বিড়ালের নরম লোমে 888sport app বিড়ালময় এই বাসায় আজ আবার নতুন করে এক বিপত্তি দেখা দিলো। বাসায় তুলকালাম কাণ্ড। একটা দুর্যোগ যেন। মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়া বাসার একমাত্র মেয়ে কাঁদছে; শিশুর মতো সে-কান্না। কাঁদছেন তার মা। তুলনায় বাসার ছেলেটি বিকারহীন; ছেলে মির্মির রহমানের মধ্যে একরকমের নীরবতা। এই ঘটনায় কিছুই যেন বলার নেই মির্মিরের; অনেকটা নির্ভার – নিজের নামের মতো করেই। আজিমপুর কলোনির বড় পুকুরটায় উত্তর-পশ্চিমের ডি-১৬ বাসাটিতে বছর দুয়েক আগেও এই রকমের এক যন্ত্রণার উদ্ভব ঘটেছিল। আজকের বিপত্তি আর দু-বছর আগের যন্ত্রণার মূল কেন্দ্রবিন্দু এক হলেও দুটোর ধরন পরস্পর বিপরীতমুখী।
সিদ্দিক রহমানের আজ ফিরতেও খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই জানা গেল, আজিমপুর-মোহাম্মদপুর-মিরপুর রুটের মাইক্রোবাসটা এই বিকেলে নেই। উপসচিব সিদ্দিক রহমানের বাসা আজিমপুর। সচিবালয়ের কাছেই। আগেও আসা কিংবা যাওয়ার সময়ে এমনভাবে লিফটের মাইক্রোবাস উধাও হয়ে যেত। প্রথমদিকে এসব বুঝতে সময় লেগেছে সিদ্দিকের। মাঠ থেকে 888sport appয় এসেই এসব ঝামেলায় পড়েছেন তিনি। অথচ জেলায় থাকতে গাড়ির সংকট নিয়ে ভাবতে হয়নি তাকে। গাড়ির ব্যবস্থা অফিসই দেখত – ওই এনডিসি নামের এক অফিসার এ-জাতীয় সকল মুশকিল আসান করে দিত। সচিবালয়ের লিফটের গাড়ির নানা সমস্যা থাকে। গাড়িচালকের ছুটি এবং গাড়ির নানা অসুখ-বিসুখ তো নিত্যসঙ্গী যেন। এরপর কোনো এক বড় স্যারের আধা-সরকারি বা অদরকারি কাজে লিফটের গাড়ি ধরে টান। আবার সচিব-মন্ত্রীর জরুরি কাজেও লিফটের গাড়ির এদিক-সেদিক ছোটা। অফিস-ছুটিতেও তাদের এই গাড়ির দরকার হয়। যারা গাড়িটা নেন, সবাই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু মিরপুরে বসবাসরত তিনজন অফিসার, মোহাম্মদপুরের দুজন পনেরো মিনিট আগে অবহিত হলে অফিস শেষে কী করে বাসায় ফিরবেন, কারো মাথায় সেটি থাকে না। অকারণে কথা শুনতে হয় গাড়ির দায়িত্বে থাকা অফিসারকে। তবে সকালে আসার পথে লিফটের ব্যবস্থা না থাকলে আগের দিনই জানিয়ে দেওয়া সিদ্দিক সাহেবের মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজ। তাও ভালো। এসব ব্যাকরণে সিদ্দিক রহমান এখন অনেকটাই অভ্যস্ত।
লিফট থেকে নেমেই একই মন্ত্রণালয়ের রবার্ট গোমেজের মুখোমুখি হলেন সিদ্দিক; সাড়ে ৩টার দিকে জয়েন্ট সেক্রেটারির রুমে দেখা হয়েছিল আজ। দুজনে একই ব্যাচের। আগে চেনাজানা ছিল না। সচিবালয়ে আসার পরই চেনাচিনি। রবার্টের মুখ কালো।
– কী হয়েছে, বন্ধু গোমেজ?
– বলিস না।
– কী?
– যন্ত্রণা।
– বলবি তো।
– সচিবের একজনকে পৌঁছে দিতে মাইক্রো গেছে সদরঘাট। নিচে নেমে দেখি গাড়ি নেই। কেউ কিছু বলছে না। এখন ফোন করতে ড্রাইভার এই কথা বললো। আমি না-হয় ফার্মগেট যাওয়ার ছিলাম, কিন্তু এই পথে তো উত্তরার
তিন-চারজন আছে। একজন বনানীতে, একজন কুড়িলে নামেন। ওরা এই সময়ে কী করে যাবেন, কখন পৌঁছবেন
এক-একজন! শালা, বরিশাইল্লা! অফিসের গাড়িতে আত্মীয় পাঠাতে হবে সদরঘাটে!
– কখন আসবে? ড্রাইভার কিছু বললো?
