888sport app download apk latest version : সম্পদ বড়ুয়া
আমার নতুন স্বামী ট্যাক্সি থেকে স্যুটকেস বের করে ব্রাউনস্টোন দালানের একটা বিষণ্ন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। বাতাস চলাচলবিহীন সংযোগপথে অতি ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া কার্পেটের ওপর পা রেখে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে অসমভাবে হলদে ধাতুর তৈরি ২বি নম্বরটি আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে।
‘আমরা এসে গেছি’, সে বলল। যখন সে আমাদের ঘর সম্পর্কে বলছিল তখন সে ‘বাড়ি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিল। আমার কল্পনায় ছিল শসা রঙের লম্বা লনের মাঝ বরাবর সর্পাকৃতির গাড়ি চলার রাস্তা, দরজা দিয়ে হলওয়েতে যাওয়ার পথ থাকবে, দেয়ালে থাকবে প্রশান্তিদায়ক চিত্রকর্ম। শনিবার রাতে এনটিএ-প্রদর্শিত আমেরিকান ছবিতে নববিবাহিত শে^তাঙ্গ দম্পতিরা যেসব বাড়িতে থাকে অনেকটা সেরকম হবে।
বসার ঘরের আলো সে জ্বালিয়ে দিলো। ঘরের মাঝখানে একটা ধূসর রঙের গদি আঁটা কাউচ একা বসে আছে – অনেকটা হেলানো ভঙ্গিতে যেন দৈবক্রমে এখানে এসে পড়েছে। কক্ষটা বেশ উষ্ণ, পুরনো বলে বাতাসে একটা বাসি গন্ধ ভাসছে।
‘আমি তোমাকে চারদিকটা দেখিয়ে দেবো’ – সে বললো।
ছোট বেডরুমের এক কোনায় একটা খালি জাজিম পড়ে আছে। বড় বেডরুমে আছে একটা বিছানা, দেরাজ আর কার্পেটের মেঝেতে টেলিফোন। তারপরও মনে হবে কক্ষ দুটিতে জায়গার অভাব রয়েছে, মাঝখানে কম জায়গার কারণে দেয়ালগুলি একে অপরের কাছে ঠিক যেন স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না।
‘আমরা যেহেতু এসে গেছি, আরো ফার্নিচার পেয়ে যাবো। যখন একা ছিলাম তখন আমার এত কিছুর প্রয়োজন হয়নি’, সে বললো।
‘ঠিক আছে’, আমি বললাম। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। লাগোস থেকে নিউইয়র্ক দশ ঘণ্টার ফ্লাইট, তার ওপর ছিল সীমাহীন অপেক্ষা, বিশেষ করে যখন আমেরিকান কাস্টম কর্মকর্তা আমার স্যুটকেস তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করছিল আমি তখন একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি, মাথায় কার্পাস তুলার তৈরি কাপড় জড়িয়ে নিই। অফিসার আমার খাবারের জিনিসগুলি এমনভাবে দেখছিল যেন ওগুলি মাকড়সা। মরিচের বীজ আটক না করা পর্যন্ত মহিলা অফিসারটি তার দস্তানার আঙুলগুলি দিয়ে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগের ভেতর রাখা তরমুজের সাদা বীজ, শুকনো অনুগবো (স্যুপের পাতা) আর পশ্চিম আফ্রিকার মরিচের বীজে বারবার খোঁচা মারছিল। সে ভেবেছে আমি ওসব আমেরিকার মাটিতে চাষ করবো। এটা জানে না যে, কয়েক সপ্তাহ ধরে বীজগুলি রোদে শুকানো হয়েছে আর এগুলি বাইসাইকেলের হেলমেটের মতো শক্ত।
‘আমি আর পারছি না’ – বেডরুমের মেঝেতে হাতের ব্যাগটা রাখতে রাখতে বলি।
‘হ্যাঁ, আমিও ক্লান্ত’, সে বললো, ‘আমাদের ঘুমুতে যেতে হবে।’
চাদর পাতা নরম বিছানায় শক্ত হয়ে গুটিয়ে শুয়ে থাকি যা অনেকটা ইকে আঙ্কেলের রেগে যাওয়ার মুহূর্তে হাতের মুষ্টির মতো, যখন তিনি আমার বেলায় স্ত্রী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে না বলে জোরালোভাবে মত প্রকাশ করছিলেন। কিছুক্ষণ পর আমার নতুন স্বামীর পরিমিত নাক ডাকার শব্দ শুনে স্বস্তি বোধ করি। প্রথমে ওটা তার গলায় গুড়গুড় করে শুরু হলো, শেষ হলো উচ্চগ্রামে – অনেকটা উচ্চনাদী হুইসেলের মতো। বিয়ের কথাবার্তা বলার সময় বিয়ের আয়োজকরা কেউ এ-বিষয়ে তাকে সতর্ক করেনি। বিসদৃশ নাক ডাকা কিংবা ঘরের বদলে আসবাবপত্রের সমস্যাসংকুল ফ্ল্যাট থাকবে – এসব বিষয়ও আগাম উল্লেখ করেনি।
আমার শরীরের ওপর তার ভারী শরীর চাপিয়ে দিয়ে স্বামী আমাকে জাগিয়ে তুলল। তার বুক আমার স্তন দুটোকে চেপে ধরেছে।
‘সুপ্রভাত’ – ঘুমজড়ানো চোখ খুলতে খুলতে আমি বললাম। সে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করছে, শব্দটা আমার সৌজন্য প্রকাশের উত্তর হতে পারে কিংবা সে যে কর্মটি সম্পাদন করছে তারই অংশও হতে পারে। আমার রাতের পোশাকটা কোমরের ওপরে তোলার জন্য সে নিজেকে ওপরে উঠিয়ে নিল।
‘দাঁড়াও’ – আমি বললাম, যাতে রাতের পোশাকটা খুলে ফেলতে পারি। কিন্তু সে তার মুখটা আমার মুখে প্রবলভাবে চেপে ধরেছে। আর একটা বিষয় বিয়ের আয়োজকরা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে – সেটা হলো, তার মুখ যা ঘুমের গল্প শোনায়; পুরনো চুইংগামের মতো আঁঠালো আর মুখের ভেতর থেকে অগবিট মার্কেটের জমানো ময়লার গন্ধ ভেসে আসে। যখন সে নড়ে তার নিশ্বাসে র্খ-র্খ শব্দ হয়, মনে হবে তার নাক দুটো এত সরু যে বাতাস বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত জোরে চাপ দেওয়া বন্ধ হলে তার পুরো শরীরের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিলো, তার পায়ের ওজনও বাদ যায়নি। বাথরুমে যাওয়ার জন্য আমার ওপর থেকে না-নামা পর্যন্ত আমি নড়াচড়া করতে পারিনি। রাতের পোশাকটা নিচে নামিয়ে তা কটিদেশের ওপর টেনে দিই।
‘সুপ্রভাত প্রিয়ে’, রুমে ফিরে এসে সে বললো। টেলিফোনটা আমার হাতে বাড়িয়ে দিলো, ‘আমরা যে নিরাপদে এসে পৌঁছেছি তোমার আঙ্কেল-আন্টিকে তা আমাদের জানানো দরকার। অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য। নাইজেরিয়ায় কথা বলতে প্রতি মিনিটে এক ডলার খরচ হয়। প্রথমে ডায়াল করো ০১১ এবং এর পর গন্তব্য নম্বরের আগে ২৩৪ দিতে হবে।’
‘সত্যিই! এটুকুই!’
