ইন্দ্রাণী গুহরায়
৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কবি ভূমেন্দ্র গুহ’র 888sport app download apk দুই খ– প্রকাশিত হয়। কবি ভূমেন্দ্র গুহ, ডা. বি.এন. গুহরায়, আমার বাবা। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাহুল পুরকায়স্থ আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টায় এবং বাবার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় তাঁর সমস্ত 888sport app download apk ও প্রাসঙ্গিক রচনা জোগাড় করেছেন। আমার বাবার কাছে তাঁর নিজের লেখা অধিকাংশ 888sport app download apkর বই-ই ছিল না। তারপর রাহুল পুরকায়স্থের সম্পাদনায় এবং মুশায়েরা প্রকাশনা সংস্থার সহযোগিতায় হিরণ মিত্রের প্রচ্ছদে বইদুটি বেরোয়। বাবার হাতে বইদুটির প্রথম কপি আসে ৩০ নভেম্বরের দুদিন আগে। আমি টনসিলাইটিসের সংক্রমণে ২০ নভেম্বর থেকেই কাবু। অফিসও বন্ধ। বাবাই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন, তাই খাচ্ছি। ২৮ তারিখ সন্ধেবেলা বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন : ‘বুচুকুন্টু, আমার ঘরে এসো তো একবার।’ বাবা আমাকে এই নামেই ডাকতেন।
আমি গেলাম।
দেখলাম, বাবার মুডটা বেশ ভালো। খুব খুশি-খুশি। আমাকে বললেন : ‘দেখো তো, আমার বইয়ের মলাটটা কেমন হয়েছে। রংটা ভালো হয়েছে? হিরণ মিত্র করেছেন।’
বাবা ভিতরে-ভিতরে বেশ এক্সাইটেড ছিলেন। বাবাকে খুশি দেখে আমারও খুব ভালো লাগল। কোথাও একটা তাঁকে খুব পরিতৃপ্ত মনে হলো।
বললাম : ‘আমাকে তোমার বইয়ের একটা কপি দেবে না?’
বাবা খুব খুশি হয়ে আমাকে আলমারি থেকে বের করে একটা কপি দিলেন। বাহ্যিকভাবে অনুভূতির প্রকাশ না দেখালেও বেশ বুঝেছিলাম যে, উনি খুব খুশি হয়েছেন, ‘বুচুকুন্টু’ নিজে থেকে তাঁর বই চেয়েছে।
২০১৫-এর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন আমি অফিস থেকে ফেরার পর বাবা বললেন : ‘তোমার থেকে একটা পারমিশান নেওয়ার আছে।’
আমি খানিক রেগে গিয়েই বললাম : ‘পারমিশান আবার কী? বলো কী বলবে।’
বাবা বললেন : ‘সামনের সপ্তাহে আমার বইটার ট্রেসিং কপি প্রকাশকের হাতে দেওয়া হবে। সবাইকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলবো ভাবছি। একটু খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। তোমার মত আছে?’
আমি বললাম : ‘নিশ্চয়ই বলবে। আমাকে আগে থেকে দিনটা বলে দিও। খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত সব আমিই করবো।’
বাবা বেশ খুশি হয়েই বললেন : ‘বেশ বেশ, তাহলে আর চিন্তা নেই।’
তারপর সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে পুজোর আগে বাবা বললেন : ‘ওঁদের সামনের বুধবার আসতে বলেছি।’
আগের দিন রাতে বেশ আলোচনায় বসা হলো বাবার সঙ্গে। কী খাবার অর্ডার করা হবে, হোম ডেলিভারি নেওয়া হবে, নাকি আমিই অফিস-ফেরতা নিয়ে আসবো ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, তন্দুরি চিকেন আর কাবাব অর্ডার করে দেব আমি অফিস থেকে। ওরা বাড়িতে দিয়ে যাবে। আমি অফিস-ফেরতা খাবার আনার ঝুঁকি আর নিলাম না। যদি দেরি হয়ে যায় আমার ফিরতে। তাও সেদিন চেষ্টা করলাম, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে। বাড়ি আসছি অটো করে। হঠাৎ রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো, বাবা তো মাছভাজা খেতে ভালোবাসেন। সেখানেই অটো থেকে নেমে পড়লাম। ওখানে তপসে মাছভাজা পাওয়া যায় জানতাম। চার পেস্নট তপসে মাছভাজা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
ফিরে দেখলাম বাড়ি জমজমাট। রাহুল পুরকায়স্থ, প্রকাশক সুবল সামন্ত, প্রদীপ দত্ত, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক, সুধীর দত্ত, প্রশান্ত মাজী, আকাশদা, স্নেহাশিসদা সবাই হাজির। আমাদের ফ্ল্যাটের ছোট্ট বসার ঘর এক্কেবারে ভর্তি। বাবাও খুব খুশি। গল্প করছেন, হাসছেন, তার সঙ্গে চলছে তন্দুরি চিকেন আর কাবাব।
আমি মাছভাজাগুলো তাড়াতাড়ি পেস্নটে সাজিয়ে তাঁদের দিয়ে এলাম। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না খেতে। হিরণ মিত্রের আসতে একটু দেরি হলো। উনি এলেন প্রায় নটা নাগাদ। সেদিনই বাবার বইয়ের ট্রেসিং প্রকাশক এবং মুশায়েরার সুবল সামন্তের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ডিসেম্বরের শেষে ভূমেন্দ্র গুহর 888sport app download apk রাহুল পুরকায়স্থের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। প্রথম দুকপি বইয়ের মধ্যে এক কপি আমাকে দেন। আর এক কপি উনি নিজে হাতে শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
