বাঙালি মননে ধর্মচিন্তা

হাবিব রহমান

 বাঙালির ধর্মচিন্তা

সংকলন ও সম্পাদনা :

মোহাম্মদ আবদুল হাই

 

সূচীপত্র

888sport app, ২০১৪

 

৯৯৫ টাকা

 

ধর্ম নিয়ে কথা বলতে হলে আগে এর স্বরূপ সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট একটা ধারণা করে নিলে ভালো হয়। ঈশ্বর বা পরম স্রষ্টায় বিশ্বাস ও নানা পদ্ধতিতে তাঁকে আরাধনার যে-আচারগত প্রক্রিয়াকে সাধারণভাবে আমরা ধর্ম বলি, তা ইংরেজি রিলিজিয়নের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রিলিজিয়নের সঠিক কোনো প্রতিশব্দ বাংলায় নেই, বোধকরি ভারতীয় কোনো ভাষাতেই নেই। রিলিজিয়নে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও তাঁর উপাসনার পদ্ধতি অনেক সুসংগঠিত ও তার একটা সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে। এই অর্থে ইহুদি-খ্রিষ্টান-ইসলাম এই সেমেটিক ধর্মত্রয় যেভাবে রিলিজিয়ন, হিন্দু ধর্ম সে-অর্থে রিলিজিয়ন নয়। বোধকরি সে-কারণে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মকে ধর্ম না বলে কালচার বলা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করেছিলেন। আর বৌদ্ধ ধর্মে তো ঈশ্বরের প্রসঙ্গই নেই।

অন্যদিকে সংস্কৃত ধর্ম শব্দটি বহু অর্থজ্ঞাপক। একটা বড় অর্থ হচ্ছে বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র, ইংরেজিতে property। যেমন আগুনের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়া। এই ধর্মের কিন্তু ব্যত্যয় নেই। সেদিক থেকে মানুষের কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম নেই। সে পোড়াবে, না গড়িয়ে যাবে, না থমকে দাঁড়িয়ে থাকবে তা আগে থেকে বলা যায় না। সে যা-ই হোক, রিলিজিয়ন অর্থে যখন ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন তার কেন্দ্রে থাকে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও নানা আচারিক প্রক্রিয়ায় তাঁর আরাধনা। ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই কথাগুলো মনে রাখা ভালো।

সন্দেহ নেই, মানুষের ধর্মভাবনা সুপ্রাচীন। সভ্য হোক, অসভ্য হোক, মানুষ বহুকাল ধরে ঈশ্বর ও তাঁর নানা রূপ কল্পনা করে এসেছে এবং তাঁর রোষ থেকে রক্ষা ও করুণা পেতে নানাবিধ আচার-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এই সবকিছুর সঙ্গে অনুস্যুত রয়েছে তার ধর্মভাবনা। আবার এর বিপরীত যে-বিশ্বাস তাও কিন্তু ধর্মভাবনাই। বাংলা  ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে এর চমৎকার দৃষ্টান্ত আমরা পাই। কেউ বলছেন, মন্ত্র-তন্ত্র-দীপ জ্বালানো-নৈবেদ্য দেওয়ার কথা; বিপরীত-বিশ্বাসীরা বলছেন, কী হবে ওসব করে, ওতে কোনো ফল নেই। বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষের মতো বাঙালিও তার বৈচিত্র্যময় ধর্ম-ভাবনা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে এসেছে। পদ্যযুগে এই প্রকাশের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল, যা বহুগুণে অবারিত হয়েছে গদ্যযুগে এসে। এই যুগের দুই শতাব্দীর কালসীমায় লেখা অন্তত পঞ্চাশ জন বাঙালির ধর্মচিন্তামূলক 888sport liveের একটি দীর্ঘকলেবর (৬৬৪ পৃ) সংকলন বাঙালির ধর্মচিন্তা নামে প্রকাশিত হয়েছে এ-বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বইটির প্রকাশক 888sport appর সূচীপত্র। সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ আবদুল হাই।

