এক. প্রবেশক
ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ।
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।
ও বগী তুই খাস কি?
পানতা ভাত চাস কি?
পানতা আমি খাই না
পুঁটি মাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।
খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের এই ছড়াটি – যার শিরোনাম ‘কানা বগীর ছা’ – সম্ভবত 888sport appsের ঘরে ঘরে শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় একটি ছড়া। এই ছড়া শুধু 888sport appsের সমৃদ্ধ, সনাতন ঐতিহ্যিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্যেরই অবতারণা করে না, এর ভেতর স্পষ্ট হয় বাঙালি জীবনযাত্রার প্রতীক ও সাংকেতিক চিহ্নসমূহ, যাকে রুশ দার্শনিক, 888sport live football-সমালোচক এবং সেমিওটিশিয়ান মিখাইল বাখতিন চিহ্নিত করেছেন সেমিওটিক্স রূপে। ভাষার গভীরে প্রচ্ছন্ন থাকা একটি জাতির চালচলন, মেলামেশা, কথোপকথন, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ এবং এমনকি এই উপাদানগুলোর সঙ্গে ওই জাতির সংশ্লিষ্টতা – এ সবকিছুকেই আমরা বলতে পারি ‘সেমিওটিকস’। আমরা, বিশেষত বাঙালিরা, জন্ম থেকেই নদী, সবুজ গাছপালা, ঝোপঝাড়, খাল-বিল, বৃষ্টি, বন্যা, নৌকা, সাপখোপ, মশামাছি, ব্যাঙ, গরু, ছাগল, ভেড়া, কাক, অপরাপর পাখি যার মধ্যে ওই বগীসহ চড়ুই, শালিক, টিয়া, ময়না এবং সচরাচর দৃশ্যমান আরো অনেক প্রজাতির পাখি (শহর ও গ্রামে) এবং তাদের ডাক, ফড়িং, প্রজাপতি – এসবই দেখে দেখে বড় হই। ফলে প্রকৃতিকে আমরা কখনো আগন্তুক মনে করি না এবং আমাদের ভাষা888sport live footballে তাদের উপস্থিতি স্বতঃস্ফূর্ত ও বন্ধুসুলভভাবেই হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের যে-কোনো 888sport app download apk, যেমন ‘আমাদের ছোট নদী’ কিংবা আমাদের জাতীয় সংগীতে যে প্রকৃতি ও প্রতিবেশের চিত্র পাই; কিংবা নজরুলের গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’; অথবা জীবনানন্দের ‘ধানসিড়ি নদী’ বা, ‘হায় চিল’ – এসবই ওই প্রতিবেশ ও সেমিওটিকসের উদাহরণ। সমালোচকরা বলতেই পারেন, এমনটা তো পৃথিবীর সব মানুষের ভেতরই দেখা যায়, কারণ মানুষ তো প্রকৃতি/ প্রতিবেশেরই অংশ – এমনকি এ-কথাও সত্যি, প্রকৃতি থেকেই মানুষের সূচনা এবং এই প্রকৃতিতেই মানুষের ক্ষয়।
কথাটি সর্বার্থে সত্যি। তবে 888sport appsের মানুষের জীবনে প্রকৃতির একটি ভিন্নতর অনুষঙ্গ আছে, আর তার প্রধান কারণ এদেশের প্রকৃতি/ প্রতিবেশ এদেশের প্রত্যেক মানুষের অন্তর স্পর্শ করে তাদের অজান্তে, নিঃশব্দে; তাই এদেশের প্রতিটি গান, যাত্রা, নাচ, পার্বণ, বিয়ে, জন্ম-মৃত্যু এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রকৃতি/ প্রতিবেশ কোনো-না-কোনোভাবে উপস্থিত। আর তা এ-কারণে যে, এদেশটার জন্মসূত্রই প্রকৃতির দান – এটি একটি নদী-সাগরের মিলনে বদ্বীপ। 888sport promo codeর শরীরের মতো নদী আর উত্তাল সাগরের মিলনে এ এক বিস্ময়কর কড়ি ও কোমলে গড়া এদেশের মানুষের মানসিকতা – সংকটকালে কঠিন ও সংবেদনশীল, আনন্দকালে নরম এবং আবেগাক্রান্ত।
উদ্ধৃত ছড়াটি আমি এলোপাতাড়ি নির্বাচন করেছি – যা প্রমাণ করে যে, আমাদের 888sport live footballকর্মে প্রতিবেশ-সমালোচনার (ecocriticism) উপাদান অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছড়াটিতে খুবই সহজে চিত্রিত করা হয়েছে প্রকৃতি এবং মানুষের এক আবেগঘন বন্ধনকে আর এই বন্ধনটিই হলো মানব ও অ-মানবের জন্ম-জন্মান্তরের যোগসূত্র বা মৈত্রী। এ-কথা তো সত্যি যে, কবি-888sport live footballিকরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হন। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক পাঠকই তাঁদের লেখা পাঠ করে সমমাপে উদ্দীপিত হন। প্রকৃতি/ প্রতিবেশের যে-রূপটি জীবনের হাজারো কর্মকাণ্ডে অবহেলিত থাকে একজন কবি তাকে জাগরূক করেন তাঁর 888sport app download apkয়, তাঁর লেখায়। আর ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে আজকের 888sport live football-সমালোচকরা প্রকৃতির আলোকে 888sport live football বিচারের এক নতুনতম তত্ত্ব উত্থাপন করেছেন, যাকে তাঁরা সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রতিবেশ-সমালোচনা বা ecocriticism বলে।
বঙ্গবন্ধু-রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা পড়ে আমার সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট ধারণা জন্মেছে, গ্রন্থদুটিতে প্রতিবেশ-সমালোচনার একাধিক উপাদান ও ব্যাপ্তি নিহিত আছে।
দুই. প্রতিবেশ-সমালোচনা বা ব ecocriticism আসলে কী?