৩০ নভেম্বর রাহুলের বাড়িতে বাবার বই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। সেদিনের অনুষ্ঠানের ছবি আমি প্রদীপ দত্তের কাছ থেকে যখন পাই, বাবা তখন হাসপাতালে। প্রদীপ দত্ত পরম যত্নে ছবিগুলির একটি অ্যালবাম বানিয়ে আমাকে দেন। অনেক গুণী বিদগ্ধজন এসেছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানে। শঙ্খ ঘোষ, হিরণ মিত্র, রণজিৎ দাশ, প্রশান্ত মাজী, সুরজিৎ দত্ত, মনোতোষ চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক, সুবল সামন্ত সবাইকেই চিনতে পারলাম প্রদীপকাকুর তোলা ছবির অ্যালবাম থেকে।
আমার শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। বাবার দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে টনসিলাইটিস তো কমলো। কিন্তু আবার বাঁ-দিকের কানের মধ্যে একটা কঠিন ইনফেকশন ধরা পড়লো। তার সঙ্গে শুরু হলো প্রচ- যন্ত্রণা। তখন হঠাৎই বাবার না জানি কিসের তাড়াহুড়ো লেগে গেল। সেই সকাল থেকে কম্পিউটারে বসে পড়ছেন। একবারের জন্য আমার ঘরেও আসেন না। তখন আমার অ্যান্টিবায়োটিক আর পেইন কিলার চলছে। খুবই কাহিল অবস্থা। ব্যথায় রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছি না। মনে-মনে খুব অভিমান হচ্ছিল বাবার ওপর। বাবা এত ব্যস্ত যে, একবার আমার ঘরে এসে জিজ্ঞাসাও করেন না, কেমন আছি। দিন দশেক উনি শুধুই স্নান করতে আর খেতে ঘর থেকে বেরোতেন। আর সমস্তটা দিন মুখ গুঁজে কম্পিউটারে বসে থাকা। এরই মধ্যে যখন আমি আর ব্যথা সহ্য করতে পারছিলাম না, বাবার ওপর খুব অভিমান করেই বরুণকাকুকে ফোন করলাম। ডা. বরুণ রায়, আমার বাবার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে একজন। আমার প্রিয় কাকু সবসময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন যে-কোনো বিপদে, শরীর খারাপে। কাকুকে ফোন করে বললাম : ‘কাকু, আমি আর ব্যথা সহ্য করতে পারছি না, তুমি আমাকে ই.এন.টি. স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে চলো।’
সেদিন ছিল এক রোববার। কাকু আমাকে ডা. তুষারকান্তি ঘোষের কাছে নিয়ে গেলেন। আমার বাবা লেখায় মগ্ন। ডাক্তার বললেন, বাঁ-দিকের কানের ভিতরে ইনফেকশন হয়েছে। ওষুধ দিলেন ব্যথা কমাবারও। বরুণকাকু বাবাকে এসে সব জানালেন। আমার আবার নতুন করে ওষুধ শুরু হলো। ওষুধে কাজও করতে আরম্ভ করলো। চার-পাঁচদিন পরে হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম, আমার মুখের বাঁ-দিকের ঠোঁটটা বেঁকে যাচ্ছে। কুলকুচি করতে পারছি না। জল মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে যাচ্ছে। গলায় ইনফেকশনের জন্য তখন আমার বরাদ্দ খাবার ছিল খিচুড়ি। দেখলাম, তাও মুখ থেকে পড়ে যাচ্ছে। বাঁ-দিকের চোখটাও পুরো বন্ধ করতে পারছি না। একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। আবার বরুণকাকুকে ফোন।
কাকু সেদিনই সন্ধেবেলা এলেন। বাবাকে আর বরুণকাকুকে দেখালাম মুখের অবস্থাটা। দুজনেই বললেন, মুখের বাঁ-দিকের ফেসিয়াল নার্ভ ইনফেকটেড হয়ে গেছে। এটা এক ধরনের প্যারালাইসিস। এর নাম বেল্স প্যালসি। স্টেরয়েড ছাড়া এর কোনো ওষুধ নেই। এবার স্টেরয়েড শুরু হলো। তখনো লক্ষ করছিলাম, বাবার যেন কিসের ভয়ংকর তাড়া। কাজ করার সময় এবং দ্রম্নততা বাড়িয়েই চলেছেন। ভাবলাম, বুঝি বাবার বইটা বেরিয়েছে, সেটা নিয়েই প্রচ- উৎসাহিত হয়ে রয়েছেন। একদিন জয় গোস্বামীও এলেন আমাদের বাড়িতে। অনেকক্ষণ গল্পগুজব হলো বাবার সঙ্গে।
এভাবেই কাটছিল দিনগুলো। বাবা মগ্ন বাবার কাজে আর আমি অসুস্থ; ভাবছি, কবে অফিসে আবার জয়েন করতে পারবো। হঠাৎই ৯ তারিখ থেকে বাবার শরীরের ব্যথা-বেদনাগুলো ভয়ংকরভাবে চাগাড় দিতে শুরু করল। দিনটা ছিল বুধবার। বাবা দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারে বসে কাজ করতেন। ঝুঁকে পড়ে তাঁর আতশ কাচ দিয়ে জীবনানন্দের পান্ডুলিপি উদ্ধার এবং টাইপ করে চলতেন। আমরা সবাই তা জানতাম। সকালের দিকে কোমরে ব্যথা, এরপর ঘাড়ে ব্যথা – এসব লেগেই থাকত। ডা. বি.এন. গুহরায় তাঁর নিজের চিকিৎসা নিজেই করতেন। এই বিষয়টায় তিনি কারো মতামত বা তাঁর ছাত্রদের সঙ্গেও কোনো পরামর্শ করতেন না। কখনো-কখনো বাবাকে দেখেছি ইন্টারনেট সার্চ করে ওষুধের নাম বের করে নিচ্ছেন। কিন্তু ৯ তারিখ থেকে অবস্থাটা অতিদ্রম্নত গুরুতর হয়ে উঠলো বুঝতে পারার আগেই। তিনি কাজ করতে-করতে হঠাৎই উঠে এসে চিৎকার করতে লাগলেন : ‘আমার বাঁ-হাতটা পড়ে গেল, আমি আর টাইপ করতে পারছি না। আমি হাত তুলতে পারছি না।’ সে কী অসহায় ক্রোধ! মাধুরীদি তখন আমাদের বাড়িতে দুপুরবেলা খেতে দেওয়ার আয়োজন করছিল। কিছু বুঝতে না পেরেই মাধুরীদিকে বললাম : ‘দেখো তো, হাতে একটু ভলিনি বা অমৃতাঞ্জন মালিশ করে দিলে উপকার হয় কিনা।’
