মণিপুর থিয়েটারের কহে বীরাঙ্গনা ও সাধনা – উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি প্রসার কেন্দ্রের সীতার অগ্নিপরীক্ষা পুরাণ ভাঙার পালা

পৌরাণিক আখ্যানকে সামনে রেখে দুটি বাংলা মঞ্চনাটক সম্প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রথমটি, মণিপুর থিয়েটারের কহে বীরাঙ্গনা। গত নভেম্বরে ৭৫ অভিনয়ের    কৃতিত্ব অর্জন করেছে এটি। আট বছরের মধ্যে এত অভিনয় এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়। এ প্রযোজনার অভিনবত্ব লুকিয়ে তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ে। দলটি 888sport appর নয়। সিলেটের মৌলভীবাজার এলাকার কমলগঞ্জ মহল্লায় যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাস তাদের শাঁসেজলে পুষ্ট। এমন একটি দল আপন বেগে চলে এমন একটি আধুনিক নাট্যভাষ রচনা করেছে যে, 888sport appসমেত সারা 888sport apps তো বটেই কলকাতাও আলোড়িত হয়েছে। আমাদের আলোচ্য দ্বিতীয় নাটকটি সাধনা – উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি প্রসার  কেন্দ্রের প্রযোজনা সীতার অগ্নিপরীক্ষা। আট বছরের মধ্যে এ-নাটকের একটি নয়, দুটি প্রযোজনা করেছে সাধনা। একটি ভারতের সঙ্গে যৌথতায়। অন্যটি স্বনির্ভর উদ্যোগে। সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরের প্রযোজনাটিও দেখতে দেখতে ৫০তম অভিনয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল।

এই দুটি নাটকের মধ্যে একটি বড় মিল আছে। ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অন্য একটি ব্যঞ্জনা গত সাড়ে চার দশকে তৈরি হলেও এ-নাটকে সাবেক ব্যঞ্জনাটিই মুখ্যত ক্রিয়াশীল। দুটি নাটকই ভারতীয় পুরাণের আধুনিক ভাষ্যকে আধার করে তৈরি হয়েছে। সীতার অগ্নিপরীক্ষার উৎসে আছে রামায়ণ। কহে বীরাঙ্গনার উৎসে আছে মহাভারত। 888sport appsে এ-ধরনের পৌরাণিক আখ্যাননির্ভর অনেক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা আছে যা ধর্মীয় কৃত্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। মণিপুর থিয়েটার বা সাধনা – উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি প্রসার কেন্দ্রের নাটকে ওই কৃত্য নাক গলাচ্ছে না বললেই চলে। তা সম্প্রদায়নিরপেক্ষভাবে  পৌরাণিক সমাজে 888sport promo codeর অবস্থানের আনাচে-কানাচে সন্ধানী আলো  ফেলছে। পশ্চিমি গতের রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্টের সারস্বত ধাঁচাকে আকর করে বেড়ে ওঠা যে-প্রবণতাকে সেলিম আল দীন বলতেন ‘পুরাণ ভাঙার 888sport live chat’, মোটের ওপর সেই ধরতা নিয়েই যুগপটভূমি ঈষৎ বদলে দিয়ে আধুনিক কালের সঙ্গে সেতুবন্ধন করছে এই নাটকদুটি। বিশেষত দ্বিতীয়টি।

এবং এ-কথা বলতে তৃপ্তি হচ্ছে যে, একক অভিনয়ের দুটি উচ্চাশী মাত্রায় আমাদের পৌঁছে দিতে পারছে কহে বীরাঙ্গনাসীতার অগ্নিপরীক্ষা। আধুনিক নাট্যশালার উপযোগী, আধুনিক 888sport live chat-উপভোক্তার আকাঙিক্ষত এ দুটি নির্মাণ কীভাবে এমন সার্থকতা  পেল তার গভীরে গেলে এমন অনেক সূত্র পাওয়া যাচ্ছে, যা আমাদের নাট্যচর্চার ভাবীকালের ইঙ্গিত বয়ে আনছে।

কহে বীরাঙ্গনা নাটকের কথা আগে বলা যাক। মণিপুর থিয়েটারের এক ঘণ্টার এই নাটক আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কহে বীরাঙ্গনা কাব্যের খ–ত নাট্যরূপ। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে বেরোনো এই পত্রকাব্যে সাকুল্যে এগারোটি পত্র ওরফে সর্গ ছিল। রোমান কবি ওভিদের রচনার অনুসরণে লেখা এসব পত্র কোনো না কোনো পৌরাণিক 888sport promo codeর বকলমা নিয়ে লিখেছিলেন মধুসূদন। এই পত্রকাব্য আদতে স্বগতোক্তিসম্পুট। মধুসূদনের কাছাকাছি সময়ে বিলেতে বসে ড্রামাটিক মনোলগস লিখে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের খুব নামযশ হয়েছিল। ব্রাউনিং 888sport promo codeপুরুষ ভেদ করেননি। লিখেছেন পাঁচমিশালি ঢংয়ে, রকমারি খেই ধরে। মধুসূদনের পত্রকাব্যে এক ধরনের মাপা ধ্রম্নপদিয়ানা আছে। তা বলে পুরাণের বাঁধা গতে পা ফেলার বান্দা  তো তিনি ছিলেন না। মেঘনাদবধ কাব্যের মতো অত বৈপস্ন­বিক ভাষ্য না হলেও বীরাঙ্গনা কাব্য হয়ে উঠেছিল ‘অভিজাত’ 888sport promo codeর ‘অনভিজাত’ আকাঙক্ষার কথামালা।

