‘ওয়েটার’, আমি জোরে ডাক দিই। রেস্টুরেন্টে অন্য কেউ থাকলে নিশ্চয়ই মুখ ঘুরিয়ে এদিকে তাকাত।
প্যান্টের এক পায়ের সঙ্গে অন্য পা ঘষা খাওয়ার শব্দ পেলাম। কেউ দ্রুত আসছে। গায়ে সস্তা পারফিউম।
‘ইয়েস স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য?’
‘এটা কী ওমলেট বানিয়েছে? পাচক জানে না, আমি দেশি ধনেপাতা খাই?’
‘ধনেপাতা দিয়েছে তো স্যার, এই যে দেখতে পাচ্ছি।’
অনুমান করতে পারি, সে হাত-না-দেওয়া আস্ত ডিমভাজাটার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছে।
পেঁয়াজটা বোধহয় আধা ভেজেছে, যেরকম আমি চাই, আর গন্ধ থেকে বুঝতে পারি কাঁচামরিচের পরিমাণও ঠিকই আছে; কিন্তু ধনেপাতার বিষয়ে ছাড় দিতে আমি নারাজ।
‘দিয়েছে, তবে হাইব্রিড। গন্ধ খুব কম, না থাকার মতো।’
‘ঠিক আছে, স্যার, ওটা বদলে দিচ্ছি। পাচককে বলছি ভালো করে খুঁজতে, দেশি ধনেপাতা যদি থাকে।’
আমি ওদের নিয়মিত খদ্দের, তাই খাতির একটু বেশি। ‘দয়া করে তাই করুন’ – গজগজ করতে করতে বললাম।
টেবিল থেকে কিছু তোলার আওয়াজ হলো, তারপর জুতার তলা কাছ থেকে দূরে মিলিয়ে যাওয়ার শব্দ। বুঝলাম যে প্লেটটা তুলে নিয়ে গেছে। আরো বুঝলাম যে উত্তেজিত হলে আমার নাক ঠিকমতো কাজ করে না। নইলে এত কাছের বেলি ফুলের ঘ্রাণ মিস করার কথা নয়।
‘বাপ রে! একটা ডিমের জন্য এত।’ হাসতে হাসতে বীথি বলে। সে কখন এসেছে বুঝতে পারিনি। চেয়ার টানার শব্দ হলো, আর চুড়ির শব্দ থেমে গেল। তার বসার শব্দটাও পেলাম।
‘খাঁটি ধনেপাতার জন্য আমি বিশ্বযুদ্ধও বাঁধিয়ে দিতে পারি।’
‘তাই তো দেখছি!’ তার কণ্ঠে কৌতুকের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি।
বেলির গন্ধটা জোরালো। নিশ্চয়ই অনেক ফুল দিয়ে গাঁথা মালা পরেছে; কিন্তু গলায় পরেছে, না খোঁপায় গুঁজেছে?
কব্জিতেও দুয়েকটা আছে কি? ধরতে পারলাম না।
‘আমার কিন্তু মনে হয় তুমি রেগে আছো অন্য কারণে।’ বীথির গলা সিরিয়াস।
‘সেটা কী?’
‘এই যে আমি চলে যাচ্ছি, আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে, সেজন্যে। রাগটা অন্যের ওপর ঝাড়ছো।’
‘তোমাকে মিস করব। তবে ধনেপাতার ব্যাপারটাও মিথ্যে নয়।’
‘তাই? তাহলে তো ভালোই। আমি ভেবেছিলাম অন্য কারণটাই বুঝি আসল।’ তার গলা কি একটু কেঁপে উঠলো? বোঝার চেষ্টা করলাম না। জানি যে, কিছু প্রশ্নের জবাব শুধু বেদনার পাল্লাকেই ভারি করে।
‘তোমার স্বামী যেন কখন আসছে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘সন্ধ্যার ট্রেনে। একরাত থাকবে। আমরা সকালে চলে যাবো।’
রোজ বিকেলে আমি এই রেস্টুরেন্টে ঘণ্টাখানেক বসি। মাঝে মাঝে বীথি আসে। একই টেবিলে বসে গল্প করে। শ^শুরবাড়িতে ঠাঁই না হওয়ায় কয়েক বছর ধরে এই শহরে বাপের বাড়িতে থাকছে। তার স্বামী মন পাল্টেছে, স্ত্রীকে নিতে আসছে। কদিন ধরেই বীথি চঞ্চল, গলায় খুশির ছোঁয়া।
আমার মনে পড়লো মাকেও মাঝে মাঝে খুশি লাগতো। বাবা যখন ছুটিতে বাড়ি আসত। মা সেদিন লাল শাড়ি পরত। তাকে খুব সুন্দর দেখাত। শরীরে থাকত অন্যরকম একটা ঘ্রাণ। সেসবই অবশ্য অনেক আগের ঘটনা। আমার নয় বছর বয়সের আগের, যে-বছর দুর্ঘটনায় চোখ দুটো গেছে। সবাই বলে যে আমার কপাল, গাল আর মুখে অনেকগুলো সেলাই দিতে হয়েছিল। কিন্তু কেউ বলেনি আমাকে কেমন দেখায়। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আমার 888sport app download for androidশক্তি ভালোই, খানাখন্দে ভরপুর এলাকার মানচিত্র কেমন দেখায় সেটা বেশ মনে করতে পারি। এখন আমি মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা পাচ্ছি।
‘এখানে কেউ কি লাল শাড়ি পরেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাকে বলো যে, আমি যদি দেখতে পেতাম, বলতাম যে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’
‘বলেছি।’
‘কই, শুনতে পাইনি তো।’
‘মনে মনে বলেছি।’
‘মনে মনে?’