মাধুরীদি ছুটে গিয়ে বাবার হাতে ম্যাসাজ করে দিতে থাকল। কিছুক্ষণ বাদে তিনি একটু শান্ত হলেন। হাতের ব্যথাটা একটু কমেছে। বাবাকে বললাম : ‘বাবা, এখন আর টাইপ কোরো না। আবার বিকেলে চেষ্টা কোরো। খুব বেশি প্রেসার নিচ্ছ তুমি। তাই তো অমন হাতে ব্যথা হচ্ছে।’
আমার কথাটা ঠিক মনমতো হলো না বুঝতে পারলাম। কিন্তু কিছু বললেন না। বিকেলবেলা গায়ে হাত-পায়ের ব্যথাগুলো আরো যেন বাড়তে থাকলো। বারবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম : ‘কী হয়েছে বাবা?’ বাবা শুধু বলেন : ‘সারা শরীরে ভীষণ ব্যথা।
বাঁ-হাতটায় কোনো জোর নেই।’ বারবারই বলছেন : ‘কাজগুলো বাকি। আমি কথা দিয়েছিলাম। কাজগুলো করতে পারছি না।’ সন্ধেবেলায় সোফায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ, নিস্তব্ধ, চুপচাপ। তারপর দেখলাম আবার 888sport free bet login নিয়ে হাইলাইটার দিয়ে আন্ডারলাইন করে করে পড়া
শুরু করেছেন। আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এই তো আমার চেনা বাবা। তাহলে এখন ব্যথা একটু কম নিশ্চয়ই।
৯ তারিখ থেকেই শরীরটা আর তাঁর মস্তিষ্কের দ্রম্নতগামিতার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। সেটা তিনিও বুঝতে পারছিলেন। আমি, মা ও মাধুরীটি আমরা বোকার মতো ভাবছি যে, বাবা এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে কম্পিউটারে কাজ করছেন, ভারী ভারী বই বিছানায় শুয়ে বুকের ওপর নিয়ে পড়ছেন প্রতিনিয়ত – এর থেকেই এই ব্যথার সূত্রপাত। মা বলেই চলেছেন : ‘বয়েসটা হয়েছে সেটা তুমি ভুলে যাচ্ছ। এই বয়সে এত অত্যাচার অনিয়ম কোরো না।’
কে শোনে কার কথা। তিনি যে লিখতে পারছেন না, কম্পিউটারেও দেখতে অসুবিধা হচ্ছে – ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সব লেখা। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন তিনি। তাঁর ডাক্তারি থেকে অবসর নেওয়ার পর এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় নিরলস জীবনানন্দ-সাধনা, 888sport apps থেকে মূলানুগ জীবনানন্দ বেরোচ্ছে, তার কাজ যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ১০ তারিখেও বারবার সোফায় বসে বলে চলেছেন : ‘বুচুকুন্টু, কাজটা বোধহয় শেষ করতে পারবো না। আমি যে কথা দিয়েছিলাম।’
আমি ভিতরে-ভিতরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। ভাবছিলাম, আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বাবার ঠিক কী অসুবিধা হচ্ছে? আমি কীভাবে তাঁকে সাহায্য করতে পারি? বরুণকাকুকে কি একবার ডাকবো ফোন করে? বাবার অসহায়তা ধীরে-ধীরে আমাকে গ্রাস করছিল। শেষমেশ ১০ তারিখে ডা. বরুণ রায়, আমার মুশকিল আসান বরুণকাকুকে ফোন করে ডাকলাম। সন্ধেবেলা কাকু এলেন। বাবা ব্যথা কমানোর জন্য চারখানা পাইরেজেসিক খেয়ে ফেলেছেন। ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য একটু সহ্যের মধ্যে থাকে, আবার সহ্যের বাইরে চলে যায়। শুরু হয় বাবার অসহায় চিৎকার – মা গো, বাবা গো। বরুণকাকু অনেকক্ষণ বাবার ঘরে গিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বললেন। সব কথা অবশ্য আমি বুঝিনি। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাবা একেবারেই নারাজ।
বাবার প্রস্টেটে একটা অসুবিধা ছিল। বছর দুয়েক আগে উনি বলেন যে, ‘জানো, আমার এনলার্জ প্রস্টেট আছে। ভাবছি একবার পি.এস.এ.টা টেস্ট করাবো।’ বাবা যখনই কোনো টেস্ট করাতেন আমি অফিস থেকে ফিরেই জিজ্ঞাসা করতাম : ‘রিপোর্ট কী বলছে?’ উনি মুখে বলতেন, কিন্তু রিপোর্ট কোনোদিন দেখাতেন না। দু-বছর আগেও পি.এস.এ. টেস্টের পরে জানতে চাইলাম। উনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন : ‘ভেবো না বুচুকুন্টু, বুড়ো বয়সে সব পুরুষমানুষেরই এনলার্জ প্রস্টেট হয়। আমার পি.এস.এ.টা একটু বেশি আছে। এই বুড়ো বয়সে আমি আর কাটাছেঁড়া করবো না। ওষুধ খাবো। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা বিনাইন।’
