888sport appsে চারুকলার ৫০ বছর 888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরীর 888sport sign up bonusচারণ

হাসান হাফিজ

তার মৃত্যুতে 888sport appsের চারুকলার জগৎ অনেকটাই এতিম হয়ে গেছে বলা চলে। আমাদের গ্রেট মাস্টারদের অন্যতম ছিলেন মহান এই 888sport live chatী। প্রগতির লড়াইয়ে তিনি সবসময় ছিলেন অগ্রসেনানী। জাতির মননে তিনি জারিত করে চলেছিলেন নান্দনিকতার চেতনা, রুচি ও সৌন্দর্যবোধ। এই দেশের 888sport live chat, 888sport live football, সংস্কৃতি ও মননের অঙ্গনে তিনি ছিলেন অভিভাবকপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। রীতিমতো একটি প্রতিষ্ঠান। ৮২ বছর বয়সেও ছিলেন তারুণ্যে উদ্দীপিত, অবিশ্রাম সৃষ্টিশীল। তাঁর মৃত্যুর মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা আগে, ৩০ নভেম্বর ২০১৪ শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে মহান 888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল মোবাইল ফোনে। মোট দুই মিনিট ৩৫ সেকেন্ড কথা হয়। রাতে টিভির ব্রেকিং নিউজে যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানতে পারি, তখন স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। সে-রাতে ঘুমাতে পারিনি।

কয়েকদিন আগে ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’র বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা। অনুষ্ঠান শুরুর বেশ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছিলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং 888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরী – দুজন অনুষ্ঠানের অতিথি। বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসার আত্মজীবনী আমার বেলা যে যায় বের করেছে প্রথমা। সে-বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। তাতে যোগ দেওয়ার জন্যে গেছি। এবিএম মূসা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের কাজ চলছে। সে-গ্রন্থের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমি সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য। আনিস স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক। স্যারকে বললাম, স্যার, আপনার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। এ-কথা শুনে তিনি জিজ্ঞাসু-চোখে তাকালেন। বললাম, আজ থেকে ১৬ বছর আগে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে 888sport live chatকলা একাডেমীতে আপনি একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিষয় : 888sport appsে চারুকলা চর্চার ৫০ বছর। সেই বক্তৃতাটি আমি নিয়ে এসেছি। কম্পিউটারে কম্পোজ করা আছে। স্যার তো রীতিমতো বিস্মিত। বললেন, তাই নাকি? তা এই খামটাও আমাকে দাও।

কাইয়ুমভাই পাশেই বসা ছিলেন। পুরো ব্যাপারটা তিনি আগ্রহভরে লক্ষ করলেন। আমি বললাম, কাইয়ুমভাই একই বিষয়ে আপনার বক্তৃতাও আমার কাছে আছে। অডিও টেপে ধারণ করা হয়েছিল। তা থেকে ট্রান্সক্রাইব করা হয়েছে।

আসলে হয়েছে কী, ’৯৮ সালে বেশ ঘটা করে উদযাপন করা হয়েছিল 888sport appsে চারুকলা-চর্চার ৫০ বছর। এ-উপলক্ষে পঞ্চাশের দশকের বিশিষ্টজনদের এক বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁরা খ্যাতিমান 888sport live chatী, কবি-লেখক, 888sport live chat-সমালোচক। মোট ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি একেকদিন একক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন : আবদুর রাজ্জাক, বিজন চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, সাদেক খান, শফিকুল আমিন, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কবি-কথা888sport live chatী সৈয়দ শামসুল হক ও ওয়াহিদুল হক। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই।

আনিস স্যার আগ্রহভরে নিজের বক্তৃতার কপিটি দেখছিলেন।  এ-সময় কাইয়ুমভাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, আরে হাসান হাফিজ, এগুলো দিয়ে তো একটা বই করে ফেলা যায়। প্রথমা তো এ-বই করতে পারে। আর হাসনাতকে (আবুল হাসনাত, সম্পাদক, কালি ও কলম) বললে ও তো লুফে নেবে। আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। আসলে এগুলো বই আকারে বের হওয়ারই কথা ছিল। 888sport live chatকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগের তৎকালীন পরিচালক 888sport live chatী সুবীর চৌধুরী সে-উদ্যোগ নিয়েও ছিলেন। শেষতক ব্যাটে-বলে আর হয়নি। সুবীরদা পরে বেঙ্গল আর্ট গ্যালারির পরিচালক পদে যোগ দেন। তিনিও আমাদের মাঝে নেই আর।

বক্তৃতাগুলোর সমবায়ে বই বের করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হলেন না কাইয়ুম চৌধুরী। নিজের মোবাইল সেট বের করে বললেন, দাঁড়ান আপনার ছবি তুলি। একটু সামনের দিকে ঝুঁকুন তো। ছবি তোলা শেষ হলে আমার নম্বর জানতে চেয়ে সেভ করলেন। একটা রিংও দিলেন। আমি দেখালাম যে, ওনার নম্বর আমার সেটে আগে থেকেই সেভ করা আছে। কাইয়ুমভাই বললেন, বইটা করার ব্যাপারে আপনাকে খোঁচাব আমি – সে-কারণেই ফোন নম্বর নেওয়া। অনুষ্ঠানের সবাই ব্যতিক্রমী এ-ব্যাপারটা খেয়াল করছেন। আমি কিঞ্চিৎ অস্বস্তিও বোধ করছি এতে। পরে বক্তৃতায় কাইয়ুমভাই এবিএম মূসার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার কথা বিশদে বললেন। মূসাভাইয়ের সুবাদে ও উৎসাহে একসময় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য যে হয়েছিলেন, সে-কথাও বললেন।

আমি অপেক্ষা করছি, কবে কাইয়ুমভাইয়ের ফোন পাব। পাচ্ছি না। তিনি মারা যাওয়ার দিন কী ভেবে আমিই ফোন দিলাম। তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন মিয়োনো মনে হলো। আমি বললাম, আপনি তো আর আমাকে খোঁচালেন না। আমি নিজেই খোঁচা খাওয়ার জন্যে আপনাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, এখন বেশ ব্যস্ততার মধ্যে দিন যাচ্ছে। বেঙ্গলের উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন চলছে। আগামীকাল এশিয়ান বিয়েন্নাল শুরু হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যস্ত আছি। আমি বললাম, এক মিনিট সময় চাই। আপনার বক্তৃতাটা এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। কয়েকটা লাইন পড়ে শোনাব কি? আপনি মজা পাবেন। তিনি বললেন, আচ্ছা। আমি পড়ে শোনালাম। কাইয়ুমভাই বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ এগুলো আমারই কথা। আমি তখন বলি, দু-চারদিন পরে আপনি যখন ফ্রি হবেন, আমাকে ফোন করবেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আমরা বসব। দুজনে একসঙ্গে দুটি ভাতও খাব। আপনি তো একসময় এই ক্লাবের সদস্যও ছিলেন। চারুকলা চর্চার ৫০ বছর – বইটা আপনি এবং আমি দুজনে মিলে সম্পাদনা করব। কাইয়ুমভাই বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তাই হবে।

তা আর হলো না! বদলে গেল দৃশ্যপট। কাইয়ুমভাই বইটা দেখে যেতে পারলেন না। আমার একটি 888sport app download apkর বই দীঘল অচেনা পরবাসের প্রচ্ছদ করেছিলেন 888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরী। সে-বইটা উৎসর্গ করেছিলাম সুবীর চৌধুরীকে। তিনিই কাইয়ুমভাইয়ের কাছ থেকে প্রচ্ছদটা আদায় করে দিয়েছিলেন। দুই চৌধুরীই আজ পরলোকে – দীঘল অচেনা পরবাসে…। রবীন্দ্রসংগীতে আছে ­- এ পরবাসে রবে কে হায়!

888sport apps 888sport live chatকলা একাডেমী-আয়োজিত পঞ্চাশের দশকের বিশিষ্ট সুধীজনের 888sport sign up bonusচারণ অনুষ্ঠানমালায় কাইয়ুম চৌধুরীর বক্তৃতা এখানে উদ্ধৃত হলো।

 

888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরীর 888sport sign up bonusচারণ

উপস্থিত সুধীবৃন্দ এবং 888sport live chatানুরাগীরা। পঞ্চাশ বছর সময় অতি দীর্ঘ। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের ঘটনা। এই 888sport sign up bonusচারণে যেহেতু আমার 888sport sign up bonusচারণ, সেহেতু আমার প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে আসবে। আমি চেষ্টা করব আমাকে বাদ দিয়ে আমি যাঁদের দেখেছি তাঁদের কথা বলার জন্যে। যদি আমার কথা বেশি বারবার এসে যায়, তাহলে সেটা আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করে নেবেন।

আজকে 888sport live chatচর্চার যে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব, এটা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আর্ট কলেজ স্থাপিত হওয়ার পরে। আমি ইশ্কুলে থাকাকালীন আমার মধ্যে একটা স্বপ্ন লালিত ছিল যে, আমি আর্ট স্কুলে ভর্তি হবো।      সে-সময়ে আর্ট স্কুল যেহেতু এই অঞ্চলে নেই – সেটা ছিল কলকাতায়। বাবাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বলতেন – ‘তোমাকে কলকাতায় পাঠাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই, তুমি অন্য কিছু পড়ার চিন্তা করো।’ মনটা মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগত। যাই হোক, ১৯৪৯ সালে তখন আমরা ময়মনসিংহে। আমি ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিই।

ময়মনসিংহের যে-অঞ্চলে আমি থাকতাম, সেটার নাম হচ্ছে আকুয়া। রেললাইনের পাশে এবং distanant signal-এর সঙ্গে; জয়নুল আবেদিন ও তাঁর পরিবার সেখানে থাকত। সে-সময়ে আবেদিন সাহেব পাকিস্তান সরকারের Films and Publication-এর Chief Artist হিসেবে করাচিতে কর্মরত। 888sport appয় আর্টস ইনস্টিটিউট হচ্ছে, কী হচ্ছে না এ-সম্পর্কে আমার তখনো কোনো ধারণা ছিল না। যদিও, এর কর্মকান্ড, পরে শুনেছি পাকিস্তান হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছিল। সে-সময়ে আমার বড়ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন জয়নুল আবেদিনের সহোদর 888sport live chatী জুনাবুল ইসলাম। তাঁরা উভয়েই আনন্দমোহন কলেজে পড়াশোনা করতেন। তাঁর কাছে শুনতে পেলাম, 888sport appয় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা অলরেডি হয়ে গেছে।   ১৯৪৮-এ এবং জয়নুল আবেদিন পাকিস্তান থেকে ফিরে আর্ট কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন এবং দু-একদিনের মধ্যেই তিনি ময়মনসিংহে আসবেন শুনে খুব উৎসাহবোধ করলাম।

জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ, আমি জয়নুল আবেদিনকে প্রথম দেখি, একটা বিচিত্র পরিবেশে। সেটা হচ্ছে দুপুরে, আকুয়াতেই মসজিদের পাশে একটা পুকুর ছিল। আমি দুপুরে সেখানে গোসল করতে গিয়েছি। হঠাৎ আমাদেরই সঙ্গের একজন বললেন, ‘তুই জয়নুল আবেদিনের খোঁজ করছিলি, জয়নুল আবেদিনকে দেখেছিস?’ আমি বললাম, ‘না।’ ‘তবে দ্যাখ, ওই পুকুরে কানে আঙুল দিয়ে ডুব দিচ্ছেন জয়নুল আবেদিন।’ আমি তো দেখে একেবারে চমকে উঠলাম। কারণ তাঁর ছবির সঙ্গে আমার পরিচয় পূর্বে ঘটেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত মিল্লাত পত্রিকায় তাঁর  সাদা-কালো রাফ ড্রয়িং এবং তৎকালীন ডিএফপির একটি মাসিক পত্রিকা মাহে নওয়ে, সেখানে তাঁর কিছু কাজ আমার নজরে এসেছে। তো তাঁর কাজের সঙ্গে মোটামুটি একটা পরিচয় ছিল এবং তাঁকে ওই অবস্থায় দেখব আমি বিন্দুমাত্র কল্পনা করতে পারিনি! এরকম একজন লোককে এভাবে দেখব! আমি গোসল-টোসল ছেড়েই চলে গেলাম দৌড়ে বাসায়। বিকেলে বাবা ফিরলেন অফিস থেকে। তাঁকে বললাম, ‘আবেদিন সাহেব এসেছেন, আপনি একটু কথা বলেন।’ তার পরদিন বিকেলবেলা দেখলাম আবেদিন সাহেব আমাদের বাসায়, তিনি আমার সেই সময়কার, আমি যেসব ছবি-টবি আঁকতাম অপটু হাতে, সে-কাজগুলো দেখলেন এবং দেখে এক কথায় বললেন, ‘একে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন 888sport appয়।’ ব্যস, আমার পারমিশন হয়ে গেল।

তখনো ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বের হয়নি। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি কি মার্চে আমি 888sport appয় এলাম। তারপর একদিন  গুটি-গুটি পায়ে চলে গেলাম আর্ট স্কুলে। ভেতরে ঢুকলাম। সে আর্ট স্কুলটা তখন ছিল সদরঘাটে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলের নিচের তলার দুটো রুমে। আমি যখন ঢুকলাম, ঢুকতেই একেবারে আবেদিন সাহেবের মুখোমুখি। তিনি আমাকে দেখলেন। দেখে বললেন, ‘তুমি কি ময়মনসিংহ থেকে এসেছ?’ আমি বললাম, ‘জি স্যার।’ তারপর আনোয়ার সাহেবকে ডেকে বললেন, ‘ওকে বসিয়ে দিন।’ আমি তো ‘বসিয়ে দিন’ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আনোয়ার সাহেব আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা কামরায়। দেখি দশ-বারোজন বসে আছে ডোংকি নামক একটা আসনের ওপর। তাদের সামনে একটা মাটির কলসি রাখা। আমাকে একটা বোর্ড এবং একটা কাগজ-পেনসিল দিয়ে আনোয়ার সাহেব বললেন, ‘এই কলসিটা আঁকো।’ আমি বসলাম আঁকতে, আশপাশে তাকালাম। বাঁদিকে দেখি মুর্তজা বশীর, ডানদিকে রশিদ চৌধুরী আর সামনে আবদুর রাজ্জাক, হুমায়ুন কাদির, আলী রেজা, আনোয়ার জগলুল – আমার সে-সময়কার সব সহপাঠী। সবার আঁকা হয়ে গেল, আমার আঁকা শেষ হয় না। এই কলসি আঁকা যে কী কঠিন সে-সময় বুঝতে পারলাম। সফিউদ্দীন সাহেব পেছনে এসে বললেন, ‘হয়ে গেছে তোমার? আর কিছু করার দরকার নেই। বেশি করলে আবার খারাপ হয়ে যাবে, দিয়ে দাও।’ দিয়ে দিলাম এবং সেদিনই আমার মনে হয় ঘণ্টাদুয়েক পরে রেজাল্ট। আমরা ভর্তি হওয়ার পারমিশন পেলাম।

কিন্তু রশিদ চৌধুরীর পারমিশন হলো না। রশিদ চৌধুরী ফেল। ভীষণ মন খারাপ রশিদ চৌধুরীর। অনুনয়-বিনয় আবেদিন সাহেবের কাছে। আবেদিন সাহেব বললেন, ‘না তোমার ড্রয়িং ভালো না, তুমি পারবে না।’ রশিদ চৌধুরী বলল, ‘স্যার আমাকে ছয় মাস সময় দিন, না দুমাস সময় দিন। আমি দুমাসের মধ্যে নিজেকে ইমপ্রুভ করব, আমাকে ভর্তি করে নিন।’ আবেদিন সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে আমি ছয় মাস সময় দিলাম।’ রশিদ চৌধুরী তাঁর কথা অনুযায়ী দুমাসের মাথায়ই সফলকাম হলেন এবং আমাদের সঙ্গে ভর্তি হলেন।

সেই থেকে শুরু আমাদের। সে-সময়ে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সফিউদ্দীন সাহেব, আনোয়ারুল হক আর শেখ হাবিবুর রহমান, তখনো খাজা শফিক আহমেদ যোগদান করেননি। আরো ছিলেন, সেই সময়ে শফিকুল আমিনও তখন যোগদান করেননি। তাঁরা পরে যোগদান করেছিলেন। কামরুলভাই ছিলেন। কামরুলভাইকে তখন ঠিক শিক্ষক হিসেবে মনে হতো না। তিনি একটা স্কেচ খাতা নিয়ে সবসময় ঘুরতেন এবং যেখানে যখন বসতেন ওই স্কেচ খাতায় ড্রয়িং করতেন এবং আমাদের তখন উপদেশ দিতেন। তিনি আমাদের স্কেচ দেখতেন প্রতিদিন। আমাদের উপদেশ দিতেন – ‘এই স্কেচ খাতা রাখবে সঙ্গে, এবং সবসময় স্কেচ করবে। আর প্রতিদিন স্কুলে যখন আসবে তখন আমার টেবিলে স্কেচ খাতা রাখবে আমাকে দেখাবে।’ তিনি আমাদের স্কেচের ভুল-ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিতেন এবং তাঁর সুপরামর্শ আমাদের পরবর্তী জীবনে খুব কাজে লেগেছিল –  এ-কথা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

সে-সময়ে আমাদের সিলেবাসে  যে-ধরনের বিষয় ছিল – যেমন একটা বিষয় ছিল আর্ট ড্রয়িং, যেটা অজন্তার ছবির ওপরে নন্দলাল বসুর যে-ব্রাশড্রয়িং তার কপি ছিল এবং ব্রাশে আমাদের হুবহু কপি করতে হতো। কপি করার একটা ব্যাপার ছিল, কারণ ব্রাশের যে মোটা-চিকন লাইন আমাদের টানতে হতো চায়নিজ ইংকে। ও, এর মধ্যে একটা মজার কথা বলে নিই, যেটা আমি ভুলে গেছি। সেটা হচ্ছে ভর্তি যখন হয়ে গেলাম, তখন মুর্তজা বশীরকে আবেদিন সাহেব ডাকলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি কাগজ, পেনসিল, ব্রাশ, চায়নিজ ইঙ্ক এগুলো কিনে নেবে। আগামীকাল থেকে ক্লাশ শুরু।’ আমি আবেদিন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চায়নিজ ইঙ্কটা কী?’ আবেদিন সাহেব কিছুক্ষণ হাঁ করে আমার মুখে দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বশীরকে ডাকলেন। বশীরকে ডেকে বললেন, ‘বশীর, ও তো দেখি কিছুই চেনে না। ওকে নিয়ে ওই যা যা প্রয়োজন, কিনে দিও।’ বশীর আমাকে নিয়ে ওই চায়নিজ ইঙ্ক নামক কালিটি চিনিয়ে দিলো এবং কিনে দিলো। সে-সময়ে রঙের দোকান ছিল আরমানিটোলায় ওয়ার্সী বুক সেন্টার বলে একটি বইয়ের দোকান। তারা   সে-সময়ে আর্ট কলেজের জন্যে রং, তুলি, কাগজ এসব আমদানি করতেন। সেখানে গিয়ে ব্রাশ, চায়নিজ ইঙ্ক এগুলো কিনলাম।

তারপর যে-কথা বলছিলাম – নন্দলাল – সেই ড্রয়িং-মোটা-চিকন ব্রাশ। সেই ড্রয়িং পেনসিলে হুবহু কপি করে সেই একই ব্রাশে মোটা এবং পাতলা লাইন কাগজ থেকে হাত না তুলে টেনে করতে হতো। প্রথম প্রথম মনে হতো খুব সোজা। তারপর দেখলাম যে খুব কঠিন। কারণ চোখের কোনায় পাতলা-সরু দিয়ে চোখের গভীরতায় আবার সেই ব্রাশটাকে চেপে আনা – হাত কেঁপে যেত। এই একটা ব্যাপার ছিল। আবার সেই ড্রয়িংটিকেই আবার ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে হাত সোজা করে একদম স্ট্রেইট লার্জ করা লাইন টেনে এনলার্জ করা। সেটাও বেশ ছবির এনলার্জমেন্ট করার সময় আমাদের খুব কাজে লেগেছিল। আর এমনি পেনসিলের স্কেচ, পারসপেকটিভ; এগুলো তো ছিলই।

আমি তখন থাকতাম সিদ্ধেশ্বরীতে। আর সিদ্ধেশ্বরী থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল সদরঘাট বেশ দূরে। তখন অর্থনৈতিক অবস্থা একটুও ভালো ছিল না। আমি যখন আর্ট স্কুলে ভর্তি হই – সে-সময়ে আমার বড় ভগ্নিপতি ছিলেন ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে। ভর্তির খরচ কী রকম, এটা জানার জন্যে বাবা তাঁকে বলেছিলেন একটু খোঁজখবর নিতে। কারণ ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তখন আর্ট কলেজের যোগ ছিল। বিভিন্ন সময়ে টাকা-পয়সার বিষয়ে ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আনোয়ার সাহেব কিংবা আবেদিন সাহেবসহ অন্যরা যেতেন সে-সময়ে। তিনি এ-ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আবেদিন সাহেব বলেছিলেন, ‘ও কিছু না, প্রথম বছরটা যদি কোনোরকমে চালিয়ে নেওয়া যায়, দ্বিতীয় বছর থেকে কমার্শিয়াল কাজ করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে।’ সুতরাং আপত্তি করার কিছু নেই।

