মাতৃত্বের স্বজ্ঞা

888sport app download apk latest version : পরাগ চৌধুরী

আমার ধারণা লোরা বোধহয় বিশ্বরেকর্ডধারী।

লোরার কাচ্চা-বাচ্চা মোট আটজন।

এতে অবাক হবার কী আছে?

এই আটটা বাচ্চার বাবা সাতজন।

বুঝুন এবার!

লোরার কাছেই আমার বায়োলজির প্রথম পাঠ। সে থাকত আমাদের পাশের বাসায়। আর আমি তাকে খুব গভীরভাবে লক্ষ করতাম।

আমি দেখতাম মাসের পর মাস তার ভুঁড়িটা কেবল ঠেলে উঁচু হয়ে উঠছে।

শেষে অল্প কিছুদিন আর তাকে দেখা যেত না।

আবার যখন তার দেখা পেতাম তখন সে পুরোপুরি চ্যাপ্টা চ্যাটানো।

মাস কয়েকের মধ্যেই তার ফুলে-ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়াটা আবারও শুরু হয়ে যেত।

আমার কাছে এটা ছিল পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য এবং এজন্য আমি সবসময়ে লোরাকে লক্ষ করতাম। তার কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা নিয়ে লোরা সবসময়েই খোশমেজাজে থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করে লোরা বলত, ব্যাপারটা আবার হচ্ছে। কিন্তু কি জানো প্রথম তিন-চার বারের পরে এটা তোমার অভ্যেস হয়ে যায়। অবশ্য ব্যাপারটা খুবই বাজে উপদ্রব একটা। এজন্য সে ঈশ্বরকে দোষারোপ করত আর পুরুষ মানুষের দুর্বৃত্তপনার কথা বলত। তার প্রথম ছয়টা বাচ্চার জন্য সে ভিন্ন ভিন্ন ছয়জন পুরুষকে পরখ করে দেখেছিল।

হাট বলত, কিছু কিছু মানুষকে খুশি করা বড় কঠিন।

কিন্তু আমি আপনাদের এমন ধারণা দিতে চাই না যে, লোরা সারাটা সময় বাচ্চা পেটে নিয়ে আর পুরুষের নিন্দা করে আর নিজের জন্য দুঃখবোধ করে কাটাত। মিগেল স্ট্রিটে বোগার্ট যদি হয় সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ, তো লোরা হচ্ছে সবচেয়ে প্রাণবন্ত। লোরা ছিল সর্বক্ষণই হাসিখুশি এবং সে আমাকে খুব পছন্দ করত।

ঘরে প্লাম বা আম থাকলে আমাকে ডেকে এনে খেতে দিত। কখনো চিনির কেক বানালে তা-ও দিত।

এমনকি আমার মা, যিনি হাসাহাসি একদম পছন্দ করতেন না Ñ বিশেষ করে আমার Ñ তিনিও লোরার সঙ্গে হাসতেন। মা প্রায়ই বলতেন, আমি বুঝি না তোকে নিয়ে লোরার এত আদিখ্যেতা করার কারণ কী? মনে হয় যেন তার যথেষ্ট ছেলেপিলে নেই।

মনে হয় আমার মা ঠিকই বলত। লোরার মতো মেয়েদের কখনোই অনেক ছেলেপিলেও যথেষ্ট মনে হয় না। বাচ্চাগুলোকে সে খুব ভালোবাসত, অবশ্য সে যে-ভাষায় বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলত তাতে তার ভালোবাসায় সন্দেহ হতে পারে। এ-যাবৎ যত গালাগাল এবং শাপান্ত আমি শুনেছি তার মধ্যে লোরার গুলো আমার কাছে সবচেয়ে মহার্ঘ মনে হয়েছে। আমি এগুলো কোনোদিন ভুলব না।

হাট বলত, বাপধন, শব্দ ব্যবহারের বেলায় লোরা একেবারে শেকস্পিয়রের মতো।

লোরা হাঁক দিয়ে বলত, ওরে হোঁৎকামুখো বর্বর আলউইন, এদিকে আয়। অথবা, গ্যাভিন, এক্ষুনি যদি এখানে না আসিস তো তোকে আগুন-পাদিয়ে ছাড়ব, শুনলি? অথবা ওরে ব্যাঁকা-ঠেঙী কালো কুত্তী লোরনা, যা করছিস তা কি চেয়ে দেখে করতে পারিস না?

