মাস্ক পরে দাঁড়ালাম ১২ নম্বর বেডের সামনে।
ধানমণ্ডি ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট ১-এর (সিসিইউ ১) ভেতরে কর্তব্যরত কয়েকজন চিকিৎসকও পাশে দাঁড়ালেন। কোনো অধ্যাপক কিংবা সিনিয়র চিকিৎসক ‘অন কলে’ রোগী দেখতে গেলে জুনিয়ররা এভাবেই পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁদের চোখের কৌতূহলী প্রশ্ন নিবৃত্ত করে বললাম, ‘অন কলে আসিনি, আমাদের প্রিয় 888sport live footballিকবন্ধুকে দেখতে এসেছি।’
তাঁরা স্বাগত জানালেন আমাকে।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের চোখ চকচক করছে। সিসিইউ-বেডে যেভাবে শুয়ে থাকার কথা সেই ভঙ্গিতেই আছেন তিনি। বোঝা গেল খুশি হয়েছেন। সেই চিরপরিচিত হাসি ছড়িয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাহস দিতে এসেছেন?’
‘চিনতে পেরেছেন?’
‘বাহ! চিনব না কেন? আমি তো ঠিক আছি!’
‘আমি মনোচিকিৎসক হিসেবে আসিনি এখন। সাহস দিতেও না। এসেছি অনুজ হিসেবে, লেখকবন্ধুকে দেখতে। ইতোমধ্যেই আপনার ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ডা. মাহবুবের মুখ থেকে শুনে এসেছি হার্টের রহঃবৎাবহঃরড়হ ভালো হয়েছে, আর এখন আবার হৃৎপিণ্ড তরুণ হয়ে যাবে।’
তিনি হাসলেন।
বেডের চারপাশ ঘিরে থাকা চিকিৎসকদল আমাকে কিছুটা দূরে নিয়ে জানাল, ‘স্যার, হার্টের ম্যাসিভ অ্যাটাক হয়েছে, intervention সফল হলেও রোগী শংকামুক্ত নন। ফুসফুসে, কিডনিতে রক্তের ফ্লো ঠিকমতো চলছে বলে মনে হচ্ছে না। কিডনির এনজাইম ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গেছে।
সে-কারণে সঠিকভাবে চিকিৎসা চালানো যাচ্ছে না। তবে সব বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ চিকিৎসা আমরা চালাচ্ছি।’
‘কিডনি বিশেষজ্ঞ দেখেছেন?’
‘জি স্যার, কিডনি এবং বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ আছেন চিকিৎসক দলে।’
আবার ফিরে গেলাম তাঁর কাছে। হাতটা ধরলাম। শিরা দেখলাম। মনিটরের দিকে তাকালাম। চিকিৎসার ফলে সব প্যারামিটার মোটামুটি কাজ করছে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। ভরসা নিয়ে বললাম, ‘আমি আবার আসব। নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবেন। এখানকার সব চিকিৎসক দক্ষ-গুণী, সবাই আপনাকে চেনে-জানে এবং সবসময় আপনার পাশে আছে, আমিও যেহেতু এই হাসপাতালে প্র্যাকটিস করি, বারবার আসব, খবর নেব। ভেতরের কনসালট্যান্টরা যে-কোনো বিষয় প্রতি মুহূর্তে আপনার চিকিৎসকদলকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছেন, আর তাঁরা তো বারবারই আসছেন আপনাকে দেখতে। কম্পিউটারেও সব মনিটরিং হচ্ছে। আপনার 888sport live footballিকবন্ধু কার্ডিওলজিস্ট ড. বরেণ চক্রবর্তী তো আছেনই। বাইরেও তো অপেক্ষা করছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী। দেশজুড়েও সবাই আপনার জন্য দোয়া করছেন। ফেসবুকে সবাই প্রার্থনা করছেন। সবার ভালোবাসায় নিশ্চয়ই সেরে উঠবেন – মহান আল্লাহর কাছে এটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দাবি, আবেদন।’
চেম্বারে ফিরে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছিলাম না, অস্থির অস্থির লাগছিল। তবু নিজ দায়িত্ব শেষে আবার গেলাম সিসিইউ ১-এর ১২ নম্বর বেডের সামনে। এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘কবে ছুটি দেবেন? কবে বাসায় যাব? বাসায় যেতে চাই।’
‘আপনার চিকিৎসকদল যখন বলবেন তখনই ইনশা আল্লাহ বাসায় যেতে পারবেন।’
উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি এবার তাকালেন শুভ্র অ্যাপ্রোন পরা সার্বক্ষণিক দায়িত্বরত চিকিৎসকের দিকে।
‘তুমি বলো মা, কখন ছাড়বে আমাকে?’
