা অসংগত নয় যে, এই তরুণ উচ্চশিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দক্ষিণেশ্বর ছিল বিজাতীয় চাকরিজগতের এবং স্বদেশি গার্হস্থ্যজগতের চাপ থেকে কিছুক্ষণের মুক্তিলাভের, শারীরিক ও মানসিক ক্লামিত্ম অপনোদনের, মনসত্মত্ত্বের ভাষায় ‘রিল্যাক্সেশনে’র একটি পরিসর। এঁর আহবানে বঙ্কিম শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে যেতে রাজি হয়েছিলেন, এই তথ্যটি আগ্রহজনক।
এই তরুণ সুবর্ণবণিক ভক্ত ‘ঠাকুরকে প্রায়ই শোভাবাজারের বাড়িতে লইয়া যাইতেন। ঠাকুর আসিলে তথায় উৎসব পড়িয়া যাইত।’ সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ বহুবার ‘কীর্তনানন্দে সমাধিস্থ’ হতেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর এরকমই এক উৎসবে বঙ্কিমসহ কয়েকজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আমন্ত্রিত ছিলেন। ‘তাঁহারা নিজে ঠাকুরকে দেখিবেন ও বলিবেন, যথার্থ তিনি মহাপুরুষ কিনা।’ অধরলাল হয়তো নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে ধরে নিয়েছিলেন যে, বঙ্কিমও ‘ঠাকুর’কে দেখলে, বিশেষ করে তাঁর ‘কীর্তনানন্দে সমাধিস্থ’ দশা প্রত্যক্ষ করলে, আবিষ্ট হবেন। কারণ ততদিনে বঙ্কিম যুক্তিবাদ আর 888sport apkমনস্কতার পথ ছেড়ে যুক্তিবাদের সঙ্গে হিন্দু আদর্শের সংমিশ্রণে একটা নতুন ভাবধারার ‘প্রচারে’ রত।
অধরলাল সগর্বে বঙ্কিমকে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বভাবসিদ্ধ রঙ্গচ্ছলে জিগ্গেস করেন, বঙ্কিম ‘বাঁকা’ কেন?৪ বঙ্কিমের উত্তর : ‘আর মহাশয়! জুতোর চোটে। সাহেবের জুতোর চোটে।’ ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে এ-উত্তর তাৎপর্যময়। ১৮৮১ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে তিনি হাবড়ায় বদলি হন এবং অনতিবিলম্বেই কালেক্টর সিই বাকল্যান্ডের সঙ্গে তাঁর ‘ঝগড়া’ হয়। এর কিছুকাল পরে তিনি বাংলা সরকারের অস্থায়ী অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু তারপরই ওই পদটির বিলোপ ঘটিয়ে ‘আন্ডার সেক্রেটারি’ নামক পদের সৃষ্টি হয়, যে-পদ ব্রিটিশদের জন্যই সংরক্ষিত। ‘সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্র বাধ্য হন নবনিযুক্ত আন্ডার সেক্রেটারি বস্নাইথ সাহেবকে চার্জ’ বুঝিয়ে দিতে। এরপর ১৮৮৩ সালে আবার হাবড়ায় বদলি হয়ে এসে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে তাঁর তুমুল সংঘাত বাধে, চাকরি ছেড়ে দেবার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।৫ শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের কাছে বঙ্কিম যে এ-প্রসঙ্গটি তোলার উপযুক্ত মনে করেছিলেন, এ থেকে বোঝা যায়, বিদেশি শাসনের অধীনে ‘চাকরি’ করার তীব্র কিন্তু অসমাধেয় জ্বালা তাঁর মনে কত জাগ্রত ছিল।
‘প–ত’ বঙ্কিমের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্ন : ‘মানুষের কর্তব্য কী? কী সঙ্গে যাবে? পরকাল তো আছে?’ উত্তরে বঙ্কিম মেকি-তাচ্ছিল্যর সুরে, প্ররোচনাত্মক ঢঙে – ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফেইন্ড ইরেভারেন্স’ সহকারে, বলেন, ‘পরকাল! সে আবার কী?’ ১৮৮২ সালে বেরিয়ে গেছে আনন্দমঠ, ১৮৮৪ সালের এপ্রিলে দেবী চৌধুরাণী। ঠিক ওই সময়েই প্রচারে ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছে তাঁর কৃষ্ণচরিত্র। তবু তিনি ওই ছদ্ম-অভক্তির সুরে কথা বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণকে প্ররোচিত করবার জন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু প্ররোচিত না-হয়ে মুক্তি ও পরলোকের বিসত্মারিত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন : ‘যতক্ষণ না জ্ঞান হয়, ঈশ্বরলাভ হয়, ততক্ষণ পরকালও আছে। জ্ঞানলাভ হলে, ঈশ্বরদর্শন হলে মুক্তি হয়ে যায় – আর আসতে হয় না।’ অন্য যে-কোনো হিন্দুর মতোই তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মনুষ্যজন্মের চেয়ে জঘন্য কিছু হতে পারে না। সুতরাং ‘আর আসতে’ না-হওয়াটাই মুক্তি।
আহার, নিদ্রা ও মৈথুন