‘হ্যাঁ। প্রথমে আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড এবং পরে নাইজেরিয়া দেশের কোড।’
‘তাই’ – আমি বলি। চৌদ্দ ডিজিটের নম্বর টিপলাম। দু-পায়ের মাঝখানে আঠালো ভাবটা চুলকাচ্ছে।
ফোনের লাইনটা নিশ্চল হয়ে মচ্মচ্ শব্দ করে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে। আমি জানি ইকে আংকেল আর আডা আন্টির গলায় থাকবে উষ্ণতার ছোঁয়া, জানতে চাইবে আমি কী খেয়েছি, আমেরিকার আবহাওয়া কেমন। কিন্তু আমার কোনো উত্তরই লিপিবদ্ধ থাকবে না, তারা জিজ্ঞাসার খাতিরেই জানতে চাইবে। ইকে আংকেল হয়তো ফোনের ওপারে হাসবে, একই রকমের হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন – আমার জন্য সঠিক পাত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। আটলান্টা অলিম্পিকে যখন সুপার ঈগল সকার গোল্ড মেডেল জিতেছে তখন সর্বশেষ আমি তার মুখে একই হাসি দেখেছি।
‘আমেরিকার চিকিৎসক’, হাস্যোজ্জ্বল প্রফুল্লমনে তিনি বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে ভালো কী হতে পারে? অফোডিলের মা ছেলের জন্য একটা মেয়ে খুঁজছিল, তার ভয় ছিল ছেলে আবার কোনো আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে বসে। এগারো বছর সে দেশে আসেনি। আমি ভদ্রমহিলাকে তোমার ছবি দিয়েছি। বেশ কিছুদিন তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি … ভেবেছি তারা হয়তো অন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছে … কিন্তু …’, ইকে আংকেল তার কণ্ঠটাকে টেনে নিয়ে গেল … তার হাসিমুখ আরো প্রশস্ত হলো।
‘হ্যাঁ আংকেল।’
‘জুনের প্রথম দিকেই ছেলেটা আসবে’, আডা আন্টি বললেন, ‘বিয়ের আগে তোমরা একে অপরকে জানার যথেষ্ট সময় পাবে।’
‘হ্যাঁ, আন্টি’।
যথেষ্ট সময় মানে দুই সপ্তাহ।
‘তোমার জন্য আমরা কী করিনি? আমাদের নিজের মতো করে বড় করেছি, তারপর তোমার জন্য ভালো পাত্র খুঁজে নিয়েছি। আমেরিকার ডাক্তার! এটা অনেকটা তোমার জন্য লটারি জেতার মতো।’ আডা আন্টি বলতেন। তাঁর চিবুকে দড়ির আঁশের মতো চুল গজিয়েছে; কথা বলার সময় তিনি তার একটাকে একপাশে টেনে রাখেন।
তাদের দুজনকে আমি সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানাই – আমার জন্য বর খোঁজা, তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, প্রতি দু-বছরে একজোড়া নতুন জুতা কিনে দেওয়া। অকৃতজ্ঞ বলে অভিযোগ না দেওয়ার জন্য এটাই আমার বক্তব্য। তাদের মনে করিয়ে দিইনি যে, আমি এবার জেএএমবি পরীক্ষা দিতে চেয়েছি আর বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য চেষ্টা করেছি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় এনুগোতে অন্য বেকারিগুলির চেয়ে আডা আন্টির বেকারিতে আমি বেশি রুটি বিক্রি করতাম। আমার কারণে বাড়িতে আসবাবপত্র আর মেঝে এত উজ্জ্বলভাবে আলোকিত ছিল।
‘তুমি কি কথা বলতে পেরেছো?’ স্বামী জানতে চাইলো।
‘লাইনটা এনগেজড ছিল,’ আমি বললাম। আমি অন্যদিকে মুখ ফেরাই যাতে সে দেখতে না পায় আমার মুখে কী রকম স্বস্তির ভাব এসেছে।
‘বিজি, আমেরিকানরা বলে – বিজি, এনগেজড নয়’, সে বলে, ‘আমরা পরে চেষ্টা করবো, এখন প্রাতরাশ সেরে নিই।’
প্রাতরাশের জন্য সে একটা উজ্জ্বল চকচকে হলুদ ব্যাগ থেকে ময়দা, দুধ ও ডিম মেশানো পিঠা বের করে সব বরফমুক্ত করলো। আমি ভালো করে লক্ষ করি, সাদা মাইক্রোওয়েভের কোন বোতামটা টিপছে – সযত্নে তা মুখস্থ করলাম।
‘চায়ের জন্য পানি গরম করো তো’ – সে বললো।
‘ঘরে শুকনো গুঁড়ো দুধ কি আছে?’ কেতলিটা পানির বেসিনে রাখতে রাখতে আমি জিজ্ঞেস করি। খোসা ছাড়িয়ে ফেলা বাদামি রঙের মতো ধুলোবালি বেসিনের পাশে লেগে আছে।
‘আমেরিকানরা দুধ আর চিনি মিশিয়ে চা পান করে না।’
‘সত্যিই? তুমি কি চায়ে দুধ-চিনি মেশাও না?’
‘না। অনেক দিন থেকে এখানকার নিয়মের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তুমিও হবে সোনা।’
আমি আমার নরম পিঠার সামনে বসে পড়লাম – ঘরে আমি যেসব চর্বণযোগ্য মাংস বানাতাম সেগুলির চেয়ে এ-পিঠা অনেক পাতলা, আর গন্ধহীন চা – ভয় হচ্ছে ওসব আমার গলা দিয়ে নামবে কি না। দরজায় বেল বেজে উঠলে সে উঠে গেল। তার হাত দুটো পেছনে আন্দোলিত হচ্ছে। এটা আমি সত্যিই আগে লক্ষ করিনি। দেখার সময়ও আমার ছিল না।
‘শুনেছি গত রাতে তুমি এসেছো।’ দরজায় একজন আমেরিকানের গলা শুনতে পেলাম। শব্দগুলি মুখ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসছে, একে অন্যের দিকে দৌড়াচ্ছে। ইফি আন্টি এটাকে বলতেন ‘দ্রুত, দ্রুত। যখন তুমি বেড়ানোর জন্য দেশে ফিরে আসবে তখন আমেরিকানদের মতো দ্রুত, দ্রুত কথা বলবে’ – আন্টি বলেছিলেন।
‘হেই শার্লি, আমার মেইলগুলো রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ’, স্বামী তাকে বললো।
‘কোনো সমস্যা নেই। তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হলো? তোমার স্ত্রী কি এখানে আছে?’