কহে বীরাঙ্গনা এর ‘খ–ত নাট্যরূপ’ কারণ এগারোটির মধ্যে  থেকে চারটি সর্গ বেছে নিয়ে নাট্যরূপ দিয়েছেন নির্দেশক শুভাশিস সিনহা। ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’, ‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’, ‘জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা’ ও ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’। শকুন্তলার কথা নতুন করে বলার নয়। মধুসূদনের শকুন্তলা একদিকে বেদব্যাস, অন্যদিকে কালিদাসের শকুন্তলার হাত ধরে পথ কেটেছে। যুক্তিতর্ক নয়, দ্রৌপদী পর্বে জোর পড়েছে প্রেম আর প্রতীক্ষার ওপর। যে অর্জুন উচ্চতর অস্ত্রশিক্ষার্থে স্বর্গে গেছেন তাঁকে চোখে হারাচ্ছেন তাঁর নবপরিণীতা। ‘জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা’ পর্বে আর প্রেমিকা নয়, পত্নীও নন, ভরকেন্দ্রে চলে এসেছেন এক মা। অসমযুদ্ধে নিজের ছেলে অভিমন্যুর মৃত্যুর পর মুখ্য ঘাতক জয়দ্রথকে হত্যার সংকল্প করেছেন অর্জুন। কেঁপে উঠেছে জয়দ্রথজায়া দুঃশলার প্রাণ। স্বামীসন্তানকে নিয়ে হস্তিনাপুর ছেড়ে যাওয়ার চিন্তায় মেতে আছেন তিনি।

কহে বীরাঙ্গনার চতুর্থ তথা অন্তিম আখ্যানের কেন্দ্রে আছেন জনা। কে এই জনা? বাঙালির তেমন করে জানা নেই। মহাভারতের মাপ ধরলেও বেশ খাপছাড়া চরিত্র। ওদিকে অথচ তাঁর কথা দিয়েই কহে বীরাঙ্গনার যবনিকাপাত ঘটাতে চেয়ে বড়সড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন শুভাশিস। মধুসূদনের মূল রচনাকে তিনি একটুও বদলাননি। কাটছাঁট করেননি। প্রামাণ্য জেনেছেন। অথচ মধুসূদনের এই পত্রকাব্য আদপে নাটকীয়তায় ঠাসা নয়। একবার শুনেই মর্মস্থলে পৌঁছানো এমন সুলভ নয়। তা বিলীয়মান এক সমন্বয়ী সংস্কৃতির সিক্তবালুরাশি।

এখন ওসত্মাদের মার শেষ রাতে না দিতে পারলে উলটপুরাণ হতে পারত। এর প্রধান কারণ শকুন্তলা বা দ্রৌপদীর কথা কমবেশি সকলের জানা। দুঃশলার হাহা-রবের খেই ধরা এমন কিছু শক্ত নয়। মধুসূদনের জাঁদরেল বাংলা, অমিত্রাক্ষরের গেরামভারী চাল, চরিত্রায়ণের আঁকাচোরা কায়দা – এসব ডিঙিয়ে একবার শুনে নাট্যবস্ত্তর মর্মে ঢুকে পড়া এমনিতেই দুরূহ ব্যাপার। কী ব্যাপার জানা থাকলে ধরতে সুবিধে হয়। নইলে শোনায় মন দেবো, না দেখায়, ভাবতে ভাবতে পালা ফুরিয়ে যায়। জনার কথা মহাভারতে পাদটীকা মাত্র। রোজকার জীবনের সঙ্গে তার অত মিল নেই। কাজেই মুশকিল ছিল। যিনি তা আসান করতে পারতেন, সেই ব্যাসদেব তাঁর আখ্যানে জনা নিয়ে কোনো জিগির তোলেননি। তুলেছেন ব্যাসশিষ্য   জৈমিনী। এবং তাঁর খেই ধরে জনাকে আমাদের ঘরে এনে তুলেছেন কাশীরাম দাস। তাঁকে বাংলার মাটি দিয়ে, মায়া দিয়ে, মমতা দিয়ে নতুন করে গড়েছেন। মাতৃত্বের এক আলাদা চেহারা তৈরি করেছেন। মধুসূদন এই কাশীদাসী আখ্যানকেই মাথায় রেখেছিলেন। তাঁর ‘অশ্বমেধপর্ব’ থেকেই যে এর আদল পেয়েছেন মধুসূদন, একাদশ সর্গের প্রাক্কথনে এ-কথা ফলাও করেই জানিয়েছিলেন।

মাহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর অশ্বমেধ-যজ্ঞাশ্ব ধরিলে, – পার্থ তাহাকে রণে নিহত করেন। রাজা নীলধ্বজ রায় পার্থের সহিত বিবাদপরাঙ্মুখ হইয়া সন্ধি করাতে, রাজ্ঞী জনা পুত্রশোকে কাতর হইয়া এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি রাজসমীপে প্রেরণ করেন। পাঠকবর্গ মহাভারতীয় অশ্বমেধপর্ব পাঠ করিলে ইহার সবিশেষ বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন।

