দূরপ্রান্ত বালক, আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, একদিন কবি হবে তুমি।
বাইচের নৌকোর টান তোমার শরীরে এখন তরতর করে উঠছে,
বীজতলার সবুজ তোমার চুলে এখনই, তোমার শাপলা এখনি লাল,
সরল স্বচ্ছ জল এখন নালার ওপর দিয়ে বহে যাচ্ছে, তুমি পা ডুবিয়ে,
মাছের বা নক্ষত্রের ঝাঁক চঞ্চলতাই যেন এখন তোমার করোটিতে,
গুঞ্জন করছে অরুণ পতাকা হাতে ভোর অথবা প্রান্তরের বুকে পূর্ণিমা,
কী একটা শব্দ যেন, কোথাও তাঁবু পড়ছে, শীতের সার্কাস হবে, তুমি
শিস দিয়ে উঠছো থেকে থেকেই, গাছের পাতা হয়ে উঠছে মুকুট,
সোনালি ডিমের মতো খসে পড়ছে চাঁদ, ভোর খুলে যাচ্ছে দরোজায়,
পয়সার মতো আছড়ে পড়ছে আলো, উঠোনে পোঁতা খাড়া বাঁশটিকে
দৌড়ে তুমি দাঁড়িয়ে পড়ছো ধরে, এক পা মাটি আঁকড়ে গোড়ালিতে,
অন্য পায়ে অবিরাম ঘুরে চলেছো তুমি, তোমার কণ্ঠ থেকে উড়ছে
শব্দের সহস্র চড়ুই, গনগন করছে ঘন দুপুর, চারদিকে রন্ধনের ঘ্রাণ,
বৃষ্টির শব্দ, অলংকারের শিঞ্জন, দৃশ্যের চন্দন, এত ভোজ্য তোমার,
এতগুলো পেয়, কিন্তু নিবৃত্তি নেই কিছুতেই, ঠোঁট বেয়ে দুধ পড়ছে,
রস পিঠের মতো টসটস করছে তোমার মুখ, মুখের ভেতরে জিহবা
আমাদের উচ্চারণ-সূত্র, করোটির ভেতরে চিত্র আমাদের ভাবনা-সূত্র,
আমরা এ রকম আরো দু’একবার দেখেছি, আরো একবার দেখছি,
দূরপ্রান্ত বালক, আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, একদিন তুমি কবি হবে।
বালক, আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, বাঁধন তোমাকে বাঁধবে না, গ্রাম
তোমাকে মুক্তি দেবে, শহর তোমাকে গান শোনাবে, আর রাজধানী
তোমাকে মিছিলের পা পরিয়ে দেবে পায়ে। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি,
বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে তুমি দরোজায় দরোজায় নাড়ছো শেকল।
তোমার পা টলছে পাঁড় মাতালের মতো কিন্তু স্থির আছো তুমি ভাষায়।
খোলো! খোলো! তোমার হাত কাঁপছে সুচের ছিদ্রে সুতো পরাবার,
কিন্তু বিস্ফারিত তোমার ঠোঁট বলছে, আমাকে চুম্বন দাও হে সময়!
