মানবকথার সেকাল একাল

গোড়ার কথা
আমাদের বন্ধু মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় গত ৪ আগস্ট কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। আমাদের কাছে খবরটা অবশ্যই আকস্মিক। ৩ তারিখে তার বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। আমরা তা-ই প্রত্যাশা করছিলাম। খবর পাওয়া গেল একটা কিছু ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ ঘটেছে শরীরে। সেই কারণে আরো দু-একদিন থেকে আসতে হবে হাসপাতালে। ৪ তারিখ দুপুরে খবর এলো মানবের শরীরে করোনা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সেই ৪ তারিখেই সন্ধ্যার পরে মানব আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
এখন আমাদের কাজ মানবের কথা বলা, তাকে 888sport app download for android করা। এই তো সেদিন, বছর দুয়েক আগে, মানবের আশি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে একটি ছোটো পত্রিকার তরফে তাকে নিয়ে খুব ছোটো করে একটা অনুষ্ঠান হলো। মানবের শরীর বেশ কিছুদিন ধরেই খুব জুতসই ছিল না। সে তখনই গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিল। তাই নেহাত দু-একজন বন্ধুবান্ধব তার বাড়িতেই জড়ো হয়েছিলেন তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। আর একটা ব্যাপার হয়েছিল, তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় মানবেন্দ্র ৮০ এই নামে একখানা বই বেরিয়েছিল। তাতে মানবকথা নিয়ে অনেকেই লিখেছিলেন। সেখানে আমারও একটি ছোটো লেখা ছিল। লেখাটা এখন পড়তে গিয়ে দেখলাম সেখানে শুধুই মানবের সেকালের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য ওই বইয়ের পরিকল্পনা অনুসারে আমার ওপর নির্দিষ্ট ভার ছিল রবীন্দ্রনাথের শিশু888sport live football নিয়ে লেখা মানবের বইয়ের ওপরে কিছু কথা বলা। আমি আমার সাধ্যমতো তাই করতে চেষ্টা করেছিলাম। এবার সেই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হলো ওখানে আছে শুধুই সেই সেকালের কথা। ওখানে মানবের যে-মনের চেহারা ধরা পড়েছে তা সত্যিই সেই সময়ের।
আমরা কেউই নিশ্চয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি না। জীবনের পথে চলতে চলতে বদলে যাই। আমরা যারা পাশাপাশি থাকি তাদের চোখে সেসব বাঁকের চেহারা এক রকম করে ধরা পড়ে। তার মধ্যে অবশ্যই আমাদের দেখা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম করে থেকে যায়। কাজেই ঠিক ভুলের কথা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে আমরা যে যা দেখি বা ভাবি তাই যা হোক করে লিখে রেখে যাই। বড়োজোর শুধু সেটুকুই পারি আমরা। কিছু কিছু পরিবর্তনসমেত সেকালের সেই কথাও রইল এখানে।

সেকাল
মানবের জীবনের খানিকটা তো আমারও আত্মজীবনী। তাই পেছনে ফিরে তাকাতেই হবে। আর পেছন মানে সেও অনেকটা পিছন। আজ থেকে চৌষট্টি বছর আগে। আমরা কয়েকজন কিসের টানে কে জানে, হয়তো এক একজনে এক এক টানে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছি।
