মঙ্গলে কলাবাগানের শিমু

আনিসুল হক

আবদুল জব্বার বললেন, ‘মা, মঙ্গলগ্রহে যে পানি নাই, এটা কিন্তু তোর মাকে বলার দরকার নাই।’
শিমু ডাইনিং রুমের টেবিলে রাখা প্লাস্টিকের জগ থেকে মগে পানি ঢেলে খাচ্ছিল। আবদুল জব্বার সেই টেবিলে ছড়িয়ে রাখা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তার চোখে চশমা, নাকের দিকে নামানো। তাঁর চশমার ফ্রেমটা মোটা আর কালো। রিডিং গ্লাস। রিডিং গ্লাসের ফ্রেম সাধারণত মোটা আর কালো হয় না। আবদুল জব্বার বলেন, রিমলেস চশমা ভেঙে যায়। সেজন্য তিনি শক্তপোক্ত দেখে নিয়েছেন।
শিমু বলল, ‘বাবা, মঙ্গলে পানি আছে।’
আবদুল জব্বার বললেন, ‘সেটা তো মাটির নিচে। কয়েক ফুট গভীরে। বরফ হয়ে আছে। সেই পানি বের করে নিয়ে খেতে হবে। তাই না? আবার মঙ্গলে তো মাটিও নাই। যা আছে তা শিলা! তাই না?’
শিমু হাসল। প্রসন্ন হাসি। তবু সেটা ম্লান দেখাচ্ছে।
কলাবাগানের চারতলা বাড়ির দোতলা। আবদুল জব্বার ধানম-ি বয়েজ স্কুলের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। অনেক আগেই তিনি রিটায়ার করেছেন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সাবিনা আক্তার। ডাকনাম শিমু। ছোট মেয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকে। নাম শাহিদা আক্তার মিমু। সে মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিয়ান। তার স্বামী ভূগোলবিদ, সেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ায়। দুটো বাচ্চা আছে। ‘ভালো আছে, মাশাল্লাহ!’
বিড়বিড় করেন আবদুল জব্বার সাহেব।
বড় মেয়েটাকে নিয়েই এখন তাঁর চিন্তা।
তাঁর বড় মেয়ে সাবিনা আক্তার শিমু নিজে বিখ্যাত হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার অবসরপ্রাপ্ত মাস্টার পিতাকেও বিখ্যাত করে ফেলেছে। তার গৃহিণী মাও এখন বিখ্যাত। শুধু বিখ্যাত বললে ভুল বলা হবে, বিশ্ববিখ্যাত।
সমস্ত পৃথিবী থেকে মাত্র চারজন চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছে প্রথমবারের মতো মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য। দুজন ছেলে, দুজন মেয়ে। শিমু তাদের একজন।
কয়েক মাস পরে তারা যাত্রা করবে। ওয়ানওয়ে জার্নি। পৃথিবী ছেড়ে তারা রওনা দেবে, আর ফিরে আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। উদ্যোক্তাদের সে-ধরনের কোনো ইচ্ছাও নেই।
আবদুল জব্বার সাহেব তা জানেন। তা সত্ত্বেও বললেন, ‘মা, সবাই বলছে, জার্নিটা ওয়ানওয়ে! কথাটা তো সত্য নয়, তাই না মা?’
শিমু তার বাবার দিকে তাকাল।
বাবার সামনে একটা কাগজ মেলে ধরা। পেছনের জানালা দিয়ে আলো আসছে। নীল রঙের পর্দা সরিয়ে রাখা। বাসার পেছনে আমগাছের পাতা বৃষ্টিস্নাত, সবুজ। আলো এসে পড়েছে বাবার পেছনে, চুলের পাশটাকে সেই আলো দিয়েছে রুপালি রেখার রূপ। বাইরে কাক ডাকছে, রিকশার ক্রিংক্রিং, গাড়ির হর্নের শব্দ, ফেরিওয়ালার চিৎকার, শব্দের কোনো বিরাম নেই। বিশ বছর পর দেশে এসে শিমুর কাছে 888sport appকে খুব কোলাহলময় বলে মনে হচ্ছে। আমেরিকা খুবই নীরব একটা দেশ। রাস্তাঘাটের গাড়িও শব্দ করে না। কেউই হর্ন বাজায় না। কেউ চিৎকার করে কথাও বলে না। ওখানে ঝিঁঝির ডাক অনেক জোরে শোনা যায়। এমনকি পেটের মধ্যে গুড়গুড় করলেও চমকে উঠতে হয়, আশপাশের লোকজন সেটা শুনতে পাবে না তো!
