সাধনা আহমেদ-রচিত ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন নাটকের মূল প্রতিপাদ্য প্রেম, তবে এর পলস্নবিত রূপ মানবপ্রেমে অভিষিক্ত হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, মানবপ্রেমই নাটকটির অভিপ্রায় ও গন্তব্য। একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর মূল চরিত্র বোষ্টমি এগিয়েছে, বিন্যসত্ম হয়েছে নাটকটির ঘটনা-পরম্পরা। এতে এই বাসত্মবতা ফের হাজির হলো – মানুষের কালপরিক্রমা দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়েই ঘটে; এমনকি তার চেতনা, বিশ্বাস, শূন্যতাবোধ, অনাস্থাও এই চলিষ্ণুতার বাইরে নয়। এটা অন্তহীন এক প্রক্রিয়া, যাতে সমাজকাঠামো, জীবনধারা ও সংস্কৃতির অভ্যন্তর-দ্বন্দ্ব নিরন্তর স্পন্দমান। এটা দেখানো বোধ করি নাট্যকারের লক্ষ্য নয়, পাঠের পর প্রসঙ্গটি আপনা থেকেই এসে যায় বা গেছে।
মোটামুটিভাবে লালন ও রবীন্দ্রনাথের মাঝখানে বোষ্টমিকে রেখে নাটকটির আখ্যানবিস্তার ঘটেছে। ফলে, এটা ধরে নেওয়া অসংগত নয় যে, নাট্যকার কাছাকাছি দুটি সময়ের যোগসাধনের জন্য বেছে নিয়েছেন বোষ্টমিকে এবং বাসত্মবিক, যে-কোনো জাতির সামাজিক ইতিহাসে এমন সন্ধিচরিত্র আসে। বোষ্টমি কেবল একটা চরিত্র নয়, বিশেষ একসময়ের রূপক এবং একটা ট্রানজিশনের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রসারিত অর্থে একটা আইডিয়া, নাট্যকার যা সংগ্রহ করেছেন শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের জমিদারিকালীন জীবন থেকে, যখন জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল ধর্ম ও দেবানুগত্য, অপবিশ্বাসে আতমসমর্পণই ছিল সমাজের নিয়তি। মানুষের বিকাশের প্রতিকূল এই অচলায়তনের প্রতিক্রিয়া থেকে লালনের মানবতাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটেছিল, পরবর্তীকালে যা রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আশ্রয় পেয়েছে – তথ্য হিসেবে এটা যথেষ্ট পুরনো হলেও ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন তাতে সঞ্চার করেছে নতুন ও বহুমুখী অর্থ, সৌন্দর্য, তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা। অধিকন্তু, এতে লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যা কেবল বাংলার সামাজিক ইতিহাস ব্যাখ্যার পরিসর গড়ে দেয় না, অতীতের পটভূমিতে সমকালীন বাসত্মবতা সম্পর্কে মূল্যায়নের সূত্রটিও তৈরি করে। তদুপরি, একটা সত্যও নতুন করে হাজির হয়ে যায় – পুরুষতন্ত্রের বাহক হিসেবে ধর্ম এবং এর কলকব্জাগুলো এই জনপদের 888sport promo codeর ওপর বহু আগে থেকেই চেপে বসে আছে।
নাটকটির কাহিনি প্রথাগত ছকে বিধৃত নয়। শুরু হয়েছে মোটামুটি মাঝখান থেকে, যখন দেখানো হচ্ছে একদল নর-888sport promo code চলেছে, তাতে রয়েছে প্রধান দুই চরিত্র খ্যাপা ও বোষ্টমি। এদের কথোপকথনেই বোঝা যায় এরা বিশেষ এক জীবনাগ্রহ ও সংস্কৃতির বাসিন্দা, মরমি চেতনাই এর চালিকাশক্তি। খ্যাপা এর ধারক, বোষ্টমি বাহক।
‘বোষ্টমি – ছি-ছি-ছি খ্যাপা – তোমার জ্ঞানবুদ্ধি আর কখনো হবে না দেখছি। এই যে এত লেখাপড়া করে মানুষের মতিগতি ঠিক করতে রাতদিন খেটে মরে। তার কানাকড়ি বোঝার জ্ঞানগম্যি তোমার আছে?