আমার আর মানবের বিষয় আলাদা, বিভাগ আলাদা। কিন্তু তখন ছাত্রছাত্রী 888sport free bet এতই অল্প যে বিভাগের এপাশে-ওপাশে খুব বেশি এসে-যেত না। আর্টস ফ্যাকাল্টি ব্যাপারটাই নতুন। তার ওপরে আমাদের তখন চালচুলো বলতে কিছুই ছিল না।
কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। আমরা তখন কোথায় কোথায় না ক্লাস করেছি। ইনডোর স্টেডিয়ামে বক্সিং প্র্যাকটিসের জায়গায়, লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের নতুন সিমেন্টের মেঝের ওপরে, তখনো সেখানে জলে ভেজানো ছিল। আমরা ইটের ওপরে পা দিয়ে দিয়ে ক্লাসের কোনায় গিয়ে বসেছি। মানবদের ক্লাস হতো অরবিন্দ বিল্ডিংয়ের দোতলায়, পরে যেখানে পিবিএক্সের ঘর ছিল সেখানে। কোনো কোনো দিন হয়তো-বা বাইরে, ফ্ল্যাগ স্টাফের তলায় খোলা আকাশের নিচে। আমরা কিছুদিন এনসিসি ক্যাপটেন্‌স্‌ কোয়ার্টারেও ক্লাস করেছি। ওটা তো বসতবাড়ি। দিব্যি রান্নাঘর, বাথরুম এসব ছিল। ওই বাড়িতে ছিল আমাদের অর্থনীতি আর ইতিহাস, ইংরেজি, সংস্কৃত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। বাংলা ওই বাড়িতে ছিল কি না ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত না। বাংলা বোধহয় ছিল অ্যালামনি বিল্ডিংয়ে, এখন যেখানে ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহ। নানা শরণার্থী শিবির ঘুরে আমরা এখনকার আর্টস বিল্ডিংয়ের একতলা আর দোতলায় এসে ঠাঁই পেলাম অবশেষে। তখন ও বাড়ির ওইটুকুই মাত্র তৈরি হয়েছিল। তাও সবটুকু তখনো পুরোপুরি হয়নি। যাই হোক এখন অন্তত সবাই সবার মুখ দেখছে। আমার সঙ্গে অল্প দিনের মধ্যে মানবের কেমন করে যেন একটু জমে গেল। সম্ভবত বুদ্ধদেব বসুর দৌলতে। না, না বুদ্ধদেবের সঙ্গে তখন আমার আলাপ-পরিচয় কিছু ছিল না। যতটুকু যা হয়েছিল সে পরে। বরঞ্চ আমরা অনেকদিন সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে গাড়িতে ওঠার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করেছি।
আসলে বুদ্ধদেবের দৌলতে বলে যে-কথা বললাম সেটা কাজ করেছিল সম্পূর্ণ অগোচরে বলে আমার বিশ্বাস। বুদ্ধদেবের লেখা তখন আমাদের অনেককে পেয়ে বসেছিল। অনেকে পরে তার থেকে হয়তো মুক্তিও পেয়েছেন। আমাদের মতো অনেকের সে-মুক্তিও হয়তো জোটেনি। মানবের সঙ্গে তখন আমার অনেক সময় কেটেছে বুদ্ধদেবের কথা বলে, রবীন্দ্রনাথের কথা বলে। এসব কথা আজ আমাদের অনেকের মনে হবে ছেলেমানুষি। কিন্তু সেদিন এসব খুব সত্যি ছিল। আর কি রবীন্দ্রনাথ, কি বুদ্ধদেব, মানব তখন আমার চেয়ে এক কাঠি নয়, দু-তিন কাঠি সরেস ছিল। আমরা তখন তিথিডোরে খুব মজে ছিলাম। আমি এখনো তাই আছি, আমার আর মেরামত হলো না। এই কিছুদিন আগেও একবার পড়েছি। গোপনেও লজ্জা পাই না এখনো। যাই হোক, যখনকার কথা বলছি তখন তিথিডোরের দীর্ঘ বিয়েবাড়ির অনুপুঙ্খ বর্ণনা আমার একটু বেশি মনে হতো। কথাটা ভয়ে ভয়ে একদিন মানবের কাছে তুলেছিলাম। মানব চমৎকার করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কেন ওই বিস্তার অত জরুরি। আজ আমি অকপটে বলব, দৈনন্দিনের ডকুমেন্টেশনের ওই জোর আমি তখন ধরতে পারিনি। এখন বিস্ময় লাগে এটা ভেবে যে, কত মনোযোগে বুদ্ধদেব তখন এসব জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ করেছিলেন। সেদিনও উনি আকাশবিহারী ছিলেন না।