দু-তিন বছর ধরেই বাবার অ্যালোপ্যাথি ছাড়াও হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, অরগ্যানিক প্রভৃতি ওষুধের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল। উনি ইন্টারনেট সার্চ করে আমাকে ওষুধ এনে দিতে বলতেন। ইমিউনিটি, লিভার, কোলেস্টেরল ইত্যাদির ওষুধ। আমি সিটি সেন্টার থেকে এনে দিতাম। উনি প্রস্টেটের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। তারপর এই বিষয়ে আর কোনোদিনই তাঁর সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। বাবা তাঁর ঘরেতেই একটি ছোট বালতি ও একটি মগ রাখা শুরু করলেন। বললেন : ‘রাত্রিবেলা হিসি পেলে বাথরুম অবধি যেতে পারি না তো। হিসি ধরে রাখতে পারি না। এনলার্জ প্রস্টেটে এরকম হয়। আর বয়সের জন্যও সব অর্গানের ইলাসটিসিটি কমে যায় তো।’ আমি বিশেষ তর্ক কোনোদিনই করতাম না বাবার সঙ্গে। উনি ডাক্তার, উনিই সবচেয়ে ভালো বুঝবেন তাঁর শরীরের অবস্থা।
কিন্তু ৯ তারিখের পর থেকেই লক্ষ করলাম যে, উনি ইউরিন কন্ট্রোল করতে একেবারেই পারছেন না। আর ইউরিন করতে গেলেও বোধহয় ব্যথা লাগছে। এটা আমার ধারণা। বাবাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর পাইনি।
১১ তারিখের রাতে হঠাৎই তিনি বললেন : ‘আজকে বুঝলে বুচুকুন্টু, শরীর বেশ ভালো লাগছে, হাতে আর ব্যথা নেই।’ সাড়ে দশটার সময় মাকে ওষুধ গুছিয়ে দিতে চলে এলেন। গত দশ বছর বাবাই নিজ হাতে কৌটোতে করে-করে সকাল, দুপুর, রাতের ওষুধ মাকে গুছিয়ে দিতেন। শুধু বাবা শান্তিনিকেতনে গেলে দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে পড়তো। দু-তিন দিন শারীরিক তীব্র যন্ত্রণার ফলে মাকে ওষুধ দিতে পারেননি। শুক্রবার একটু সুস্থ বোধ করেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে এসে উপস্থিত। হাত ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখালেন : ‘দেখো, আজ হাতে ব্যথা নেই।’ একটু স্বস্তি পেলাম। বাবা সুস্থ হয়ে উঠছেন।
কিন্তু প্রতি রাতেই আবার সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা এবং বারবার ইউরিন হচ্ছে। কিন্তু লক্ষ করলাম, একটা ডিসওরিয়েন্টেশন কাজ করছে। উনি আমাকে তো ধরতে দেবেন না। কিন্তু আমি দেখতাম, উনি মগ এক জায়গায় ধরে আছেন আর সব হিসি মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞাসা করতাম : ‘বাবা, আমি ধরবো মগটা?’ প্রচ- বিরক্তিতে বলতেন, ‘আমিই পারবো। ঘরে ঢুকবে না।’ বাবা রাত্রিবেলা আ্যালজোলাম খেতেন। তখন সেও আর ঘুম আনতে পারছে না, এতটাই তীব্র ব্যথা।
৯ তারিখ থেকে ১২ তারিখ, প্রতি রাতেই আমি অসহায়ের মতো সারারাত বাবার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। যতবার মেঝেতে ইউরিন পড়ে যায়, তাড়াতাড়ি গিয়ে মুছে দিই। যদি ইউরিনে আবার পা পিছলে পড়ে যান। আর সারারাত একটু-একটু ঘুমোন, আবার ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করতে থাকেন। আমি ঘর মোছার কাপড় হাতে নিয়ে তটস্থ হয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। রাতগুলো মনে হতো যেন বিভীষিকা। নিজেকে একা আর অসহায় লাগতো। বাবাকে এরকম অসহায়, অশক্ত দেখিনি তো কখনো।
১২ তারিখ দুপুরবেলা হঠাৎ আমার রেখা-পিসি এলেন। আমার তখনো স্টেরয়েড চলছে। বাবা বোধহয় ফোনে পিসিকে বলেছিলেন : ‘বুচুকুন্টুর শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে।’ সেদিন আমার জন্মদিনও ছিল। বাবা বেশ সুস্থই বোধ করছিলেন। সারাটা দুপুর বাবা, মা আর পিসি বসার ঘরে আড্ডা মারলেন। আমিও খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি। হঠাৎ বিকেলবেলা বাবা বলে উঠলেন : ‘বুকে খুব ব্যথা করছে।’ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে। আমি পিসিকে বললাম : ‘তুমি বাবার কাছে থাকো, আমি ডাক্তারকে ফোন করছি।’ মা নার্ভাস হয়ে গেছেন। আমার নার্ভাস হলে চলবে না। বরুণকাকুকে ফোন করলাম। আমার দুর্ভাগ্য, কাকু তখন কল্যাণীতে। কাকু বললেন : ‘মামণি, পস্নাবনকাকুকে ফোন করো।’ ডা. পস্নাবন মুখার্জি বাবার অন্যতম প্রিয় ছাত্র। পস্নাবনকাকুকে ফোন করলাম তৎক্ষণাৎ। পস্নাবনকাকু আমাদের বাড়ির কাছেই আনন্দলোক হাসপাতালে একটা অপারেশন করছিলেন। কাকু বললেন : ‘এক্ষুনি সরবিট্রেট দিয়ে দে। আর ঘাম হচ্ছে কিনা দ্যাখ। আমি ও.টি. শেষ করে আসছি।’
আমি সরবিট্রেট দেওয়ার আগেই বাবা নিজেই খেয়ে নিয়েছেন। ঘাম হচ্ছিল না। তারপর পিসি হটপ্যাড দিয়ে দিলো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে স্নেহাশিসদা চলে এসেছেন। উনি বাবাকে ডি.টি.পি. করা আর জীবনানন্দের পান্ডুলিপি উদ্ধারের কাজে সাহায্য করেন। বাবার
কথায় খুব লক্ষ্মী ছেলে। তারপর অরুণাভ এসে হাজির। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে-শুয়ে বাবা তাঁকে আবার আগামী দিনের কাজ বোঝাতে শুরু করেছেন খুব ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে। পিসিকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলাম : ‘পস্নাবনকাকু আসা পর্যন্ত একটু থেকে যাও পিস্নজ।’