তিনি আইসিইউ কনসালট্যান্ট, সারারাত ডিউটি করেছেন, চোখে তার ঘুম ঘুম ভাব। প্রশ্ন করেই মনজুভাই তাকালেন মেয়েটির পরিশ্রান্ত, কর্মক্লান্ত মুখটার দিকে; নিজের প্রশ্নের উত্তরের আশা না করে বললেন, ‘তুমি একটু টেবিলে মাথা নুইয়ে রেস্ট নাও, মা। আমি ভালো হয়ে যাব।’
দরদি মেয়েটি হেসে বললেন, ‘আমার ক্লান্তি চলে গেছে, স্যার, আপনাকে ছুটি দিতে পারলেই আমাদের শান্তি।’ আরো বললেন, ‘আমাদের স্যাররা অনুমতি দিলে শিগগির বাসায় যেতে পারবেন।’
এবার মনজুভাইয়ের ঘোরগ্রস্ত কণ্ঠে কিছুটা আকুলতা ঝরে পড়ল, ‘মোহিত কামাল, বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করুন, ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’
আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অন্যপ্রকাশের মাজহার। তাঁর উৎকণ্ঠা, ছোটাছুটি দেখে বুঝলাম মাজহারের ভেতর অন্য এক মাজহার লুকিয়ে আছে। শুধু প্রকাশক এবং লেখকই নন তিনি, মানবিক সত্তার অধিকারীও। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম বিপদের সময় এত আন্তরিকভাবে কেউ কারো পাশে আপনজনের মতো সার্বক্ষণিক দাঁড়াতে পারে, মাজহারের এক্সপ্রেশন না দেখলে বোঝা যেত না। তাঁর মধ্যে মনজুভাইয়ের জন্য যে 888sport apk download apk latest version, ভালোবাসা ও সেবামূলক মানসিকতার মৌলিকত্ব আছে, মনোচিকিৎসক হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা চলার সময়ও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আর আমাদের মনজুভাইয়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তাঁকে দেখলাম দেবদূতের মতো। তিনি শুধু একা নন, সঙ্গে ছিল অন্যপ্রকাশ-অন্যদিনের বিশাল বাহিনীও।
সন্ধ্যা সাতটায় মেডিক্যাল বোর্ডের আয়োজন করা হয়েছে। জেনেছি আমি। বোর্ড চলার সময় হাজির হয়ে ভেতরে গেলাম। বোর্ডের সদস্য নই, তবু আমাকে দেখে কেউ কেউ চমকে উঠলেন। সবার কৌতূহল নিবৃত্ত করে বললাম, ‘আমি এসেছি আমার লেখকবন্ধুর কাছের একজন হয়ে, বলতে পারেন দূরবর্তী অভিভাবক হিসেবে।’
সবাই আমাকে বসার জন্য জায়গা করে দিলেন। দেখলাম চিকিৎসক ছাড়াও সেখানে উপস্থিত আছেন মনজুভাইয়ের বোন, মাজহারসহ আরো অনেকে। মনজুভাইয়ের একজন কলিগও।
ডা. বরেণ চক্রবর্তী এবং ডা. মাহবুব রোগীর বর্তমান অবস্থায় কী করা হয়েছে, হচ্ছে, আর কী করা যেতে পারে তা নিয়েও কথা বলছিলেন। বিদেশে নেওয়ার প্রসঙ্গও উঠেছিল। আমি নীরব শ্রোতা হয়ে কেবল শুনলাম।