শিমু বলল, ‘জি বাবা। কথা সত্য। আমাদের জার্নিটা হবে ওয়ানওয়ে।’
‘তাহলে এরপর তোর সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না?’
‘হতেও পারে। নাও পারে।’
‘হতেও পারে?’ বাবার মুখে একটা প্রশান্ত আলো যেন ফুটে উঠল, আশার আলো। তিনি বললেন, ‘হতেও পারে নাকি! তুই তাহলে আবার আসবি?’
‘আমিও আসতে পারি। তুমিও যেতে পারো। বলা যায় কিছু?’
‘আমি আবার যাব কী করে?’
‘তুমি দেখো নাই? নতুন একটা তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন তো ধরো মঙ্গলগ্রহে যেতে লাগবে দুইশো সত্তর দিন। কমসে কম। নতুন এই পদ্ধতিতে মাত্র আধঘণ্টায় মঙ্গলগ্রহে পৌঁছানো যাবে।’
‘কী বলিস। মঙ্গলগ্রহ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব না সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার?’ বাবা চশমা হাতে নিয়ে বললেন।
‘কমপক্ষে। মঙ্গল যখন পৃথিবীর কাছে থাকে, এটা তখনকার হিসাব।’
‘সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার যাওয়া যাবে আধা ঘণ্টায়? কী বলিস।’
‘হ্যাঁ। একজন 888sport apkী সেই থিয়োরি দিয়েছেন।’
‘আমরা আসাদগেট থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এক মাইল দূরত্ব এক ঘণ্টায় যেতে পারি না। আর তোরা আধা ঘণ্টায় সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিবি? পাগল নাকি?’
শিমু হাসল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘888sport apkীরা একটু পাগলই হয় বাবা। ধরো, ত্রিশ বছর আগে, আমি যখন 888sport appয় ছিলাম, তখন যদি কেউ বলত, এই দেশে একদিন সবার হাতে হাতে ফোন থাকবে, আর লোকে সেই ফোনটা নিয়েই ঘরের বাইরে যেতে পারবে, সেই ফোনটা নিয়েই রংপুরে, ময়মনসিংহে, কক্সবাজারে যেতে পারবে, তখন তুমি আর আমি তাকে পাগল বলতাম। তাই না? কিন্তু এটা তো এখন হয়েছে, না! সবার হাতে ফোন। আবার সেই ফোনে কথা বলাই শুধু যায় না, ভিডিও কলও করা যায়। এটা দেখে তুমি আশ্চর্য হচ্ছো না!’