প্রায় সাড়ে আটটা-নটার সময় কাকু এলেন। মনে হলো আর ভয় নেই। এবার কাকু সব দেখে নেবে। আর একা নই। বাবা শুয়ে-শুয়েই কাকুর সঙ্গে কথা বললেন। কাকু বাবার জন্য রাতের কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন। বললেন : ‘স্যর, হাসপাতালে চলুন, আমরা একবার পুরো ব্যাপারটা চেক-আপ করি। আর এত ওষুধ কেন খান, সেটাও দেখা দরকার।’
বাবা হাসপাতালে যেতে রাজি হলেন না। বললেন : ‘হাসপাতালে যাবো না, যাবো না। এখন তো মনে রাখতে পারি না, তাই সব ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে নিই।’ পস্নাবনকাকু বেশ বাবার মতো মেজাজ নিয়েই বললেন : ‘স্যর, ঞযরং রং হড়ঃ ধপপবঢ়ঃবফ.’ কাকু আমাকে আলাদা ডেকে বললেন : ‘রাতটা দেখে সকালে জানা আমাকে।’ ১২ তারিখ রাতে নিজের উদ্যোগেই একটি আয়া ডেকেছিলাম সেন্টার থেকে। বাবা রাজি ছিলেন না, তাও। আমার কাছে রাতগুলো খুবই ভয়ের ছিল। মনে হতো, যদি সামলাতে না পারি, একজন তো থাকবে। সেদিন রাতে স্নেহাশিসদাকেও অনুরোধ করলাম রাতটা থেকে যেতে আমাদের বাড়িতে। সে-রাতে আমরা সবাই জাগা সারারাত। বাবা প্রায় বারো থেকে তেরোবার ইউরিন করলেন। সেদিন আর দাঁড়িয়ে উঠে ইউরিন করতে পারছিলেন না। বোঝার আগেই বিছানা ভিজে যাচ্ছিল। আর সেই মা গো, বাবা গো গোঙানি। আমি ভোর চারটের দিকে পস্নাবনকাকুকে ফোন করলাম। এবার আর কারো কথা শোনা নয়। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে। পস্নাবনকাকু কিছু সময় চাইলেন বেড রেডি করার জন্য।
সকাল নটায় ডা. সুব্রত গোস্বামী এলেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। বাবা খুব ভালোবাসতেন সুব্রতকাকুকে। বাবা সুব্রতকাকুকে বললেন : ‘বসো।’ নিজে উঠে গিয়ে বেসিনে মুখ ধুলেন, চুল আঁচড়ালেন। মা পাঞ্জাবি বের করে দিলেন। বাবা বললেন : ‘যাওয়া কি খুব দরকার?’ কাকু বললেন : ‘হ্যাঁ স্যর। একবার পুরো চেক-আপ হওয়াটা খুব জরুরি।’ বাবা বললেন : ‘আচ্ছা, মেয়ে বলছে বলেই যাচ্ছি।’
১৩ ডিসেম্বর বাবাকে ভর্তি করা হলো বাবার হাতে তৈরি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিও থোরাসিক ডিপার্টমেন্টে, তাঁরই ছাত্র ডা. পস্নাবন মুখার্জির আন্ডারে, যিনি এখন থোরাসিকের বিভাগীয় প্রধান। বাবা হাসপাতালে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারেননি বোধহয়। যে-ডিপার্টমেন্টে ডা. বি.এন. গুহরায় দাপট ও মেজাজের সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন এতগুলো বছর, সেখানে সেই ডিপার্টমেন্টের বেডে শুয়ে তিনি আজ একজন পেশেন্ট। কিছুক্ষণের জন্য একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাঁর মধ্যে। পরে অবশ্য তিনি স্বাভাবিক আচরণই করেন। ১৪ ডিসেম্বর থেকে পস্নাবনকাকুর তত্ত্বাবধানে এবং 888sport app ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডাক্তারদের পরামর্শমতো সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। পস্নাবনকাকু তাঁর হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিনই তিন-চারবার বাবাকে এসে দেখে যান। তখন দায়িত্বে ছিলেন একজন মেডিক্যাল অফিসার এবং একজন থার্ড ইয়ারের পিএইচ.ডির ছাত্র। এ ছাড়া বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররা বাবাকে এসে দেখে গেছেন প্রতিনিয়ত। ১৪ তারিখ থেকে আমার দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। সকাল নটায় হাজির হয়ে যেতাম হাসপাতালে। কখনো প্যাথলজি ল্যাব, কখনো বস্নাড ব্যাংক, কখনো মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব; বিভিন্ন জায়গায় বাবার রক্তের নমুনা ও রিকুইজিশন জমা করা, আবার রিপোর্ট আনা এসব শুরু হলো। বাবার বন্ধুরা – প্রশান্ত মাজী, প্রদীপ দত্ত, সুধীর দত্ত, গৌতম বসু, সুরজিৎ কী অসাধারণ আন্তরিকতা ও বাবার প্রতি ভালোবাসায় আমার পাশে-পাশে থেকেছেন। রাহুল পুরকায়স্থ, অমস্নান দত্ত, অরুণাভ, হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, একরাম আলি, নমিতা চৌধুরী, অনুরূপ ভৌমিক, বিমল ধর, অমিয় দেব, কালীকৃষ্ণ গুহ, গৌতম চৌধুরী, গৌতম ম-ল, আকাশ ঘোষ, অর্ণব চট্টোপাধ্যায়, শান্তনু, অধীর বিশ্বাস, প্রদীপ ভট্টাচার্য, 888sport appsের আবুল হাসনাত ভাই, নয়া উদ্যোগের পার্থশঙ্কর বসু, সুকল্প চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্টজন যখনই সময় করতে পেরেছেন, বাবাকে দেখতে এসেছেন। বয়স-নির্বিশেষে বাবা এত গুণমুগ্ধ ব্যক্তিদের ভালোবাসা পেয়েছেন, আমি সেই হাসপাতালের ব্যস্ততার মধ্যেও দেখে অবাক হয়ে গেছি।
