মহুয়াপূর্ণিমা আর কালো বিড়াল

জোছনার ছলাৎ ছলাৎ জলের মধ্যে কাজলা মাছের মতোন চিকচিকিয়ে ওঠে মহুয়ার গতর। ঘর থেকে ঠিকঠাক মতোন বেরিয়ে পড়েছে, ভাবতেই ধলা চামড়ার তলার লহুতে শিরশিরে এক আমোদ, পাশের বাঁশঝাড়ে আজ বকপক্ষি ঝাপটা-ঝাপটি করেও খামোকা ডর দেখাচ্ছে না।

এই কদিন আগেও যে ছিল দুডানাওয়ালা … ওড়ো … ওড়ো … ক্ষেত, প্রান্তর, আসমান ডিঙ্গিয়ে, মনার সাথে ভেদহীন কিল-থাপ্পড়।

এরপরই হঠাৎ এক ধলপহরে, যখন চিল্লিয়ে মোরগ গলা ফাটাচ্ছে, পায়ের পাতা বেয়ে জলের নহর, ঘুমের বিভ্রম কাটিয়ে, ছিঃ পেশাব? কী শরম…? কেমনে? এই ঘোর গেলে দেখে, তার আসমানের মতো বিশাল স্বাধীনতার প্রান্তর ছেড়ে ফ্রকের নিচে লাল রক্তের নহর পায়ের পাতা স্পর্শ করছে।

টের পেয়ে, যে-কোনো কারণেই সারাক্ষণ ভীত মা বাজপাখির মতোন কিশোরী কন্যাকে দুডানার নিচে ঢুকিয়ে ফেলে।

দুইদিন ঘরবন্দি মহুয়ার কানে মায়ের কোনো কথা যায় না। পাজামা আর তেনানেড়ির ফাঁদে আটকে সে হাঁসফাস করে।

কুন ব্যাটা কুমতলব দিলে সব্বোনাশ!

মার এ জাতীয় কথারও মাথামুণ্ডু না বুঝে সে তখন হাঁ করে, যেন বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে, এই মুখ করে মা’র দিকে তাকিয়ে থাকে, মা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে শিলপাটার ঘষাঘষি দিয়ে জানায়, এই সম্পোক্যের মইদ্যেই দুনিয়ায় পুলাপান আহে, বিবাহের পরে আইলে হেই বাচ্চা লক্ষ্মী … আগে আইলে … মাইয়াগো এই রক্ত আইলেই সাবধান হওনের বয়স। ছটফট করে জীবনের ওই বয়সে আর সত্য জানতে চায়নি সে, বিমূঢ়বিস্ময় ঢেকুর গিলে তার আত্মা জানতে চেয়েছে … আর মনা?

মা-কি তার আত্মার কথাও শব্দের মধ্যে শোনার শক্তি অর্জন করে ফেলেছে? মহুয়ার বেণি করে করে শেষ ডগায় ফুল বানাতে বানাতে বলে, অহন কিন্তু মনাও একজন মরদ।

কী কয় মা? ডাকাতের মতো, ইয়া বড় মোচওয়ালা

কুদ্দুইস্যা খপ করে একদিন মহুয়ার দেহটাকে একহাতে শূন্যে তুলে হাঃ হাঃ করে হেসেছিল! আরেকটু সেয়ান হ, তরেই বিয়া করুম, আমার মতো মরদ দশ গেরামে পাইবি না।

আর ওই কচি লাউডগার মতো তিরতির কম্পমান ছেলে, যাকে চান্দের ঘোর টানে, খোয়াবের ঘোর টানে, হেই মনাও মরদ?

না … না … তাকে আর মনাকে নিয়ে প্রকৃতি এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রে নেমেছে। দুদিন আটকা থেকে বুনোঝোপের দিঘির কাছে, যেখানে মনা সারাক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে, সেখানে এসেও তার তাই মনে হয়, যে মনা ঘণ্টা ঘণ্টা তার জন্য অপেক্ষা করে, আজ সে নেই …। পুকুরের মাঝখানে পদ্মফুলের মধ্যে ইয়া বড় ফড়িং … এমন বহুবর্ণ ফড়িং মহুয়া জীবনে দেখেনি … এক ঘোর আচ্ছন্ন টানে সে নেমে পড়ে জলে।

প্রচণ্ড ব্যথায় ঘুলিয়ে ওঠে বমি। মনার কথা মনে হয়, তুই তাকাতো মহুয়া? তাকাতো। মনা বলতো, তোর চোখ খায়া ফালতে ইচ্ছে হয়।

মহুয়া অবাক, ক্যান?

