বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর

মহাভারতেও আমরা বাঙালি জাতির উল্লেখ পাই। তাই সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বাঙালির জাতিসত্তা কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছরের। আজকে যুক্ত-বাংলায় আমরা যেসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী দেখি যেমন, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, গারো, হাজং, কোচ, রাজবংশী এবং দক্ষিণ-পূর্বের চাকমা, মগ, মুরং, বম ইত্যাদি এরা এই অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে দক্ষিণের নৃগোষ্ঠীসমূহের স্থানান্তর তত প্রাচীন নয়।

প্রাচীন বাংলায় যে-কটি বিভাগের নাম আমরা পাই : অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুম্ম। এর মধ্যে বঙ্গ আমাদের কাছে নিজস্ব অঞ্চল বলে দাবি করতে পারি। পুণ্ড্র্র উত্তর বাংলা। রাঢ় অঞ্চল বর্ধমান বিভাগ। কলিঙ্গ উড়িষ্যা। অঙ্গ এবং সুম্ম নিয়ে কিছুটা দ্বিধা থাকতে পারে। তবে বাংলা যুগে যুগে তার আয়তন পাল্টেছে। একসময়

বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ছিল বাংলার মিলিত অঞ্চল। সুতরাং প্রাচীন বাংলা নিক্তি দিয়ে মাপার অসুবিধা আছে। যেমন দক্ষিণ বাংলার নাম ছিল সমতট। আবার বৃহত্তর ত্রিপুরা রাজ্য ইতিহাসে হরিকেল নামে পরিচিত। দেব, বর্মণ ও চন্দ্র বংশের রাজারা এই অঞ্চল পরিচালনা করতেন। তবে প্রাচীনকালে বাংলার নাম কলিঙ্গও ছিল। আজ আমরা কলিঙ্গ বলতে উড়িষ্যাকেই বোঝাই।

গুপ্ত যুগের পর সপ্তম শতকের শেষ দশকে একমাত্র নির্বাচিত রাজা শশাঙ্কের নাম পাচ্ছি প্রথম বাঙালি নৃপতি হিসেবে। কর্ণসুবর্ণ, আজকের মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন অঞ্চল ছিল তাঁর রাজধানী। এই রাজ্য মাত্র বিশ-ত্রিশ বছর টিকে ছিল। তারপরই শুরু হয় বাংলায় মাৎস্যন্যায়। অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজন্যদের মধ্যে কলহ-বিবাদ। এর সমাপ্তি ঘটে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গোপালের মাধ্যমে। পাল যুগ বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবময় যুগ। এই সময় বাংলার সংস্কৃতি একটি নিজস্ব শৈলী নির্মাণ করে। এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজাদের আমলে অসংখ্য বিহার গড়ে ওঠে। এই বিহারগুলির মধ্যে রয়েছে কুমিল্লার ময়নামতি ও বৃহত্তর রাজশাহীর পাহাড়পুর বিহার। বাঙালি সংস্কৃতির আরেকটি সমান্তরাল শাখা হলো বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশ। এঁরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। সুতরাং মন্দির নির্মাণ সহগ। বিষ্ণুপুর ঘরানা বাংলায় সনাতনধর্মী সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট নমুনা। রাগসংগীত ও স্থাপত্যে এদের উৎকর্ষ ঈর্ষণীয়। এর অন্যতম কারণ হলো এই বংশের নিষ্কণ্টকভাবে টিকে থাকার নীতি। এই রাজবংশ সবসময় সন্ধির মাধ্যমে নিজ রাজ্য ও প্রজাদের মঙ্গল সাধন করে গেছেন। এঁরা উচ্চাশা ত্যাগ করে অল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন। এতদঞ্চলে রাষ্ট্রনীতিতে যা বিরল ঘটনা। উচ্চাশা যেখানে সর্বগ্রাসী মনোভাব তার বিরুদ্ধে এই শান্ত মনোভাব প্রশংসার দাবিদার। আর তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সভ্যতা গড়ে ওঠে অবকাশের ক্ষেত্রে।’ যুদ্ধ মানেই বিধ্বংসী ব্যস্ততা। ইমারত ও মানবজীবনকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানকালে আমাদের সামনে মাহাথির মহম্মদের মালয়েশিয়া ও লি কুয়ানের সিঙ্গাপুরের নবউত্থানকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারি। এঁরা একটানা নির্বিঘ্নে রাজত্ব করে দেশকে চমৎকার কাঠামো দান করেছেন। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বর্তমান ভারতের সুদৃঢ় কাঠামো দান করে গেছেন। মানব সংস্কৃতির উত্থানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সমাজে অস্থিরতার অনুপস্থিতি। এই আপ্তবাক্য গোটা মানবসমাজের জন্যই প্রযোজ্য।