– কেবল লঞ্চঘাট থেকে রওনা করেছে। বলেছে, এক ঘণ্টা। আমার মনে হয় না পারবে। আমি বলে দিয়েছি, আমি অপেক্ষা করবো না।
রবার্ট গোমেজ এমনিতে খুবই ভদ্র। তাকে রাগ-টাগ করতে দেখেননি সিদ্দিক। আজই এমন রাগতকণ্ঠ তার। দুজন হাঁটতে হাঁটতে গেট অবধি এসে সিদ্দিক আজিমপুর কলোনির একজনকে পেয়ে গেলেন, তিনি কেবল রিকশায় উঠে বসেছেন। সিদ্দিক রহমান দেখেই বললেন, আসেন স্যার, আজ একসঙ্গে যাই। রবার্ট গোমেজ পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তার লক্ষ্য বাস, না সিএনজি অটোরিকশা বোঝা যাচ্ছে না; তবে বিরক্তিটা স্পষ্ট করেই জানান দিচ্ছিলো।
সিদ্দিক রহমান বাসায় ঢুকতেই মেয়ে মৃত্তিকা রহমানের কান্নার শব্দ যেন বেড়ে গেল। বিজ্ঞাপন বিরতিকালে টিভির শব্দ যেভাবে বেড়ে যায়। কাঁদছেন মৃত্তিকার মা আয়েশাও। এখন দুই কান্না বাসার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঘরের মধ্যে একটা গুমোট পরিবেশ।
– কী হয়েছে? কী হয়েছে, মা?
সিদ্দিকের এই কথায় মেয়ের কান্নার শব্দ আরো উচ্চকিত হলো। কান্নাকণ্ঠে বাবাকে কিছু যেন বললো মৃত্তিকা। কিন্তু বাবা কিছুই বুঝলেন না। তাকালেন স্ত্রীর দিকে। তিনি কিছু বলার আগেই মির্মির এসে বললো, ‘তোমার মেয়ের বিড়াল হারিয়ে গেছে।’ ছেলের কথায় তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। অন্যসময় হলে একটা ধমক আসতেই পারতো। কিন্তু এই সময়ে সিদ্দিক কিছুই বললেন না ছেলেকে। বললেন – ‘বিড়াল হারিয়ে গেছে! সেকি?’
‘হ্যাঁ, বাবা, মিম্মিকে পাচ্ছি না।’ মৃত্তিকাই বাবাকে বললো এবার। তখন কান্নার শব্দ খানিকটা নিচে নেমে গেছে।
আয়েশা এগিয়ে এসে বললেন, ‘৩টার দিকে মৃত্তিকা মেডিক্যাল থেকে বাসায় ফিরেই মিম্মিকে পায়নি। সেই থেকেই মেয়েটা কাঁদছে। ভাতও খায়নি মেয়ে আমার।’
‘সেকি রে! খাসনি কেন, মা মৃত্তি? খেয়ে নে। আমি দেখছি, ও কোথায় গেল।’
‘আগে আমার মিম্মিকি এনে দাও। তারপর খাব।’ মেয়ের সাফ কথা।
মিম্মি মানে বাসার বিড়াল কোথায় গেল – মহাচিন্তার বিষয়। আর ব্যাপারটা সিদ্দিককেই দেখতে হবে। কেবল মেয়েকে সামলানোর প্রশ্নই নয়, মিম্মি এখন বাসার একজন হয়ে গেছে; নিজে কিংবা স্ত্রী আয়েশারও সময় কাটে মিম্মিকে নিয়ে। কখনো আবার মিম্মিকে নিয়ে বাবা-মা-মেয়ের কাড়াকাড়িও লেগে যায়। অথচ একদম প্রথমদিকের চিত্র অন্যরকমের ছিল।
বছর-দুই আগে দেড় মাসের বাচ্চা ঘরে তুলেছিল মৃত্তিকা। পাশের ফ্ল্যাটের ওরা চলে যাওয়ার আগেই ওদের মা-বিড়াল তিনটা বাচ্চা দিয়েছিল। ও-ফ্ল্যাটের মেয়ে মৃত্তিকার ক্লাসমেট। হয়তো তার থেকেই বিড়াল অনুরক্তি-অনুরাগ জন্মাতে পারে মৃত্তিকার। তা থেকেই এই বাচ্চাটা নিয়ে আসা। নাইন-টেনের সময়েও বিড়াল বিড়াল করছিল মৃত্তিকা। কিন্তু মা আয়েশা রহমান তাতে কান দেননি, বরং প্রতিবার মেয়েকে এই বলে নিবৃত্ত করেছে, ‘তোমার নানু কিন্তু আমাদের বাসায় আসবেন না। জানো তো, বিড়াল-কুকুরে আম্মার ভীষণ অ্যালার্জি।’ সিদ্দিকেরও খুব পছন্দ ছিল না ঘরে বিড়াল পোষা। কিন্তু মেয়ের পছন্দ। একমাত্র মেয়ের ইচ্ছে বা পছন্দকে কোনো বাবাই না করতে পারে না। ফলে সেদিনও অফিস থেকে বাসায় ফিরে এক মহারণেরই নিষ্পত্তি করতে হয়েছিল। ঢুকতেই আয়েশা চিৎকার করছিলেন, ‘দেখো, তোমার মেয়ের কাণ্ড দেখো। ওটাকে বাইরে রেখে আসতে বলো। মা কিন্তু এ-বাসাতে আর আসবেন না। বিড়াল থাকলে আমিও থাকবো না।’
বিড়াল পছন্দ আর অপছেন্দর ব্যাপার পরে। আগে
মা-মেয়েকে সামলানোই সিদ্দিকের কাজ। থামাতে হবে এই যুযুধান। ওদিকে ঘরের এককোণে বিড়ালবাচ্চা আগলে বসে আছে মেয়ে মৃত্তিকা। সিদ্দিক মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়েকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ‘মা যদি না চায়, কী করে এটাকে বড় করবি? তুই কলেজে গেলে একে খাওয়াবে কে?’
‘ওসব জানিনে। এটা থাকবেই। তুমি মাকে বলো।’
‘কেন রে মা! আর হঠাৎ এই বিড়াল ঘরে নিয়ে আসার ইচ্ছেই কেন হলো, মৃত্তি?’
