বর্ষা-বর্ষণের রূপচিত্রকর রবীন্দ্রনাথ

বর্ষা-বর্ষণের মাদকতা নিয়ে বাঙালি কবির নান্দনিক আবেগ সম্ভবত চিরন্তনের ঘরে পৌঁছায়। সে পরিবেশের গুণে অকবিও কবি; লেখার সাধ্য না থাকলেও মনের ভুবনটা তখন পালটে যায়। রোমান্টিকতাবিরোধী হয়েও তাই আধুনিক বাঙালি কবি মর্মে মর্মে রোমান্টিক, অন্তত ক্ষেত্র বিশেষে তো বটেই। আধুনিকতার টানে বিদ্রোহী (রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে) তিরিশের প্রধান কবি অনেককেই দেখা যায় বৃষ্টি-বর্ষার তাত্ত্বিক অ-তাত্ত্বিক রূপ নিয়ে পঙ্ক্তি রচনা করতে, হোন না তারা একান্তই নাগরিক কবি।

মেঘ-মাখা বৃষ্টি ঝরানো আকাশের দিকে তাই তাকাতে হয়, তেমনি নজর ফেরাতে হয় ‘বর্ষার অজস্র জলধারে’। ‘ফাল্গুন বিকেলে’ ও তাই ‘বৃষ্টি নামে’। মনে পড়ে যায় ‘আদিম বর্ষণ জল, হাওয়ার কথা, মত্ত দিন মুগ্ধক্ষণ আর্দ্র চৈতন্যের’ ঘাটে পৌঁছে যায়। আর জড়বাদী কবির ‘অন্তরে থামে না বৃষ্টিধারা। বৃষ্টিঝরার মুগ্ধতা মনে রেখে লিখতে হয় ‘এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে।’ ‘বিচ্ছেদ-বাদল-রাত’ প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে।

তুলনামূলক বিচারে তিরিশের আধুনিকতায় অধিকমাত্রায় বিদ্রোহী কবিও লেখেন আষাঢ়-শ্রাবণের গাথা। বড়ো রোমান্টিক শোনায় কথাগুলো : ‘আকাশে আষাঢ় এলো; 888sport apps বর্ষায় বিহবল’ … ‘বৃষ্টিতে ধুমল’ … ‘মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেল-সারি’। কিংবা তার বৃষ্টি-বন্দনা – ‘এসো বৃষ্টি, এসো তুমি অতল ভূতলে রুদ্ধ স্তম্ভিত পাষাণে’ অথবা ‘শ্রাবণ’-অন্বেষায় ‘ঝরঝর স্বরে নিজেরে নিবিড়ে মেশাতে’ ইচ্ছা জাগে। জাগে ‘ঘনবরিষণঝংকৃত ঘন নিশীথে।’

আরেক অনন্য আধুনিকের মুক্ত চেতনায় ‘বাংলার হাওয়া’ শুধু বৃষ্টিই যে আনে তা নয়, সে ‘বৃষ্টি পড়ে সহজিয়া মানুষের মনের মাটিতে, সারাজীবনের মাঠে, … শহরে সদরে অফিসে অন্দরে’ নানা প্রতীকে। কখনো ‘আষাঢ়ের জয়গানে’ কখনো সাগরের টানে ‘কলকাতার গলিত সন্তাপ ধুয়ে দিতে’ চান যে কবি তারও অন্বিষ্ট ‘শ্রাবণের ধারাজলে সন্দ্বীপের চর হয়ে সোনার বাংলায়’ পৌঁছানো। ‘গঙ্গায় পদ্মায়’ তার নিত্য আসা-যাওয়া।

তাই বলি অমিয় চক্রবর্তী থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে থেকে বুদ্ধদেব বসু, এমনকি চল্লিশের মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও মেঘবৃষ্টিজলের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে চলতে পারেন না, বাংলার পটভূমিতে তো নয়ই। তাই বিপ্লববাদী কবি সুকান্তকেও অনুরূপ দু-এক পঙ্ক্তি লিখতে গিয়ে ঘোষণার মতো করে বলতে হয় : ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ 888sport apps/ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে। … জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।’