এখন, আট বাচ্চার মা লোরাকে আট বাচ্চার মা চীনা মেরির সঙ্গে তুলনা করা যুক্তিযুক্ত না। কারণ মেরি তার বাচ্চাগুলোকে ভয়ানক যত্ন করত এবং কখনোই তাদের সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলত না। কিন্তু লক্ষ করুন, মেরির একজন দোকানদার স্বামী ছিল, যার দরুন বাচ্চাদের পেট ঠেসে চৌমিন, চৌফেন কি চপস্যুয়ে খাওয়ানো সম্ভব ছিল। তাই তার পক্ষে বাচ্চাদের প্রতি মার্জিত এবং মিহিন হওয়াও সম্ভব ছিল। কিন্তু লোরা তার বাচ্চাদের ভরণ-পোষণের জন্য কার দিকে তাকাবে? সন্ধেবেলায় যেসব পুরুষ লোরার বাড়ির পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে শিস দিত তারা লোরার বাচ্চাদের জন্য কোনো রেস্ত দিত না, তারা শুধু লোরাকে চাইত।

আমি একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, লোরা টাকাপয়সা পায় কোথায় মা?

আমার মা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা চড় মেরে বললেন : মানুষটা তুই ছোট, কিন্তু এত পাকা পাকা কথা বলিস কেন, হ্যাঁ? Ñ তখন আমি সবচেয়ে খারাপ কিছু একটা সন্দেহ করলাম।

তবে সেটা সত্য হোক এ আমি চাই না।

একদিন আমি হাটকেও জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, লোরার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে যারা বাজারে বিক্রিবাট্টা করে। ওরা তাকে বিনা পয়সায় জিনিসপত্র দেয়, আবার অনেক সময় তার আগের একজন দুজন কি তিনজন স্বামীও কিছু কিছু দেয়। তবে সেটা অবশ্য খুব বেশি না। সমস্ত ব্যাপারটায় সবচেয়ে অদ্ভুত হলো লোরা নিজে। লোরা সুন্দরী ছিল না। বয়ই একদিন বলেছিল যে, লোরার মুখটা ঠিক মোটরগাড়ির ব্যাটারির উপরের দিকটার মতন।

লোরা ছিল গোলগাল নাদুসনুদুস।

আমি যখনকার কথা বলছি তখন সে মোটে ছয় বাচ্চার মা।

একদিন হাট বলল, লোরার একজন নতুন সঙ্গী জুটেছে।

সবাই হেসে উঠল, বাসি খবর। যদি সম্ভব হতো তাহলে লোরা শহরের প্রতিটি পুরুষকে একবার চেখে দেখত।

হাট বলে, আরে না। সত্যি সত্যি লোকটা লোরার সঙ্গে সবসময় থাকার জন্য এসেছে। আজ সকালে গরু বের করার সময় আমি তাকে দেখেছি।

আমরা লোকটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

পরে শুনলাম লোকটাও আমাদেরকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

তার নাম নাথানিয়েল। অল্প সময়ের মধ্যেই সে মিগেল স্ট্রিট দলের একজন হয়ে উঠল। কিন্তু এটা খুব পরিষ্কার ছিল যে, সে আসলে আমাদের নয়। পোর্ট অব স্পেনের পূর্বাঞ্চল – যাকে আমরা নোংরাতম জ্ঞান করতাম, সে ওখান থেকে এসেছে। তার ভাষা-ব্যবহারও ছিল খুব বাজে রকম।

সে আমাদের আভাসে জানাল যে, পূর্বাঞ্চলের পিকাডেলি স্ট্রিটের আতঙ্ক ছিল সে। দলবেঁধে মারামারি করার অনেক গল্প বলল সে আমাদের। এটাও সবাইকে জানিয়ে দিল যে, সেখানে দুতিনজনকে সে বিকলাঙ্গ করে ছেড়েছে।

হাট বলল, বুঝেছিস, আমার মনে হয় লোকটা ডাহা মিথ্যে কথা বলছে। আমি নিজেও অবশ্য অবিশ্বাস করলাম। লোকটা দেখতে বেঁটেখাটো। আমি   সবসময় ভাবতাম বেঁটে লোকগুলো বজ্জাত আর হিংস্র হয়। তবে আমাদের সবচেয়ে খারাপ লাগত মেয়েদের প্রতি তার মনোভাব। আমরা কেউই রমণীরসিক ছিলাম না, কিন্তু নাথানিয়েল যেভাবে মেয়েদের অবজ্ঞা করত সেটা আমাদের পছন্দ ছিল না। মেয়েরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে খুব ইতর মন্তব্য ছুড়ে মারত।