অবশেষে তাঁকে ভেন্টিলেশন মানে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলো। হাহাকার করে উঠল দেশ। শুভানুধ্যায়ী ভক্তদের উৎকণ্ঠা। সবাইকে চমকে দিয়ে মনজুভাই আবার ফিরে এলেন ভেন্টিলেটর বা লাইফ সাপোর্ট থেকে।
ফুসফুসের অবস্থা ভালো নয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আলী হোসেনকেও কল করা হলো। সেদিন তাঁর ছুটি ছিল। তবু তিনি এলেন। দেখলেন। পরামর্শ দিলেন। 888sport app চিকিৎসার পাশাপাশি নেবুলাইজেশন করা হলো। বিস্ময়করভাবে দেখলাম আগের দিনের তুলনায় পরের দিনের রিপোর্টে ফুসফুসের অবস্থা বেশ উন্নত। মাজহারের হাত চেপে ধরে বললাম, ‘প্রিয় মাজহার, ভয় নেই। নিশ্চয়ই আমরা আবার ফেরত পাব আমাদের মনজুভাইকে।’
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বললেন, ‘এই উন্নতি স্থায়ী নয়। বিপর্যয় ঘটতে পারে যে-কোনো সময়।’
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম বেডের পাশে। এবার আরো বেশি আকুল হয়ে মৃদুস্বরে মনজুভাই বলছেন, ‘বাসায় যাব। বাসায় যাব। ওদের বলে ছুটির ব্যবস্থা করুন, মোহিত কামাল।’
বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। সত্যিই কি তাঁকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে পারব? প্রশ্নটা পাঁজর ভেঙে হানা দিলো বুকের ভেতর আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের শেষ অনুচ্ছেদের কথা – ‘… এমন সময়ে ফটিকের মাতা ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করিয়াই উচ্চ কলরবে শোক করিতে লাগিলেন। বিশ্বম্ভর বহুকষ্টে তাঁহার শোকোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত করিলে, তিনি শয্যার উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, “ফটিক। সোনা! মানিক আমার!”
ফটিক যেন অতি সহজেই তাহার উত্তর দিয়া কহিল,
“অ্যাঁ।”
মা আবার ডাকিলেন, “ওরে ফটিক, বাপধন রে।”
ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ না করিয়া মৃদু স্বরে কহিল, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”’
দুই
তখন বাসায়। হঠাৎ আইসিইউ থেকে জরুরি কল এলো।
কর্তব্যরত চিকিৎসক বললেন, ‘স্যার, আপনার বন্ধুর বিপি (ব্লাড প্রেসার) রেকর্ডেবল নয়।’
‘ওদের আত্মীয়-স্বজনকে ব্রিফ করেছেন?’
