আমি একজন মানুষ। আসলেই কি আমি মানুষ? জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বারবার আমার একটি কথাই মনে হয়, মানুষ হলে আমার জীবন মানুষের মতো নয় কেন? কেন অন্য দশজনের চেয়ে আমি আলাদা? আমি কীভাবে জন্মালাম, আমার মা-বাবা কে, কোনো কিছুরই হদিস নেই। আমি তো নিজে নিজে জন্মাইনি। আমার জন্মের পেছনে কেউ না কেউ ছিল। তারা কেন আমাকে জন্মলগ্নেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেল, কেন জন্মের পূর্বে তারা আমাকে মেরে ফেলল না, সেটা আমার জিজ্ঞাসা। এ-প্রশ্নের উত্তর কেবল তারাই দিতে পারবে। কিন্তু তারা কে? কোথায়?
রাতের অন্ধকারে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে আমাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। একটা কুকুর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছিল। তার অভিসন্ধি বোঝা কঠিন ব্যাপার নয়। তবে আমার সর্বাঙ্গে কাপড় মোড়া বলে সম্ভবত সে ইতস্তত করছিল। কুকুরেরা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান প্রাণী। আমি যে জীবন্ত, সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। ওই মুহূর্তে আমি যে খুব অসহায় ছিলাম, তা মনে হয় না। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল, অসহায়ত্ব নিবারণের একটা অস্ত্র আমার আছে। কান্না। কান্নার চেয়ে বড় শক্তি মানুষের আর কী হতে পারে?
মাঝরাতে গলাগলি ধরে দুই ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। তাদের একজন বলল, কার যেন কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়।
কার আবার! তোমার বউয়ের। মাল খেয়ে বেশি রাতে বাসায় ফিরছ তো, তাই।
প্রথমজন আবার বলল, একটু দাঁড়াও। পাশের ডাস্টবিন থেকে কান্না শোনা যাচ্ছে। বলে সে নিজেই এগিয়ে গেল ডাস্টবিনের দিকে।
দ্বিতীয়জন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বলল, কী যে ঝামেলা বাধাও।
প্রথম ব্যক্তি ডাস্টবিন থেকে আমাকে তুলে আনল। কোলের ওপর ধরে আমার কান্না থামাতে চেষ্টা করল। তারপর আমাকে নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকল।
দ্বিতীয়জন বিরক্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ একে?
বাসায়।
মাথা খারাপ! তোমার বউ ভাববে এটা তোমারই। শেষে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে।
তার বাপের কোনো বাড়ি নেই।
আত্মীয়স্বজন তো আছে।
তা আছে।
চলতে চলতে আমি আবার কান্না শুরু করলাম। প্রথমজন আমাকে কোলে দোলাতে দোলাতে বলল, ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে।
কী আপদ! অন্যজন ক্ষুব্ধকণ্ঠে জানাল, এত রাতে দুধ কোথায় পাবে? আমার কাছে শিশিতে সামান্য মাল আছে। মুখে ঢেলে দাও।
পাগল নাকি!
পাগল আমি না তুমি? মাঝরাতে ডাস্টবিন থেকে বেওয়ারিশ বাচ্চা তুলে নিয়ে বাসায় যাচ্ছ। বাচ্চাটা ছেলে, না মেয়ে?
জানি না। সারা গায়ে কাপড় মোড়া। ছেলে না মেয়ে বুঝব কী করে?
আমি বলি কি, এসব ঝামেলা না করে ওটাকে রাস্তার পাশে রেখে দিয়ে যাও। আরো জোরে কান্নাকাটি করুক। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এ-পথে আসবে।
কীসব কথা বলছ তুমি! সে আর কথা বাড়াল না। আমাকে কাঁধে তুলে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করল। যেন আমি ঘুমিয়ে গেলে কান্না থেমে যাবে। দুধের কথা আপাতত ভাবতে হবে না।
আরেকটু সামনে যেতেই অকস্মাৎ তিনজন পুলিশ আবির্ভূত হলো তাদের সামনে। তিনজন ঘিরে ধরল তাদের দুজনকে। বড় পুলিশ জিজ্ঞেস করল, এই! তোমার পোঁটলার মধ্যে কী?