তোমার শরীর থেকে ক্রমাগত নামছে বন্যা, তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছো তুমি। মাদলের ঘোর শব্দ।
বলোক উথলানো ভাতের গন্ধের মতো শব্দ, আমি দেখতে পাচ্ছি
তুমি ছুটছো সেই দিকে, তোমার পায়ের নিচে মড়মড় করে উঠছে
বিবর্ণ হলুদ পাতা পৃথিবীর যা কত দীর্ঘ ইতিহাসের ওপর পড়ছে,
পড়ে পড়ে পাহাড়, ওদিকে ব্রহ্মপুত্রের আঙুল চলছে তোমার চুলে।
পতাকার মতো বাতাসে উড়ছে তোমার বোতামখোলা নীল জামা,
আমের মৌসুমে ক্ষিপ্ত ষাঁড়, প্রান্তর ভেঙে চলেছো, ওই খুরে খুরে
শব্দে শব্দে ব্যাকরণ ছন্দোবোধ অবিরাম ছেনে উঠছো, আর দেখছি
888sport app download apkর বৃষ্টিপাত এই স্তব্ধতার দেশে, আমি বেশ স্পষ্টই দেখছি।
বালক, একদিন একটি হাত তোমাকে ঠেলেঠুলে তুলে দেবে নৌকোয়,
একদিন, কিন্তু এখন তোমার দুধ দাঁতে চর্বিত হচ্ছে সোনালি ঘাস।
বালক, চর্বিত হচ্ছে ঘাস, কিন্তু এখনি মথিত হচ্ছে এই পলিমাটি,
চোখে চোখে কাজল পড়ছে, ফাল ওপড়াচ্ছে মাটি, পাতা ওলটাচ্ছে
ইতিহাস, কিন্তু কোটর থেকে ওই বেরিয়ে আসছে সাপ, খাচ্ছে দুধ,
নৌকো হেলে পড়ছে খর বাতাসের টানে, গর্ভবতী চিৎকার করছে,
জঙ্গলে ফোঁপাচ্ছে শুকসারী, কুঠার উঠছে পাতাল থেকে ধারালো,
মাটিতে স্তন পর্যন্ত পোঁতা রমণীটির ওপর পড়ছে পাথরের পর পাথর,
বৈশাখের উদাস গেরুয়াকে রক্তলাল ছুপিয়ে দিচ্ছে হঠাৎ এক বোমা,
পথিকেরা অমাবস্যার ভেতরে খুঁজে মরছে গ্রামচিহ্ন তাল গাছটিকে,
পূর্ণিমার ধন্দে পড়ে গেরিলারা চৌমাথায় দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক তুলে,
মানুষেরা একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়ছে চাদরের তলায় ছুরি,
কোথাও কলেরা, কোথাও বা শিশুজন্ম, কোথাও চাষাবাদ হচ্ছে খুব,
কোথাও বা রাত্রির রন্ধ্রে প্রবেশের জন্যে মাথা ঠুকছে আকন্দের ফুল,
গ্রাম প্রান্তের মাঠে কোদাল পাড়তেই উঠে আসছে গোঁ কবরের লাশ।।
পথের ওপর পা রাখতেই পা হড়কে যাচ্ছে ফিনিক দেয়া রক্তধারায়,
আজান কাঁদছে মিনারে, ফুঁপিয়ে উঠছে সীমন্তের সিঁদুরে শাখ, বালক,
তুমি দুধের দাঁতে চিবিয়ে চলেছো ঘাস, কিন্তু করাতের মতো দাঁতে
আমাদের দিন ও রাত্রি চিবিয়ে খাচ্ছে দাতাল এখন মানব দেহ ধরে
তোমার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়ছে চর্বিত ঘাসের সবুজ থেঁতো কষ,
ওদের মাঢ়ি থেকে থসথস করে পড়ছে অমাবস্যার ঘন আলকাতরা।
দূরপ্রান্ত বালক, ওই যে নৌকোয় তুমি উঠে পড়বে, দীর্ঘ একটি হাত,
পেশল সে হাত একদিন যে তোমাকে ঠেলে তুলে দেবে নৌকোয়,
আছে ওর ভেতরেই সংবাদ! ওই হাত তোমাকে দিয়েছে পিতৃপরিচয়,
ওই হাত তোমাকে মাতৃনাভিতে স্থাপন করেছে যখন তোমাকে নিয়ে
মাথার ওপরে চক্কর ঘোরাচ্ছিলো সংক্রান্তির কশাই। পূর্ণিমার ধন্দে
গেরিলারা, নদীর দিকে যেতে চেয়েছিলো, তার আগেই বিভ্রান্ত তারা,
ভালোই যে তারা থেমে গিয়েছিলো, নইলে শত্রুপক্ষেই গিয়ে পড়তো
ভুল পায়ে, তারা দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তরে সেই যে কবে থেকেই তার
গাছপাথর নেই! বালক, একদিন তুমি বেরিয়ে পড়বে মাঠে, একদিন
তুমি জ্যোছনার ভেতরে ছুটে বেড়াবে যখন হারানো গাভিটিকে ডেকে
আনতে গোহালে, তখন সেই হাত তোমাকে অকস্মাৎ ঠেলে তুলবে
প্রান্তরের মধ্যে নৌকোয়, তুমি বলবে, আরে একি! স্থলভাগে জলযান?
