এম আবদুল আলীম
উনিশ শতকের বাঙালি-সমাজে গভীর প্রভাবসঞ্চারী দুই মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪)। আধুনিক জীবনবোধ তথা রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত হলেও পাণ্ডিত্য, সৃজনশীলতা, দেশ-কাল-সমাজভাবনায় দুজন ছিলেন দুই মেরুর বাসিন্দা। একজন ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন খড়্গহস্ত; আরেকজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং চিন্তা-মননে আধুনিক হলেও ছিলেন সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং সময় সময় ঋষির আসনে সমাসীন। উভয়ের চিন্তা-কর্মে অমিল যেমন প্রবল, তেমনি মিলও বিস্তর; একজন পরশুরামের কঠোর কুঠার হাতে ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল প্রচলিত সংস্কার-কুসংস্কারের মর্মমূলে আঘাত হানতে সদা উদ্যত, আরেকজন শাণিত লেখনীর মাধ্যমে সমাজের নানা অসংগতির মূলোচ্ছেদে তৎপর। কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও সামগ্রিকভাবে এই দুই মনীষী স্বীয় চিন্তা এবং কর্মকাণ্ড দ্বারা উনিশ শতকের বাঙালি-সমাজের নানা সংস্কার সাধন করেছেন এবং সমাজের অগ্রগতি ও মানবকল্যাণে রেখেছেন অসামান্য অবদান।
বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের তুলনামূলক বিচার করতে গেলে প্রথমেই দৃষ্টি দিতে হয় তাঁদের ব্যক্তিজীবন, সমকালীন দেশ-কাল-সমাজ এবং পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের দিকে। বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ-পরিবারে, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার এক দোকান কর্মচারী। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁঠালপাড়া গ্রামে, পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। বিদ্যাসাগর পারিবারিক সূত্রে বিত্তের অধিকারী না হলেও, অর্থাৎ তাঁর পিতামহের বিত্ত না থাকলেও ছিল ‘হাস্যময় তেজোময় নির্ভীক ঋজুস্বভাব’, যাঁর তেজ বিদ্যাসাগরের চিত্তে ঠাঁই পেয়েছিল; রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : ‘এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোন সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয় সম্পদের উত্তরাধিকার বণ্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্রমাহাত্ম্য অখণ্ডভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠপৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়াছিলেন।’১ বাস্তবিকই উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তা হলো চরিত্রের তেজ। আঁতুরঘরেই এই শিশুর মধ্যে ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়ে পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ এঁড়ে বাছুরের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন : ‘একে এঁড়ে বাছুর বললাম কেন জানো? এ এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে। যা ধরবে তাই করবে, কাউকে ভয় করবে না। … ও হবে ক্ষণজন্মা, প্রথিতযশা, দয়ার অবতার। ওর জন্য আমার বংশ ধন্য হবে। ওর নাম রাখলাম ঈশ্বরচন্দ্র।’২ চরিত্রের তেজের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের গৌরবও বিদ্যাসাগর কতকটা পেয়েছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেই। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন বনমালীপুরের ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, তাঁর পিতার মাতামহ বীরসিংহের উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত, জননীর মাতামহ পাতুলের পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশ, নিজের মাতামহ গোঘাটের রামকান্ত তর্কবাগীশ; এঁরা সকলেই ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গোঁড়া হিন্দু-পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও এবং সনাতন ধর্মের আবহে বেড়ে উঠলেও তাঁর পরিবার ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উনিশ শতকের একটি প্রাগ্রসর চেতনার। সেখানে যেমন অনেক ইংরেজ সাহেবদের আসা-যাওয়া ছিল, তেমনি শিশু বঙ্কিমের সুযোগ হয়েছিল সাহেবদের বাড়িতে যাতায়াতের। বঙ্কিম শিক্ষাজীবনের শুরুতে যে-ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, তা ইংরেজ সাহেবদের পরামর্শের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। একদিকে