বইটির গোড়ায় রয়েছে সম্পাদকের শতপৃষ্ঠার ভূমিকা। এটি রচনায় সম্পাদকের পাঠ-পরিধি ও শ্রমশীলতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অংশটি পড়ে পাঠক যে কেবল বহু বিষয়ে অবহিত হতে পারবেন তা নয়, চিন্তার অনেক উপাদানেরও সাক্ষাৎ পাবেন। তবে পুরো বিষয়টি উপস্থাপনে স্তরবিন্যাসের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলার আছে। গোড়ার দিককার স্তরগুলো এরকম : মানব জাতির উদ্ভব ও বিকাশ, ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, বাঙালির অনুসৃত প্রধান চারটি ধর্ম, মধ্যযুগে বাঙালির ধর্মচিন্তা, বেদে উল্লিখিত চার শ্রেণির ধার্মিক, ধর্ম ও 888sport apk, ধর্ম ও দর্শন, ধর্ম ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও নৈতিকতা ইত্যাদি। আমাদের বিবেচনায় বেদসম্পর্কিত স্তর বা পরিচ্ছেদটির স্থান যেখানে দেওয়া হয়েছে তাতে কালানৌচিত্য দোষ ঘটে। এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরিচ্ছেদে আলোচনা করলে সংগত হতো। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ‘ধর্ম’ শব্দটির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে। বেদের দৃষ্টিতে চার শ্রেণির ধার্মিক-চিহ্নায়নেও স্বাভাবিকভাবে তত্ত্ব আসে। অন্যদিকে ‘বাঙালি অনুসৃত চারটি ধর্ম’ অংশে যেখানে হিন্দু ধর্মের পরিচয় দেওয়া হয়েছে সেখানেও প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করলে অসংগত হতো না। কেননা হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র হিসেবে যে-গ্রন্থগুলো গণ্য করা হয় বেদ সেগুলোর মধ্যে প্রথম। কোথায় বাঙালির মধ্যযুগ আর কোথায় বেদের কাল!

প্রথমেই ধর্মের সঙ্গে 888sport apkের সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ ওই একই দোষ ঘটায়। 888sport apk তো অনেক পরের ব্যাপার। আগে দর্শন, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নির্ণয়ের পর 888sport apkের প্রসঙ্গ আনলে সংগত হতো। এগুলোর পর আছে ধর্ম ও রাজনীতি।

এই সঙ্গে আরো কিছু প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। মূলত মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলিম চিন্তাবিদরা দুই দলে বিভক্ত হন – জাবারিয়া ও কাদেরিয়া। প্রথম দল মনে করতেন, মানুষের ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা নেই, দ্বিতীয় দল ছিলেন এ মতের বিরোধী। জাবারিয়া এ বইয়ে দেখছি হয়েছে ‘জাকারিয়া’ (পৃ ১৭)। এটি মুদ্রণপ্রমাদ কিনা বলা কিছুটা কঠিন; কেননা অব্যবহিত পরেই এদের পৃথক ‘ধর্ম সম্প্রদায়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরা ধর্মসম্প্রদায় নন, দার্শনিক সম্প্রদায়।

‘মধ্যযুগে বাঙালির ধর্মচিন্তা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বাঙালির ধর্মচিন্তা ততটা নয়, যতটা গুরুত্ব পেয়েছে ধর্মবিরোধ। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য থেকে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের হিন্দু ধর্মের নিন্দা ও ভবানন্দের উত্তরের যে-দীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে (পৃ ১৯-২৩) তাতে ওই বিরোধ প্রকটিত হয়। কিন্তু বিরোধের পাশে সমন্বয়বাদী একটি ধারাও ছিল। সেই ধারাটির পরিচয় এখানে দেওয়ার যথেষ্ট আবশ্যকতা ছিল। তা না হলে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থেকে যায়।

দু-একটি স্থানে পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে। ২৬ পৃষ্ঠায় সম্পাদক লিখেছেন, ‘ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা থাকা সত্ত্বেও গ্যালিলিওকে তাঁর নিজের ইনক্যুইজিশনের কাছে নিগৃহীত হতে হয়েছিল’ – এখানে ‘নিজের’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ইনকুইজিশন তাঁর নিজের সৃষ্ট? গ্যালিলিও ধর্মীয় বিচারসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন তথ্য আমাদের জানা-শোনার বহির্ভূত। পরের পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে বিশ শতকে এসে 888sport apkীদের 888sport free bet ‘ক্রমশ ক্ষীয়মাণ’। প্রশ্ন তুলতেই হয় যে, কোন শতকে 888sport apkীদের 888sport free bet বেশি ছিল? মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে তাঁর বিখ্যাত ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ পদ্যটি রচনার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে (পৃ ৯৫)। সম্পাদকের এই ভুল একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