প্রতিবেশ-সমালোচনা বা ecocriticism 888sport live footballের সেই পাঠ বা পর্যেষণা, যার মাধ্যমে 888sport live footballকর্ম ও পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ককে পর্যবেক্ষণ করা হয় এক আন্তরবিষয়ক দৃষ্টিকোণ থেকে। এই পর্যবেক্ষণে 888sport live football-বিদ্বজনরা 888sport live footballকর্মের পাঠাংশকে বিশ্লেষণ করেন পরিবেশের সকল উপাদানের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও সংবেদনশীলতা কীভাবে আচরিত ও আরোপিত হয়েছে সে-বিষয়াদিকে। এই শব্দটি প্রথম উদ্ভাবন করেন উইলিয়ম রুকারট (William Rueckert) ১৯৭৮ সালে তাঁর রচিত 888sport live ÔLiterature and EcologyÕ-তে Ôan ecological poeticsÕ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে।বিষয়টি পরবর্তীকালে আরো বেশ কিছু শব্দের জন্ম দেয়, যার ভেতর উল্লেখ্য হলো : anthropocentricism (নৃকেন্দ্রিকতা বা বাস্তুকেন্দ্রিকতা), ecofeminism (প্রতিবেশ888sport promo codeবাদ), এবং ecospiritualism বা প্রতিবেশ-আত্মিকতা – যা উপরোল্লিখিত আন্তরবিষয়ক দৃষ্টিকোণ বলে ধরে নেওয়া যায়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে শিক্ষায়তনিক জগতে ecocriticism শব্দের সূচনা। মানতেই হবে সারাবিশ্বে প্রতিবেশ সচেতনতারই প্রতিফলন রয়েছে এই শব্দের অভ্যন্তরে। তবে এই বিষয়টির শক্তি সঞ্চার ও বিস্তার ওই শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে। ফলে দেখা যাচ্ছে ecocriticism বা যার প্রতিশব্দ আমি করেছি প্রতিবেশ-সমালোচনা, সংশোধনবাদী আন্দোলনের তরুণতম সদস্য, যদিও এই কাব্য/ 888sport live football দর্শন বা তত্ত্ব মানবতাবোধকে কয়েক দশক ধরে বেশ আন্দোলিত করেছে। উল্লেখ্য ‘সংশোধনবাদী আন্দোলন’ শব্দটির প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যার অবকাশ আছে। আসলে 888sport live chat888sport live footballে প্রকৃতি ও প্রতিবেশের উপস্থিতি চিরায়ত কিন্তু প্রতিবেশ-সমালোচনা কিছু নতুন অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে 888sport live chatকর্মকে বিচার করার প্রয়াস পায়, অর্থাৎ প্রতিবেশের সঙ্গে 888sport live chatের সম্পৃক্ততার মাত্রা, তার ব্যাখ্যা ও সচেতনতা, তার প্রভাব, বৈশিষ্ট্য ও অবস্থানের বিষয়গুলো বিবেচনা করাকেই প্রতিবেশ-সমালোচনার মূল বলে ধরা হয়, যাকে আধুনিক যুগে ‘সংশোধনবাদী আন্দোলন’ বলে বিশেষায়িত করা হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, 888sport appsে এখন পর্যন্ত সীমিত কয়েকটি শিক্ষায়তনের গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি সাধারণে পৌঁছতে পারেনি যেমনটা পরিবেশ/ প্রতিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি করতে পেরেছে।
প্রসঙ্গত আমি আমার বর্তমান 888sport liveে প্রতিবেশ-সমালোচনা শব্দটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমার যুক্তিগুলোকে সঠিক উপস্থাপন করার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি পরিবেশ শব্দটির পরিবর্তে প্রতিবেশ শব্দটিকে বেশি সমর্থন জানাই এ-কারণে যে পরিবেশ, সম্পূর্ণ আমার ধারণা, প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিককে শুধু বোঝায় না, প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানবিক ও অ-মানবিক প্রতিক্রিয়াকেও বোঝায়। প্রতিবেশ বলতে আমি বুঝি প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে প্রকৃতির উপাদানসমূহের – যেমন গাছপালা, পশুপাখি, নদীনালা, জলাশয়, মেঘ, বৃষ্টি ইত্যাদি, এবং সর্বোপরি মানবজাতির যে-নিবিড় অম্লমধুর সম্পর্ক ঠিক সেই বিষয়াদিকে। এর সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও সংবেদনশীলতার বিষয়টিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আসলে এই বিচারেই 888sport live chatকর্মকে বিচার করব, যাকে ওই প্রতিবেশ-সমালোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় বলে ধরে নিচ্ছি।
তিন. বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশ-সচেতনতা এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা
ক. অসমাপ্ত আত্মজীবনী
‘বঙ্গবন্ধু নদীমাতৃক 888sport appsে দলীয় কাজে ঘুরতে গিয়ে বারবার তিনি নদীর কাছে হাতে পেতেছেন। তিনি রাজশাহীতে প্রমত্তা পদ্মার কাছে গেছেন। পিরোজপুর-বাগেরহাটের বিভাজক বলেশ্বরকে দেখেছেন, খুলনার ভৈরব, রূপসা, পায়রা নদীর সখ্যে মেতেছেন। বরিশাল তাঁকে মাতিয়েছে কীর্তনখোলা দিয়ে। হবিগঞ্জের জকিগঞ্জে কুশিয়ারাকে দেখে তিনি হয়েছেন মাতোয়ারা। … চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতেও তাঁর পড়েছে চিহ্ন। পাবনায় গিয়ে যমুনার প্রেমে তিনি মজেছেন। মধুকবিকে খুঁজতে গিয়ে সাগরদাঁড়ি আর কপোতাক্ষের সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছেন। বুড়িগঙ্গা, দড়াটানা নদীও তাঁর লেখায় পেয়েছে স্থান। নিজ জেলার মুহুরি নদীকেও তাঁর পড়েছে মনে। জাতির জনকের শৈশবের প্রিয় নদী মধুমতী ও বাইগার বা বাঘিয়ারে গিয়ে এক মুজিব সৈনিক যেন খুঁজে ফিরেছেন নেতাকে।’