 চেতনায় ‘মেঘবৃষ্টিঝড়’ তুলে নিয়ে কিছু ভিন্ন সুরে হলেও মঙ্গলাচরণ লেখেন : ‘শেষরাতে মরুধূসর ঝড় এলো/ … হাওয়া, হাওয়ায় বৃষ্টি নামল। …/ আমার মনের আবাদ ভরে বৃষ্টি ঝরে … সোনাও ফলে গান ধরলুম আয় বৃষ্টি ঝেঁপে।’ আর কবি জীবনের শুরুতে চল্লিশের আদর্শগত তাৎপর্য মাথায় রেখেই এক পোঁচ রোমান্টিকতা মেখে লিখেছিলেন : ‘কালোমেঘে বাষ্পের খেলাতে/ বৃষ্টির কী নরম গন্ধ।’ পরিণত বয়সেও লিখলেন : ‘আয় বৃষ্টি বৃষ্টি অবিরাম দৃষ্টিধারাস্নানে যাচ্ছি দূর দূর।’ কিংবা চেতনায় আরাম জাগানো পঙ্ক্তিমালা (‘বৃষ্টি বৃষ্টি’) : ‘কবে কোন রাত্রে-এক বিভোর বৃষ্টির গন্ধ ঘুমে …/ অস্তিত্ব-চোয়ানো বৃষ্টি চুপিচুপি ভারি চুপিচুপি -/ ঘুমে কিংবা জাগরণঘুমে।’ নিজেকে প্রশ্ন করেন : ‘কতদূর নিয়ে যাবে বৃষ্টি ঝমাঝম/ বৃষ্টি টাপুরটুপুর।’

এ-ধারাতেই তো চল্লিশের দামাল দশকেও, আন্দোলনের দশকেও, সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন প্রতিবাদী অনুষঙ্গে – ‘আয় বিষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’র মতো জনপ্রিয় 888sport app download apk-গান, যা পঞ্চাশের দশকেরও ক্ষেতে-খামারে, প্রগতিবাদী রাজপথে সুরের ঢেউ তুলেছে। এ আলোচনার বিষয়-তাৎপর্যে আমাদের লক্ষ্য অবশ্য রবীন্দ্রনাথ, শুধুই রবীন্দ্রনাথ, তবু বিষয়ের গুরুত্ব ভেবে তাঁর উত্তরসূরিদের সংশ্লিষ্টতা সামান্য কিছু বলা গেল। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রযুগে-রবীন্দ্রনুরাগী অথচ আপন স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথারীতি বৃষ্টিবন্দনায় যোগ দিয়েছেন। ‘ইল্শে গুড়ি’র পাশাপাশি অন্য এক 888sport app download apkয় লক্ষ করেছেন ‘বৃষ্টির স্রোত/ করে বিশ্বলোপ।’ এমনটাই বাংলার বৃষ্টিঝরঝরা প্রকৃতি।

দুই

888sport appsের, বিশেষ করে গ্রামবাংলায় বর্ষাবর্ষণের সঙ্গে নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে যখন শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর অঞ্চলে এলেন, ফিরে ফিরে এলেন। সেই আসা-যাওয়ার অবকাশে, সাময়িক বসবাসের সুবাদে নদীমাতৃক, বর্ষা-বর্ষণপ্রধান গ্রামবাংলাকে স্বরূপে চিনে নিলেন। বাংলার ওই প্রকৃতি তাঁর চেতনায় স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছিল, যে জন্য আমৃত্যু ওই 888sport sign up bonus বহন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিভিন্ন ধরনের লেখায় সে-প্রমাণ ধরা আছে।

রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা এদিক থেকে বিচিত্র। কালবৈশাখির সাময়িক ঝড়জলশেষে আষাঢ়-শ্রাবণের মেঘবৃষ্টি নিয়ে দিনরাতের নানা প্রহরে তাঁর নানা অভিজ্ঞতা। ‘আইতান-কাইতানে’র (আশ্বিন-কার্তিকের) লোকপ্রবাদধৃত ‘বাদলা’র সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছে তাঁর। শ্রাবণের উদ্দাম জলস্রোতের পর দেখেছেন ভরা ভাদরের স্থিরজলের অদ্ভুত গাম্ভীর্য, যা মনে ভিন্ন ভাবনার জন্ম দিয়েছে।