‘ঠিক বলেছিস। একটা ল্যান্ডফোন পাবার জন্য আগে কত তদ্বির করতে হতো। কত ধরনা দিতে হতো। আবার একটা কল করার জন্য কী কষ্ট। পাশের বাড়িতে যেতে হতো। বা রাস্তার ধারের দোকানে। পাঁচ টাকা দিয়ে একটা কল করা যেত। আর এখন। এই দেশে সবার হাতে ফোন।’
‘তাহলে বোঝো! 888sport apkীরা আজকে যা ভাবেন, কালকে তো তাই হয়ে যাচ্ছে। কাজেই কে জানে, আধঘণ্টায় মঙ্গলে যাওয়ার স্বপ্নটাও হয়তো একদিন সত্য হবে। তখন আমার বাবা হিসেবে তুমি মঙ্গলে যাবে। গিয়ে আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে দিন সাতেক পরে আবার চলে আসবে। আধা ঘণ্টার ব্যাপারই তো মাত্র।’
আবদুল জব্বার সাহেব উত্তেজিত বোধ করলেন।
তিনি পামটপ অন করতে গেলেন নিজের ঘরে। পামটপে ইন্টারনেটের সংযোগ আছে। তিনি ও তাঁর স্ত্রী এই পামটপ দিয়ে তার প্রবাসী দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। ভিডিও কল। কথাও বলা যায়, সরাসরি ছবিও দেখা যায়।
আবদুল জব্বার সাহেবের স্ত্রী লায়লা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত। তাঁর মেয়ের জন্য তিনি ভালোমন্দ রাঁধছেন। ছোটবেলায় মেয়ে খুব পছন্দ করত চিংড়ির মালাইকাড়ি। তিনি সেটা রাঁধছেন। নারকেল দিয়ে রাঁধতে হবে। নারকেলের গুঁড়া রেডিমেড কিনে আনা হয়েছে। বাসার উলটোদিকে ময়ূরী নামের সুপার মলেই পাওয়া যায়।
আবদুল জব্বার সাহেব ইন্টারনেটে সার্চ করলেন। আধা ঘণ্টায় মঙ্গলযাত্রা। মারস ইন থার্টি মিনিটস। অনেকগুলো আর্টিক্যাল পেলেন তিনি এই বিষয়ে। বলা হচ্ছে, মঙ্গলে যাওয়ার জন্য এখন যে রাসায়নিক ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, তার বদলে যদি লেজার ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা আলোর গতির চার ভাগের এক ভাগ গতি অর্জন করতে পারে। এক সেকেন্ডে ৪৫ হাজার মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ২৬০ দিন নয়, ৩০ দিন, এমনকি ৩০ মিনিটেও মঙ্গলে পৌঁছানো সম্ভব। মুশকিল হলো, এই যন্ত্র থামানোর কোনো উপায় এখনো ভাবা যায়নি।
আবদুল জব্বার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এটা একটা কল্পনামাত্র। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।
তিনি পামটপ হাতে নিয়েই মেয়ের ঘরের সামনে গেলেন। মেয়েও ইন্টারনেটে বসে আছে। তার সামনে ল্যাপটপ। বিছানায় হেলান দিয়ে আধাবসা হয়ে হাঁটুতে ল্যাপটপ রেখে সে একটা কিছু করছে। এই ল্যাপটপ সে এনেছে আমেরিকা থেকে। এটা নাসা তাকে দিয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী এই কম্পিউটার। আর গোপন তথ্যে ঠাসা। এটা নিয়েই শিমু মঙ্গলগ্রহে যাত্রা করবে। এটা এই বাসার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। নিচে পুলিশি প্রহরা থাকার পরেও আবদুল জব্বার সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন, আবার চুরিটুরি হয়ে যাবে না তো। হলে দেশের অপমান। আর মেয়ের অসুবিধা!
জব্বার সাহেব বললেন, ‘এটা তো বাস্তবে সম্ভব নয়।’
‘কোনটা বাবা?’ মেয়ে ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল।
‘আধা ঘণ্টায় মঙ্গলগ্রহে যাওয়া?’
‘কেন সম্ভব নয় বাবা?’
‘এটা বাস্তবায়িত করতে হলে আলোর গতিতে যেতে হবে। আলোর গতিতে কোনো কিছু গেলে তা আর বস্তু থাকবে না। কণা থাকবে না। তরঙ্গ হয়ে যাবে। মানুষ যদি ওই গতিতে যেতে পারে, তাহলে তো মানুষ টাইমমেশিনই আবিষ্কার করে ফেলতে পারবে।’
‘বাবা, তুমি তো বাংলার শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk, জীবনানন্দ দাশের 888sport app download apk পড়াও। তুমি এত জানলে কী করে?’
‘তুই মঙ্গলে যাবি, শোনার পর থেকেই আমার 888sport apkে আগ্রহ হয়েছে মা। আমি ইন্টারনেটে বসে বসে নানা কিছু পড়ি।’
‘বাবা, তাহলে তুমি বলো, জীবনানন্দ দাশ যে লিখেছেন, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে। তিনি কী করে হাজার বছর ধরে হাঁটলেন?’