দেড়শো বছর আগেকার বাঙালি ‘পাঠকবর্গে’র হাতে মধুসূদন যা তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তার কদর আজকের সমঝদার বাঙালি পাঠক একইভাবে করবেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ দেখি না। তার ভিন্নতা তার রসগ্রাহিতার ভিন্ন ভিন্ন পরিসর তৈরি করবে। কমলগঞ্জ সিলেট বা 888sport appর নাটমঞ্চে তার কদরদারির ধরন অভিন্ন হবে না। তবু শুভাশিস ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আন্দাজ করি, একটি মহাভারতীয় সূত্র রচনার পাশাপাশি, শকুন্তলা-দ্রৌপদী-দুঃশলার জীবননাট্যের ধারাবাহিকতা রচনার পাশাপাশি, একটি তুঙ্গ নাট্যমুহূর্তের সন্ধানী ছিলেন তিনি। কারণ হলোই বা রানি, জনা আদতে ছেলে-হারানো এক মা। তাঁর মধ্যে কি হাজার চুরাশির মায়ের ছবি দেখেছিলেন শুভাশিস? দেখতে পারেন। প্রবীর নামে যে দামাল ছেলে পা-বদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে তুড়ি মেরে বুক ফুলিয়ে অশ্বমেধের  ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিয়েছিল, সেই প্রতিস্পর্ধীর মধ্যে কি মুক্তিযোদ্ধার আদল পেয়েছিলেন শুভাশিস? পেতেই পারেন। যে-অর্জুনের ছোড়া তিরে তাঁর ছেলে মারা গেছে, সেই অর্জুনের মধ্যে কি পাক হানাদারের আদল পেয়েছিলেন শুভাশিস? পেতে পারেন।  যে-নীলধ্বজ বুকে পাথরচাপা দিয়ে নিজের ছেলের খুনিকে অভ্যর্থনা করেছিলেন, তার মধ্যে কি গদি আঁকড়ে থাকা ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আদল পেয়েছিলেন শুভাশিস? পাওয়ার কথা। পেয়ে থাকলে আরো অনেকের মধ্যে সেই বোধ ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ তিনি অনুভব করবেন। ২০১০ বা ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের 888sport apps ইতিহাসের যে-বাঁকে এসে পৌঁছেছে, যেখানে শহিদ হয়ে উঠেছেন বরণীয়, শহিদের মা

 

হয়ে উঠছেন মাননীয়া, লাখ লাখ ‘বীরাঙ্গনা’ হয়ে উঠেছেন  দেশপ্রেমিকোত্তম, সেখানে জনার মতো এক প্রতিবাদী চরিত্র তো জনগণমনে ঈপ্সিত প্রতিক্রিয়ারই জন্ম দেবে। গঙ্গার জলে ডুবে তাঁর আত্মহত্যার মধ্যে যে-করুণরসের সূচক আছে, তা ছেলেহারানো মায়ের অসহায় হাহাকারে পর্যবসিত না হয়ে সন্তানের মর্যাদার ওপর পুরুষতান্ত্রিক খবরদারির মুখে সপাট চপেটাঘাতের চেহারা নেবে। গ্রিক পুরাণের মেদেয়ার এক পালটা ছবি জনার মধ্যে আছে।  সেটি মধুসূদনের নজর এড়ানোর কথা নয়। ইউরিপিডিসে সড়গড় শুভাশিসও তার নাগাল পেয়ে থাকবেন।

যাও চলি, মহাবল, যাও কুরুপুরে

নব মিত্র পার্থ সহ! মহাযাত্রা করি

চলিল অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!

ক্ষত্র-কুলবালা আমি; ক্ষত্র-কুল বধূ

কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য ধরি?

ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;

দেখিব বি888sport sign up bonus যদি কৃতান্তনগরে

লভি অন্তে! যাচি চির বিদায় ও পদে!

ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,

নরেশ্বর, ‘‘কোথা জনা?’’ বলি ডাক যদি,

উত্তরিবে প্রতিধ্বনি ‘‘কোথা জনা?’’ বলি।

 