বাংলায় পালরাজ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় একটি শক্তি হিসেবে বিশে^ পরিচিতি লাভ করে। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে চীন-জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী আসতেন ধর্মচর্চা ও দর্শন অধ্যয়নে। বাংলায় নালন্দার সমান্তরাল জ্ঞানচর্চা হতো। শীলভদ্র ছিলেন নালন্দার আচার্য, যিনি একজন বঙ্গসন্তান। তাঁর বাড়ি ছিল 888sport appর বজ্রযোগিনী গ্রামে। এখন যা দর্শনীয় স্থান।

বগুড়ার মহাস্থানগড় বাংলার প্রাচীনতম নগর ও পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী। এখানে করতোয়া নদীর পাশে দুর্গ-প্রাকারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে আরো অনেক নিদর্শন, যা পুণ্ড্রবর্ধন নগরী নামে খ্যাত।

পাল আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌঢ়। বাংলার সংস্কৃতিতে গৌঢ়ের প্রভাব কম নয়। রাগসংগীতে গৌঢ় সংযুক্ত অনেক রাগের নাম পাওয়া যায়।

আমরা চীনের প্রাচীর সম্বন্ধে সবাই জ্ঞাত। কিন্তু জ্ঞাত নই পাল আমলে নির্মিত মাটির বিশাল বাঁধ সম্বন্ধে। রাজা ভীম পালের সময় এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বন্যা-নিরোধ, বহিঃশত্রুকে বাধা দেওয়ার ও সেনা চলাচলের প্রয়োজনে। একে আঞ্চলিক কথায় বলা হয় ‘ভীমের জাঙ্গাল’। গত শতাব্দীতে ষাটের দশকে আমি ভীমের জাঙ্গাল দর্শন করেছি। ভূমি থেকে উচ্চতা ও পাশ দর্শনীয়। সাম্প্রতিককালে যাওয়া হয়নি। তবে পূর্বেই দেখেছি, অনেক জায়গায় জাঙ্গাল কেটে চাষের জমি বের করা হয়েছে। তবে এর দৈর্ঘ্যরে নমুনা ছাড়া ছাড়াভাবে দেখা যায়।

পাল যুগের স্থাপত্যকলায় পোড়ামাটির ফলক বাংলার সংস্কৃতিকে ভীষণভাবে সমৃদ্ধ করে। বিশেষ করে পাহাড়পুরে সোমপুর বিহারের নিদর্শনগুলি অনেকটা অক্ষত আছে। বর্তমানে তা জাদুঘরে সংরক্ষিত। এর জায়গায় কপি করে নমুনা সাঁটা হয়েছে। বাঙালির ইতিহাসে এর স্থান অতি উচ্চে। পরবর্তী সময়ে এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে বগুড়ায় অবস্থিত কান্তজিউর মন্দির। এটাই বিষ্ণুপুর ঘরানার বাইরে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠা সূক্ষ্মকর্ম মৃৎফলক। কান্তজিউর মন্দিরের নির্মাণকাল ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দ। নাটোরের কাছে বনপাড়ায় এই ধরনের আরো দুটি মন্দির আছে। একটি বেশ পুরনো। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্যটি সম্ভবত সমসাময়িক। কান্তজিউর মন্দিরের টেরাকোটা 888sport live chatী এই কাজ শেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাড়ির পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এর গায়ে  বেশ অলংকরণ আছে। তবে ফোলিয়েজ বা শতদলপুষ্প আকৃতির। ইসলাম যেহেতু মূর্তিপূজক ধর্ম নয়, তাই কোনো জীবজন্তুর অবয়ব অবস্থান পায়নি। এটি আমার নিজের চোখে দেখা।

