অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আন্তোনভা বোনগার্দ-কতোৎস্কি রচিত এবং মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন শর্মার 888sport app download apk latest versionকৃত ভারতবর্ষের ইতিহাস একটি বহুলপঠিত বই। এ-বইটিতে মোগল যুগের 888sport live football প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কোকা আন্তোনভা লিখেছেন –
ওই যুগে 888sport live footballের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারাটি ছিল ‘ভক্তিবাদী’ কাব্য। আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে লিখিত লোকগীতিগুলো মধুর সুরে গেয়ে শোনাতেন ভক্ত কবিরা। আর সেগুলোর বিষয় হতো রূপক কাহিনি কিংবা তাঁদের ধ্যানলব্ধ উপলব্ধির কথা। ‘ভক্ত’ কবিরা মানুষের কাছে আবেদন জানাতেন জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করতে, তাঁরা ঘোষণা করতেন যে, ঈশ্বরের চোখে সকল মানুষই সমান এবং ধনী ভূস্বামী ও ধর্মীয় নেতাদের মমতা ও প্রতিপত্তিকে তাঁরা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপে জর্জরিত করতেন। … মোগল যুগের শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী কবিদের মধ্যে ছিলেন তুলসীদাস, রাজপুতনার অধিবাসী সুরদাস, রাজপুত মহিলা-কবি মীরাবাই, মহারাষ্ট্রের একনাথ, আসামের শঙ্করদেব এবং শিখ গুরুবৃন্দ। বাংলায় ওই যুগের দু’খানি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত চৈতন্যজীবনী কাব্য ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ এবং মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ আছে সে-যুগের বাংলার বাস্তববাদী জীবনচিত্র ও তার সঙ্গে মেশানো লোককথা ও অলৌকিক কল্পনা। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ‘ভক্তি’বাদ আরও বিকশিত হয়ে ওঠে বাংলার বৈষ্ণব গীতিকাব্যে – চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস ইত্যাদির পদচারণায় এবং সপ্তদশ শতকে জাতীয় সংগ্রামের আবেদনে পূর্ণ মারাঠা ও শিখদের গানে ও গাথাকাব্যে।
এই ভক্তিবাদী কাব্যধারার পথ ধরেই এসেছেন উনবিংশ ও বিংশ শতকের বাংলার মরমী লোককবিরা – অর্থাৎ লালন, হাসন, শরৎ, রাধারমণ, জালাল খাঁ প্রমুখ জননন্দিত সাধক-কবিরা। তাঁদের সবার কাব্যেই আন্তোনভা-উল্লিখিত সব বিশেষত্বই কমবেশি চোখে পড়ে। এই সাধক-কবিদেরই শেষ প্রজন্মের একজন, পূর্ব ময়মনসিংহের মরমী লোককবি জালাল উদ্দীন খাঁর পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো ৩১শে জুলাই – এ-দিনটিকে উপলক্ষ করেই আমার এ-নিবন্ধের অবতারণা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আমার পিতামহ, যাঁর প্রথম পুত্র চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের আধুনিক কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ছিলেন আমার পিতা। তাঁরা দুজনই নেত্রকোনার একটি নিভৃত পল্লীতে বাস করে তাঁদের 888sport live footballসাধনা চালিয়ে গেছেন।