এই বলে জনার কথা ফুরিয়েছিল। জুড়েছিল ‘ইতি শ্রীবীরাঙ্গনাকাব্যে জনাপত্রিকা নাম একাদশ পর্ব’ এই ভণিতা। নাটকীয়তার এই শীর্ষবিন্দুতে উঠে শুভাশিস মঞ্চ ঢেকে দিলেন সাদা কাপড়ে। তার নিচে কুশীলবদের কেরামতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠল জাহ্নবীর জল। যেন জোয়ার এলো গাঙদরিয়ায়। কাপড়ের ওপর এসে পড়ল হালকা নীল আলো। নেচে নেচে উঠল ঢেউয়ের মাথা। আবছায়ার এই অবকাশে মঞ্চ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া জ্যোতি চকিতে মুখ গলিয়ে দিলেন ওই আদিগন্তপ্রসারিত কাপড়ের মাঝে যেখানে গোল করে কাটা তার মধ্যে দিয়ে। জ্যোতির সেই অভিব্যক্তিতে শোক আছে। অভিমান আছে। ক্ষোভ আছে। আবার অপার নির্লিপ্তি আছে। উদাসীনতা আছে। ওই উথালপাতাল ঢেউয়ের মধ্যে ক্রমে মিলিয়ে গেলেন তিনি। এটিই এ-নাটকের তুরুপের তাস। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের নিজস্বতাময় আবহসংগীত আর পশ্চিমি নাট্যপ্রকরণের এই চারু প্রয়োগ আমাদের চকিতে মনে করিয়ে দিলো মণিপুর থিয়েটারের আরেক সার্থক প্রযোজনা দেবতার গ্রাসকে। দুবছর আগে যখন কহে বীরাঙ্গনা প্রথম দেখেছিলাম বাংলা 888sport live chatকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে, এমন প্রবল ছিল তার অভিঘাত যে, মনে হয়েছিল বুঝি জলে ডুবেছি আমরাও। এর দুমাসের মাথায় সিলেটে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবের পালা পড়েছিল আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পোর্টস কমপেস্নক্সে। একদিন সন্ধ্যায় তাঁর ইনডোর স্টেডিয়ামে কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল এ-নাটক। ওই অন্তিম মুহূর্তের অনুভব এখনো শিহরণ জাগায়।

বাচিক অভিনয়ের উৎকর্ষের পাশাপাশি দৃশ্যরচনার যে-বৈভব এ-নাটককে সম্পদশালী করেছে, তার নির্মাণে আরো মালমশলা আছে। এমনিতে হালকা মঞ্চ। ছাদ থেকে ইতিউতি মোটা গাছির দড়ি ঝুলছে। চাইলে ছুঁতে পারা যাবে। ডিপ সেন্টার স্টেজে একটি নিচু ধাপি। দরকারে তলবিন্যাসকে উনিশ-বিশ করে নেওয়া যায়। ডাউন রাইটে একটু মেটেরঙের এক ছোটখাটো কাঠামো। তার ওপর আরাম করে আলগোছে বসে কনুইয়ে ভর দিয়ে গালে হাত

 

দিয়ে আনমনা হওয়া যায়। আবার ময়ূরের পালক দোয়াতে ডুবিয়ে পত্র রচনা করা যায়। মণিপুর থিয়েটারের 888sport app প্রযোজনার মতো এ-নাটকের জুড়ির দল জনসমক্ষে নেই। তাদের উপস্থিতি নেপথ্যে।  জ্যোতি সিনহা আছেন মঞ্চ জুড়ে। তাঁকে সংগত দিচ্ছেন আরো পাঁচজন। কখনো তাঁরা শকুন্তলার সখী অনসূয়া-প্রিয়ংবদা সাজছেন। সম্মেলক মণিপুরি অঙ্গবিন্যাসে অরণ্যবালা হচ্ছেন। কখনো জ্যোতির কথকতার সমান্তরালে একটি নাট্যনির্মাণ করছেন। শকুন্তলা-দুষ্মন্তের গান্ধর্ব বিবাহের বাসরসজ্জা রচনা হচ্ছে ডিপ সেন্টার স্টেজের ওই বেদিমূলে। মূকাভিনয়ে। দুই কুশীলব গাঁদাফুলের মালা পরছেন। একজন টেনে দিচ্ছেন ঘোমটা। ফুলশয্যা রচনা হচ্ছে অন্য একটি লাইট জোনে। স্নিগ্ধ প্রেমের মাধুরী দিয়ে। ওই মালা, ওই ঘোমটা, ওই ফুলশয্যা কতখানি মহাভারতসংগত এ-প্রশ্ন তখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। শুভাশিস পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে নিজের ঘরের উঠোনে এনে ফেলছেন শকুন্তলাকে। পরাচ্ছেন বঙ্গীয়-মণিপুরি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান। এর ফলে সমান্তরাল একটি চিত্রমালা তো তৈরি হচ্ছেই, মধুপদাবলি একবার শুনে যে-অতৃপ্তি থাকে, আকাঙক্ষা থাকে তারও নিবৃত্তি হচ্ছে। অনেকাংশে। আমাদের কল্পনার ওপর আস্থা নেই বলেই কি শকুন্তলার 888sport sign up bonusচারণের সম্পূরক এসব দ্যোতক দৃশ্যনির্মাণ? এ আমাদের মনে হয় না। মনে হয়, ভিন্ন ভিন্ন রসনিষ্পত্তির সংকেত  দেওয়াই আধুনিক নাট্যনির্দেশকের মুখ্য কর্তব্য। এসব অণুনাট্যায়ন তারই সহায়ক।