ভর্তি তো হলাম। সেই অর্থনৈতিক অবস্থায় বাবা মাসে আমাকে আট টাকা করে দিতেন। চার টাকা বেতন আর চার টাকায় যেভাবে পারো রং, তুলি – যা পারো কিনে নিও। সে-সময়ে সেই সিদ্ধেশ্বরী থেকে সদরঘাট যাওয়া, আমরা হেঁটেই চলে যেতাম। বাস সার্ভিস ছিল, সেটা পুরানা পল্টনে। পুরানা পল্টনে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের একটা বাড়ি ছিল। কাঠের মাচার ওপরে। সেখান থেকে বাসে চড়তাম এবং সদরঘাটে আসতাম, ছয় পয়সা লাগত। ছয় পয়সাও অনেক সময় পকেটে থাকত না। কোনো কোনোদিন হয়তো কন্ডাক্টর দেখেনি, ভুলে চার পয়সায় কাজ সেরে এসেছি। আবার কোনো কোনোদিন পয়সা দিতে না পারলে তো কোনো কথাই নেই – ব্যস দুপুরের জলখাবারটা হয়ে যেত। এভাবেই চলছিল আর কী। এর মধ্যে প্রথম দিন আর্ট কলেজে আমরা যখন গেলাম, তখন আমাদের সিনিয়র যারা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম যখন ক্লাসটা, আমার মনে আছে – ওটা ছিল উডকাটের কাজ। আমাদের আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, আবদুর রহমান ভূঁইয়া – এঁরা সব ক্লাস করছে এবং হামিদ একটি বাটাওয়ালা কাঠের হাতুড়ি নিয়ে ঠক্ঠক্ করে কাঠের ওপর মারছে। আমরাও অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছি, কেমন ছবি হচ্ছে এটা। আমিনুল সে-সময়ে থাকতেন সিদ্ধেশ্বরীতেই। তাঁর একটা সাইকেল ছিল। সাইকেলের পেছনে একটা বিরাট পোর্টফোলিও থাকত। আর তিনি পায়জামা পরতেন, টায়ারের স্যান্ডেল পায়ে দিতেন। পায়জামা দুটো পায়েই রুমাল দিয়ে বাঁধা এবং সাইকেলে তিনি চলাফেরা করতেন। মাঝে মাঝে আমাকে সামনে হ্যান্ডেলে বসিয়ে স্কুলে চলে আসতেন।

সেই সিনিয়র আমিনুল ইসলাম – তাঁর সঙ্গে বহুবার আউটডোর স্কেচে গিয়েছি এবং তাঁর কাজের ধরন আমার লক্ষ্য করার সুযোগ হয়েছে। তিনি নিজে আমাকে শেখাবার নানান কলাকৌশল দেখাতেন। আমিনুল তখন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কাছে মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে কাগজপত্র আসত। বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) থেকে একটা কাগজ আসত ক্রসরোড বলে। তিনি সেটা আমাকে পড়তে দিতেন। তা আমার মধ্যেও ওই ধরনের একটা মতবাদ আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে এবং আমি অকপটে স্বীকার করব আজকে প্রগতিশীল যে-ভাবধারায় আমি জারিত হয়েছি, তার পেছনে আমিনুলের অবদান প্রায় একশ পার্সেন্ট।

সিদ্ধেশ্বরী থেকে সদরঘাট আসতাম। সারাদিন আর্ট স্কুলে কাজ করতাম। দুপুর বেলায় যখন পয়সা থাকত, তখন ওল্ড কোর্ট হাউসে একটা চায়ের দোকান ছিল। মোহান্ত নামে একটা লোক। তার ওখানে এক আনা দামের শিঙাড়া পাওয়া যেত। এক আনা দামের এক কাপ চা পাওয়া যেত, এক আনা দামের একটা সন্দেশ পাওয়া যেত। তিন আনা হলে একটা ভালো রকমের খাওয়া-দাওয়া হয়ে যেত। তিন আনা তো সবসময় থাকত না পকেটে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সচ্ছল অবস্থা ছিল রশিদ চৌধুরীর। আমরা মাঝেমধ্যে রশিদ চৌধুরীকে খুব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাম্প-টাম্প দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা আদায় করে নিতাম। সে-সময়ে এই তিন আনার ব্যাপারেও অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটত। সেটা হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে বগুড়ার একটি ছেলে পড়ত – আমিনুর নামে। সে গ্র্যাজুয়েট, বিএ পাশ করে আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। তো একদিন দেখি মোহান্ত একেবারেই কাঁচুমাচু হয়ে আবেদিন সাহেবের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। বললাম, ‘কী ব্যাপার?’ তা আবেদিন সাহেবের কাছে কী একটা নালিশ আছে। পরে শুনলাম, এই তিন আনার হিসেবে আমিনুর রহমান খেতে খেতে ৭৫ টাকা বাকি ফেলেছে আর কী! সে-টাকাটা কিছুতেই সে আদায় করতে পারছে না এবং সেজন্যে সে আবেদিন সাহেবের শরণাপন্ন। পরে আবেদিন সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার স্কলারশিপের টাকা থেকে ওটা আমি ওকে দিয়ে দেবো।’ এভাবে বোধহয় ফয়সালা হয়েছিল।

সে-সময়ে আমার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল মুর্তজা বশীরের। সে তখন বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত। পোস্টার লিখছে, পোস্টার রাত্রিবেলায় ঘুরে ঘুরে সে-ই সাঁটছে। একসময় সে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ল, জেলেও গেল। তার সঙ্গে আমার সখ্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একবার হলো কী – তার বোধহয় জ্বর হয়েছিল, দিন চার-পাঁচ সে আসে না। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার, আসছে না কেন?’ তারপর আমি তার বাসায় গেলাম, ঠিকানা আগেই জানা ছিল। সেই বেগমবাজারে গেলাম, গিয়ে দরজা নক করলাম। আমার তখন জানা ছিল না ওটা তার বাবা ড. শহীদুল্লাহ্র লাইব্রেরি। দুবার নক করার পর থার্ড টাইমে শহীদুল্লাহ্ সাহেবই দরজা খুলে দিলেন। আমি তখন খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘মুর্তজা বশীর আছে?’ উনি আমাকে একটু দেখলেন। দেখে বললেন, ‘এ-নামে   এ-বাড়িতে কেউ থাকে না।’ বলেই আমার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমি তো আরো নার্ভাস! তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। পরদিন দেখি বশীর গেছে। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার?’ তোর বাবার সঙ্গে দেখা হলো। জিজ্ঞেস করলাম বশীর কোথায়? বলল, এ-নামে কেউ থাকে না। বশীর হাসল। হেসে বলল – ‘আমার নাম আসলে মুহম্মদ মুর্তজা বশীরউল্লাহ। আমি নাম পালটেছি, বাবার এটা পছন্দ না। সুতরাং তিনি আমাকে ওই নামে স্বীকার করতে চান না।’ শহীদুল্লাহ্ সাহেবের সঙ্গে সেই আমার চাক্ষুষ প্রথম সাক্ষাৎ। এভাবেই আমাদের সবার সে-সময়কার সময়টা কেটে যাচ্ছিল।

আমরা দলবেঁধে স্কেচে বেরোতাম। আবার সারাদিন কলেজে থেকে ৪টার সময় ছুটি হতো। বেরিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে বসতাম। সেখানে ঘণ্টা তিন-চার এই স্কেচ করে তারপরে রাত্রিবেলা বাসায় একেবারে ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম। বাসায় ফিরলে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। আবার পরদিন সেই একই রুটিন। এর মধ্যে স্কেচে বৈচিত্র্য আনার জন্যে আমরা – আমি, রশিদ, রাজ্জাক, বশীর একবার ঠিক করলাম, না, আমরা অন্য জায়গায় যাব। তখন রশিদও সিদ্ধেশ্বরীতে থাকে। একবার রাত্রি প্রায় ৪টার সময় আমরা সেই পোর্টফোলিওতে কাগজপত্র নিয়ে বেরোলাম স্কেচ করতে রামপুরা দিয়ে। তখন তো রামপুরার এরকম চেহারা ছিল না। সেই একটা মেঠোপথ দিয়ে আমরা চললাম। ভোর হলো। এক জায়গায় বসলাম, কিছু কাজ করলাম আবার এগোলাম। সঙ্গে খাবার-দাবারও ছিল। আবার কিছুদূর গিয়ে আবার একটা স্পট দেখে বসলাম। বেলা ১০টার দিকে আমরা এক জায়গায় বসে কাজ করছি। এমন সময় একটা ছেলে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল – ‘আপনারা কী করেন?’ রশিদের সামনে আমি পাশে বসা। রশিদ একটু তাকিয়ে কী যেন একটা জবাব দিলো। ছেলেটি চলে গেল। খানিকক্ষণ পর একটা লোক এলো। সে চলে যাওয়ার পর রশিদ আমাকে বলল, ‘দেখেছিস ছেলেটা যে কথা বলে গেল?’ আমি বললাম যে, ‘না অতটা খেয়াল করিনি।’ ও আর কিছু বলল না। খানিকক্ষণ পর আরেকটা লোক গেল। সে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। তার একটি হাত নেই – সেটাও রশিদ লক্ষ করল। তার পর আরো কিছুক্ষণ পরে আরেকটি লোক গেল। রশিদ আমাকে ধাক্কা দিলো। বলল – ‘ওই দ্যাখ’। দেখি যে আরেকটা লোক যাচ্ছে তার একটা পা নেই। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, প্রথম  যে-ছেলেটা এসেছিল তার একটা কান ছিল না। তাড়াতাড়ি সব রং-টং প্যাকেট-ট্যাকেট গুটিয়ে বলল, ‘এখান থেকে চল, এটা ক্রিমিনাল এরিয়া। এখানে বসা যাবে না।’ সবাই তাড়াহুড়ো করে ছবি আঁকা বাদ দিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর সেই সারাদিন কাজ। কাজ করতে করতে এমন একটা জায়গায় এলাম যে আর কোথাও চিনি-টিনি না। কোথায় এলাম, এটা জিজ্ঞেস করতে হয়। তারপরে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা বাজার মতো মনে হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কোথায় এলাম?’ বলল, ‘এটা টঙ্গী।’ রামপুরা থেকে হেঁটে হেঁটে টঙ্গী। টঙ্গী যখন শুনলাম তখন ধরে নিলাম যে, আর হাঁটতে পারব না। তারপর সেই রাত্রি ৮টার ট্রেনে 888sport appয় ফেরত।

এভাবে আমরা দলবেঁধে ছবি আঁকতাম। একটা অদ্ভুত নেশা ছিল ছবি আঁকার এবং এই যে সে-সময়ে আমাদের চোখের সামনে আমাদের শিক্ষকদের ছবি ছাড়া অন্য কোনো ছবি দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। ছবির সাইজ কত হবে, কী হবে না হবে, এগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমাদের ম্যাক্সিমাম ছবি ওয়াটার কালার বলুন, স্কেচ বলুন, আমরা কোয়ার্টার শিটের ওপর আজকে যে ২০ x ৩০ সাইজের কাগজ, সেটার কোয়ার্টার সাইজ ১৫ x ১০-এর ওপরে আমরা আঁকতাম না। কারণ আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে, ছবি কত বড় হতে পারে! এ-ধরনের কাজ। আমি রশিদ চৌধুরীকে দেখেছি – সে ওয়াটার কালারে খুব দ্রুত কাজ করত। সবকিছুতেই একটা দ্রুততা। অবশ্য কামরুলভাইয়ের মতো দ্রুত নয়। কিন্তু ওয়াটার কালার করতে গিয়ে সে হয়তো কাগজে রং চাপাচ্ছে, ওয়াটার কালার প্যালেটে পানি দিয়ে রং গুলছে। অনেক সময় দেখতাম, একেবারে পুরো টিউবটা কাগজের ওপর ঢেলে টিউব থেকে রং বের করে কাগজের ওপরই সে রংটাকে স্প্রেড করার চেষ্টা করছে। নতুন একটা এফেক্ট তাতে আসত।