‘হ্যাঁ, ভেতরে এসো, এই তো এখানে।’
এক মহিলা বসার ঘরে ঢুকল মাথায় ধাতব রঙের চুল। সারা শরীরে গোলাপি রঙের ঢিলে জামা যা কোমরে ফিতা দিয়ে বাঁধা। মুখের ওপর রেখাগুলো দেখে মনে হয় তার বয়স ষাট থেকে আশির মধ্যে হবে। আমি ঠিকভাবে বয়স পরিমাপ করার জন্য যথেষ্ট সাদা চামড়ার লোক দেখিনি।
‘আমার নাম শার্লি, ৩এ-তে থাকি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগলো’, আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে বললো। ঠান্ডাজনিত কারণে তার গলায় নাকিসুর।
‘তোমাকে ধন্যবাদ’, আমি বললাম।
শার্লি একটু থেমে গেল, হয়তো অবাক হলো। ‘ঠিক আছে, তোমরা প্রাতরাশ সেরে নাও।’ সে বলে, ‘তোমরা গুছিয়ে নিলে আমি নিচে এসে তোমাদের দেখে যাবো।’
শার্লি দ্রুত চলে গেল। আমার নতুন স্বামী দরজা বন্ধ করে দিলো। খাবারের টেবিলের একটা পা অন্যগুলির চেয়ে ছোট; তাই টেবিলটা নড়বড়ে, ঢেঁকি-কলের মতো। ওটার ওপর ঠেস দিয়ে সে বললো – ‘এখানে লোকদেরকে বলবে, ‘হেই’, – ‘তোমাকে ধন্যবাদ’ নয়।’
‘সে তো আমার বয়সী নয়।’
‘এদেশে ওটা কোনো ব্যাপার না। প্রত্যেকে বলে হেই।’
‘ঠিক আছে’।
‘প্রসঙ্গক্রমে বলছি, এখানে আমাকে অফোডিল নামে কেউ ডাকে না। ডেভ নামেই চলে’, শার্লি যে-খামের পাহাড় দিয়ে গেছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে সে বললো। অনেক খামে ঠিকানার ওপরেই লেখার লাইন টানা, সম্ভবত খামটা বন্ধ করার পর কোনোকিছু যোগ করার কথা প্রেরকের মনে পড়েছিল।
‘ডেভ?’ আমি জানতাম তার কোনো ইংরেজি নাম নেই। আমাদের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল – ‘অফোডিল এমেকা উদেনা এবং চিনাজা আগাথা ওকাফর’।
‘এখানে আমার নামের শেষটাও আলাদা। উদেনা নিয়ে আমেরিকানদের কঠিন সময় যাচ্ছে। তাই ওটা পরিবর্তন করেছি।’
‘ওটা কি তাহলে?’ আমি এখনো উদেনা নামের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টায় আছি, যেটা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে জেনেছি।
‘নামটা বেল।’
‘বেল!’ আমি একজন ওয়াতুরোছারের কথা শুনেছি যে কি না আমেরিকায় তার নাম পরিবর্তন করে ওয়াতুরো রেখেছে। একজন চিকেলুগো তার নাম আরো বেশি আমেরিকাবান্ধব করতে গিয়ে করেছে চিকেল। কিন্তু উদেনা থেকে বেল? ‘এ-নামটি উদেনার কাছাকাছি যাচ্ছে না’ – আমি বললাম।
সে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘তুমি বুঝতে পারছো না এদেশে এ-বিষয়টা কীভাবে কাজ করে। যদি তুমি এদেশে কোনো কিছু চাও, তোমাকে যতটা সম্ভব মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। যদি না হও, রাস্তার পাশে ছিটকে পড়বে। এখানে তোমাকে তোমার ইংরেজি নাম ব্যবহার করতে হবে।’
‘আমার ইংরেজি নাম কখনো ছিল না, জন্ম সনদপত্রে নামকাওয়াস্তে ইংরেজি নাম একটা ছিল। সারা জীবন আমার নাম চিনাজা ওকাফর।’
‘প্রিয়ে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবে’, আমার চিবুকে আদর করার জন্য এগিয়ে এসে সে বললো, ‘তুমি দেখে নিও।’
পরের দিন সে আমার সামাজিক নিরাপত্তা নম্বরের জন্য আবেদনপত্র পূরণ করল, আমার নাম ইংরেজি বড় অক্ষরে লিখল ‘আগাথা বেল’।
আমাদের নিকটবর্তী এলাকার নাম ফ্লাটবুশ; যখন আমরা গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে হেঁটে বাসস্টপে যাচ্ছিলাম তখন স্বামী আমাকে জানালো। বললো, আরো নিচে একটা কোলাহলপূর্ণ রাস্তা আছে যেখানে গেলে হিমায়িত করার অনেক আগে রাখা মাছের গন্ধ পাওয়া যায়। মুদির দোকানে বাজার করা, বাসে চড়া এসব সে আমাকে শেখাতে চাচ্ছিল।
‘চারদিকে তাকাও; ওভাবে সারাক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে থেকো না। চারপাশ দেখো। এভাবেই তুমি সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে’, সে বললো।
আমি মাথা ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ করি যাতে সে ভাবে তার উপদেশ অনুসরণ করছি। কালো কালো রেস্টুরেন্টের জানালাগুলি বড় বড় অক্ষরে এলোমেলোভাবে মুদ্রিত লেখায় সবচেয়ে ‘বেস্ট ক্যারিবিয়ান অ্যান্ড আমেরিকান ফুড’ পরিবেশনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, রাস্তার পাশে কোকের বোতল আর কাগজের স্তূপের মধ্যে চকবোর্ডের ওপর লেখা ৩.৫০ ডলারে কার ওয়াশের বিজ্ঞাপন। ইঁদুর যেভাবে খুঁটে খায় সেভাবেই পায়ে চলার পথের পাশগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের ভেতর কোথায় মুদ্রা ফেলতে হয়, নিজের গন্তব্যস্থল জানানোর জন্য দেয়ালে কীভাবে বোতাম চাপ দিতে হয় – এসব সে আমাকে দেখালো।
‘এটা নাইজেরিয়া নয় যে, চিৎকার করে কন্ডাক্টরকে ডাকবে’ – বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বললো এমনভাবে যেন সে নিজে উচ্চতর আমেরিকান সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে।
‘কী ফুড’ দোকানের ভেতর আমরা দুই সারির মাঝে হাঁটতে থাকি। সে যখন গরুর মাংসের একটা প্যাকেট ট্রলিতে রাখল তখনই আমি সতর্ক হয়ে যাই। আমার মনে হলো মাংসের লাল রংটি পরীক্ষার জন্য একটু স্পর্শ করা দরকার। এ-কাজটি আমি অগবেট মার্কেটে প্রায়শই করে থাকি, যেখানে কসাইরা সদ্য কাটা মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে রাখে আর চারদিকে মাছি ভনভন করে।
‘আমরা কি ওই বিস্কিট কিনতে পারি?’ আমি জিজ্ঞেস করি। বার্টন’স রিচ টি-এর নীল প্যাকেটগুলি খুবই পরিচিত। বিস্কিট আমি খেতে চাইতাম না, তবে ট্রলিতে রাখা পরিচিত কিছু থাকলে তা আমি নিতাম।
‘কুকিস, আমেরিকানরা সেগুলিকে কুকিস বলে’? সে বললো।
আমি বিস্কিট (কুকিস) নেওয়ার জন্য হাত বাড়াই।
‘স্টোরের নামে রাখা জিনিসগুলি দেখো। সেগুলি দামে সস্তা, কিন্তু জিনিস একই’ – একটা সাদা প্যাকেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বললো।
‘ঠিক আছে’, আমি বলি, আমার আর বিস্কিট কিনতে ইচ্ছে করলো না। তবে স্টোরের নামের পণ্য আমি ট্রলিতে রাখি আর দোকানের সরুপথ ত্যাগ না করা পর্যন্ত তাকের নীল প্যাকেটের দিকে তাকাই; আমার পরিচিত বুটি-খচিত সেই বার্টনের লোগো।
‘আমি যখন একজন অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার হয়ে যাবো তখন আমরা প্রতিষ্ঠানের চিহ্নযুক্ত পণ্য কেনা বন্ধ করে দেবো। কিন্তু এখন তা করবো, স্টোরের এগুলি সস্তা মনে হলেও এতে সবকিছু আছে’, সে ব্যাখ্যা করে।
‘তুমি কখন কনসালট্যান্ট হবে?’
‘এখানে এটাকে বলে অ্যাটেন্ডিং, একজন অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার।’
বিয়ের আয়োজকরা শুধু বলেছিল আমেরিকার ডাক্তাররা প্রচুর টাকা রোজগার করে। তারা বলেনি যে, ডাক্তার হিসেবে টাকা আয়ের আগে তাদের ইন্টার্নশিপ এবং রেসিডেন্সি কাজ করতে হয়, যা আমার নতুন স্বামী এখনো শেষ করেনি। আমরা লাগোস থেকে বিমানে যাত্রা করার সময় ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সে এসব কথা আমাকে বলেছিল।
‘ইন্টার্নরা বছরে আটাশ হাজার পেয়ে থাকে; তবে তাদের সপ্তাহে আশি ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অনেকটা ঘণ্টায় তিন ডলারের মতো’, সে বলতে থাকে, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো? ঘণ্টায় তিন ডলার!’