আঙ্গিক ও আহার্য অভিনয়ের আধারও বটে। যখন প্রয়োজন হচ্ছে, তখন আবরণ-আভরণের তরবেতর ঘটিয়ে দিচ্ছেন শুভাশিস। দুঃশলা পর্বে ওই ঝুলন্ত রজ্জুর কোলেপিঠে কয়েকটি স্বচ্ছ রেশমি কাপড় রেখে রাজ অমত্মঃপুরের আবহাওয়া এনে দিয়েছেন। এ পর্বের  শেষে জয়দ্রথকে রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে রাজদ্বারে চলে আসার আবেদন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘অবিলম্বে যাব/ এ পাপ নগর ত্যাজি সিন্ধুরাজালয়ে!/ কপোতমিথুনসম যাব উড়ি নীড়ে! -’ এর উপযোগী একটি live chat 888sport রচনা করেছেন শুভাশিস। জ্যোতিকে সামনে রেখে লম্বা এক ফালি সাদা কাপড় দিয়ে উড়ে চলেছে লাল পাড় কালো শাড়ি পরা চার-পাঁচজন। পর্ব থেকে পর্বান্তরের খানিক বিরাম এ-নাটকের নড়বড়ে জায়গা। দৃশ্যবিভ্রমে ভারাতুর প্রসেনিয়াম থিয়েটারের এ এক চোরাবালি। তার উপভোক্তাও ওই শর্তে অভ্যস্ত। ঐতিহ্যবাহিত পরম্পরা আর আধুনিক মঞ্চভাষের সাঁকো গড়তে আসা শুভাশিস জানেন ওই বিরামকালকে ভরিয়ে রাখতে হবে কল্পনার মুগ্ধতায়, সাংগীতিক মূর্ছনায়, ঘনায়মান অন্ধকারে। নইলে জ্যোতির পরিচ্ছদের অদলবদল ঘটবে না। অনিবার্য হয়ে উঠবে দৃশ্যগত ক্লান্তি। এক ঘণ্টার এ-মহানাটকের মহানায়িকা জ্যোতিও দম ফেলার ফুরসত পাবেন না। তাই বুঝি একেকটি পর্বের সমাপ্তিবিন্দুকে এমন প্রলম্বিত করেন নির্দেশক। দর্শকের আকুতিকে টেনে রাখেন পরের পর্বের নিরুত্তাপ সূচনাবিন্দু পর্যন্ত।

নাটকীয়তার এই তুঙ্গস্পর্শী নির্মাণে শুভাশিসের সহায় শর্মিলা সিনহার আবহ-পরিকল্পনা। বিধান সিনহার বাজনা। এমনিতে ওপেন কার্টেন প্রোডাকশন। যবনিকার বালাই নেই। অভিনয় শুরুর আগেই হারমোনিয়াম বাঁশি খোল করতালের ঐকতানে যে-মন যে-মেজাজ  তৈরি করে দেন শর্মিলা, তা আমাদের নাটকের ভেতরে ঢুকতে খুব সাহায্য করে। খোলের বোল মাতন তোলে রক্তস্রোতে।

তবে এ-নাটকের প্রাণভোমরা জ্যোতি। গত ১০ নভেম্বর 888sport apps 888sport live chatকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে কহে বীরাঙ্গনার ৭৫তম মঞ্চায়নে এসে মামুনুর রশীদ বলেছেন, ‘বাচিক অভিনয়ের সাথে সংগীত, নৃত্য ও দেহের ভাষাকে একাত্ম করে মধুসূদনের দুরূহ কাব্যকে সে যেরকম অনায়াসে সহজ-সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে, তা বিস্ময়কর!’ তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি, জ্যোতি যা  পেরেছেন তার তুলনা একমাত্র গৌতম হালদার। প্রথমে নান্দীকার, পরে নয়ে নাটুয়া থেকে মেঘনাদবধ কাব্যের যে ঐতিহাসিক মঞ্চায়ন করেছিলেন তা শুভাশিসকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকবে। মধুসূদনের আধুনিক মঞ্চায়নে সেটি মাইলফলক বইকি! কিন্তু জ্যোতির বিশিষ্টতা তাঁর মগ্নতায়। সূত্রধারের কথাটি সেরে নিয়েই জ্যোতি যেই চরিত্রে ঢুকে পড়ছেন, ইতি টানার আগে আর বেরোচ্ছেন না। এবং এমনই সম্মোহনী শক্তি সেই অভিনয়ে যে আমরাও বশ হয়ে থাকছি। যেমন চালাচ্ছেন তেমন চলছি। মধুসূদনের কাব্যের অন্তর্গত ছন্দকে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়। কঠিন হলো তাঁর কানায় কানায় গুঁজে  দেওয়া ছায়াছবিকে ফুটিয়ে তোলা। কোনোরকম পুনরুক্তির ধার না ধেরে একবার বলেই সেসব চরণের প্রতি সুবিচার করা। নিহিত কাব্যগুণ ও চিত্রভাষকে জলজ্যান্ত করা। শুভাশিস ও সহ888sport live chatীদের সহযোগিতায় সেটি যেন অনায়াসেই পেরেছেন জ্যোতি। বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলার মধ্যে যে নিঃশর্ত সমর্পণ আছে, বিহবল বিরহ আছে, সেটি তাঁর করতলগত আমলকী। দ্রৌপদী তাঁর স্বামীকে ‘সখা’ভাবে জানেন। তাঁর মধ্যে অভিমানী স্ত্রী আর ঈর্ষান্বিত  প্রেমিকার দোরোখা ছবির মধ্যে যে-টানাপড়েন তাকে ফুটিয়ে তুলতে  পেরেছেন জ্যোতি। দুঃশলার মর্যাদাবোধ উঠে এসেছে জ্যোতির  তেজস্বী কটাক্ষে। যখন চক্রব্যূহে অভিমন্যুর হত্যাদৃশ্য 888sport app download for android করতে করতে নিজের সন্তানের অনুরূপ ভবিতব্যের দিকে চেয়ে শিউরে উঠছেন দুঃশলা, লেখা থামিয়ে অনবধানে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, তখন  সেই চরিত্রের দ্বিধাবিভক্তি উঠে আসছে জ্যোতির আকুল চাউনিতে। পুত্রশোকাতুর জনার মধ্যে যে-দার্ঢ্য ঢেলে দিয়েছিলেন মধুসূদন তার অকাতর চিত্রায়ণের কথা তো আগেই বলা হয়েছে।