মিশরের পিরামিড আশ্চর্য স্থাপনা। প্রস্তরনির্মিত এবং বিপুলাকৃতির। কিন্তু বিষ্ণুপুরের পিরামিড আকৃতির বিষ্ণুমন্দিরটি তাক লাগানো। উঁচু ভিত্তির ওপর চালাবাড়ির ওপর ইটের তৈরি পিরামিড বিশে^ দ্বিতীয়টি আর নেই।

আসলে আমরা বাঙালিরা নিজেদের গুরুত্ব বুঝি না। পরের পায়ের তলায় থাকতে থাকতে বিস্মরিত জাতিতে পরিণত হয়েছি। অন্যের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

মৃৎনির্মিত তৈজসপত্রে বাংলার সংস্কৃতি পৃথিবীকে চমক লাগানোর মতো। কিন্তু সজাগ জাতি হিসেবে নিজেদের পরিগণিত করার কাজগুলি থেকে আমরা সর্বদা দূরে থেকেছি।

আমার পিতৃব্যতুল্য সহকর্মী 888sport live chatী প্রয়াত জয়নুল আবেদিন আমাকে একটি গবেষণার কাজ দিয়েছিলেন : ‘বাংলার দই-এর হাঁড়ির একটা খতিয়ান নাও। বেরুবে একটা ক্যামেরা নিয়ে। আর খাতায় ড্রইংটা করে নেবে। দেখো কি মজার জিনিস বেরিয়ে আসে।’

আজ পর্যন্ত কাজটা আমার সমাধা করা হয়নি। শেষ করতে পারব – এই ভরসাও পাচ্ছি না। কোনো অনুজ কি দায়িত্বটি নেবেন? তাহলে আমি দায়মুক্ত হই।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে 888sport live chatীগুরু নন্দলাল বসুর কথা। তিনি আড়াইশো টাকার মাইনে ছেড়ে কবিগুরুর ডাকে শান্তিনিকেতনে একশ পঁচিশ টাকার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আর শান্তিনিকেতনকে শান্তির নীড় তৈরির কারিগরের অন্যতম হিসেবে পূজ্য। যেমন 888sport appsে 888sport live chatাচার্য জয়নুল আবেদিন। 888sport appsের 888sport live chatচর্চার পটভূমি তাঁর হাতে নির্মিত।

পাল যুগের পর সেন যুগ। দ্বাদশ শতক। সেন বংশ কর্ণাটক থেকে আগত। তাদের মধ্যে কৌলীন্যপ্রথার প্রাবল্য থাকায় বাংলার বৌদ্ধ অধিবাসীগণ পীড়নের শিকার হন। প্রচুর ভিক্ষু দেশত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে দেশে স্থানান্তরিত হতে থাকেন।

ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলায় শাসকবদল ঘটে। বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজাদের হটিয়ে গৌঢ় ও নদীয়া দখল করেন। সেন রাজন্যবর্গ লক্ষ্মণ সেনের নদীয়া ত্যাগের পর আরো কিছুকাল 888sport appর বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। একসময় তাও হাতছাড়া হয়। এভাবে বাংলার শাসনভার মুসলমান শাসনকর্তাদের হাতে অর্পিত হয়। এই সময় অনেক মুসলমান ধর্মপ্রচারক বাংলায় আসতে থাকেন এবং জনগণের মধ্যে সাড়া পান। নির্যাতিত বৌদ্ধ ও বর্ণবাদী পীড়নের ফলে নিম্নবর্গীয় সনাতনধর্মীয়দের মধ্যে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। চতুর্দশ থেকে ষষ্টদশ শতক সময়কালে বাংলায় কোনো উল্লেখযোগ্য মন্দির নির্মাণের নিদর্শন আমাদের চোখে পড়েনি। বরং সুলতানি আমলে (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.) বাংলায় বিখ্যাত সব মসজিদ নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ হলো গৌড়ে অবস্থিত আদিনা মসজিদ। কারিগরগণ মন্দির নির্মাণের পূর্বকৌশল যে ব্যবহার করেছেন তার যথেষ্ট নমুনা পাওয়া যায়। অলংকরণ ও স্থাপত্যরীতিতেও এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গৌড়ের দক্ষিণ প্রান্তে ফিরোজপুর গ্রামে ছোট সোনা মসজিদের কাঠামো দেখলেই মনে হবে এটি বাংলার একটি বড় চালাবাড়ি। মসজিদের ছাদে এগারো সারির গম্বুজের মাঝেরটি আবার সম্পূর্ণ চালবাড়ি-সদৃশ। এটিকে বাংলা সংস্কৃতির মুকুট বলা চলে।