খ্যাপা – তার এসব ছাইপাঁশ লেখাপড়া হচ্ছে বুদ্ধির বেগার খাটুনি। এই লেখাপড়া দিয়ে বড়জোর খেতে-পরতে পাওয়া যায়। মানুষের মতিগতি ঠিক করতে তা কোনো কাজে আসে না। তাই তো আসল মানুষ কেউ তার আঙিনাটিও মাড়ায় না। আর বাঁচার জন্য তুমি নিজে তো খাও ভিক্ষে করে – তবে খামোকা তার কাছে ঘুরে মরে কেন?’
তবে বোষ্টমির এই অবস্থান মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর ধর্মের বিধিবিধানের শিকার এক 888sport promo codeর রূপান্তর কিংবা পরিণতি। কাহিনি প্রচলিত ছকে বিন্যসত্ম হলে সে কেন বেছে নিয়েছে বোষ্টমির জীবন – তা জানা যেত নাটকের শুরুতেই। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি; নাট্যকার প্রথমে সহজিয়াদের জীবনধারা সম্পর্কে পাঠক-দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তাঁদের প্রস্ত্তত করেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের গলদগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য। আনন্দি নামে এক মেয়ের বোষ্টমিতে রূপান্তরের যে-ডিসকোর্স, তাতেই কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। তা এই – সে ছিল প্রাণবন্ত এক কিশোরী, ওই অবস্থাতেই তার বিয়ে হয় – এবং একটা শিশুর জন্ম দেয়। কিন্তু কৈশোরের স্বভাবজাত দুরন্তপনা সে এড়াতে পারে না, যাত্রাপালা দেখা থেকে দিঘিতে সাঁতার – সবই চলতে থাকে। একদিন আনন্দীর সামনেই শিশুটির সলিলসমাধি ঘটে। সেই শোক কটিয়ে ওঠার জন্য তার স্বামী কাশী থেকে ধর্মগুরু নিয়ে আসে। আনন্দির মন শান্ত হয়, গুরুর প্রতি সে 888sport apk download apk latest version পোষণ ও প্রকাশ
করতে থাকে। কিন্তু এই ব্যক্তি তার প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়ে এবং মন্ত্রশেvকের মাধ্যমে তাকে ভোগ করার ইচছা প্রকাশ করলে আননিদ তা এড়িয়ে যায়। অধিকন্তু, তার স্বামী চায় সে ধর্মগুরুর কাছে নিজের শরীর সমর্পণ করুক। কেননা, তাতে স্বামীর পুণ্যলাভ হবে এবং পতির স্বর্গ নিশ্চিত করাই সতীর ধর্ম। এ-কথায় আনন্দি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, বলে – ‘জগতের সকল সতীই কি বেশ্যা তবে?’ … বেশ্যা হতে চায়নি বলে সে কেবল সংসার ত্যাগ করেনি, বর্জন করেছে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, দেবালয় এবং এর বিধিবিধান।
পিকারেস্ক-প্রস্তাবিত কাহিনি888sport live footballে আমরা দেখেছি, বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের পথে সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায় এবং একপর্যায়ে সে আউটকাস্ট হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিড়ম্বিতরা আত্মহত্যা করে, নয়তো নিরুদ্দেশ হয়। 888sport promo code হলে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করে। এই নাটকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণে আনন্দির সংগ্রাম আছে, সমষ্টির সঙ্গে দ্বন্দ্বও আছে। যদিও এই অবস্থায় তাকে পূর্ণমাত্রায় ব্যক্তি হিসেবে দেখা মুশকিল। তাতে সমস্যার কিছু ঘটেনি। কেননা, সে হয়ে উঠেছে বাংলা তথা এই উপমহাদেশের (পৃথিবীর 888sport app অনগ্রসর জনসমাজেরও বটে) 888sport promo codeর রূপক;