১৩ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি চলল। কখনো আমার লুনাদিদি, কখনো আমার বাপিদিদি, কখনো সুরজিৎ, কখনো কৌশিক তাদের চাকরির সময়টুকু ছাড়া আপ্রাণভাবে আমাকে সাহায্য করে চললেন। আমার বড় মাসি-পিসিদের সবারই বয়স বেড়েছে। শারীরিকভাবেও অসুস্থ। তার মধ্যেই বড় মাসি প্রায় রোজ দুপুরবেলা থেকে আই.টি.ইউর বাইরে একটি ছোট্ট চেয়ারে গিয়ে বসে থাকতেন। আমি তো রক্ত, পেস্নটলেট, রিপোর্ট ইত্যাদি জোগাড় করার জন্য দৌড়োচ্ছি। বড় মাসি অকৃত্রিম 888sport apk download apk latest versionর সঙ্গে মাঝে-মাঝে ঢুকে বাবাকে দেখে আসতেন। অপেক্ষা করতেন, ডাক্তার যদি নতুন কোনো নির্দেশ দেন। আমাকে ফোন করে জানাতে হবে যে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররা আসছেন। তাঁর কেস হিস্ট্রি জানতে চাইছেন।
সকালে এসেই বাবার কাছে যেতাম। বাবা বলতেন : ‘ব্যথাটা কমছে না বুচুকুন্টু।’ হঠাৎই বললেন : ‘রাহুল কখন আসবে?’ আমি বললাম : ‘বিকেলে।’ বাবা বললেন : ‘রাহুলকে বলো, আমার গলাটা টিপে দিতে। এই ব্যথা সহ্য করা যায় না।’
রাহুল পুরকায়স্থকে বাবা আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন রাহুলের প্রতি, তাঁর বইয়ের সম্পাদনা করেছিলেন বলে। বহুবার বলেছেন আমাকে।
পিসিরা রোজ আসতেন বিকেলবেলা তাঁদের প্রিয় দাদাকে দেখতে। তাঁরা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। কথা বলতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন আই.টি.ইউর বাইরে। আমি সবসময় সবার সঙ্গে কথাও বলতে পারতাম না। আমাকে যে সব বন্দোবস্ত করতে হবে ডাক্তার যা-যা বলছেন। তাঁদের আমি কিছু বলিনি। তাঁদের বয়স হয়েছে। পাজলড হয়ে পড়বেন হয়তো।
এটা আমার লড়াই। আমার বাবার জন্য আমার লড়াই। দেখছিলাম তো, কী অমানুষিক মনের জোরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাবা লড়ে যাচ্ছেন।
১৫ তারিখ থেকে এক-এক করে রিপোর্টগুলো আসতে থাকল। আই.টি.ইউতে যে মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। জানতে পারলাম, বাবার সারা শরীরে এবং রক্তে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে গেছে। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম সেপটিসিমিয়া ড/উওঈ। সারা শরীরে বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে, যাকে বলে হোমাটোমা। পেস্নটলেট কমে ২৭০০০-এ নেমে গেছে। পস্নাবনকাকুর সঙ্গে তক্ষুনি কথা বললাম। কাকুর ধারণা, প্রস্টেট থেকেই এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের একটি ল্যাবে পি.এস.এ. টেস্ট করতে পাঠানো হলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম আরো দু-তিন রকম রিপোর্ট করাবার জন্য। ওই পরীক্ষাগুলো মেডিক্যাল কলেজে হয় না।
বাবার কাছে যাই সারাদিনের সব ছোটাছুটির পর। বাবার বোধহয় দেখতেও সমস্যা হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম। আমি গিয়ে বলতাম : ‘বাবা, আমি বুচুকুন্টু এসেছি।’ বাবার দুচোখ জলে ভরে আসতো। বলতেন : ‘তুমি থাকো।’
‘আমি তো আছি বাবা সারাদিন। চিন্তা করো না। ভালো হয়ে যাবে।’
সমস্ত রকম ওষুধ চালু হয়ে গেল। ইনফেকশনটাকে কন্ট্রোলে আনতে হবে তো। আমি মেডিক্যাল কলেজের বস্নাড ব্যাংকে পেস্নটলেট পেলাম না। বাইরে দৌড়লাম। কলকাতা শহরের কোন বস্নাড ব্যাংকে পাওয়া যাবে। ভাগ্যিস সঙ্গে একটা ভাড়া করা গাড়ি ছিল। ক্রায়ো জোগাড় করতে হবে, সেটা পেস্নটগুলো যাতে ভেঙে না যায় তার সিমেন্টিং করবে। আমার লুনাদিদির স্বামী মুশকিল আসানের মতো ফোন করতেই এসে উপস্থিত। কিট্টুদাদা আমার আরেকজন মুশকিল আসান। কিট্টুদাদা মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পেস্নটলেট আর ক্রায়ো খুঁজতে। রাত ১টা পর্যন্ত কলকাতা ও শহরতলি খুঁজে ক্রায়ো জোগাড় করা গেল না। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পেস্নটলেট কাউন্ট বাড়াবার।
১৬ তারিখ থেকে বাবা একটু ঝিমিয়ে পড়লেন। সেই মেজাজ তখন শান্ত। খাওয়ানো যাচ্ছিল না কিছুতেই। পিসিরা রোজ আসেন নিয়ম করে। বড় মাসিও আসেন। বাবার বন্ধুরা যে যেরকমভাবে পারছেন সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছেন আমাকে। না হলে এই যুদ্ধ করা হয়তো সম্ভব হতো না আমার পক্ষে।
বিকেলবেলার দিকটা একটু ভালো থাকলে কথা বলেন রাহুল এলে। সুধীরকাকু, প্রশান্তকাকু এলে এরই মধ্যে 888sport live footballের কথা বলেন। পিসিরা এলে খুবই খুশি হন, তবে বুঝতে পারছিলাম
আসেত্ম-আসেত্ম ডিসওরিয়েন্টেড হয়ে যাচ্ছে তাঁর কথাগুলো।
রাতে যখন ১১টার সময় বাড়ি ফিরতাম, কোথাও মনটা কেঁদে