উদ্ধৃতাংশ ২০১৬ সালে প্রকাশিত ওবায়দুল কাদের-রচিত বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও 888sport app গ্রন্থের পাঠ-পর্যালোচক পীযূষ কান্তি বড়–য়ার লেখার অংশবিশেষ। স্পষ্ট বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা প্রতিবেশের ঘনিষ্ঠ পরিচর্যায়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর অনন্য এক সখ্য ছিল বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, পানির সঙ্গে, আর সে-বোঝাপড়া অন্তরের গভীর টানে হয়তো তাঁকে কবি তৈরি করেনি কিন্তু এমন একজন মানুষ তৈরি করেছে যিনি সহজে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে সংবেদনশীল হতে সমর্থ হয়েছেন – আর সেই সংবেদনশীলতা তাঁকে গড়ে তুলেছে এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ হিসেবে। একেই আমরা ecospiritualism বা প্রতিবেশ-আত্মিকতা বলে শনাক্ত করতে পারি।
হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিবিদ ছিলেন অথচ বিশ্বের অপরাপর হাজারো রাজনীতিবিদের মতো প্রতিবেশের প্রতি উদাসীন ছিলেন না। বক্তব্যটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমরা দেখি, বিশ্বের প্রায় সব রাজনীতিবিদই আজকাল পরিবেশ/ প্রতিবেশ নিয়ে বিড়ম্বিত, উদ্বিগ্ন। কিন্তু এই সচেতনতা সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিবেশ বৈজ্ঞানিকরা। বঙ্গবন্ধুর পরিবেশ/ প্রতিবেশ সহমর্মিতা ছিল অন্তর্জাত, আরোপিত নয়। তার উদাহরণ স্বয়ং ওই উদ্ধৃতি।
কিন্তু শুধু ওই উদ্ধৃতিই নয় – আরো অনেক পর্যালোচনা আছে, আর সেসব পর্যালোচনা আমি করব তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা থেকে।
আমি প্রথমেই নৃকেন্দ্রিকতা বা বাস্তুকেন্দ্রিকতার (anthropocentricism) বিষয়টির প্রসঙ্গটি তুলব। বাঙালির স্বতন্ত্র বাস্তুকেন্দ্রিকতার কথা বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা, বিতর্ক, বক্তৃতা এবং ওই দুই গ্রন্থের একাধিক স্থানে ছড়িয়ে আছে। যেহেতু আমার এই 888sport liveের পাঠ তাঁর দুই গ্রন্থের ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে প্রস্তাব করেছি, আমি সে-কাজটিই করব।
১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখছেন (মনে রাখতে হবে সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের), ‘ইংরেজের কথা হলো, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। … যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুতেই অভাব ছিল না। … সেই বাঙালির এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি …’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১৮)। বাঙালি জাতির অহংকার ও বাস্তুকেন্দ্রিকতা এ-কথাগুলোর ভেতর স্পষ্ট অথচ বঙ্গবন্ধু তখন ২৩ বছরের যুবক।
শহীদ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তাঁর গ্রন্থের অধিকাংশ স্থানে ওই নামেই সম্বোধন করেছেন) সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক উত্তেজনাপূর্ণ সংলাপের উদাহরণ পাই ওই একই গ্রন্থে। ‘শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, ÔWho are you? You are nobody.Õ আমি বললাম ejjvg ÔIf I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.Õ (পৃ ২৯)। সংলাপের শেষ কথাগুলো অনুধাবনযোগ্য যেখানে স্পষ্ট বিধৃত হয়েছে, বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবোধ, বিশেষ করে Ô I will prove that I am somebodyÕ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
প্রসঙ্গত গ্রন্থের ঠিক আগের পৃষ্ঠায় (২৮) বর্ণিত একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই যা প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু জন্মগতভাবেই মানুষের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, যেটি প্রতিবেশ-সমালোচনার এক অন্যতম উপাদান। শাহ আজিজুর রহমান রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বিপরীত মেরুতে ছিলেন, এমনকি স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল রাজাকার রাজনীতি, এবং স্বাধীনতার পর, আমরা সবাই জানি, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর অকপট উক্তি, ‘শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন।’ এই উক্তিটি মানুষে মানুষে নিবিড় অম্লমধুর সম্পর্কের সন্ধান দেয়, যার সূত্র মেলে উইলিয়ম ecological poetics-এ।
