বিভাজিত সত্তার আর্তনাদ : সময়ের ভাগের মানুষ

ভাগের মানুষ নাটকের উপজীব্য সাতচল্লিশের দেশভাগ, অবলম্বন – উর্দু গল্পকার সাদাত হাসান মান্টোর কাহিনী ‘টোবাটেক সিং’। দেশভাগ এই উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন যেভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে মান্টোর গল্পে ও জীবনে। ‘খোল দাও’, ‘ঠান্ডা গো¯্—’ দেশভাগবিষয়ক তাঁর দুই রক্তহিম করা গল্প। কঠিন বাস্তবকে কঠিনতর গল্পকাঠামোয় উপস্থাপন করেন মান্টো। তার মধ্যে ‘টোবাটেক সিং’ বোধকরি দেশভাগবিষয়ক উর্দু কি বাংলা 888sport live footballে এ-যাবৎ প্রকাশিত তাবৎ গল্পের মধ্যে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত। এই গল্প একবার পাঠ করলে ভোলা যায় না। পাঠকের অন্তরে গল্পের যে-তোলপাড় তার থেকে রেহাই পাওয়া সহজ নয়। এই গল্পকে সমালোচকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। কারো কাছে মনে হয়েছে গল্পের পরতে পরতে মিশে আছে রূপক, কেউ কেউ একে ঈশ্বরের কাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, কারো কাছে মনে হয়েছে যেখানেই রাজনীতি কিংবা ধর্ম কিংবা বর্ণের নামে বিভাজন টানা হয়েছে সেখানেই এই গল্প প্রাসঙ্গিক। ১৯৫০ সালে লাহোরের 888sport live football-সাময়িকী সাভেরায় প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হয়। মান্টো ততদিনে দেশভাগের বেদনায় উ™£ান্ত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন, মদ্যাসক্তিতে গভীরভাবে নিমজ্জিত এবং অনেকটা আমাদের কাছে মানুষ ঋত্বিক ঘটকের মতো

অন্তরের জ্বালায় দগ্ধ হয়ে নিজেই খাক হয়ে যাচ্ছেন। এর দুই বছর পর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে সাদাত হাসান মান্টোর মৃত্যু ঘটে, থেকে যায় তাঁর অসাধারণ গল্পগুচ্ছ। ‘টোবাটেক সিং’ সেই রাজমুকুটের বৈদুর্য্যমণি হিসেবে আজও উজ্জ্বল

হয়ে আছে। এই গল্প নিয়ে ক্ষোভে-ভরা অসাধারণ এক 888sport app download apk লিখেছিলেন গুলজার। বলেছিলেন, ‘সকল উন্মাদ তো ঠিক-ঠিকভাবে পৌঁছায়নি তাদের নির্দিষ্ট আশ্রমে।/ অনেকে রয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে/ অনেকে এপারে।’

‘সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ যখন মান্টোর এমনি গল্প-অবলম্বনে ভাগের মানুষ মঞ্চস্থ করেছিল তখন মনে মনে তাদের সাধুবাদ না জানিয়ে পারিনি। তরুণতর এই দলের জন্য গল্প থেকে নাটক-রচনা করে দিয়েছেন মান্নান হীরা এবং অতিথি পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আলী যাকের। উভয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শ্রুতকীর্তি ব্যক্তিত্ব। তাই দল হিসেবে ‘সময়’ অপেক্ষাকৃত নবীন-অধ্যুষিত হলেও প্রযোজনার গুণগতমান-অর্জনে নিষ্ঠা ও সচেষ্টতার পরিচয় তারা দাখিল করেছে।