বঙ্কিমের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের পরের প্রশ্ন : ‘আচ্ছা, আপনি কী বলেন, মানুষের কর্তব্য কী?’ উত্তরে শুধু তাচ্ছিল্য নয়, রীতিমতো ফক্কুড়ি করার ঢঙে বঙ্কিম ‘হাসিতে হাসিতে’ বলেন, ‘আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।’ এবার কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে; তিনি প্ররোচিত হন। ‘বিরক্ত হইয়া’ বলেন :
এঃ, তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া। তুমি যা সারাদিন কর, তাই তোমার মুখে বেরোচ্ছে। লোকে যা খায়, তার ঢেকুর ওঠে। মুলো খেলে মুলোর ঢেকুর ওঠে। ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর ওঠে। কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর সারাদিন রয়েছে, আর সারাদিন ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে। কেবল বিষয়চিমত্মা করলে পাটোয়ারি স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বরচিমত্মা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ও-কথা কেউ বলবে না।
গ্রাম্য সারল্যের প্রতিমূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণ নাগরিক পরিশীলনের প্রতিভূ বঙ্কিমের শেস্নষটা ধরতেই পারলেন না। আনন্দমঠ আর দেবী চৌধুরাণীর লেখককে অষ্টপ্রহর ‘আহার নিদ্রা মৈথুনে’র উদ্গার তোলার দায়ে অভিযুক্ত করা যে কতখানি হাস্যকর, তার কোনো বোধ শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল না। তিনি তাঁর নিজের জগৎ নিয়ে
থাকতেন, বহিঃপৃথিবীর জটিলতা সম্পর্কে তাঁর গভীর ধারণা বা 888sport apk download apk latest version, কোনোটাই ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করলেন, অনুশীলনতত্ত্বের প্রবক্তা বুঝি ‘আহার নিদ্রা মৈথুনে’ দিনাতিপাত করাটাই কাম্য বলে মনে করেন। অথচ ঠিক এর বিপরীতটাই কিন্তু বঙ্কিমের বক্তব্য। শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকেরা আহার নিদ্রা মৈথুনে মেতে থেকে দেশের সর্বনাশের পথ প্রশসত্ম করছে, এ-কথা বহুবার বহু উপলক্ষে বলেছেন তিনি। ৬ জানুয়ারি, ১৮৮৩ কালীপ্রসন্ন ঘোষকে উড়িষ্যা থেকে লেখেন :
আমি যখন প্রথম এখানে আসি, তখন দুই এক মাসের জন্য আসিতেছি, এরূপ কর্তৃপক্ষের নিকট শুনিয়াছিলাম। এ জন্য একাই আসিয়াছি।… এক্ষণে জানিলাম ইহার ভিতর অনেক চক্র আছে।… সেই মন্থরার দল আমাদের স্বদেশী স্বজাতি, আমার তুল্য পদস্থ; আমার ও আপনার বন্ধুবর্গের মধ্যে গণ্য। আমিই বা আনন্দমঠ লিখিয়া কী করিব, আপনিই বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষাপরায়ণ আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল, ‘বন্দে উদরং।’৬
এই চিঠি থেকে আরো লক্ষণীয়, বঙ্কিম কিন্তু বিশেষ করে তাঁর ‘তুল্য পদস্থ’, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের বাঙালিদের সম্পর্কেই ওই ব্যঙ্গোক্তি করেছেন – চাষি, কেরানিকুল বা শ্রমজীবীদের সম্পর্কে নয়, যদিও এই পর্যায়ে তাদের প্রতিও যে তাঁর বিশেষ উচ্চ ধারণা ছিল এমন নয়।
পুরীষতান্ত্রিক চিত্রকল্প
শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমকে ঈশ্বরচিমত্মাহীন, ‘মেয়েমানুষে আসক্ত’ আত্মম্ভরী প–ত বিবেচনা করে ভৎর্সনা করে বলেন :
কাকও মনে করে, আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের গু খেয়ে মরে। কাক দেখোনো, কত উড়ুরপুড়ুর করে, ভারী স্যায়না। সে তুলনায় হাঁস ভালো। – হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে।
এই বহুপ্রচারিত লোকপ্রচলিত মিথ্যাটি অন্য অনেকের মতো শ্রীরামকৃষ্ণও বিশ্বাস করতেন, যদিও এটা প্রমাণিত যে, হাঁস আদপেই নীর বর্জন করে ক্ষীর খায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কাঞ্চন-বৈরাগ্য’ এবং ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ তত্ত্ব শুনে তাঁকে ‘প্ররোচিত’ করবার জন্য বঙ্কিম বলেন, ‘টাকা মাটি! মহাশয়, চারটা পয়সা থাকলে গরিবকে দেওয়া যায়। টাকা যদি মাটি, তাহলে দয়া পরোপকার করা হবে না?’ শ্রীরামকৃষ্ণ এবার সত্যিই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন :
দয়া! পরোপকার! তোমার সাধ্য কি যে তুমি পরোপকার করো? মানুষের এত নপর-চপর কিন্তু যখন ঘুমোয়, তখন যদি কেউ দাঁড়িয়ে মুখে মুতে দেয়, তো টের পায় না, মুখ ভেসে যায়। তখন অহংকার, অভিমান, দর্প কোথায় যায়?