আমি জানতাম না ঘণ্টায় তিন ডলার আয় ভালো না মন্দ – আমি বেশ ভালোর দিকে ঝুঁকে থাকি যতক্ষণ না সে বললো যে, হাইস্কুলের ছাত্ররা পার্টটাইম কাজ করে অনেক বেশি পায়।
‘যেহেতু আমি এখন অ্যাটেন্ডিং হিসেবে কাজ করছি আমরা এ এলাকার কাছাকাছি কোথাও থাকবো না’, স্বামী বললো। সে দাঁড়িয়ে গেল। একজন মহিলাকে ট্রলিতে তার শিশুকে নিয়ে পার হওয়ার জন্য জায়গা করে দিলো। ‘দেখো, বাজারের ট্রলি বাইরে না নেওয়ার জন্য তারা কি প্রতিবন্ধকতা রেখেছে। ভালো এলাকাগুলিতে তারা এসব করে না। সেখানে তোমার ট্রলি কার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে।’
‘তাই!’ আমি বলি। ট্রলি বাইরে নিয়ে যেতে পারা না পারায় কি কিছু এসে-যায়? আসল ব্যাপার হচ্ছে সেখানে ট্রলি থাকে।
‘যারা এখানে বাজার করছে তাদের দেখো; তারা প্রায় সবাই অভিবাসী, আর এমন ভান করছে যেন নিজেদের দেশে ফিরে এসেছে।’ কোনো কিছু না ভেবেই সে একজন মহিলা আর তার দুটো শিশুর দিকে ইশারা করলো যারা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিল। ‘আমেরিকার সঙ্গে খাপ না খাওয়া পর্যন্ত তারা কখনো সামনে এগোতে পারবে না। এ-ধরনের সুপার মার্কেটেই তাদের ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকবে।’
আমি বিড়বিড় করে কিছু বলি যাতে মনে হবে মনোযোগ দিয়ে শুনছি। আমি ইনুগোর খোলাবাজারের কথা ভাবছিলাম। সেখানে ব্যবসায়ীরা দস্তা-আচ্ছাদিত শেড-এ ক্রেতাদের সঙ্গে মিষ্টিসুরে কথা বলে, সারাদিন দর-কষাকষির জন্য প্রস্তুত থাকে শুধু ক্রয়মূল্যের চেয়ে এক কোবো (নাইজেরিয়ার মুদ্রা) যেন বেশি বাড়ানো যায়। তুমি যাই কেন, সেটা তারা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে দেয় যদি তাদের থাকে, আর ব্যাগ না থাকলে তারা হেসে জীর্ণ খবরের কাগজ বাড়িয়ে দেয়।
স্বামী আমাকে একটা বিপণিকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সোমবার তার কাজ শুরুর আগে যত পারে আমাকে দেখাতে চায়। যখন সে গাড়ি চালায়, সেটি খটর-খটর শব্দ করে। মনে হবে গাড়ির অনেক যন্ত্রাংশ ঢিলে হয়ে গেছে – পেরেকভর্তি টিন ঝাঁকালে যেরকম শব্দ হয় অনেকটা তাই। একটা ট্রাফিক আলোর সামনে এসে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। চালু করার আগে বেশ কয়েকবার চাবি ঘুরালো সে।
‘রেসিডেন্সি পাওয়ার পরই আমি নতুন গাড়ি কিনবো’, সে বলে।
বিপণিকেন্দ্রের ভেতরের ফ্লোরগুলি দীপ্তি ছড়াচ্ছে, বরফের প্রস্তরখণ্ডের মতো মসৃণ আকাশছোঁয়া সুউচ্চ ছাদ ছোট ছোট আলোর তরঙ্গে জ¦লজ¦ল করছে। মনে হলো আমি একটা ভিন্ন পৃথিবীতে আছি, অন্য কোনো গ্রহে। যারা আমাদের ঠেলে চলে যাচ্ছে, এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিরাও, তাদের সবার মুখে ভিন্নতা, বিদেশি বিদেশি ভাব।
‘আমরা প্রথমে পিজা খাব,’ সে বলে ওঠে, ‘আমেরিকায় এ-জিনিসটা তোমার পছন্দ হবে।’ পিজা স্ট্যান্ডের লোকটা নাকে রিং আর লম্বা সাদা টুপি পরে আছে। আমরা হেঁটে সেখানে যাই।
‘দুটো পেপেরনি আর সসেজ। আপনাদের কম্বো (পেপেরনি ও সসেজের মিশ্রণ) ভালো হবে?’ স্বামী জানতে চায়। আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলার সময় তার উচ্চারণে ভিন্নতা আসে, ‘র’ বেশি উচ্চারিত হয়, ‘ট’ থাকে অনুচ্চারিত। লোকটা হাসলো, তার আগ্রহপূর্ণ হাসির জন্য সে প্রিয় হয়ে ওঠে।
আমরা একটা ছোট গোল টেবিলে বসে পিজা খাই যাকে ‘ফুড কোর্ট’ বলে। প্রচুর লোক গোলাকার টেবিলগুলিতে বসে আছে, কাগজের প্লেটে চর্বিযুক্ত পিচ্ছিল খাবারের ওপর তারা কুঁজো হয়ে আছে। এখানে এভাবে খাওয়ার কথা চিন্তা করলে ইকে আংকেল ভয় পেয়ে যাবেন। তিনি একজন বনেদি লোক, তাকে আলাদা রুমে খাবার না দিলে বিয়েবাড়িতেও তিনি খেতে পারেন না। এ-ধরনের খোলা জায়গায় অনেক টেবিল অনেক খাবার আছে, এটা অনেকটা লজ্জাজনক গণব্যবস্থা, মর্যাদাহানিরও ব্যাপার আছে।
‘তোমার কি পিজা পছন্দ হয়েছে?’ স্বামী জিজ্ঞেস করে। তার প্লেট খালি হয়ে গেছে।
‘টমেটোগুলি ভালো করে রান্না হয়নি।’
‘আমরা বাসায় খাবার বেশিক্ষণ চুলায় রাখি, আর এজন্যই সব পুষ্টিগুণ হারিয়ে ফেলি। আমেরিকানরা সঠিকভাবে রান্না করে। এজন্যেই দেখেছো তারা সবাই কিরকম স্বাস্থ্যবান আর
নাদুস-নুদুস।’
আমি মাথা নাড়ি। চারদিকে তাকাই। পরের টেবিলে বসে আছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, সঙ্গে একজন বালক – বালিশের মতো নরম আর প্রশস্ত, আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। আমিও হাসি ফিরিয়ে দিয়ে পিজায় আরেকটি কামড় বসাই। পেটটাকে টান টান রাখি যাতে ওটা আবার কোনো কিছু বের করে না দেয়।
এরপর আমরা ফ্যাশন শপ ম্যাকি’স-এ ঢুকলাম। আমার নতুন স্বামী একটা টানা সিঁড়ির পথে এগিয়ে গেল; ওটার চলাচল মসৃণ রাবারের মতো। আমার ভয় হচ্ছে ওটাতে পা রাখলেই আমি পড়ে যাবো।
‘দয়া করো, তাদের কি এর পরিবর্তে লিফট ছিল না?’ আমি জিজ্ঞেস করি। তবে একবার আমি স্থানীয় সরকারি অফিসে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ করা লিফটে চড়েছি, সেটা দরজা খোলার আগে এক মিনিট কেঁপে কেঁপে উঠত।
‘ইংরেজি বলো, তোমার পেছনে লোক আছে।’ সে ফিসফিস করে বলে। ঝলমলে জুয়েলারি ভর্তি একটা গ্লাস কাউন্টারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে সে বললো, ‘এটা এলেভেটর, লিফট নয়। আমেরিকানরা বলে এলেভেটর।’
‘আচ্ছা।’
সে আবার লিফটের (এলেভেটর) কাছে নিয়ে যায়। আমরা উপরে উঠে একটা সেকশনে যাই যেখানে লাইন ধরে সারি সারি ভারি কোট ঝুলছে। সে আমার জন্য অনালোকিত দিনে আকাশের মতো বিষণ্ন রঙের একটা কোট কিনল। দেখতে ফোলা ফোলা, মনে হয় ভেতরে স্পঞ্জের মতো রাবার দ্বারা আবৃত। কোটটা দেখতে বেশ বড়। আর এর সঙ্গে সুবিন্যস্ত হতে আমার মতো দুজন লাগবে।
‘শীত আসছে’, সে বললো। ‘এমন শীত যে মনে হবে ফ্রিজারের মধ্যে ঢুকে আছো। তোমার একটা গরম কোট দরকার।’
‘ধন্যবাদ।’
‘যখন দোকানে ‘সেল’ দেয় তখন কেনাকাটা করা উত্তম। মাঝে মাঝে তুমি একই জিনিস অর্ধেকেরও কম দামে পাবে। এটাই আমেরিকার অন্যতম আশ্চর্য বিস্ময়।’
‘তাই নাকি?’ আমি বলি আর দ্রুত যোগ করি, ‘সত্যি বলছো?’