বঙ্গবন্ধুর নৃকেন্দ্রিক বা বাস্তুকেন্দ্রিক স্বাতন্ত্র্যের আরো উদাহরণ আছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময়ে ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ (পৃ ৩৭) করতেন তার উল্লেখ গ্রন্থের একাধিক স্থানে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রন্থের ৭৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।’ (পৃ ৭৫), এবং তারই ফলে ‘ … ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।’(পৃ ৯২)। অর্থাৎ পাকিস্তান হওয়ার মাত্র এক বছর পরই বাঙালি স্বতন্ত্র বাস্তুকেন্দ্রিকতার উদ্ভব বঙ্গবন্ধুর ভেতরে। তারপর পাচ্ছি জিন্নাহ-কর্তৃক ১৯ মার্চের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার কথা যেটি ওই বাস্তুকেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহের অঙ্কুরোদ্গম।
স্ববিরোধী হলেও সত্যবর্জিত নয় বাঙালি সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য, ‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুটো দিক আছে। একটা হলো, ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটি পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালির মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা।’ (পৃ ৪৭-৪৮)
উক্তিটি নীরদ শ্রী চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙ্গালির কথা 888sport app download for android করিয়ে দেয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এমন একজন বাঙালি বাস্তুকেন্দ্রিক মানুষ এমন কথা কেন লিখলেন? আমার কাছে ব্যাপারটির অন্য ব্যাখ্যা আছে। এই বক্তব্যটি আসলে বঙ্গবন্ধুর নৃকেন্দ্র্রিক আত্মবিশ্লেষণ যা নিঃসৃত ওই স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকেই। এক অর্থে বক্তব্যটির ভেতর ভাবীসূচক ইঙ্গিতও আছে মানতেই হবে – ১৯৭৫-এর নির্মম ঘটনা।
১৯৪৬ সালে দাঙ্গার হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু কলকাতার বর্ণনা দিচ্ছেন :
‘ইসলামিয়া কলেজের কাছেই সুরেন ব্যানার্জি রোড, তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কোয়ারের জংশন। এখানে সকলেই প্রায় হিন্দু। … মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে, শুধু একই কথা, ‘আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব।’ … অনেক হিন্দু তালতলায়, ওয়েলেসলী এরিয়ায় ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক গোপনে আমাদের সাহায্য চাইল। অনেক কষ্টে কিছু পরিবারকে আমরা হিন্দু এরিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হলাম, বিপদ মাথায় নিয়ে। বেকার হোস্টেলের আশেপাশে কিছু কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, তাদেরও রক্ষা করা গিয়েছিল।’ (পৃ ৬৪-৬৫)
ধর্ম নয় মানুষের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা – যাকে প্রতিবেশ-সমালোচনায় চিহ্নিত করা interpersonal relationship/ interpersonal sensibility/ interpersonal amity বাংলায় যাকে সম্ভবত বলা যেতে পারে আন্তর-মানবিক সম্পর্ক/ আন্তর-মানবিক সংবেদনশীলতা/আন্তর-মানবিক সংহতি, তারই আগলভাঙা বহিঃপ্রকাশ ওই উদ্ধৃতাংশে।
এমন আরো একটি ঘটনার উল্লেখ করব। জেলখানার ঘানি ঘুরিয়ে তেল করার ঘটনা।
‘যদিও সরকার কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করতে নিষেধ করেছেন, তথাপি ফরিদপুর জেলে তখনও ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হচ্ছিল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম। ‘এখনও আপনারা জেলে মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরান?’ তিনি বললেন, ‘কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। গরু কিনতে দিয়েছি।’ কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’ (পৃ ১৮২)
এমন অসংখ্য আন্তর-মানবিক সম্পর্ক/আন্তর-মানবিক সংবেদনশীলতা/ আন্তর-মানবিক সংহতির উদাহরণ অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ছড়িয়ে আছে যার সমন্বিত উদাহরণ না দিলেও স্পষ্ট হবে বঙ্গবন্ধুর অন্তরে ecological poetics বা প্রতিবেশ-সুবেদ-শাস্ত্র বিশ্বের যে-কোনো রাজনীতিবিদের চেয়ে তীব্রভাবে প্রথিত ছিল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীপর্বে আমার সর্বশেষ উদাহরণটি হলো বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি-সংশ্লিষ্টতা। প্রতিবেশ-সমালোচকরা বলেন, ÔEcocriticism is any critical method that seeks to study, interpret, analyze, contextualize, popularize and personalize the text Ñ literary, semi-literary, or cultural Ñ with an obvious focus on nature, environment, and any such concepts.Õ (Chakroborti, L, Class Lecture, 2019)
আমি এ-পর্যন্ত যে-বিষয়াদি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি তার ভেতর nature বা প্রকৃতির উদাহরণ উপস্থিত ছিল না। লক্ষণীয় এবং সংগতভাবেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি-সংশ্লিষ্টতার উপাদান তেমন মেলে না। আমি সংগত শব্দটি ব্যবহার করেছি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। আসলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীপর্বটি ছিল বঙ্গবন্ধুর গড়ে ওঠার অসমাপ্ত জীবনপর্ব, এবং আত্মজীবনীটি তিনি অবিচ্ছিন্ন আনুক্রমিকভাবে লিখতে পারেননি। উপরন্তু আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত। তবু এই গ্রন্থ থেকে শুধুমাত্র একটি উদাহরণই সাক্ষ্য দেবে তিনি কতটা প্রকৃতি-সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯৪৬ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগ কনভেনশন শেষ হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আজমির শরিফ এবং সেখান থেকে আগ্রায় তাজমহল দেখতে যান। তাঁর তাজমহল দেখার অভিজ্ঞতা :
‘সূর্য অস্তাচলগামী, আমরাও তাজমহলের দরজায় হাজির, … সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রং আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আর একটা রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও 888sport cricket BPL rate বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। দারোয়ান দরোজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম।’ (পৃ ৫৯)
এমন রূপকল্প একজন প্রকৃতি-সংশ্লিষ্ট সংবেদনশীল মনের পক্ষেই সৃষ্টি করা সম্ভব।
খ. কারাগারের রোজনামচা
কারাগারের রোজনামচার শুরুটাই প্রতিবেশ শব্দকোষ দিয়ে : রাইটার দফা; চৌকি দফা; জলভরি দফা; ঝাড়ু দফা; বন্দুক দফা; পাগল দফা; শয়তানের কল; দরজি খাতা; মুচি খাতা; আইন দফা; ডাল চাকি দফা; হাজতি দফা; এবং ছোকরা দফা। পাগল দফা বিষয়ে লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলছেন :
‘১৯৫৪ সালে জেলে গিয়ে এক পুরান পাগলের সাথে দেখা হলো। ওকে আমি চিনতাম, কারণ বছরের মধ্যে প্রায় ১১ মাস ভাল থাকে, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়। যখন ভাল থাকে তখন খুব ভাল ভাল কথা বলে। ওদের যখন নিয়ে যাচ্ছে আমি দাঁড়াইয়া দেখছি, দেখি সেই পুরান পাগল। নাম তার কফিলউদ্দিন। জিজ্ঞাসা করলাম ‘কি কফিলউদ্দিন কেমন আছ?’ বললো, ‘ভাল তো আছি, ছাড়ে না। আপনারা তো ছাড়লেন না। আবার বুঝি আসছেন।’ … রোজ যখন আমার সামনে দিয়ে নিয়ে যেতো [ওকে] তখন আমাকে দূর থেকে একটা আদাব করত।’
এটিও সেই আন্তর-মানবিক সম্পর্ক/ আন্তর-মানবিক সংবেদনশীলতা/ আন্তর-মানবিক সংহতির উদাহরণ।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে জেলহাজত অনেক বাস্তব মানবচরিত্রের সম্মুখীন করেছে, সম্ভবত ওই আন্তর-মানবিক সম্পর্ক/ আন্তর-মানবিক সংবেদনশীলতা/ আন্তর-মানবিক সংহতির বিপরীতে। ১৯৪৯ সালের তেমন একটি ঘটনা এক মওলানা সাহেবকে নিয়ে যাকে জেলহাজতে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে জেলে দেখে এক পাহারার কাছে কারণ জানতে চাইলে সে বলল :
‘জানেন না, ‘রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামত মারধর করে। …’ আমি বললাম ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে।’ বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।’ (পৃ ৪৪)
ঘটনাটি আমাদের বর্তমানের এমন আরো অনেক অবিশ্বাস্য অথচ বাস্তব ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়, যা মানব চরিত্রের অন্ধকার দিক।
বইটির ৪৭ থেকে ৫৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পকেটমার ‘লুদু ওরফে লুৎফর রহমানে’র গল্প আছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালে জেলে এসে দেখেন ১৯৫৪ সালের কয়েদি পকেটমার লুদু আবার জেলে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বঙ্গবন্ধুকে বলল :
‘হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুখের জীবন। প্রায় ২০ বৎসর আমার জেলখানাতে হয়েছে। ১৩ বৎসর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি। কেন যে করেছিলাম আজো জানি না। তবে মাঝে মাঝে ভাবী কেন এই পথ নিয়েছিলাম। জীবনটা দুঃখেই গেল।’ (পৃ ৪৭)
এ-প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিশ্লেষণ :
‘মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না। জন্মগ্রহণের সময় মানুষের দেল একভাবেই গড়া থাকে। বড় লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, … বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পরে যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদের স্বভাব চরিত্রই তারা পায়।’ (পৃ ৪৮)
এমন বাস্তব ও মনোবীক্ষণিক বিশ্লেষণ আন্তর-মানবিক সম্পর্ক/ আন্তর-মানবিক সংবেদনশীলতা/ আন্তর-মানবিক সংহতির মানসিকতা থেকেই নিঃসৃত হতে পারে।
প্রকৃতির সঙ্গে বাস্তবের সংমিশ্রণে দিনলিপি লিখন (২ জুন ১৯৬৬) :
‘ভোর দুইটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এক পাগল ক্ষেপে গিয়েছে। খুব জোরে চিৎকার করছে আর পাগলামি করছে। … জেল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ কি? কখন কোন পাগল ক্ষেপে উঠে বুঝবে কেমন করে? আর ঘুম হয়! বৃষ্টি হয়েছে, বেশ ঠাণ্ডাও পড়েছে।’ (পৃ ৫৮)
বৃষ্টির আবহে দিনলিপির লিখন। সবচেয়ে দৃষ্টি দেবার বিষয়টি হলো, জেল কর্তৃপক্ষকে দোষ না দেবার মৌলযুক্তি।
একটি 888sport app download apkর পঙক্তির মতো অনুভূতি : ‘ঠাণ্ডা ছিল, বৃষ্টি হয়েছে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যদি জেলের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটাতে পারতাম তা হলে কত ভালই না হতো।’ (পৃ ৬০)
এমন বৃষ্টির বার্তা, মেঘের কথা রোজনামচা জুড়েই রয়েছে, যেমন ৬০, ৬১, ৬৬, ৯৮, ১০৬, ১০৮, ১১২, ১১৪, ১১৬, ১৩৩, ১৪৩, ১৬১, ১৮৮ ও ১৯৫ পৃষ্ঠায়। বন্যার কথাও আছে তার সঙ্গে, আছে সূর্য-রৌদ্রের বর্ণনা। আর আছে বিকেলে হাঁটার কথা, বাইরে বসে চা খাবার কথা – প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যের কথা। মনে রাখতে হবে পুরো রোজনামচার সিংহভাগই জুন ১৯৬৬ থেকে জুন ১৯৬৭-র দিনলিপি।
বঙ্গবন্ধু জেলখানায় সবজি ও ফুলের বাগান করেছিলেন। সে-বিষয়ে তাঁর বর্ণনা :
‘বিকালে বাগানে কাজ করতে শুরু করলাম। … লাউয়ের দানা লাগাইছিলাম, গাছ হয়েছে। ঝিংগার গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি। বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। … নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের গাছগুলি।’ (পৃ ৬৮-৬৯)
আবার লিখছেন ৮০ পৃষ্ঠায় :
‘ছোট ছোট যে মাঠগুলি পড়েছিল আমার ওয়ার্ডে সেগুলিতে দূর্বাঘাস লাগাইয়া দিয়াছিলাম। এখন সমস্ত মাঠটি সবুজ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে চলেছে। দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে জায়গাটি। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মুরগিগুলি। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ফুলের গাছ চারদিকে লাগাইছিলাম, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। বড় চমৎকার লাগছে।’
মনোযোগ আকর্ষণ করছি ‘অনেকক্ষণ বসে রইলাম’ মন্তব্যের দিকে। প্রকৃতিতে অবগাহন এবং প্রকৃতিকে উপভোগ করার ইঙ্গিত স্পষ্ট এই তিন শব্দের বক্তব্যে।
অ-মানবিক প্রাণীর প্রতি যে- নৈকট্যানুভূতি তার প্রমাণ মেলে এই অপূর্ব আবেগাক্রান্ত উচ্চারণে :
‘বহুদিন পর্যন্ত দু’টি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত। আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দু’টি আসল না। ভাবলাম ওরা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও দূরে চলে গিয়াছে। আর আসবে না। ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো। যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে একাকী থাকতাম তখন রোজই সকাল বেলা লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বসতাম ওদের দেখার জন্য। মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।’(পৃ ১০১-১০২)
আবার সেই প্রকৃতিতে অবগাহন :
‘দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। [যদিও] বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। [কিন্তু] একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না।’ (পৃ ১১৭)
এরই সঙ্গে সম্মিলিত তাঁর রাজনৈতিক দর্শন :
‘বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ – যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়।’ (পৃ ১১৭)
প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের এক অনন্য উদাহরণ। আরো আছে :
‘আমার মোরগটা [বঙ্গবন্ধু জেলখানায় মুরগি ও পাখি পুষতেন] আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে।ছোট মুরগির বাচ্চারা ওকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলে না। কাক যদি ওকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। রাতে ওরা একসঙ্গেই পাকের ঘরে থাকে। এই গভীর বন্ধুত্ব ওদের সঙ্গে। একসঙ্গে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেঈমানী করে। পশু কখনও বেঈমানী করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধ হয় মানুষের চেয়ে একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।’ (পৃ ১১৮)
এমন কথা কি আমরা আজকাল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা অ্যানিমাল প্লানেট টিভি চ্যানেলে দেখছি বা শুনছি না?
আর একটি সদৃশ মজার ঘটনা ২১৯ পৃষ্ঠায় :
‘কাকের কাছে আমি পরাজিত। আমার সামনের আমগাছ কয়টাতে কাক বাসা করতে আরম্ভ করে। আমি বাসা করতে দেব না ওদের। কারণ ওরা পায়খানা করে আমার বাগান নষ্ট করে, আর ভীষণ চিৎকার করে। আমার শান্তি ভঙ্গ হয়। … ধনুক মেরেও যখন কুলাতে পারলাম না তখন আমার বাগানী কাদের মিয়াকে দিয়ে বারবার বাসা ভেঙে ফেলি। বারবারই ওরা বাসা করে। লোহার তার দিয়ে কি সুন্দরভাবে গাছের সাথে পেঁচিয়ে ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক একজন দক্ষ কারিগর, কোথা থেকে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে! … ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হই। তিনটা গাছ ওদের ছেড়ে দিলাম – ওরা বাসা করল। আর একটা গাছ ওরা জবরদখল করে নিল। আমি কাদেরকে বললাম, ‘ছেড়ে দাও। করুক ওরা বাসা। দিক ওরা ডিম। এখন ওদের ডিম দেওয়ার সময় – যাবে কোথায়?’
মশার কথা আমি বলেছিলাম এই 888sport liveের শুরুতে। সেই মশাকেও পাই বঙ্গবন্ধুর রোজনামচায় :
‘রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল, দেখলাম আড়াইটা বাজে। আমি উঠে বসে পাইপ ধরালাম। আপন মনে পাইপ টানতে আরম্ভ করলাম। মশারির বাইরে বসার কি উপায় আছে! মশক শ্রেণী সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করে। তবে একটা গুণ আছে এই জেলখানার মশক শ্রেণীর, শুল বসিয়ে রক্ত খেতে থাকে চুপচাপ। একদিনের জন্যও ‘বুন, বুন’ শব্দ শুনি নাই। তারা ডাকাডাকিতে নাই, নীরবে কাজ সারতেই পছন্দ করে। কয়েদিরা যেমন অত্যাচার সহ্য করে, মার খায়, সেল বন্ধ হয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরে, হাতকড়ি লাগায় – প্রতিবাদ করার উপায় নাই, কথা বলার উপায় নাই। নীরবে সহ্য করে যায়। তাই বুঝি মশক বাহিনী বড় সাহেবদের খুশি করার জন্য শব্দ না করেই শুল বসাইয়া দেয়।’ (পৃ ১৪৪)
লক্ষণীয় 888sport appsের প্রকৃতির দুটি ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ – কাক এবং মশা – এ দুটির স্বভাব এবং প্রাকৃতিক আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন বঙ্গবন্ধু, এবং শুধু তাই নয় তিনি তাদের আচরণের সঙ্গে মানবজাতির অনেক আচার-আচরণ, নিয়মনীতির তুলনামূলক হাস্যরসাত্মক মিল খুঁজে বের করেছেন যা অতীব বাস্তবসম্মত।
এরই সঙ্গে সংযুক্ত আরো দুটি শিক্ষণীয় বক্তব্য :
ক। ওদের [কাকদের] এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।
খ। কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুঝি ওদের ঘর ভাঙবো। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না। (পৃ ২২০)
অ-মানবিক প্রাণীর সাথে মানবিক সম্পর্কের আরো একটি উদাহরণ :
‘আমার মুরগিটা মারা গেছে। অনেক ওষুধ খাইয়েছি। বেচারার খুব কষ্ট হতেছিল, ভালই হলো। আমার একটু কষ্ট হলো। মুরগিটাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওর হাঁটাচলার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ছিল।’(পৃ ১৭৮)
888sport appsের মানুষদের চরিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কূটাভাস-আকীর্ণ পর্যবেক্ষণ একাধিক স্থানে আছে যার একটি উদাহরণ আমি আগেও উপস্থাপন করেছি অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে। এর কারণ বোধহয় তাঁর রাজনৈতিক বাস্তবতার শিক্ষা, যদিও চূড়ান্তভাবে তিনি ছিলেন জনগণের ওপরই আস্থাবান। যেমন :
ক। ‘888sport apps শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল।’ (পৃ ১১১)
খ। ‘বাঙলি জাতিটা এত নিরীহ, না খেয়ে মরে যায় কিন্তু কেড়ে খেতে আজো শিখে নাই। আর ভবিষ্যতেও খাবে সে আশা করাও ভুল।’ (পৃ ১৫৩)