‘তুমি বুঝবে না, বাবা। আর কেন কেন করছো যে বড় – শেরপুর স্কুলে পড়াকালেই তো একটা বিড়ালের কথা বলেছিলাম।’
‘ঠিক আছে। তখন ছোট ছিলি। এখন কলেজ শেষ করে বিশ^বিদ্যালয়ে যাবি, নয় মেডিক্যালে – কত পড়া! একে পুষতে সময় পাবি কী করে! চল, মা, ওটাকে বাইরে রেখে আসি।’
এ-কথা শুনে মৃত্তিকা আবারো কান্নার ঝড় তুলে দিলো। বাবা তো হতবাক।
‘কী রে, আবার কী হলো।’
তখন মৃত্তিকা যা শোনাল তাতে কেবল বাবাই নয়, মা আয়েশারও আর কিছু বলার ছিল না।
‘দেখো বাবা, গত এক সপ্তাহ ধরেই ও আমার পিছু পিছু করছিল। তন্বীরা চলে যাবে বলে এই কদিন তো ওদের বাসায় দিনে তিনবারও গিয়েছি। তন্বীর কাজিন অন্য দুইটা বাচ্চার সঙ্গে এটাকেও নিতে চেয়েছিল। যতবারই নিতে চেয়েছে ততবারই এইটুকুন বাচ্চা আমার পায়ের কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তন্বীই বললো, ‘এ বোধহয় মৃত্তিকেই লাইক করেছে। তো, তুই-ই এটাকে নিয়ে যা রে মৃত্তি।’
‘কী বলিস, মা!’
‘হ্যাঁ, বাবা।’
কথাগুলো আয়েশাও শুনছিলেন। মৃত্তিকা আরো বললো – ‘মা চিল্লাচিল্লির পর ওটাকে নিচে রেখে এসেছিলাম। গেটও বন্ধ করে এসেছিলাম। বিশ্বাস করো, বাবা, অন্য বাসার কে যেন ঢুকতে গেট খুলেছিল, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমার বাসার দরজার সামনে এসে কান্না করছিল। আবার নিয়ে এলাম। মা আবার হুংকার ছাড়লেন। ছাদে ছেড়ে দিয়ে এলাম। তখন একটু বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি যখন ওকে রেখে ছাদের দরজা আটকাতে যাচ্ছিলাম, ও-মা! চোখে-মুখে কী বিষাদের ছায়া। কেমন কান্না কান্না। মিউ মিউ করছিল। আমার কানে বাজছিল, ‘মা, আমাকে এই বৃষ্টিতে রেখে যেও না।’ তখনই কোলে তুলে নিয়ে এলাম। একে আর কোথাও ছেড়ে আসবো না, বাবা। কক্ষনো না।’
সেই থেকে ওই বিড়ালবাচ্চা এই বাসারই একজন হয়ে উঠেছে। মিম্মি নামটাও মা-মেয়ের যৌথতায় দেওয়া। কিন্তু মির্মির এই বিড়াল পোষাকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি। প্রথম প্রথম দুই বছরের ছোটকে নানা কিছুই বলে খেপাত। সেটা আবার বাবা-মায়ের সামনে নয়। মির্মির বুঝে গেছে, এখানে বাবা-মায়ের পুরো সায় আছে। মির্মির বোনকে বলতো, ‘তোর মিম্মি তো এখন এই বাসার তৃতীয় সন্তান।’
আবার বলতো, ‘খাঁচায় একটা সাপের বাচ্চা পুষতে পারিস।’
বিশেষ করে প্রথম প্রথম মিম্মি যখন তরকারিতে মুখ দিত, তখন মির্মির বাবা-মায়ের সামনেও নানা কথা শুনিয়েছে ছোট বোনকে। সেটা অপ্রত্যক্ষভাবে মা-বাবাকেও শোনানো। কিন্তু মিম্মি এখন অনেকটাই পরিশীলিত। পাশে বসে থাকলেও প্লেটে-বাটিতে-পাতিলে মুখ দেয় না। খাবার দিলেই কেবল খায়। খাই খাই ভাবও নেই আর। নির্দিষ্ট সময়েই খায়। খাওয়াটাও বেশ গোছানো। প্লেটের বাইরে কিছুই যায় না। নির্ধারিত সময়েই বাইরে গিয়ে প্রাত্যহিকী সেরে আসে। বাসা নোংরা করার হ্যাপা নেই। কিন্তু এই রকমের ভদ্রতায় পৌঁছতে সে কম যন্ত্রণা দেয়নি।
মাস কয়েক আগে চারতলার পূর্বপাশের ফ্ল্যাটের একজনকে কামড়েছে মিম্মি। তবে ঘটনায় প্রকাশ, লাঞ্চের পর মিম্মি সিঁড়ির গোড়ায় চোখ বুজে একটু আরাম করছিল। চারতলার ভদ্রলোক ওপরে উঠতে খেয়ালই করেননি। ফলে পায়ে পা দিতেই মিম্মি আদর দিয়েই দিলো। সেটাই কামড়। এরপর টিকা-ইনজেকশন। সে এক তুলকালাম কাণ্ড। বিচ্ছিরি ব্যাপার। একই ভবনের মধ্যে তো। একাধিকবার বলেও তাকে মানানো যায়নি, মিম্মির টিকা দেওয়া আছে, আর এই সামান্য কামড়ে কিছুই হবে না। না, টিকা-ইনজেকশনের খরচা দিতে হয়নি বটে, তবে ভদ্রতা করে আহতের সঙ্গে সিদ্দিক সাহেবকে দুদিন যেতে হয়েছিল।
এমন ঘটনা আরো একদিনের।