এভাবে আমরা কাজ করতাম। সে-সময়ে ততদিনে আমরা বোধহয় সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। সে-সময়ে খাজা শফিক আহমেদ, তিনি আমাদের কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। তিনি খুব ভালো ওয়াটার কালার করতেন। তাঁর ওয়াটার কালার আমরা খুব মজার সঙ্গে লক্ষ করতাম এবং তিনি আমাদের মাঝেমধ্যে স্টিল লাইফের ক্লাস নিতেন। এরকম একদিন একটা পারস্পেকটিভের ক্লাস আমাদের হয়েছে। আজ যে মীজানুর রহমানের পত্রিকা বলে একটি কাগজ বেরোয়, তার সম্পাদক মীজানুর রহমান – সেও আমাদের ক্লাসফ্রেন্ড। আমাদের পারস্পেকটিভ ক্লাস হচ্ছে, সেই কলাসে সাবজেক্ট দেওয়া হয়েছিল একটা ড্র্যাপারি, ড্র্যাপারির ওপরে কাঠের একটা ট্রায়াঙ্গল (ত্রিভুজ) এবং রাউন্ড একটা কাঠের বল এবং সেটা সিপিআই কালারে আমাদের করতে হবে। ওয়াশে করতে হবে, আমরা সিপিআই কালারে করছি। এমন সময় মীজানের কাজের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে একেবারে মেরুন কালার দিয়ে ওয়াশ দিচ্ছে। সফিউদ্দীন সাহেব ছিলেন সেদিন। উনি দেখে বললেন, ‘কী হে, তুমি এটা কী রং চাপাচ্ছ? এটা তো সিপিআই দিয়ে করার কথা।’ ও বলল যে, ‘সিপিআই-ই তো দিয়েছি।’। উনি বললেন, ‘না, তুমি তো দেখি রং চিনতেই পারো না।’ সেই থেকে সে কালার ব্লাইন্ড ছিল। সে তারপর পড়া ছেড়েই দিলো। আমাদের সঙ্গে আর রইল না।

আমাদের সে-সময়ে ক্লাসে আমরা এই যে সিদ্ধেশ্বরী থেকে সদরঘাটে যেতাম, মাঝেমধ্যে একটা সমস্যা ছিল রেলগেট। দেরি হলেই একটা কথা বলতাম – ‘স্যার রেলগেট পড়ে গিয়েছিল, প্রায় আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেল, আসতে পারলাম না।’ অন্য কোনো কলাস হলে আমাদের খুব একটা ভয় হতো না। কিন্তু সফিউদ্দীন সাহেবের ক্লাস হলেই ব্যস, হৃৎকম্প রীতিমতো।  আলী রেজা বলে আমাদের এক ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। একদিন এরকম সে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক লেট করে এলো। সফিউদ্দীন সাহেব ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, আর আলী রেজা ঢুকছে। ‘কী হে, তুমি ঢুকছ, না বের হচ্ছো?’ এ-ধরনের একটা রসিকতা সফিউদ্দীন সাহেব সবসময় করতেন। এই চায়নিজ ইঙ্ক দিয়ে একটা কাজে, একটা উডকাটের কাজ হচ্ছিল সফিউদ্দীন সাহেবের ক্লাসে। সফিউদ্দীন সাহেব তখন খুব ‘ওয়েল ড্রেসড পারসন’ এবং খুব ফিটফাট থাকতেন। সেই গ্রিনের প্যান্টে, সাদা টুইলের শার্ট, অক্সফোর্ড শু পায়ে দিয়ে তিনি কলেজে আসতেন। সবসময়ই যখনই আমাদের প্র্যাকটিক্যালি কিছু দেখাবার হতো, তিনি শার্টের বোতাম লাগিয়ে যেমন একজন সার্জন অপারেশন টেবিলে যেভাবে যায়, ওরকমভাবে এসে আমাদের দেখাতেন। আমাদের সঙ্গে আখতারুজ্জামান বলে একটা ছেলে ছিল, সে খুব চঞ্চলপ্রকৃতির ছিল। একদিন ওরকম কাঠের ওপরে কাজ করছে, কী করে জানি আখতারের হাত থেকে তুলিটা পড়ে গেল, আর এক ফোঁটা চায়নিজ ইঙ্ক এসে সফিউদ্দীন সাহেবের মাখন গ্রিনের প্যান্টে। তুলকালাম কান্ড লেগে গেল। কী হলো, কী হলো! মানে কী করে যাবে, কী করে যাবে। তখন কে যেন একজন বলল, ‘স্যার, এটা ছাগলের দুধ দিয়ে ধুয়ে দিলে উঠে যাবে।’ খোঁজো এখন ছাগলের দুধ। এরকম রসিকতা প্রায়ই হতো আর কি আমাদের সঙ্গে।

আমরা যেন একটা পরিবার ছিলাম। ছাত্র-শিক্ষক যদিও আমরা, একটা ডিসট্যান্স মেইনটেইন করতাম। কিন্তু স্যাররা সবসময় আমাদের তাঁদের সহজ-সরল বিহেভিয়ার দেখিয়ে কাছে টেনে নিতেন। একবার এরকম আরেকটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের স্টিললাইফ দেওয়া হয়েছিল প্রথম এবং সেই স্টিললাইফের সাবজেক্ট ছিল আপেল, কলা, আঙুর এবং নানারকম লোভনীয় ফল। প্রথম দিন ক্লাস হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন যখন ক্লাস করতে এসেছি, তখন দেখি ‘স্টিললাইফের’ সমস্ত জিনিপত্র উধাও – কিছু নেই! হইচই পড়ে গেল। কোথায় গেল, কোথায় গেল? কারা খেয়েছে? পাইকারি হারে সবাইকে বকাবকি। সবার পকেট থেকে পয়সা দিতে হবে। কে করেছে বলো। কেউ আর স্বীকার করে না। স্যাররাও ছেড়ে দিলেন। ঠিক আছে, প্রথম ক্লাস এরকম যাক। পরে সেদিনও আরেকটা ক্লাস দেওয়া হলো সেরকম। কাঠের ঘোড়া, ঘোড়ার সঙ্গে কাঠের একটা প্লেট। তখন একটা পুতুল পাওয়া যেত – তিনমাথার বুড়ো, তার হাতে একটা হুঁকো থাকত। একটু ঝাঁকালে মাথাটা নাড়ত সে-পুতুলটা – এই দিয়ে ‘স্টিললাইফ’ সাজিয়ে দিলো। দিলেন আনোয়ার সাহেব। বললেন, ‘বোঝো, এখন খাও।’ সেদিন আবার ক্লাস হলো। পরদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি সবই ঠিক আছে কিন্তু বুড়ো পুতুল – তাকে সুতোয় ঝোলানো, কাত হয়ে আছে, ওপরে ঝুলছে। সবার মুখেই তো হাসি, কী ব্যাপার কী ব্যাপার! কে করল, কে করল? আবার সেই আনোয়ার সাহেব দৌড়ে এলেন। আবেদিন সাহেবকে খবর দিলেন। আবেদিন সাহেব ঢুকলেন। ঢুকে একটা দমফাটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, ‘না, ওদের আবার ফলমূল এনে দেন।’ আবার ফলমূল আনা হলো। এভাবে আমরা বেশ মজা করে ক্লাস করতাম। এর মধ্যে লিটন হলে (888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার শহীদুল্লাহ্ হল) প্রথম প্রদর্শনী হবে। এটা আপনারা সবাই দেখেছেন। আমিনুল ইসলাম সংবাদে এ-সময়কার ঘটনা এবং             সে-সময়কার লিটন হলের এক্সিবিশনের যে ব্রোশিওর, তার কভারের ছবি-টবি ছেপেছেন। এটা আমারও মনে ছিল না – ভুলেই গেছিলাম। সেই এক্সিবিশনে ছবি বিক্রিও হয়েছিল। আমার একটি ছবি বিক্রিও হয়েছিল। একটা ওয়াটার কালার ‘জিঞ্জিরাতে দুপুরবেলায় দুটো নৌকো বাঁধা’ ছবিটা কিনেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। খুব inspired হয়েছিলাম। ভালো ছবি হলে তো বিক্রিই হয়। এই ওয়াটার কালার করার একটা উৎসাহ তখন জেগেছিল। কামরুলভাই আমাদের ওয়াটার কালার দেখাতেন। কামরুলভাই খুব দ্রুত ওয়াটার কালার করতেন এবং কাজ কমপ্লিট করে বলতেন, ‘দ্যাখো কেমন ফসাফস এঁকে ফেললাম।’ তাঁর মুখে এই ‘ফসাফস’ শব্দটা দিয়ে তিনি নিজের স্পিডটাকে বোঝাতেন। তাঁর ওয়াটার কালার – তিনি শেষদিন পর্যন্ত ওয়াটার কালার মাধ্যমটাকে বোধহয় বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর কাজের বহু মাত্রা, নানান ধরনের ওয়াটার কালারের এক্সপেরিমেন্ট তিনি করেছিলেন।

সে-সময়ে অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ, কাজের সন্ধানে আছি। একদিন আমিনুল এক ভদ্রলোককে নিয়ে এলেন। বললেন, ‘একটা কভার করে দ্যান, কিশোরগঞ্জ থেকে একটা কাগজ বেরোবে প্রতিভা নাম। বাচ্চাদের-কিশোরদের কাগজ। ওটার কভারটা করে দিতে হবে।’ আমিনুলই প্রথম নিয়ে এলেন। আমি কভারটা করলাম। কভার করার পর বোধহয় পনেরো টাকা পেয়েছিলাম। খুব ভালো লাগলো আর কী। রং-টং কী কী কেনার সব কিনলাম, সবচেয়ে মজার কথা – এই মাস  সাত-আট আগে আমি ইউনিভার্সিটির পাবলিক রিলেশন্স ডিপার্টমেন্টের পিআরওর টেবিলে বসে আছি। ওনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। তিনি আমাকে প্রথমে ঢুকতেই বললেন, ‘কী কাইয়ুম সাহেব, কী খবর-টবর, কেমন আছেন?’ সম্বোধন করলেন, ‘কলেজের খবর কী?’ আমি উঠে আসছি, সামনে বসা ছিলেন এক ভদ্রলোক তিনি হঠাৎ উঠে এলেন। উঠে এসে বললেন, ‘আপনি আমাকে চিনতে পরবেন না কিন্তু আপনার নাম শুনে আমি আপনাকে চিনতে পারলাম। আপনার মনে আছে কি-না জানি না, বহু আগে আপনি তখন স্কুলের ছাত্র, প্রতিভা নামে একটা কাগজ করেছিলেন। কিশোরগঞ্জ থেকে বেরোত, আমি তার সম্পাদক।’ সে যে কী অবস্থা! আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম, তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কেউ কাউকে চিনি না কিন্তু নামে মনে আছে, কাগজের কথা মনে আছে। এই যে ঘটনা ঘটে এগুলো মনের ওপর বেশ বিরাট একটা ছাপ ফেলে দেয়। সেই কমার্শিয়াল কাজ শুরু। তারপরে ওয়ার্সী বুক সেন্টারের আবদুল বারী ওয়ার্সী তখন ছিলেন মালিক। তিনি তখন পাবলিকেশন্স করছেন। আমিনুল দু-তিনটি কভার করেছেন সে-সময়ে। আমাকেও ওর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন, ‘কভার করেন।’ তখন আলাউদ্দিন আল আজাদের বই বেরিয়েছে – আমিনুলেরই করা কভার। তখন তো ব্লক ফর্ম ছিল না। কাঠে খোদাই করে আমিনুলই বোধহয় করেন। আমিনুল এখানে আছেন। তিনি বলতে পারবেন। কাঠখোদাই করে কভারটা করেছিলেন এবং ওটা ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল, সেই কমার্শিয়াল কাজের মধ্যে ঢুকে গেলাম। সেই যে ঢুকলাম, এখনো আছি। আর বেরুতে পারলাম না ওখান থেকে। দুটোই সমানতালে চলছে আর কী।

