বিন্দু থেকে বৃত্তায়নের রূপায়ণ

মামলাল সাক্ষী ময়না পাখি

শাহাদুজ্জামান

প্রথমা প্রকাশন l 888sport app, ২০১৯ l ২৫০ টাকা

আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে শাহাদুজ্জামান এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। ভিন্ন ধরনের চিন্তা, উদ্ভাবনী শক্তি, ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণভাবনা তাঁর ছোটগল্পকে সর্বজনীন করে তুলেছে। বিভিন্ন ও বিচিত্রধর্মী মিথ এবং লোকপুরাণের বিশেষ প্রয়োগে তাঁর গল্প হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন। তাঁর রচিত সমকালীন গল্পগ্রন্থ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বিন্দু থেকে বৃত্তায়নের দিকে যাত্রার এক অভিনব সংযোজন।

‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’ – এই গল্পটিতে গল্পকার শাহাদুজ্জামান স্তন্যপায়ী প্রাণীর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খেলার অপরিহার্যতার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য অতএব শৈশবে খেলা বেঁচে থাকবার, বেঁচে উঠবার একটা অপরিহার্য শর্ত।’ তিনি এ-কথা উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে মানবজীবনের সৃষ্টিশীল সত্তার ক্রমপরিণতির দিকে অগ্রযাত্রাকে ইঙ্গিত করেছেন। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। সে তার সৃজনকর্মস্বরূপ অর্থহীন খেলার মধ্য দিয়ে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার প্রচেষ্টায় রত থাকে। তবে এই সৃজনকর্ম হতে হবে ব্যতিক্রম। গতানুগতিক ধারার সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করা যায় না। গল্পকার শাহাদুজ্জামান এই গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’ গল্পটিতে মতিন কায়সার নামে এক গল্পলিখিয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীর সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন।

গল্পকার শাহাদুজ্জামান হাসপাতালে ওয়ার্ডে রাখা পাঁচজন রোগীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গল্পটির সমাপ্তি টেনেছেন। এই পাঁচজন রোগীর গল্পটা পুরনো। তবুও সেটিই মতিন কায়সারের মনে উঁকি দেয়। ওয়ার্ডে রাখা পাঁচজন রোগী জানে তারা সবাই মারা যাবে। তাদের ওয়ার্ডে একটা জানালা আছে। ফলে জানালার পাশে যে-রোগী শোয় সে-ই কেবল বাইরের দৃশ্য দেখতে পায়। সে সহরোগীদের কাছে বাইরের দৃশ্য বর্ণনা করে। সহরোগীদের মনে একটা নতুন গল্পের ভুবন নির্মাণে সচেষ্ট হয়। সে তাদের ভোরের সূর্য কতটা লাল, গাছের পাতারা কেমন হলুদ থেকে সবুজ হয়ে ওঠে, নদীর পাড়, প্রেমিক যুগল ও তাদের মাথার ওপর দিয়ে নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যাওয়ার গল্প বলে। গল্প শুনে বাকি রোগীরা অধীর উদগ্রীব আর উত্তেজনায় জানালার পাশের বিছানায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। জানালার পাশের লোকটি হঠাৎ একদিন মারা গেলে লটারিতে সুযোগ পেয়ে তৃতীয় রোগীটির জানালার পাশের বিছানায় শোয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু পরদিন সে শুধু জানালা দিয়ে তাকিয়ে একটা উঁচু নিরেট দেয়াল দেখতে পায়। ‘তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পায় একটা উঁচু নিরেট দেয়াল। সে দেয়াল ভেদ করে কোথাও কিছু দেখা যায় না। বাইরে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পায় সাদা, শীতল একটা ইটের দেয়াল। আর কিছু না।’

গল্পকার শাহাদুজ্জামান এ-গল্পে একজন হয়ে ওঠা গল্পকারকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। যে-গল্পকার জ্ঞান দিয়ে নয়, উপলব্ধি, অন্তরজাত অনুভূতির মধ্য দিয়ে জ্ঞানের নিরেট বস্তুর মধ্যে রূপসৃষ্টির নতুন জগৎ বিনির্মাণ করবেন। যে-জগৎ জ্ঞানের চোখ দিয়ে দৃষ্টিগোচর হবে না। যা হবে স্পর্শাতীত। অতীন্দ্রিয়ের মধ্যে যা দৃশ্যমান হবে। বাস্তবের বন্ধুর পথ ভেঙে; ঈর্ষা, গসিপ, অ্যারোগেন্সের ক্যাকটাসের কাঁটাকে পাশ কাটিয়ে যেখানে গল্পকার এমন এক অনাস্বাদিত গল্পভুবন নির্মাণ করবেন যার ভেতর দিয়ে গল্পকারের মৃত্যু ঘটলেও পাঠক সে-গল্পরসে স্বপ্ন দেখার প্রেরণা পাবে।

‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ গল্পটিতে গল্পকথক আইসিইউতে ভর্তি ক্যানসার রোগাক্রান্ত তার বাবার জীবন-সন্ধিক্ষণের এক রূঢ় বাস্তবতার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যু সম্পর্কে তার অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।  উত্তম পুরুষের জবানিতে গল্পটি বর্ণিত হয়েছে। গল্পকথকের বাবার ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে। তার বাবার শরীরে টিউব, নল, ভেন্টিলেটরসহ নানা মেডিক্যাল ইকুপমেন্ট লাগানো। যার প্রতিদিনের খরচ চল্লিশ হাজার টাকা। প্রতিদিন এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হবে; কিন্তু তার বাবার জীবন ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটি অনিশ্চিত থেকে যাবে। মেডিক্যাল সায়েন্স তার বাবার লাইফকে প্রলং করার একটা অপশন তাকে দিয়েছে; কিন্তু নিশ্চিত করে বলেনি তিনি ভালো হয়ে যাবেন।

গল্পকথক তার বাবার চেতনাকে ধারণ করে উত্তম পুরুষের জবানিতে গল্পটি পাঠকের কাছে বর্ণনা করেছেন। ফলে গল্পের উপস্থাপন রীতি ও কৌশলে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। গল্প বলার এমন কৌশল ও ভঙ্গি সহজেই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। গল্পকার শাহাদুজ্জামান মৃত্যুর পাশে চলমান জীবনের গদ্য পাঠককে শুনিয়েছেন। যাপিত জীবনের ঘটনার বর্ণনা কখনো কখনো গল্পকথকের বাবার মৃত্যুর চিত্রকে আড়াল করেছে। মৃত্যুবিরোধী গল্পকথক তার বাবার বলে যাওয়া গল্পের বর্ণনার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের গল্প বুনে চলেছেন এবং জীবনকে জয়যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার বাবা তার কাছে গল্পগুলো এমন নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতেন, তার মনে হতো, তার বাবা কোনো থিয়েটারের বর্ণনা দিচ্ছেন। গল্পকার শাহাদুজ্জামান গল্পটিতে বাবার গল্প বর্ণনা করার কৌশলের ভেতর দিয়ে ছেলের মনোজগতে বাবার একটি স্থায়ী ছবি আঁকতে সমর্থ হয়েছেন। বাবার এ-গল্প বর্ণনরীতির কারণে ছেলের মনে বাবার মৃত্যুসংক্রান্ত চিন্তার বিপরীতে জীবন সংলগ্নতার বোধ ফুটে উঠেছে।

গল্পটিতে একটা মৃত্যুদৃশ্যের অবতারণা করে জীবনের জয়গানকে মুখরিত করতে চেয়েছেন গল্পকার। জীবনবাদী গল্পকার বাবার জীবন সম্পর্কে আশান্বিত থাকতে চেয়েছেন। তাই লেখক গল্পশেষে বলেছেন, ‘আমি আবারও স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই যে মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার, আমি এর ঘোর বিরোধী।’ জীবনকে মৃত্যুসংগ্রামের বিপরীতে জয়ী করার দৃঢ় প্রত্যয় গল্পকার এ-গল্পে ব্যক্ত করেছেন।

‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’ গল্পে গল্পকার এক চিন্তাশীল প্রবীণ বানরের মধ্য দিয়ে পুরান 888sport appর জনপদের কথা উল্লেখ করে আবদুল মোমেনের পারিবারিক জীবনচিত্রের গল্প তুলে ধরেছেন। গল্পকার পুরান 888sport appর নারিন্দার পঞ্চাশ কামরার বিশাল বাড়ি ‘পাঠান মঞ্জিলে’র কথা বলেছেন, যেখানে আবদুল মোমেন তার পরিবার নিয়ে বাস করে। পুরান 888sport appর মানুষের অদ্ভুত জীবনযাপন এবং তাদের  ভাষা ও আচরণে মনোবিকারগ্রস্ততার বর্ণনা দিয়ে তিনি গল্পটি শুরু করেছেন। গল্পকার এ-জনপদে বসবাসরত বাসিন্দাদের মনোসমীক্ষণে জাদুবাস্তবতার দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন। এ-অঞ্চলের মানুষ খেয়ালি ও হেঁয়ালিপনায় যেমন অভ্যস্ত, তেমনি তাদের যৌনজীবনের চিন্তনস্তরে রয়েছে নানা ধরনের অসংগতি। গল্পশেষে আবদুল মোমেনের পারিবারকেন্দ্রিক এমনি এক যৌন-অসংগতি চরিতার্থের বর্ণনা তুলে ধরেছেন লেখক।

কলকাতার 888sport free betলঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার আবদুল মোমেনের পরিবারটি যখন মোমেনের বন্ধু আলী হায়দারের সহযোগিতায় পুরান 888sport appর পাঠান মঞ্জিলে বসবাস করতে শুরু করে, তখন থেকেই একটা বিশেষ প্রবীণ বানর তাদের লক্ষ করতে শুরু করে। মহল্লার আলী হায়দারের পরিবারের সঙ্গে মোমেনের পরিবারের যোগাযোগ ও সখ্য গড়ে ওঠে। আলী হায়দারের স্ত্রীর গ্রামের এক দরিদ্র আত্মীয় ফরিদ তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে। পোলিও আক্রান্ত হয়ে এক পা পঙ্গু হয়ে যাওয়াতে মহল্লায় সে ল্যাংড়া ফরিদ নামে পরিচিত। আলী হায়দার ফরিদকে বাংলাবাজারে বই বাঁধাইয়ের কাজে লাগিয়ে দেয়। মোমেনের পরিবারে নানা ফুটফরমাশ খাটার জন্য আলী হায়দার ফরিদকে মাঝে মধ্যে মোমেনের পরিবারে পাঠায়। গল্পের পরিণতি দানে এই ল্যাংড়া ফরিদের ভূমিকাকে বিশেষভাবে সুচিহ্নিত করেছেন গল্পকার। অবিবাহিত টুম্পার গর্ভবতী হওয়া এবং গর্ভপাতের ঘটনা, মহল্লার মানুষের মধ্যে কৌতূহলের জন্ম দেয় এবং এ-কৌতূহল থেকে তারা সত্য উদ্ঘাটনে তৎপর হয়ে ওঠে। মহল্লার লোক সত্য উদ্ঘাটনে টুম্পার চিকিৎসাকারী ডাক্তারকে নিয়োগ করলে টুম্পা ডাক্তারকে তার গর্ভবতী হওয়ার ব্যাপারে ল্যাংড়া ফরিদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে। তার সঙ্গে ল্যাংড়া ফরিদের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে ফরিদ তার মা নিলুফারের সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে – এমন তথ্য প্রদান করে। তার ও ফরিদের বিচারের পূর্বে তার মা ও ফরিদের অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিচার করতে বলে। এ-সময়ে গল্পকার পাঠককে জানালায় মুখ বাড়িয়ে চিন্তাশীল ভঙ্গিতে সেই প্রবীণ বানরের তাকিয়ে থাকার কথা জানান। গল্পকার শাহাদুজ্জামানের এক অসাধারণ 888sport live chatোত্তীর্ণ গল্প ‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’।

গল্পকার শাহাদুজ্জামানের ‘লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে’ গল্পটির গঠনে বৈচিত্র্য রয়েছে। গল্পটির পরিবেশনায় একটি গতি রয়েছে। গল্প বলার ভঙ্গি ও গতির টানে পাঠকের মনে একধরনের তীব্র কৌতূহল ও উত্তেজনা জারিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন গল্পকার। গল্পশেষে ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণতত্ত্বে বিশ্বাসী লেখক বিকৃত যৌনচেতনার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গল্পটির নাটকীয় পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে পাঠকের কৌতূহল ও উত্তেজনা নিবৃত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। গল্পকার গল্পটিকে একটি বিন্দু থেকে শুরু করে তাকে বৃত্তে রূপ দিয়েছেন। পনেরোটি ছোট ছোট পরিচ্ছদে বিন্যস্ত গল্পটির সূচনার সঙ্গে শেষটিকে মিলিয়ে দিয়েছেন। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি শৈল্পিক নির্মাণকাঠামোর দৃষ্টান্ত রেখেছেন তিনি। গল্পের গঠন ও বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে বোঝা যায়, গল্পটির সূচনা এবং উপসংহার তিনি আগে নির্মাণ করে পরবর্তীকালে পুরো গল্পের প্লট পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন।

‘লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে’ গল্পটির সূচনাতে গল্পকার নার্গিস পারভীন নামে এক চঞ্চল যুবতীর বর্ণনা দিয়েছেন, হরিণীর মতো যার চলন। নিজ গ্রামে ‘ছক্কা বেটি’ হিসেবে পরিচিত। সে গ্রামের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কুপি জ্বালিয়ে লুডু খেলে এবং ছক্কা পড়লে উত্তেজনায় সে চিৎকার করে বলে ওঠে ‘ছক্কা আআআ’। গল্পের শুরুতে দিনশেষে তাকে একটি কালো ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। তার ছাগলের গায়ের ওপর একটা শালিক বসে থাকে। গল্প এগিয়ে চললে জানা যায়, সে স্বামী পরিত্যক্ত বাঁজা 888sport promo code। কিন্তু তার রূপ-যৌবনে, চলনে-বলনে সে তার চারপাশে একটা ঘোর তৈরি করতে সমর্থ। ‘তাকে দেখলে ভাবা যেতে পারে যে সে আর জনমে হরিণ ছিল। চাঞ্চল্য এবং মায়া মিলিয়ে একটা ঘোর তৈরিতে সে পারঙ্গম।’

গল্পে মোজাম্মেল আলী অন্যতম প্রধান চরিত্র। সত্রাসিয়া গ্রামে তার বসতি। সে পেশায় একজন কাঁঠাল ব্যবসায়ী। সম্প্রতি তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন মৃত্যুবরণ করলে তার জীবনে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্ত্রীর মৃত্যুতে পাশের গ্রাম থেকে তার বাড়িতে আসে তার একমাত্র মেয়ে রেহানা, মেয়েজামাই রুহুল আমিন এবং নাতনি জুঁই। কিছুদিন পর শোক প্রশমিত হলে মোজাম্মেল আলী নার্গিস পারভীনকে বিয়ে করে।

গল্পের শেষ পরিণতিতে গল্পকার পাঠককে জানান, সত্রাসিয়ার মাঠে সেই কালো ছাগল বাঁধা থাকে, কেউ তাকে নিতে আসে না। শালিক পাখি ছাগলের পিঠ থেকে উড়ে অন্য গন্তব্যে চলে যায়। একাকী ছাগল অন্ধকারে খুঁটির চারপাশে ঘোরে। নার্গিস পারভীন তাকে নিতে আসে না। গল্পকার নির্মোহভাবে পাঠককে আরো জানিয়ে দেন মহিমাগঞ্জে রুহল আমিনের বাড়ির পেছনের পুকুরে মাঝ বরাবর হলুদ ছাপা শাড়িপরিহিত এক 888sport promo codeর মৃতদেহ পানিতে ভেসে ওঠার কথা। সে আর কেউ নয়, সে হলো মোজাম্মেল আলীর মেয়ে রেহানা। রেহানা আত্মহত্যার আগে তার এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারে, ‘রুহুল আমিন সত্রাসিয়া গিয়ে মোজাম্মেল আলীর স্ত্রী নার্গিস পারভীনকে নিয়ে পালিয়ে চলে গেছে অন্য এক শহরে।’

নিখুঁত বয়ন এবং আকস্মিক ঘটনার পরিণতিদানে গল্পরস পাঠকের অন্তরে একটা মোচড় সৃষ্টি করে। যে-ঘটনার জন্য পাঠকমন প্রস্তুত ছিল না, গল্পশেষে গল্পকার শাহাদুজ্জামান পাঠককে তেমনি ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। গল্পটির কাঠামো রচনা ও পরিণতিদানে রুহুল আমিন ও নার্গিসের পলায়ন বিষয়টিকে গল্পকার অপরিহার্য করে তুলেছেন। তাদের এই আকস্মিক পলায়নে গল্পে যেমন পারস্পরিক উগ্র যৌনতৃষ্ণাকে জাগ্রত রেখেছেন, তেমনি ঘটনার আকস্মিকতায় মোজাম্মেল হোসেনের মেয়ের আত্মহত্যায় নিয়তিবাদকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ এটি গল্পগ্রন্থের নামগল্প। গল্পটির গঠনরীতি ও বিন্যাস অভিনব। গল্পটির কাহিনি সংঘটনে শাহাদুজ্জামান পুঁথির আশ্রয় নিয়েছেন। পুঁথির কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে গল্পটিতে তিনি নাটকীয় ক্লাইমেক্স তৈরি করেছেন। তাঁর গল্পের পরিসমাপ্তিতে তিনি ভিন্ন ঘটনা বা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। মোহাম্মদ বজলু নামক চরিত্রটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করে গল্পের কাহিনি আবর্তিত। কাহিনির 888sport app শাখা-প্রশাখা বজলুর সৃষ্টি। সর্বজ্ঞ লেখক গাছি বজলুর কল্পনাপ্রবণ মনোবিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। এ-গল্পের শুরুর ইঙ্গিতের সঙ্গে সমাপ্তির বক্তব্যের একটা যোগসূত্র বিদ্যমান। এখানেও তিনি বিন্দু থেকে ক্রমশ বৃত্তায়নের দিকে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মাঝের যে-গল্পটির কাঠামো নির্মাণ করেছেন এবং বয়ান করেছেন, তার মধ্য দিয়ে পাঠকচিত্তে টানটান উত্তেজনা ও কৌতূহল সৃষ্টিতে গল্পকার সমর্থ হয়েছেন। নিশানদিয়া গ্রামের গাছি বজলুর রয়েছে অসাধারণ কল্পনাশক্তি। সে পুঁথির বই কিনতে এবং পাঠ করতে পছন্দ করে। গল্পের শুরুতে গল্পকার তার কল্পনাপ্রবণ মানসের রূপ উন্মোচন করেছেন।

ফুরিয়ে যাওয়া কেরোসিন তেল, কৃষ্ণচূড়া গাছের মগডালে দেখতে পাওয়া ভুবন চিল, পুঁথির মতিজানের নৌকা, নদীতে ঝড়, জেকের আলীর ঘাট, ইংরেজিতে কথা বলতে পারা ময়না পাখি – এসব দৃশ্যকল্প বজলুকে ক্রমশ কল্পনাপ্রবণ সৃজনশীল মানুষে রূপান্তরিত করেছে। এ-কারণে বজলু জীবনে একটু ভালোমতো বাঁচার জন্য প্লাজা ঘটনায় মিথ্যা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নিয়ত এমনসব প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। বজলুর মনের ভেতর দুষ্কর মানসিক রসায়নের ছবি তিনি সাবলীল দক্ষতায় গল্পটিতে বাক্সময় করে তুলেছেন।

শাহাদুুজ্জামান বাংলা মননশীল কথা888sport live footballের অন্যতম লেখক। আধুনিক গল্পবিশ্বের নিরীক্ষা এবং বাংলা লোকগল্পের সারল্য মিলিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর নিজস্ব গল্পভুবন। মামলার সাক্ষী ময়না পাখি (২০১৯) গল্পগ্রন্থটি তাঁর পঞ্চম গল্পগ্রন্থ। এ-গ্রন্থে মোট এগারোটি গল্প সংকলিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি ও প্রেক্ষাপট নিয়ে এগারোটি গল্পের কাঠামো তিনি তৈরি করেছেন। গল্পগুলোর নির্মাণ, প্রকরণকলা, ভাষা, সংলাপ, চরিত্রায়ণ উপস্থাপন এবং গঠনরীতিতে নতুনত্ব ও অভিনবত্বের ছাপ রয়েছে। পুরান 888sport appর গল্প (‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’), সাম্প্রতিক জঙ্গি অপতৎপরতা ও ভীতি (‘উবার’), সন্তানদের অস্বাভাবিক মানসিক বিকাশ এবং তাদের মোবাইল ও ল্যাপটপ আসক্তি (‘অপস্রিয়মাণ তির’), প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের যন্ত্রণা এবং স্বদেশকেন্দ্রিক নস্টালজিয়া (‘ওয়ানওয়ে টিকিট’), যৌনজীবনের বিকার ও বিকৃতির স্বরূপ উন্মোচন (‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’, ‘লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে’), লোকঐতিহ্যের তথা পুঁথির ব্যবহার (‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’), চিঠি সংক্রান্ত নস্টালজিয়া (‘টুকরো রোদের মতো খাম’) প্রভৃতি গল্প ভিন্ন ভিন্ন বুনন ও বয়ানে সমুজ্জ্বল। লোকঐতিহ্য, লোকপুরাণ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পুরান এবং মিথের বিবিধ ব্যবহার তাঁর এ-গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোতে লক্ষ করা যায়। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী গান :

উত্তর দুয়ারী বাড়ি,

দিঘল ঘোমটা 888sport promo code,

পানার তলের শীতল জল,

তিনই মন্দকারী।

(‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’, পৃ ২১)

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা – ‘কর কর খর খর গর গর ঘর ঘর, ধর বচন কর রচন, কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না, তাহা বলিলে তাহারা মনে দুঃখ পায়, উহঃ মেঘের ডাকে কান ফাটিয়া যায়।’ (‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’, পৃ ২২)

গ্রিক মিথলোজির দেবী ইয়োসের গল্প। ইয়োস ও টিথোনাসের প্রেমকাহিনির উল্লেখ। (‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’, পৃ ১৯)

মহাভারতের প্রজাপতির দুই রূপবতী কন্যা কুদ্র আর বিনতা প্রসঙ্গের অবতারণা। (‘পৃথিবী হয়তো বৃহস্পতিবার’, পৃ ৪৮)

শোলক বা ধাঁধার ব্যবহার – ‘কামারের মার মাইরা, পাঁঠার কাইট্টা পা, লবঙ্গের বঙ্গ ফেইলা চুইষা চুইষা খা।’ (‘লবঙ্গে বঙ্গ ফেলে’, পৃ ৯৩)

পুঁথির ব্যবহার – ‘888sport app download apk ইতি হইল, 888sport app download apk ইতি হইল রায় লিখিল,

জজসাহেব তখন

দুই মাঝির কারাদণ্ড হলো যাবৎ জীবন।

ধন্য পাখির ভাষা, ধন্য পাখির ভাষা শুনতে খাসা খুশি সর্বজনে

পাখিকে করিল দান যাহার যা আছে প্রাণে।

দেখলাম একুনেতে, দেখলাম একুনেতে হইবে তাতে

টাকা নয় হাজার।

ধন্য ধন্য ময়না পাখি শুনেন সমাচার …।

          (‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’, পৃ ১০২)

এ-গল্পগ্রন্থে সংলাপ ব্যবহারে শাহাদুজ্জামান অনন্য সক্ষমতা ও পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। চরিত্র অনুযায়ী ভাষা ও সংলাপ সৃজনে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পুরান 888sport appর কথ্য ভাষার সাবলীল প্রয়োগ লক্ষ করা যায় ‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’ গল্পটিতে।

‘চান্দের আলো হালায় মাইয়ার শরীরে ঢুইকা আর বারাইবার পারতাছে না।’ (পৃ ৩৩)

‘তোরে আমি টিকটিকি দিয়া চোদামু।’ (পৃ ৩৩)

‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ গল্পে পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি দুটি চরিত্র আইডিয়ার মধ্যে অভিনব সংলাপ যোজনা করেছেন –

পূর্বসূরি : পাহাড় দেখেছ?

উত্তরসূরি : হ্যাঁ দেখেছি।

পূর্বসূরি : তাহলে চোখ বন্ধ করে কোনো এক উঁচু পাহাড়ের কথা ভাবো।

উত্তরসূরি : ভাবলাম।

পূর্বসূরি : চিরুনি ব্যবহার করো?

উত্তরসূরি : করি।

পূর্বসূরি : এবার চোখ বন্ধ করেই তোমার প্রতিদিনের ব্যবহার্য চিরুনিটার কথা ভাবো।

উত্তরসূরি : ভাবলাম।

পূর্বসূরি : এই যে বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র ভাবনায় যাতায়াত করার পদ্ধতি, একে রপ্ত করো।                 (পৃ ১০৭-১০৮)

গল্প উপস্থাপন রীতি, তার ভঙ্গি, প্রকরণকলা ও ভাষার জন্য গল্পকার শাহাদুজ্জামানের যোগ্যতা ও দক্ষতা পাঠকমহলে সুবিদিত। তাঁর গল্পে কখনো কখনো দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে 888sport app download apk, 888sport live বা দর্শনের উপাদান। তাঁর গল্পভুবনে সাম্প্রতিক সংযোজন মামলার সাক্ষী ময়না পাখি। সমসময়ের গভীর উৎকণ্ঠা বয়ে গেছে প্রতিটি গল্পের শরীরে।তাঁর এ-গ্রন্থের গল্পগুলো একটি অন্যটি থেকে আলাদা।

এক অভিনব 888sport live chatশৈলী ও প্রকরণকলায় গল্পগুলো হয়ে উঠেছে সময়ের সার্থক কণ্ঠস্বর। গল্পগুলো যেমন 888sport live footballের মানদণ্ডে 888sport live chatোতীর্ণ হয়েছে, তেমনি এর উপস্থাপনরীতি, বুননে ও বয়নে পরাবাস্তবতা এবং জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ পাঠকের মনে এক ধরনের রহস্য বা কৌতূহল সৃজনে সমর্থ হয়েছে। তাঁর গল্পে পাঠক যেমন পরিসমাপ্তির জন্য প্রস্তুত থাকেন, ঠিক তার বিপরীত একটা পরিসমাপ্তির মুখোমুখি তিনি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। ফলে পাঠকমনে তাঁর গল্প অনুভূতি, উপলব্ধি, আত্মবিচ্ছিন্ন, অস্তিত্বসংকট, আত্মমগ্নতা সুখ-দুঃখ ও বিষাদ-বেদনার বিচিত্র মনোজাগতিক রসায়নের জন্ম দেয়।