নাথানিয়েল বলত, মেয়েমানুষ হচ্ছে গাইয়ের মতো। গাই আর মেয়েলোক একই জিনিস। মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী মিস রিকাউড পথ দিয়ে যাবার সময় নাথানিয়েল মন্তব্য করত, দেখ দেখ বড় গাইটা যাচ্ছে। এটা কোনো সুরুচির পরিচয় না। আমরা ভাবতাম মহিলা এত বেশি মোটা যে তাকে নিয়ে হাসাহাসি উচিত নয়, তার প্রতি দরদ দেখানো দরকার। নাথানিয়েল প্রথম দিকে আমাদের বিশ্বাস করাতে চাইত যে সে জানে কী করে লোরাকে ঠিক রাখতে হয়। সে ইঙ্গিত করত যে, সে মাঝে মাঝে লোরাকে উত্তম-মধ্যম দেয়। সে বলত, মেয়েমানুষ মাত্রই ভালোমাত্রায় লাঠৌষধ চায়। ক্যালিপসো (যে-কোনো খবরের আকর্ষণীয় বিষয়-অবলম্বনে লেখা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লোকগীতি) কী বলেছে জানো?

‘দাও পিট্টি যখন তখন

মারো আছাড় ইচ্ছে মতন

মুখে কালশিটে হাঁটুর তোলো ছাল

তখন সে তোমায় ভালোবাসবে চিরকাল।’

কথাটা মেয়েদের সম্পর্কে ধর্মপুস্তকের মতো সত্য।

হাট বলে, সত্য কথা বলতে কি, মেয়েরা খুবই আশ্চর্য। আমি বুঝি না লোরার মতো মেয়ে নাথানিয়েলের ভেতর কী দেখেছে?

এড্ডোস বলে, আমি মেয়েদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। আমার মনে হয় নাথানিয়েল ডাহা মিথ্যে কথা বলছে। লোরার কাছে গেলে নিশ্চয়ই এই ব্যাটার ন্যাজখান দুই ঠ্যাঙের ভেতর সেঁধিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ওদের ঝগড়াঝাঁটি এবং ভয় পাওয়া বাচ্চাদের তীক্ষè চিৎকার কান্নাকাটি শোনা যেত। নাথানিয়েলের সঙ্গে দেখা হলে বলত, পিটুনি দিয়ে ওকে কিছু কাণ্ডজ্ঞান শেখাবার চেষ্টা করছিলাম।

হাট বলে, কি আশ্চর্য, পিট্টির পরে লোরাকে একটুও বিষণ্ন কী মন খারাপ দেখাচ্ছে না!

নাথানিয়েল বলে, হাসি-খুশি থাকার জন্যই সে আসলে পিটুনি চায়। নাথানিয়েল অবশ্য মিথ্যে কথাই বলছিল। সে নয়, লোরাই তাকে নিয়ম করে পিট্টি দিচ্ছিল। সত্যি কথাটা বেরিয়ে এল সেদিন যেদিন নাথানিয়েল হ্যাট মাথায় দিয়ে চোখের কোনার কালশিটে 888sport appর চেষ্টা করে।

এড্ডোস বলে, মনে হয় মেয়েরা ধরেই নিয়েছে যে ক্যালিপসোর গান বাঁধা হয়েছে ছেলেদের লক্ষ করে।

 ছোট্ট এবং প্যাঁটকা এড্ডোসের ওপর একদিন ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করে নাথানিয়েল। হাট বলে, যাও, গিয়ে লোরাকে ধরার চেষ্টা করো। আমি লোরাকে চিনি। তোমাকে তার সঙ্গে রাখার জন্য এখনো সে তোমাকে অল্পস্বল্প উত্তম-মধ্যম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যখন তার ধৈর্য শেষ হবে, তখন তুমি কুইট্টা দৌড় দিও, বৎস।