‘জি স্যার।’
আবার ছুটে গেলাম হাসপাতালে। দেখলাম
লেখক-888sport live footballিকের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই ল্যাবএইডের আইসিইউর আশেপাশের অলিগলিতে।
হ্যাঁ, জীবনের বাড়ি ছেড়ে তিনি অনন্তের ঠিকানায় চলে গেছেন। এখন শুয়ে আছেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তিনি আমাদের প্রিয় কথা888sport live footballিক, বন্ধু, বড়ভাই, গুরুজন, 888sport live footballের অভিভাবক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তিন
888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি 888sport live footballে অধ্যাপনা করেছেন। জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান উজ্জ্বলতম করেছেন। অ্যাকাডেমিক লেখালেখি ছাড়াও নন্দনতত্ত্ব এবং 888sport live chat-বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। কিন্তু ছোটগল্পকার হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ ১৯৭৪ সালে। বিচিত্রায় প্রকাশিত ‘বিশাল মৃত্যু’ গল্পটি যেন ’৭৩ সাল থেকে উড়ে এসে ১০ই অক্টোবর ২০২৫ সালে জুড়ে বসল।
১৯৭৩ সালে মৃত্যুর সংকেত রেখে দিয়েছিলেন তিনি। সত্য হয়ে ‘বিশাল’ শব্দটি হিমালয় চূড়ায় উঠে উচ্চকণ্ঠে যেন ঘোষণা করছে, ‘হ্যাঁ, ‘বিশাল’ শব্দটি আমারই সৃজন। আমার ফেলে আসা জীবনকে তোমরা যদি 888sport app download for android রাখো, তাহলে এই শব্দটির অর্থ, অর্থময় হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।’
আসলে তাই-ই।
মনজুভাইয়ের মৃত্যুকেও ‘বিশাল মৃত্যু’ হিসেবে দেখতে চাই।
দেশ-বিদেশের 888sport live football-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে বেদনার ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে তাঁর এই মৃত্যু।
পুরো 888sport apps কেঁদেছে। মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মাটিতে স্থান দিয়ে যেন কবরটি হয়ে আছে আমাদের বেদনা আর ভালোবাসার নন্দনতত্ত্বের সাড়ে তিন হাত শান্ত ভূমি।
১৯৭৩-এ ‘বিশাল মৃত্যু’ গল্প লেখার পর দীর্ঘদিন লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। আশির দশকের শেষ দিকে বিচিন্তায় একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর পুনরাবির্ভাব ঘটে। তারপর তিনি নিয়মিত লিখছেন। এ পর্যন্ত 888sport app ও কলকাতা থেকে তাঁর এগারোটি গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে। ২০০১ সালে প্রকাশ পায় অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প। ২০০৫ সালে প্রকাশিত প্রেম ও প্রার্থনার গল্প প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের 888sport app download bd লাভ করে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি 888sport app download bd অর্জন করেন, 888sport cricket BPL rateে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প মানেই গতানুগতিক ধারার বাইরের গল্প, ব্যতিক্রমী গল্প। কী কী বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর 888sport live football আলাদা, কেন আলাদাভাবে পাঠের যোগ্য? সর্বজনীনভাবে কেন গৃহীত?
সহজ উপলব্ধি হলো মনস্তত্ত্ব, দর্শন ও অনন্য শৈলীর মেলবন্ধন রয়েছে তাঁর অসংখ্য গল্পে। এগুলোর চারটি উল্লেখযোগ্য গল্প বেছে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে চাই। প্রতিটি গল্পের মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
‘নোলক’