যে স্বামী ও ধর্মগুরুর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব – তারা হয়ে গেছে পুরুষতন্ত্রের রূপক; আর ধর্মীয় বিধিবিধান হয়ে এসেছে গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর রূপক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আনন্দি কি আউটকাস্ট হয়ে গেছে? বোষ্টমি তো আনন্দি নয়, তার আগের পরিচয় কিংবা জীবন মাত্র। আত্মপরিচয় সে যে বিসর্জন দিয়েছে, তাতে কী বলে তাকে চিহ্নিত করতে পারি? নাটকের শুরুতেই দেখা যায় সে ‘মনের মানুষ’ খুঁজছে। আসলে সে খুঁজছে মানুষ, সেখান থেকেই তার কাম্য মনের মানুষ। এই আকাঙ্ক্ষা ও সাধনাই তাকে জাতসংসারের সংকীর্ণ পরিচয় থেকে বিশ্বমানবের মহাপরিচয়ে উদ্বোধিত করেছে। ফলে, পিকারেস্ক-নির্দেশিত আউটকাস্ট তাকে বলা গেলেও সে বৃহত্তর মানবসমাজ এবং এ-সংক্রান্ত ভাবনার অংশ হয়ে উঠেছে। এ-বিবেচনাও প্রাসঙ্গিক – জাতসংসার থেকে এই বেরিয়ে আসার ধরনটি বিদ্রোহাত্মক, বোষ্টমির রূপে সেটা শমিত দেখালেও ধর্ম, মানুষ, দেবালয়, প্রেম, পাপ ইত্যাদি সম্পর্কে যে-চিন্তা তার সংলাপে লক্ষণীয়, তাতে তার অভেদব্যঞ্জক জীবনাগ্রহ স্পষ্ট। পিকারেস্ক-কথিত আউটকাস্ট এই লক্ষণের বাইরে।
আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রোমান্টিসিজম নামে যে চেতনাবদল ঘটেছিল ইউরোপে, তা ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধানের চেয়ে জীবনকে বড় করে দেখার পরিসর গড়ে দিয়েছিল; ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা ও উপলব্ধির গুরুত্ব তাতে স্বীকৃত হয়েছিল। দেবতার ধারণায় অনাস্থা প্রকাশ পেতে থাকে তখন থেকে, কল্পিত বিধাতার জায়গায় মানুষের আরাধ্য হয়ে উঠেছিল প্রকৃতি। প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাকে অবিরল আঘাত, প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামো বর্জন, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের প্রয়াস, কাম্য মানুষের মধ্যে পৃথিবী, বিধাতা, নিজেকে সন্ধানের সাধনা ইত্যাদি রোমান্টিসিজমের অনিবার্য লক্ষণ। ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন নাটকের বোষ্টমি আগাগোড়া রোমান্টিক। সে ত্যাগ করেছে সংসারের মতো নিশ্চিত আশ্রয়স্থল, বর্জন করেছে প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামো ও ধর্মব্যবস্থা। এর আগে সে প্রশ্ন তুলেছে, প্রতিবাদও করেছে।
‘আনন্দি – শুধুই তোমার পাপপুণ্য? সংসারে আমার তবে কিছু নেই?
স্বামী – পতির পুণ্য সতীর পুণ্য। এটাই সংসারের সারকথা।
আনন্দি – যেদিন মাতৃহারা কন্যাকে সজল চক্ষে পিতা সঁপেছিলেন স্বামীর হাতে – সেদিন কন্যার কানে কানে বলেছিলেন – মা গো – আজ থেকে তিনিই তোর সব। পিতারও অধিক – দেবতারও দেবতা পতিপরমেশ্বর। সেই থেকে আমার কানে দিন-রাত বেজেছে – দেবতারও দেবতা – পতিপরমেশ্বর। সেই পরমেশ্বর আজ আমাকে বেচে দেয় নিজ পুণ্যলোভে! কোথায় তবে দেবতা? কোথায় তবে প্রেম? হায় প্রেম নয়, ভক্তি নয় – শুধুই মিথ্যার মন্ত্রে বাঁধা তবে সংসার ! শুধুই স্বামীর পাপ-পুণ্যের ভার বহন করা? সংসারে তবে আমার কোনো স্থান নেই – কোনো কর্ম নেই।
স্বামী – থাকবে না কেন? এসবই তো তোমার। বিষয়-সম্পত্তি ঘর-দুয়ার সবকিছুকে আগলে রাখবে। গুরুকে খুশি রাখবে। এই তো তোমার কর্ম। এই কর্মে পরকালে আমার স্বর্গবাস নিশ্চিত।
আনন্দি – সতীর পাপের বিনিময়ে হবে পতির পুণ্যলাভ! জগতের সকল সতী কি বেশ্যা তবে?’