পরিবারের আধুনিক শিক্ষিত সদস্যদের প্রভাব, অন্যদিকে ইংরেজ সাহেবদের সান্নিধ্য বঙ্কিমের চেতনাজগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পারিবারিক পরিসরে তাঁর ইঙ্গ-বঙ্গ সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার সান্নিধ্য-সংস্পর্শ লক্ষ করে অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন : ‘যাদবচন্দ্র ছাড়া পরিবারের 888sport appরাও দায়িত্বশীল সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুতরাং নিজের পরিবারের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র ইঙ্গ-বঙ্গ সংস্কৃতির নব-রূপায়ণের প্রভাব অনুভব করিয়াছিলেন।’৩
বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবন শুরু বীরসিংহ গ্রামের ভগ্নকুলীন কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। এরপর লেখাপড়া করেন কলকাতার শিবচরণ মল্লিকের পাঠশালা এবং সংস্কৃত কলেজে। সংস্কৃত কলেজ থেকে ব্যাকরণ, 888sport sign up bonus, ন্যায়, অলংকার, কাব্য, বেদান্ত এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে জ্ঞানার্জন করে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। বঙ্কিম লেখাপড়া করেন মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুল, হুগলি কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন সংস্কৃত ও দেশীয় শিক্ষায় এবং আরেকজন ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষায় নিজের চিন্তাজগৎ পুষ্ট করেন। বিদ্যাসাগর দেশীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাঁর মননে ইউরোপীয় জ্ঞান-888sport apkের আলো ঠিকরে পড়েছিল। তিনি প্রচলিত ধর্ম ও দেশাচারের বশ ছিলেন না। বঙ্কিম ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও এবং কোঁৎ-মিল-বেন্থাম প্রমুখের দর্শনের অনুরাগী হয়েও, আপাদ-মস্তক ছিলেন একজন ‘নিষ্ঠাবান হিন্দু’।৪ একই সঙ্গে 888sport live chatরসিক হলেও বঙ্কিম হিন্দু-পুনরুজ্জীবনবাদী ধ্যান-ধারণায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। কর্মজীবনে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা-অধ্যক্ষতার পাশাপাশি সরকারের শিক্ষাবিভাগের স্কুলপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে খুলনা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, মেদিনীপুর, বারাসত, হাওড়া, আলিপুর প্রভৃতি স্থানে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম উভয়ই বাল্যবিবাহ করেছিলেন। পিতার ভয়ে চোদ্দ বছরের বিদ্যাসাগর বিয়ে করেছিলেন আট বছরের দিনময়ী দেবীকে। কুলীন হিন্দুপরিবারের সন্তান বঙ্কিমকেও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় অল্প বয়সে; বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল এগারো, স্ত্রী মোহিনীদেবীর ছিল পাঁচ। একজন শেষজীবনে বাস করেন নিভৃত সাঁওতাল পল্লিতে, আরেকজন কাটান কলকাতার পটলডাঙায়।
বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০, বঙ্কিমের ১৮৩৮; উভয়ের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছর। তাঁদের আবির্ভাবের কাল ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগান্তরের কাল। পুরনো বিশ্বাস-সংস্কারের ভূমিতে ইউরোপীয় চিন্তার বিচ্ছুরণে জাতির জীবনে ঘটছিল নানা পরিবর্তন। সমাজে সামন্ত অর্থনীতির প্রভাব তখন প্রবল; ইউরোপীয় প্রভাবে ধনতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে, জমিদারি শোষণে কৃষি অর্থনীতির ক্ষয়িষ্ণু রূপও সামনে চলে আসে। তাছাড়া যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নতি, 888sport live chat-কারখানা স্থাপন, শিক্ষার প্রসার এবং ইউরোপীয় প্রভাবের বিচিত্র অভিঘাতে সমাজের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে যায়। বলা চলে, তখন এক প্রকার যুগান্তরের হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিল ভারতীয় জীবনে।৫ যার সূত্রপাত রামমোহনের হাতে, প্রধানত সতীদাহ প্রথা নিবারণসহ নানা সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ এবং ইউরোপীয় প্রভাবপুষ্ট চিন্তা-চেতনা সঞ্চারের ফলে। ভারতবর্ষের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান তখন দ্বন্দ্ব-মধুর সম্পর্কের ভেতর দিয়ে বসবাস করছিল; এক সম্প্রদায় রাজ্য-হারানোর বেদনায় অভিমানবশে ইতিহাসের উলটোপথের যাত্রী, আরেক সম্প্রদায় ইংরেজ শাসনকে স্বাগত জানিয়ে সামনে হাঁটছে।