সেরা দশ গল্প (অন্যপ্রকাশ, ২০১৬) গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ‘নোলক’ গল্পটি। এই গল্পে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 888sport sign up bonus ও হারানোর বেদনাকে এমনভাবে দেখিয়েছেন, যা একাধারে মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক।
নোলক হারানো মানে শুধু গয়না হারানো নয়, এর সঙ্গে অতীত হারানোর বিষয়টিও যুক্ত। প্রেমের অপূর্ণতা এবং অস্তিত্ব ক্ষয়ের মধ্যেও ভিন্নমাত্রার মেলবন্ধন স্থাপন করেছে হারানোর এই বিষাদঘন প্রতিক্রিয়া।
নোলকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিয়জনের 888sport sign up bonus। নোলকের মতো একটি বস্তু কীভাবে গভীর মানসিক বন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠে তা লেখক সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন যথার্থ চরিত্র সৃজনের মাধ্যমে। প্রেমপিয়াসী মকনের নিষ্ঠুরতায় কেবল নাক থেকে নোলকই বিচ্ছিন্ন হয়নি, একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়েছে নাকের নরম অংশও। মকনের বাবা সিরাজুদ্দিন তা খুঁজে পান। তবে জঙ্গলে ফেলে আসা জ্যোৎস্নাকে খুঁজে পাওয়া গেল কি না তার উত্তরের জন্য গল্পের জানালা খুলে দিয়ে কাহিনি শেষ করেছেন লেখক। মকন জ্যোৎস্নার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে গর্ভবতী করলেও সে যে অপূর্ব গানের পাখি, নুলা মেয়েটিকে ভালোবেসেছে, তার প্রমাণ নেই। কোনো জোরজবরদস্তিতে নোলকটা হারাতে চায়নি জ্যোৎস্না। দুজনের মাঝখানে দেওয়ালের মতো এসে দাঁড়িয়েছে জ্যোৎস্নার ‘নুলা পা’। এই বাস্তবতা ডিঙানো সম্ভব হয়নি মকনের পক্ষে। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সিরাজুদ্দিনের শেষ দৃশ্যের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া। যে হিংস্রতা নিয়ে মকন বাঘের বিরুদ্ধে লড়েছিল বাবাকে রক্ষা করার জন্য, একই ধরনের সহিংসতা আমরা দেখলাম বাবার চরিত্রে। মকনকে বাঘের চেয়েও হিংস্র হিসেবে উপস্থাপন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বিশেষ করে তার নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার কারণে।
এখানে ‘থেনাটোস’ বা ধ্বংসাত্মক মরণ-প্রবৃত্তি, ফ্রয়েডের গবেষণার অসাধারণ তত্ত্বের সফল ব্যবহার করেছেন লেখক।
পাঠক এসব চরিত্রের ভেতরের নীরব অস্থিরতা অনুভব করে – মনস্তাত্ত্বিক এই বিষয়টি আবেগের সঙ্গে জড়ানো নয়, চরিত্রের চিন্তনজগৎকে আঁকড়ে ধরে মনোজাগতিক 888sport live chat উপহার দিয়েছেন।
এই নোলক আসলে অস্তিত্বের চিহ্ন। আর নুলা পা বাস্তবতার প্রতীক।
মানুষ চলে যায়, বস্তু টিকে থাকে। এই চিরন্তন সত্যকে লেখক নান্দনিকভাবে গল্পের কাঠামোর মধ্যে তুলে এনেছেন। গল্পটি একই সঙ্গে মনস্তত্ত্ব ও দর্শনের সূত্রের সঙ্গে পেঁচিয়ে নন্দনতত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে সহজ ভাষা, 888sport sign up bonusর গভীরতম অনুভবের টান, বর্ণনার পরিমিতি ও সংযম। আর তাই গল্পের ছন্দ নিঃশব্দ সুররূপে প্রকাশিত হয়। এটাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অপূর্ব সৃজনস্বাক্ষর, অল্পকথায় গভীর ভাব প্রকাশের 888sport live chatশৈলী।
‘তিন টাকার নোট’
প্রেম ও প্রার্থনা (অন্যপ্রকাশ, ২০০৫) গল্পগ্রন্থে সংকলিত ‘তিন টাকার নোট’ গল্পটিতে বাস্তবতার ভেতর থেকে অলৌকিক প্রতীকের প্রকাশ ঘটে।
এই গল্পে তিন টাকার নোট একদিকে বাস্তব এবং অবাস্তবও, যা ‘আছে আবার নেইও’। এই নোটের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন সমাজের ভেতরে থাকা অযৌক্তিক ও বিভ্রান্ত এক বাস্তবতাকে।