ও বলতো, তোর চোখ শালুকের মতোন।

মানুষের ক্যান সব খাইতে ইচ্ছা হয়? মহুয়া ভেবে আকুল, পশু, ঠোঁট-রং, দেহ – ক্যান কতা এমুন – তোর গাল আপেলের … ঠোঁট কমলার কোয়া …? একদিন ওই জান্তব মরদ কুদ্দুসটা পর্যন্ত – চোখ বুঁজে … আহা! মহুয়ার ঘেরান, খায়া ফালতে ইচ্ছা হয়।

সেদিন ফড়িংটা উড়ে গিয়েছিল, বাড়ি এসে মহুয়া খেয়েছিল বেদম বকুনি, একবার এক ফাঁকে যে মনাকে পেয়ে ভেঙে পড়েছিল, আমার ঠ্যাংয়ের রশি খুইল্যা দে… স্বপ্নাতুর ছেলে দেখিয়েছিল মুক্তির জীবন – দূর পাহাড়ে পূর্ণিমার রাতে মহুয়ার গাছ থেকে সে ছুরির ফালি দিয়ে বের করবে মহুয়ার কষ … সেই কষ চান্দের আলোর সাথে মিশিয়ে খেলে আর পরাধীনতা থাকবে না মহুয়ার – এটা মনা স্বপ্নে দেখেছে।

সে-ই আজ অতি সাবধানে ঘর থেকে বেরোলো। ধু-ধু জ্যোৎস্নার জলের ওপর ভাসছে আস্ত গ্রাম … তারই জলের ওপর সাঁতার কেটে কেটে মুক্ততার স্বপ্নে মহুয়ার প্রাণে ডর নেই। সামনে কাঁটাঝোপ, কলাই বন, স্তব্ধ গেরামের অচিন ধোঁয়া … আর কদ্দুর পাহাড়? যত এগোয় … ততই দূর … খোলা জায়গা পেরিয়ে বটগাছের নিচে খানিকটা ঢলে পড়ে সে জিরোয় …। মনা কি গাছের কষ বের করছে? অসাড় দেহে কিছুক্ষণ শুকনো পাতার ওপর শুয়ে থেকে ফের দাঁড়ায়। হুহু শীতবাতাস গতরে লাগে না। প্রথম রাত্রির রক্তমাংস আহার করছে মধ্যরাত … আর নিজে যেন সদ্যভূমিষ্ঠ … এই গ্রাম … চরাচর সব নতুন … পা ঘষটে ঘষটে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে এগোতে এগোতে নাকে সে পায় অপূর্ব ঘ্রাণ … কোনোদিন এতদূরে আসা হয়নি। আশ্চর্য! তার নামেই এই গ্রামে গাছ আছে? ওইতো … পাহাড় … হঠাৎ কানে ফিসফিসানি … দুম করে পেছন দিকে তাকায় … না, কেউ নেই, এক খাবলা বাতাস … এতক্ষণে টের পায়, মাথার ওপর চন্দ্রের স্তন থেকে যেন খসে পড়েছে এক ফোঁটা দুগ্ধ! আর কঠিন শীত। চুল ভেজা কেন? হে আল্লাহ! বৃষ্টি পড়ছে না-কি? সূরা পড়তে পড়তেই বৃষ্টির এসেই চলে যাওয়া টের পায়, না-কি স্নায়ুর বিভ্রম! সোয়েটারে কষে উঠতি স্তন আটকায়, স্তন তো নয়, ব্যথার বিষফোড়া। নিজের ভুলহাত কখনও ওখানে পড়ায় কতবার নিজেই কঁকিয়ে উঠেছে।

দূরে পাতার মতো উড়তে উড়তে কেউ আসছে … কালো মতো কী … কাছে আসতেই কী গভীর চোখ! … মনার পোষা বিড়াল। মহুয়াকে যে কী ভালোবাসে! চান্দের আলোয় ওর কালো রোমগুলো চকমক করছে।

মহুয়ার সব ক্লান্তি মুছে যায়… বিড়ালটি আহ্লাদে ওর কোলে রগড়াচ্ছে… ওকে কোলে নিয়ে মহুয়ার কাছে আসতেই… পাগল ঘ্রাণে আচ্ছন্ন মনাকে শুয়ে থাকতে দেখে। পাহাড়তো নয়, টিলা। তারপরও মরাটে পাহাড়টি এই রাত… এই আলোয় রহস্যময় …। এই মনা … মনা … কানের কাছে ফিসফিস করে মহুয়া … এই? ফজর হইয়া যাইবো, চান্দ নিইভ্যা যাইবো … কষ কই? মনা উঠে পরীর মতো ঘুরে ঘুরে নাচছে … মহুয়ারে মহুয়া তর অত ঘেরান।

খাইতে ইচ্ছা হয়?