‘ওটা তো 888sport app download apk মা। 888sport app download apkয় তো আমরা যে-কোনো জায়গায় এক মুহূর্তে যেতে পারি। কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। মনে মনে।’
‘888sport apkীরাও তো মনে মনেই চলেছেন; কিন্তু তোমাকে বললাম না, ১৯৯০ সালে যদি কেউ বলত যে, 888sport appsের মানুষের হাতে হাতে এমন ফোন থাকবে, যা নিয়ে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে, যাতে কিনা ভিডিও কল করা যাবে, সেটাকে লোকে বলত গাঁজাখুরি গল্প। প্রথম যখন মোবাইল ফোন এলো এই দেশে, লাখ টাকা দাম ছিল, ফোন করতে অনেক টাকা বিল হতো, ইনকামিং কলের জন্য পয়সা দিতে হতো, সেখান থেকে আজকে প্রত্যেকটা মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। স্মার্ট ফোন। আজ যা কল্পনা, কাল তা বাস্তবতা। একজন 888sport apkী যখন স্বপ্ন দেখছেন, আরেক 888sport apkী সেটা বানিয়ে ছাড়তে পারেন। তখন কিন্তু আধা ঘণ্টায় মঙ্গলে যাওয়া যাবে, বাবা। আর আধা ঘণ্টায় না হয়ে যদি ব্যাপারটা তিনদিনে হয়, তাহলেই বা খারাপ কী। এখনো তো 888sport appsের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে তিনদিন লেগে যেতে পারে।’
বাবা বললেন, ‘তা লাগতে পারে। ঘন কুয়াশার জন্য ফেরি চলে না, লঞ্চ চলে না, এখন তুই সিলেট থেকে রওনা দিয়ে সুন্দরবন পৌঁছাতে চাইলে তো এমনিতেই তিনদিন লেগে যেতে পারে।’
‘তাহলে বাবা মঙ্গলগ্রহে যদি তিনদিনে পৌঁছানো যায়, তোমার চলবে তো?’
‘খুব চলবে, মা। কিন্তু টিকিটের দাম বেশি হয়ে যাবে না? আমি কি সেটা এফোর্ড করতে পারব?’
‘তোমাকে তো ফ্রি নিয়ে যাবে। তুমি আমার বাবা না? পৃথিবীর প্রথম যে-চারজন মানুষ মঙ্গলে যাচ্ছে, তাদের একজনের বাবা তুমি। তোমার কাছেও যদি ওরা টিকিটের দাম নেয়!’
‘কিন্তু আমি কি পারব মা? আমি তো সায়েন্স বুঝি না। আবার আমার তো উচ্চতাভীতি আছে। উঁচু জায়গায় উঠতে ভয় পাই। প্লেনে উঠে তো ভয়ে বুক ধুকপুক করতে থাকে।’
‘নিশ্চয়ই সেই বুদ্ধিও আবিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা তাহলে যাব। শোন, কিন্তু তোর মাকে ছাড়া কি এইরকম একটা নতুন জায়গায় যাওয়া উচিত হবে? সেবার হলো কি জানিস, আমরা কলেজ থেকে সার্ক দেশগুলো সফরে গেলাম। তাজমহলের সামনে গিয়ে আমার বুকটা হাহাকার করে উঠল। এত সুন্দর একটা জায়গা, এই রকম একটা বিখ্যাত জিনিস, তার সামনে আমি এসেছি, এই সেই তাজমহল, কালের কপোলতলে একবিন্দু জল শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল, সেখানে লায়লাকে ছাড়া আমি এসেছি, এটা কি আমি ঠিক করলাম। আমার মনে হয়, মঙ্গলেও আমি একা যেতে পারব না। সেখানে গিয়ে পৃথিবী নামের নীল গ্রহের দিকে তাকালে আমার চোখে জল চলে আসবে। মনে হবে, লায়লা ওখানে একা কী করছে। তারচেয়ে তুই এক কাজ কর, তোর কোম্পানিকে বল, আমাদের দুজনের টিকিটই যেন দেয়। আমি আর তোর মা দুজনে একসঙ্গে যাব।’
লায়লা বেগম তখন এই দরজার কাছেই ছিলেন। হঠাৎই তিনি বলে বসলেন, ‘কোথায় তুমি আমাকে নিয়ে যাচ্ছ? আমি এখন কোথাও বেরুতে পারব না।’
‘মঙ্গলে যাচ্ছি আমরা দুজন।’
‘মঙ্গলে? ওখানে কি পান নিয়ে যেতে দেবে?’