আমাদের সে-সময়ে ’৪৯ সালে বোধহয় প্রথম ছেলেরা এক্সকারশনে গিয়েছিল। মধুপুরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীদের বাড়ি। ময়মনসিংহের মধুপুর। আর্ট কলেজে আবেদিন সাহেব থাকতে আর্ট এক্সকারশনটা ঠিক কলেজের এক্সকারশন হতো না। এটা হতো সে-সময়কার 888sport appর সব প্রখ্যাত লোকজনের একটা সমাবেশ। যেমন মধুপুরে আমরা গিয়েছিলাম, 888sport app থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন। গায়ক আবদুল আলীম ছিলেন। আবদুল আলীম তখন জসীম উদ্দীনের কাছে গান শিখতেন। জসীম উদ্দীন সাহেবও গুনগুন করে গান গাইতেন, আবদুল আলীম তাঁর কণ্ঠে সেগুলো তুলে নেন। আমরা গিয়েছিলাম মধুপুর। মধুপুর গিয়ে অবশ্য আমরা ছবি আঁকার সুযোগ পাইনি। কারণ আমরা বৃষ্টির পাল্লায় পড়েছিলাম। তিনদিন ধরে বৃষ্টি এবং সেই বৃষ্টির মধ্যে সবাই মিলে তুমুল আড্ডা চলছে। সে-সময়ে আমরা দেখেছিলাম আবেদিন সাহেব, সফিউদ্দীন সাহেবকে এবং তাঁদের একটা অন্যরকম ভূমিকায়। যেমন সফিউদ্দীন সাহেব তখন সিগারেট খেতেন কিনা, আমার মনে নেই। কিন্তু তাঁকে আমি সেখানে হুঁকো খেতে দেখেছি। সিগারেট তো পাওয়া যাবে না তিন দিন। মধুপুরে কোথায় পাওয়া যাবে। তিনি বেশ হুঁকো টানছেন।

তারপরে আমিনুল, হামিদ তারা আবার একট গ্রুপ করে আছেন। আমরা রশিদ চৌধুরী, রাজ্জাক, হুমায়ুন এঁরা বসে আছি। হঠাৎ জসীম উদ্দীন সাহেব প্রস্তাব দিলেন ‘অ্যাই, বসে থেকে কী হবে চলো কবিগান হোক।’ ঠিক আছে কবিগান হোক। একদিকে কবিয়াল হলেন জসীম উদ্দীন সাহেব নিজে, আরেকদিকে কবিয়াল রশিদ চৌধুরী। তাঁর আবার গ্রামের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল এবং তাঁর এই যে folk based কাজে তা বেশ বোঝা যায়। এই কবিগানের ধুয়া-টুয়া তাঁর অনেক মুখস্থ ছিল আর কী। আমরা কবিগান গাইতে লেগে গেলাম। আমরা রশিদের সাগরেদ আর জসীম উদ্দীন সাহেবের সাগরেদ অন্যরা। গান গাইতে গাইতে জসীম উদ্দীন খুব নাচানাচি শুরু করে দিলেন। তারপরে শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি। আমরা তো অবাক! বাপরে, কবি এভাবে এরকম করছে – মানে খুব লাইফফুল হয়ে গেলেন। এক্কেবারে উত্তেজিত হয়ে গেলেন। আবেদিন সাহেব মাঝেমধ্যে বলছেন, ‘খবরদার, এই কবির, পল্লিকবির যাতে কোনো অপমান না হয়।’ তিনিই যখন ধাক্কাধাক্কি শুরু করলেন, আর আমাদের রোখে কে? ব্যস শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি, জসীম উদ্দীন সাহেবকে ফ্ল্যাট করে মাটিতে ফেলে দিলাম। আর জয়নুল আবেদিন সাহেব তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে কবিকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। তখন এরকম খুব মজা হতো।

এরপরে আরেকবার আমরা বোধহয় গিয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জে এক্সকারশনে। সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন প্রফেসর অজিত গুহ। তৎকালীন 888sport appর ডিসি ছিলেন সাবের করিম রেজা। তাঁর একটি লঞ্চ ছিল, সে-লঞ্চে তো সবার জায়গা হয় না। আমরা নৌকোতেই গিয়েছিলাম। যারা অভ্যাগত নিমন্ত্রিত ছিলেন, তারা লঞ্চে করে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রফেসর অজিত গুহ, সাবের করিম রেজা, শামসুদ্দিন আবুল কালাম এবং আরো অনেকে ছিলেন। আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীনও বোধহয় ছিলেন। এই যে সবাইকে, প্রখ্যাত লোকদের, কবি, লেখক এবং 888sport app প্রফেশনাল লোকদের একত্রিত করা এবং আমাদেরকে সেই সমস্ত লোকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দেওয়া – এটা আবেদিন সাহেব কিন্তু বরাবর করেছিলেন এবং এতে একটা জিনিস হতো, আমরা এসব লোককে কাছ থেকে দেখার যে-সুযোগ পেতাম এবং তাঁদের সম্পর্কে একটা ধারণা, তাদের কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা, এটা আমাদের পরবর্তী জীবনে বিরাট কাজে লেগেছিল এবং এ-সুযোগটা আবেদিন সাহেব সমসময় করতেন, এমনকি আর্ট কলেজে কোনো প্রদর্শনীতে সে-সময়ে প্রদর্শনী চলছে তার সঙ্গে একটা কালচারাল ইভেন্ট – মমতাজ আলী খান এসে আমাদের গান শোনাচ্ছেন, অনেক সময় কানাইলাল শীল এসে দোতারা বাজাচ্ছেন, আবদুল আলীম তো আছেনই। এমনকি সে-সময়ে আমার মনে আছে, ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসের একজন অফিসার এসেছিলেন। নাম ছিল তাঁর ক্লদ কলভিন। তিনি ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’ গাইতেন খুব ভালো। একদিন আবেদিন সাহেব তাঁকে কলেজে ডেকে নিয়ে এলেন। এটা তিনি করলেন ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’ সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্যে।

শুধু ছবি আঁকলেই তো 888sport live chatী হয় না। সে তো ইলাস্ট্রেটর হতে পারে, নাও হতে পারে। এই যে  ইন্টারঅ্যাকশন করার চেষ্টা আবেদিন সাহেবের – এটা ওনার সবসময় ছিল এবং আমরা বেশ সুযোগ পেয়েছি এই ধরনের প্রখ্যাত লোকদের সান্নিধ্যে আসার। সে-সময়ে এই আর্ট কলেজের বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও আমার অনেক পরিচিতজন ছিল। আমি ১৯৫৪ সালে পাশ করে বেরিয়ে গেলাম। তখন কোনো চাকরি-বাকরি নেই। বাইরে চাকরি করছি একটা ব্লক ফার্মে – ডিজাইনারের কাজ। সেখানে একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় হলো, সিনেমা নামক একটা কাগজ ছিল live chat 888sportের, তার এডিটর ফজলুল হকের। তাঁর স্ত্রী ছিলেন, তখন স্ত্রী হননি অবশ্য, আমার সঙ্গে আলাপের পরে উনি এসে আমাকে ব্লক ফার্মে দেখে বললেন, ‘কাগজে কাজ করবে নাকি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ করব।’ ‘ঠিক আছে আমার সিনেমা কাগজে কাজ করো।’ ব্যস, জুটে গেলাম সিনেমা কাগজের সঙ্গে। এমনিই আমার সিনেমা দেখার বাতিক ছিল। আমি সে-সময়ে আর্ট কলেজের বাইরে ম্যাক্সিমাম সময় কাটিয়েছি বোধহয় সিনেমাহলে। সিনেমার কাজ করতে গিয়ে সে-সময়ে আলাপ হলো কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে, শামসুদ্দীন আবুল কালামের সঙ্গে, আফজাল চৌধুরীর সঙ্গে, তারপরে আরো অনেকের সঙ্গে। এই কাজের সুবাদে একদিন জহির রায়হানের সঙ্গে আলাপ হলো। সৈয়দ শামসুল হক এবং ফজলে লোহানীর সঙ্গে আলাপ হলো। ফজলে লোহানী তখন অগত্যা বলে একটা কাগজ বার করতেন। আমাদের খুব আকৃষ্ট করেছিল কাগজটার একটা বিদ্রূপাত্মক এক্সপ্রেশন এবং তার একটা বিদ্রোহী ভূমিকা। সে-সময়ে অগত্যা পত্রিকায় ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করতেন কামরুলভাই। আমার মনে আছে, তার একটা হেডপিস ‘আদ্যোপান্ত’ বলে একটা হেডপিস – একটা চটি জুতো ছুড়ে মারা হচ্ছে – এই হেডপিসের বিষয়বস্ত্ত। একটা কভার করেছিলেন আবেদিন সাহেব – 888sport app সিটির রাস্তার দৃশ্য এবং এটা আবেদিন সাহেবের ড্রয়িং এবং লেটারিংটা করে দিয়েছিলেন কামরুলভাই। এ-ধরনের কাজ দেখতে দেখতে কমার্শিয়াল নানান রকম অ্যাসপেক্ট আমার চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হলো। কামরুলভাই সে-সময়ে ভিতরবাড়ি লেনে থাকতেন। তাঁর একটা পাবলিসিটি ফার্ম ছিল। দৈনিক সংবাদে ইলাস্ট্রেশন করতেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করত আমাদের সে-সময়কার বিজন চৌধুরী, আবদুস সবুর এঁরা। মাঝে মাঝে ভিতরবাড়ি লেনে যেতাম। তাঁরা কাজ করছেন, এটা দেখতাম। আমারও খুব ইচ্ছে হতো কাজ করার জন্যে আর কী। কামরুলভাই মাঝেমধ্যে আমাকে দিয়েও কিছু কাজ করিয়েছেন। পত্রিকাজগতে আমিও ঢুকে পড়লাম। আমি প্রথম 888sport appয় কাজ করি ইত্তেহাদে। তখন হাবীবভাই ছিলেন ইত্তেহাদের 888sport live football-সম্পাদক। সে-সময়ে কাগজটি  বেরোত শ্রীশ দাস লেন থেকে। আমার মনে আছে, একটা Folk Art Exhibition, তখন সেগুনবাগিচা স্কুলে প্রদর্শনীটা হচ্ছে। একটা বন্যা হয়েছিল সে-সময়ে। আমারও সেখানে কাজ করার কথা ছিল। আবেদিন সাহেব বলে দিয়েছিলেন, এক্সিবিশনের জন্যে কাজটা করবে। আমি তখন ওই অর্থনৈতিক তাগিদেই সেই কাজে ফাঁকি দিয়ে ইত্তেহাদের ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতে লেগে গেলাম।