মণিপুর থিয়েটারের এ-নাটকের আদত পারফরম্যান্স স্পেস কমলগঞ্জে তাদের নিজস্ব নাট্যশালা যার পোশাকি নাম নটম-প। অনুমান করি নটম-পে ঘরের লোকের সামনে এ-নাটকের অভিনয়ে তাদের পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। 888sport appয় 888sport apps 888sport live chatকলা একাডেমির ছোট-বড়-মাঝারি মিলনায়তনে হরেক রকম দর্শকের সামনে কহে বীরাঙ্গনা মঞ্চস্থ করতে গেলে এক ধরনের ঠোকাঠুকি লাগে। সেই ঠোকাঠুকির মূলে থাকে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দূরত্ব। দেখে ভালো লেগেছে যে, ঠোকাঠুকি অচিরেই মিলে  গেছে, টক্করে দাঁড়ায়নি। আর বিস্মিত হয়েছি সিলেটে ওই স্পোর্টস কমপেস্ন­ক্সে প্রযুক্তি ও প্রকরণগত হাজারো উপদ্রব সয়ে এবং মানিয়ে কহে বীরাঙ্গনার উপস্থাপন দেখে। যে-888sport apps তার মৃত্তিকালগ্ন সংস্কৃতির উনকোটি অভিব্যক্তিকে খুঁজে পেতে চিনে বুঝে আধুনিক মঞ্চনাটককে সাজাতে চায়, সেই 888sport appsে এমনতর নাটকের সাফল্য আরো দূরতর দ্বীপের সন্ধান দিক।

 

তবে মহাভারত নয়, রামায়ণ যে কত শত পারফর্মিং আর্ট ফর্ম  তৈরি করেছে তার ইয়ত্তা নেই! আজকের 888sport appsের ইতিউতি রামায়ণের আখ্যাননির্ভর এমন বেশ কিছু আঙ্গিক বেঁচেবর্তে আছে। এদের কমিউনিটি থিয়েটার বলে দাগিয়ে দিলে বা অ্যাকাডেমিক স্টাডিজের গর্তে সেঁধিয়ে দিলে নিজের পায়েই কুড়াল মারা হয়। 888sport apps তা করেনি। সংরক্ষণ অতিবিষম বস্ত্ত। আত্তীকরণ আরো দুরূহ। তবু পায়ে পায়ে বেশ এগোনো গেছে। ভাঙাচোরা রাসত্মা বেয়ে আনাগোনা বেড়েছে। কুড়িগ্রাম মহল্লার কুশান গানের কথা দেখি 888sport appর অনেকেই জানেন। রামকীর্তন বা রামপাঁচালি বা রামযাত্রা বা রামলীলা গ্রামীণ চর্চাবৃত্তে থাকলেও কৃতী গবেষক ও  ক্ষেত্রসমীক্ষকদের লাগাতার চেষ্টায় সেসবের সঙ্গে 888sport appsের নাট্যতত্ত্ব জুড়ে গেছে। সাইমন জাকারিয়া এই আঁধার রাতের বাধার পথের এক একলা পাগল। বছরদশেক আগে রামায়ণ আখ্যানের বিসত্মৃত আধার থেকে নাট্যবস্ত্ত ছেঁকে নিয়ে সীতার অগ্নিপরীক্ষা রচনা করেছিলেন তিনি। এই বিশ্বাসে যে, ‘এই নাট্যপালা পরিবেশনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে 888sport appsের অসাম্প্রদায়িক পরিচয় পুনর্ব্যক্ত হবে।’ একক অভিনয়ের মাপে ছকা এই নাটকের দুটি প্রযোজনা করেছে সাধনা – উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি প্রসার কেন্দ্র। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রযোজনার পুরোভাগে ছিলেন দিলিস্ন-প্রবাসী বাঙালি অভিনেতা আভেরী চৌরে। নির্দেশক ছিলেন আবদুল হালিম প্রামাণিক সম্রাট। পরের বছর নাজনীন হাসান চুমকির নির্দেশনা ও অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ফের মঞ্চে আসে সীতার অগ্নিপরীক্ষা। গত ৩০ অক্টোবর 888sport apps 888sport live chatকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে এর ৪৬তম অভিনয় দেখে মনে হলো এমন বর্ণিল প্রযোজনা আগে দেখিনি কেন!