আর রবীন্দ্রনাথ। আমাদের উপায় ছিল না অন্যরকম হওয়ার। মানবের সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে তক্তপোশের ওপরে বসে মানবের নতুন লেখা গল্প শুনছি। শেষে ‘সোনার তরী’র কয়েকটা লাইন উদ্ধার করে গল্প শেষ হচ্ছে। মানবের চোখ উদ্ভাসিত। লাইন কটা কেমন ব্যবহার করেছি বলুন। এই ছিল তখন আমাদের দিনরাত। তাছাড়া তখন আমরা এ-পত্রিকা সে-পত্রিকায় লেখা লিখে বেড়াবার চেষ্টা করে চলেছি অবিরত। সে-সব পত্রিকার অনেকগুলি শুধু নামজাদা নয় তাই নয়, আজ তাদের নাম ভালো মনে নেই, থাকলেও উচ্চারণ করা খুব সুবিধের হতো না। সেসব পত্রিকায় শ্লীল-অশ্লীলের মিশেল বেশ অবাধে চলত। সেরকম এক পত্রিকার সম্পাদক হঠাৎ আত্মহত্যা করলেন। পত্রিকা বন্ধ হলো, আর আমরাও ক্রমে ক্রমে অন্যত্র পত্রিকাস্থ হলাম। যাকগে সেসব কথা। সেই সম্পাদককে নিয়ে পরেও মানবের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। জানি না কেন অমন মাঝপথে চলে গেলেন তিনি। যতটুকু শুনেছিলাম পারিবারিক কিছু সমস্যা ছিল বলে মনে হয়। তা এইরকম ছিল আমাদের সেই কাল।
মানবের 888sport live footballবোধের কাছে আমি সারাজীবন ঋণী হয়ে আছি। অনেক পরে যখন আমরা নিজেরাই যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছি, চোখ-কান খুলছে, হাত-পা ছড়াচ্ছি, তখন মানব আমাকে কত নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। আমি সেসবের কোনো মূল্য তেমন করে দিতে পারিনি, সে আমার অসমর্থতা। আমি এদিকে-ওদিকে বয়ে যেতে দিয়েছি নিজেকে। কিন্তু এই গল্পের সব বলতে গেলে সত্যিই সেটা আমার আত্মজীবনী হয়ে দাঁড়াবে। তাতে এই বইয়ের সম্পাদকের মাথায় বাজ পড়বে। তবু যে পুরনো গল্প খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে তুললাম তার একটা কারণ এই যে, যে-বই নিয়ে আমাকে কথা বলতে হবে সে-বইটাকে খানিকটা তার জায়গায় বসানো যাবে। রবীন্দ্রনাথ : শিশু888sport live football। আমার হাতে এখন যে-বইটা আছে সেটা ২০০০ সালে ছাপা প্যাপিরাস সংস্করণ। এ-বই প্রথম বেরিয়েছিল বৈশাখ, ১৩৭৭, অর্থাৎ ১৯৭০-এ। যে-সত্তর দশক মুক্তির দশক বলে আস্তে আস্তে খ্যাতি পাবে। সে-সময়টাতে বেরোচ্ছে এরকম একটা বই। বইয়ের নামে বুদ্ধদেবের নির্ভুল স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ : কথা888sport live football নামে বুদ্ধদেবের বই একসময় আমার জন্য অতি সুখাদ্য ছিল। অনুমান করি মানবও সেসব বই একেবারে ভিতর থেকে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। এ-বইয়ের লেখাগুলো বেশির ভাগ রবীন্দ্র-শতবর্ষের উপলক্ষে লেখা। সে-কথা লেখকের ভূমিকাকথন থেকেই জানা যাচ্ছে। তাছাড়া ওই শতবর্ষের আবহাওয়াতে আমরা কী করছি তখন? আবার 888sport sign up bonusর কথা। আমরা তখন যাদবপুরের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের তিনতলায় কাছাকাছি দুটো আলকভে বসে দুজন গবেষণা নামের কিছু একটা করার চেষ্টা করে চলেছি। বস্তুত যা করছি তা প্রচুর গল্প আর আড্ডা। মানব তখন বুদ্ধদেব বসুর