মেঘবৃষ্টির বাংলা যে রবীন্দ্রনাথের চোখে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল সে-প্রমাণ ধরা রয়েছে এ-বাংলায় তাঁর জীবনাচরণে। শিলাইদহ-পতিসরে চমৎকার কুঠিবাড়ি থাকা সত্ত্বেও বোটে চেপে ভেসে বেড়িয়েছেন নদী থেকে নদীতে, কখনো বোট বেঁধেছেন এ নদী-সে নদীর ঘাটে। মনে মনে বলেছেন, ‘এই ঘাটে বাঁধ মোর তরণী’, যা একসময় 888sport app download apkর পঙ্ক্তিতে রূপ পেয়েছে। সে-সুবাদে মূলত পদ্মা সেইসঙ্গে চলাচলের পথে একাধিক নদীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়, পদ্মার সঙ্গে গভীর এক নান্দনিক ভালোবাসা। পদ্মা হয়ে ওঠে প্রিয়সঙ্গিনী।

ছেলেবেলা থেকে বৃষ্টির টাপুর-টুপুর সুরধ্বনির প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগ, সে-উপলব্ধির ব্যাপ্তি শিলাইদহ ও সংশিস্নষ্ট অঞ্চলে এসে। বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর মনের ঋতুবদল ঘটিয়েছে, গুণগত নান্দনিক পরিবর্তনও। ভাববাদিতা ও জীবনবাদিতার আশ্চর্য এক সমন্বয় ঘটেছে কবিচেতনায়। আকাশ-ছেয়ে নেমে-আসা অঝোর বৃষ্টিতে যখন আশপাশ ঝাপসা হয়ে গেছে তখন মনে এক ধরনের অচেনা বিষণ্ণতার ছাপ। আবার ঝড়ো হাওয়ার টানে উথালপাথাল গাছগাছালি ও ঢেউয়ের নদীতে প্রবল গতিবেগ তাঁর চেতনায় প্রাণশক্তির প্রতীকে ধরা দিয়েছে।

বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদাগন্ধ বা বৃষ্টিস্নাত ফুলের সুবাস কবিকে একইভাবে মুগ্ধ করেছে, যেমন করেছে হাওয়ার নদীতে ঢেউয়ের উথালপাথাল কিংবা বৃষ্টিধোয়া আকাশ ও প্রকৃতির প্রাণময় রূপ। বর্ষার ভরানদী তো তাঁর চোখে অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে কিছু অমর 888sport app download apkর যেখানে পালতোলা নৌকা, নৌকায় ধানকাটা চাষি বা হালধরা মাঝি সমান গুরুত্বে স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির রূপময়তা এবং দুস্থ জনপদ-জীবনের অসহায়তা – এ দুই বিপরীত উপলব্ধিতে কোনো তফাৎ দেখা যায়নি। এরা একইভাবে উঠে এসেছে তাঁর 888sport app download apkয়, গানে, ছোটগল্পে, চিঠিপত্রে এমন কি 888sport sign up bonusচারণে বা লিখিত নিবন্ধাদিতে।

যেমন বৃষ্টি ঝরে গাছের পাতায়, তৃষ্ণার্ত মাটিতে কিংবা নদী ও সাগরে তেমনি বৃষ্টি ঝরে কবির মনের মাটিতে, জন্ম নেয় বিচিত্র অনুভূতির ফুল। সেসবের পরিচর্যায় ত্রুটি ছিল না রোমান্টিক কবির। যখন বৃষ্টিটা বেশ জমে উঠেছে তখন প্রাণভরে 888sport app download apk বা গান লেখার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি চিঠিগুলোও গদ্যের বদলে 888sport app download apkয় লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। ছিন্নপত্রাবলীতে এ-ধরনের মন্তব্য থেকে বুঝতে পারা যায় বৃষ্টি-বর্ষণ কবি রবীন্দ্রনাথ, গীতিকার রবীন্দ্রনাথকে কতভাবেই না প্রভাবিত করেছে!