আয়েশার কাজিন এসেছেন বেড়াতে। সঙ্গে তার স্ত্রী। স্ত্রী ভেতরের ঘরে। এদিকে মিম্মি তো আয়েশার খালাতো ভাইয়ের হাতে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে। কী হলো, কী হয়েছে বলতে বলতেই আগত মেহমান স্বীকার করলেন, আগে একবার মিম্মিকে সোফার বালিশ দিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছেন তিনি। এরপর দূরের সোফায় মিম্মি চোখ বুজেই ছিল। তখন শখ করে ধরতে গেলে এই অপকর্ম ঘটিয়ে দেয় সে। মৃত্তির এই মামা একজন উকিল, তিনি আবার একজন পরিবেশবাদী। ঘটনায় মৃত্তিকা খানিকটা খুশি হলেও প্রকাশের উপায় ছিল না।
আরো একদিন। তখন মিম্মি একা না, ওর পেটে আরো তিনখান জন্ম নিয়েছে। ওদের তখন চারজনের সংসার। তখন আর এই প্রাণিকুল সকলের সামনে আসতো না। তাদের জন্য বারান্দায় আলাদা থাকার বন্দোবস্ত। না ডাকলে এদিকে সচরাচর আসেই না। আগে যেমন সারাক্ষণ এঘর-ওঘর করতো, এখন সেটা করছে না – কেবল মৃত্তিকা বাসায় থাকলেই ওরা চারজন ওই বারান্দা থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। এমন একদিন, সিদ্দিকের ছোট ভাইয়ের শ^শুর এসেছেন গ্রাম থেকে কী একটা কাজে। তিনি সন্ধ্যায় ডি-১৬-তে এসেছেন। রাতে খেয়েও গেছেন। তিনি জামাইর বাসায় ফিরে গিয়ে নাকি বমি করেছেন এবং বলেছেন, তোমার ভাইয়ের বাসায় খাবারের মধ্যে বিড়ালের লোম ছিল। ঠিক এভাবে বিড়ালজনিত কারণে দু-চারজন মেহমান আসার পথ রুদ্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে বিড়ালের প্রতি অপত্য স্নেহে কোনো ঘাটতি দেখা দেয়নি। না মৃত্তিকা অথবা বাবা-মায়ের। বরং বাসাটা ক্রমশ বিড়ালময় হয়ে উঠেছে। মির্মির অধিকাংশ সময় বুয়েটের হলে থাকে। ও বাসায় এলে ওর সামনে মিম্মি বা মিম্মির বাচ্চারা একদম আসবে না – এমন প্রশিক্ষণই পেয়েছে এই বাসার চারপেয়ে প্রাণীরা। আবার মির্মিরও আগের মতো ততটা বিড়ালবিদ্বেষ নেই যেন। আয়েশার মাও বেঁচে নেই। তবে এই বাসায় আর আসছে না মৃত্তিকার মেজমামা; মায়ের মতোই বিড়ালে তার খুব অ্যালার্জি।
গোড়াতে এদের খাবার-দাবার নিয়ে নানা সমস্যা ছিল।
প্রথমদিকে বাসার সবটাই খেত মিম্মি। এই বাসি, মাছের কাঁটা – এসব। কিন্তু আয়েশা এবং মৃত্তিকা বইপত্তর পড়ে আর অনলাইন দেখে দেখে পেটফুডের ভক্ত বানিয়েছে এই প্রাণীদের। সঙ্গে বাজার থেকে নির্ধারিত কয়েক পদের মাছ। সবকটিই উচ্চমূল্যের। রান্নার রেসিপিও আলাদা। সিদ্দিক রহমান এখন মাসের প্রথমেই নিজেদের মাছ-মাংসের সঙ্গে বিড়ালের খাবারের তালিকাও করে রাখেন। একটা পদোন্নতি হওয়ায় বেতনও খানিকটা বেড়েছে। ফলে সিদ্দিক এখন বিড়ালগুলোকে ভালোই উপভোগ করছেন। এখন 888sport appর ক্যাটফুডের সব দোকান তার মুখস্থ। বিড়ালের খাওয়া-দাওয়ায় যুক্ত হয়েছে আভিজাত্য। দুধে একটু পানি দিলে এখন আর মুখে নেয় না মা আর তিন বাচ্চা। বাসি কোনো কিছুও মুখে নেয় না তারা। খায় আবার সময় মেনে।
দুই
এই ভরদুপুরে মিম্মি কোথায় যাবে? এমন তো হয়নি আগে কখনো। মেয়ে ছিল মেডিক্যাল কলেজে। আয়েশাও বাইরে ছিলেন। গতকালই কথা হয়েছে 888sport app পেট সোসাইটির মিটিংয়ে গুলশান যাবেন আয়েশা। আয়েশা এই সমিতির নির্বাহী কমিটির একজন। আগামী মাসেই বিশাল ক্যাট প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। এই নিয়ে আয়েশা বেশ ব্যস্তই। বাসায় ছিল মির্মির। বুয়েটে কী এক গোলমালে ক্লাস বন্ধ। হলও বন্ধ। মির্মির কদিন ধরেই বাসাতে। বাসায় ছুটা ঝি আছে। আর পার্মান্যান্ট যে থাকে, খুবই ছোট মেয়ে। ছুটা ১১টার পর একবার আসে। তখন দরজা খোলা পেয়েই কি মিম্মি কোথাও গেছে! বিড়াল বেরুতে দরজা খোলা থাকাও জরুরি নয়। যাবে কেন – এমন তো আগে হয়নি; নানা চিন্তা সিদ্দিক রহমানের মাথায়। প্রথমেই সিদ্দিক ভাবলেন, ছেলে মির্মির পিটিয়ে-টিটিয়ে কোথাও ফেলে আসেনি তো। সেটাই-বা হবে কেন! এখন তো মির্মিরের ঘরেও মিম্মির যেতে বাধা নেই। কদিন আগে বাবার কথায় মির্মিরই তো বিড়ালের খাবার নিয়ে এলো। তাহলে!