তারপর ইত্তেহাদ বের হলো। যেদিন বেরোল, তার পরদিনই বোধহয় আমি আর্ট স্কুলে গিয়েছি। দেখি আবেদিন সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। আমাকে দেখে একেবারে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছেন। কাছে ডাকলেন। ‘কোথায় ছিলে এ্যাদ্দিন?’ আমি বললাম, ‘স্যার একটু কাজ ছিল, ওই কাজে…’ ‘এদিকে যে এক্সিবিশনটা হচ্ছে এটা দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘না দেখিনি, দেখব।’ আমাকে বললেন, ‘চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’ আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা প্লেটের ওপর ট্রেসিং পেপারের মতো গোল গোল কিছু জিনিস। আমি তো একটু অবাক, ‘এটা কী? আমি তো স্যার বুঝতে পারছি না।’ বললেন, ‘এগুলো কোথাকার জিনিস জানো? এগুলো নোয়াখালি থেকে এসেছে। তোমার বাড়ি কোথায়?’ আমি বললাম ‘নোয়াখালি, স্যার।’ ‘নিজের দেশের জিনিসটাও নিজে চিনতে পারো না!’ তারপর বললেন, ‘এটা সুপারি।’ ‘সুপারি!’ ‘হ্যাঁ সুপারি, নোয়াখালির এক গ্রামের মহিলা সুপারি কেটেছে কীভাবে দ্যাখো। একদম ট্রেসিং পেপার।’ অবাক ব্যাপার! তারপর লোক888sport live chatের 888sport app জিনিস দেখলাম এবং এই যে লোক888sport live chatের প্রতি, আমাদের যে-ঐতিহ্য, এটাকে চেনাবার জন্যে আবেদিন সাহেবের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না এবং সবকিছু ওনার নিজের বাড়িতেও দেখেছি। পুতুলের একটা বিরাট সংগ্রহ ছিল, ক্র্যাফটসের একটা সংগ্রহ ছিল। তিনি প্রায়ই দেখাতেন কীভাবে এগুলো তৈরি হয়ে এসেছে এবং মাঝে মাঝে বলতেন কীভাবে এগুলো অন্যভাবে ব্যবহার করা যায়।

আমি তখন পাকিস্তান অবজারভারে চাকরি করি। সে-সময়ে Sunday Observer-এ ইলাস্ট্রেশন করতাম। আমি তখন থাকি শান্তিনগরে, আবেদিন সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। তখন রোববার ছুটি ছিল। ছুটির দিনে আবেদিন সাহেবের বাসায় চলে যেতাম। রকে বসে দেখতাম, আবেদিন সাহেব বসে আছেন। সেখানে বসে আড্ডা হতো খুব। একদিন এরকম গেছি। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে অবজারভারে ইলাস্ট্রেশনগুলো বেরোয়, ওগুলো কার করা?’ আমি বললাম, ‘স্যার আমি তো করি।’ আমি তখন একটা নৌকোর ফর্ম করতাম। একটা নৌকো সিলেট অঞ্চলে দেখেছিলাম। ওই নৌকোর ফর্মটাকে একটু ভেঙে আমি ব্যবহার করতাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই নৌকোর ডিজাইনটা কার?’ ‘স্যার, আমার।’ ‘এই যে নৌকোর চোখটা, এটা কি তুমি দেখে করেছ?’ ‘হ্যাঁ স্যার, সিলেট অঞ্চলে আছে এরকম।’ ‘তুমি এরকম ইলাস্ট্রেশন করো?’ আমি তখন সেহেতু চাকরি করছি বাইরে ছবি আঁকাটা একটু কমে গিয়েছিল। আঁকতাম না ঠিক। উনি আমাকে বলছেন, ‘এই যে নৌকোটা আঁকলে তুমি, এটাকে এই নৌকো দিয়ে পেইন্টিং করতে পারো না তুমি?’ ‘আমি স্যার এতটা চিন্তা করিনি।’ ‘এই যে নৌকোটা, একটা নৌকো, একটা চোখ, একটা ঘাটে চারটে নৌকো, চারটে চোখ, অনেকগুলো নৌকো অনেকগুলো চোখ। একটা একটা কম্পোজিশন করে এরকম।’ ওনার ভঙ্গি, হাত নাড়া দেখে আমি খুব অনুপ্রাণিত হলাম। আমার গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেল। তাই তো, এটা তো কখনো চিন্তা করিনি। তারপর ফিরে এসে শুরু করলাম ছবি আঁকা। আবার ছবি আঁকার মধ্যে ফিরে এলাম।

উনি ভীষণ রকম অনুপ্রাণিত করতে পারতেন। আমরা তাঁকে যেমন দেখেছি, ভীষণ রকম উৎসাহ পেতাম। কারণ উনি সবসময়ই ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতেন এবং যখনই কাছে গিয়েছি শুধু ছবি আঁকার গল্প। সেই থেকে আজকে যে-পর্যায়ে আমরা এখানে এসে দাঁড়িয়েছি চিত্রকলার পঞ্চাশ বছরে, এই দাঁড়ানোর পেছনে আমাদের শিক্ষকদের যে আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল, সেটা সর্বক্ষণই আমার কাছে মনে হয় যে, তাদের এ-চেষ্টা না থাকলে আমরা হয়তো এখানে এসে দাঁড়াতে পারতাম না।

পঞ্চাশ বছরে নানান উত্থান-পতন ঘটেছে। আমার জীবনেও ঘটেছে। নানান ধরনের কাজ করেছি। যখন চাকরি ছিল, না আমি ফিল্মেও গিয়েছিলাম ডিরেকশন দেওয়ার জন্যে। কিন্তু এটমস্ফিয়ার দেখে টিকতে পারিনি। পরে জহিরের সঙ্গে তাঁর অনেক ছবির পাবলিসিটি ম্যাটেরিয়ালস আমি করেছি। তাঁর বেহুলা – তারপরে আরো কিছু কিছু ছবি আমারই করা পোস্টার, সেইসঙ্গে সেই সময়কার ফিল্মের যারা সবচেয়ে ম্যাগনেট ছিলেন আনিস – ‘দোসানি ফিল্মস করপোরেশন’ তাদের হয়েও আমি অনেক কাজ করেছি। আমার সঙ্গে আরো অনেক সহকর্মী ছিল, তাদের নিয়ে।

কাজের নানান ধরন, নানান রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আজকে এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি যখন আর্ট কলেজে চাকরি করি, কিবরিয়া সাহেব ১৯৫৭ সালে জাপান চলে যান। সে-সময়ে কিবরিয়া সাহেবের পোস্টে আমি চাকরি নিই। কিন্তু সেই চাকরি আমি বেশিদিন করতে পারিনি। কারণ সে-সময়ে স্মল কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ ডিজাইন সেন্টার বলে একটা বাটার অরগানাইজেশন তৈরি হয়েছিল, যেটার সঙ্গে আবেদিন সাহেবও যুক্ত হয়েছিলেন। পরে কী কারণে হয়তো ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে, আবেদিন সাহেব চাইতেন যে ডিজাইন সেন্টারটাও আর্ট কলেজের সঙ্গে যুক্ত থাক। কামরুল সাহেব সেটা চাইতেন না। তিনি এটাকে স্মল কটেজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন এবং নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের কয়েকজনকেও টেনে নিয়ে গেলেন। আমি আর্ট কলেজের চাকরিতে রিজাইন দিয়ে ডিজাইন সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। কিন্তু সেখানে আমি বেশিদিন চাকরি করতে পারিনি। কিছুদিন পরেই একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত কারণে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দিয়ে আবার বেকার। আবার সেই অ্যাডভারটাইজিং ফার্ম এবং পাবলিকেশন্সের সঙ্গে যুক্ত হলাম।

সে-সময়ে ১৯৬৫ সালে আবার কী করে যেন আর্ট কলেজে একটা সুযোগ হলো এবং ১৯৬৫-তে আর্ট কলেজে ঢুকি। সেই থেকে এই আর্ট কলেজের সঙ্গে যুক্ত আছি। যেটা বলছিলাম যে, 888sport live chatী তৈরি করার চেষ্টা আবেদিন সাহেবের ছিল। বহুমুখী যে-চেষ্টা কামরুলভাই, আবেদিনভাই, সফিউদ্দীন সাহেব করেছেন – তখন হয়তো এতটা গুরুত্বের সঙ্গে জিনিসটা আমরা বুঝতে পারিনি যে, কী চেষ্টা তাঁরা করছেন। আজকে এই এতদূর জীবনের প্রান্তে এসে মনে করি যে, সেই সুযোগগুলো যদি আমরা পুরো মাত্রায় গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে হয়তো আরো অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম।

অনেকক্ষণ তো বললাম। একটা জিনিস আমার বলার ইচ্ছে। সেটা হচ্ছে যে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৮ সাল। এই যে সময়ের ব্যাপ্তি – এই ব্যাপ্তিতে আমাদের চিত্র888sport live chatীরা যেমন ছবি এঁকেছেন, দেশ সম্পর্কে ভেবেছেন, দেশের ক্রান্তিকালে সবসময় শ্রম দিয়েছেন এবং ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এই যে 888sport live chatীদের এই ভূমিকা সেদিন আমিনুল ইসলাম সাহেব ওপেনিংয়ে বলেছিলেন, একাত্তরে যে স্বাধীনতাযুদ্ধ হলো, সেই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নয় মাস 888sport app সব জায়গা থেকে রাজাকার তৈরি হয়েছে কিন্তু 888sport live chatীদের মধ্য থেকে কোনো রাজাকার তৈরি হয়নি। এটা কিন্তু আমাদের প্রাপ্তি – এটা তো বলে বোঝানো যাবে না। কথাটা এক মুহূর্তে বলা যায়, কিন্তু এর যে ব্যাপ্তি এটা যে কত, আর্টিস্টরা আর যা-ই হোক, দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কখনো করেননি।