কাছে 888sport alternative linkের কোনো একটা কিছু নিয়ে গবেষণা করছে। আর আমি প্রভাত সর্বাধিকারীর কাছে ভারতের 888sport live chat অর্থনীতির বিকাশ নিয়ে ওইরকমই যা হোক কিছু একটা করছি। তখন চতুরঙ্গ নিয়ে মানবের উত্তেজনা ফুরোবার নয়। চতুরঙ্গ কেন বাংলা 888sport live footballের প্রথম সত্যিকারের আধুনিক 888sport alternative link, মানব আমাকে সে-কথা বুঝিয়ে চলেছে অকাতরে। এমন নয় যে আমি বুঝতে চাইছি না কথাটা। আসলে সে তো কথা বলছে নিজেরই গরজে, ভিতরের উত্তেজনায়। কালে কালে বুদ্ধদেবের কথা888sport live footballের বইয়ের নামত পিঠোপিঠি বই বেরোল মানবের রবীন্দ্রনাথ : শিশু888sport live football। মানবের এই পর্বের বইগুলো যে কিছু হলেও আবার নতুন করে বেরোতে পারছিল একসময়ে তাতে আমি খুব খুশি। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে মানবের নিজের থেকেও বেশি। মানবের চন্দ্রাহত 888sport alternative link পুনর্মুদ্রণের সময় আমি বলেছিলাম, বেশ তো লিখতেন তখন, তা ওরকম করেন কেন? মানব একটু লজ্জা লজ্জা করে বলেছিল, তাই মনে হয় আপনার। 888sport free bet loginের সঙ্গে জড়িয়ে এমনি দিন একদিন ছিল আমাদের।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোদের নিয়ে লেখা এই বইটা হাতে নিয়ে এবার প্রথমেই আমার একটা বকুনি খাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। মানব এই বইটাতে কোনো অধ্যায় প্রচলিত অর্থে ভাগ করেনি। একটা করে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছে। সেই সেই অধ্যায়ে আলোচিত বিষয়ের নির্যাস ধরা পড়েছে ওই ছোট উদ্ধৃতিতে। ফলে বইটা উলটে গেলেও একটা টানা চেহারা ধরা পড়ে। এবার অন্তত বেশ লাগল ব্যাপারটা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল মানবের জন্য একবার দেবীবাবুর কাছে বকুনি খেয়েছিলাম। মানব তখন একটা 888sport live লিখেছিল জেম্‌স‌ জয়েস্‌কে নিয়ে। লেখাটার নাম দিয়েছিল ‘ডাবলিনের অরফিউ’। দেবীবাবু আমাকে পথে পেয়ে বকে দিলেন, তোরা কী সব নাম দিস আজকাল। আমি বললাম, আমি তো দিইনি। উনি হেসে চলে গেলেন। প্রশ্রয় ছিল হাসিতে।
কথায় কথায় 888sport sign up bonus পেয়ে বসা বয়সের লক্ষণ। কোনো সন্দেহ নেই, আবার উপায়ও নেই কোনো। যাই হোক অন্য কথায় আসি। এবার সত্যিকারের যে-জিনিস আমায় টানল এই বইতে তা অকপটে বলে ফেলি। ছোটোদের লেখা যে আসলে শুধু ছোটোদের লেখা নয়, এ-কথা মানবও অনেকবার বলেছে, লিখেছে এবং কথাটা মানেনও অনেকে। সুকুমার রায়ের প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব কবেই বলেছিলেন এসব কথা। সে-কথা তো অবশ্যই আছে এই বইয়ে। কিন্তু আমাকে যে-কথা এবার সত্যি বেশ টানল তা হলো বিষাদের কথা। ছোটোদের লেখাতেও বিষাদের ভূমিকা মানব যে অতদিন আগে এমন করে দেখেছিল সেটা খেয়ালে আসায় মানবের কাছে আর একবার মন কৃতজ্ঞ হলো। আমি কথাটা নানা প্রসঙ্গে নানা জায়গায় তুলে থাকি। শুধু ছোটোদের বেলায় নয়, কথাটা সবার বেলা খাটে বলেই আমার ধারণা। এসব কথা বললেই অনেকে কেমন করে তাকায়। ভাবে, এ আবার কী কথা। আমি বলি, আমরা সব সময়ে যত