ধেৎ! পাগল হইতে ইচ্ছা লয়।

হাঁপ ছাড়ে মহুয়া … হাছাই, কেউ আমারে আর ঘরে বাইন্দা রাখবো না? কী পাপ করছি আমি? ক্যান তর লগে দৌড়ানি শেষ?

মনা আগের মতোনই মহুয়ার বেণি ধরে টানে … হি … হি হেসে স্তব্ধ প্রকৃতিকে হঠাৎ চমকে দেয়।

মনা … তাড়াতাড়ি দে, অহন আমার ডর করতাছে।

আয় … বলে মনা ওর হাত ধরতেই কেমন অজানা একটা অনুভব নিজের শরীরে টের পায় মহুয়া … মনাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই জন্যেই? সে দ্রুত নিজের হাত গুটিয়ে যেন বিবি হাওয়া, অজানা গন্ধমের গাছের দিকে এগিয়ে যায়, এ-কী গাছের তলায় কুণ্ডুলী সাপ কেন? মনা … মনা … মনার আধছেঁড়া ফতুয়ায় কাঁপতে কাঁপতে মুখ লুকায় মহুয়া …।

পুরুষের মতো এইবার হাঃ হাঃ হাসি মনার, কই সাপ? এই মহুয়া? দাদির কাছে আদম-হাওয়ার কাহিনী শোনা মহুয়া ভয়ে ভয়ে গাছের তলায় তাকায়, লতানো পরগাছা। নিজেকে যেন হঠাৎ মহুয়ার চেয়ে অনেক সেয়ান হয়ে গেছে টের পেয়ে খুকি মহুয়াকে টানতে টানতে মনা চন্দ্রালোকিত বিশাল পাহাড়ের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, হুনলাম, তুই ডাঙ্গর হইছস? হের লাইগ্যাই …। তুই তো দেহি আরো পোলাপান হয়া গেছস …ল, কষ বাইর করি … ফনফনে সোনালি আলোয় ছুরি বের করতেই মুহূর্তে ওদের সম্মুখে দৈত্যের মতো এক জীবন্ত পাহাড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনার হাত থেকে একটানে সে ছুরি ছিনিয়ে নেয়। মহুয়ার মৃত স্নায়ুগ্রন্থিগুলো চিরিক দিয়ে ওঠে। পড়তে পড়তে টাল খেয়ে মহুয়া দেখে, চারপাশে জ্যোৎস্না তো নয়, আজব আগুন।

কুদ্দুস নিঃশব্দে মহুয়ার মুখ চেপে ধরে। চারপাশে সটান চোখ যায়, মনার ছুটন্ত পালাতে যাওয়া দেহ …। প্রথমে দুই বিষফোড়া গলাতে থাকা কুদ্দুসের আঙুল … না … না চাঁদ নয়, মৃত্যুর আগের পিশাচ লাল রক্ত দিয়ে পাহাড়, মাটি, মহুয়াবনকে রক্তাক্ত করে তুলছে সূর্য। স্তদ্ধ বনভূমিতে ফের মহুয়ার কানে নিজ গোঙানির শব্দ। কুদ্দুস বলে, কথা কইলে কল্লা ফাঁক।

প্রথমে মনে হয় মাটির ওপর নিজের দেহটাকে দোমরানোর শব্দ পেয়ে পাতাগুলো হিসহিস করছে, ওরা বাতাসকে বলছে … হায়! হায়। এই সব কী … না, মা-কে ডাকছে কোনো শিশু, আর প্রাণান্তকর নিশ্বাস ফেলছে আমার পায়ে দড়ি বান্দো … মা, দাদিগো, পুলসেরাত পার হইতে পারি নাই … দোযখ-আগুনের কড়াই-তেলে পইড়া গেছি …। সামনে ইয়া বড় বড় সাপ বুড়ো মহুয়া গাছটাকে খাবলে ধরেছে … মা’র ফিসফিস সাবধান বাণী … বাচ্চা হইয়া যাইবো … চন্দ্র-আলোয় মহুয়ার সদ্যভূমিষ্ঠ বাচ্চাটাকে আসমানে তুলে ধরেছে কেউ … পৃথিবীতে যন্ত্রণা কারে বলে …? নিশ্বাস বন্ধ করে মহুয়া এই প্রশ্নের অনুভবে পুড়তে পুড়তেই টের পায়, মরদটার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছে কেউ …।

প্রভাতে প্রকৃতি দেখে, এক রক্তাক্ত 888sport promo codeর ওপর একটি রক্তাক্ত কালো বিড়াল মরে পড়ে আছে।