এরপর বঙ্কিমকে ‘শম্ভু মলিস্নকের গল্পটি’ শোনান শ্রীরামকৃষ্ণ। শম্ভু মলিস্নক ‘খুব কতকগুলো ডিসপেনসারি, হাসপাতাল’ করতে চেয়েছিল। সেটা তাঁর মতে খারাপ কাজ নয়, ‘কিন্তু তার থাক আলাদা। যে শুদ্ধভক্ত, সে ঈশ্বর বই আর কিছু চায় না।’ এই পরোপকারকেও তিনি ‘বিষয়চিমত্মা’ মনে করেন। সুমিত সরকার লক্ষ করতে ভোলেননি যে, ‘ভদ্রলোকদের সমাজকল্যাণমূলক ক্রিয়াকর্মের বিশিষ্ট বিষয়গুলির একটি তালিকা তাঁর একটি গল্পে তিনি প্রায়ই পরিবেশন করতেন।’ কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের ‘মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের নামেই মিশন প্রতিষ্ঠা করে বিবেকানন্দ সুপরিকল্পিত লোকসেবাকেই মিশনের মূল লক্ষ্য করে নেন।’৭
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর উপদেশগুলি বিতরণ করবার জন্য প্রায়শই পুরীষতান্ত্রিক রূপকের ও চিত্রকল্পের আশ্রয় নিতেন। কথামৃতের পাতায় পাতায় তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। এর একটি মনসত্মাত্ত্বিক বিশেস্নষণ নিশ্চয়ই করা যায়, কিন্তু এখানে অন্য একটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ইংরেজি ভদ্রতাবোধের প্রসাদবঞ্চিত নিম্নবর্গীয় লোক-প্রকাশভঙ্গির স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবেই, ভদ্রলোকি – বিশেষত ব্রাহ্ম – শস্নীল ভাষার ‘অপর’ হিসেবেই, তাঁর মুখে উঠে আসত এই ভাষা। শিক্ষিত ভদ্রলোকি রুচিশীলতা এই অবিরল পুরীষতান্ত্রিক উচ্চারণে আহত হতো সন্দেহ নেই, বিশেষত ব্রাহ্মসমাজি, ভিক্টোরীয় রুচিবাগীশতা। আবার শহরের পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্গীয় ভদ্রলোকেরাই – এমনকি ব্রাহ্মরাও – ছিল এসব উপদেশের উদ্দিষ্ট।
বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষ করে উলেস্নখযোগ্য এই কারণে যে, তিনি রুচিশীলতা, আচরণের সুভদ্রতা ও ভাষার সংযমের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবন888sport sign up bonusর প্রবাদপ্রতিম অনুচ্ছেদটি এখানে 888sport app download for android করি :
একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ প–ত স্বদেশ সম্বন্ধে তাঁহার কয়েকটি স্বরচিত সংস্কৃত শেস্নাক পড়িয়া শ্রোতাদের কাছে তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিমবাবু ঘরে ঢুকিয়া এক প্রামেত্ম দাঁড়াইলেন। প–তের 888sport app download apkর একস্থলে, অশস্নীল নহে, কিন্তু ইতর একটি উপমা ছিল। প–ত মহাশয় যেমন সেটিকে ব্যাখ্যা করিতে আরম্ভ করিলেন অমনি বঙ্কিমবাবু হাত দিয়া মুখ চাপিয়া তাড়াতাড়ি সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। দরজার কাছ হইতে তাঁহার সেই দৌড়িয়া পালানোর দৃশ্যটি যেন আমি চোখে দেখিতে পাইতেছি।
হুতোমি ভাষা সম্বন্ধে বঙ্কিমের মমত্মব্য প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে :
হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশস্নীল নয়, সেখানে পবিত্রতাশূন্য…। যিনি হুতোমপেঁচা লিখিয়াছিলেন, তাঁহার রুচি বা বিবেচনার প্রশংসা করি না।৮
এই যাঁর রুচি ও মত, শ্রীরামকৃষ্ণের পুরীষতান্ত্রিক চিত্রকল্প, রূপক ও উপমাগুলি শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু এ-বিষয়ে তাঁর বা অন্যদের কোনোরকম অস্বসিত্মর কোনো পরিচয় শ্রীম-লিখিত বিবরণে আমরা পাই না।