সীতার অগ্নিপরীক্ষা মঞ্চায়নের খুঁটিনাটিতে যাওয়ার আগে সাইমন জাকারিয়ার লেখার কারিকুরিতে মন দেওয়া দরকার। কারণ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যকে মন্থন করে এমন লেখা সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে না। উত্তর-১৯৭১ পর্বের 888sport appsি নাটকের বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষামূলক লেখালেখির যে-রেওয়াজ চালু করেছিলেন সেলিম আল দীন, যাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে কাজে লেগেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, যা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির তকমা সেঁটে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে আজকাল, সাইমনের ঝোঁক সেদিকে। পৌরাণিক আখ্যানের নতুন ভাষ্য রচনার এই সাধনমার্গে সাইমন একা নন; আছেন মাসুম রেজা (নিত্যপুরাণ), অলোক বসু (এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ), তানভীর আহমেদ সিডনী (কর্ণকথা), রুবাইয়াৎ আহমেদ (হিড়িম্বা), আনন জামান (শিখ-ী কথা) ও আরো কেউ কেউ। এঁদের মধ্যে অলোক তো আখ্যানের এই পর্বটিকেও স্পর্শ করেছেন। সাইমন চাইলেই বাল্মীকি রামায়ণে যুদ্ধকা–র শেষদিকে যা ছিল তাকে সামনে রেখে লিখতে পারতেন। কিন্তু বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসকে আঁকড়ে ধরে থাকেননি তিনি। তাঁদের পরও বাঙালির কল্পনায় রামকথা ও রামকাহিনির কতরকমের ভাষ্য রচনা হয়েছে। হয়ে চলেছে। আধুনিক 888sport live football ও সংস্কৃতিপাঠের একটি মান্য প্রবণতা যাকে আমরা ফেমিনিস্ট স্টাডিজ বলি, তার আয়নায় সীতার যে-মুখ ফুটে ওঠে তা পুরুষতন্ত্রের মুখোশকে উড়িয়ে দেওয়ার তাকত রাখে। সীতার অগ্নিপরীক্ষায় এ সব কিছু থেকে সারবস্ত্ত আহরণ করে একটি বহুমাত্রিক নাট্যপাঠ উপস্থাপন করেছেন সাইমন। সীতার মুখ দিয়ে, সীতার চোখ দিয়ে ওই অগ্নিপরীক্ষার একটি স্বতন্ত্র ভাষ্য রচনা করেছেন।

মুন্শিয়ানা রয়েছে ভাষ্যবিন্যাসেও। কতক রামকীর্তনের গতে বাঁধা আসরবন্দনা করে নাটক শুরু হয়েছে। জরুরি হয়ে উঠেছে গায়েন, দোহারদের সহযোগ। সাইমন সীতাকে গড়েছেন বাংলার কুমোরদের মতো করে। খড়ের কাঠামোর ওপর একমেটে, দোমেটে,  তেমেটে প্রলেপ পড়েছে। রাবণবধের পর রামের কাছে যাওয়ার জন্য সীতার আকুলিবিকুলি এক লহমায় ফুটে বেরোয়নি। বেরিয়েছে ধীরে ধীরে। নানাজনের সঙ্গে কথোপকথনের খেই ধরে। দেখাশোনার ওপর ভর করে। যে-সীতার মনের কথা সংলাপে আসেনি, তা এসেছে চেতনাপ্রবাহের মধ্যস্থতায়। রচনার চারুকৃতির সঙ্গে গবেষণার সুবাস  মেলায় সীতার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠেছে রম্য একটি ভাষ্য।

এই ভাষ্যটিকে মঞ্চের ওপর সচলায়িত করার সুবিধা ছিল অনেক। সাইমনের নাটক একেবারে মঞ্চায়িত হওয়ার জন্য উন্মুখ। আবার অসুবিধাও ছিল অনেক। আখ্যানে এমন আগুপিছু আছে, আষ্টেপৃষ্ঠে এমন আলোছায়া আছে যে, অভিনেতৃ উঁচুদরের না হলে একটি শুষ্কং কাষ্ঠং মানের কাজ হতো। কিন্তু চুমকির কাছে অভিনয় বস্ত্তটি জলবৎ তরলং। একে পোড়খাওয়া। স্পষ্ট প্রমিত বচন। তায় তাঁর গানের গলা ভালো। শাস্ত্রীয় নৃত্যের ভিত পাকা। তার ওপর লুবনা মারিয়ামের নৃত্য-পরিকল্পনায় পরিমিতিবোধের ঘাটতি নেই। ফলে চোখেমুখে কথা কইতে বাধে না চুমকির। সর্বাঙ্গ বাঙ্ময় হতে পারে। তুড়ি মেরে নবরসের ভিয়েন চড়িয়ে তাতে দর্শক-শ্রোতাকে মজিয়ে রাখতে পারেন তিনি। চোখের তারা মেলে বিস্ময়ের প্রকাশ, ভ্রম্নকুটিতে বীভৎস রসের সঞ্চার, নোয়ানো মুখে করুণের আভাস – এসবে তাঁর পরিপাটি পটুত্ব। তাঁর বেশভূষায় নীল-হলুদের একটু লড়াই বাধলেও আলোর কেরামতিতে তা বাড়তে পারে না। পরম আদরে যখন মালা গাঁথেন, তখন একটিবারের জন্যও সত্যিকারের ফুলের অভাব বোধ হয় না। অথচ মধুরের ভাব জাগে। শিবিকায় বসে রামের সকাশে আসেন সীতা। মঞ্চের পেছন বরাবর একটি রঙিন কাপড় টানানো হয়। আমাদের প্রায় অগোচরে। তাতে লালচে আলো ফেলেন অমস্ন­vন বিশ্বাস। পটভূমি বদলে যায়। মনের। শরীরের। শৃঙ্গারের আবেশ লাগে। ভরতনাট্যম তালিমের সুবাদে রপ্ত করা মুদ্রাবলি এতে জুড়ে যাওয়ায় চুমকির অভিব্যক্তিতে এক শীলিত শান্তায়ন আছে যা সীতা ও তাঁর আশপাশের চরিত্রকে এমন এক নিচু চাবির ঘেরাটোপে বাঁধে যে, কালের চঞ্চলা গতি শস্নথ হয়ে আসে। আপনিই। এই অবকাশ তিনি আদায় করতে পারেন বলে চরিত্রচিত্রণের হরেক ফন্দি অনায়াসে আঁটা যায়। তাঁর অভিনেতৃ সত্তা তাঁর নির্দেশক সত্তার দাবি-দাওয়া মেনে নেয়। প্রতিটি চরিত্রের জন্য একটি বিশিষ্ট অঙ্গভাষা, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু শরীরীমুদ্রা তিনি বেছে রাখতে পারেন এবং এক লহমায় চরিত্র থেকে চরিত্রান্তরে যেতে পারেন। তাঁর বেশভূষায় নীল-হলুদের একটু লড়াই বাধলেও আলোর  কেরামতিতে তা বাড়তে পারে না।