চরিত্রের মধ্যে একধরনের দ্বিধা ও ভয় – যা বাস্তবতার ভেতর মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রাটের ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা দেয়। পাঠক বুঝতে পারে, মানুষ কখনো কখনো নিজের কল্পনাকেও বাস্তব ভাবতে শুরু করে। লেখক মনভুবনের এই বিষয়টা নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তার সঙ্গে দার্শনিক প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় – ‘বাস্তবতা কী?’ এ-প্রশ্নটাই গল্পের কেন্দ্র থেকে ঘূর্ণি তোলে এক মায়ার অস্তিত্ব। তিন টাকার নোটের অস্তিত্বই যেন একটা মায়া। বিষয়টি বৌদ্ধ দর্শনের ‘মায়াবাদ’-এর সঙ্গে মিলে যায়। মূলত এখানে লেখক আধুনিক সমাজের ভেতরে মানুষের বাস্তববোধ হারিয়ে যাওয়াকে উপজীব্য করে প্রতীকরূপে প্রকাশ করেছেন।
শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গেলে বলা যায়, গল্পের ছোট কাঠামোর ভেতর থেকেও জাদুবাস্তবতার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে দিয়েছেন লেখক।
অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে তিনি এমন বাস্তব ভঙ্গিতে বলেছেন যে পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এটাই তাঁর গল্পকথনের বড় ধরনের মুনশিয়ানা।
‘জলপুরুষের প্রার্থনা’
এ-গল্পটিও সংকলিত হয়েছে প্রেম ও প্রার্থনার গল্প গ্রন্থে। ‘জলপুরুষ’ আসলে মানুষ ও প্রকৃতির সীমা ভেঙে দেওয়া এক চরিত্র। তিনি যেন ‘অর্ধমানব’, ‘অর্ধপ্রকৃতি’; নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই তার নিরন্তর প্রার্থনা।
জলপুরুষের মনের ভেতর ভয়, নিঃসঙ্গতা এবং অস্তিত্ববোধের গভীর শূন্যতা বিরাজমান, যা তার মনস্তাত্ত্বিক অনুষদগুলো সহজ ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরে।
এই চরিত্রে আমরা এক নিঃসঙ্গ মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্ব দেখতে পাই।
সে কে? কোথায় তার ঘর? কী তার জীবনের উদ্দেশ্য?
এসব প্রশ্নের ভেতর থাকে চরিত্রের দার্শনিক দিকও।
গল্পই গল্পের নির্মাণকে 888sport live chatমণ্ডিত করে তোলে।
আসলে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংলাপের মধ্য দিয়ে কেবল দর্শন কিংবা মনস্তত্ত্ব নয়, শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যও নবীন লেখকের জন্য অনুকরণীয় সৃজন আলো ছড়ায়।
‘প্রার্থনা’ এখানে কেবল ধর্মীয় আবেদন নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র আকুলতা। করোনাকালে আমরা দেখেছি ‘মানুষ ও প্রকৃতি’ পরস্পরের পরিপূরক। কিন্তু মানুষই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। প্রকৃতিও তাই মানুষের প্রতি বিরূপ হয়েছে। এই তত্ত্বকে তিনি রূপকভাবে বলেছেন করোনাকালের আগেই। এটি লেখকের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান মেধার প্রমাণ বহন করে। জল, প্রার্থনা, নদী – সবই রূপান্তরিত হয়েছে তত্ত্বে, মনস্তত্ত্বে, দর্শনে, 888sport live chatকলায়। তাই ‘গল্পটি একই সঙ্গে 888sport app download apkময় ও দার্শনিক’ – কথাটা শতভাগই মেনে নেওয়া যায়।
‘বিশাল মৃত্যু’
(১৯৭৪ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত প্রথম গল্প)
গল্পের শুরুতেই নিস্তব্ধ, রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে লেখক এক নৈরাশ্যময় সমাজের প্রতীকী চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা দৃশ্যমান ও সর্বগ্রাসী শক্তি। চারপাশে ধীরে ধীরে মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ বেঁচে আছে, কিন্তু জীবনযাপনের মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। এই নিস্তব্ধতা আসলে আত্মিক মৃত্যুরই ইঙ্গিত।