তিন

বৃষ্টিঝরা সকাল সন্ধ্যা বা রাতের নেশাধরানো যে মায়াবী প্রভাব তার সর্বাধিক প্রকাশ দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গানে, ছিন্নপত্রাবলীর বয়ানে, 888sport app download apkয় এবং ছোটগল্পে কাহিনির পটভূমি বা অনুষঙ্গ তৈরিতে। তাঁর বর্ষাঋতুর গান তাই এতোটা জনপ্রিয় যা শ্রোতার চেতনা আচ্ছন্ন করে। পূজাপর্ব বা প্রেমপর্বের গানেও বর্ষাবাদলের অনুপ্রবেশ থেকে কবির বর্ষাপ্রীতির পরিচয় মেলে। গীতবিতানের অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতিবিষয়ক গানের মধ্যে বর্ষাঋতুর গানের 888sport free bet সবচেয়ে বেশি, সম্ভবত সে-888sport free bet ১৩৪ বা ১৩৫।

এ-গানগুলোর সবকটি গ্রামবাংলায় বসে লেখা না হলেও অধিকাংশ গানের বাণীবন্ধে; অন্তর রূপের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে নদীমাতৃক গ্রামবাংলার বর্ষণমুখর বা বিষণ্ণ বাদল প্রকৃতির ছাপ ফুটে উঠেছে বলে মনে হয়। ছিন্নপত্রাবলীতে
কবি-চেতনার যে-প্রকাশ শব্দচিত্রে পরিস্ফুট তার সঙ্গে বর্ষার গানের চারিত্ররূপ মিলিয়ে দেখতে চাইলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু ছিন্নপত্রাবলী নয়, ওইসব অঞ্চল থেকে অন্যদের কাছে লেখা চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথের
বর্ষা-বর্ষণপ্রীতির প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়।

আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমে যখন চারিদিক আবছা আঁধারে ভরে যায় তখন অজ্ঞাত কারণেই মন বিষাদে ভরে ওঠে। আর সে-প্রভাবে কাউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কবির ভাষায় – ‘পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে।’ এ-ধরনের গানে বিষণ্ণ-ভাববাদিতার ছাপ যথেষ্ট, কখনো এত স্পষ্ট যে মনে হতে পারে এগুলো পূজাপর্বের গানের তালিকায় স্থান পেতে পারে। এ-জাতীয় গানে কবি তাই বলতে পারেন – ‘এখন বাদল-সাঁঝের অন্ধকারে আপনি কাঁদাই আপনারে।’ এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় বাউল-মানসিকতা বা বিষাদাশ্রয়ীভাবের প্রকাশ।

বর্ষার শ্রাবণ যে রবীন্দ্রনাথের গানেরও উৎস তার ইঙ্গিত মেলে বহুশ্রুত একটি গানে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ উপহারের প্রতিদানে যে ‘শ্রাবণের গান’ তা শুধু মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে 888sport appই নয়, সে হলো কবির ‘সুরের ক্ষেত্রের প্রথম সোনার ধান’ যা সোনার তরীতে করে ফিরে ফিরে আসবে। পদ্মা-শিলাইদহ প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথকে এতোটা আচ্ছন্ন করেছিল যে, ভিন্ন ব্যঞ্জনার 888sport app download apk বা গানেও সোনালি ধান, নৌকোভরা পাকা ধান, ছুটে চলা জলস্রোতের অনুষঙ্গ স্থানিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটায়।

অন্যদিকে পূর্বকথিত বিষণ্ণতার প্রকাশই যেন মেঘজমা বা বৃষ্টিঝরা আকাশের দিকে তাকালে প্রধান হয়ে ওঠে, ‘দিঘির কালো জলে মেঘের ছায়া’ নেমে তাতে নয়া মাত্রা সংযোজন করে। তখন ‘যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা’ বাতাসে ভর করে এসে মনে জমা হয়। পাঠক-শ্রোতা ভাবতেই পারেন বর্ষা-বর্ষণের ঋতু বুঝি বিষাদ-বিষণ্ণতারই,
বিরহ-বেদনার প্রকাশ ঘটানো তার কাজ। এ বিষাদ-বিষণ্ণতা বা বিচ্ছেদ-বেদনার নানারূপ তা নানা চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে, যেমন ভাববাদিতায় তেমনি ব্যক্তিক বিরহের প্রতীকে। এ হিসেবে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের যক্ষবিরহও বাদ পড়ে না। তাই ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়’ কবির মনে এসে দোলা দেয়। দেবব্রত বিশ্বাসের ভরাট কণ্ঠে সে বিষণ্ণতা বড়ো গভীর হয়ে বাজে।