তুমি দুধের সমুদ্র পাবে বলে তোমাকে সেই হাত টানবে নৌকোয়।
তুমি জ্যোছনা নয় মাতৃদুধে যাবে, তুমি মাতৃভাষা হয়ে ডেকে উঠবে,
তুমি ছন্দোবদ্ধ হবে, তুমি বাঁশি হবে, শঙ্খ হবে, মিনারে দাঁড়াবে তুমি,
এসো, এই দিকে পথ, আর ঠিক তখনই সময় হবে, নড়ে উঠবে,
গেরিলারা গ্রামের সেই চৌমাথায়, তখনই ভাঙতে থাকবে পাথর,
গলতে থাকবে বরফ, ফুলে উঠবে নদী, মৃত্যু থেকে হেসে উঠবে
ব্রহ্মপুত্র, তোমার চুলের ভেতর থেকে বহে যেতে থাকবে, বালক।
বালক, আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, একদিন কবি হবে তুমি। একদিন
শব্দ হবে তুমি, ছন্দ হবে, ব্যাকরণ হবে। একদিন শব্দকে ভাঙবে তুমি,
ছন্দ একদিন তোমার হাতে খেলা করবে বাজিকরের হাতে আগুনলাঠি,
ব্যাকরণ তোমার কাছে থেকে শিখে নেবে কী করে ভাঙতে হয় তালা,
তোমার কড়া নাড়ায় খুলে যাবে শহরের বন্ধ সকল দরোজা ও জানালা,
গ্রাম উঠবে আহ্লাদে নেচে, যুবতীর মতো শুয়ে পড়বে মাঠে মাঠে,
মিছিলের পা হবে অগ্রসর ও জেদী, স্লোগানের স্বর হবে অভ্রভেদী,
যুদ্ধের ফলাফল হবে নিশ্চিত, আর তুমি ময়লা জামায় ফেরেশতা, তুমি
কবি, তুমি দূরপ্রান্ত থেকে এই আগুনের মধ্যে অবিরাম হাঁটতে থাকা
বালক, একদিন তুমি এ সবের উপায় নিয়ে খুলে ফেলবে তোমার জামা,
মাতৃদুধে ধুয়ে নেবে তোমার রক্তভেজা চুল, আর তোমার জন্যে
জামা নিয়ে অপেক্ষা করবে যারা এতকাল উৎসন্নতার ভেতরে ছিলো
নির্বাসিত কিন্তু গোপনে গোপনে বয়ন করছিলো বস্ত্র, ভোর তোমাকে
পদক দেবে, রাত্রি তোমাকে মালা দেবে, চাঁদ তোমাকে চন্দন দেবে,
নদী তোমাকে দুধ দেবে, পলি তোমাকে পেশী দেবে, মানুষ তোমাকে
888sport app download apkর ভাষা দেবে, মানুষের শোক তোমাকে দীর্ঘ জীবন দেবে,
মানুষের স্বপ্ন তোমাকে কবরের ভেতরে কাফনে জড়িয়ে রাখবে।
তুমি মরণশীল, তুমি মৃত্যুর নীল ভেতরে অমরত্বের বিমানে উড়বে।
বালক, আমি তোমাকে স্বাগত করছি, একদিন তুমি আমাদের কবি হবে।
১৮ই পৌষ ১৪১০, 888sport app

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.