তখনই আয়েশা কী মনে করে স্বামীকে বেডরুতে যেতে বললেন। কিছু একটা বলতে চান, ছেলেমেয়ের সামনে হয়তো বলবেন না।
বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম না, ও সেক্সুয়ালি ম্যাচিউরড হয়ে গেছে। চার-পাঁচ মাস থেকে দশ মাসে এটা হতে পারে। যদিও বাচ্চা দিতে জন্মের পর দেড়-দুই বছর লাগে। আমার মনে হয়, মিম্মির এখন কলিং টাইম। বাইরে সঙ্গী খুঁজতে যায়নি তো?’
‘কী করে বুঝলে?’
‘তুমি একটা বোকা। কিচ্ছু পড়বে না। কয়েক মাস আগেও এমন হয়েছিল। গতকালই আমার এমনটা মনে এসেছে।’
‘কী সেটা?’ সিদ্দিক রহমান বুঝতে চান। তাই স্ত্রীকে আবার প্রশ্ন করেন।
আয়েশা বললেন, ‘স্ত্রী বিড়ালের শরীর হিট হলে অস্বাভাবিক আচরণ করে। গড়াগড়ি দেয়। মাথা লেজ দিয়ে ঘষতে থাকে। লেজ উঁচু করে রাখে। বাইরে যেতে চায় আর কিছুটা হিংস্রও হয়। আমি তো এসব পড়ে পড়ে বিড়ালের হাড়হদ্দ জেনে গেছি।’
‘হুম।’
‘জানো, কয়েক মাস আগেও এমন দেখেছি। দেখেই তোমায় বলেছিলাম।’
‘আমি তো একজন ভেটেরিনারির সঙ্গে কথা বলেছি।’
‘বলোনি আমায়। কী বলেছেন তিনি?’
‘বলেছিলেন, ইনজেকশন দিয়ে প্রজনন ক্ষমতা ঠেকানো যায়। কিন্তু পুরুষ বিড়ালের সঙ্গে একদম মিশতে না দিলে স্ত্রী বিড়াল পাগলের মতো আচরণ করবে। হিংস্র হয়ে উঠবে। ঘরে রাখাও কঠিন হবে।’
‘এই জরুরি কথাগুলো আমায় বলোনি।’
‘ওই বলি-বলি করে হয়নি। ডাক্তার আরো বলেছিলেন, এক-দুবার গর্ভবতী হতে দেওয়া উত্তম। এরপর ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চা জন্মদানের ক্ষমতা রহিত করলে ভালো হবে।’
‘আমার মনে হয়, মিম্মি এজন্যই কোথাও গেছে। আমরা তো এই দিকটা নিয়ে ভাবিনি। তুমি একটু আশেপাশে দেখে আসবে?’
‘সে যেতে পারি। তুমি একটু চা দাও। আমি কেডসটা পরে নিই। একটু হেঁটেও আসি।’
চা-খাওয়ার মাঝপথেই দরজার বাইরে মিম্মির শব্দ শোনা গেল। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো মিম্মি।
বাসায় অনাবিল প্রশান্তি এখন। মিম্মি ঘুমাচ্ছে। ওর মধ্যেও মহাপ্রশান্তি। আয়েশাই সিদ্দিককে এসব বললেন।
তিন
চারজন মানুষের বাসায় চারটি বিড়াল। মিম্মির তিন বাচ্চার নাম প দিয়ে পুষ্পি, পুষ্টি আর পপি। শেষেরটা মর্দা। এদের জন্ম নিয়ে বাসায় কম বিড়ম্বনা হয়নি। মা বিড়াল মিম্মির পেট যখন স্ফীত হচ্ছিলো, তখন মৃত্তিকা বেঁকে বসেছিল। প্রথমে তো মিম্মির বাচ্চা দেওয়াতেই আপত্তি ছিল মৃত্তিকার। সে আপত্তির দ্রুতই নিরাকরণ হয়ে যায়। দ্বিতীয় আপত্তি যেন এক দুর্বিপাকের মতোই। বাইরের ছাড়াবিড়াল বা কোনো না কোনো বাসার মর্দা বিড়ালের বাচ্চা মিম্মির পেটে – মানতেই পারছিল না মৃত্তিকা রহমান।
বাবা-মা দুজনের ওপরে রাগ আছড়ে পড়ছে। আবার এই নিয়ে এই কলোনিতেই দুই বাসার মধ্যে ঝগড়ার রেকর্ড আছে। সেও এক অদ্ভুত বিষয় – ওই বাসার অজাত মর্দাটা আমাদের উন্নত জাতের মাদির সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলো কেন? এই হচ্ছে ব্যাপার।
‘তোমাকে কতদিন বলেছি, ক্যাট সোসাইটির আন্টিদের বলে একটি উন্নত জাতের পুরুষ বিড়ালের কাছে মিম্মিকে নিয়ে যেতে। তুমি শোনোনি, মা।’
এবার আয়েশা স্বামীর ওপর খানিকটা নিলেন। বললেন – ‘বলেছিলাম, একজন বিড়াল বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে উন্নত জাতের মর্দা বিড়ালের সন্ধান করতে।’
‘তুমি না সারাদিন ক্যাট সোসাইটি নিয়ে আছো, তা তুমি মেয়ের কথা শোনোনি কেন!’ এ-কথা বলে আবার সিদ্দিককেই সারেন্ডার করতে হয়। বললেন, ‘বল মা, কী চাস তুই?’