কিন্তু বিষাদ-বিষণ্ণতাই বর্ষাঋতুর শেষ কথা নয়, অন্তত রবীন্দ্রনাথের জন্য তো নয়ই। যার দেখার চোখ আছে তিনি দেখেন ‘বর্ষারাতের শেষে’ বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চেহারা যা রঙে ঝিলমিল। ঘাসে বা পাতায় ‘সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো’ মিশে রঙের যে প্রকাশ ঘটায় সে ‘ধারায় হৃদয় কোথায় যেন ভেসে যায়।’ এ এক আনন্দের অনুভূতি যা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছেন গানে। সে-শব্দচিত্রের সুরময় ধ্বনিরূপ 888sport live chatীর দরদী কণ্ঠে শ্রোতাকে অভিভূত না করে পারে না।

প্রায় একইরকম অনুভূতির জোয়ার আসে যখন ‘পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী।’ ‘গানে গানে মিলন এবং রসের বানে ভেসে যাওয়া’ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এমনই মহিমা বর্ষার পুবে হাওয়ার যা দেহেমনে আনন্দের সঞ্চার ঘটায়। অন্যদিকে ‘বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ যখন ‘আকাশ ছেয়ে আষাঢ় নামে হৃদয় তখন পুলকে দোলে ওঠে।’ বাদল-শেষে ‘বনের ভিজেপাতায় কাঁচা রোদের’ মায়াবী রূপ যত মোহন হোক না কেন, বর্ষার ঋতুর গানে কল্পিত বিচ্ছেদ-বেদনা বা বিষণ্ণতার সুর নানাভাবে প্রকাশ পায়, যেমনটা আমাদের অভিজ্ঞতা ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়ার বাণী ও সুরে। সে-বিষণ্ণতার কারণ ক্বচিৎ জানা, প্রায় সর্বদাই অজানা।

তাই ‘বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি একা একা 888sport sign up bonusবেদনার মালাগাঁথা’য় শেষ হয়। এবং ‘যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে তার ছায়া’ দেখতে পাওয়া যায় ‘শ্রাবণগগনতলে।’ তাই শ্রাবণের পটভূমিতে এমন ছবিই সত্য হয়ে ওঠে যে, আসার চেয়েও ‘পলাতকা ছায়া ফেলে’ চলে যাওয়াটাই অধিকতর সত্য, বিচ্ছেদটাই বড়ো। আর সেখানেও প্রকৃতির সায়, তাই ‘তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল, শ্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।’

তবে শ্রাবণরাতের বিরামহীন বৃষ্টিধারা সম্ভবত বিষণ্ণতার সুগভীর প্রকাশ ঘটায়। ‘সঘনগহন রাত্রি’ গানটির আদ্যন্তপাঠ এবং গভীরকণ্ঠে এর গায়কি শ্রাবণরাতের বিষণ্ণতা ভরা মর্মবাণীর অসামান্য প্রতিফলন হয়ে ওঠে। বাউলের একতারাতে যেমন করে না-পাওয়ার বেদনা ধারা জলের মতো ঝরে পড়তে থাকে। এমন পরিবেশে ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী হয়ে নিঃসীম শূন্যে’ ভেসে যেতে চায়, এমনটাই রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় শ্রাবণবিহার। তবে ‘ঝড়ের রাতে পরানসখা বন্ধুর অভিসারে’ বিচ্ছেদ-বেদনা এবং মিলনাকাঙ্ক্ষা এমনই তীব্র যে, এ-গানের অধ্যাত্মবাদিতা শ্রাবণের বাস্তবিকতা ছাড়িয়ে যায়।

চার

ভাববাদী উদাসীনতা বা অধ্যাত্মবাদী বিচ্ছেদের তীব্রতা প্রকাশের পাশাপাশি বাংলার বর্ষার জাগতিক রূপ একইরকম আবেগে রবীন্দ্রনাথের মন টেনেছে। ভাসমান ধান বা পাট গাছের ডগা, শাপলা-শালুকের নানা রং নিয়ে বর্ষাকালের ছবিটা যেন প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো ক্যানভাস। ভাসমান চরের জলিধান এখন পানির নিচে। বোটে বসে কবি দেখতে পাচ্ছেন নৌকা বোঝাই করে কৃষকের কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসার দৃশ্য এবং সেইসঙ্গে শুনতে পাচ্ছেন বন্যার অত্যাচারে কাঁচা ধান কাটার হাহাকার।