এ-নাটকের মঞ্চকে আলগা করে রাখেন আলি আহমেদ মুকুল। তিনটি বেদি ছড়ানো থাকে তেকোনা বিন্যাসে। সেদিন ওই বেদির ওপর এমন কটকটে কচি কলাপাতার রং লাগায় আমাদের চোখ কটকট করলেও অহরহ সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে নানান উঁচুনিচু  তৈরি করেন চুমকি যা পৌরাণিক সামাজিক বিন্যাসকে চেনায়। রাজার সঙ্গে প্রজা, পতির সঙ্গে পত্নীর সম্পর্কের পরত চেনায়। পরত  চেনায় অঙ্গভাষাও। ওপর থেকে ঝুলতে থাকে পত্রবলস্নরী। আলো  পেলে অরণ্য হয়, হয় অশোককানন। মেঝেয় পড়ে থাকা এক ফালি রঙিন দড়া হয়ে ওঠে হরধনু। সেটি বাগিয়ে জ্যামুক্ত তির ছোড়েন অভিনেত্রী। রুদ্ররসের জোয়ার আসে মঞ্চে।

নাটকটি সংলাপধর্মী হওয়ায় আখেরে সুবিধেই হয় চুমকির। রাম যখন সবার সামনে সীতাকে ফিরিয়ে দেন, তাঁকে মনুবাদী সংস্কারের পাকে বাঁধতে চান, তখন ‘হায় আর্যপুত্র!’ বলে নাটকের গতি ঘোরাতে পারেন তিনি। যখন বলেন, ‘তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে নটীর মতো অন্যের কাছে দান করতে ইচ্ছা করছো? তুমি ভুবনজয়ী বীর, আমি তোমার বিবাহিতা স্ত্রী। কিন্তু হে বীর! নীচজাতীয়া রমণীর মতো আমাকে এমন শ্রবণবিদারক এবং অনুচিত রূঢ়বাক্য শোনাচ্ছ কেন? তুমি আমাকে যেরূপ মনে করছো, আমি  সেরূপ নই, আমি তোমার কাছে নিজ চরিত্রের জন্যই শপথ করছি, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।’ স্বল্পপরিসরের মধ্যে সীতার মনের এত ভাংচুর আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে কি একটু তড়িঘড়ি করেন চুমকি? কী জানি! নইলে এর মর্মে পৌঁছতে আমাদের দেরি হয় কেন?  সেদিন আবার অগ্নিপরীক্ষার দৃশ্যায়নের সময় সেন্টার স্টেজে এমন সাদা আলোর দাপাদাপি হচ্ছিল যে, গান্ধারী দশা প্রার্থনীয় হলো। যিনি অঙ্গভাষার উনিশ-বিশে এমন কামিয়াব, তিনি যন্ত্রের এহেন বেয়াদবি সহ্য করেন কেন? মঞ্চের পেছনে ডানদিকের ধার বরাবর যন্ত্রীদের বসানো হয়েছিল। হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলার পাশাপাশি রণবাদ্যও ছিল দু-তিনটি। বাজনা মন্দ হয়নি। গান একটু চাপা ছিল। নইলে জাহিদুল কবির লিটনের সংগীত পরিকল্পনায় উপকরণের কমতি ছিল না। নানান রকমের মিশেল ছিল। মাপসই সেই মিশেল। দোহারকি জমে গেলে এ-নাটকের চেহারা আরো খুলে যাবে বিশ্বাস রাখি।

এ বিশ্বাস আরো পাকা হয়, যখন দেখি সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক দোটানায় পড়েও এমনসব নাটককে এমন করে বুকে টানতে পারে 888sport appsের 888sport live chatজগৎ।