জগৎ, সৃষ্টি, সায়েন্স, ফায়েন্স
শ্রীরামকৃষ্ণ অতঃপর প্রশ্ন করেন :
কেউ কেউ মনে করে… আগে জগতের বিষয়, জীবের বিষয় জানতে হয়, আগে সায়েন্স পড়তে হয় (সকলের হাস্য)। তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এ-সব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। তুমি কি বল? আগে সায়েন্স, না আগে ঈশ্বর?
বঙ্কিমচন্দ্র ‘আগে সায়েন্স, পরে ঈশ্বর’পন্থী শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার চটে যান :
ওই তোমাদের এক। তাঁকে লাভ করলে দরকার হয়তো সবই জানতে পারবে।… তুমি অত জগৎ, সৃষ্টি, সায়েন্স, ফায়েন্স এ-সব করছো কেন?… স্যায়না বুদ্ধি, পাটোয়ারি বুদ্ধি, বিচার বুদ্ধি করলে, ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
এরপরই ভাবতুঙ্গ। কেশবচন্দ্রের ভক্ত, ব্রাহ্মসমাজের সুপরিচিত গীতিকার ও গায়ক ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল ‘গান গাহিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তন একটু শুনিতে শুনিতে হঠাৎ দণ্ডায়মান ও ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশূন্য হইলেন। একেবারে অমত্মর্মুখ, সমাধিস্থ। দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ।’ শ্রীম জানিয়েছেন, ত্রৈলোক্যনাথের গান শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ নাকি প্রায়ই ‘ভাবাবিষ্ট’ হতেন। পাভলভীয় পরিভাষায় একে হয়তো ‘কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স’ বলা যায়। বঙ্কিমের কাছে ব্যাপারটা নতুন, হয়তো অভিনব। তাই ‘বঙ্কিম ব্যসত্ম হইয়া ভিড় ঠেলিয়া ঠাকুরের কাছে গিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন। তিনি সমাধি কখনও দেখেন নাই।’
বস্ত্তত, এই ‘সমাধি’ দেখানোর জন্যই তো অধরলাল বঙ্কিমকে এবং অন্য ডেপুটিদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সে-উদ্দেশ্য তাঁর সার্থক।
‘কিয়ৎক্ষণ পরে একটু বাহ্য হইবার পর ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন।… সে অদ্ভুত নৃত্য দেখিয়া বঙ্কিমাদি ইংরেজী পড়া লোকেরা অবাক!’ কিন্তু এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বঙ্কিম ঠিক কী মমত্মব্য করলেন, সেটা শ্রীম লেখেননি। তবে এটুকু লিখেছেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ স্বাভাবিক হবার পর বঙ্কিম তাঁর কাছে ‘ভক্তি কেমন করে হয়’ জানতে চান। শ্রীরামকৃষ্ণ এককথায় বলেন, ‘ব্যাকুলতা’, যা সম্পূর্ণ নিঃশর্ত, আন্কন্ডিশন্ড। ছেলে যেমন মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়, সেইরকম ব্যাকুলতা, যার মধ্যে কোনো বিচারবুদ্ধির প্রণোদনা নেই। যুক্তিতর্ক, জ্ঞানবুদ্ধি ছেড়ে বঙ্কিমকে সেই আন্কন্ডিশন্ড ভাবের গভীরে ডুব দেওয়ার উপদেশ দেন তিনি :
গভীর জলের নীচে রত্ন রয়েছে, জলের উপর হাত-পা ছুড়লে কি হবে?… ঠিক মাণিক লাভ করতে গেলে জলের ভিতর ডুব দিতে হয়।