কৃষি ও সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার নিষ্পেষণে বেশিরভাগ মানুষ তখন দারিদ্র্যের কশাঘাতে কাতরাচ্ছে। এর সঙ্গে দেব-দেবী নির্ভরতা এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার আচ্ছন্নতা তো ছিলই। ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন এবং বর্ণবৈষম্য হিন্দুসমাজের বুকে পাষাণের মতো চেপে বসেছিল, মুসলমান সমাজ ছিল আশরাফ-আতরাফের নানা ভেদাভেদে জর্জরিত। সর্বোপরি শ্বেতাঙ্গ দুঃশাসনও তখন জেঁকে বসতে শুরু করে। এসব কারণে ভারতবাসী পরিণত হয় একটি নির্জীব, জড়তাগ্রস্ত, হীনবল ও মুমূর্ষু জাতিতে। এরই মধ্যে নিজেদের শাসন আরো পাকাপোক্ত করতে এবং খ্রিষ্টধর্ম প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এদেশীয় ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহান্বিত হয়। এ-লক্ষ্যে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে বাংলা ভাষায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রচার শুরু করে। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি সংবাদপত্র প্রকাশ এবং ইংরেজি শিক্ষা তথা ইউরোপীয় জ্ঞানের প্রসারে তারা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদী উন্নাসিকতা এবং ভারতীয়দের ধর্ম, দেহবর্ণ ও জীবনাচার সম্পর্কে ঘৃণার ভাবও গোপন থাকে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, স্কুল বুক সোসাইটি, হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপনের ফলে ভারতবাসীর সামনে জ্ঞানের বিচিত্র দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ক্রমে পারলৌকিক জীবনের খোলস ছেড়ে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বজা উড়িয়ে তারা ইহলৌকিক জীবনের পথে পা বাড়ায়। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার মর্মবাণী তারা নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শেখে। ইতিহাস, 888sport apk, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি তথা আধুনিক জ্ঞান-888sport apkের নতুন আলোয় উদ্দীপ্ত হয়ে পুরনো বিশ্বাস ও জীবনাচার পেছনে ফেলে ইহজাগতিকতা, দেশপ্রেম এবং মানবতাবাদের ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরে। এক কথায়, বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম যে-যুগের মানুষ সে-যুগে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলোয় নতুন জীবনের আবাহনে ভারতবর্ষের মানুষ জেগে উঠেছিল। 888sport live chat-888sport live football, দর্শন-888sport apk, রাজনীতি, অর্থনীতি – সকল ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে। অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তির আবির্ভাবে ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারে লাগে নবচিন্তার দোলা। কৃষ্ণমোহনের খ্রিষ্টধর্ম প্রচার, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-কর্তৃক ব্রাহ্মধর্মের প্রসার, অক্ষয়চন্দ্র-রাজেন্দ্রলাল-মহেন্দ্রলাল প্রমুখের 888sport apkমনস্কতা, কৃষ্ণকমলের নিরীশ্বরবাদ প্রভৃতির প্রচার-প্রসারে সমাজে সৃষ্টি হয় বহুমাত্রিক তরঙ্গ। এমন যুগ-পরিবেশে বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম যুগচিত্তকে ধারণ করে স্বীয় কর্ম সম্পাদন করেন এবং তাতে ঘটান নবচিন্তার প্রকাশ।
বিদ্যাসাগর সবকিছু পরিচালনা করতেন ইহজাগতিক ভাবনা দ্বারা, বঙ্কিম পরিচালিত হতেন আধুনিক চিন্তার সঙ্গে গীতার অনুশীলনতত্ত্ব তথা – জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও কর্ম দ্বারা। বিদ্যাসাগরের কাছে ‘আকাশ অপেক্ষা মাটি, পরলোক অপেক্ষা ইহলোক, ভগবান অপেক্ষা মানুষ অধিকতর গুরুত্ব পেল, এর মধ্যেই পূর্ণ মানবতার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল।’৬ মানবপ্রেমই ছিল তাঁর মূল অস্ত্র। এই অস্ত্র হাতেই তিনি দুর্জয় সাহসে সমাজহিতৈষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যুগের হাওয়া, পাশ্চাত্য জ্ঞান-888sport apk অধ্যয়ন এবং সহজাত মানবপ্রীতি থেকে সঞ্চিত হয়েছিল তাঁর মানবতাবাদ; আর তাকে শিরোধার্য করেই পরিচালিত হয়েছে তাঁর মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড। ধর্মবিষয়ে তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। পিতৃদেব এবং জননীদেবীতেই তিনি বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণার সাক্ষাৎ পেয়েছেন। বঙ্কিম ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মের মৌল চেতনাকে আঁকড়ে ধরে তার সংস্কার-সাধনে লেখনী সঞ্চালন করেন। তিনিও ঈশ্বরপ্রীতি অপেক্ষা মানবপ্রীতিকে উচ্চে তুলে ধরেন এবং লেখেন : ‘মনুষ্যজাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে, তবে আমি অন্য সুখ চাই না।’ ভারতীয় সমাজে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত উৎকট বর্ণবৈষম্যজনিত সামাজিক সংকট নিরসনে বঙ্কিম সাম্যচিন্তার প্রকাশ ঘটান। সকল মানুষ সমানাবস্থাপন্ন হবে – এমনটি না মনে করলেও তিনি মানুষে মানুষে অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন; বলেছেন কৃষক ও ভূম্যধিকারীর বৈষম্য, 888sport promo code-পুরুষের বৈষম্য প্রভৃতি অপনোদনের কথাও। বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিস্তার এবং সমাজ-সংস্কারমূলক নানা কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করলেও উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা বঙ্কিম মূলত লেখনীর মাধ্যমে সমাজ ও মানবের হিতসাধন করেছেন। নিজে তো বটেই, নবীন লেখকদেরও তিনি সে-পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন : ‘যদি এমন মনে বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের ও মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।’
বিদ্যাসাগর যে-সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে-সমাজের নানা কুসংস্কার-অনাচার-অবিচার এবং প্রচলিত রীতি-নীতি, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটনে সদা তৎপর থেকেছেন। তিনি বাঙালি হিন্দুসমাজে ‘নবযুগের আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছিলেন।’৭ বলা যায়, কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি সমাজজীবনে আনেন নতুন গতিবেগ। এ-প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ লিখেছেন : ‘বিদ্যাসাগরের যুগ ছিল ডালহৌসির যুগ। … রেলপথ ও টেলিগ্রাফ নির্মাণ, দু’পয়সার ডাকব্যবস্থার প্রবর্তন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন, সবই কিন্তু নতুন গতি-শক্তির উপকরণ। … বাংলা সমাজ-জীবনে যে সময় এই নূতন গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়, নতুন চলমান মধ্যবিত্তশ্রেণীর প্রসার হয়, ঠিক সেই সময় বিদ্যাসাগর তাঁর প্রত্যক্ষ সামাজিক আন্দোলন আরম্ভ করেন।’৮ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী আচার-প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা যার সূত্রপাত ঘটান, সেই রেনেসাঁসের আলোকবর্তিকা হাতে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ-প্রথা নিবারণের আন্দোলনের ডাক দিয়ে ভারতীয় সমাজে জাগরণের যে-ঢেউ তোলেন; বিদ্যাসাগর তা বেগবান করেন বিধবাবিবাহ প্রচলন, শিক্ষাবিস্তার এবং বাল্যবিবাহ-রোধ আন্দোলনের মাধ্যমে। তবে তাঁর সংস্কারমূলক চিন্তা ও কর্ম রামমোহনের মতো ধর্মাচ্ছন্ন ছিল না। এক্ষেত্রে হিন্দু কলেজকেন্দ্রিক ইয়ং বেঙ্গল দলের চিন্তা-চেতনা তাঁকে পথ দেখিয়েছে। ইয়ং বেঙ্গলের মুখপত্র এনকোয়ারার (১৮৩১-৩৫) এবং জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১-৪৪) পত্রিকায় কুলীনপ্রথা ও বহুবিবাহের সমালোচনা এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে মতামত তুলে ধরে যেসব লেখা প্রকাশিত হয়, তা বিদ্যাসাগরকে প্রভাবিত করে। বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ শিরোনামে 888sport liveটি যে-পত্রিকায় (সর্বশুভকরী) প্রকাশিত হয়, তাও হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রকাশিত। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার উদ্ভাসনে বিদ্যাসাগরের এ-888sport liveটি তাঁকে দান করে ‘যথার্থ হিউম্যানিস্ট পণ্ডিতের মর্যাদা।’ সহজাত মানবপ্রীতি এবং সমকালীন যুগের আবহাওয়া থেকে সঞ্চিত চিন্তাধারা তাঁকে মানবতাবাদী করে তুলেছিল এবং সমাজ-সংস্কারে ব্রতী করেছিল। শাস্ত্রবচন তিনি মানতেন না, কিন্তু শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়েই তিনি রক্ষণশীলতার মর্মমূলে আঘাত হেনেছেন। পিতা-মাতার প্রেরণা এবং এক বিধবা বালিকার বুকফাটা আর্তনাদ তাঁকে বিধবাবিবাহ আন্দোলনে নামতে অনুপ্রাণিত করে। এর সঙ্গে যুক্ত করেন সমাজে দীর্ঘকাল প্রচলিত শাস্ত্রীয়তার কঠোর অনুশাসন। কঠোর সাধনায় শাস্ত্রবাক্য (‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।