জালাল উদ্দীন খাঁ জন্ম নিয়েছিলেন ১৮৯৪ সনের ২৫ এপ্রিল, তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার আসদহাটি গ্রামে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী আজ থেকে ২৮ বছর আগেই নিঃশব্দে পার হয়ে গেছে। তাঁর রচিত বেশকিছু জনপ্রিয় গান এখনো সবাইকে মুগ্ধ করলেও অনেকেই হয়তো এ-গানগুলোর রচয়িতা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেন না। বিগত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, আবদুল আলীম প্রমুখ জনপ্রিয় 888sport live chatী তাঁর কিছু গান রেকর্ড করেছিলেন – যার মধ্যে রয়েছে ‘ও আমার দরদী রে, আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না’, ‘আরে ও ভাটিয়াল গাঙের নাইয়া’, ‘দয়াল মুর্শিদের বাজারে, কেহ করে বেচাকেনা’, ‘সে পাড়ে তোর বসত বাড়ি রে, এ পাড়ে তোর বাসা’ ইত্যাদি। দশকের পর দশক অতিবাহিত হলেও 888sport appsের কৃষিভিত্তিক জনসমাজে এ-গানগুলো এখনো শ্রোতৃবৃন্দের মনে আবেদন বজায় রেখেছে।
দুই
জালাল উদ্দীন খাঁর ৭০২টি গান নিয়ে অধ্যাপক যতীন সরকারের সম্পাদনায় নন্দিত প্রকাশনী থেকে জালালগীতিকা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে (মার্চ) ২০০৫ সালে। মনস্বী বুদ্ধিজীবী যতীন সরকারের লেখা একটি দীর্ঘ ভূমিকা ‘বাংলা 888sport app download apkর মূলধারা ও জালাল উদ্দীন খাঁ’ গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। জালালগীতিকার ফ্ল্যাপে বইটি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিত দেওয়া হয়েছে –
‘দোহাকোষ ও চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, সহজিয়া 888sport live football, গাথা ও গীতির পরম্পরায় বাংলা888sport live footballের যে বেগবান ধারাটি দেশের অন্তরতম ঐতিহ্য এবং লোকজীবনের মর্ম-উৎসারী বহুমাত্রিক চর্চা ও সাধনার ধারক, জালাল উদ্দীন খাঁ সে-ধারারই একজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার লৌকিক জীবনবোধের ফল্গুধারায় নিষিক্ত, দেশজ জ্ঞান ও ভাবের আলোকচ্ছটায় দীপ্ত গভীর জীবনজিজ্ঞাসা ও প্রখর যুক্তির উৎসারণে এক সহজ মানবিকতার অভিসারী। বিশ শতকের উন্মেষলগ্ন থেকে পরবর্তী কয়েক দশকের নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় গানের যে বর্ণিল জগৎ তিনি গড়ে তুলেছেন, তা 888sport appsের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
কৃষিজীবী মানুষের মনোলোকে বিভা ছড়িয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ-গান তাঁদের প্রাণের গান। তবে আঞ্চলিক সীমারেখা ছাড়িয়েও তা আদৃত হয়েছে 888sport appsের সর্বত্র, এমনকি দেশের বাইরে বাংলাভাষী জনগণের কাছেও। আজ যখন উৎসের দিকে ফেরার, দেশ ও মানুষকে আরো গভীরভাবে বোঝার এবং ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার নতুন তাগিদ মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিন্তায় – তখন জালাল উদ্দীন খাঁর সঙ্গীতসম্ভার আমাদের কাছে আরো প্রাসঙ্গিক, আরো জরুরি। নিঃসন্দেহে তাঁর গানের মর্মগ্রাহিতা নতুন মাত্রা যোগ করবে আমাদের জীবনপ্রত্যয়ে, আমাদের চেতনা ও উপলব্ধিতে।
বইটির অন্য ফ্ল্যাপে উদ্ধৃত করা হয়েছে লোক888sport live footballের স্থিতধী চিন্তক, পশ্চিমবঙ্গের স্বনামখ্যাত লেখক সুধীর চক্রবর্তী-সম্পাদিত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত ইহবাদী লোকায়ত মানবমুখী বাংলা গানের সংকলন জনপদাবলির একটি উদ্ধৃতি –
‘জালাল অত্যন্ত জনপ্রিয় গীতিকার এবং বলিষ্ঠ মতবাদের মানুষ। তাঁর যুক্তিবাদী আধুনিক-মনস্কতা বিশেষভাবে তাঁর গানকে আকর্ষণীয় করেছে। জালালের গান আমাদের দেশের পরম্পরায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। … তাঁর গানগুলোর আলাদা টিকাভাষ্য লেখার প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁর রচনা খুব প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। … স্রোতের বিপক্ষে সর্বাধুনিক ভাবনা ছিল জালালের – ছিল সর্বাধুনিক ভাষা। … জালাল তাঁর গানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছেন। বিশ্বাস থেকে লিখেছেন :
হিন্দু কিংবা মুসলমান, শাক্ত বৌদ্ধ
খ্রিশ্চিয়ান
বিধির কাছে সবাই সমান পাপ-
পুণ্যের বিচারে।
জালাল শেষ পর্যন্ত মানবপন্থী, তাই বলতে পেরেছেন – ‘আরবে মক্কার ঘর, মদিনায় রসুলের কবর এবং বায়তুল্লায় শূন্যের পাথর, সবই মানুষের হাতের সৃষ্টি। এমনকি ফেরেশতা যেখানে যেতে পারে না, মানুষ সেখানেও গেছে।’
তিন
জালালগীতিকার পরিশিষ্টে রয়েছে কয়েকটি চিঠি। স্বনামখ্যাত আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ৬০, পাতলা খাঁ লেন থেকে ১৯.৩.১৯৪৯ তারিখে একটি চিঠিতে তাঁকে লিখেছেন – ‘আপনার প্রেরিত ‘জালালগীতিকা’ পাইয়াছি। একবার, দুইবার পড়িয়াছি। মুগ্ধ হইয়াছি, বিস্মিত হইয়াছি। কোন্ অজ্ঞাতনামা গ্রামে ফুটিয়া আপন সৌরভে আপনি মাতোয়ারা হইয়া রহিয়াছেন। আপনাকে লোকচক্ষুর অন্তরাল হইতে টানিয়া আনিয়া রেডিওর বুকে ছড়াইয়া দিতে চাই। গ্রামোফোনের প্লেটে বাঁধিয়া ঘর ঘর বিলাইয়া দিতে চাই। ইতিমধ্যে রেডিওতে আপনার গান গাহিয়াছি। দু’চার খান গান রেকর্ড করিতেছি। … আপনার আধ্যাত্মিক গান পড়িয়া সত্যই বুঝিয়াছি আপনি উঁচুদরের সাধক কবি। দূর হইতে আপনাকে সহস্র তসলিম জানাইতেছি।’
ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে কলকাতায় চলে যাওয়া কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য ছিলেন কবির বন্ধুস্থানীয়, যিনি কলকাতা থেকে তাঁকে চিঠিপত্র লিখতেন। তাঁর পুত্র কবি ও 888sport live footballিক পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যও (অতিসম্প্রতি ১০২ বছর বয়সে প্রয়াত) জালাল খাঁকে চিঠিপত্র লিখতেন এবং তাঁর সম্পাদিত পত্র-পত্রিকা পাঠাতেন। জালালগীতিকায় মুদ্রিত তাঁর একটি ১৪-১২-১৯৬৬ তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেন – ‘এইবার একটি কাজের কথা বলি, বোলপুর স্টেশনের নিকটবর্তী জয়দেব কেন্দুলি গ্রামে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির সময় বাউলদের বার্ষিক মেলা হয়। এ বছর সেই সময় সেখানেই আমাদের সমিতি ‘সারা বাংলা 888sport live football মেলা’র ৩য় বার্ষিক সম্মেলন হবে। ১৩ জানুয়ারি শুক্রবার ইদুল ফেতরের দিন থেকে ১৫ জানুয়ারি রবিবার পর্যন্ত ৩ দিন এই সম্মেলন হবে। সে সময় আপনি অনুগ্রহ করে এই সম্মেলনে আসুন। … আমাদের সম্মেলনে লোক888sport live football ও সংস্কৃতি শাখার অধিবেশনে আপনাকে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আপনার চিঠির অপেক্ষায় রইলাম।’
বইটিতে তাঁর আরো একটি অসাধারণ 888sport live footballগুণসমৃদ্ধ চিঠি রয়েছে। পিতা জালাল খাঁর মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে আমার আব্বা তাঁকে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তার উত্তরে ২৭-৯-১৯৭২ তারিখে কলকাতার মান্নাপাড়া রোড থেকে তিনি লিখেছেন –
‘হাকিম, তোমার চিঠি পেলাম। কৈশোরেই আমি বাউল গানের ভক্ত হয়েছিলাম – এর জন্য জালালদা এবং আমার বাবার প্রভাবই দায়ী। জালালদা ও বাবার সম্পর্কটা কুষ্টিয়া-ছেউরিয়ার লালন সাঁই এবং শিলাইদহের রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করতে পার। কিংবা আরো আগের হরিদাস সাঁই ও শ্রী চৈতন্যের সম্পর্কের সঙ্গে, এমনকি সুদূর অতীতের কবি জয়দেব ও জালাল মখদুম শাহের সম্পর্কের সঙ্গে। আমি নিশ্চয়ই লোকগুলোর সঙ্গে তুলনা করছি না, – কেবল সম্পর্কগুলির তুলনা করছি। এই জাতীয় সম্পর্কগুলির জন্যই ইতিহাসে ‘দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে’ ব্যাপারটা ঘটেছে ও ঘটতে পারে। বাউল গান এই মিলনের ফল ও বীজ দুই-ই।
‘ছেলেবেলাতেই রাধাকৃষ্ণের তত্ত্ব জানতাম : পূর্ণতার আরেক নাম রাধা। সেই পূর্ণ থেকে এই জগৎটা ভ্রষ্ট হয়ে অক্ষম আয়ান ঘোষ হয়ে আছে। কিন্তু এই জগতের অন্তর্যামী কৃষ্ণ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবার পূর্ণতার দিকে অভিসার করছেন। তাঁর ফুটে উঠার বিরাম নেই, শেষ নেই। তাই তিনি চিরশিশু, চিরকিশোর। আবার অবচেতন প্রাণীদের মধ্যে রু´িনী মন ফুটেছে, সচেতন মানুষরা এসেছে। মানুষদের মধ্যে আবার গোপী বোধি ফুটেছে, মহাপুরুষরা আবির্ভূত হয়েছেন, হচ্ছেন। এমনিভাবে স্বর্গের সিঁড়ি বাঁধা হচ্ছে। এমনিভাবে জগতের অন্তর্যামী কৃষ্ণ আবার পূর্ণতার আলিঙ্গনে ফিরে আসছেন। কিন্তু কুব্জা-প্রাণের লক্ষণগুলি নিয়ে রাধাকে পাওয়া যায় না। নর-দেহ ধারণ করেও যদি প্রাণীস্বভাবের চিহ্নগুলি কেউ ধারণ করে – রাধিকা বিমুখ হন, মান করেন, ধরা দেন না। ইত্যাদি।
‘লায়লা-মজনুর তত্ত্ব যেদিন জানলাম, সেদিন আমার কী আনন্দ! লায়লা সেই রাধিকা, নওফেল সেই কুব্জা স্বভাবের প্রাণী, সালাম বাদশা সেই রু´িনী মনের মানুষ, মজনু সেই গোপী বোধির মহাপুরুষ – পূর্ণতা তারই অপেক্ষায় থাকে। প্রাচ্য ভূখণ্ডের দুই প্রান্তে একই পূর্ণতার অভিসারের কথা সুফী গজলে ও বৈরাগীর একতারায় প্রকাশ পেয়েছে, এ-সত্যটা জানাই আমার কাছে এক আবিষ্কার। জালালদা আমাকে এই আবিষ্কারে সাহায্য করেছিলেন।
‘আজকাল সেক্যুলার রাজনীতির, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা খুব শুনি। কিন্তু বাউলরা আধ্যাত্মিকতাকেও ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলেছিলেন। তাঁদের কৃতিত্বটা একবার ভেবে দেখো। আজকাল গণমুখী কথাটার খুব কদর। কিন্তু বাউল গান জিনিসটা গণসংগীত ছাড়া আর কী? ওদের চাইতে বিপ্লবীই বা কে? যারা দেহটাকে মন্দির-মসজিদ বলে দাবি করে, অন্তর্যামী জীবন দেবতাকে জীবনের গভীরেই বিশ্বাস করে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকেই নামাজ-রোজার মর্যাদা দেয়, তাদের চাইতে বড় বিপ্লবের কথা কে কবে বলেছে? শরিয়ত-তরিকতের চাইতে হকিকত-মারফত-এর মূল্য তাঁরাই সর্বাগ্রে ঘোষণা করেছেন।
‘ওরা মনো888sport apkেরও অগ্রদূত। প্যাভলভ বলেন, শরীরটাই সব এবং শরীরের অভ্যাসটাই আত্মা। ফ্রয়েড বলেন – শরীর নয়, প্রাণ ও প্রাণের তাড়নাই সব। অ্যাডলার বলেন – দেহ প্রাণ নয়, মনের অহমিকাই মুখ্যশক্তি। ইয়ং বলেন – ওসব নয়, বোধিই নিয়ামক শক্তি। – কিন্তু এই মরমীয়ারা বলেন, আমরা সবাই চারতলা বাড়ি; একতলায় দেহ, দোতলায় প্রাণ তথা কুব্জা-নওফেল, তেতলায় মন তথা রু´িনী-সালাম, চারতলায় বোধি তথা গোপী-মজনু। এই মালটি-পারসোন্যালিটির মাঝে লাঠালাঠি থামাতে হলে চাই, – দেহের শুদ্ধি বা নাছুৎ, প্রাণের শুদ্ধি বা লাহুৎ, মনের মার্জনা বা মালকুৎ, বোধির প্রতিষ্ঠা বা হাউৎ – তবেই তৌহিদ বা পূর্ণতার সঙ্গে একত্ব।
‘চিঠি আর বাড়াব না। উপেন ভট্টাচার্যের বাংলার বাউল ও বাউল গান বইটা আমাদের অফিস লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আমি পড়েছি, তাছাড়া উল্লেখযোগ্য সব সূফী সাধকদের সম্পর্কেও অল্পবিস্তর পড়াশুনা ও গবেষণা দীর্ঘকাল যাবত করেছি, করছি। তাই জালালদাকে বুঝতে আমার অসুবিধা হবে না। তুমি যদি উপাদানগুলি দিয়ে সাহায্য কর, তবে সানন্দে আমি জালালদা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হব।’
চার
একান্তই যে ব্যক্তিগত শোককে বুকে ধারণ করে যৌবনেই গৃহত্যাগ করে তিনি সংসার-বিরাগী হয়েছিলেন, পত্নী-বিয়োগের সে-শোক কিছুটা প্রশমিত হলে তিনি হয়তো উপলব্ধি করলেন যে বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি তাঁর অন্বিষ্ট হতে পারে না। তাই শিশুপুত্র ও কন্যাকে ফেলে চলে যাওয়া সে-সংসারে তিনি আবার ফিরে এলেও সংসার তাঁকে আর স্থিতি দিতে পারেনি। সংসারের গরল তিনি পান করেছেন এক নীলকণ্ঠের মতোই নির্লিপ্তভাবে। কবিজীবনে তিনি যেমন তাঁর ব্যক্তিগত কামনা-বাসনাকে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিস্ময়াভিভূত চিন্তাকে রূপ দিয়েছেন গানে, তেমনি তাঁর পারিপার্শ্বিক প্রাকৃত সমাজে বসবাসকারী অধিকার-বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকেও। সাধারণ্যে তাঁর পরিচিতি ছিল এস্টাব্লিশমেন্ট ও যাজকতন্ত্রের কঠোর সমালোচক একজন প্রথাবিরোধীর।
প্রথাবিরোধীরা কোনো সমাজে আদৃত হন না – অন্তত সে-সমাজের স্থিতাবস্থার রক্ষক শ্রেণির কাছে। আর তাঁর বেলাতেও এটা ঘটেছে। ধর্মের বাহ্যিক আচারসর্বস্বতা সম্পর্কে অনীহ এ-মানুষটি কখনই তাদের প্রিয়পাত্র ছিলেন না।
‘ধর্মমতে এ জগতে দলাদলিই কেবল সার’, অথবা ‘মানুষ পড়ছে কী গোলমালে/ পাপী যারা স্থান লয়েছে ধর্মগাছের আড়ালে’, কিংবা ‘আমি একটা জেতে মরা, পঞ্চভূতে দেহ গড়া/ মধ্যে একটা বাতাস ভরা, তার কী আবার হিসাব লবে?’ ইত্যাদি গানসমূহে (শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর ভাষায় ‘বিস্ফোরক মন্তব্যসহ’) প্রথাসিদ্ধ ধর্মকে যখন আঘাত করেন, তখন ধর্মরক্ষকদের বিরাগের কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। জালাল খাঁ যখন ঈশ্বর-বন্দনার আগে মানব ও মানবতার বন্দনাকেই জরুরি বিবেচনা করেন, অতিবর্তী কঠোর-স্বভাব ঈশ্বরের বেঁধে দেওয়া অনুশাসন না মেনে সংবেদনশীল এক দয়ালু ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করেন, তাতেও তাঁরা খুশি হতে পারেন না। পাপীর দয়া পাওয়ার অধিকার রয়েছে মনে করেই ‘পূণ্যের ঘরে শূন্য দিয়া, জালাল উদ্দীন আছে বইয়া/ শূন্যে শূন্য মিশাইয়া দিতে পারলেই হয় যে তার’ – এই অমোঘ বাক্যটি বলে নিশ্চিন্ত রয়েছেন তাঁর অন্তিম দিনটির প্রতীক্ষায়। আর জালাল খাঁর এই নিশ্চিন্তির কারণ তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় – ‘কী ছুরত বানাইলে খোদা রূপ মিশায়ে আপনার/ এই ছুরত দোজখে যাবে, যে বলে সে গোনাগার।’
ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিনগুলো, অর্থাৎ গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ায় তাঁর সংগীত-সাধনা ও কবিজীবন শুরু হলেও তাঁর রচনায় রাজনীতির সরাসরি প্রভাব ততটা উচ্চকিত নয়। অন্য আর দশজন লোককবির মতো তাঁর গানেও গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও সমাজচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা প্রধান হয়ে ওঠেনি। সমাজচিন্তা ও দেশকালের সমসাময়িকতা তাঁর অনেক গানেই দেখা যায় – জন888sport free bet সমস্যা থেকে ম্যালেরিয়া কিংবা কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব নিয়েও তিনি গান লিখেছেন। এগুলো তাঁর বইয়ে লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব ইত্যাদি সর্গে বিন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁর রচনার মধ্যে বিশিষ্ট হলো আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মাতৃতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি সর্গে স্থান পাওয়া গভীর দার্শনিকতাপূর্ণ গানগুলো। এসব গানে ছড়িয়ে রয়েছে দেশকাল ছাড়িয়ে মহাকালের পরিসরে ব্যক্তির অবস্থান, সৃষ্টির দুর্জেয় রহস্য, স্রষ্টা ও সৃষ্টির আপাত-দুর্বোধ্য সম্পর্ক, পাপপুণ্য ইত্যাদি বিষয়। ইহজাগতিকতার বিপরীতে যাকে বলা হয়ে থাকে পরকাল বা পরজগৎ, সে-জগতের অস্তিত্ব ও স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর সন্দেহবাদী মন ছিল সর্বদাই প্রশ্নকণ্টকিত। আর তাই বিধাতা নামক কঠোর এক নায়কের স্বেছাচারকে তিনি অবলীলায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন – ‘আমায় তুমি দোষী বল, তুমি কি আর বেশি গুণী?/ তুমি হয়তো আমায় চিন, আমিও তোমায় কিছু চিনি।’ অথবা ‘খোদা তুমি আছ আমার মনমন্দিরে বসিয়া/ তবে কেন মোর শক্তি সাহস দিন দিনে যায় খসিয়া?’ অন্যদিকে পাপ-পুণ্যের বিচার প্রসঙ্গে ওমর খৈয়ামের মতোই প্রশ্ন করেছেন – ‘উপাসনা করলে পরে স্বর্গ যদি ভাগ্যে ঘটে। সে কি হবে দয়া তোমার, মজুরীর ওই পাওনা বটে।’ এ কোন জগৎ, যখন জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় আমাদের অমোঘ ভবিতব্য? ‘জন্ম দিয়াই সঙ্গে পাঠাও আজলের এই অভিশাপ/ খেয়ালের বশে জালাল শেষে করে যদি কোন পাপ/ তাও তুমি করবে না মাপ, বাপরে বাপ গোলকধাঁধায় পড়েছি। পাপে তোমার দুনিয়াই ঘেরা পাপছবি তাই এঁকেছি।’ আবার স্রষ্টার বিশালতার বিপরীতে ক্ষুদ্র মানুষের কৃত পাপপুণ্যের তুচ্ছতা নিয়ে লিখেছেন আত্মবিশ্বাসের সুরে – ‘পাপীর আছে তোমার কাছে দয়া পাইতে অধিকার/ পাপ করে না জন্মে যে জন ভাগী নয় সে করুণার।’
পাঁচ
জনপ্রিয় গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, বেদারউদ্দিন, সোহরাব হোসেন প্রমুখের সঙ্গে জালাল উদ্দীন খাঁ পঞ্চাশের দশকেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। এছাড়া ষাটের দশকে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হয়েছিল বলে শুনেছি। এসব সাক্ষাৎকালেও তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য ও দৃপ্তভঙ্গি অক্ষুণ্ন ছিল বলে তাঁর সংগীতের বর্ণনায় শুনেছি। কৃষি সমাজের মানুষের সারল্য ও অকপটতা তাঁর চরিত্রে এক ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছিল, তাই 888sport appর এই সুধীমণ্ডলীতে পল্লীপ্রান্তনিবাসী জালাল উদ্দীন খাঁর বিচরণে কোনো সংকোচ বা জড়তা ছিল না। 888sport live chatী আব্বাসউদ্দীন চল্লিশের দশকে ও আবদুল আলীম পঞ্চাশের দশকে তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন, যেগুলো দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখনো জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। পরবর্তীকালে 888sport live chatী ফেরদৌসী রহমান, নীনা হামিদ, বিপুল ভট্টাচার্য, সুবীর নন্দী প্রমুখ 888sport live chatীও তাঁর বেশকিছু গান গেয়েছেন।
দাদা নিজেও ছিলেন একজন জনপ্রিয় পারফর্মার – তাঁর যৌবনে, অর্থাৎ তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, 888sport appর আনাচে-কানাচে তিনি বাউল গান গেয়েছেন। এ-সময়টিতে তাঁর নাম জানত না, এমন লোকজন খুব কমই ছিল। ভাটি এলাকায় আয়োজিত গানের আসরে জলের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া তাঁর সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ শুনে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন নদী সাঁতরে আসরে চলে আসতেন বলে শুনেছি। 888sport appর আহসান মঞ্জিলে গান গাওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং সারারাত গান গেয়ে সেখানে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন বলেও শুনেছি।
888sport appsের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালেই তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটে, আমরা লক্ষ করি যে, তাঁর জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। বাহাত্তর সালের ৩১শে জুলাই সন্ধ্যারাতের প্রথম প্রহরে তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে ছিলেন, তখন তাঁর শিয়রে বসে থাকা এক শিষ্যকে বললেন – ‘আমি এখন ঘুমাবো, তুমি আমাকে বাতাস করো।’ সে শিষ্য বাতাস করতে করতেই দেখেন যে তাঁর দেহ নিষ্পন্দ। এভাবেই ঘুমের মধ্যে, নির্বিকার প্রশান্তির মধ্যে ঘটে তাঁর অনন্তলোকে যাত্রা। তাঁর একটি গানে যেমনটি রয়েছে – ‘সমাধির পূণ্যগর্ভে দেহ যখন হইবে লীন/ আর কি বাকি থাকবে আমার আসতে ভবে কোনও দিন?/ কাতরে কয় জালাল উদ্দীন এই খেলা পাতিসনে আর।’ আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ভবের বাজারে আসা-যাওয়ার এই খেলা থেকে জালাল উদ্দীন খাঁ এভাবেই বিদায় নিয়েছেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.