‘শিমু, তোর মায়ের কথা শোন। এতকিছু থাকতে পান নিয়ে তার চিন্তা?’
‘চিন্তা করব না? সেবার যে মিমু আমাদেরকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গেল, প্লেনে তো পান নিয়েই উঠেছিলাম, ভেতরে খেয়েও ছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে পান নিয়ে ঢুকতে দেয়নি। এয়ারপোর্টেই আটকে দিয়েছিল। কিন্তু ওই দেশেও তো পান কিনতে পাওয়া যায়। কাজেই আমার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মঙ্গলগ্রহে কি পান নিতে দেবে? কাঁচা সুপারি? চুন?’
শিমু খিলখিল করে হাসতে লাগল।
হাসলে শিমুর গালে টোল পড়ে। মেয়েটার রং ছোটবেলায় ধবধবে ফরসা ছিল। তারপর স্কুলে যাবার পর রং ময়লা হতে শুরু করল। আমেরিকায় গিয়ে এখন বরং একটু শ্যামলা ভাব এসেছে। ওর বাঁপাশে একটা দাঁতের ওপরে আরেকটা দাঁত। এজন্য ওর হাসি সবসময় সুন্দর লাগে।
আবদুল জব্বার সাহেব মেয়ের হাসির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললেন, ‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ!’ যেন তাঁর নজর মেয়ের গায়ে না লাগে।
আবদুল জব্বার সাহেব ভেবে পান না, তার মতো সাধারণ সাদাসিধে একজন বাংলার শিক্ষকের ঘরে এই রকমের একটা মেয়ে বেড়ে উঠল কী করে, যার নাম এখন সারা পৃথিবীর সবার জানা। আবার সে যদি এমন দাপুটে মেয়েই হবে, তাহলে সে এমন নিরীহভাবে তার এই বাসায় এসে থাকছে কী করে। মাসকয়েক পরে সে উড়াল দেবে পৃথিবী ছেড়ে। তাকে দেখলে কে বলবে সে এরকম একটা ডাকসাইটে অ্যাস্ট্রোনট। নাসায় চাকরি করে। আমেরিকায় থাকে। ইংরেজিতে ফটরফটর করে কথা বলে। কী রকমভাবে কলাবাগানের বাসায় খাটে আধা শোওয়া হয়ে আছে। বাবা-মার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে।
শিমু বলল, ‘মা, তোমার জন্য অবশ্যই পান-সুপুরির ব্যবস্থা থাকবে। আমরা তো মঙ্গলে গিয়ে আস্তে আস্তে চাষবাস শুরু করব। আমি পানের চারা নিয়ে যাব সঙ্গে করে। মঙ্গলে একরের পর একর জমিতে পান চাষ হবে। তুমি নেমে দেখবে চারদিকে পানগাছ। পানের পাতা। তুমি পাগল হয়ে যাবে খুশিতে। পান আর পান।’
বাসার নিচে চারজন পুলিশ আছেন। 888sport apps সরকার দিয়েছে এই নিরাপত্তা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনুরোধ করেছে। টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা জ্বালিয়ে মারছে। সারাক্ষণ খবর নিচ্ছে সংবাদপত্রের লোকজন। শিমু বলে দিয়েছে, অফিসিয়ালি কথা বলা বারণ। আবদুল জব্বার সাহেবও সবাইকে সেটা জানিয়ে দিচ্ছেন। ওর অফিস থেকে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। তাই কোনো কথা হবে না। নিরাপত্তারও একটা ব্যাপার আছে। প্রচার-প্রচারণা থেকে তাই দূরে থাকতে হবে।
‘বাবা, তোমার মনে আছে, আমি যেদিন বিমানবাহিনীর ইন্টারভিউতে ফেইল করলাম, সেদিনটার কথা?’ শিমু বলল।
‘না তো মা। কী হয়েছিল!’