এমনই এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় শিলাইদহে বোটে বসে দেখেছেন মানবজীবনের বিপর্যয়ের ছবি। অবিরাম বৃষ্টি অর্থাৎ বর্ষার বৃষ্টি ওই বিপর্যয়ের কারণ। একাধিকবার দেখেছেন এমন দৃশ্য আর ভেবেছেন সময়-বিশেষে প্রকৃতি এতো অকরুণ কেন! ‘পাখিরা বিমর্ষমনে তাদের নীড়ের মধ্যে বসে আছে, কিন্তু মানুষের ছেলেরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে।’ কারণ তাদের তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না।

এই দুঃখবোধের মধ্যেও ভালো লাগে বর্ষার জলস্রোতে, বিশেষ করে পদ্মায় ভেসে চলতে। অনুকূল বাতাসে পাল তুলে চলা আরো আকর্ষণীয়। জুলাই, ১৮৯৩ সালের তেমন একটি ছবি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – ‘বাতাস বেগে বইতে লাগল, পদ্মা নৃত্য করতে লাগল, পলে ফুলে উঠল, দিনের আলো মিলিয়ে এল, আকাশের ধারের মেঘগুলি ক্রমে আকাশের মাঝখানে ঘনঘটা করে জমে গেল, চারদিকে পদ্মার উদ্দাম জল করতালি দিচ্ছে – … আমি যেন প্রকৃতির রাজার মতো বসে আছি।’

এভাবেই পদ্মার ওপর বোটে বসে বা জলপথে চলতে চলতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষায় শ্রাবণের ডায়েরি রচনা করেছেন। বিস্তীর্ণ চর, ঝাউবন, বালুচরের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি দেখেছেন ‘জমির শোভা ধান’ – যে সোনালি ধান কেটে নিয়ে কৃষকের নদীপথে নৌকো করে ঘরের দিকে যাত্রা-মনে জন্ম নিয়েছে রাশি রাশি ধানকাটার সঙ্গে ভিন্ন বোধের পঙ্ক্তিমালা। সোনার তরী পর্বের অনেক 888sport app download apkই রবীন্দ্রনাথের পদ্মাপর্বের অভিজ্ঞতার ফসল। 888sport app download apkই নয়, সেইসঙ্গে গানের কলি – কখনো শ্রাবণগাথা, কখনো একেবারেই ভিন্ন ভাবনা ভিন্ন স্বাদের। এসবের উৎস প্রকৃতির দানে ঋদ্ধ বর্ষার গ্রামবাংলা।

কিন্তু বর্ষার এ-রূপ, ভরাপদ্মার ভয়ংকর প্রকৃতি, অবিরাম বর্ষণে বিপর্যস্ত জীবনচিত্র যেমন চিঠিতে, ডায়েরিতে ধরে রেখেছেন তেমনি সেগুলো স্থান পেয়েছে তাঁর পদ্মা পর্বের ছোটগল্পে। দৃশ্যগুলো আমাদের অচেনা নয়।

অভিজ্ঞতা-নির্ভর এসব শব্দচিত্রে কখনো রোমান্টিকতার প্রকাশ, কখনো জনজীবনের দুর্ভোগ-দুর্দশার প্রকাশ ঘটেছে। উদ্ধৃতিতে রচনার দৈর্ঘ্য না বাড়িয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, এ-ধরনের চিত্রাবলিতে রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তাঁর জীবনবাদী-বাস্তববাদী 888sport live chatীচরিত্র স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

বলা চলে, রবীন্দ্রনাথের হাতে বর্ষার বাংলার রূপচিত্রণে সৌন্দর্যের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বিপর্যস্ত জনপদ-জীবনের অসুন্দর রূপ যা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন কবি। দুই বিপরীত চরিত্রের এসব ছবি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোকে নান্দনিকতায় পূর্ণ করে তুলেছে। 888sport app download apkও সেক্ষেত্রে বাদ পড়েনি। তাই ‘সোনার তরী’ 888sport app download apkর রচনা প্রসঙ্গে চিঠিতে লেখেন – ‘ছিলাম তখন পদ্মার বোটে। … বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরবেগে বয়ে চলেছে। … নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে। … ভরা পদ্মার উপরকার ওই বাদল-দিনের ছবি সোনার তরী 888sport app download apkর অন্তরে প্রচ্ছন্ন এবং তার ছন্দে প্রকাশিত।’ তবে তা অধিকতর বাস্তবতায় তাঁর ছোটগল্পে উপস্থিত।