‘চলো, এই বিপণিকেন্দ্রের চারদিকে ঘুরে আসি। এখানে আমেরিকার আরো আশ্চর্য জিনিস রয়েছে।’
আমরা হাঁটতে থাকি। আমার পায়ের নিচে ব্যথা না করা পর্যন্ত যেসব দোকানে কাপড়, জিনিসপত্র, প্লেট, বই, ফোন বিক্রি হচ্ছে সেগুলি দেখতে থাকি।
চলে যাওয়ার আগে সে ম্যাকডোনাল্ডস-এর দিকে এগিয়ে গেল। রেস্টুরেন্টটার অবস্থান বিপণিকেন্দ্রের পেছনে। হলুদ এবং লাল রঙের ‘এম’ লেখাখচিত একটি কার প্রবেশপথে রাখা আছে। আমার স্বামী ওপরে ঝুলিয়ে রাখা মেন্যু বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে দুটো বৃহৎ ২ নম্বরের খাবারটির অর্ডার দিলো।
‘আমরা বাড়ি যেতে পারি, তাহলে আমি রান্না করতে পারবো’, আমি বললাম। ‘তোমার স্বামীকে বাইরে বেশি খেতে দিও না’, আডা আন্টি বলতেন, ‘তাহলে রান্না খেতে খেতে ওই খাবার যে মহিলা রান্না করে তার বাহুর দিকে তাকে ঠেলে দেবে। সব সময় সতর্কতার সঙ্গে তোমার স্বামীকে পাহারা দেবে।’
‘মাঝে মাঝে এখানে খেতে আমার ভালো লাগে।’ সে বললো। দু-হাতে হ্যামবার্গার নিয়ে মনোযোগ সহকারে সে চিবুতে থাকে। তার ভ্রুতে কুঞ্চনের রেখা, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তাকে আরো বেশি অপরিচিত মনে হয়।
সোমবার আমি নারকেলের চাল রান্না করি যাতে বাইরে খাবারের ইচ্ছে পুষিয়ে দেওয়া যায়। আমি গোলমরিচের স্যুপও বানাতে চেয়েছি; ইফি আন্টি মনে করে, এই স্যুপ পুরুষের মনকে আর্দ্র করে তোলে। তবে আমার প্রয়োজন পশ্চিম আফ্রিকার মশলা উজিজা যেটা কাস্টম অফিসার আটক করেছিল। গোলমরিচের স্যুপ কিন্তু ওই মশলা ছাড়া হবে না। রাস্তার কাছেই জ্যামাইকান স্টোর থেকে আমি একটা নারকেল কিনেছিলাম আর ওটাকে ছোট ছোট টুকরোয় কাটার জন্য এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করি, কারণ সেখানে খাবার গুঁড়ো করার কোনো যন্ত্র ছিল না। তারপর রস বের করার জন্য সেগুলো গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখি। আমার রান্না শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বাসায় আসে। তার পোশাকের দিকে তাকালে অনেকটা ইউনিফর্ম বলে মনে হবে, বালিকাসুলভ নীল পোশাক এক জোড়া নীল ট্রাউজারের ভেতর ঠেসে চাপানো যা কোমরে শক্ত করে বাঁধা।
‘ওহে’, আমি বলি, ‘তুমি কি ভালোভাবে কাজ শেষ করে এসেছো?’
‘তোমাকে ঘরেও ইংরেজি বলতে হবে, সোনা। এতে তুমি সহজে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।’ সে তার ঠোঁট দিয়ে আমার চিবুক আলতো ঘষে দিলো আর তখনই দরজায় বেল বাজলো। শার্লি এসেছে, তার শরীরও একইভাবে গোলাপি কাপড়ে আবৃত। সে তার বেল্টটা কোমরে মোচড়াতে থাকে।
‘সেই গন্ধ’, শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে সে বলে। ‘এটা সব জায়গায়, এই বিল্ডিংয়ের সবখানে আছে। তুমি কী রান্না করছো?’
‘নারকেলের ভাত।’
‘তোমার দেশের কোনো রান্নার রেসিপি?’