/পঞ্চস্বাপৎসু 888sport promo codeণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।’) উদ্ধার করে বিদ্যাসাগর যুক্তি দেখান, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ। শাস্ত্রবিধান খুঁজে পাওয়ার পর বিধবাবিবাহ প্রচলনে তিনি উঠেপড়ে লাগেন। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (জানুয়ারি ১৮৫৫) পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেন, ‘এরূপ বিষয়ে এ দেশে শাস্ত্রই সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্ম্মই সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম্ম, ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।’ বিধবাদের দুর্বিষহ জীবনচিত্র তুলে ধরে ওই পুস্তকে লেখেন : ‘দুর্ভাগ্যক্রমে বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা, যাঁহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্পবয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত শত বিধবারা ব্রহ্মচর্য্যনির্ব্বাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভ্রƒণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণার নিবারণ, ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের পরিহার, ও তিনকুলের কলঙ্কবিমোচন হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইতেছে, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।’ বিধবা-বিবাহবিষয়ক প্রথম পুস্তিকা প্রচারের পর বিদ্যাসাগরকে আবারো কলম ধরতে হয়। কারণ, তাঁর বই প্রকাশের পর একদল পণ্ডিত পালটা যুক্তি তুলে ধরে পুস্তক রচনা করে বলেন, আমাদের শাস্ত্র বিধবাবিবাহ সমর্থন করে না। এরপর অনেক শাস্ত্রীয় বচনের আশ্রয় নিয়ে রক্ষণশীল পণ্ডিতদের যুক্তি খণ্ডন করে তাঁকে রচনা করতে হয় বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (দ্বিতীয় পুস্তক, অক্টোবর ১৮৫৫)। এখানেই শেষ নয়, বিধবাদের বেদনার ভয়াবহতা অবলোকন করে তিনি বলেন, ‘যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে। হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।’ পুস্তক-রচনার পাশাপাশি এক হাজার লোকের স্বাক্ষর-সংগ্রহ করে তিনি সরকারের নিকট আবেদন করেন। তাঁর এ-তৎপরতা ছিল ভিমরুলের চাকে ঢিল মারার শামিল। তিনি এক হাজার স্বাক্ষর-সংগ্রহ করে আবেদন করলে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে প্রতিপক্ষ বিধবাবিবাহের বিপক্ষে তেত্রিশ হাজার স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদন জমা দেন। এছাড়া কলকাতা, পুনা, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বারাসত, বোম্বাই, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত জয় হয় বিদ্যাসাগরের। তাঁর প্রাণান্ত প্রয়াস সফল হয়। কারণ তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘যখন এ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন ইহার প্রাণান্ত পণ জানিও। ইহার জন্য যথাসর্বস্ব দিব।’ ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই সরকার বিধবাবিবাহ আইন পাশ করে; আইনটির নাম ছিল : Act XV of 1856, being an Act to remove all legal obstacles to the Marriage of Hindu Widows. এই আইন পাশের পর একই বছর ৭ ডিসেম্বর জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়; যার পাত্র-পাত্রী ছিলেন যথাক্রমে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালীমতী দেবী। পরে বিদ্যাসাগরের নিজের পুত্র নারায়ণও বিয়ে করেন ভবসুন্দরী নামে এক বিধবাকে। বিধবাবিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় হিন্দুসমাজে যুগ যুগ ধরে রক্ষণশীলতার যে-পাষাণপ্রাচীর নির্মিত হয়েছিল, তার ভিত কাঁপিয়ে দেন। এটি বাস্তবায়নে তিনি পুস্তক রচনা করে, নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সামাজিক আন্দোলন করেন এবং প্রচুর অর্থও ব্যয় করেন। এ-কাজ করতে গিয়ে সময় সময় তাঁর জীবন হুমকির মুখে পড়লেও কোনোকিছুই তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। মূলত, বিধবাবিবাহ প্রচলনের এই আন্দোলন ছিল তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মহৎকর্ম।