আমরা প্রার্থনা করতে থাকি যে, এমন কিছু একটা ঘটুক যাতে নাথানিয়েল মিগেল স্ট্রিট থেকে ভেগে যেতে বাধ্য হয়।

হাট বলে, আমাদের বেশিদিন ধৈর্য ধরতে হবে না। লোরার পেটে আট মাসের বাচ্চা। আর মাসখানেক, তার পরেই নাথানিয়েল ফুড়ুত।

এড্ডোস বলে, এক্কেবারে সত্যি সত্যি রেকর্ড। এক মায়ের সাতটা বাচ্চার সাতটা ভিন্ন ভিন্ন বাপ।

লোরার বাচ্চা জন্ম নিল।

দিনটা ছিল শনিবার। ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় আমি লোরাকে তার উঠানের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। পরদিন সকাল আটটায় তার বাচ্চা জন্মাল। আর কী আশ্চর্য, মাত্র দুঘণ্টা পরে লোরা আমার মাকে ডাকাডাকি করতে লাগল।

আমি লুকিয়ে দেখতে থাকি।

লোরা জানালার চৌকাঠে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছে। তার সারা মুখে আমের হলুদ রস লেপ্টে আছে।

সে মাকে বলে, সকালে আমার বাচ্চা হয়েছে।

মা শুধু বলল, ছেলে না মেয়ে?

 লোরা বলে, আমার কপাল কেমন তুমি জানো না? মন্দ কপালী আমি। আবার একটা মেয়ে হয়েছে। ভাবলাম তোমাকে জানাই। আচ্ছা, যাই এবার। সেলাই পড়ে আছে।

 সেই বিকেলেই মনে হলো হাট যা বলেছে তা বোধহয় সত্যি হতে যাচ্ছে। লোরা ফুটপাথে নেমে এসে চিৎকার করে ডাকল : এই নাথানিয়েল, এদিকে আসো।

হাট বলে, কিন্তু ব্যাপারটা কী বলো দেখি, আজকেই না সকালবেলায় ওর বাচ্চা জন্মেছে।

নাথানিয়েল আমাদের সামনে বাহাদুরি দেখাবার চেষ্টা করে বলে, আমি এখন ব্যস্ত। আসতে পারব না।

লোরা একটু এগিয়ে আসে। তার আচরণ লড়াইয়ের পূর্বক্ষণ। সে বলে, আসতে পারবে না? পারবে না? এসব কী শুনছি আমি?

নাথানিয়েলকে এবারে চিন্তিত দেখা গেল। বেচারা আমাদের সঙ্গে কথা বলার ভান করে, কিন্তু সে কেবল আবোল-তাবোল বুকনি।

লোরা বলে, তুমি মনে করো তুমি একখান পুরুষমানুষ? আমাকে পুরুষালি দেখাতে হবে না। শুনতে পাচ্ছ? হ্যাঁ, নাথানিয়েল আমি তোমাকেই বলছি। প্যান্টের ভেতর দুইখান বাসি পাউরুটির মতো পোঁদওলা নাথানিয়েল, তোমাকেই বলছি।

লোরার গালাগালের চরম এটা। আমরা সকলেই হাসতে শুরু করি। সেটা দেখে লোরা নিজেও হাসিতে ফেটে পড়ে।

হাট বলে, এই মেয়েটা আসলেই কেইস একটা।

কিন্তু বাচ্চা জন্মানোর পরেও নাথানিয়েল মিগেল স্ট্রিট থেকে সটকে না পড়ায় আমরা সবাই অল্পবিস্তর দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ি।

হাট বলে, সাবধান না হলে এবারে লোরা একই পুরুষ থেকে দুটো বাচ্চা পাবে।

নাথানিয়েলের চলে না যাওয়াটা অবশ্য লোরার দোষ নয়। ভালোই মারপিট করছে সে আজকাল, এক্কেবারে প্রকাশ্যেই।