‘হ্যাঁ।’
‘গন্ধটা সত্যিই ভালো। এখানে সমস্যা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নেই, একেবারেই নেই।’ এই বলে সে আমার স্বামীর দিকে মুখ ফেরালো যেন সে তার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে। তবে সে শুধু হাসলো। ‘ডেভ, তুমি কি এসে আমার শীতাতপযন্ত্রটি একবার দেখবে?’ সে বললো, ‘ওটা ঠিকমতো কাজ না করায় বড় বিপদে আছি; আজ খুব গরমও পড়ছে।’
‘অবশ্যই’, স্বামী উত্তর দেয়।
তারা বেরিয়ে যাওয়ার আগে শার্লি আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বলে, ‘গন্ধটা সত্যিই চমৎকার।’ আমি তাকে ভাত খাবার আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলাম। আধঘণ্টা পর আমার স্বামী ফিরে এলে আমি সেই সুগন্ধি ভাত তার সামনে হাজির করি। সে
তৃপ্তিভরে খেয়ে নেয়। আডা আন্টির রান্নায় খুশি হয়ে মাঝে মাঝে ইকে আঙ্কেল যেভাবে ঠোঁটে চুক চুক শব্দ করতো আমার স্বামীও ভাত খেতে খেতে তাই করলো। কিন্তু পরের দিন সে বাইবেলের মতো মোটা গুড হাউসকিপিং – অল আমেরিকান কুকবুক বইটি নিয়ে ঘরে ফিরল।
‘আমি চাই না আমরা মানুষের কাছে এভাবেই পরিচিত হই যারা পুরো বিল্ডিংটা বিদেশি খাবারের গন্ধে ভরে তোলে’ – সে বললো।
আমি রান্নার বইটা নিলাম, প্রচ্ছদের ওপর হাত বুলালাম; কিছু ছবির ওপর হাত রাখলাম, যেগুলি দেখতে ফুলের মতো, তবে ওসবও সম্ভবত খাবার হবে।
‘আমি জানি, শিগগিরই তুমি আমেরিকান খাবার তৈরিতে পারদর্শী হবে’, আমাকে আলতো করে কাছে টানতে টানতে সে বললো।
সেই রাতে আমি যখন রান্নার বইটি নিয়ে ভাবছি সে তখন আমার শরীরের ওপর প্রবলভাবে চড়াও হলো, ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করতে করতে পেষণের মাধ্যমে আমাকে পীড়িত করতে লাগলো। বিয়ের আয়োজকরা আরো একটি কথা আমাকে বলেনি – তেলের মধ্যে বাদামি গরুর মাংস আর ময়দায় ছিটানো চামড়া ছাড়া মুরগির মাংসের কঠিন লড়াই। আমি সবসময় গরুর মাংস তার নিজের তরল রস দিয়ে রান্না করেছি। মুরগির মাংসের চামড়া অক্ষত রেখে ফুটন্ত জলে ফেলে সিদ্ধ করি। পরের দিনগুলোতে আমি খুশি হই এজন্যে যে আমার স্বামী সকাল ৬টায় কাজে বেরিয়ে যায় আর রাত ৮টার আগে বাসায় ফেরে না। আর এজন্যেই আমার সময় থাকে অর্ধরান্না করা ঠান্ডা চটচটে মুরগির টুকরোগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে রান্না শুরু করার।
নীআ নামের মেয়েটি ২ডি নম্বরের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো। সে যে ধরনের মহিলা আমার ধারণা, আডা আন্টি তাকে পছন্দ করবে না। তিনি তাকে হয়তো বেশ্যা ডাকবেন। কারণ সত্যিকার অর্থে সে যেভাবে শরীরের ওপরের কাপড় পরেছে তাতে তার ব্রা’র একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছায়া তীব্র হয়ে বেরিয়ে আসছে। তাছাড়া আডা আন্টির নীআ’কে বেশ্যার কাতারে বিচার করার কারণ হিসেবে দেখবে তার ঝকমকে কমলা রঙের লিপস্টিক, চোখের ছায়া – লিপস্টিকের শেড যা তার ভারী চোখের পাতায় সেঁটে আছে।
‘হেই’, নীআ ডাক দিলো যখন আমি চিঠিপত্র আনার জন্য নিচে এলাম। ‘তুমি ডেভের নতুন স্ত্রী। আমি বলতে চাচ্ছি তুমি উপরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারো। আমি নীআ।’
‘ধন্যবাদ, আমি চিনাজা … আগাথা।’
নীআ আমাকে যত্নের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ‘তুমি প্রথমটা কী বললে?’
‘আমার নাইজেরিয়ান নাম।’
‘এটা একটা ইগবো নাম, তাই না?’
সে উচ্চারণ করলো ই-বো।
‘হ্যাঁ।’
‘এটার অর্থ কী?’
‘ঈশ^র প্রার্থনার উত্তর দেয়।’
‘সত্যিই সুন্দর। তুমি জানো, নীআ হলো একটি সোয়াহিলি নাম। আঠারো বছর বয়সে আমি নাম পরিবর্তন করেছি। তাঞ্জানিয়ায় তিন বছর কাটিয়েছি। সময়টাও ছিল নির্ঘাৎ বিস্ময়কর।’
‘তাই?’ আমি বলি আর মাথা নাড়ি। সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। পছন্দ করলো আফ্রিকান নাম আর আমার স্বামী আমার নামটাকে ইংরেজি নামে পরিবর্তন করতে চায়।
‘এই অ্যাপার্টমেন্টে তুমি একঘেয়েমির কারণে শেষ হয়ে যাবে। আমি জানি ডেভ অনেক দেরিতে ফেরে’, সে বললো, ‘এসো, আমার সঙ্গে একটা কোক খাও।’
আমি ইতস্তত করি কিন্তু ইতোমধ্যে নীআ সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। তাকে অনুসরণ করি। তার বসার ঘরটি খোলামেলা, রুচিশীল বলা যায়। একটি লাল সোফা, একটা হালকা পটে বসানো গাছের চারা, দেয়ালে ঝুলছে একটি বড় সাইজের কাঠের মুখোশ। সে আমাকে একটা লম্বা গ্লাসে বরফসহ ডায়েট কোক খেতে দিলো।
সে জানতে চাইলো আমেরিকায় আমি কীভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ব্রুকলিনের চারপাশটা দেখানোরও প্রস্তাব দিলো।
‘তবে সেটা সোমবার হতে পারে।’ সে বললো, ‘কারণ সোমবার আমি কাজ করি না।’
‘তুমি কী কাজ করো?’
‘আমার একটা চুলের সেলুন আছে।’
‘তোমার চুল সুন্দর’। আমি বলি, তখন সে তার চুল স্পর্শ করে বলে ওঠে, ‘ওহ, এটা’ – যেন নিজের চুল সম্পর্কে সে কিছুই ভাবেনি। শুধু তার চুল নয়, আফ্রো স্টাইলে শক্ত কোঁকড়ানো চুলের গোছা যা মাথার ওপর গোল হয়ে ফুলে আছে, ওটা আমার সুন্দর মনে হয়েছে – তার গায়ের রং সেঁকা চীনাবাদামের মতো, তার রহস্যময় ভারী পাতাসহ চোখ, বাঁকানো কটিদেশ। একটু উচ্চস্বরে সে গান চালিয়ে দিলো আর তাই কথা বলার সময় আমাদের গলাটাকে উঁচুতে তুলতে হলো।
‘তুমি জানো আমার বোন ম্যাকি’স-এ ম্যানেজারের কাজ করে। তারা মহিলা সেকশনে প্রাথমিক এন্ট্রি পর্যায়ে সেলসপিপল ভাড়া করছে। তুমি যদি আগ্রহী হও আমি তোমার জন্য বলতে পারি। তুমি সুন্দরী আছো। আমার বোন আমার জন্য কৃতজ্ঞচিত্তে একটা দিতে পারবে।’
আমার চিন্তার ভেতর কিছু একটা লাফ মেরে উঠল; হঠাৎ এবং নতুন চিন্তা, রোজগার যা হবে তা আমার, আমার। ‘আমার তো এখনো ওয়ার্ক পারমিট হয়নি’, আমি বলি।
‘তবে কি ডেভ তোমার জন্য আবেদন করেনি?’