তবে বোষ্টমির রোমান্টিক জীবনাগ্রহ একটু আলাদা, কেননা সে প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামো ও ধর্মব্যবস্থা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার পরও সেই বিধিবিধানের অন্তর্গত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে যায়, তাদের দান গ্রহণ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের নিগ্রহের শিকার হয় এবং জমিদাররূপী রবীন্দ্রনাথের কুঠিতে আশ্রয় নেয়। পরিণতিটি খুব ইঙ্গিতবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা দেখে এসেছি, রোমান্টিকের জীবন অব্যবস্থিত, মরমি চেতনাই তার ব্যবস্থিত হওয়ার জায়গা, শেষ আশ্রয়। এই নাটকে দেখি, খ্যাপার মরমি চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে জমিদাররূপী রবীন্দ্রনাথে আর নিগৃহীত বোষ্টমি আশ্রয় নিয়েছে তার কাছেই। কিন্তু আশ্রয়দাতা ত্যাগ করেনি প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামো, তার দরকারও হয়নি; আধা-সামন্ত আর আধা-বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে তার শারীরিক বসবাস, মনে সে বাউল, বোষ্টমির মতো তার পথে বের না হওয়ার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ক্লাসিক নিবৃত্তিধর্মী সত্তার প্রকাশ এবং এর অনুকূলে একটা যুক্তিও সে তৈরি করেছে – তার একেকটি ‘আমি’ অখ- ‘আমি’র খ- রূপ। এই মেটাফিজিক্স প্রাচ্যের অভেদাত্মক মরমি চিন্তার
প্রতিনিধিত্ব করলেও শেষ পর্যন্ত নাটকের মর্মে রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির কম্পনই বেশি টের পাওয়া যায়। অধিকন্তু এতে ঘটেছে উনিশ শতক ও বিংশ শতাব্দীর বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন, বাংলার প্রধান দুই ব্যক্তির সম্পর্ক ও উভয়ের উপলব্ধির পুনর্ব্যাখ্যা এবং রবীন্দ্রসৃষ্ট বোষ্টমি চরিত্রের নতুন এক উপস্থাপনা। উল্লেখ বাহুল্য নয়, মিথ ও ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন রোমান্টিকের অনিবার্য ও প্রধান একটি লক্ষণ, যা ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন নাটকে চেষ্টাহীনভাবে ঘটেছে।
সাধনা আহমেদ-সৃষ্ট বোষ্টমি চরিত্রটি রোমান্টিক – এই বিবেচনায় আপত্তি উঠতে পারে এদিক থেকে যে, লালনের জাতভেদহীন বিশ্বমানব দর্শনের পথে সে পা বাড়িয়েছে এবং এর প্রণালিপদ্ধতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে রোমান্টিসিজমের বিরোধ রয়েছে। কিন্তু সমগ্র নাটকে ব্যক্তি হিসেবে যে-লালনকে দেখা যায়, সেও রোমান্টিক। ধর্ম, দেবালয়, সংসার এমনকি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি রোমান্টিক চেতনার সাক্ষ্য দেয়। ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন নাট্যের কৃতিত্ব কেবল এই লালনকে নতুন করে দেখানো নয়, তার সঙ্গে বিদ্রোহী বোষ্টমি ও নিবৃত্তিধর্মী রবীন্দ্রনাথকে যুক্ত করে এমন এক সমন্বয়ধর্মী চিন্তনবিশ্ব গড়ে তোলা, যাতে দেবতা নয়, মানুষই প্রকৃত আরাধ্য হয়ে ওঠে। এই মানুষ জাতধর্মভেদ থেকে মুক্ত।
দেখা যাচ্ছে, ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন ধারণ করেছে রোমান্টিক সংবেদনশীলতা; কিন্তু এর প্রকরণ ও মর্মে আধুনিক চেতনার প্রকাশও লক্ষযোগ্য। ব্যক্তির নিজস্ব চেতনার আশ্রয় নিয়ে 888sport live footballের প্রচলিত ছক ভেঙে নতুন আঙ্গিক ও বোধ সৃষ্টিই আধুনিকতার মূলকথা। এর মর্মে রয়েছে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ।
‘বেণি – তুই হিন্দু না মুসলমান? জবাব দে – জবাব দে –
সবাই – জবাব দে বলছি – চুপ করে থাকবি না, জবাব দে …