এই যে দেশের প্রতি ভালোবাসা, এ-দেশটা যে কী – এটা চেনার তো চেষ্টা ছিল আমাদের প্রথম দিককার শিক্ষকদের। আবেদিন সাহেবের এই যে লোকজ 888sport live chat নিয়ে চিন্তাভাবনা, এই যে লোকজ 888sport live chatকে চোখের সামনে নিয়ে আসা। আমাদের ট্র্যাডিশনটাকে সামনে রাখা। আমার একটা জিনিস খুব মনে আছে, তখন খুব প্রেশার চলছিল পাকিস্তান থেকে – এখানকার চিত্র888sport live chat কী হবে, কী ধরনের রূপ নেবে? সালটা ঠিক মনে নেই। তখন একটা প্রদর্শনী চলছিল। আবেদিন সাহেব সেই প্রদর্শনীর প্রথম তোরণটা করেছিলেন – আমাদের এই ছনের আটচালা ঘরের কোণ নিয়ে। তারপরে ভেতরে হাতের ডানদিকে যে-স্পেসটা ছিল সেখানে একটা ক্র্যাফট শপ করেছিলেন যেখানে মাটির হাতে টেপা পুতুল এবং 888sport app ক্র্যাফটস সামগ্রী পাওয়া যেত এবং প্রথমদিন ওপেনিংয়ে তিনি ময়মনিসংহ থেকে নকশিপিঠা আনিয়েছিলেন অতিথিদের ভেজে খাওয়াবার জন্যে। এই যে চেষ্টাটা সেরকম একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে খালি বুঝিয়ে দেওয়া যে, এই ঐতিহ্য যাদের আছে, তাদেরকে তাদের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। এটা শুধু একেবারে তিনি কোনো কথা না বলে শুধু ওনার কর্মকান্ড দিয়ে এসব জিনিসকে জড়ো করে উনি বুঝিয়ে দিলেন এবং সত্যিই তাই এবং যারা এই প্রদর্শনী দেখেছে তারাও এক বাক্যে স্বীকার করেছে যে, হ্যাঁ, এই ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা যায় না এবং সেখানে বিদেশিরাও কিছু ছিলেন। তারা যখন আমরা নকশিপিঠা খাচ্ছি, ওই যে … গোলাম হোসেন বলছিলেন, ‘ইউ আর ক্রিমিনাল, তোমরা এমন একটা সুন্দর জিনিস খেয়ে ফেলছ, এটা কি!’ এই ধরনের অনেক ঘটনা           সে-সময়ে ঘটেছিল এবং খুব সোচ্চার না হয়েও আবেদিন সাহেব এসব জিনিস প্রতিবাদ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন – এগুলো কিন্তু মনে রাখার মতো।

আজ পঞ্চাশ বছরে 888sport app আর্ট কলেজে শুধু নয়, চট্টগ্রামে একটা ডিপার্টমেন্ট, একটা কলেজ, রাজশাহীতে একটা কলেজ, খুলনায় এই যে ছড়িয়ে যাওয়া এটার প্রয়োজন, আমরা তো মনে করি 888sport appয় আরেকটি আর্ট কলেজ চালু হতে পারে। তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, প্রয়োজনও আছে। এই যে সর্বসাধারণের মধ্যে চারুকলা চর্চার যে-চেষ্টা এর ফলটা কী, এর রুচিতে এর যে পরিবর্তন এটার একটা ইতিবাচক প্রভাব গত পঞ্চাশ বছরে আর্ট কলেজের দান বলে আমি মনে করি। সেদিন মিৎসুবিশি এশীয় চিত্রকলা উৎসবে আমি জুরি কমিটির মেম্বার ছিলাম। আমি দেখেছি 888sport appsের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেই কোথায় কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, এদিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী এসব জায়গা থেকে বাচ্চারা ছবি এঁকে পাঠিয়েছে এবং বাচ্চাদের পিতামাতারা কতটা উদ্বুদ্ধ হলে এ-ধরনের ছবি 888sport appsের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসতে পারে ­- এটা ভেবে আমি খুব শিহরিত হয়েছিলাম এবং সেখানে দেখেছি যেমন, কুষ্টিয়া থেকে যে-ছেলেটি প্রাইজ পেয়েছে, এবার শুধু 888sport app, চট্টগ্রাম নয়, 888sport appsের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও প্রাইজ পাওয়া শিশুদের আমি দেখেছি এবং এই যে প্রাপ্তিটা এটা কিন্তু আর্ট কলেজের 888sport live chatীদের দান এবং সেখানে কুষ্টিয়া থেকে যে-ছেলেটি প্রাইজ পেয়েছে তাকে আমি বললাম, ‘তুমি ছবি আঁকা শিখলে কোত্থেকে?’ তখন একটি ছেলে বলল, ‘স্যার, আমি কুষ্টিয়ার একটি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করি। কিন্তু আমি একটা স্কুল করেছি ওখানে।’ আমি বললাম, ‘বাহ্ তুমি স্কুল করেছ, তোমার স্কুলের ছেলে তো প্রাইজ পেয়ে গেছে।’ বলল, ‘হ্যাঁ, পেয়েছে।’ এই যে একটা ব্যাপ্তি, এটাও তো আর্ট কলেজের দান। আমি মনে করি, পঞ্চাশ বছরে আমরা অনেক পেয়েছি, আগামী শতবর্ষে হয়তো দেখব আর্ট কলেজের ছেলেরাই সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাদের ভূমিকা রাখছেন এবং সেই রাখার যে-চেষ্টা সেটা আমি এখন দেখতে পাচ্ছি।

 

প্রশ্ন : আপনার ব্যাপক সময় গেছে বুক ডিজাইনের কাজে। এ-ব্যাপারে আপনি কিছু বলুন।

কাইয়ুম চৌধুরী : প্রথমদিকে তো কোনো পাবলিশার ছিল না। পাঠ্যবই বেরোত। সে-সময়ে পাঠ্যবইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতেন কামরুলভাই এবং ওনার কাজের চাপও ছিল খুব, আমাদের স্কুলে কাজ নিয়ে আসতেন এবং কাজ বুঝিয়ে দিয়ে উনি ওনার টেবিলে কাজগুলো করতেন। আমরা উৎসুক হয়ে দেখতাম। আমি তো কমার্শিয়ালের ছাত্র ছিলাম না। আমি ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু কামরুলভাইয়ের কাজ দেখে তিনি কীভাবে সেটস্কয়ার ফেলছেন, কীভাবে লাইনিং পেনটা টানছেন এগুলো আমি খুব উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ করতাম এবং কামরুলভাইয়ের কাজ দেখেই আমি কিন্তু কাজ শিখেছি। ওই সময়ে যে-পাবলিশার, যেমন আমরা পাবলিশার পেয়েছি পাঠ্যবইয়ের এবং ইলাস্ট্রেশন করা হতো, এক-একটা ইলাস্ট্রেশন রেট করা ছিল – পাঁচ টাকা। এরকম হয়তো ইলাস্ট্রেশন করেছি, দশটা ইলাস্ট্রেশন কি পাঁচটা ইলাস্ট্রেশন, সেই পাঁচ টাকা পাওয়া সহজ ছিল না। হয়তো একদিন গেলাম ওই টাকাটা একটু নিতে হয়। পকেট থেকে আট আনা বের করে দিত – ‘আজকে এই নিয়ে যান, পরে বাকিটা হবে।’ আট আনাতেই সন্তুষ্ট, পাওয়া তো গেল। তারপর কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খেয়েটেয়ে আবার দুদিন পর গেলাম ‘টাকাটা’? অর্ধেক টাকা পেতাম, আবার পেতাম না। এভাবেই কাজ শুরু হলো আর কী।  সে-সময়ে প্রথম কাজ আমি মনে করি  ওয়ার্সী বুক সেন্টারে। তারপর আরো ধীরে ধীরে আরো যে পাবলিশার এলেন … সে-সময় কবি আহসান হাবীবের একটা পাবলিকেশন ছিল ‘কথা বিতান’ নামে, সেখানে তখন একটা বই বেরোনোর কথা। সদ্যপ্রয়াত জহুরুল হক সাহেব যিনি হামিদের ভগ্নিপতি ছিলেন, তিনি আমেরিকা থেকে ফেরত এসেছিলেন। তিনি একটা বই লিখেছিলেন আমেরিকা 888sport slot gameের ওপর। বইটির নাম ছিল সাতসাঁতার। আমি  সে-বইটির কভার করেছিলাম এবং উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি দুটো সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ দেখাবার চেষ্টা করেছি। তুমি যদি এর ওপর একটা কভার করতে পারো।’ আমি মোজাইকের মতন একটা কাজ করেছিলাম দুটো সংস্কৃতির মিলন বোঝাবার জন্যে। বইটা যখন বেরোল সে-বইটা আবেদিন সাহেবকে দেখাবার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। সে-সময়ে  শামসুদ্দীন আবুল কালামের একটা বই কাশবনের কন্যা  বেরোচ্ছিল ওসমানিয়া বুক ডিপো থেকে। আবেদিন সাহেব ওই বইয়ের ইলাস্ট্রেশন এবং কভার করছিলেন। কালামভাই টেবিলে ওই বইটা দেখে হঠাৎ বললেন, ‘এই বই কোত্থেকে বেরোয়? কলকাতা থেকে এসেছে নাকি?’ তখন আবেদিন সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ আপনি তো বলেন এখানে কভার হয় না। এই দ্যাখেন, এই কভার দ্যাখেন। কে করেছে?’ তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কালামভাইয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ ওখানেই। উনি আমাকে ওসমানী বুক ডিপোতে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে আবার আমার কিছু কাজের সংস্থান হলো।

এই যে বইয়ের কভার, বই যা-ই হোক, কনটেন্ট যাই থাকুক কভারটা একটু ভালো হওয়া চাই। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। কভারটা ভালো হলেই বইটা চলবে। একটা সময় ছিল, যখন একটা বইয়ের কভার করতে হলে আমাকে চার-পাঁচটা ইলাস্ট্রেশন করতে হতো। সে এক মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। পয়সা কম, এদিকে লে-আউট করতে হচ্ছে চার-পাঁটটা। তারপর আস্তে আস্তে এ-ভাবটা কেটে গেল। এখন যা-ই দিই তাই। সুতরাং আর কষ্টটা হয় না আর কী। টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট যেমন প্রিন্টিং ফ্যাসিলিটিজ, প্রসেসিং ফ্যাসিলিটিজ এগুলো কম্পিউটার আসার পরে টেকনোলজি একটা বিরাট পর্যায়ে গেছে, যদিও এটাকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দেখা হয় না। কিন্তু এখন একটা ভালো পর্যায়ে গেছে এবং অনেকসময় অনেক বই খুবই ভালো হয়। আমরা তো মনে করি যে, কলকাতার বই ছাপা-বাঁধাই সবদিক থেকে উন্নত। কিন্তু আমাদের বই কোনো অংশে কম নয়। বরঞ্চ অনেক অংশে ভালো।

প্রশ্ন : আপনি ওয়াটার কালার করে কত টাকা পেয়েছেন?