উঠতো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম বোধহয়, ‘ঠাকুর, বাবাকে আর কষ্ট দিও না।’ এ-কষ্ট দেখা যায় না। সেই মেজাজি, দাপুটে, রাগি আমার বাবা এত অসহায়। এটা বোধহয় মেনে নিতে পারছিলাম না।
সারাটা দিন। বিশ্বস্ত সৈনিকের মতো বাবার জন্য লড়াই করতাম। যা-যা ডাক্তাররা বলতেন সেরকম। আমিও যে পুরোপুরি সুস্থ নই, এই অনুভূতি কাজই করেনি তখন। না শারীরিকভাবে, না মানসিকভাবে। কী এক প্রবল শক্তি ঈশ্বর জুগিয়েছিলেন আমার মধ্যে।
১৭ তারিখ বাবার সি.টি. স্ক্যান করা হলো। মাথার বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। পি.এস.এ. রিপোর্টও এসে গেল। প্রায় ৫৫০-এর ওপর তার মাত্রা। পেস্নটলেট কাউন্ট কিছুটা ওপরের দিকে উঠেছে। কিন্তু কেন জানি না, মনে প্রশ্ন উঠছিল : ‘বাবা কি রিভাইভ করতে পারবেন?’ বাবাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না একেবারেই। খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পস্নাবনকাকু এবং 888sport app মেডিক্যাল অফিসার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। তাঁরা আমাকে তখনো ভরসা দিচ্ছেন। কিন্তু মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ দ্রম্নতগতিতে বেড়েই চলল। মেডিক্যাল অফিসাররা বলাবলি করছেন, কানে এলো : ‘অন্য পেশেন্ট হলে তো এতক্ষণে কোমায় চলে যেতেন।’
এখন বেশিরভাগ সময় বাবা ঘুমিয়েই থাকেন বা ঝিমিয়ে থাকেন। আমি যাই বাবার মাথায় হাত বোলাই, পায়ে হাত বুলিয়ে দিই। আবার বেরিয়ে আসি।
১৭ তারিখ বিকেলের দিকে বাবার কাছে গেলাম। বাবা বলে উঠলেন : ‘কে? কে?’ আমি বললাম : ‘আমি বাবা।’ বাবা বললেন : ‘আমিটা কে?’ আমি বললাম : ‘আমি মেয়ে, তোমার বুচুকুন্টু।’
বাবার তখন চোখের দৃষ্টি চলে গিয়েছিল। ডুকরে কেঁদে উঠলেন : ‘আমার বুচুকুন্টু – আমার বুচুকুন্টু।’ আমি কেঁদে ফেললাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাবার মাথায় হাত বোলালাম। বাবা ঘুমিয়ে পড়লেন।
১৮ তারিখ সকালে মা, নানমাসি আর মেজমামাকে নিয়ে গেলাম। ভয় পাচ্ছিলাম। মা, নানমাসি দুজনেরই পায়ে অস্টিওপোরোসিস। হেঁটে যেতে পারবেন তো।
আশ্চর্যজনকভাবে সকালে আই.টি.ইউতে পৌঁছে দেখলাম পস্নাবনকাকু হাজির। বাবা বিছানায় উঠে বসে কথা বলছেন। কাকু বললেন : ‘মাকে নিয়ে আয়।’ আমি বেশ খুশি এবং অবাকও বটে।
মাকে নিয়ে এলাম। পেছন-পেছন এলেন নানমাসি, মেজদুমামা। বাবা কথা বলছেন। সামনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত দেখতে পাচ্ছেন না। আমি বললাম হাতটা ধরে : ‘বাবা, মা এসেছেন।’ বাবা শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বলে উঠলেন : ‘তোমার মা এসেছেন। তুমি এসেছো। এ আমার পরম সৌভাগ্য। তুমি এসেছো।’ মা কাঁদছিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন বাবার।
বাবাকে বললাম : ‘বাবা, নানমাসিও এসেছে।’ আমার মাসি বাবার পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। হাসিমুখে খুব খুশি হয়ে বলে উঠলেন : ‘কী পরম সৌভাগ্য আমার।’ বাবা কী খুশি। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্নও নেই। বাবাকে বললাম : ‘বাবা, মেজদুমামা এসেছেন।’ এই আমার মেজমামা একসময় বাবার সর্বকাজের সঙ্গী ছিলেন, বাবার বিয়ের পরে-পরে। এই মেজমামা এবং নানমাসির হাতেই অনেকাংশে আমি মানুষ।
মামা আসেত্ম করে বাবার হাতটা ধরলেন। বাবা একবার কেঁদে উঠলেন। চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি মুছিয়ে দিলাম। সেদিন বাবাকে বেশ হাসিখুশি আর ফ্রেশ লাগল। আমার বেশ অবাক লাগছিল। মনের কোণে কোথাও একটা অজানা ভয়ও কাজ করছিল। সেটা কী, জানি না।
তারপর আমি, বড়মাসি ও আমার জামাইবাবু পার্থদাকে হাসপাতালে রেখে আবার পেস্নটলেটের সন্ধানে বেরোলাম। সুধীর দত্ত জানালেন, ভারুখা বস্নাড ব্যাংকে পেস্নটলেট পাওয়া যাবে। ওখানেই দৌড়ালাম। রক্তের বন্দোবস্ত পার্থদা করে ফেলেছে। পস্নাবনকাকুর নিজস্ব উদ্যোগে শেষ দুদিন ক্রায়োর বন্দোবস্তও করা গিয়েছিল।
পেস্নটলেট নিয়ে ফিরে লিফটে উঠছি। একজন সিনিয়র নার্স বললেন : ‘তাড়াতাড়ি যান।’ আমি ছুটে ওপরে এলাম। আই.টি.ইউতে আমাকে ঢুকতে দিলো না। ডাক্তার বললেন : ২টা ৩০ নাগাদ বাবার একটা কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয় এবং ওনাকে ইনকিউবেটেড ভেন্টিলেশনে দেওয়া হচ্ছে।’ তখনো মনে হচ্ছিল যে, মানুষ ভেন্টিলেশনে থেকেও তো রিভাইভ করে। মাথাটা ঠিক কাজ করছিল না। বাবা সকালবেলা এত প্রাণোচ্ছলভাবে কথা বলল। কানের মধ্যে বাজছিল : ‘আমার বুচুকুন্টু, আমার বুচুকুন্টু।’ মনের গভীরে একটা কথা বারবার ঘা দিচ্ছিল। তাহলে কি মাকে একবার দেখার জন্য, একটিবার স্পর্শ পাওয়ার জন্য বাবা অপেক্ষা করছিলেন!