যেমন ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘একরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘শাস্তি’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘মণিহারা’ ইত্যাদি, তবে সর্বাধিক ‘অতিথি’ গল্পটিতে। এগুলোতে কখনো প্রমত্ত পদ্মার খরস্রোত, কখনো কখনো মুষলধারে বৃষ্টি, কখনো ঝড়জলের প্রলয় স্রোত আবার কখনো বর্ষার পারিপার্শ্বিক চিত্র বাস্তব রূপ নিয়ে ফুটে উঠেছে। এবং গল্পগুলোকে 888sport live chatগুণে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। পদ্মাপর্বের গল্প থেকে গুটিকয় উদাহরণ
বক্তব্য-বিষয় স্পষ্ট করে তুলবে। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পের প্রেক্ষাপট রূপে রবীন্দ্রভাষ্য :

বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল।… পাড়ভাঙার অবিশ্রাম ঝুপ্ ঝাপ্ শব্দ এবং জলের গর্জনের দশ দিক মুখরিত হইয়া উঠিল…।

এমন এক পটভূমিতে ছোট্ট শিশু খোকাবাবু প্রবল কৌতূহল নিয়ে একপা-দু’পা করে পদ্মার ভয়ংকর জলস্রোতের দিকে এগিয়ে গেছে, তৈরি হয়েছে অনিবার্য ট্র্যাজেডির পটভূমি যা কয়েকটি ছত্রে পরিস্ফুট। শিশুটি ‘দেখিল, জল খল্ খল্ ছল্ ছল্ করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে; যেন দুষ্টামি করিয়া কোন্-এক বৃহৎ রাইচরণের হাত এড়াইয়া এক লক্ষ শিশুপ্রবাহ সহাস্য কলস্বরে নিষিদ্ধ স্থানাভিমুখে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতেছে। … মানবশিশুর চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। … দুরন্ত জলরাশি অস্ফুট কলভাষায় শিশুকে বার বার আপনাদের খেলাঘরে আহ্বান করিল।’ শিশু মন কি এ-আহবানে সাড়া না দিয়ে পারে? তাই ‘ঝুপ করিয়া একটা শব্দ হইল’ এবং ট্র্যাজেডি পূর্ণতা পেল।

‘শাস্তি’ গল্পেরও বৈনাশিক পদ্মার প্রতীকী উপস্থিতি পরোক্ষ হলেও তাৎপর্যপূর্ণ : ‘অদূরে পদ্মা ভয়ংকর রূপ ধারণ করিয়া চলিয়াছে। শস্যক্ষেত্রের অধিকাংশই ভাঙিয়া লোকালয়ের কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছে। ভাঙনের ধারে দুই চারিটা আমকাঁঠালের শিকড় বাহির হইয়া দেখা দিয়াছে, যেন তাহাদের নিরুপায় মুষ্টির প্রসারিত অঙুলিগুলি শূন্যে একটা কিছু অমিত্মম অবলম্বন আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে।’ প্রাকৃত রূপের এ বাস্তবতাও প্রতীকী রূপচিত্রণ ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত বহন করে।

বর্ষা-বর্ষণভিত্তিক প্রাকৃত চেতনার চরিত্র সৃষ্টি ও তার পরিণতি ‘অতিথি’ গল্পটিতে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে। গোটা গল্পটিতে পরিস্ফুট প্রকৃত চেতনার টানে নায়ক তারাপদ ব্যক্তিক, পারিবারিক, এমনকি ভালোবাসার বন্ধনও ছিন্ন করতে পেরেছে। ঘনকালো মেঘ, পুবে বাতাস, উদ্দাম নদীর জলতরঙ্গ, আকাশ-চেরা বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো দীপ্তি আর ‘মুষলধারাবর্ষী বৃষ্টির গন্ধ’, জলস্ফীত নদীতে বড় বড় নৌকার উন্মাতাল নৃত্য অনিকেত-মানসিকতার নায়ককে সংসার-বন্ধন থেকে ছিন্ন করে ছোটগল্পের প্রথাসিদ্ধ ট্র্যাজিক মুহূর্ত (‘ক্লাইমেক্স’) সৃষ্টি করেছে। বর্ষা ও বর্ষণমুখর প্রকৃতিকে ঘিরে রচিত ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘অতিথি’।

‘যখন গহনরাত্রি ঝরেছে শ্রাবণধারা’ ও ‘অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা’র মতো গানের পঙ্ক্তি মনে হয় ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পটির চমকপ্রদ পটভূমি তৈরি করতে পারে। ‘মুষলধারে বৃষ্টি’ ধরিত্রীভাসানো বিরামহীন বৃষ্টির ধারা বাস্তবিকই এ-গল্পের ট্র্যাজিক পটভূমি তৈরি করেছে। এর সর্বোত্তম প্রকাশ গল্পের শেষ দুটো বাক্যে – ‘সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল, … পরদিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে – মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’

রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর মধ্যে ‘একরাত্রি’ একটি – এমনটাই অভিমত গল্পবিশেষজ্ঞদের। এখানেও একইরকম পরিবেশ অর্থাৎ মুষলধারে বৃষ্টি ও ঝড়, লেখকের ভাষায় ‘প্রলয়কাল’ গল্পের মহামুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। ‘আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃন্তটুকু হইতে খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই’, কিন্তু শেষ ঢেউ আসেনি। তবু ‘একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে’ নায়ক এক মধুর ট্র্যাজেডিতে ‘অনন্ত আনন্দের আস্বাদ’ পেয়েছে।

সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতে তাঁর ‘গল্পের দুপুরবেলা’য় বসে লেখা ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটির পরিণতিও ট্র্যাজেডি সৃষ্টিতে নদী, ধাবমান জলস্রোত বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। জলস্রোতের উদাসীন চলার প্রভাবে পোস্টমাস্টারের মনে ব্যক্তিক সম্পর্কের ভিত্তি ও গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ‘বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করা’র পরিপ্রেক্ষিতে ‘হৃদয়ে বেদনা অনুভব’ করার পরও ওই উদাসীনতার প্রভাবে ‘নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিক’ পোস্টমাস্টারের ‘উদাস হৃদয়ে তত্ত্বের উদয় … পৃথিবীতে কে কাহার?’ এ-ধরনের বাউল-মানসিকতা বা বিচ্ছিন্নতাবোধ নদীমাতৃক বাংলা-প্রকৃতির দান।

‘সমাপ্তি’ গল্পেও দেখা যায় বর্ষার খরস্রোতা নদী ও মুষলধারে বৃষ্টিকাহিনির তাৎপর্যময় পরিণতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। যেমন দেখা যায় ‘মহামায়া’, ‘মণিহারা’ বা ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে। ‘ছুটি’ গল্পে এর কিঞ্চিৎ আভাস। ‘মহামায়া’তে একাধিকবার ‘মুষলধারায় বৃষ্টি’ কখনো ‘প্রলয়-ঝড়’ যে-ঝড় ‘লোকালয় হইতে দুইটা মানুষকে ছিন্ন করিয়া প্রলয়ের দিকে উড়াইয়া লইয়া চলিয়াছে।’ পদ্মাপর্বের অধিকাংশ গল্পে ‘মুষলধারায়’ বৃষ্টির প্রবল প্রভাব। ছিন্নপত্রের ভাষ্যে দেখা যায়, এ-ধরনের ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। সে-অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে বেশ কয়েকটি গল্পে, কখনো আটপৌরে কখনো গভীর শৈল্পিক তাৎপর্যে। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পটি শ্রাবণে লেখা হলেও ‘ছুটি’ পৌষে, ‘মহামায়া’ ফাল্গুনে, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অগ্রহায়ণে। কিন্তু এগুলোতে
বর্ষা-বর্ষণ ও জলস্রোতের বাস্তব উপস্থিতিতে কোনো ঘাটতি নেই। বুঝতে পারা যায় রবীন্দ্রনাথ গ্রাম-বাংলার বর্ষণমুখর বর্ষা প্রকৃতিকে চেতনায় স্থায়ীভাবে ধারণ করেছিলেন। সে-পরিচয়ের কিছুটা এ-আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে। 

* কালি ও কলম সপ্তম বর্ষ একাদশ 888sport free bet, পৌষ ১৪১৭/ ডিসেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত।