মহসিন হামিদের উদ্বাস্ত বিশ্ব

হাসান ফেরদৌস

পাকিস্তানি লেখক মহসিন হামিদের সঙ্গে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ – নাকি সংঘর্ষ! একবারই হয়েছে, বছর চারেক আগে নিউইয়র্কে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে তিনি এসেছিলেন তাঁর 888sport alternative link রিলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট-অবলম্বনে নির্মিত একই নামের ফিল্মের এক বিশেষ প্রদর্শনীতে। সঙ্গে ছিলেন সেই ফিল্মের পরিচালক মিরা নায়ার।

রিলাক্ট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট বইটি যারা পড়েছেন তারা জানেন মহসিনের এই 888sport alternative linkের নায়ক একজন সচ্ছল পাকিস্তানি-মার্কিন যুবক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর সে বৈষম্যের শিকার – এ-ধারণার বশবর্তী হয়ে কিছুটা অনিচ্ছাতেই স্বদেশে ফিরে আসে। এতদিন সে নিজেকে একজন ধোপদুরসন্ত আমেরিকানই ভেবে এসেছে, কিন্তু ট্রেড সেন্টারের ঘটনার পর টের পেল সবার চোখে সে একজন মুসলমান ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই নায়ক টেলিভিশনে ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হওয়ার বদলে কিঞ্চিৎ উৎফুলস্ন­ হয়েছিল। ফিল্মেও দেখলাম সে মুখ টিপে হাসছে। ফলে, যুবকটি যতটা আমেরিকান, তার চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান, এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই। নিজেকে সে একজন পশ্চিমা মানসিকতার আধুনিক বলেই মনে করে, তাঁর মৌলবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই, অন্ততপক্ষে তাঁর নিজের মনে। কিন্তু নিউইয়র্কে তাঁর সহকর্মীদের চোখে সন্দেহভাজন হওয়ায় হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসে স্বদেশে। স্বদেশ মানে পাকিস্তান, যেখানে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে ধর্ম রক্ষার নামে, যেখানে কার্যত প্রতিটি মানুষ ধর্মের নামে খুন করতে প্রস্ত্তত। এই পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে মহসিনের নায়ক কালাশনিকফ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছে অধ্যাপনা করে, শামিন্তর কথা শোনায়।

888sport alternative linkটি পড়ার সময় আমার মনে তেমন কোনো তীব্র ক্ষোভ জাগেনি, কিন্তু সিনেমার পর্দায় তা দেখে আমার কার্যত বিবমিষার উদ্রেক করেছিল। ফিল্মটি প্রদর্শনের দিনতিনেক আগে বস্টনে ঘটে  গেছে এক মর্মামিন্তক সন্ত্রাসী হামলা। চেচনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী দুই জঙ্গি যুবকের হাতে বোমা হামলায় নিহত হয় তিনজন, মারান্তকভাবে আহত হয় শ-দুয়েক। মহসিনের নায়কের মত এই দুই যুবকও যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে, সামাজিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় নিজেদের পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছে। হয়ত তারাও ‘রিলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট’, অজ্ঞাত কোনো ক্ষোভ থেকে প্রবল অনিচ্ছায় বোমা নিক্ষেপে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধাস্তে পৌঁছেছে।

মহসিন হামিদের নায়ক আমেরিকায় অধ্যয়নের সুযোগ পেলেও  সে-দেশের ইতিহাসের বর্বরতম হামলায় নিরীহ মানুষ ও আক্রান্ত এই দেশটির সঙ্গে সংহতি প্রদর্শনের বদলে সে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংহতি বোধ করে একদল খুনে, যাদের কাউকেই সে চেনে না।  মানছি, এই ঘটনার জন্য সে দায়ী নয়; কিন্তু একজন নাগরিক হিসেবে এই নির্মম বর্বরতার সে যে একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যুবকটির মধ্যে এই প্রত্যয়ের বিন্দুমাত্র প্রভাব আমি দেখি না। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা ঠেকাতে তাঁর কোন দায়-দায়িত্ব থাকতে পারে, তারও কোনো প্রকাশ নেই। এই নির্লিপ্ততার একটি বাসন্তবসম্মত ব্যাখ্যা সম্ভব। বস্ত্তত, মৌলবাদের পক্ষাবলম্বন অথবা তার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ, উভয়ই একটি মানসিক ‘কন্সট্রাক্ট’, এর পেছনে থাকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নৈতিকতার প্রভাব। দড়ির কোন ধারে আপনি, লেখক, নাগরিক অথবা ছাত্র, যাই হোন না কেন, এই বহুপক্ষীয় নৈতিকতার অলক্ষ্য আবরণে তার গঠনগত নির্মাণ। মহসিন তাঁর চরিত্রের ভেতর দিয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেন এই বিভক্তির কোন ধারে তিনি।

বস্টন হামলার তিন দিন পর এই ফিল্ম দেখার পর আমি নিজের ক্রোধ আটকে রাখতে পারিনি। কিছুটা তপ্ত স্বরেই আমি  মহসিনকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, মৌলবাদের ক্ষতিকর ধর্মীয় আইডিওলোজির কেশাগ্র স্পর্শ না করে যে-কাহিনি তিনি নির্মাণ করেছেন, তা মৌলবাদের পক্ষে একটি দুর্বল ‘অ্যাপোলোজি’ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই কাহিনি আর যাকেই মুগ্ধ করুক, আমাকে করেনি। আমি 888sport appsের লোক, সেখানে আপনার দেশের নেতারা ধর্ম রক্ষার নামে কী খা-বদাহন ঘটিয়েছিল, তা আমরা ভুলে যাইনি, যাবোও না। আমরা এ-কথাও ভুলিনি যে, আপনারা, সে-দেশের  লেখাপড়া জানা মানুষ, তাতে নীরব সম্মতি জানিয়েছিলেন।

মহসিন খুশি হননি আমার কথায়, আমার ইতিহাসপাঠের সঙ্গে তাঁর মতান্তর রয়েছে, সে-কথা উল্লে­খ করে বলেছিলেন পরে মুখোমুখি আলাপ হলে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলবেন। আরো কী বলেছিলেন আমার তা আর মনে নেই, আমি তখন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলাম। সেই মহসিন হামিদের নতুন 888sport alternative link একজিট ওয়েস্ট হাতে নিয়েছিলাম কিঞ্চিৎ দ্বিধায়, কিঞ্চিৎ অবিশ্বাসে। ইতোমধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় এই বইয়ের প্রশংসা পড়েছি, নিউইয়র্ক টাইমসের মিচিকোকাকুতানি তো বলেই বসেছেন এই বইতে একটি শব্দও অতিরিক্ত নয়। ‘এটিই মহসিনের সেরা বই’, তিনি রায় দিয়েছেন। অতএব পড়তেই হলো।

এটি ঠিক, 888sport alternative linkের পরিচিত কাঠামো অনুসরণ করে রচিত হয়নি। কিছুটা বাসন্তব, কিছুটা কল্পনা, কিছুটা ম্যাজিক, সব মিলিয়ে 888sport alternative linkের কাঠামো ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক ম্যানুফেস্টো তিনি নির্মাণ করেছেন, যার মূল সেস্নাগান, আমরা সবাই উদ্বাস্ত্ত। ঘটনার সূত্রপাত গৃহযুদ্ধ-কবলিত কোনো একটি দেশের প্রধান নগরে। অনুমান করি এবং মহসিনের বর্ণনা অনুসরণ করলে সে-অনুমান প্রমাণযোগ্য। এটি পাকিস্তানের করাচি নগর। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধকবলিত এক নগর। কেন এই গৃহযুদ্ধ, কে কোন পক্ষে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটি তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের একটি নগর হতে পারে, মহসিন সম্ভবত আমাদের সে-ইঙ্গিত দিতেই তাঁর পরিচিত নগরের নামটি উহ্য রেখেছেন। নিজ দেশ ও নগর নিয়ে তিনি বিব্রত, এমন সম্ভাবনা থেকেও সে-নাম উহ্য  রেখেছেন, এমনও হতে পারে।

তো, এই অজ্ঞাতপরিচয় যুদ্ধবিধ্বসন্ত নগরে এক যুবক ও যুবতী নাদিয়া ও সায়ীদ ঘটনাচক্রে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয় ও প্রেমে পড়ে। গল্পের এই শুরুটা মোটামুটি পরিচিত, বলা যায় প্রথামাফিক, ‘বয় মিটস গার্ল’ ধাঁচের। নাদিয়া বা সায়ীদ কেউই ঠিক আমাদের পরিচিত পাকিস্তানি নয়। তারা ডেট করে, একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে মাদক সেবক করে ও যখন খুশি সঙ্গমে মিলিত হয়। যে-অ্যাপার্টমেন্টে নাদিয়া একা বাস করে, বোরখা পরে, সে-ঘরে ঢুকতে সায়ীদকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। এমনকি নিয়মচারী ধার্মিক পিতার কথা মাথায় রেখেও সায়ীদ এক সময় নাদিয়াকে নিজের ঘরে তুলে আনে। বাইরে কারফিউ, হরহামেশা পড়ছে বোমা, কাচের শার্শিতে এসে লাগছে গুলি, যখন-তখন লোডশেডিং। তার মধ্যেই ভালবাসা জন্ম নেয়।

বেশ, এ-পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। হঠাৎ মারা যায় সায়ীদের মাতা, পাশাপাশি তেতে ওঠে গৃহযুদ্ধ, চোখের সামনে গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায় প্রিয় স্বজনের। এই নির্দয় সময়ে এখানে বসবাস সম্ভব নয়, এতএব পালাও। কোথায় তাঁরা পালাবে, কীভাবেই বা পালাবে? গ্রন্থের বাকি অংশ – বস্ত্তত তার সিংহভাগ – এ দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কেটে যায়।

গ্রন্থের প্রথম পর্বটিতে মহসিন বেশ বাসন্তবধর্মী একটি চালচিত্র নির্মাণ করেন, কিন্তু বাকি পর্বসমূহে তিনি ব্যসন্ত থাকেন এক ‘ডিস্টোপিয়’ পৃথিবীর বহিরাবরণ নির্মাণে। বহিরাবরণ বলছি, কারণ এই পর্যায়ে সময় অথবা স্থানের সুনির্দিষ্টতা নেই, গল্পে যেসব চরিত্র আশ্রয় পায়, তাদের কোনো নাম নেই – বোধগম্য কোনো আন্তপরিচয়ও নেই। তারা সবাই উদ্বাস্ত্ত। তাঁদের দুর্দশার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই বটে, কিন্তু মনোজগতের চেহারাটি টের পাই না।  সায়ীদ ও নাদিয়ার সম্পর্ক – যা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে, তারা একে অপরকে ত্যাগ না করলেও ভালবাসার উত্তাপ হারায়, অন্যত্র ভালবাসার সন্ধান পায়। একমাত্র এই দুজনের ভেতর দিয়েই আমাদের বিশ্বের তাবৎ উদ্বাস্ত্তর মনোজগৎকে চিনতে হয়।

মহসিনের 888sport alternative linkে যেসব উদ্বাস্ত্তর সঙ্গে আমাদের নামমাত্র পরিচয় হয়, তারা সবাই তৃতীয় বিশ্বের কোনো না কোনো দেশের, আশ্রয় খুঁজছে ইউরোপের কোনো দেশে, অথবা শেষ পর্যন্ত আমেরিকায়। দেশ ছাড়া সহজ নয়, কিন্তু সকল সম্ভাব্য উদ্বাস্ত্তর জন্য রয়েছে একটি ম্যাজিক দরজা, যে সে-দরজার খোঁজ জানে এবং তার কপাট খুলতে যে রেসন্ত চাই তা জোগাড়ে সমর্থ, তারা সে-দুয়ার ভেঙে খিড়কিতে এলেই উন্নতবিশ্ব। নাদিয়া ও সায়ীদ প্রথমে আশ্রয় পায় গ্রিসে, সেখান থেকে ইউরোপের একাধিক দেশ ঘুরে ইংলন্ডে। আরো অনেক পরে,  টেমস নদীতে বিসন্তর জল ঘোলা হবার পর, আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোতে।

এসব উদ্বাস্ত্ত যেখানেই আশ্রয় পায়, মহসিনের বিবরণ অনুসারে তাঁদের বিসন্তর বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হলেও আশ্রয় ঠিকই মেলে। সঙ্গে খাদ্য, এমনকি কাজের সুযোগও। নানান দেশের নানা কিসিমের মানুষ, তাঁদের মধ্যে হিংসা আছে, দ্বেষ আছে, আবাস ও খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে। শেষমেশ মোটামুটি মিলমিশ করে
থাকার সুযোগ জুটে যায়। স্থানীয় লোকজন ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই সুনজরে গ্রহণ করে না, লন্ডনে তাদের ওপর নজরদারির জন্য ড্রোনের সাহায্যে চৌপ্রহর পাহারারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে কেবল সাময়িক দুর্ভোগ। এক দরজা ছেড়ে আরেক দরজা গলিয়ে তারা অন্যত্র চলে আসে, এক সময় নতুন, সুস্থ ও সম্ভাবনাপূর্ণ জীবনের পত্তনও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়।

মহসিন হামিদের গল্পের এই হাড়মাস থেকে একটি রাজনৈতিক প্যারাবল নির্মাণ সম্ভব, কিন্তু একটি অর্থপূর্ণ 888sport alternative link সম্ভব কিনা আমি জানি না। তিনি উচ্চাভিলাষী লেখক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কাহিনির ভিত্তি বর্তমানে হলেও এই গল্প আগামীকালেরও, প্রায় অর্ধশতক ধরে যার বিসত্মৃতি। মহসিন হয়ত আমাদের বলতে চাইছেন, এই উদ্বাস্ত্ত সমস্যা আমাদের পিছু ছাড়ছে না, একে প্রত্যাখ্যান না করে বরং তা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়, সেদিকেই উন্নত বিশ্বের উচিত মনোযোগ দেওয়া। 888sport alternative linkের শেষ বাক্যে মহসিন আমাদের এমন কথাও বলেন, ‘We are all migrants through time.’ সময়ের পরিক্রমায় আমরা সবাই উদ্বাস্ত্ত।

কেউ কেউ তাঁর এই কথায় আশাবাদের ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন, আমি পাইনি।

গৃহযুদ্ধপীড়িত মানুষ নিজ গৃহে আশ্রয়হীন হলেও ভিনদেশে এসে আশ্রয় পায়, অনুমান করি লিব্যারাল পাঠক-সমালোচকের কাছে সেটিই আশাবাদের বার্তাবহ। কিন্তু আগামী বিশ-পঁচিশ-পঞ্চাশ বছর বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-বিবাদ লেগে থাকবেই, আর তা এড়াতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ‘ম্যাজিক দরজা’ খুলে লন্ডন-প্যারিস-সান ফ্রান্সিস্কোয় এসে বসতি গড়ে তুলবে, সেটি আমার কাছে কোনো আশাবাদের মানচিত্র নয়। পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হবে, সিরিয়ায় শামিন্ত ফিরবে,  সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ শেষ হবে, একটা সময় আসবে যখন কেউ আর নিজ গৃহ ত্যাগ কিরে উদ্বাস্ত্ত হবে না।  এমন একটি পরিবর্তিত সম্ভাবনার আশাচিত্র যদি তিনি দেখাতে পারতেন, তাহলে তাকেই আমি আশাবাদ বলতাম।  বলতাম, তিনি ব্রেখটের বলা সেই লেখক  যে বাসন্তবকে হাতুড়ি দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে নিজের বিশ্বাসের আদলে নতুন করে নির্মাণে সমর্থ।

মহসিনের এ-888sport alternative link নিয়ে আমার অন্য সমস্যা, উদ্বাস্ত্ত সংকট ও অব্যাহত অভিবাসনের ফলে ইউরোপে ও যুক্তরাষ্ট্রে যে শ্বেত জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছে – যা কোথাও কোথাও দ্রুত ফ্যাসিবাদে পরিণত হচ্ছে – মহসিন সে-বাসন্তবতা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। কেউ কেউ বলবেন এতে তাঁর নিজের ইতিবাচক মানবিকতা প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে তাঁর ইতিহাসবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এ-কথা অগ্রাহ্য করাও কঠিন। উদ্বাস্ত্তর আশ্রয় ও অভিবাসন উভয়ই যে মানবাধিকার, সে-সম্ভাবনার স্বীকৃতি বিষয়েও ওয়াকিবহাল নন  মহসিন।

গ্রন্থটি পাঠ শেষে আমার এমন বোধ জন্মেছে যে, মহসিন প্রকৃত  কোনো উদ্বাস্ত্তর অভিজ্ঞতার সঙ্গে আদৌ ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত নন। যারা দেশ ছাড়ে, তার পেছনে থাকে বহুবিধ আর্থিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সংকট। এর সবগুলি যে সবসময় আন্তপক্ষ সমর্থন যোগ্য, তাও নয়। সে-বিতর্কে না গিয়ে এটুকু বলা যায়, অধিকাংশ উদ্বাস্ত্তর জন্য আসলে কোনো সহজ ম্যাজিক-দরজা নেই। ম্যাজিক-দরজা দিয়ে নয়, নড়বড়ে ডিঙি নৌকায় অথবা গভীর জঙ্গলে জান বাজি রেখে তাঁদের ভিন দেশে ঘর খুঁজতে বেরুতে হয়। তাঁদের সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়, মরুভূমি অতিক্রম করতে হয়, সীমান্তপ্রহরীর গুলি খেয়ে মরার ভীতি অগ্রাহ্য করতে হয়। কখনো – অথবা হরহামেশাই – মরতেও হয়। উদ্বাস্ত্তদের আশ্রয়ের ও নিরাপত্তার খোঁজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছেঁড়া ঠোঙার মত ভেসে বেড়াতে হয়। মহসিনের উদ্বাস্ত্তদের সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করতে হয়েছে, তেমন  বোধ সঞ্চারিত হয় না।

এই ডিটেইলের অভাবকে কেউ কেউ অর্থপূর্ণ টেকনিক বলে তার স্বাগত জানিয়েছেন। একজন বলেছেন, একজন উদ্বাস্ত্ত যেভাবে  রোদ-বৃষ্টি-শীত-খরতাপ-ক্ষুধার নির্মম যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে এক অনিশ্চিত ঠিকানা ছেড়ে অন্য অনিশ্চিত ঠিকানায় আশ্রয় খুঁজে নেয়,  মহসিন সে-বাসন্তবতা উপেক্ষা করে ‘নির্বাসনের মনোচিত্র’ নির্মাণে অধিক আগ্রহী। কথাটা ইতিবাচক অর্থেই বলা। আমার জিজ্ঞাস্য, যে-মনোচিত্র তিনি নির্মাণ করলেন তাতে যন্ত্রণাময় শারীরিক –  ফিজিক্যাল  – অভিজ্ঞতা যদি না থাকে, কীভাবে সে-অভিজ্ঞতা পাঠকের আস্থাভাজন হবে?

একটি বৈশ্বিক মানচিত্র নির্মাণ করতে যেয়ে মহসিন নিজেকে একটি পাখিতে পরিণত করেছে। পাখি যদি লেখক হত তাহলে নিকট-দূর থেকে দেখা এক লহমার দৃশ্যচিত্র দিয়ে হয়ত একটা 888sport alternative linkই লিখত। হায়, তাকে 888sport alternative link না বলে বড়জোর বলা যায় শুধু ‘কথা, কথা আর কথা’। r