১৮ তারিখটা এভাবেই চলে গেল। বাবা এখন টোটাল লাইফ সাপোর্টে। নিস্তব্ধ। আর কথা বলছেন না। নড়াচড়া বন্ধ। ডাক্তারদের কথামতো পেস্নটলেট, রক্ত, ক্রায়ো সব জোগাড় করে দিয়ে এলাম। বাবার সব বন্ধু, পিসিরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করে তাঁকে চোখের দেখা দেখে চলে গেলেন। আর আমার, যতক্ষণ থাকা যায়, বাবার হাতেই তৈরি এই আই.টি.ইউর বাইরে, ওয়ার্ডের প্যাসেজে অপেক্ষা করে। অবশেষে আমিও ফিরে এলাম রাত প্রায় ১২টা নাগাদ।
১৯ তারিখও সকালে চলে গেলাম। এখন আর আমার দৌড়াদৌড়ির বিশেষ দরকার নেই। ডা. সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী এসে দেখে গেছেন বাবাকে। বাবার প্রথম থেকে প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। কাকু আমাকে চিনতে পারেননি, অনেক বড় হয়ে গিয়েছি আমি। বললেন : ‘ভালো দেখলাম না রে স্যারকে।’ বুঝলাম, লড়াই এবার শেষের পথে। এবার শুধুই অপেক্ষা। বিকেলবেলা সবাই নিয়ম করে এলেন। 888sport apps থেকে আবুল হাসনাত ভাই বাবার সম্পাদিত মূলানুগ জীবনানন্দের সদ্য প্রকাশিত বই-দুটি নিয়ে এসেছিলেন। বাবা দেখতে পেলেন না।
বিকেলে ডা. সুব্রত গোস্বামী এলেন। যদি লাইফ সেভিং কোনো ড্রাগস লাগে, সমস্ত বন্দোবস্ত উনি করলেন ওষুধের দোকানের সঙ্গে কথা বলে। সন্ধের দিকে পস্নাবনকাকু বললেন : ‘এখন কোনো ওষুধ যেন না কেনা হয়। পরে দরকার লাগলে বলা হবে।’ সন্ধের পর থেকে দুটো লাইফ সাপোর্টে আর কাজ হচ্ছিল না। চারটা লাগানো হলো। পিসিরা ও বাবার বন্ধুরা চলে গেলেন, রাত যে বাড়ছে। সবাই অনেক দূরে থাকেন। বাড়ি ফিরতে হবে যে। তখন আর শুধু দুঃসংবাদটা পাওয়ার অপেক্ষা। প্রতিটা মিনিট তারই প্রতীক্ষা। সুব্রতকাকু হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসারকে বলে গিয়েছেন, খবর যেন সরাসরি আমাকে না দেওয়া হয়। আগে তাঁর কাছে যেন ফোন করা হয়।
পস্নাবনকাকু এসে গেছেন। রাত সাড়ে আটটা। আমি, কৌশিক (আমার পিসির মেয়ের স্বামী) এবং অমস্নান দত্ত আমরা অপেক্ষা করছি। পস্নাবনকাকু আমাকে বারবারই বাড়ি চলে যেতে বলছেন। প্রায় আধঘণ্টারও বেশি সময় তিনি তাঁর চেম্বারে নিয়ে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। বললেন : ‘স্যারের থেকে শিখেছিলাম, রুগির শেষ নিঃশ্বাস অবধি লেগে থাকতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে না। আমরা তাই করে যাচ্ছি।’ পস্নাবনকাকু অনেক রাত অবধি বাবার কাছে রইলেন। তখন অলরেডি ইউরিন বন্ধ হয়ে গেছে, সন্ধে থেকে মাল্টি অরগান ফেলিওর শুরু হয়ে গেছে।
শেষবার দেখতে গেলাম বাবাকে। প্রচুর যন্ত্রপাতির মধ্যে নিস্তব্ধ শুয়ে বাবা। বুকটা শুধু হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। বাড়ি ফিরে এলাম। রাত্রে জেগে একা প্রতীক্ষায়। ভোর ৪টায় আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। সুব্রতকাকুর কণ্ঠস্বর : ‘খবর এসে গেছে। ৩টা ৫০ মিনিটে সব শেষ। আমি সবাইকে ফোন করে খবরটা দিয়ে দিলাম।’
১৯ তারিখ রাত ৩টা ৫০ মিনিটে উনি এই দেহ ছেড়ে সূক্ষ্ম শরীরে চলে গেলেন।
এবার বাবার শেষযাত্রার সমস্ত আয়োজন করার পালা। সাতদিনের লড়াইয়ের অবসান। সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধা হলো নিমতলা মহাশশ্মানে।
আমার কানে এখনো বাবার কণ্ঠস্বর : ‘আ-মা-র-বু-চু-কু-ন্টু,
আ-মা-র-বু-চু-কু-ন্টু।’ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। উনি কোনার ঘরে বসে আতশ কাঁচ দিয়ে আজো জীবনানন্দের পান্ডুলিপি উদ্ধার করে চলেছেন।
ওরহান পামুকের কথায় : ‘Every man’s death begins with the death of his father.’

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.