‘আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার শখ ছিল পাইলট হবো। এই জন্য আমি চেয়েছিলাম বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে। সাহসী আছি। সায়েন্স নিয়ে পড়েছি। রেজাল্ট ভালো। আমার সাহস আছে। গাছে চড়তে পারি, সাঁতার কাটতে পারি। ফুটবল খেলি, বাস্কেটবল খেলি। আমাকে বিমানবাহিনী নেবে না, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। অনেকদূর পর্যন্ত গেলাম। শেষে বাদ দিয়ে দিলো। খুব কাঁদছিলাম। তখন তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে। আমাকে তুমি ভারতের প্রেসিডেন্ট আর পরমাণু 888sport apkী এপিজে আবদুল কালামের গল্প শুনিয়েছিলে। এপিজে আবদুল কালামও বিমানবাহিনীর জিডি পাইলট হতে চেয়েছিলেন। দেরাদুনে গিয়ে বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। অল্পের জন্য তিনি চান্স পেলেন না। তখন তাঁর মনে হলো, তাঁর জীবনের আর কোনো মূল্য নেই। তিনি একটা নদীর ধারে মনখারাপ করে বসে রইলেন। ওই সময় একজন সাধু এলেন তাঁর কাছে। তাঁকে বললেন, তোমার কী হয়েছে? এত মনখারাপ করে বসে আছ কেন?
এপিজে আবদুল কালাম বললেন, আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। আমি বিমানবাহিনীর পাইলট হতে পারব না।
সাধু বললেন, তোমার জীবন মোটেই ব্যর্থ হয়ে যায়নি। তুমি বিমানবাহিনীর পাইলট হতে চেয়েছ। কিন্তু তোমার বিধিলিপি হয়তো তা নয়। হয়তো তোমার জন্য নিয়তি এর চেয়ে ভালো কিছু নির্ধারণ করে রেখেছে। তোমাকে বিধাতা যা হওয়ার জন্য বানিয়ে রেখেছেন, তাই তো তুমি হবে। হয়তো সেটা বিমানবাহিনীর জিডি পাইলটের চেয়েও বড় কিছু, ভালো কিছু। তুমি সেটা হওয়ার জন্য চেষ্টা করো।
এপিজে আবদুল কালাম এরপর পড়তে শুরু করলেন 888sport apk। হলেন বড় 888sport apkী। শেষে হলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট। কতদিন আগের কথা বাবা। আমার ঠিক মনে আছে। তোমার কথা শুনে আমি ঠিক করলাম, আমিও ফিজিক্স পড়ব। একদিন হয়তো 888sport appsের প্রেসিডেন্ট হতে পারব! হা হা হা।’
‘তুই কি সত্যি 888sport appsের প্রেসিডেন্ট হতে চাস?’
‘তা কী করে হবে বাবা? আমি তো মঙ্গলে যাচ্ছি।’
আবদুল জব্বারের চোখ টলমল করে উঠল। তার বাচ্চাটা কী পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে। বলবেই না বা কেন। তেইশ বছর বয়স পর্যন্ত তো 888sport appsেই ছিল। হলিক্রস কলেজে পড়েছে, তারপর পড়েছে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়েই। সেখান থেকেই সে চলে গেল আমেরিকায়।
888sport appয় তো ছায়ানটে গান শেখার ক্লাসও করেছে। ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারত। ওর বাংলা উচ্চারণ তাই ভাঙা ভাঙা হওয়ার কোনোই কারণ নেই।
মেয়েটা মঙ্গলে যাচ্ছে। মঙ্গলে যাওয়া মানে একবারে যাওয়া। আর কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে না; কিন্তু হয়তো কথা হবে। আর ওর কাজকর্ম সবই তো দেখা যাবে। ছবি মঙ্গল থেকে আসবে। মঙ্গলের ছবি নিশ্চয়ই মঙ্গলবার্তায় ভরাই থাকবে।
আবদুল জব্বার আশা হারান না।