হম্বিতম্বি করি তার একটা চিকিৎসা বোধহয় হতে পারে এটা। ছোটবেলায় বিষাদের ঘর করা জরুরি। মনটা তখন এমনিতেই নরম থাকে। কত কথা যে তখন সেখানে গেঁথে যায়। আমরা বড়োরা তখন যে ব্রতকথা তাদের কানে নিত্য শোনাই তার মধ্যে বীরত্ব থাকে, সাফল্য থাকে, জীবনে দাঁড়াবার, প্রতিষ্ঠিত হবার সংকল্প থাকে। থাকতেই পারে। তবে তার সঙ্গে আরো কিছু থাকলেই বা মন্দ কী। কেউ হয়তো চুপ করে বসে থাকে, এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়, হয়তো-বা আকাশ দেখে, এরকম আরো কত রকমের অদরকারি কাজে তার মন যায়। ওই বয়সে সে খামোকা কত কিছু করে বসে। বড়োরা যার কোনো মানে খুঁজে পান না। কেননা তাঁরা সে-বালাই পেছনে ফেলে এসে তবে বড়ো হয়েছেন। নইলে বড় হয়েও তাঁদের কপালে দুঃখ জোটে। ভাঙাচোরা কত মানুষ নিয়ে যে আমাদের সংসার সে-কথাটা আমরা বড়ো একটা খেয়াল রাখি না। বুঝি অত খেয়াল রাখতে গেলে আমাদের চলে না। আমাদের এগোতে হয়। ঠিক, তবে এগোতে এগোতে থামতেও হয়, নইলে কোনদিকে এগোচ্ছি তা কে জানে, সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মাঝে মাঝে থেমে থেমে হিসাব-নিকাশ কষতে হয়।
ছোটোদের নিয়ে লিখতে গিয়ে, ছোটোদের জন্য লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে এ-কথা কখনো ভোলেন না, মানব সে-কথা ভালো করে ধরিয়ে দিয়েছে। বস্তুত এ-বইয়ের ভিতর দিয়ে মানব এই কথাটাই বলতে চেয়েছে যে, একজন লেখক যখন লেখেন তখন তিনি তাঁর যা বলার কথা তা-ই কেবল লিখতে পারেন। তিনি কী লিখছেন, কাদের জন্য লিখছেন সে-কথা তখন গৌণ হয়ে যায়। তা না হলে বুঝতে হবে তাঁর লেখক সত্তাই ঠিকমতো তৈরি হতে পারেনি। তাঁর নিজের ভিতরটা তখনো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। দানা বাঁধেনি। দানা-বাঁধা কোনো লেখক যখন যাই লিখুন না কেন তার ভালোমন্দের তারতম্য নিশ্চয়ই থাকতে পারে, তবে তার মধ্যে তাঁর নিজের ছোঁয়া যদি কিছু না থাকে তাহলে বুঝতে হবে তাঁর স্খলন হয়েছে। এই দানা-বাঁধা মানে কি আর এই যে এক লেখক একই কথা সারাজীবন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে যান। তা কখনোই নয়। লেখকের পরিবর্তন, চিন্তার বিবর্তন, নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় সবই আছে। কিন্তু এই সবের মধ্যে একজন মানুষের লেখক ব্যক্তিতার অভিজ্ঞান তাও ধরা পড়ে। লেখককে শনাক্ত করার জন্য সবসময়ে যে লেখকের স্বাক্ষর দরকার পড়ে না তার রহস্য আছে এরই মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের ছোটোদের লেখা বলে পরিচিত যেসব বই তার মধ্যে যে এই জিনিস নির্ভুলভাবে চেনা যায় মানব সে-কথাটার ওপরে খুবই জোর দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথকে নির্ভুলভাবে চিনে নিচ্ছে যে সেও তো আর একজন লেখক। তাহলে এই চিনে নেবার মধ্যে দিয়ে তাকেও তো চিনতে পারার কথা। পারা যায়ও। তার মধ্যে আছে মানবের ব্যক্তি অভ্যাসের ছোঁয়া-লাগা শব্দ ব্যবহার, বানান পদ্ধতি, আর তারও চেয়ে বেশি করে আছে তার দেখার বিশিষ্ট ভঙ্গি। মানব খুব মন ঢেলে কথা বলেছে সে, খাপছাড়া আর গল্পসল্প এই তিনটে বই নিয়ে। বলারই