‘অ্যাবরশন।’
‘কী বলছিস! কেন করাতে হবে, শুনি?’ আয়েশা রাগতকণ্ঠে বললেন।
বাসার কর্তা হোক আর বাবা কিংবা কারোর স্বামী – এই ঝগড়া তাকেই সামলাতে হয়। আর বাসায় মেয়ের কথাকে প্রাধান্য দেওয়া বাবার প্রথম কাজ। পরেরদিন কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে মিম্মিকে নিতেই হলো। এখন নিজেরই গাড়ি হয়েছে সিদ্দিক রহমানের। পশু হাসপাতালের একজন ডাক্তার দেখে-টেখে জানিয়ে দিলেন, ‘অ্যাবরশন হবে না। লাইফ রিস্ক।’ জয়েন্ট সেক্রেটারি পরিচয় জেনে ডাক্তার বরং একটা বাড়তি কাজ ধরিয়ে দিলেন সিদ্দিককে।
‘প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আরো দুবার চেকআপ করিয়ে নিতে হবে।’
চার
রাতে খেতে খেতে আয়েশাকে বললেন সিদ্দিক – ‘তোমাদের ক্যাট প্রদর্শনীর কতদূর? কবে হচ্ছে?’
‘আর বলো না। হাইফাই ব্যাপার। নির্বাহী কমিটির হাফ ডজন ভাবিই মন্ত্রী-এমপি-সচিবের স্ত্রী। তাদের কত কী প্ল্যান! বলছে, একশ এক জাতের বিড়াল দেখা যাবে প্রদর্শনীতে। বাইরের কয়েকটা দেশ থেকেও বিড়ালপ্রেমীরা তাদের প্রিয় প্রাণীকে নিয়ে আসবে এই আয়োজনে।’
‘ভালোই তো।’
‘শুধু কি তাই! থাকবে সেমিনার। সেখানে বিড়ালের জন্ম ও বিবর্তন নিয়ে সেশন থাকবে। তারপর গার্হস্থ্যকরণ ও চিকিৎসা নিয়েও আলোচনা আছে। জানো, একজন বিদেশি বিড়ালের আচরণ ও ভাষা নিয়েও কথা বলবেন।’
‘আরো কিছু?’
‘হ্যাঁ। বিড়ালের কংকাল নিয়েও প্রদর্শনী থাকবে। এই কংকাল থেকে বিড়ালের অতীত ইতিহাস আর গঠনপ্রণালিও জানা যাবে।’
‘আমরা যেতে পারবো কি এসব সার্কাস দেখতে?’
‘সার্কাস, মানে কী? সার্কাস বলো কিংবা পুতুল নাচ – আমাদের প্রদর্শনী ও সেমিনারে প্রবেশাধিকার খুবই সংরক্ষিত থাকবে। অলরেডি পুলিশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একজন ডিআইজির পত্নীও আমাদের সদস্য।’
‘প্রদর্শনী হবে। আবার এতটা রেসট্রিকশন। কেন গো?’
‘থাকবে না! বছর কয়েক আগে ধানমন্ডির সারমেয় প্রদর্শনী পণ্ড হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বাধার মুখে। এক ভাবিই বললেন সে-কথা। কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। বিদেশিরাও থাকবে তো।’
‘হুম’, বলে চুপিসারে খাচ্ছিলেন সিদ্দিক। মনে পড়লো ছাত্রকালে এমন প্রদর্শনী হয়েছিল জাদুঘরের সামনে। কুকুর প্রদর্শনী। বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি থেকে নানা জাতের কুকুর নিয়ে এসেছিল অনেকে। তার মধ্যে উঠতি বয়সের তরুণীর 888sport free betই বেশি। হাতে শিকল-ধরা। সিদ্দিকও গিয়েছেন হলের কজনের সঙ্গে। ওদের একজন গুলশানের এক সারমেয়প্রেমী স্বল্পবসনা মেয়েকে বললেন, ‘আপনার এটায় কী খায়, কোথায় ঘুমায়?’ ছেলেটির কথায় দুষ্টুমি থাকলেও মেয়েটি স্বাভাবিকভাবেই তার প্রাণীটির খাবারের ফর্দ বলে দিলেন। বললেন, ‘একে এসি রুমেই রাখতে হয়।’ সিদ্দিকের আরেক বন্ধু সিদ্দিককে দেখিয়ে বললো, ‘এই যে আমাদের মনুষ্যপ্রাণী; সকাল-দুপুর-রাতে দশ টাকার খাবারেই চলে যায়। আপনার ফর্দে তো দিনে শখানেক লাগে। এর এসি রুমও দরকার হয় না। ওই চেইনটা খুলে এর গলায় পরিয়ে নিয়ে যান না, প্লিজ।’
সিদ্দিকের আরো মনে পড়ছে, হলের ছেলেদের যন্ত্রণায় সেই প্রদর্শনী এক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে গিয়েছিল। হাসি পেল সিদ্দিকের। সেটা আয়েশার চোখ এড়ায়নি।
‘হাসছো কেন? রান্না কেমন হয়েছে, বললে না তো!’