‘করেছে।’
‘বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে না। শীতের আগে আগেই তোমাকে তা নিতে হবে। আমার হাইতির এক বন্ধু আছে যে সদ্য তার অনুমতিপত্র পেয়েছে। সুতরাং তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে জানাবে।’
‘ধন্যবাদ’, নীআ’কে আদর করতে ইচ্ছে করল, ‘অশেষ ধন্যবাদ।’
সেদিন বিকেলেই আমার নতুন স্বামীকে নীআ’র কথা বললাম। অবসাদে তার চোখ দুটো ডুবে আছে।
অনেকক্ষণ সে কাজে ব্যস্ত ছিল। সে বললো ‘নীআ!’ যেন মনে হলো আমি কার কথা বলছি সে জানে না। তারপর বললো, ‘সে ভালো তবে সতর্ক থেকো, কারণ সে যে-কোনো খারাপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।’
নিজের কাজ শেষ করে নীআ আমাকে দেখতে বাসার সামনে এসে থামে, তার সঙ্গে আনা ডায়েট সোডা পান করে আর আমার রান্নার আয়োজন দেখে। আমি শীতাতপযন্ত্র বন্ধ করে জানালা খুলে দিই, যাতে বাইরের গরম বাতাস ঘরে প্রবেশ করে। আর এর ফলে নীআ ধূমপানও করতে পারবে। সে তার হেয়ার সেলুনে কর্মরত মহিলাদের কথা বলে, যেসব পুরুষের সঙ্গে সে বেড়াতে গিয়েছিল তাদের কথাও বলে। তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিদিনের কথাবার্তার শব্দগুলির মধ্যে বিশেষ্য হিসেবে ‘ক্লিটোরিস’ আর ক্রিয়াপদ হিসেবে ‘ফাক’ শব্দটি ছুড়ে মারে। তার কথা আমার মনে ধরে। সে যেভাবে হাসে তাতে দেখা যায় তার একটা দাঁত যেন সুন্দর করে চেঁছে ফেলা হয়েছে। একটা নিখুঁত ত্রিভুজাকৃতি যা প্রান্তে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি তার এ-হাসিটাকে পছন্দ করি। সব সময় আমার নতুন স্বামী আসার আগেই সে চলে যায়।
নিঃশব্দে শীত এলো আমার কাছে। একদিন সকালবেলা আমি ঘরের বাইরে পা রাখি আর দেখি নিশ্বাস ঘন ঘন পড়ছে। মনে হলো, ঈশ^র সাদা উর্ণাজালের গোছা কুচি কুচি করে কাটছে আর সেসব সজোরে নিচে ছুড়ে মারছে। আমি দাঁড়িয়ে বরফ পড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি; দীর্ঘক্ষণ ধরে ছোট ছোট হালকা-পাতলা বরফের টুকরো ঘূর্ণি তুলে ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে। ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত অনেকক্ষণ ধরে পড়ছে। আমি রান্নাঘরের মেঝে শক্ত ব্রাশ দিয়ে ঘসে ঘসে আবার পরিষ্কার করলাম, ডাক-বাক্সের চিঠির সঙ্গে আসা ‘কী ফুড ক্যাটালগ’ বই থেকে আরো কিছু কুপন কাটলাম। এরপর জানালার পাশে গিয়ে বসি, দেখি ঈশ^রের বরফকে কুচি কুচি করে কাটার কাজ আরো বেশি উন্মত্ত রূপ ধারণ করেছে।
শীত এসে গেছে অথচ আমি এখনো বেকার, আমার স্বামী বিকেলে বাসায় ফিরলে আমি তার জন্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফ্রাইড চিকেন পরিবেশন করি এবং বলি, ‘আমি ভাবছি এখন আমার ওয়ার্ক পারমিট থাকা দরকার।’
উত্তর দেওয়ার আগে সে তৈলাক্ত ফ্রাইড পটেটোর কয়েক টুকরা মুখে দিলো। আমরা এখন শুধু ইংরেজি বলি। সে জানে না আমি রান্নার সময় নিজের সঙ্গে ইগবো ভাষায় কথা বলি। নীআ’কে ‘আমি ক্ষুধার্ত’, ‘কাল দেখা হবে’ – এসব কথা ইগবো ভাষায় শেখাই।
‘গ্রিন কার্ডের জন্য যে আমেরিকান মহিলাকে আমি বিয়ে করেছিলাম সে এখন সমস্যা করছে’, সে বললো আর আস্তে আস্তে মুরগির মাংসের একটা টুকরো দু-ভাগ করল। তার চোখের নিচের অংশ ফুলে গেছে। ‘তোমার বিয়ের আগেই আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ প্রায় চূড়ান্ত, তবে পুরোপুরি শেষ হয়নি, খুব ছোট একটা ব্যাপার, কিন্তু মহিলা আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পেরেছে এবং এখন আমার বিষয়টা ইমিগ্রেশনে জানাবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। সে আরো টাকা চায়।’
‘তুমি আগে বিয়ে করেছো?’ আঙুলগুলিকে আমি শক্ত করে ধরে রাখি, কারণ সেগুলি কাঁপতে শুরু করেছে।
‘দয়া করে তুমি কি প্রসঙ্গটা বাদ দেবে?’ আমি আগে যে লেমোনেড বানিয়েছিলাম সেটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে জানতে চায়।
‘জগটা?’
‘পিচার। আমেরিকানরা বলে পিচার, জগ নয়।’
আমি জগটা (পিচার) তার দিকে ঠেলে দিই। আমার মাথায় ধপধপানি বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কান দুটো তীব্র গরম জলে ভরে আছে। ‘তোমার আগেই বিয়ে হয়েছে?’
‘এটা শুধু কাগজে করা। এখানে অনেক লোক এ-কাজটি করে। এটা ব্যবসা – তুমি মহিলাকে টাকা দিয়ে দাও – দুজনেই তাহলে একসঙ্গে কাগজপত্র ঠিক করে নেবে – তবে মাঝে মাঝে সমস্যা হয়ে যায়। তখন হয় সে ডিভোর্স করতে রাজি হয় না, কিংবা সে এটা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করবে বলে ঠিক করে।’
আমি কুপনের স্তূপটা আমার দিকে টেনে আনি আর সেগুলি একটার পর একটা ছিঁড়ে দু-ভাগ করি। ‘অফোডিল, তুমি এ-ব্যাপারটা আমাকে আজকের আগেই জানাতে পারতে।’ সে কাঁধ ঝাঁকাল যেন কিছুই জানে না।
‘আমি তোমাকে বলবো বলবো ভাবছিলাম।’
‘আমাদের বিয়ের আগে ব্যাপারটা আমার জানা দরকার ছিল।’ তার সামনের চেয়ারে আমি আস্তে আস্তে বসে পড়ি যেন এভাবে না বসলে চেয়ারটা ভেঙে যাবে।
‘এটা তেমন কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। তোমার আংকেল-আন্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমার মা-বাবার মৃত্যুর পর যারা তোমার দেখাশোনা করেছে তাদের তুমি না বলতে পারতে?’