অনেকসময় তাকে বাইরে রেখে লোরা দরজা তালাবন্ধ করে দেয়। আমরা তখন ফুটপাতে ছিলাম বলেই নাথানিয়েলের অনুনয়-বিনয় কান্নাকাটি ও তোয়াজের মিষ্টি কথাগুলো শুনতে পেতাম, লোরা ডার্লিং, শুধু আজ রাতের মতো, লক্ষ্মীটি লোরা, একবার ঘরে ঢুকতে দাও। শুধু আজ রাতের মতো আসতে দাও লোরা সোনামনি। Ñ আজকাল নাথানিয়েল আর লোরাকে শায়েস্তা রাখার ভান করে না। আমাদের আড্ডাতেও আসে না। সেজন্য আমরা খুব খুশি। হাট বলত, যে শুকনা নদী থেকে সে উঠে এসেছে সেখানে সে ফিরে যাচ্ছে না কেন? এটাই আমি বুঝতে পারি না। ওদিকটায় কোনো শিক্ষা-সংস্কৃতি নেই, ওখানেই তো তার সুখে থাকার কথা।

কেন যে সে থেকে গেল এটা আমিও বুঝতে পারি না।

হাট বলে, কিছু পুরুষ আছে যারা মেয়েদের লাথিগুঁতা খেতে ভালোবাসে।

এদিকে দিন-দিনই নাথানিয়েলের ওপর লোরার রাগ চড়তে থাকে।

একদিন শুনি লোরা বলছে, তুমি মনে করেছ একটা বাচ্চা দিয়েই তুমি আমাকে কিনে ফেলেছ? বাচ্চাটা আসলে এসেছে দুর্ঘটনাক্রমে, বুঝেছ?

লোরা তাকে পুলিশের ভয়ও দেখায়।

নাথানিয়েল বলে, কিন্তু আমি চলে গেলে তোমার বাচ্চাদের কে দেখবে?

Ñ সেটা আমার মাথাব্যথা। তোমাকে এখানে আর চাই না। তুমি হলে খানা খাবার আরেকটা মুখ মাত্র। যদি তুমি এক্ষুনি না যাও আমি গিয়ে সার্জেন্ট চার্লসকে ডেকে আনব। Ñ শেষে পুলিশের ভয়েই নাথানিয়েল ভেগে গেল।

কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেল সে।

কিন্তু ততদিনে লোরা আবার ফুলতে শুরু করেছে।

হাট বলে, হা ঈশ্বর! এক পুরুষ দিয়ে দু-দুটো বাচ্চা?

মিগেল স্ট্রিটের একটা আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এখানে কেউ ভুখা থাকে না। যদি কাগজ-পেন্সিল নিয়ে টেবিলের সামনে বসে ব্যাপারটা বের করার চেষ্টা করো, পারবে না। কিন্তু আমি মিগেল স্ট্রিটে বাস করি বলে তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি এখানে কেউ উপোস করে না। হয়তো কেউ কখনো উপোস করেও, তবে এ-কথা কেউ শুনিনি। লোরার বাচ্চারা বড় হয়ে ওঠে।

বড় মেয়ে লোরনা সেন্ট ক্লেয়ারের এক বাসায় ঝিয়ের কাজ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকভিন স্ট্রিটে এক লোকের কাছে টাইপ শেখাও শুরু করে।

 লোরা বলত, দুনিয়াতে শিক্ষার মতো আর কিছু নেই। আমি চাই না আমার বাচ্চারা আমার মতো হোক।

সময় হলে বরাবরের মতো অনায়াসে লোরা তার অষ্টম বাচ্চার জন্ম দিল। এটাই তার শেষ সন্তান।

 লোরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অথবা পুরুষসমাজের প্রতি তার আবেগ-ভালোবাসা হারিয়ে গেছে Ñ ব্যাপারটা এমন না। বাস্তবিক, লোরার যেন বয়স বাড়ে না, তার আনন্দ-উচ্ছ্বাসেও ভাটা পড়ে না। আমার মনে হতো সুযোগ পেলে লোরা অবিরাম একটার পর একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারত।

বড় মেয়ে লোরনা একদিন টাইপ শিখে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে তার মাকে জানাল, মা আমার বাচ্চা হবে।

সেই রাতে লোরার মর্মন্তুদ আর্তনাদ আমি শুনেছি।

এবং সেই প্রথমবারের মতো আমি লোরার কান্না শুনলাম। সেটা যে-সে কান্না নয়। মনে হলো জন্ম থেকে যত কান্না তার জমা হয়েছিল সব বুঝি একসঙ্গে বেরিয়ে আসছে। তার হাসি-আনন্দ দিয়ে যত কান্না এতকাল সে ঢেকে রেখেছিল তা যেন আজ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আমি মানুষকে অন্ত্যেষ্টিতে কাঁদতে দেখেছি, কিন্তু মনে হয়েছে সেখানে কিছুটা লোক দেখানো কান্নাও থাকে। কিন্তু সে-রাতে লোরার কান্না আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়েছে। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা একটা অর্থহীন বেদনাময় জায়গা এবং লোরার সঙ্গে সঙ্গে আমিও প্রায় কাঁদতে শুরু করি।