গল্পের একটা প্রতীক হলো ‘ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া মৃত্যু’ শুধু একজন মানুষের নয়, এক সমাজবোধের মৃত্যুকেও বোঝায়। চরিত্ররা যে উদাসীন, ভীত, আবার কখনো আত্মরক্ষামূলক আচরণ করে তা তাদের মানসিক মৃত্যুর কথাই প্রকাশ করে। আরেকটা উদাহরণ হলো, আলো ও অন্ধকারের সংঘাত গল্পে বারবার ফিরে আসে। এখানে আলো মানে চেতনা, নৈতিকতা আর অন্ধকার মানে অবক্ষয়, মানবিক বিপর্যয়, বিলুপ্তি। লেখক যখন মৃত্যুকে ‘বিশাল’ বলেন, তখন তিনি শারীরিক মৃত্যুকে নয়, এই অন্ধকারে ডুবে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করেন। ফলে গল্পে বর্ণিত নিস্তব্ধ ঘর, আলোর ক্ষীণ ঝিলিক, মানুষের মুখে ক্লান্তি, নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া – সবই এক অস্তিত্ববাদী নিঃসঙ্গতার চিত্র হিসেবে গল্পের প্রতিটি দৃশ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। এসব প্রতীকের ভেতর দিয়েই লেখক দেখিয়েছেন, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হলো মানুষের আত্মিক অবসান, যেখানে জীবনের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস ও সৃজনশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।
চার
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প পাঠে আমরা একজন 888sport live footballের নিরলস সৃজনকর্মীকে খুঁজে পাই। তিনি বাস্তবকে অবলম্বন করে কল্পনার সীমা অতিক্রম করেন আর মানবসৃষ্ট দ্বন্দ্বকে দার্শনিক উচ্চতায় তুলে ধরেন।
তাঁর গল্পগুলো পাঠককে চমকে দেয় না বলা ঠিক হবে না। তবে নিশ্চিতভাবে ভাবিয়ে তোলে, জাগিয়ে তোলে।
গল্প কেবল বলার বিষয় নয়, গল্প এক ভাবনার অনুশীলনও – তা অনুভব করে পাঠক কিংবা লেখক ঋদ্ধ হতে পারেন।
মূলকথা হলো, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে মনস্তত্ত্ব ও দর্শনের রয়েছে অপূর্ব মেলবন্ধন, নির্মাণেও রয়েছে নন্দনশৈলী। তাঁর সৃষ্টি নিশ্চয়ই পরানে বাঁশির সুর প্রতিধ্বনিত করবে, আলোর দিশাও দেবে নতুন প্রজন্মের 888sport live footballিককে।
এই সজ্জন সৃজনশীল মানুষটির আকস্মিক চলে যাওয়া নিশ্চয়ই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জীবনদর্শনও। উত্তরপ্রজন্মের আমরা অবশ্যই তাঁর কর্মময় জীবনকে 888sport app download for android রাখব আর বিশেষভাবে মনে রাখব উপরে আলোচিত ১৯৭৩ সালে লেখা তাঁর প্রাথমিক ও গভীর ভাবসম্পন্ন ‘বিশাল মৃত্যু’ গল্পটির কথাও – মূলত এক ধরনের অস্তিত্ববাদী ও প্রতীকী এই আখ্যান পাঠে আমাদের উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে ‘মৃত্যু’ শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের, এক সমাজচেতনার, এক মানবিকবোধের মৃত্যুর প্রতীকও। এই গল্পে মৃত্যুকে আরো দেখানো হয়েছে ‘বিশাল, সর্বব্যাপী, ধীরে ধীরে গ্রাসকারী এক শক্তি হিসেবে’ – যা কেবল দেহ নয়, মানুষের মানসিকতা ও নৈতিকতাও ধ্বংস করে। গল্পের চরিত্রগুলো একদিকে বাস্তব, আবার অন্যদিকে তারা এক অন্ধকার সময়ের প্রতিনিধি, যে-সময়ে মানুষ বেঁচে থাকলেও ভেতর থেকে মরে যেতে থাকে।
‘আসলে “বিশাল মৃত্যু” মানবসভ্যতার অভ্যন্তরীণ পচন, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশের এক প্রতীকী প্রতিচিত্র।’ এই বিনাশী জীবনচক্রে বেঁচে থাকতেই আমাদের সচেতন থাকতে হবে – এটাই হোক আমাদের অনুভবে তুলে দেওয়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জীবনদর্শন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.