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সমাজ নিয়ে ভেবেছেন এবং সামাজিক অসাম্য, ভণ্ডামি ও রাজনৈতিক অসংগতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছেন। প্রচলিত 888sport live footballাদর্শের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। এক্ষেত্রে অগাস্ট কোঁৎ-এর পজিটিভিজম বা 888sport apkসম্মত মানব-সেবা-ধর্ম তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে ব্যক্তি-মানুষ অপেক্ষা সমগ্র মানবজাতি তথা সমষ্টির কল্যাণে তিনি স্বীয় চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। হিন্দুসমাজের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে লেখনী সঞ্চালন করলেও বঙ্কিমের চেতনাজগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল দেবোপম পিতা, দেবীপ্রতিমা মাতা, জাগ্রত দেবতা রাজবল্লভ, ভট্টপল্লির অধ্যাপকমণ্ডলী, প্রসিদ্ধ কথকদের ভাগবতপাঠ, পূজার দালানের হোম-চণ্ডীপাঠ-শান্তিস্বস্তয়ন, গোবিন্দ অধিকারীর কৃষ্ণযাত্রা, দুর্গোৎসব-রথ-রাস প্রভৃতি পার্বণ, ক্ষুদ্র পল্লির শঙ্খধ্বনি, মন্দিরের স্তোত্রপাঠ প্রভৃতি।৯ বাল্যকালে এসব পরিবেশ থেকে আহরিত রস উত্তরকালে অগ্রাহ্য করতে পারেননি; জ্ঞান-888sport apkচর্চার ফলে ঘোরতর সংশয়বাদী হয়ে উঠলেও শৈশবে সঞ্চিত ঐতিহ্যের আকর্ষণ তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মদর্শিতা তাঁর সনাতন নীতিধর্ম বোধের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘ঈশ্বরানুবর্ত্তিতাই ভক্তি এবং সেই ভক্তি ব্যতীত মনুষ্যত্ব নাই।’ 888sport promo code-পুরুষের সমান অধিকারের কথা জোর দিয়ে বললেও এবং তাঁর 888sport alternative link-888sport liveে সময় সময় বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেও, শেষপর্যন্ত তিনি সামাজিক নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। কৃষ্ণকান্তের উইল 888sport alternative linkে বালবিধবা রোহিণীর প্রেমের অধিকার দিয়েও পরে তাকে হত্যা করান এবং নায়ক গোবিন্দলালকে ফিরিয়ে আনেন তার সতী-সাধ্বী স্ত্রী ভ্রমরের কাছে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের আন্দোলনকে তিনি প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছেন। এজন্যে, বিষবৃক্ষ 888sport alternative linkের নায়িকাকে দিয়ে বলিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর যদি পণ্ডিত হন, তবে মূর্খ কে?’ এখানেই শেষ নয়, তিনি সাম্য গ্রন্থে লিখেছেন : ‘অতএব বিধবা, বিবাহে অধিকারিণী বটে। কিন্তু এই নৈতিক তত্ত্ব অদ্যাপি এদেশে সচরাচর স্বীকৃত হয় নাই। যাঁহারা ইংরেজি শিক্ষার ফলে, অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয় বা ব্রাহ্ম ধর্মের অনুরোধে, ইহা স্বীকার করেন, তাঁহারা ইহাকে কার্যে পরিণত করেন না। … তাহার কারণ, সমাজের ভয়।’ এ-গ্রন্থে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা বলিব, বিধবাবিবাহ ভালও নহে, মন্দও নহে। সকল বিধবার বিবাহ হওয়া কদাচ ভাল নহে, তবে বিধবাগণের ইচ্ছামত বিবাহে অধিকার থাকা ভাল; যে স্ত্রী সাধ্বী, পূর্ব্বপতিকে আন্তরিক ভালবাসিয়াছিল, সে কখনই পুনর্বার পরিণয় করিতে ইচ্ছা করে না; যে জাতিগণের মধ্যে বিধবাবিবাহ প্রচলিত আছে, সে সকল জাতির মধ্যেও পবিত্রস্বভাববিশিষ্টা, স্নেহময়ী, সাধ্বীগণ বিধবা হইলে কদাপি আর বিবাহ করেন না।’ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও বঙ্কিম ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি তুলে হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন এবং মুসলিম শাসনামলের নানা ঐতিহাসিক ঘটনা সামনে এনে রাজপুতদের বিজয়ধ্বজা উচ্চে তুলে ধরেছেন। তিনি হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যেমন বিভোর হয়েছেন, তেমনি কৃষ্ণচরিত্র এবং গীতার অনুশীলন তত্ত্বের মাহাত্ম্য প্রচারে তৎপর থেকেছেন। মৃণালিনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরী, সীতারাম, রাজসিংহ, সাম্য, কৃষ্ণচরিত প্রভৃতি গ্রন্থ এবং অনেক 888sport liveে এর প্রকাশ লক্ষ করা যায়। হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন : ‘যাহাতে মনুষ্যের যথার্থ উন্নতি, শারীরিক মানসিক এবং সামাজিক সর্ব্ববিধ উন্নতি হয়, তাহাই ধর্ম্ম। এইরূপ উন্নতির তত্ত্ব লইয়া সকল ধর্ম্মেই সার ভাগ গঠিত। এরূপ উন্নতির তত্ত্ব সকল ধর্ম্মাপেক্ষা হিন্দুধর্ম্মেই প্রবল।’ প্রফুল্ল চরিত্রের মাধ্যমে ধর্মকে তিনি বিপ্লবাত্মক রূপ দিয়েছেন। তবে এও সত্য যে, ঐতিহ্য ও সাধুসজ্জনের প্রভাব সত্ত্বেও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর অনুরাগ ‘মুখ্যত ছিল একজন সুপণ্ডিত বুদ্ধিজীবীর অনুরাগ।’১০ তাঁর জন্মগত সংস্কার যা-ই থাকুক না কেন, চেতনার সজ্ঞান ভাববিস্তারের মূলে ছিল নতুন যুগের মনোভাব, যা সঞ্চারিত হয়েছিল ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে।১১ নিজের অগোচরেই বঙ্কিম হিন্দুধর্মের মূল ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। এর ফলে যুগ যুগ ধরে পাষাণভার চেপে থাকা ভারতীয় জীবনে সমাজ ও ধর্মসম্পর্কের বন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং সমাজের ভেতর থেকে নতুন শক্তির উত্থান ঘটে। সমাজ-সংস্কারক হিসেবে ঋষি বঙ্কিমের অবদান এখানেই যে, সজোরে ঘা মেরে তিনি সংস্কার-কুসংস্কারের অতলে ডুবে থাকা হিন্দুসমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
বিধবাবিবাহ প্রচলনের পাশাপাশি বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধে আন্দোলন করেছেন। তিনি ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বহুবিবাহ রহিত করার জন্য গভর্নমেন্টের কাছে একটি আবেদন দেন। বহুবিবাহ নিবারণে বিদ্যাসাগরের এই আবেদন সরকার-কর্তৃক গৃহীত হওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও সিপাহী বিদ্রোহের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করলেও এ-সময় বহুবিবাহ রোধের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক বাক্বিতণ্ডা হয়। এমন পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর রচনা করেন বহুবিবাহ রোহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার (আগস্ট ১৮৭১) নামক পুস্তিকা। এ-গ্রন্থে বহুবিবাহ রোধে শাস্ত্রীয় যুক্তি তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি বঙ্গের হিন্দুসমাজে এর প্রকোপের বাস্তব পরি888sport free betন তুলে ধরেন এবং সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি তোলেন। বিতর্ক প্রবল আকার ধারণ করলে বিদ্যাসাগর আরো যুক্তি-তথ্যসংবলিত করে রচনা করেন বহুবিবাহ রোহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার দ্বিতীয় পুস্তক (১ এপ্রিল ১৮৭৩)। পুস্তিকাটি প্রকাশের পর রক্ষণশীল সমাজ আরো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়; স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কঠোর সমালোচনা করে বঙ্গদর্শনে দীর্ঘ 888sport live লেখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘বহুবিবাহ এদেশে যতদূর প্রবল বলিয়া, বিদ্যাসাগর প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন, বাস্তবিক ততটা প্রবল নহে। … বহুবিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তকে যে ভাষা ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহাতে ভদ্রসমাজে বিচার চলিতে পারে না। … যিনি ভদ্রলোকের ব্যবহার্য্য ভাষা ব্যবহার না করিয়া কটূক্তি করেন, তাহার সহিত বিচার করিতে ঘৃণা করি।’ বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ প্রচলনবিষয়ক গ্রন্থের কঠোর সমালোচনা করলেও বঙ্কিম শেষ পর্যন্ত বহুবিবাহের অধিকারকে ‘নীতিবিরুদ্ধ’ ও ‘কদর্য প্রথা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, 888sport promo code-পুরুষ কারোই বহুবিবাহের অধিকার থাকা উচিত নয়; এমনকি অপুত্রক রাজা কিংবা যার স্ত্রী কুষ্ঠাদি রোগগ্রস্ত – তাদেরও।
বিদ্যাসাগর 888sport promo codeর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজ-সংস্কারমূলক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি 888sport promo codeশিক্ষার প্রসারে বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে পরবর্তী সাত মাসে তিনি বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর এবং নদীয়া অঞ্চলে ৩৫টি বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নিজগ্রাম বীরসিংহেও প্রতিষ্ঠা করেন একটি বালিকা-বিদ্যালয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিধবাবিবাহের ঘোরবিরোধী হলেও 888sport promo codeর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজের বিবিধ অনুশাসনে নিষ্পেষিত 888sport promo codeদের মুক্তির জন্য তিনি লেখনী ধারণ করেছেন। ভারতীয় সমাজে 888sport promo codeদের অন্তঃপুরবাসী করে রাখার প্রথাকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। একে তিনি বন্যপশুর ন্যায় বদ্ধ করে রাখার মতো নিষ্ঠুর, জঘন্য, অধর্মপ্রসূত বৈষম্য বলে অভিহিত করে বলেছেন : ‘ধর্মরক্ষার্থে যে স্ত্রীগণকে পিঞ্জরনিবদ্ধ রাখা আবশ্যক, হিন্দুমহিলাগণের এরূপ কুৎসা আমরা সহ্য করিতে পারি না।’ গৃহকর্ম, বিদ্যাশিক্ষা, অর্থোপার্জন, পৈতৃক সম্পত্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে 888sport promo codeর সমানাধিকারের বিষয়েও তিনি নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। 888sport promo codeর সতীত্বধর্ম যেমন সর্বতোভাবে রক্ষণীয়; তেমনি পুরুষের বারস্ত্রীগমন, পরদারনিরত হওয়াও অনুচিত বলে তিনি মনে করেন। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও 888sport promo codeসমাজের সামগ্রিক কল্যাণে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন : ‘পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ব্রাহ্মসম্প্রদায় অনেক যত্ন করিয়াছেন – তাঁহাদিগের যশঃ অক্ষয় হউক; …।’
বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম দুই ভিন্ন পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে উঠলেও উভয়েই উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত ছিলেন। আধুনিক জীবনবোধ, যুক্তিবাদ, মানবপ্রত্যয়, ইহজাগতিকতা প্রভৃতি দ্বারা তাঁরা পরিচালিত হয়েছেন। ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল প্রচলিত বিধান দুজন দু-ভাবে এবং ভিন্ন দৃষ্টির আলোকে গ্রহণ-বর্জন করলেও এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনাদর্শ স্বকীয়তামণ্ডিত হলেও, উভয়ের মানবকল্যাণচিন্তায় অনেক মিল রয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, তাঁদের সমাজভাবনা এবং জীবনদর্শন আলাদা স্রোতে প্রবাহিত হলেও মানবহিতৈষণার প্রশ্নে উভয়েই সময় সময় এক মোহনায় মিলিত হয়েছেন। বস্তুত, বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের চিন্তা উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের অগ্রগতি সাধনে কাজ করেছে সঞ্জীবনীসুধার।
সহায়কপঞ্জি
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরচরিত, কলকাতা, শ্রাবণ ১৩৬৫, পৃ ১৯।
২. উদ্ধৃত, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃ ১১।
৩. অরবিন্দ পোদ্দার, বঙ্কিম-মানস, গ্রন্থবিতান, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৭৫, পৃ ৪৪।
৪. সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় সংস্করণ, বাংলা একাডেমি, 888sport app, জানুয়ারি ১৯৯৭, পৃ ২৪৩।
৫. ‘উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের অভিঘাতের ফলে বাংলার চিরাচরিত ঐতিহ্যিক সমাজে ভাঙন দেখা দিতে শুরু করেছিল। এই অভিঘাতের যেমন বহুমুখী স্বরূপ ছিল, তেমনি বহুমুখী ছিল সমাজের প্রতিক্রিয়া। এক নব্য ভূভিত্তিক অভিজাত শ্রেণীর আবির্ভাব, এক নয়া ব্যবসায়ী শ্রেণীর উন্মেষ এবং এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে এক আধুনিক আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ভিত রচিত হয়েছিল।’ – সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, উনিশ শতকের বাংলার সমাজ-চিন্তা ও সমাজ বিবর্তন ১৮১৮-১৮৩৫, জার্নিম্যান বুক্স, 888sport app, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ ৩০।
৬. অজিতকুমার ঘোষ, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বর্তমান কাল’, বিদ্যাসাগর : 888sport cricket BPL rate শতকের চোখে, পল্লব সেনগুপ্ত ও অমিতা চক্রবর্তী, দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, মে ২০০৩, পৃ ১১।
৭. আনিসুজ্জামান, বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা, পৃ ২১।
৮. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, প্রথম ওরিয়েন্ট লংম্যান সংস্করণ, কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৭৩, পৃ ৩৭১।
৯. উদ্ধৃত, অরবিন্দ পোদ্দার, বঙ্কিম-মানস, পৃ ১৫৬।
১০. অরবিন্দ পোদ্দার, বঙ্কিম-মানস, পৃ ১৫৬। ১১. মোহিতলাল মজুমদার, বঙ্কিম-বরণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৯৬৫, পৃ ১৬।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.