বাচ্চা।
কার বাচ্চা চুরি করেছ? মালও খেয়েছ দেখছি। দুটো কেস হবে। একটা চুরির, আরেকটা মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামির।
আমি কোনো মাতলামি করিনি।
চুপ বেয়াদব! পুলিশের মুখের ওপরে কথা! তোদেরকে নিয়ে এখনই থানাহাজতে ঢুকিয়ে দেব।
মাঝারি পুলিশটি চুপিসারে বলল, আমাদের বখরা দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
আমার কাছে কোনো টাকা নেই। মাল খেয়ে সব টাকা …
ছোট পুলিশ জানাল, তাহলে আর কি! থানাহাজত।
দ্বিতীয় ব্যক্তি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার মুখ খুলল সে, তখনই বলেছিলাম, এসব ঝামেলা করে লাভ নেই। আমার কথা শুনলে এমন বিপদে পড়তে হতো না।
পুলিশের দিকে ফিরে বলল, ঠিক আছে। আমি যাই। আমি তো এর মধ্যে নাই।
যাই মানে! ধমকে উঠল বড় পুলিশ, তুমি তো মদের মামলার আসামি। লাইসেন্স আছে তোমার?
কিসের লাইসেন্স। মদ খেতে লাইসেন্স লাগে নাকি? আমি তো বোতল পেলে গপাগপ খেয়ে ফেলি।
থানায় গিয়ে এই কথাটা বলে দেখো। তাহলেই হবে।
এতক্ষণ সম্ভবত আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এবার উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিলাম। প্রথম ব্যক্তি আমার কান্না থামিয়ে বড় পুলিশের সামনে এগিয়ে গেল। বলল, স্যার! ঘটনাটা তো আপনি শুনলেন না।
কিসের ঘটনা? বলো।
পথের ধারে ডাস্টবিনে আমি বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে পেয়েছি। দুধ খাওয়ার জন্য ও কান্নাকাটি করছে। এতে আমার অপরাধ কোথায়?
বেওয়ারিশ জিনিসকে কুড়িয়ে নেওয়াই তোমার অপরাধ। যাকগে। ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ তুমি?
থানায়। ওসি সাহেবের কাছে জমা দেব বলে।
তুমি একটা বুরবক। এ-কথাটা আগে বললেই তো হতো।
ওরা সবাই মিলে থানায় এলো। ওসি কী একটা কারণে মাঝরাতেও থানায় ছিলেন। পুলিশ বাহিনীতে ওসি নেয়ামতউল্লাহর নাম আছে। বেশ কয়েকটি পদক পেয়েছেন তিনি। আগে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানায় নিয়োজিত ছিলেন। মাসতিনেক আগে তাকে 888sport appয় বদলি করে আনা হয়েছে। তার কর্মদক্ষতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার গুণে অনেকেই তার প্রশংসা করেন। দু-একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে।
নেয়ামতউল্লাহ শিশুটির বিষয়ে আগ্রহভরে সব কথা শুনলেন। মাত্র তিন-চার দিনের শিশুটি কে বা কারা ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে, তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। থানার ডিউটি অফিসারকে ডেকে বললেন, আগামীকাল সকাল ১০টায় প্রেস কনফারেন্স করা হবে। শিশুটিকে যারা উদ্ধার করেছেন, তারাও তখন উপস্থিত থাকবেন।
রাস্তার টহলরত বড় পুলিশ বলল, স্যার। যারা বাচ্চাটিকে কুড়িয়ে পেয়েছে, তারা দুজনেই মাতাল ছিল। ওদের মদ খাওয়ার লাইসেন্স নেই।
তাতে কি? আমি নিজেও মাঝেমধ্যে একটু ড্রিংক করে থাকি। বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে ওরা বড় একটা কাজ করেছে। নইলে ওকে নিয়ে শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করত।
পুলিশটি বলল, স্যার আমরা বুদ্ধি করে ওদের থানায় নিয়ে এসেছি।
ঠিকই করেছ। প্রেস কনফারেন্সের সময় তোমরাও সঙ্গে থাকবে।
ওসি নিজে আমাকে কোলে নিয়ে বাসায় গেলেন। স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে আদ্যোপান্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। বললেন, ওকে তাড়াতাড়ি দুধ খাওয়াও। বিয়ের এত বছর পরেও আমাদের তো কোনো সন্তান নেই। আল্লাহই একে মিলিয়ে দিয়েছেন।
পরদিন থানার ওসির কক্ষে প্রেস কনফারেন্সে আমাকে হাজির করা হলো। পত্রিকার সাংবাদিকরা ছাড়াও বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা উপস্থিত হয়েছেন। সঙ্গে তাদের চিত্রগ্রাহকরাও। নেয়ামতউল্লাহ আমাকে কোলে নিয়ে ছবি তুললেন। অনেকে আলাদাভাবে আমার ছবি তুলে নিলেন। নিজের ভাগ্যের ব্যাপারে আমার দুঃখ ও দুর্ভাবনার আর অবকাশ রইল না। পরদিন অনেক পত্রিকায় আমার ছবিসহ সংবাদ ছাপা হলো। আমাকে দত্তক নেওয়ার জন্য অনেকেই টেলিফোন করল। নেয়ামতউল্লাহ স্রেফ জানিয়ে দিলেন, আমার প্রকৃত মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করা হবে। না হলে নেয়ামতউল্লাহ নিজেই দত্তক নেবেন আমাকে। অবশ্য সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে।