‘এখন তো খাবারের মূল নজর ওই চার প্রাণীর জন্যই। খাদ্যবাজেট চারজন মানুষের চেয়ে ওদের জন্য কম কিছু না। তবু ভালো, বিড়ালের পোশাক-পরিচ্ছদের দরকার হয় না। প্রসাধনীর দরকার হয় না। বছরে এক-আধবার টিকা ছাড়া ওষুধও কিনতে হয় না।’
‘কী বললে বাবা! আমার বিড়াল নিয়ে খোটা দিচ্ছো।’ বলেই টেবিল ছেড়ে উঠে গেল মৃত্তিকা। মৃত্তিকাকে ওই রাতে আর খাবার টেবিলে ফেরানো যায়নি। পরদিন বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাবা মেয়েকে নিরস্ত করতে সমর্থ হলেন। আয়েশা বললেন, ‘মেয়ের সামনে বিড়াল নিয়ে এমন বেফাঁস কথা বলো কেন!’
পাঁচ
বিড়াল-কুকুর নিয়ে কুকথা বিড়াল-কুকুরপ্রেমীদের খুবই অপছন্দের। এই পোষা প্রাণীদের নিয়ে বিরূপ কথার কারণে বন্ধুতে বন্ধুতে সম্পর্ক ইতি হয়েছে, এমন নজির হাজারটা। অনেকেই অন্যের পক্ষীপ্রেম, বিড়ালপ্রিয়তা কিংবা কুকুর পোষা, এমনকি অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছও দেখতে পারে না। সে হয়তো ঠিক আছে, যার যার ইচ্ছে। কিন্তু মুখে কিছু না বলাই শ্রেয়তর। আবিরও মুখে কিছু বলেনি। অন্তত মৃত্তিকা শোনেনি। কিন্তু দুই-তিনজনের কান হয়ে সেটি মৃত্তিকার কাছে পৌঁছে গেছে। মৃত্তিকার ফোর্থ ইয়ারেই আবিররা বেরিয়ে গেছে। রিলেশনের রসায়ন যখন ঘন হয়েছে তখন মৃত্তিকা মেডিক্যালের শেষ বর্ষে আর আবির ইনটার্ন করছিল। মৃত্তিকাদের ফাইনাল পরীক্ষার পরই আবিরের ইউটান। ইনটার্ন শেষ করে আবির তখন 888sport appর বাইরে। মৃত্তিকার রেজাল্ট বেরুলেই বিয়ে – এমনই কথা ছিল। নিজের ইনটার্নের আগেই মৃত্তিকা লক্ষ করলো, আবির যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে। রেজাল্ট বেরুবার পরও বিয়ের নাম নেই আবিরের। বরং এই নিয়ে কিছু বললেই এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আাবিরের। এখন একরকমের যোগাযোগহীনতা। ঠিক সে-সময়েই মৃত্তিকার পরম বান্ধবী নাতাশা এই কথা বললো। এই বান্ধবীর প্রেমিক আবার আবিরের হোস্টেলমেট।
‘বুঝলি মৃত্তি, তোর বিড়ালই আবিরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।’
‘মানে কী, নাতাশা? কোথায় পেয়েছিস এই কথা?’
‘আবির ভাই-ই বলেছেন, আমার জনকে। তুই জাফরির সঙ্গে কথা বলতে পারিস।’
বহুক্ষণ মৃত্তিকা চুপ থেকে বললো, ‘তার আর দরকার কি! এমন একটি ব্যাপার, জাফরি ভাই তোকে তো আর
বানিয়ে-বানিয়ে বলবেন না। আবির আমাকেই বলতে পারতো।’
বিড়াল নিয়ে এখন আবার নতুন দুর্বিপাক শুরু হয়েছে। মেয়ের পছন্দের ডাক্তার-ছেলে বিড়ালের অজুহাতে হাওয়া হয়ে গেছে। কদিন ধরেই মেয়ের মন খারাপ। সেটা বাবা এবং মায়ের জন্য কষ্টকর বটে। এরই মধ্যে মির্মির নাকি মাকে জানিয়েছে, ওর পছন্দের মেয়ে এসব বিড়াল পছন্দ করে না। ফলে বিয়ে মানেই আলাদা বাসা। সিদ্দিক শুনে স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে বিয়ের পর আলাদা থাকবে, সে আমার মাথায় ছিল। কিন্তু এই অজুহাতটা কেন? আদৌ কি মেয়ে এ-কথা বলেছে? নাকি বিয়ের আগেই নিজের বোনের সঙ্গে ভাবি-বউর বিবাদের জন্ম দিতে চায়?’