নাট্যকার মান্নান হীরা ‘টোবাটেক সিং’ গল্পের নাট্যরূপ দেননি, সে-গল্প অবলম্বন করে নাটক-রচনা করেছেন। তাই তিনি মূল গল্প থেকে কতোটা সরে এসেছেন, সেটি বিশেষ বিবেচ্য হতে পারে না। কেননা সেই স্বাধীনতা তাঁর স্বীকৃত অধিকার। তবে এটুকু বলা যায়, সরেছেন তিনি অনেকটাই এবং নাটক-তৈরির জন্যে সরতে তাঁকে হতোই, তবে গল্পের মূল ভাবরস-রূপান্তরের চেষ্টাও তিনি বিশেষ নেননি এবং সেখানটিতে আমাদের খেদ থেকে যায়। ‘টোবাটেক সিং’ গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম এবং স্থানের নাম মিলেমিশে এক হয়ে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা বয়ে আনে, যার পরম প্রকাশ ঘটেছে গল্পের সমাপ্তিতে, যখন লেখা হয়েছে : ‘ওদিকে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে রয়েছে হিন্দুস্থান। এদিকে, কাঁটাতারের বেড়ার এপাশে আছে পাকিস্তান। দুইয়ের মাঝামাঝি একখণ্ড জমি, যার কোনো নাম নেই, সেখানে পড়ে আছে টোবাটেক সিং।’ মান্টো খুলে বলেননি, এই টোবাটেক সিং কি সেই মানুষটি, যে দিনের পর দিন স্রেফ দাঁড়িয়ে থেকে এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, নাকি এই টোবাটেক সিং সেই গ্রাম, যেখান থেকে এসেছে ওই উন্মাদ মানুষটি যাঁর নাম ভিষেণ সিং, নাটকে বচন সিং এবং ভাগের পর যে-গ্রাম পড়েছে হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মাঝামাঝি।

গল্পের পরতে পরতে বাস্তব নিয়ে গভীরতর যে-ক্রীড়াপরায়ণতা করেছেন মান্টো, নাট্যরূপে সেই চেষ্টা বিশেষ নেননি মান্নান হীরা। বরং বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, নাট্যপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলায় অনূদিত

এ-গল্পটির ভাষা, গাঁথুনি, ছোটগল্প হিসেবে এর মানও আমার কাছে

ততটা লোভনীয় মনে হয় না। কিন্তু থিম হিসেবে এর একটি অসাধারণ ক্ষমতা ও গুণ রয়েছে। আমি সেই থিমটাকেই অবলম্বন করি এবং নাট্যরচনা শুরু করি।’

এই মন্তব্য অবশ্য নাট্যকারের নিজস্ব, তবে দেশভাগ এবং উর্দু 888sport live footballের শ্রেষ্ঠ এক গল্পের আরো নিবিড় পাঠগ্রহণ করলে নাট্যকার হয়তো অনেকাংশে উপকৃত হতে পারতেন। মান্টোর গল্প উন্মাদ-আশ্রমের পাগলদের নিয়ে, দেশভাগের দুই বা তিন বছর পর ভারত ও পাকিস্তানের সরকারগুলোর খেয়াল হলো সবকিছু ভাগ করা হয়েছে অথচ পাগল-বিনিময়ের ব্যবস্থা অসম্পন্ন থেকে গেল। তখন লাহোর উন্মাদ-আশ্রমের পাগলদের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিনিময়ের আয়োজন করা হয়, হিন্দু ও শিখ পাগল যাবে হিন্দুস্থানে এবং তেমনিভাবে সেদেশ থেকে মুসলমান পাগল আসবে পাকিস্তানে। এমনি ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে শুরু হওয়া কাহিনীতে পাগলাগারদের উন্মাদদের যেসব আলাদা আলাদা বর্ণনা দিয়েছেন মান্টো, তাতে কৌতুকময়তা থাকলেও এর গভীরে রয়েছে মর্মবেদনা। মান্টোর বর্ণনায় কোনো তারল্য নেই, রয়েছে আপাত তারল্যের আবরণ। তাই দেখি, গারদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাগলরা চিন্তিত, তাদের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডের কী হবে, সকালের নাশতায় পাউরুটি-টোস্ট মিলবে তো, নাকি তাদের গলাধঃকরণ করতে হবে ‘ব্লাডি ইন্ডিয়ান চাপাতি’! পাগলাগারদের যেসব পাগল কিছুটা হুঁশিয়ার, স্থান-কাল সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা রয়েছে, তারা আরো বেশি হতবুদ্ধি। তারা জানে না কোথায় রয়েছে তারা, হিন্দুস্থানে না পাকিস্তানে। তারা যদি হিন্দুস্থানে থাকে তাহলে  পাকিস্তান কোথায়? আর তারা যদি পাকিস্তানে থেকে থাকে তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব হলো যে কিছুকাল আগেও তারা ছিল হিন্দুস্থানে, আর এখন এসেছে পাকিস্তানে, অথচ তারা তো কোনো সময়েই জায়গা-বদল করেনি।

মান্টোর এইসব পাগল আমাদের হাসায় বটে, তবে একই সঙ্গে ভাবিত করে তোলে। মান্নান হীরা শুরুতে আশ্রমের যে-পাগলদের সঙ্গে পরিচয় ঘটান তারা বাংলা নাটকে পাগলের প্রচলিত আদলের বাইরের কেউ নয় এবং লোক হাসাতেই তারা ব্যস্ত বেশি, ভাবনাচিন্তার বালাই সেখানে নেই। গভীরতা ও অর্থময়তার পথ মান্নান হীরাকে বিশেষ আকর্ষণ করেনি, আবেগ তাঁকে যতোটা আলোড়িত করে বিশ্লেষণ ততটা নয়।

পরিচালক হিসেবে আলী যাকের অবশ্য আবেগ ও বিশ্লেষণ উভয়কে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। নাট্যপত্রে তিনি জানিয়েছেন যে, নাটকের শেষ সংলাপটি তিনি কখনো অশ্রু-উদ্বেল না হয়ে পড়তে পারেননি। বস্তুত মান্টোর গল্পে সচরাচর যে-নাটকীয়তা মেলে তা এক্ষেত্রে আরো ঘন-সংবদ্ধ হয়েছে এবং রূপান্তরিত নাটকেও তা তীব্রভাবে প্রকশ পেয়েছে। পাগল-বিনিময়ের পাগলামিতে অসম্মত টোবাটেক সিং ভারত নয়, পাকিস্তান নয়, চায় টোবাটেক এবং দুই সীমানার মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটিই টোবাটেক, এটিই টোবাটেক। এরপর সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারায় বচন সিং ওরফে টোবাটেক সিং এবং শেষ-সংলাপে সূত্রধর উচ্চারণ করে, “পরদিন উন্মাদ টোবাটেকের মৃতদেহ পড়ে থাকে নামগোত্রহীন রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যবর্তী রেখায়। দুই দেশের সৈন্যসান্ত্রি কেউ টোবাটেকের মৃতদেহ স্পর্শ করে না। কারণ কোন দেশের সৈন্যের গুলিতে টোবাটেক মৃত্যুবরণ করে তা চূড়ান্ত হয়নি। ধীরে ধীরে টোবাটেকের মৃতদেহ শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খায় – আর তার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সীমান্ত-সেনারা, টোবাটেক যেখানে শায়িত আছে তাকেই বলা হয় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, ঠিকানাহীন মানুষের ঠিকানা, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও রাষ্ট্র মানুষকে স্পর্শ করে না। আমরা টোবাটেকের পক্ষ থেকে সমগ্র পৃথিবীর ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর মাটিকে প্রণাম করি।”

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র টোবাটেক সিং যখন প্রথম আসেন মঞ্চে সেই দৃশ্যও অবি888sport app download for androidীয়, টোবাটেক যে আর সব পাগল থেকে আলাদা, টোবাটেক যে-প্রতীকী উদ্ভাসন, টোবাটেক যে জাতি-ধর্ম-বর্ণভিত্তিক উন্মাদসম সকল বিভাজনের বিরুদ্ধে এক বিশাল চিৎকার, যেমন, এডওয়ার্ড মুংকের ছবি স্কিম, যেমন, অ্যালেন গিন্সবার্গের 888sport app download apk ‘হাউল’, তেমনি এক 888sport app download for androidীয় উপস্থাপন এই নাটকে ঘটাতে পেরেছেন নির্দেশক। নাটকের তৃতীয় দৃশ্যের শেষে প্রথম আবির্ভাব ঘটে টোবাটেকের, তাঁর রূপসজ্জা, তাঁর মঞ্চাবস্থান, বিশাল লাঠি হাতে শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটির দাঁড়ানো, সবকিছু তাঁকে আলাদা করে তোলে এবং রক্তহিম করা এক চিৎকারে তিনি বলেন, আমি টোবাটেক সিং। এক স্বর্গীয় আলো এসে তাঁর ওপর পড়ে, ঠান্ডু রায়হানের চমকপ্রদ আলোক-পরিকল্পনা নাট্যরসের অনুগামী হয় এবং উন্মাদ-আশ্রমের কোলাহলময়তা নিমেষে স্তব্ধ হয়ে আসে, আর সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ধীরে ধীরে দৃশ্যের অবসান ঘটে, ঘুরপাক খেতে থাকে অজস্র জিজ্ঞাসা – কে এই টোবাটেক, কেন এই টোবাটেক, কী এই টোবাটেক।

‘সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’র নবীন-নবীনা কলাকুশলীরা আলী যাকেরের নির্দেশাবলি-অনুসরণে যথাসম্ভব সচেষ্ট থেকেছেন, তবে এর মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন আকতারুজ্জামান – সূত্রধর ও চিকিৎসকের ভূমিকায়। বস্তুত নাটকে সূত্রধরের রয়েছে কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং আকতারের চমৎকার বাচনিক গুণ এবং স্বল্পাভিনয়ে দক্ষতা এই চরিত্র অনুপমভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। টোবাটেক সিং-চরিত্রে ফখরুল সার্থক হতে পেরেছেন। অন্যরা মোটামুটি মানসম্মত অভিনয় দ্বারা নাটক সফল করে তুলতে সহায়তা করেছেন। নির্দেশকও দলগত অভিনয়ে দক্ষতার ঘাটতি পোষাতে বিশেষ নির্ভর করেছেন শারীরিক অভিনয়ের-পর। উন্মাদ-আশ্রমের দৃশ্যাবলির সঙ্গে তা বেশ মিলেও গিয়েছিল, কিন্তু এর ফলে যে-তারল্য সৃষ্টি হয় সেটি সবসময়ে নাটকের দাবি মেটাতে সহায়ক থাকে না। বিশেষভাবে নাটকে সৈন্যদলের যে-ভূমিকা, তাদের সংলাপ কিংবা উপস্থাপনে সৃষ্ট তরলতা পীড়নকারী রাষ্ট্রের হিংস্র রূপকে কিছুটা যেন আড়াল করে ফেলে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভাগের মানুষ উপমহাদেশের ইতিহাস তথা ধর্ম ও রাজনীতির ভেদবুদ্ধির শিকার অসহায় মানুষের আর্তি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। সেজন্য ‘সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’র সদস্য-সদস্যাবৃন্দ এবং নাট্যকার, নির্দেশক, কলাকুশলীদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে ‘টোবাটেক সিং’ হয়ে ওঠা হয়নি এই নাটকের, থেকে গেছে ‘ভাগের মানুষ’, সেটি আক্ষেপের বিষয়। উচ্চাভিলাষকে ছেঁটে উদ্দিষ্ট হাসিল অথবা আকাশস্পর্শী প্রয়াস নিয়ে ব্যর্থতা-বরণ, দুইয়ের মধ্যে বাছাইয়ে কোনদিকে পক্ষপাত ঘটবে, সেটিও নাট্যকার কিংবা নাট্যদলের জন্য এক বড় বিবেচনা। ‘সময়’ তাদের সদিচ্ছা ও শক্তিময়তার প্রকাশ ঘটিয়েছে বর্তমান নাটকে, আগামীতে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশার মাত্রা তাই অনেক বেড়ে গেল।