বাংলার চালাবাড়ি আকারটি মোগল আমলে লাহোর ফোর্টে  শিশমহলে ব্যবহৃত হয়। এমনকি দক্ষিণ ভারতের অনেকাঞ্চলে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এর সবটাই কার্যকারণনির্ভর। সুলতানি আমলে মসজিদগাত্র অলংকরণে ঘণ্টা ও শেকল বা কলার মোচা পুরোপুরি স্থাপত্য ও পরিবেশকে তুলে ধরে। ইসলাম ধর্মের নিরাকারবাদিতা এবং মরু অঞ্চলের প্রকৃতি ইসলামি স্থাপত্যে নকশা ও ক্যালিগ্রাফিপ্রধান। জ্যামিতিকতা এর মৌল উপাদান। প্রাণের বা জীবজগতের অনুপস্থিতি। বাংলার স্থপতি ও 888sport live chatীরা বিধান মেনে তাঁদের 888sport live chatীসত্তাকে নমস্কার জানান।

বাংলার সুলতানি আমল একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। পণ্ডিত সুখময় মুখোপাধ্যায় এ-ব্যাপারে একটি আকর-গ্রন্থ রেখে গেছেন।  পুস্তকটি এই দুশো বছরের 888sport live chat-888sport live football-রাজনীতি সব বিষয়ের বিশদ দলিল। বিশেষ করে আলাউদ্দিন হুসেন শাহর আমল সবচেয়ে মিলনের কাল ছিল হিন্দু-মুসলিম দুটি বড় সম্প্রদায়ের। এই সময় নদীয়ায় নিমাই সন্ন্যাসীর আবির্ভাব। তিনি নির্বিঘ্নে তাঁর ধর্মপ্রচার করতে সক্ষম হয়েছেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহর পুত্র নুসরাত শাহও পিতার পদাঙ্ক অনুসারী ছিলেন। তাঁর সময় রাজশাহীর বাঘা অঞ্চলে একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যাঁরা ছিলেন উদারপন্থী। এখানে নির্মিত বাঘা মসজিদের (১৫২৬ খ্রি.) গাত্র অলংকরণে সমৃদ্ধ। পদ্মের জ্যামিতিক রূপ এই সময় মন্দির ও মসজিদ উভয় স্থাপনাতেই সমানভাবে আদৃত হয়েছে।

মসজিদ-অভ্যন্তরে মিহরাবেও গাছপালার নকশায়িত রূপ স্থান করে নিয়েছে। মিহরাব হলো যেখানে ইমাম সাহেব স্থান গ্রহণ করে নামাজিদের নেতৃত্ব দেন।

মোগল আমলে বাংলার স্থানীয় রূপটি তেমন করে আর টিকে থাকেনি। বরং মোগল ইম্পেরিয়াল রূপ গ্রহণ করতে থাকে। চালাবাড়ির ধারা আর তেমনভাবে জায়গা পায়নি। বলতে গেলে অদৃশ্য হয়ে যায়।

বাংলায় পাল-পরবর্তীকালে কৌলীন্যবাদ স্থাপনের চেষ্টা হলেও এ-যুগে সনাতনধর্মী ও বৌদ্ধবাদীদের মধ্যে কোনো বিবাদের তথ্য মেলে না। দুই পক্ষ একে অপরকে 888sport apk download apk latest version করে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মের অভিঘাতে বাংলায় বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় বা রীতি-প্রথাধারী গোষ্ঠী তৈরি হয়। তারা হলো :

নাথপন্থী, তান্ত্রিক, বাউল ও সহজিয়া। ইসলাম ধর্মের আগমনের অভিঘাতে সুফিবাদের প্রভাবে মাজার সংস্কৃতি তৈরি হয়, যেখানে সর্ব ধর্মের একটা মিলন ঘটে। ভারতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি প্রমুখ এর জ¦লন্ত উদাহরণ।