‘বাদ দাও তো। ওর কথা ছাড়। এখন মির্মির নয়, মৃত্তিকার কথা ভাবো। চাকরিও তো শেষের দিকে। মেয়েটার একটা বিয়ে হলে দুশ্চিন্তামুক্ত হই।’
আয়েশা ছেলের আচরণে খেপে আছেন। কিছুদিন আগে মির্মির বোন মৃত্তিকার সঙ্গে অসম্ভব রকমের খারাপ ব্যবহার করেছিল। মৃত্তিকা চেয়েছিল পারিবারিক পরিবেশে বাসাতেই পুষ্পি, পুষ্টি আর পপির জন্মদিন করবে। কিন্তু মির্মির রেগেমেগে সব ভণ্ডুল করে দিয়েছে। বিড়াল নিয়ে মির্মিরের এতটা সিরিয়াস বিরোধিতা আগে দেখা যায়নি। অধিকন্তু এক ধাপ এগিয়ে মৃত্তিকাকে কথা শুনিয়েছে মির্মির, ‘বিলাই-বাচ্চার জন্মদিন করতে চাস, না! তা তোর মিম্মি, না তিম্মি, বিয়ের অনুষ্ঠানও তো করতে পারতিস, করলি না কেন; যত্তোসব!’ কথাগুলো বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলেছিল মির্মির। হয়তো মাকে শোনানোর জন্যই। আয়েশা মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে বলেছেন, ‘কী জানি, ওর ক্লাসমেট মেয়েটাই হয়তো ওকে এতটা বিড়ালবিদ্বেষী করে তুলেছে।’
মৃত্তিকা এখন আরো বেশি দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। নতুন প্রতিজ্ঞা। অনেক শক্ত সেই প্রতিজ্ঞার ভিত। বিয়েতে তার আপত্তি নেই আর, অথচ গত ক-মাস বিয়ের কোনো কথাই শুনতে চাইতো না – যাবতীয় রাগ ছিল আবিরের ওপর। সেটা কেটে গেছে এখন। কিন্তু যে এই বিড়ালকে তার মতো করেই পছন্দ করবে, সেখানেই বিয়ে। বিড়ালকে এখন আগের চেয়ে বেশি আঁকড়ে ধরছে যেন। মধ্যখানে সিদ্দিকের এক-ব্যাচমেট স্বীয় স্ত্রীসমেত তার ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য মৃত্তিকাকে দেখে গেছেন। খুবই পছন্দ হয়েছে মৃত্তিকাকে; কিন্তু শেষমেশ ওই প্রাণীকুলই বিয়েটা হতে দিলো না। এসব নিয়ে মৃত্তিকা একদমই নির্ভার। এখন বরং বেশি বেশি সময় দিচ্ছে বাসার তিন চতুষ্পদ প্রাণীকে – বাসায় সময় কাটে এদের নিয়েই। লম্বা সময়ের জন্য এখন দূরেও যেতে চায় না মৃত্তিকা। বাবা-মা ভারত ঘুরে এসেছেন, কত করে বাবা বলেছেন; কিন্তু যায়নি মৃত্তিকা। হয়তো এমন ধারণাও হতে পারে, বেশিদিনের জন্য দূরে কোথাও গেলে এদের খাবার-দাবার ঠিকঠাক হবে না। এই বিড়াল চারটিকে ষড়যন্ত্র করে কেউ মেরে ফেলতে পারে – এমন ধারণাও মৃত্তিকার মনে বাসা বেঁধেছে; আর এই সন্দেহের তির নিজের ভাই মির্মিরের ওপর। বাইর থেকে মৃত্তিকা ঘরে ঢুকলেই টের পেয়ে যায় মিম্মি আর বাচ্চা তিনটি। দৌড়ে চলে আসে মৃত্তিকার কাছে। ওরা ঘুমে থাকলেও মৃত্তিকার উপস্থিতি কীভাবে যেন জেনে যায়। মানুষে মানুষে ঝগড়া হয়, প্রিয়জনের সঙ্গেও থাকে মান-অভিমান। কিন্তু কী অদ্ভুত! মৃত্তিকার সঙ্গে এই চার প্রাণীর বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না, নেই সামান্যমাত্র রেষারেষি বা ঝগড়াঝাটি – এদের অবিশ্বস্ত হতেও দেখা যায় না।
ছোট মামার সঙ্গে মৃত্তিকার সম্পর্ক বেশ ভালো; প্রায় সমবয়েসি – মামা এবং বন্ধু, দুটোই যেন। মামাই এবার ভাগ্নির বিয়ের জন্য অধিকতর তৎপর হলেন। আয়েশাও ছোট ভাইকে বারবার বলে যাচ্ছেন। এবার মৃত্তিকার মামা নানা জায়গায় পাত্র দেখছেন ভাগ্নির জন্য। মৃত্তিকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বর চাই রে, মা মিত্তি?’
‘888sport app মেডিক্যাল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ভাগ্নির জন্য মামা যেই রকমের চাইবে, সেটাই। মামা উপযুক্ত বিবেচনা করলেই হলো। তিন মামার একটাই তো ভাগ্নি। তো তোমার পছন্দ হলেই হলো। কিন্তু মামা …!’
‘কী, মামা?’
‘পাত্রকে কিন্তু আমার এই প্রাণীদের মেনে নিতে হবে। ওরা এখন যেমন আমার সঙ্গে আছে, তেমন করেই থাকবে। আমার মতো করেই তোমাদের ভাবি ভাগ্নিজামাইকেও দেখতে হবে এদের। এইটুকু মান্যতা দিলে, বলছি মামা, ফর্সা খানিকটা কম হলেও চলবে। লম্বায় একটু কম হলেও তোমার প্রিয় ভাগ্নি আপত্তি করবে না। গ্রাম থেকে আসা একজন হলেও না নেই; হোক ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা শিক্ষক বা ব্যাংকার। এবার বুঝেছো, মাই ডিয়ার মামা?’
‘হুম। বুঝেছি, মৃত্তি।’
ছোট মামার দৌড়ের পরিসরটা বেড়ে গেল। গন্তব্যে পৌঁছতে জোরে দৌড়াতে হবে। নয়তো সময় বেশি লেগে যাবে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.