বোষ্টমি – হিন্দু-মুসলমানের কথা জানি না গো দাদা। মানুষের কাছে ভিক্ষা করে খাই। মানুষের ধর্মই আমার ধর্ম। মানুষের মাঝে খুঁজে বেড়াই মনের মানুষ। যেদিন তার দেখা পাব, সেদিনই ভগবানের সঙ্গে আমার মিলন।’
আগেই বলা হয়েছে, রোমান্টিক চেতনার সঙ্গে মরমি চিন্তার বিরোধ রয়েছে; আর আধুনিক সংবেদনশীলতার অবস্থান উভয়ের বিপ্রতীপে। আধুনিকের কাজ বিপর্যয় দেখানো, তাতে সারল্য ও একরৈখিকতার স্থান নেই। ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন বাঙালির ইতিহাসের একটা পর্বে সামাজিক বিপর্যয়কে নির্দেশ করছে, ব্যক্তির বিপর্যয়ও তাতে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠছে। এই ক্যাটাস্ট্রফি বানানো কিছু নয়, এটা ইতিহাসের একটা বাসত্মবতা, একটা ট্রানজিশন বা সন্ধিসময়, যখন সামন্ত সমাজের ক্ষয় হচ্ছে, বুর্জোয়া শ্রেণির প্রাদুর্ভাব ঘটছে এবং মধ্যবিত্তের জন্ম হচ্ছে। সমাজের পুরনো ধ্যানধারণা, ধর্মীয় বিধিবিধান এসময় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, ব্যক্তির মুক্তি কাম্য হয়ে ওঠে। নাটকটিতে, বিশেষত আনন্দি ও বোষ্টমির জীবন-রূপায়ণে এই চিত্র সুস্পষ্ট। এমন এক থিসিস এখানে তৈরি হয়েছে, যা জানিয়ে দেয় – ধর্মীয় সংস্কারসর্বস্ব সমাজে ব্যক্তি ও মানুষের মুক্তি নেই। এটি প্রকাশ করতে গিয়ে নাট্যকার প্রচলিত নাট্যরীতির দ্বারস্থ হননি; বরং তা নস্যাৎ করেছেন। দৃশ্যনির্দেশ, অংকবিন্যাস, মঞ্চসজ্জা, আলো ও শব্দের ব্যবহার, পোশাক ইত্যাদি বিষয় অগ্রাহ্য হয়েছে এ-রচনায়। বয়ানই হয়ে উঠেছে মুখ্য এবং এতে চরিত্র-কথক-লেখকের মধ্যে আসা-যাওয়া অনুভব করা গেছে। নাট্য888sport live footballে বর্ণনাত্মক এই রীতি সেলিম আল দীনের উদ্ভাবন হলেও সাধনা আহমেদ তাতে যুক্ত করেছেন নতুন এক প্রান্ত, যেখানে চরিত্রগুলোর সাংলাপিক স্বাধীনতা রয়েছে। লেখকের বয়ান চরিত্রগুলোর ওপর যে চেপে বসেনি – তা প্রতিভাত হয়েছে। উপলব্ধির সূক্ষ্মতা ও প্রকাশের জটিলতা আধুনিকতার আরেকটি অনিবার্য শর্ত। এই অনিবার্যতার কারণ বিচিত্রমুখী চিন্তা ও পরস্পরবিরোধী প্রত্যয়গুলোর সমন্বয় ও সংশেস্নষণ। ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন নাটকে আধুনিকতার এই শর্তও মান্য হয়েছে। কেননা, এতে একই সঙ্গে রোমান্টিসিজম, মিস্টিসিজম, প্রতীকবাদ, মেটাফিজিক্স, মানবতাবাদ, কার্যকারণ তত্ত্ব, বাসত্মবতাবাদ, উপযোগবাদ, 888sport promo codeবাদ – এইসব বিচিত্র ও পরস্পরবিরোধী প্রত্যয়ের সমন্বয় ও সংশেস্নষণ ঘটেছে। আবহমান বাংলার লোকজীবনের পটভূমিতে নাটকটির আখ্যান সৃষ্টি করা হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে এর বর্ণনা সরল; কিন্তু ব্যাখ্যায় এটি যে আলোচককে জটিলতার সম্মুখীন করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন কি উত্তরাধুনিক প্রত্যয়কেও ধারণ করে? ইহাব হাসান আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের যে প্যারাডাইম প্রণয়ন করেছেন, তার প্রায় প্রতিটিই মিলে যায় এই রচনার সঙ্গে। একদিকে এই রচনা কাঠামোকে স্বীকার করছে, অন্যদিকে প্রত্যাখ্যানও করছে; ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরনের উন্মুক্ততা – যাতে গ্রাহ্য হচ্ছে উপযোগ ও ক্রীড়াময়তার সহাবস্থান, সম্পন্ন কাজের সঙ্গে দ্রষ্টব্য হচ্ছে প্রক্রিয়া ও পারফরম্যান্স, দূরত্বের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে অংশগ্রহণ, আর বিনির্মাণ তো বটেই; অধিকন্তু অ্যান্টিথিসিস, আকাঙ্ক্ষা, আলংকারিকতা এ-রচনার উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্যবাচক অংশ হয়ে আছে। বোষ্টমি যে ‘মনের মানুষ’ খুঁজছে, উত্তরাধুনিকতাবাদী প্রেক্ষণবিন্দু থেকে বলা যায়, এই সন্ধান সত্তার অনুপস্থিতিজনিত।
‘খ্যাপা – মনের মানুষকে পেলে সখি?