সংকলনের অর্ধশতকের বেশিসংখ্যক রচনাগুলোকে বিষয়গত দিক থেকে চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যয় : ধর্মের উৎসসন্ধানী অভিমত; দ্বিতীয় অধ্যায় : ধর্ম : মানসলোক ও চেতনালোক; তৃতীয় অধ্যায় : যুক্তিবাদীদের দৃষ্টিতে ধর্ম এবং চতুর্থ অধ্যায় : ধর্ম ও রাজনীতি। বাঙালির ধর্মচিন্তার সামগ্রিক পরিচয় সন্ধানে এই অধ্যায়-বিভাজন সংকলকের চিন্তাপ্রসূত বলেই মনে হয়। অবশ্য কেউ বলতে পারেন যে, অধ্যাত্মবাদীদের দৃষ্টিকোণসম্ভূত ধর্মচিন্তা নিয়ে একটা অধ্যায় এ বইয়ে থাকলে ভালো হতো। এ জাতীয় দু-তিনটি লেখা দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে। তার পরেও বলতে হয় সুফি, বৈষ্ণব ও বাউলদের ধর্মচিন্তাবিষয়ক লেখা এখানে থাকার দরকার ছিল। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একটা লেখাও চোখে পড়ল না। এদিক থেকে বলা যায়, সংকলনটিতে কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।

প্রথম অধ্যায়ের প্রথম লেখাটিতেই আবারো হোঁচট খেতে হলো। এবারের হোঁচটটা বেশ জোরালো। লেখাটির রচয়িতা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রচনার নাম সূচিপত্রে ‘সকল ধর্মগ্রন্থই পুরুষ রচিত’ কিন্তু গ্রন্থমধ্যে ‘ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত’। এ ত্রুটি মেনে নিলেও অন্য প্রশ্ন সূচিমুখ হয়ে উঠবে যে, রোকেয়ার কি ওই নামে কোনো 888sport live আছে? পড়তে গিয়ে বোঝা গেল আবদুল কাদির-সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলীর ভূমিকা থেকে এটি সম্পূর্ণ অসচেতনভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাটি হচ্ছে নবনূর পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ পঞ্চম 888sport free betয় (ভাদ্র ১৩১১) রোকেয়ার ‘আমাদের অবনতি’ নামে একটি 888sport live প্রকাশিত হয়েছিল। মতিচূর প্রথম খন্ডে অন্তর্ভুক্তির সময় রচনাটির পাঁচটি অনুচ্ছেদ বর্জন করে নতুন সাতটি অনুচ্ছেদ সংযোজনপূর্বক এটির নাম দেওয়া হয় ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’। রচনাবলীর ভূমিকায় উদ্ধৃত উল্লিখিত পাঁচটি মাত্র বর্জিত অনুচ্ছেদ বাঙালির ধর্মচিন্তার সংকলক গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এর চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ওই পাঁচটি অনুচ্ছেদের পর ‘আমাদের অবনতি’র প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নওশের আলী খান ইউসফজীর লেখার যে-উদ্ধৃতিটুকু আবদুল কাদির দিয়েছেন, আলোচ্য গ্রন্থে তাও নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রোকেয়ার লেখায় ইউসফজীর অনুপ্রবেশ!

এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও বাঙালির ধর্মচিন্তা গ্রন্থের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা পঞ্চাশ জন বাঙালির, যাঁরা অধিকাংশই মেধা-মননে যথেষ্ট খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত, ধর্মচিন্তার পরিচয় দুই মলাটের মধ্যে একসঙ্গে পাওয়া কম কথা নয়। সন্দেহ নেই এ গ্রন্থের অনেক রচনা বহু পাঠকের চিন্তায় অভিঘাত সৃষ্টি করবে, তাকে জাগিয়ে দেবে, এমনকি নিজের ও অন্যের সঙ্গে তর্কে প্রণোদিত করবে। বিশেষ করে ‘ধর্ম ও রাজনীতি’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়টি ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণজনিত কারণে বর্তমানের অস্থির ও বিক্ষুব্ধ সময়ে যথাযথ পথের দিশা-নির্দেশে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

শেষে একটি পরামর্শ। এ বইয়ের মুদ্রণপ্রমাদের 888sport free betধিক্য পাঠের ক্ষেত্রে খুবই পীড়াদায়ক। বইটির মান ক্ষুণ্ণ হওয়ার এও এক বড় কারণ। এছাড়া সম্পাদকের সুদীর্ঘ ভূমিকার পর ১০৫ পৃষ্ঠায় গিয়ে সূচিপত্র মুদ্রণ অস্বাভাবিক তো বটেই, সূচিসন্ধানের ক্ষেত্রে যারপরনাই বিরক্তিকর। সম্পাদক ও প্রকাশকের উচিত হবে এর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া।