কথা। কী আশ্চর্য তিনটি বই। লেখালেখির আমাদের প্রচলিত চেনা সব ছক যেন একেবারে ভেঙে বেরিয়ে এসেছে এই তিনটে বই। ছোটোদেরই বই বটে, হ্যাঁ, দেখতে সেরকমই লাগে হয়তো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বিশেষ কোনো মানে থাকে না এসব কথার। কেননা কী নেই এসব বইতে যা থাকতে পারে না যে-কোনো রকমের বড়ো মাপের লেখাতে। আছে। সবই আছে। কিন্তু আছে কেমন একটু ত্যাঁড়াবাঁকা ভাবে। এ-বইগুলির প্রাণভোমরা ওই ত্যাঁড়াবাঁকা চালচলনের মধ্যেই নিহিত। আর তার জোরেই হয়তো বইগুলিকে ছোটোদের বই বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। নইলে সত্যিই আলাদা করে ছোট-বড় কোনো ব্যাপারের আশ্রয় আমাদের না নিলেও বোধহয় চলত।
এই কারণেই উঠে পড়ে এইসব বইয়ের চলনের কথা। খাপছাড়ার শুরুতে কবি জানিয়েছেন, ‘কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,/ যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।’ এই যা-তা’র আর্টে বৃদ্ধ কবি শেষবেলায় যে অতটা মজে গেলেন তার তাৎপর্য খেয়াল করতেই হয়। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ একেবারে বলে-কয়ে ঘোষণা করেই এগিয়েছেন। খাপছাড়া উৎসর্গ করেছেন রাজশেখর বসুকে। সোজা প্রশ্ন তুলেছেন বিধির মুখ চারটে কেন। উত্তর দিচ্ছেন, এক মুখে দর্শন বাণী বর্ষণ হবে, একটাতে হবে বেদ‌, একটাতে রসে দ্রবিতা 888sport app download apk আর একটাতে নিশ্চিতভাবে ‘হো হো রবে/ পাগলামি বেড়া ভেঙে উঠে উচ্ছ্বাসিয়া’। হ্যাঁ, আমাদের কালের বিধি তাঁর প্রথম মুখে দর্শনের বাণী শুনিয়েছেন অনেক। বেদ তত বেশি না শোনালেও বেদাঙ্গ, বেদান্ত এসবে কিছু কম পড়েনি, আর রসে দ্রবিতা 888sport app download apkর কথা বলার কী আছে। এখন চতুর্থ মুখের কাজ। তার জন্য সাক্ষী মেনেছেন স্বয়ং রাজশেখর বসুকে। হো-হো হাসির ছুরি চালাতে যাঁর জুড়ি মেলা ভার। খাপছাড়া থেকে আমি যদি এখন উদাহরণ কুড়োতে বসি তাহলে এ-লেখা আর ফুরোবে না। অনুমান করি মানবও সে-ভয়ে ওই পথে বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু এসব লেখার পাতা ওলটাতে গেলেও ভাগ করে নেবার লোভ সামলানো শক্ত হয়। মতিলাল নন্দীর কাণ্ডটাই দেখুন না। মন দেওয়া সত্ত্বেও তার পাঠশালার পাঠ বেশি এগোয় না। শেষকালে একদিন টঙ্গায় চড়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলো। ‘সমাস এগিয়ে গেল,/ ভেসে গেল সন্ধি;’। পড়া এগোবার এমন বুদ্ধি আর কার কবে হয়েছে। কিংবা দেশোদ্ধারে ব্রতী ‘ঘোষালের বক্তৃতা/ করা কর্তব্যই,/ বেঞ্চি চৌকি আদি/ আছে সবই’। মাতৃভূমির জন্য সে পাড়া ঘুরে ঘুরে একশ টিকিট বিলি করেছে। তারপর ‘চোখ বুজে ভাবে, বুঝি/ এল সব সভ্যই,/ চোখ চেয়ে দেখে, বাকি/ শুধু নিরানব্বই’। এই যে দুনিয়ার কথা বলার জন্য বিধি এখন কোমর বেঁধেছেন তার জন্য একেবারে আনকোরা এক ভাষাও বানিয়ে ফেলেছেন, তার নাম দিয়েছেন হেডপেডেন্ডোর ভাষা। সে-ভাষার অভিধান এখনো রচিত হয়নি বটে, তবে তার জন্য কারো কোনো অসুবিধা হয় না তেমন। তাছাড়া মানব অনেকখানি ভাষ্য লিখে দিয়েছে সে-ভাষার। আর বাকি যেটুকু অসুবিধে সেটুকু এই চতুর্মুখ বুড়োর সঙ্গ করলেই মিটে যাবে। পুপেদিদির তো কোনো অসুবিধা হয় না। এই বৃদ্ধ আমাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, ‘এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি/ হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্লামি’।