বোষ্টমি – পাবো – একদিন ঠিক তার দেখা পাবো। খুঁজতে খুঁজতে যেদিন একবারে ডুবে যাবো – সেদিন তার দেখা পাবো।’
নাটকটির প্রতিপাদ্য জীবন, অনুষঙ্গ ও আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিতভাবেই উত্তরাধুনিক। তবে সবচেয়ে বড় কথা, যে-বর্গ কিংবা সীমানা আধুনিকতাবাদে পরিস্ফুট, তার বিপ্রতীপে এতে মান্য হয়েছে টেক্সট, ইন্টারটেক্সট এবং কাউন্টার টেক্সটের অনির্ণেয় ও আপেক্ষিক সম্ভাবনা।
নাটকের ‘কথামুখে’ সাধনা আহমেদ লিখেছেন,
ধর্ম কি শুধুই প্রাতিষ্ঠানিকতা? যদি প্রাতিষ্ঠানিকতাই ধর্ম হয় – তবে বিশ্বজুড়ে যে এত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম – ধর্মালয় – সেগুলো মানুষকে কতটা মানবিক করতে পেরেছে? … মানুষের অন্তর্গত মুক্তি কোথায়? ধর্মের নামে যে সমূহ অধর্ম চলছে তারই-বা কোথায় সমাপ্তি? এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণেরই অপর নাম ‘ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’। সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্গত বাউল রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করার চেষ্টা।
বলা বাহুল্য নয়, এসব ছাড়িয়ে রচনাটি এমন এক নীরবতায় পৌঁছেছে, যেখানে মানুষই মহাসত্য, অন্যসবই প্রপঞ্চ কিংবা বানানো, যেগুলোয় নিজেরাই অযথা প্রাণপাত করে চলেছে।
বাংলা নাটকে সাধারণত কিছু চরিত্র ও দৃশ্যপ্রবাহের মিশেলে সমাজবাসত্মবতা কিংবা এর অংশবিশেষ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন এর কেবল বাইরে নয়; আইডিয়া, প্রতিপাদ্য, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রস্তাবনা, অভিপ্রায়, প্রকাশরীতি – সবদিক থেকে এটি স্বতন্ত্র এবং এই ধরনের রচনা বাংলা 888sport live footballে সম্ভবত নেই। নানা দিক থেকে এটা বলা যায়। যেমন, শুরুতেই বলা হয়েছিল এর প্রতিপাদ্য প্রেম, তবে অভিপ্রায় মানবপ্রেম; কিন্তু এই বিন্দু ও গন্তব্যকে নানা জিজ্ঞাসা ও বিষয়চূর্ণে সংশেস্নষণের মধ্য দিয়ে এক মহাজিজ্ঞাসার সমগ্রতায় উপনীত করা হয়েছে। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের বিশেষ এক পর্বের বিনির্মাণ ও পুনর্মূল্যায়নের পথ ধরে যে-বিষয়ে সাধনা আহমেদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, 888sport apps ও বিশ্বের সমকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাসত্মবতায় তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় ভেদাভেদ ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি না ঘটলে মানুষের বিকাশ দূর-কল্পনা মাত্র, এই বার্তা নতুন করে নানা মাত্রায় নাটকটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.