কাইয়ুম চৌধুরী : পঁচিশ টাকা। আমার এখনো মনে আছে। অনেক টাকা। ওরে বাপরে বাপ! সেই টাকা কীভাবে খরচ করব, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার। আমরা মাঝেমধ্যে ওয়ার্সী বুক সেন্টারে যেতাম রং কিনতে। ওয়ার্সী বুক সেন্টারে মজা ছিল একটা। কী রং কিনব, কী রং কিনব? ওই ড্রয়ার-ট্রয়ার ছিল, নিজেরাই বার করে নিতাম। তারপর ওটা সমানে এনে … ওখানে মাঝেমধ্যে হাত-সাফাই করে ফেলতাম, দু-একটা কিনতাম। ওয়ার্সী বুক সেন্টার সম্পর্কে আমিনুল ভালো বলতে পারবেন। কারণ আবদুল বারী ওয়ার্সী আমিনুলের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। হ্যাঁ, পুরনো 888sport appয়, আরমানিটোলায়। তারপরে তো রয়েল স্টেশন সাপ্লাই হাউস হলো সদরঘাটে, ওখান থেকে আমরা কিনতাম। তারপরে হলো বাংলাবাজারের একটি দোকান। এর পরে তো অসংখ্য দোকান হয়েছে।

ছবি আঁকার জিনিসপত্র সমস্তই আসত ইংল্যান্ড থেকে। কাগজ পাওয়া যেত, রং পাওয়া যেত, তুলি এবং আর্টের ওপর বইও আসত ওখানে। ভ্যারাইটিজ কালেকশন ছিল ওখানে। আমরা প্রচুর বই মানে ‘হাউ টু ড্র’ বলে সিরিজ ছিল মানে ‘হাউ টু ড্র ট্রিজ’ ‘হাউ টু ড্র ক্যাটস’, ‘হাউ টু ড্র ডগস’ এরকম একটা স্টুডিওর একটা সিরিজ ছিল। আমরা একেবারে ওই সিরিজটা পুরো কিনেছিলাম পেনসিলের।

এটা তো একটা সময় গেছে যখন 888sport appsে ইস্ট পাকিস্তান আমলে ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে।  ভাষা-আন্দোলনের সময় অবশ্য আমাদের তখন একটা এক্সিবিশন হওয়ার কথা ছিল নিমতলীতে পুরনো জাদুঘরে। গোলাগুলি হওয়ায় এক্সিবিশনটা আর হয়নি। সেখানে মুর্তজা বশীর ছিল, ফায়ারিংয়ে আবুল বরকতের পাশেই ছিল। আমরা ওখানে পোস্টার, ছবিটবি ওগুলো লাগাচ্ছিলাম। আমিনুলও ছিল। খানিকক্ষণ পরে দেখি বশীরকে নিয়ে রাজ্জাক, রশিদের গায়ে রক্ত, রাজ্জাক সাহেব বশীরকে ধরে নিয়ে আসছেন। ‘কী ব্যাপার?’ এরকম?’ ‘গুলি হয়েছে।’ তখন আবেদিন সাহেব রাজ্জাককে বললেন, ‘তুমি ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দাও।’ তারপর বশীরকে রিকশায় করে রাজ্জাক বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলো। এ-ধরনের ক্রান্তিকালে ছাত্রসমাজ থেকে যেমন আজকে এখানে মতিউর রহমান আছে, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত ’৬৯-এ গণআন্দোলনে কারফিউর মধ্যে কাজ করানোর জন্যে রাতের বেলায় এঁরা আমার বাসায় আসত। আমার তখন খুব অবাক লাগত, এঁরা নিজের জীবনটাকে বিপন্ন করে এভাবে আসে, আর আমি যদি রাত জেগে কাজটা না করে দিই, এটা তো হয় না। আমি তখন খুব অনুপ্রাণিত হতাম। ওরা যা চাইত, আমি চেষ্টা করেছি তা দেওয়ার জন্যে এবং আমি মনে করি যে, আমি ওদের স্বপ্নটাকে সফল করার মধ্য দিয়ে আমার নিজের জীবনটাও সফল হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনারা স্বামী-স্ত্রী –  ঘরে-বাইরে দুজনই 888sport live chatী। ছবি আঁকতে কোনো সুবিধা-অসুবিধা হয়েছে কি-না?

কাইয়ুম চৌধুরী : না, সুবিধা-অসুবিধা কী, আমি তো মানে আমাদের জীবনটাই তো একটা স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে গেছে আর কী। আমাকে এস্টাব্লিশ করতে গিয়ে আমার গিন্নিকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। এটা তো অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং সে যে ভালো ছবি আঁকত এই যে পঞ্চাশ বছরের পূর্তিতে তাঁর ছবি দেখে নিশ্চয়ই বলবে সবাই ‘হ্যাঁ, ভালো ছবি আঁকত।’ আমি নিজেকে এস্টাব্লিশ করতে আর কোথাও নজর দিতে পারিনি। এখন মনে হয় এটা সত্যি অন্যায় হয়ে গেছে আর কী। হয়তো ছবি আঁকাটা যদি তাঁর চালু থাকত, তোমরা আরেকজন 888sport live chatী পেয়ে যেতে।

প্রশ্ন : বিয়ে করলেন কত সালে?

কাইয়ুম চৌধুরী : ১৯৬০ সালে। কিন্তু আমি যখন আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছি, তখন মেয়েরা আর্ট কলেজে ঢোকে। সুতরাং সেখানে মানে পূর্বরাগের কোনো প্রশ্ন ছিল না। তবে আমার এই বিয়ের মূলে আরেকজন চিত্র888sport live chatীর দান অনেকখানি। আমার ম্যাচমেকার যিনি ছিলেন – রুমি ইসলাম তাঁর নাম। তিনি এ-বিয়েটা ঘটিয়েছিলেন। আমি তাঁর কথা সবসময় মনে করি। তিনি আমার ম্যাচমেকার ছিলেন।

প্রশ্ন : আপনি যদি ক্লান্ত বোধ না করেন তাহলে আরো দু-একটা কথা কি বলব?

কাইয়ুম চৌধুরী : হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন। আমি অক্লান্ত।

প্রশ্ন : কত বছর আপনার বিবাহিত জীবন?

কাইয়ুম চৌধুরী : ১৯৬০ সালে বিয়ে, এবার হিসাব করে নিন।

প্রশ্ন : এই যে এত বছর কাটালেন একসঙ্গে – কারো কারো মুখে কখনো কখনো শুনেছিম ওই পেইন্টিংয়ের ক্যানভাস সব কিচেন থেকে এনে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়েছে?

কাইয়ুম চৌধুরী : আমি তো একজন পেইন্টারকে বিয়ে করেছি। সুতরাং এটা তো হওয়ার কথা নয়। নো, নো, নেভার।

প্রশ্ন : ’৭১ সালের কোনো বিশেষ ঘটনার কথা বলুন।

কাইয়ুম চৌধুরী : ’৭১-এর ঘটনা, ’৬৯-এ যখন আন্দোলন হয়, তখন আমরা আর্ট কলেজে 888sport live chatী সংগ্রাম পরিষদ করেছিলাম। সেই 888sport live chatী সংগ্রাম পরিষদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমি ছিলাম প্রেসিডেন্ট। আমরা তো নানান রকম পোস্টার, কার্টুন এগুলো করে মিছিল করেছি। আমাদের মিছিলের একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, খুব ডেকোরেটেড মিছিল হতো। আমরাই প্রথম আর্ট কলেজের চারটি মেয়েসহ স্বাধীনতার চারটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে ’৬৯-এর স্বাধীনতার বিষয়বস্ত্ত নিয়ে মিছিল করেছিলাম। ’৭১-এর মার্চে একটা মিছিল আমরা করেছিলাম। এটা একটা খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যখন ক্র্যাকডাউন হলো, এক্সপ্রেস বলে একটা পত্রিকা, শফিক রেহমান ছিল তার এডিটর। আমি ওই এক্সপ্রেস পত্রিকাটা মেকআপ করতাম। যেদিন ২৫ মার্চ বিকেল চারটের সময় আমি পত্রিকা অফিসে যাব। তখন আমার একটা গাড়ি ছিল। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, চাবি নিয়ে যাচ্ছি। তখন আমার স্ত্রী বলল, ‘না, তুমি আজকে গাড়ি নিয়ে যেও না।’ আমি বললাম, ‘কেন গাড়ি নিয়ে যাব না?’ স্ত্রী বললেন, গাড়িটা রেখে যাও।’ আমি রাগ করে গাড়ির চাবিটা ফেলে এলাম। এক্সপ্রেস পত্রিকার অফিস তখন ‘জোনাকী’র পাশে। ওখানে আমি বসে বসে মেকআপ করছি। বাইরে কোনো রকম গোলমালের শব্দ পাচ্ছি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে একটা অস্পষ্ট কী যেন একটা হচ্ছে। কিন্তু আমার ওদিকে কোনো কান নেই। এমন সময় এক্সপ্রেসের পাবলিশার গাজী শাহাবুদ্দীন, তাঁর বাবা ওপর থেকে নেমে এলেন। নেমে এসে বললেন যে, ‘বউমা বাসা থেকে টেলিফোন করেছে, শহরের অবস্থা খুব খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও।’ আমি ভাবলাম, কী বলে! তখন আমি ওনার ছেলে গাজী শাহাবুদ্দীনকে বললাম, ‘আপনি একটু দ্যাখেন তো কী ব্যাপার?’ ও অবজারভারে টেলিফোন করল। তখন বোধহয় সন্ধে ছটা। অবজারভার থেকে বলা হলো, ‘না না, একরম কোনো গন্ডগোল নেই।’ তারপর আমি কাজ করছি।  সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবার টেলিফোন। উনি আবার এসে বললেন, ‘না, তুমি চলে যাও। বউমা আবার টেলিফোন করেছে।’ তখন আমি বেরোলাম। বেরিয়েই দেখি শহরের অবস্থাটা পালটে গেছে।  তখন ৭টা বাজে, দেখি আবেদিন সাহেব, উনি পেছনে থাকেন। ছেলেদের নিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছেন। আমাকে দেখে উনি অবাক! ‘তুমি এখানে কী করো?’ ‘আমি স্যার, আমি তো এখানে কাজ করতে এসেছিলাম।’ ‘ধুত, বাড়ি চলে যাও। দেখো না, শহরের অবস্থা খারাপ।’ উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের দিয়ে ব্যারিকেড দিচ্ছেন। আমার সঙ্গে তখন ওই অফিসেরই একজন কেশব গুপ্ত বলে আমাদের এক বন্ধু ছিল, ও বলল, ‘চলুন আমি আপনাকে নামিয়ে দিই।’ আমি বললাম, ‘দরকার নেই, আমি চলে যেতে পারব।’ ‘না, আপনি চলুন।’ তখন একটা স্কুটার নিলাম। ও বলল, ‘যেতে তো পারবেন না বোধহয়, তবু আমি যতদূর পারি আপনাকে নিয়ে যাই।’ হাইকোর্টের কাছে এসে দেখি ওখানে বটগাছটা কেটে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে। ওখান থেকে আবার ঘুরে পিজির সামনে এসে আর্ট কলেজের সামনে এসে আবার আটকে গেলাম। তখন আমি কেশবকে বললাম, ‘কেশব আপনি চলে যান। এই স্কুটার আর যেতে চাচেছ না, আমি এখান থেকে জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে চলে যাব।’ তখন প্রায় রাত্রি নটা। তারপর ওখান থেকে নেমে আমি রাত্রি নটার সময় জগন্নাথ হলের পেছন দিয়ে রেলগেটের সামনে এলাম। ওখানে দেখি ছেলেরা ব্যারিকেড দিচ্ছে। আমাকে একজন ধরল। ‘কোত্থেকে আসছেন?’ আমি বললাম। একজন আমাকে চিনতে পারল, ছেড়ে দিলো। আমি যখন আজিমপুরের মাঝখানে, তখন দেখি হাজার হাজার রিকশা। পাগলের মতো ছুটছে। বাসায় এলাম, দেখি ওরা সব মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাগুলো ছুটছে। তারপরে তো … আমি সাড়ে ৯টায় জগন্নাথ হলের ওখানটা ক্রস করেছি। ১১টায় ওখানে অপারেশন … এই একাত্তরের ঘটনা। সারারাত তো সেই ইকবাল হল … আমি ওপর থেকে দেখি খালি গুলি যাচ্ছে, রেইড হচ্ছে – এসব দেখতে পাচ্ছি।