এসবের জন্য শুধু এক নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছেন তাই না। ওঁকে প্রায় দখল করে নিয়েছে ছবি। সেও এক ভাষা। আর এই যে তুমুল পাগলামির এক পর্ব, এই পর্বের প্রকাশ ঘটানোর উপযুক্ত ভাষাই বটে। মানব এ-সংযোগ দেখিয়ে দিয়েছে যথেষ্ট বিস্তার না করেও। যথেষ্ট বিস্তার না করার সংযমও আমি মনে করি খেয়াল করা দরকার। সব কথা সবাইকে মাস্টারি করে বুঝিয়ে দিতে হবে কেন? ছোটোদের অত বোঝানোর দরকার তো পড়েই না, কেননা তারা তাদের মতো একরকম বুঝে নেয় ঠিকই। তবে আমাদের তাতে মন ওঠে না, কেননা আমাদের দায় তাদের পরীক্ষা করা, আর তাও করা হবে আমাদের পাকা বুদ্ধির হিসেবে।
মানব যে-বিষাদের কথা বলেছে সে-কথা আগে খেয়াল করেছি আমরা। ‘ইন্দ্রের প্রাঙ্গণতলে দেবতার অর্থহীন খেলা’ খেলতে গিয়ে সুকুমারের কথা কতটা কেমনভাবে বললেন কবি। পুপেদিদিও ততদিনে এসব কথা নিতে পারার মতো বড়ো হয়ে গেছে বোধহয়। আর ‘ডাকঘর’। অমলের কথায় শুরু মানবের শেষ কথাপালা। সুকুমারের বিষাদের সুরটা মানব কী নিপুণতায় ছড়িয়ে দিয়েছে আরো অন্য অনেকের কথা টেনে। সেই যে ছেলে দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটে উঠেছিল। সেই ছেলে তো বলেছিল, তখন কি মা চিনতে আমায় পারো। চেনার বাইরে চলে গেলেও আমরা চিনতে তো চাই তবু, খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে। পাওয়া যায় না।
এসব লেখার জন্য আমরা মানবের কাছে ঋণী। আর যে-বইয়ের জন্য আমার এই লেখা সে-বই করার জন্য যাঁরা উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁদের কাছে ঋণী রইলাম মানবের বইটা আর একবার নতুন করে পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য।

একাল
এই পর্যন্ত লেখার পরে আমি এই বলে শেষ করেছিলাম ‘ভালো থাকুন, মানব’। এখন তো আর সে-কথা বলে লেখা শেষ করা যাবে না। তাই আমি মানবের উত্তরকালের কথা একটু তুলব। আমাদের সেই অল্প বয়সের আবেগ-টাবেগ পেরিয়ে আমরা সকলেই যে যার মতো নানাদিকে চলে গেছি। মানব একেবারে নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করে বসল। দেশ-বিদেশের 888sport live footballচর্চা বলতে একটা জিনিস এর আগেও ছিল। তার ভৌগোলিক পরিধি শুধু মানবের হাতে পড়ে প্রসারিত হলো তাই না, সে-জিনিসের চরিত্র বদল হলো। দেখার ধরনে বদল এলো। অন্য জীবন, অন্য মানুষ, অন্য অভিজ্ঞতা, এসব আস্তে আস্তে ধরা দিলো।