গ। ‘পূর্ব বাংলার মাটিতে বিশ্বাসঘাতক অনেক পয়দা হয়েছে, আরো হবে, এদের 888sport free betও কম না।’(পৃ ২১৫)
বঙ্গবন্ধুর গ্রাম নিয়ে পথের পাঁচালীর অপুর মতো এক বিষণ্ন অতীতবিধুরতা ছিল যেটি ecospiritualism বা প্রতিবেশ-আত্মিকতার অন্তর-আবেশ :
‘চুপ করে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম গ্রামের কথা, বস্তির কথা। গ্রামে গ্রামে আনন্দ ছিল, গান বাজনা ছিল, জেয়াফত হতো, লাঠি খেলা হতো, মিলাদ মাহফিল হতো। আজ আর গ্রামের কিছুই নাই। মনে হয় যেন মৃত্যুর করাল ছায়া আস্তে আস্তে গ্রামগুলোকে প্রায় গ্রাস করে নিয়ে চলেছে। অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনীই না মনে পড়ল। কারণ আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালবাসি।’ (পৃ ১৫৩)
একটা চমকপ্রদ মনোগ্রাহী ঘটনার বর্ণনা আছে ১৫ই জুন ১৯৬৬-এর বরাতে :
‘আমার বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালে। তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বেড়াই। … এখন একটু একটু উড়তে শিখেছে। চুপচাপ কিছু সময় তারপর দেয় ছুট। একেবারে পাকের ঘরের দিকে ছুটলো। মানে আমাকে আর ধরতে হলো না। বাচ্চাটা বাবুর্চিকে দেখলে মনে করে সেই বোধ হয় তার সব কিছু।’ (পৃ ৯০)
এ হলো এক নির্মল মানবিক ও অ-মানবিক মিথস্ক্রিয়ার অনন্য ঘটনা যা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি।
পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিরায়ত অখণ্ড ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, তার প্রমাণ অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরু থেকেই পাওয়া যায়, যেখানে বঙ্গবন্ধু লিখছেন : ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ রেণুর ভালোবাসার অনুরোধের ফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। রেণুর কথা, হাচুর কথা, রেহানার কথা, কামাল-জামালের কথা, রাসেলের কথা এক প্রেমকাতর উদ্বিগ্নতায় বারংবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কারাগারের রোজনামচার – ৭৭, ৯০, ৯৪, ১২০, ১৩৫, ১৪৯, ১৫৯, ১৭৮-৭৯, ১৮০, ১৮৯, ১৯৪, ২০১, ২০৩, ২০৮, ২১০, ২১৫, ২২১, ২৩৩, ২৪০ ও ২৪৯ পৃষ্ঠায়। এর ফাঁকে ফাঁকে বাবা-মা-বোনের কথাও এসেছে বহুবার। তবে আমার কাছে একান্তভাবে মনে হয়েছে মা-বাবা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর দুটি মানুষের প্রতি কিছুটা হলেও পক্ষপাত ছিল, আর তাঁরা দুজন হলেন রেণু এবং হাচু বা শেখ হাসিনা। এই গ্রন্থে রেণুর সঙ্গে জেলখানায় দেখা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর একধরনের উদগ্র বাসনা স্পষ্ট হয়েছে একাধিকবার আর হাসিনার পড়াশোনা, বিবাহ ইত্যাদি নিয়ে দুজনকেই ভাবতে দেখা গেছে বেশ। স্বামী হিসেবে, পিতা হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে এমন পক্ষপাতিত্বের প্রভাব থাকাটাই ecospiritualism বা প্রতিবেশ-আত্মিকতার নিয়ম বলে মনে করি। রাজনীতিবিদ ছাড়াও একজন পুত্র, একজন ভ্রাতা, একজন স্বামী এবং একজন পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চারিত্র্য সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত কারাগারের রোজনামচায়।
চার. পরিশেষ আমার এই 888sport liveে সংযোজিত যুক্তিমালা যদিও একান্ত আমার ব্যক্তিগত, আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু-রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থদুটিতে ecocriticism বা প্রতিবেশ-সমালোচনার অসংখ্য উপাদান আছে। আমি শুধু সূচনামূলক প্রস্তাবনা এখানে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.