মিগেল স্ট্রিটের সবাই সেদিন লোরার কান্না শুনেছে।

পরের দিন বয়ই বলে, আমি বুঝলাম না এটাতে এত পাগল হবার মতো কী হলো? লোরা নিজেও তো এই কাজই করেছে।

হাট এ-কথায় এত বিরক্ত হলো যে, কোমর থেকে চামড়ার বেল্টটা খুলে বয়কেই দিল এক বাড়ি।

আমি ঠিক বুঝলাম না কার জন্য আমার দুঃখ বেশি হলো Ñ লোরা না লোরনা?

এরপর থেকে মনে হলো লোরা বুঝি সবার সামনে লজ্জা পাচ্ছে। পরের বার আমি যখন তাকে দেখলাম আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, এই সেই লোরা, যে অনর্গল হাসতে পারত আর মাঝে মাঝে আমাকে চিনির কেক খাওয়াত।

আজকাল সে একজন রীতিমতো বৃদ্ধা মেয়েমানুষ।

ইদানীং আর সে বাচ্চাদের বকুনি দেয় না, পিটুনিও না। আমি জানি না সে কি ওদের বেশি যত্ন নিচ্ছে,  না-কি তাদের উপর আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু আমরা কখনো শুনিনি সে লোরনাকে সামান্যও ভর্ৎসনা করেছে।

সেটা বড় ভয়ঙ্কর।

লোরনা একদিন বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এটা নিয়ে মিগেল স্ট্রিটে কোনোরকম পরিহাস-রসিকতা হলো না।

লোরার বাড়িটা যেন মৃত, নিঃশব্দ পুরী।

হাট বলে, জীবনটা দারুণ, তুমি দেখতে পাচ্ছ ঝঞ্ঝাট একটা আসছে, কিন্তু সেটার আসা বন্ধ করার জন্য তুমি সামান্য কিছুও করতে পারবে না। শুধু বসে বসে দেখতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে।

তারপর সেইদিন এল।

পত্রিকার ভাষ্যমতে এটা শুধুই একটা সপ্তাহান্তিক দুঃখজনক ঘটনা, অনেকগুলোর মধ্যে একটি। লোরনা ডুবে মরেছে।

হাট বলল, যতক্ষণ না ভয়ঙ্কর রকম ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ততক্ষণ এরা সাঁতার দিতেই থাকে দিতেই থাকে, এরপর আর সাঁতরাতে পারে না।

পুলিশ যখন লোরাকে জানাতে এল, সে প্রায় কথাই বলল না।

শুধু বলল, ভালো। খুব ভালো। তুলনামূলকভাবে এটাই ভালো পথ।

লেখক-পরিচিতি

ভি. এস. নাইপলের জন্ম ১৯৩২ সালে ত্রিনিদাদে। তাঁর বাবা-মা উত্তর ভারতীয় হিন্দু বংশীয় অভিবাসীদের উত্তরপুরুষ ছিলেন। ফলে নাইপল ত্রিনিদাদ এবং উত্তর ভারত – উভয় সংস্কৃতির সাহচর্যেই বেড়ে ওঠেন। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত মিগেল স্ট্রিট গল্পগ্রন্থটি ত্রিনিদাদের প্রতি তাঁর বিদায়-সম্ভাষণ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। এতে বহুবর্ণিল ক্যারিবীয় সংস্কৃতি ও জীবনকে উপস্থাপন করা হয়েছে অবিস¥রণীয় কিছু চরিত্রের বর্ণনায়। গল্পগুলোর বর্ণনাকারী এক কিশোর, যে বড় হয়ে রোজগার করা শুরু করে, এবং বইটির শেষ অংশে ত্রিনিদাদ ছেড়ে পড়াশোনা করতে বিদেশ চলে যায় Ñ নাইপলের মতোই। ক্যারিবীয় ইংরেজভাষী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত নাইপল ২০০১ সালে 888sport live footballে নোবেল 888sport app download bd পান।