উপনবিবেশ আর উপনিবেশের জীবন, এটা একটা আলাদা বর্গ হিসেবে আমাদের মনে দানা বাঁধবে এবার। বেড়াল আর বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর যে ঠিক একইভাবে একসঙ্গে হাসে না, সে-কথা এবার হানা দেবে আমাদের মনে। উত্তরকালে এই নতুন দৃষ্টিতে হবে মানবের বসতি। সেকাল কি তবে ধুয়েমুছে গেল একেবারে। না, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। তা হবার কথাও না। কোনো ক্ষেত্রে সেরকম হয় না তা বলছি না। চেনা যায় না, তখন ঠিক মিল হয় না এ-পাশে ও-পাশে। মানবের বেলায়, আমি যতদূর বুঝি, তা হয়নি ঘটনাটা। প্রশ্নটা প্রসারের। চেনা গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া নয়, হারিয়ে গেলে তো আর ফিরে আসা যাবে না। তাহলে ঘরবাড়ির কী হবে! বিশ্বের হাতছানি কোনো কুহকে পরিণত না হয় যেন।
সবাই জানেন এই বিন্দুতে একটা চ্যালেঞ্জ আছে। কঠিন পরীক্ষা। মানবকেও, আমার ধারণা, নামতে হয়েছে সে-পরীক্ষায়। কে কীভাবে উতরে যাবে বা যাবে না, সে-বিচার একদিনে হবার নয়। আর সেরকম বিচারে আমাদের কারো কোনো হক আছে কি না কে জানে। শেষ পর্যন্ত তাই থেকে যায় সেই কথা : দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচার ঘরে, আমার বিচার তুমি করো তোমার আপন করে। এই উত্তরকালে আমি এই ধরনের কথা বললে মানব কিছু না বলে শুধু মিষ্টি করে হেসে বলত, আপনার তাই মনে হয়। ওই হাসিতে আমি সেই সুতোটা খুঁজে পেতাম, যেটা ছিঁড়ে গেলে কাটা ঘুড়ি আছড়ে পড়ে। মানব সে-বিপদ পেরোতে পেরেছিল বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু একটা অন্য সমস্যা আছে এখানে।
মানবের মন 888sport app download apkয় ন্যস্ত। নিজের রচনার প্রতি মায়া তার কাটবার নয়। এই উত্তরকালে মানব আবার ঝাঁপাতে চেয়েছিল সেই 888sport app download apkর দিকে। সাপলুডো লিখে মানব বেশ উত্তেজিত ছিল। টানা গদ্যের চালে লেখা 888sport app download apk। তার পরে অনেকদিন, অনেকবার, নানা মুদ্রায় মানব তার 888sport app download apkয় ফিরতে চাওয়ার কথা আমাদের সবাইকে বুঝতে দিয়েছে। আমরা সবাই বুঝতে চেয়েছি কি না সে অন্য কথা।
মানবের প্রথম 888sport app download apkর বই বেরিয়েছিল একান্তর। সে তখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। আমাদের আরেক প্রয়াত বন্ধু সুবীর রায়চৌধুরী মানবকে বলতেন, আপনি তো ভালো করে হাঁটতে শেখার আগে বই ছাপিয়েছিলেন। কথাটা প্রায় আক্ষরিক অর্থে সত্যি। বই ছাপানোয় তার প্রবল উৎসাহ। শুধু সেই হাঁটি হাঁটি বয়সে নয়, পরেও, সারা জীবন। আর শুধু নিজের বই নয়, অন্যদের বই ছাপানোতেও তার একই রকমের আগ্রহ ও উৎসাহ। এমনকি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের গদ্য বই ছাপানোর জন্য সে শেষের কতদিন কতকিছু করেছে, ভেবেছে। হয়নি বা পারেনি, সে অন্য কথা।
যাই হোক, মানবের 888sport app download apk সত্তা একটু চাপা পড়ে গেল। তা নিয়ে আমার বরাবরের জন্য একটু মন খারাপ লাগে। মানবের সঙ্গেও সে-ব্যাপারে অনেকবার কথা হয়েছে আমার। আমাদের আরেক বন্ধু, শিশিরকুমার দাশ। তাঁর বেলাতেও এরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতির আড়ালে চাপা পড়ে গেল তাঁর 888sport app download apk সত্তা। তাঁর ছিল তুমুল নাটকের সত্তাও। সেটা তিনি তবু খানিকটা বাঁচাবার চেষ্টা করে গেছেন। 888sport app download apk যা থেকে গেছে তা এখন অন্যদের চেষ্টার জন্য রয়ে গেল। মানবেরও বহু কাজ অন্যদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে এখন।