বাংলায় শাহজালাল, শাহ পরান, বায়েজিদ বোস্তামি, শেখ ফরিদ, বদর শাহ প্রমুখ। ইরান ও তুরস্কের সুফিবাদ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে বাংলায়। সর্ব ধর্মের মিলন বাংলার জনগণের একটি বৈশিষ্ট্য। জানা যায়, কনৌজ থেকে ১৫ জন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত এনে সনাতন ধর্মের শক্ত ভিত দানের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলার প্রকৃতির শ্যামল রূপ এখানকার মানুষের মনকে গোঁড়া হতে দেয়নি। বাউল কবি শাহ আবদুল করিমের গানে আমরা এর প্রতিধ্বনি পাই : ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম …’, অর্থাৎ আমাদের সেই সুন্দর দিন ক্রমশ অসুন্দর হয়ে উঠেছে। সংগীত এভাবে সামাজিক মানস ও সমস্ত ঘটনার ধ্যান-ধারণাকে প্রকাশ করে। তা বসন্তের কোকিলের ডাক থেকে ক্ষুদিরামের ফাঁসির খবর চিরকালের জন্যে স্বাক্ষর রেখে যায়।

বাংলার সংস্কৃতিতে কাঠামোগত সনাতন ধর্মের পূর্বে যে সর্বপ্রাণবাদ বা অ্যানিমিজম বিদ্যমান ছিল তার নমুনা হলো সমগ্র ব্রতকথা। এখান থেকে প্রবাদ তৈরি হয়েছে – বারো মাসে তেরো পার্বণ।

প্রকৃতিকে বশ করার জন্য কত না প্রচেষ্টা। বৈরী প্রকৃতির মধ্যে মানুষ একমাত্র প্রাণী, যার কোনো শারীরিক অস্ত্র নেই। তার আছে শুধু দুটি মাত্র হাত। এই হাতের সাহায্যে সে সকল বাধা অতিক্রম করেছে। চার পা থেকে দু-পা মুক্ত করে এই অবস্থানে পৌঁছতে লাখ লাখ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তার প্রথম হাতিয়ার হলো একটি গাছের ডাল বা লাঠি। পরবর্তী সময়ে পাথরের সরাসরি ব্যবহার ও ফলক সৃষ্টির মাধ্যমে ক্রমবর্ধিত হওয়া। আরো উন্নত হাতিয়ার তৈরির জন্যে। আগুনের ব্যবহার তাকে এগিয়ে দেয়। এই সঙ্গে আসে চাকা, যা দ্রুত অগ্রসর হওয়া ও অনায়াসে একজনকে বহন করা যায়। বহন করা যায় অনেক ভারী বস্তু।

পশুপালন ও শস্যের আবিষ্কার মানুষের সংস্কৃতি নির্মাণের সবচেয়ে বড় অবদান। মানুষ ক্রমশ সমাজ সংগঠনের দিকে এগিয়ে গেছে। আর বাঁচার জন্যে যা কিছু সৃষ্টি করছে তা-ই সংস্কৃতি।

ক্রম-সংস্কারের মাধ্যমে মানুষ দিন দিন উন্নতির হার বাড়িয়েছে। মিশরের পিরামিড থেকে বিষ্ণুপুরের ইটের তৈরি বিষ্ণু-মন্দির নির্মাণের মধ্যে কেটে গেছে কয়েক সহস্রাব্দ।

পাথর প্রকৃতির অঙ্গ। ইট মানুষের তৈরি। ব্যাবিলনে কাঁচা ইট। বাংলায় ইট পাকা – মানে পোড়ানো। গুণগত পার্থক্য বিশাল। চীনে চীনামাটি বা কেওলিনের সিরামিক আরো উন্নত। এভাবে মানুষ তার অসহায়ত্ব কাটিয়েছে। একটি বৃহদাকার হস্তির মাহুত পাঁচ ফুট উচ্চতার একজন মানুষ। বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ। জোয়ানরা বয়স্কদের অনেকটাই হটিয়ে দিয়েছে। তবু কথায় আছে, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ – আপ্তবাক্যটি একেবারে ফেলে দেওয়ার সময় আসেনি।

বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অবদান হলো তামা-কাঁসা-পিতলের। এরপর আসে বয়ন888sport live chatের কথা। বয়ন888sport live chatে বাঙালি মধ্যযুগে পৃথিবীকে তাক লাগিয়েছে। তার জামদানি, বালুচরি, মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী সিল্ক বিখ্যাত। এর সামন্তরাল টাঙ্গাইল ও পাবনার দোগাছি। গরিবের তাঁত ধানখালিকেই বা বাদ দিই কী করে। তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমাদের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাইবোনরা সবাই চমৎকার বয়ন888sport live chatের অধিকারী। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের লোগো ছিল চরকা। বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতে থাকে বস্ত্র। কবি লিখছেন : ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই …’

রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যে স্থান দিয়েছেন :

পরণে 888sport appই শাড়ি

কপালে সিঁদুর …

888sport appর মসলিন বিশ^খ্যাত, এর সূক্ষ্মতার জন্যে। বাঙালি সংস্কৃতির আদি রূপটি ব্রতকথানির্ভর। তারপর আর্য-সভ্যতাকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক সনাতন ধর্ম ও ব্রতের মিশ্রণ। পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের অবস্থান। সব শেষে আসছে ব্রিটিশ ও 888sport app ইউরোপীয় দেশবাসীর খ্রিষ্ট-ধর্ম। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট দুই-ই। মুসলমানদের শিয়া-সুন্নি প্রধান। আছে কিছু অপ্রধান ধর্ম – যেমন বাহাই বা মতুয়া।

বাংলার নবাবি আমলের পতনের পর ইংরেজ বণিকগণ ইতিহাসের ধারা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার ইতিহাসের মৌলিক পালাবদল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পর নামেমাত্র মীরজাফর, মীর কাসিম প্রমুখ নবাব ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ পুরো ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। ইতিহাসের ধারায় একটি নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে। বাংলায় সামন্তবাদ পেছনে পড়ে যায়। তৈরি হতে থাকে ধনতান্ত্রিক, অর্থনীতি ও বিশ^-সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একীভূত হওয়া, যার পুরোধা ব্রিটিশরাজ। বিশে^ কমনওয়েলথ দেশসমূহের 888sport free bet ৫৬ – এ থেকেই বোঝা যায় এই যুগে তাদের শক্তির পরিমাণ। ধনতন্ত্র বিশ^কে যান্ত্রিক যুগে পরিণত করে। ব্রিটেন নিজ ভূমিতে মাত্র তিন মাসের খাদ্য উৎপাদন করে। বাকিটা কলকারখানার উৎপাদন মারফত সুরাহা।

ব্রিটিশ শাসন এদেশে ডিভাইড অ্যান্ড রুলের মাধ্যমে ভারতবর্ষের মতো একটি উপমহাদেশকে শাসন করে ১৯০ বছর। অর্ধেক সময় কোম্পানি, মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বাকি অর্ধেক ইম্পেরিয়াল শাসন।

কোনো দেশ তার দখলি সত্তা কখনো ছাড়তে চায় না। যেনতেন  প্রকারে অধিকার বজায় রাখতে চায়। ঘুস দিয়ে হোক, স্বায়ত্তশাসন দিয়ে হোক বা গায়ের জোরে গণহত্যা চালিয়ে হোক। ইতিহাসে যাওয়ার দরকার নেই – ১৯২১ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায় গণহত্যা ও গণধর্ষণ, যা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা। সুতরাং ইতিহাস আমাদের পড়তে হয় না। প্রতিটি সময় কালের যাত্রার অংশ মাত্র। আমরা কেউ এর ব্যতিক্রম নই।

ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির প্রথম আন্দোলনকারী জাতি হলো বাঙালি। এ-জাতিকে বিভক্ত করার জন্যে ব্রিটিশ শাসক প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে। পূর্বাঞ্চলের রাজধানী হয় 888sport app। এই অংশে আসামও অন্তর্ভুক্ত।

এদিকে ১৮৮৫ সালে সৃষ্টি হয় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস, জাতির অধিকার আদায়ের জন্যে। এর পরপরই মাত্র ২১ বছর পর প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম লীগ, ১৯০৬ সালে, 888sport appয়। লর্ড কার্জনের আমলে। ক্রমশ মুসলিম সম্প্রদায়কে তাতাতে থাকে ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু 888sport live chatী-বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদগণের আন্দোলনে তা রদ হয় ১৯২১ সালে। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান সৃষ্টির চাপ তৈরি হতে থাকে। এই আন্দোলন ১৯৪৬ সালে রক্তাক্ত রূপ নেয় কলকাতায় ও ভারতের 888sport app অঞ্চলে। ইতিহাসে কলকাতার দাঙ্গা ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে পরিচিত। দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নেয় নোয়াখালীতেও। মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গা প্রশমনে নোয়াখালী যান। স্বদেশি আন্দোলনের চাপ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শ্রান্ত ব্রিটিশরাজ ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগে তাদের যন্ত্রণা দেওয়ার কারণে অগ্রসরমান দুই জাতি বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের বিভক্ত করে যায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট। ভারত ডোমিনিয়নের শাসনভার ছেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয় দুটি রাষ্ট্র – তিনটি অংশের বিভক্তির মাধ্যমে। ভারতের পশ্চিমের সিন্ধু রাজ্য, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবের অর্ধেক – পূর্বে পূর্ববঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র। কী অদ্ভুত সৃষ্টি। পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতি কড়াই থেকে পড়ল আগুনে। তারা চিনতে পারেনি পশ্চিমের স্বধর্মী শত্রুদের। প্রায় জন্ম থেকেই বিমাতাসুলভ আচরণ। মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে না, যার সমাপ্তি ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে। একসময় ১৯৭১-এ সমস্ত বিবাদের সমাপ্তি। লাখ লাখ প্রাণ ও সম্ভমের বিনিময়ে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি আমলে বাঙালি-সংস্কৃতি প্রবল চাপের ফলে তার বাঙালিত্ববোধ আরো নতুন করে জেগে ওঠে। কিন্তু হায়! 888sport apps জন্মের পর ক্রমে ক্রমে সেই সংস্কৃতি এখন ধরেছে বকচ্ছপ মূর্তি। 888sport appsে শাড়িপরিহিত মহিলার 888sport free bet কম। টিপপরা প্রশ্নবিদ্ধ। বয়স্ক মহিলারাও সালোয়ার-কামিজে রূপান্তরিত, ভারতের বাঙালির বদল ঘটেছে। বাংলা সিরিয়ালে দেখি প্রেম বা বিরহের সময় একচেটিয়া হিন্দিগানের অনুপ্রবেশ।

এসব অদলবদলকে বড় করে দেখার কিছু নেই। বাংলা ১৯৩৮ থেকে বাঙালি মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীরা ছিলেন বাঙালি মুসলমান। তাই বাংলা ভাগ বেশিরভাগ মুসলমানই চাননি। বিশেষ করে নেতাজি সুভাষ, তার মেজদাদা শরৎ বসু, বর্ধমানের মুসলমান নেতা আবুল হাশিম প্রমুখ ব্যক্তি এবং আরো অনেকে এর প্রবল বিরোধিতা করেন। দেশ ভাগকে শুধু সাম্প্রদায়িক রূপ দিলে আসল ফাঁকিটা রয়ে যায় মূলত এটি শ্রেণি-সংগ্রামের ব্যাপার। আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নাজমুল করিম তাঁর ডক্টরেট থিসিসে চেজিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান-এ দেখিয়েছেন সনাতনী ও মুসলমান জমিদারদের অনুপাত। সনাতনধর্মী ৭১ শতাংশ আর মুসলমান জমিদার ২৯ শতাংশ। এই ৭১ শতাংশ সনাতনধর্মী উচ্চ শ্রেণী চাননি মুসলমান ধনিক শ্রেণীর উত্থান এবং বৃহত্তর ভারতীয় বাজার হাতছাড়া করতে। এদিকে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হলে লাভবান হচ্ছে উত্তর প্রদেশ। তারা ভারতের শাসনভার স্থায়ীভাবে নিজেদের হাতে রাখতে পারবেন – এই চিন্তা। তাই তারাও পাকিস্তান চেয়েছেন বাংলা ও পাঞ্জাবের ভাগের মাধ্যমে। এভাবে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার শ্রেণী-সংগ্রামের বিপদটা থেকে খুব কৌশলে বের হয়ে গেল সর্বভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ একটা বড় অস্ত্র সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের চিন্তাকে ঘুরিয়ে দিতে। বর্তমানে তিন দেশেই আজ নতুন করে ধর্মের উত্থান ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পশ্চাদপসরণ। আজ ধনতন্ত্র পুরোপুরি বাধাহীন। বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আছে, কিন্তু সর্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া যায় না।