এবারেও ছদ্ম-তাচ্ছিল্যর সুরে বঙ্কিমের উত্তর : ‘মহাশয়, কি করি, পেছনে শোলা বাঁধা আছে। (সকলের হাস্য)। ডুবতে দেয় না।’ তিনি বুঝিয়ে দেন, বিচারবুদ্ধিহীন ব্যাকুলতাসর্বস্ব ভক্তির পথ তাঁর নয়, যুক্তিবুদ্ধির ‘শোলা’ তিনি ত্যাগ করতে পারবেন না। সুতরাং শেষ পর্যমত্ম অধরলাল সেনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল মনে হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিদশা দেখে তিনি নিজে যেভাবে আপস্নুত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, সেরকম কিছু স্পষ্টতই বঙ্কিমের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তবে বঙ্কিম যে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘ফেনোমেনন’টিকে নিয়ে ভাবনাচিমত্মা করেছিলেন সেটা ঠিক।
বিদায় নেবার আগে বঙ্কিম ‘ঠাকুরকে প্রণাম’ করে ‘অনুগ্রহ করে’ তাঁর ‘কুটিরে একবার পায়ের ধুলা’ দেবার নিমন্ত্রণ করেন। সে-নিমন্ত্রণের মধ্যেও ছিল সূক্ষ্ম সংশয়বাদী শেস্নষ : ‘সেখানেও দেখবেন ভক্ত আছে।’ শ্রীরামকৃষ্ণ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা-সহকারে বুঝিয়ে দেন যে, ভক্ত নানারকম হয়। ভক্তির ছলে ধান্দা গোছানোর ব্যাপারটা যে তিনি ভালোই বোঝেন তার প্রমাণ দেন বিখ্যাত ‘গোপালের গল্প’ বলে। বঙ্কিম কিছু মনে করলেন না। কিন্তু বিদায়ের আগে ‘একাগ্র হয়ে কি ভাবিতেছিলেন’ – এতটাই একাগ্র যে, আর একটু হলেই গায়ের চাদর ফেলেই চলে যাচ্ছিলেন। শ্রীমর প্রশ্ন, আমাদেরও প্রশ্ন : ‘বঙ্কিম কি ভাবিতেছিলেন?’
বঙ্কিমের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের আর দেখা হয়নি। পরে ‘শ্রীযুক্ত গিরিশ ও মাস্টারে’র সঙ্গে বঙ্কিমের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনেক কথা হয়। ঠাকুরকে আবার দর্শন করিতে আসিবার ইচ্ছা’ও তিনি প্রকাশ করেন, কিন্তু আসেননি।
৬ ডিসেম্বর, ১৮৮৪ সালেই বঙ্কিমের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম ও শেষ দেখা। শ্রীম জানাচ্ছেন, এরপর ‘২৭ শে ডিসেম্বর, শনিবার’ শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী চৌধুরাণীর ‘কতক অংশ পাঠ শুনিয়াছিলেন ও গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মের বিষয় অনেক কথা বলিয়াছিলেন।’ সে-কথাগুলি কী, তা অবশ্য লেখেননি তিনি। লিখলে হয়তো বোঝা যেত, বঙ্কিমের গীতাভাবনার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের গীতাভাবনা কতদূর মিলত।
সূত্র নির্দেশ
১. দ্রষ্টব্য অরবিন্দ পোদ্দার, বঙ্কিম-মানস, ‘বঙ্কিম ঐতিহ্য ও বন্দে মাতরম’, প্রত্যয়, কলকাতা ২০১২, পৃ ৮৯।
২. শ্রীম-কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, দ্বিতীয় খ-, উদ্বোধন, কলকাতা ১৯৯৬, পৃ ১২৯৩।
৩. ওই।
৪. শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের কথোপকথনের যাবতীয় বিবরণ ও উদ্ধৃতির উৎস কথামৃত, দ্বিতীয় খ-, পৃ ১২০৯-১২২০।
৫. অরবিন্দ পোদ্দার, পৃ ৯০-৯১।
৬. বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খ-, সম্পাদনা : যোগেশচন্দ্র বাগল, 888sport live football সংসদ, কলকাতা ১৯৬৮, পৃ ৯২২।
৭. সুমিত সরকার, কলিযুগ, চাকরি, ভক্তি : শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর সময়, 888sport app download apk latest version ও সম্পাদনা : শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেরিবান, কলকাতা ২০০৬, পৃ ১৬।
৮. ‘বাঙ্গালা ভাষা’, বঙ্গদর্শন, ১২৮৫ জ্যৈষ্ঠ, বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খ-, পৃ ৩৭২। r

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.