‘হ্যাঁ, লাল শাড়িটা আমিই পরেছি।’
বীথি হাসল। হাসলাম আমিও। বোধহয় একটু
অসাবধানী হয়েছিলাম। হাত লেগে একটা গ্লাস উল্টে পানি গড়িয়ে পড়ল।
‘নড়ো না, প্যান্ট ভিজে যাবে। আমি পানিটা কেচে ফেলে দিচ্ছি।’
হাতের একপাশ দিয়ে টেবিল মোছার আওয়াজ পেলাম। প্লাস্টিকের আচ্ছাদন বেয়ে বেয়ে মেঝেতে পানি পড়ার শব্দ আমার কান এড়াল না। সব শুনতে পাই, কেবল নিজের চোখ থেকে যখন জল ঝরে, সেটা ছাড়া।
ওয়েটার নতুন করে ওমলেট আর কফি দিয়ে গেল। বীথির জন্য চা আর মাছের কাটলেট। ওর প্রতিদিনকার পছন্দ ওরা জানে। আমারটাতে এবার দেশি ধনেপাতা দিয়েছে। বোধহয় খুঁজেটুজে বের করেছে। গন্ধটা তাজা পাতার নয়। আমরা চুপচাপ খেলাম। আজ গল্প জমল না।
‘তোমার নিশ্চয়ই অনেক কাজ? মজাদার কিছু রান্না, কাপড়চোপড় গোছানো, রাতের জন্য ঘর সাজানো …।’ কিছু একটা বলা দরকার, তাই বললাম।
বীথি জবাব দিলো না। একটা নীরবতার তাঁবু নেমে এসে আমাদের টেবিলটাকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘চলো উঠি।’
কয়েক রকমের শব্দ জানান দিলো যে, বীথি উঠে দাঁড়িয়েছে। টেবিলে ঠেস দিয়ে রাখা সাদা ছড়িটা হাতে নিয়ে তাকে অনুসরণ করলাম।
আমাদের একই পথ। আগে তার বাড়ি, তারপর আমার। খুব দূর নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। আমরা তাই করলাম।
রেস্টুরেন্ট থেকে একটু এগুলেই মাথায় আগুন-ধরানো ডাস্টবিন। বাকি পথটা মোটামুটি ভালোই। ঘাস888sport app হাঁটাপথের একপাশে পিচ আর একপাশে মাটির গন্ধ। বোশেখ এসে গিয়েছে, নইলে পথের ওপর বড় আমগাছে বোলের সুবাসটা এখনো থাকত। অবশ্য তার পুরনো ছালেরও একটা গন্ধ আছে। সেটা দিয়েই চিনতে পারি। আমরা গাছটা পেরুলাম, কিন্তু বীথির পায়ের জুতো বাঁয়ে মোড় নেওয়ার আওয়াজ পেলাম না। সে সোজা হাঁটছে।
‘কী হলো? বাড়ি যাচ্ছো না যে?’
‘তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি’, বীথি জবাব দিলো। আমি কিছু বললাম না।
বোশেখের বিকেল হলেও রোদ কোমল।
‘আকাশে কি মেঘ করেছে? বৃষ্টি হবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘তেমন না। মাথার ওপর দুয়েকটা ঘুরছে, বৃষ্টি নামার মতো নয়’, সে বলল।
কিন্তু আমি জানি বৃষ্টি হবে। বাতাস নরম হয়ে আসছে। বৃষ্টির গন্ধ পাচ্ছি।
আমাকে বাড়ির উঠানে পৌঁছে দিয়ে বীথি বিদায় নিল। একবার ভাবলাম উঠোনের পাশে কদম গাছটার নিচে বৃষ্টিতে ভিজি। আবার ভাবলাম, না, থাক। বৃষ্টি এলে কাদা হবে, আর আমাকে ভেজা পায়ে কাদার গন্ধ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। তার চেয়ে দূরের বৃষ্টির গন্ধই থাক।
আমি তো জানি পছন্দের হোক বা অপছন্দের, কোনো গন্ধই শূন্য ঘরকে ভরিয়ে দিতে পারে না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.