আমি নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। কুপনগুলি আরো ছোট করে কুচি কুচি করে কাটি। ডিটারজেন্ট আর মাংসের প্যাকের ছবি, কাগজের টাওয়েল মাটিতে পড়ে যায়।
‘তাছাড়া যেভাবে সব বিষয়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে সেখানে তোমার কী করার আছে?’ সে জিজ্ঞেস করে। ‘মাস্টার্স পাশ করে লোকজন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে না? চাকরি আছে?’ তার গলা নীরস, বৈচিত্র্যহীন।
‘কেন তুমি আমাকে বিয়ে করেছো?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘আমার একজন নাইজেরিয়ান স্ত্রী দরকার আর আমার মা বললো, তুমি ভালো মেয়ে, শান্ত স্বভাবের। মা আরো বলল, তুমি অবশ্যই একজন সচ্চরিত্রা কুমারী হবে।’ সে হাসলো। যখন সে হাসে তখন তাকে আরো বেশি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মনে হয়। তাকে সম্ভবত আমার বলা উচিত তার ধারণা কত ভুল।
আমি আরো কুপন নিচে ফেলে দিই, দু-হাত একত্রে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখি আর নখ দিয়ে শরীরের চামড়ায় আঁচড় কাটি।
‘তোমার ছবি দেখে আমি খুশি হয়েছি’, দুই ঠোঁট আলাদা করার শব্দ করে সে বলতে থাকে, ‘তুমি হালকা ত্বকের মেয়ে। আমার সন্তানদের চেহারা কেমন হবে সেটা আমাকে ভাবতে হবে। হালকা ত্বকের কালো মেয়েদের আমেরিকায় ভালোই মানায়।’ আমি তাকে লক্ষ করি, সে বাটার-দেওয়া মুরগির মাংসের বাকি অংশ খেল এবং খেয়াল করলাম একটু পানি খাবার আগে খাবার চিবানো বন্ধ করেনি।
সেদিন বিকেলে যখন আমার স্বামী বাথরুমে গোসল করছিল; আমার জন্য সে কেনেনি এমন কাপড়, দুটি নকশা করা খাটো ঢিলে হাতওয়ালা পরিচ্ছদ, একটা শিথিলবদ্ধ দীর্ঘ বসন, আডা আন্টির পরিত্যক্ত কাপড়-চোপড় এসব কিছু নাইজেরিয়া থেকে আনা প্লাস্টিকের একটা স্যুটকেসে ভরে আমি নীআ’র অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাই।
নীআ আমার জন্য দুধ-চিনি দিয়ে চা বানালো আর আমার সঙ্গে গোলাকার খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো যার চারদিকে পা রাখার ছোট নিচু চৌকি আছে।
‘তুমি যদি তোমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাও, এখান থেকেই বলতে পারো। তোমার যতদিন প্রয়োজন এখানে থাকতে পারো। বেল আটলান্টিকের সঙ্গে এ-বিষয়ে আমি পরিকল্পনা করে নেবো।’
‘বাড়িতে এখন কথা বলার কেউ নেই’, কাঠের তাকের ওপর নাশপাতি আকৃতির ভাস্কর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম। ওটার খালি চোখ দুটো যেন উল্টো আমাকেই দেখছে।
‘তোমার আন্টির খবর কী?’ নীআ জানতে চাইল।
আমি মাথা নাড়ি। ‘তুমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছো’ – আডা আন্টি তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠবে। ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? কেউ কি নিরাপদ আশ্রয় ছুড়ে ফেলে দেয়? তুমি কি জানো আমেরিকায় একজন ডাক্তারের জন্য কত মেয়ে দুচোখ বিসর্জন দিতে পারে? যে-কোনো স্বামীর জন্য?’ ইকে আংকেল গুরুগম্ভীর কণ্ঠে আমার অকৃতজ্ঞতা, বোকামির জন্য বকা দেবে, ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর হাতের মুষ্টি আর মুখ শক্ত হয়ে যাবে।
‘তোমাকে তার আগের বিয়ের কথা বলা উচিত ছিল, তবে ওটা একটা সত্যিকারের বিয়ে ছিল না চিনাজা’, নীআ বলে। ‘আমি একটা বই পড়েছি; তাতে লেখা – আমরা পেমে পড়িনি, ধীরে ধীরে প্রেমে উঠেছি। তবে তুমি যদি একটু সময় …।’
‘এটা সময় দেওয়ার বিষয় নয়।’
‘আমি জানি।’ হাই তুলে নীআ বলে, ‘শুধু নির্ঘাত ভালো জিনিসটা এখানে আনতে চাচ্ছি। বাড়িতে তোমার কে আছে?’
‘একজন ছিল, কিন্তু সে খুব ছোট আর তার কাছে কোনো টাকাকড়ি নেই।’
‘পুরো ব্যাপারটা শুনতে খারাপ লাগছে, ধ্যাৎ।’
আমি আমার চা নাড়তে থাকি যদিও তার প্রয়োজন নেই। আমি অবাক হচ্ছি কেন আমার স্বামী নাইজেরিয়ায় একটা স্ত্রী খুঁজে নিল।
‘তুমি কখনো স্বামীর নাম বলোনি, কখনো বলোনি। ওটা কি কোনো রীতির বিষয়?’
‘না’, আমি ওয়াটারপ্রুফ কাপড় দিয়ে তৈরি টেবিল-চাদরের দিকে তাকাই, ‘আমি বলতে চেয়েছি এটা হয়েছে কারণ আমি তার নাম জানতাম না, তাকে চিনতাম না।’
‘যে-মেয়েটাকে সে বিয়ে করেছে তার সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছে; অথবা তার 888sport app মেয়ে বন্ধুকে তুমি চেনো?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
নীআ অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তার এই মাথার নাটকীয় দিক পরিবর্তন যেন বলতে চায় অনেক কিছু। নীরবতা আমাদের দুজনের মধ্যে বিস্তৃত হতে থাকে। ‘নীআ?’ আমি আবার জিজ্ঞেস করি।
‘আমি তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছি। প্রায় দু-বছর আগে যখন সে প্রথম এসেছিল। আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক করেছি এবং এক সপ্তাহ পরে তা শেষ হয়ে যায়। আমরা কখনো অভিসারে যাইনি। অন্য কারো সঙ্গে তাকে ডেটিং করতেও দেখিনি।’
‘ওহ!’ আমি বলি আর দুধ-চিনি মিশিয়ে চা খাই।
‘তোমার কাছে আমি সৎ থাকতে চাই। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দাও।’
‘হ্যাঁ’, আমি বললাম। জানালার বাইরে তাকানোর জন্য আমি উঠে দাঁড়াই। মনে হচ্ছে শুভ্র মৃত্যুর চাদরে বাইরের পৃথিবী বিশুষ্ক মমি হয়ে আছে। পায়ে চলার পথে বরফের স্তূপ যা ছয় বছরের ছেলের উচ্চতার সমান হবে।
‘তুমি তোমার কাগজপত্র পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারো, তারপর চলে যেতে পারো’, নীআ বললো। ‘তোমাদের বিয়ের যৌথ কাগজ পেলে তুমি ভাতার জন্যও আবেদন করতে পারবে। তারপর তুমি একটা চাকরি পেয়ে একটা থাকার জায়গা খুঁজে নেবে, নিজেকে রক্ষা করবে আর নতুন জীবন শুরু করবে। দোহাই, এটাই হচ্ছে আমেরিকা – দূর ছাই, নির্ঘাৎ ‘আ’।’
নীআ এসে আমার পাশে দাঁড়াল, জানালার কাছে। সে ঠিক বলেছে। আমি এখন চলে যাব না। পরের দিন বিকেলে আমি হলগুলির ভেতর দিয়ে সেই ২বি-তে ফিরে আসি। দরজায় বেল টিপ দিই। স্বামী এসে দরজা খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে যাওয়ার পথ করে দেয়।
লেখক-পরিচিতি : চিমামানডা নগোজি আদিচের জন্ম ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে নাইজেরিয়ায়। নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে Medicine আর Pharmacy-তে পড়ালেখা করেছেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি আমেরিকা চলে যান এবং সেখানে ফিলাডেলফিয়ার Drexel University-তে Communication and Political Science বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরে আমেরিকার Eastern Connecticut State University (ECSU) থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে আদিচে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Creative Writing-এর ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৮ সালে Yale University-তে তিনি African Studies-এর ওপর Masters of Art ডিগ্রি নেন।
888sport app download apk, নাটক, 888sport alternative link, গল্প – 888sport live footballের সব শাখাতেই তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। উল্লেখযোগ্য 888sport alternative link হচ্ছে Purple Hibiscus (2003), Half of Yellow Sun (2005). We should All be Feminists (2014), Americanal (2013)| 888sport app download apkর বই Decisions (1997), নাটক For love of Biafra (1998), ছোটগল্প The Things Around Your Neck (2011), ছোটদের জন্য বই Mama’s Sleepings Scarf (2022) উল্লেখযোগ্য। Half of Yellow Sun 888sport alternative linkের জন্য Orange প্রাইজ পেয়েছেন। এ-888sport alternative link নিয়ে ছবিও হয়েছে। Purple Hibiscus 888sport alternative linkের জন্য কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ আর হার্সটন রাইট লিগেসি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। উন্নত দেশে বিশেষ করে আমেরিকায় আফ্রিকার লোকজনের জীবন, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য, মূল্যবোধের পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় বারবার তাঁর লেখায় উঠে এসেছে।
‘বিয়ের আয়োজকরা’ গল্পটি Helon Habila-সম্পাদিত The Granta Book of the African Short Story (২০১২) বইয়ে অন্তর্ভুক্ত আদিচের ÔThe Arrangers of MarriageÕ M‡íi বাংলা রূপান্তর।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.