নেয়ামতউল্লাহ আমার বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চিঠি লিখলেন। প্রত্যুত্তর পেতে দেরি হলো না। পুলিশের আইজির বরাত দিয়ে তাকে জানানো হলো বাচ্চার পিতা-মাতাকে না পাওয়া গেলে তিনি এর প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে পারেন। এই মানবিক কাজের জন্য আইজি মহোদয় নেয়ামতউল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরদিন আবার নেয়ামতউল্লাহর ছবি দিয়ে তার মহানুভবতার প্রশংসা করে সংবাদ ছাপা হলো। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশিত হলো – ‘পুলিশের মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে।
আমার বাবা-মার খোঁজ করা হলেও তাদের হদিস পাওয়া গেল না। না পাওয়াই স্বাভাবিক। আমার জন্য তাদের মনে এতটুকু মায়া-মমতা থাকলে তারা আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে যেত না। পুলিশ অবশ্য ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখেছে কোনো বাড়িতে সদ্যপ্রসূত মায়ের সন্ধান পাওয়া যায় কি না! কিন্তু যারা আমাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে, তারা যে এই এলাকারই কেউ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ভেবেছিলাম আমার জীবনের একটা স্থায়ী আশ্রয় জুটে গেল। প্রথম দুদিন আমার যত্নের কোনো কমতি ছিল না। তৃতীয় দিনে নেয়ামতউল্লাহর স্ত্রী জয়তুন্নেসা স্বামীকে বললেন, এ তুমি কাকে এনেছ?
মানে?
বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না।
তাকে কী? ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তাতে আমাদের অসুবিধা কোথায়?
বারে! আমরা একটা সন্তান পালক নিলাম, সে ছেলে না মেয়ে জানতে হবে না? ওকে কী নামে ডাকব? ছেলে, না মেয়ে?
নেয়ামতউল্লাহ স্ত্রীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে পরে বললেন, ওর নাম দাও মমতাজ। এটা ছেলে বা মেয়ে উভয়ের নামই হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত আমার একটা নাম পাওয়া গেল। নামটা মন্দ নয়। কিন্তু আমি ছেলে না মেয়ে, তা অবশ্য নিজেই জানি না। এর মধ্যে থানার অনেক পুলিশ তাদের স্ত্রীসহ দেখতে এলো আমাকে। শুধু দেখা নয়। তারা অনেকেই উপহার নিয়ে এলো আমার জন্য। কেউ জামা-কাপড়, কেউ খেলনা। ভেবেছিলাম আমাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর বাকবিতণ্ডা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা মোটেই নয়। একদিন রাতে জয়তুন্নেসা স্বামীকে বললেন, তুমি যাকে এনেছ, সে তো মানুষ নয়।
মানে? আধো ঘুমের ঘোরে প্রশ্ন করলেন নেয়ামতউল্লাহ।
ও তো একটা হিজড়া।
হিজড়ারা কি মানুষ নয়? ঘুমের ঘোরেই প্রশ্ন করলেন তিনি।
জয়তুন্নেসা বললেন, কত সাধ করে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম আমাদের কোনো সন্তান নেই বলে। ভেবেছিলাম আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারব না।
এসব কথায় নেয়ামতউল্লাহর ঘুম ভেঙে গেল। বললেন, তোমার সমস্যা কোথায়?
একটা হিজড়া আমাকে মা বলে ডাকবে তা আমার সহ্য হবে না।
মা না বলে তোমাকে খালা বলে ডাকলেই তো হলো।
এতেই বুঝি সব সমস্যা মিটে যাবে?
আমি তো এর মধ্যে কোনো সমস্যা দেখি না।
তুমি একটা থানার ওসি। তোমার কী কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই?
বিয়ের আগে ছিল। এখন আর নেই।
যাকগে। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। তুমি ওকে কোথাও দিয়ে এসো।
কোথায় দেবো?
যারা তোমাকে টেলিফোন করে ওকে পালক নিতে চেয়েছিল, তাদের কাছে পাঠিয়ে দাও।
নেয়ামতউল্লাহর কণ্ঠস্বর পালটে গেল, তুমি কী বুঝতে পারছ তুমি কী কথা বলছ?
আমি খারাপটা কী বললাম?
দেখো, ওসি হিসেবে আমার একটা ইজ্জত আছে। এই বাচ্চাকে আমি দত্তক নেব বলে ঘোষণা দিয়েছি। আইজি স্যার প্রশংসা করে আমাকে চিঠি দিয়েছেন। দেশের পত্রপত্রিকাগুলো আমাকে ধন্য ধন্য করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পর্যন্ত আমার নামে 888sport world cup rate প্রচার করেছে। আমাকে নিয়ে ‘নূতন আলো’ পত্রিকার সম্পাদকীয়টা পড়ে দেখো, তারা কী বলেছে। এ অবস্থায় ওকে আমি অন্যের হাতে তুলে দেব, তা হতে পারে না।
তুমি পত্রিকায় জানিয়ে দেবে, হিজড়া বলে তুমি একে নিচ্ছ না।
তাহলে একজন কেউ তো নেবে? আমি যদি না রাখি, সে কেন নেবে? তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, মমতাজ এখানেই থাকবে। এ-বাড়িতেই থাকবে।
শেষ পর্যন্ত এ-বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যাপারে ফয়সালা হলো মনে করলাম। কিন্তু এর মধ্যে কিছু পরিবর্তনও হয়ে গেল। জয়তুন্নেসার কোল থেকে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হলো। বাসার কাজের বুয়া হাসিনার মায়ের কোলে আমি স্থান লাভ করলাম। হাসিনার মা সম্পর্কে কিছু কথা বলা আবশ্যক। হাসিনার মায়ের আসল নাম কেউই জানে না। তিন বছর বয়সে হাসিনা মারা যাওয়ার পর মায়ের নামের মধ্যে সে 888sport sign up bonus হয়ে আছে। নেয়ামতউল্লাহর দেশের বাড়ির লোক। দশ বছর আগে পেটের তাগিদে বাসাবাড়ির কাজ নিয়েছিল। অবশ্য এই একই বাড়িতে। আমাকে কোলে নিয়ে হাসিনার মায়ের মৃত মেয়েরে জন্য শোক উথলে উঠল। আমাকে আদর করতে করতে আলতো করে কপালে চুমু খেল। এমন চুমুর স্পর্শ এই প্রথম আমার জীবনে। মনে হলো মানুষ কত মায়া-মমতায় ভরা। সব মানুষ কেন এরকম হতে পারে না? সবাই যদি এরকম হতো, পৃথিবীটা কত সুন্দর হয়ে উঠত তখন।
জয়তুন্নেসা ঘরে ঢুকে বললেন, কী ব্যাপার! কখন থেকে তোমাকে ডাকছি। সাড়াশব্দ একবারে নাই। করছটা কী তুমি? সারাক্ষণ ওটাকে আগলে বুকে রাখছ কেন?
বেগম সাহেবা! আমি যেন আমার হাসিনাকে আবার ফেরত পেয়েছি। আমি ওকে হাসিনা নামেই ডাকি।
হাসিনা তো মেয়ে ছিল। ও তো হাসিনা হতে পারে না।
মানুষের মধ্যে ছেলেমেয়ের কোনো তফাৎ নাই। আপনি দোয়া করেন, ওকে যেন মানুষের মতো মানুষ করতে পারি।
কী জানি বাপু! বেগম সাহেব মুখ বাঁকিয়ে অন্য ঘরে ফিরে গেলেন।
জীবনে একটা কথা আমি শুনেছিলাম হাসিনার মায়ের কাছ থেকে। মানুষের মতো মানুষ। আমি বড় হওয়ার পর এ-কথাটা নিয়ে কতবার ভেবেছি। মানুষের মতো মানুষ কাকে বলে? সব মানুষ কী তাহলে মানুষের মতো মানুষ নয়? তার মানে পৃথিবীতে দু-ধরনের মানুষ আছে। এক, যারা মানুষের মতো মানুষ। অন্য, যারা মানুষের মতো মানুষ নয়। তাহলে তারা কী রকম? বড় হওয়ার পর এ-কথার জবাব আমি পেয়েছি। জীবনের পরতে পরতে দেখতে পেয়েছি তাদের। কথাটা অনেকবারই মনে হয়েছে আমার। আমাকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। আমি ছেলে না মেয়ে, সেটা অতি তুচ্ছ ব্যাপার। আমি মানুষ কি না, কতটা মানুষ, সেটাই হচ্ছে আসল। এ-কথার অর্থ মানুষ হয়ে জন্মালেই সবাই মানুষ হয় না। মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ না হলে তাকে মানুষের মতো মানুষ বলা যায় না।
আমি এ-বাড়িতে আসার কিছুদিন পরে নেয়ামতউল্লাহর পদোন্নতি হয়েছে। থানা থেকে তিনি বদলি হয়েছেন 888sport app পুলিশ সুপারের অফিসে। তার প্রমোশনের দিন তিনি একগাদা খেলনা ও চকলেট নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। জয়তুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, কী বিষয়? এসব পুতুল-টুতুল তোমাকে কে দিলো?
কেউ দেয়নি। আমি কিনেছি? এসব উপহার।
কার জন্য? কারো জন্মদিন আছে বুঝি?
না, তা নয়। আমি মমতাজের জন্য আনলাম।
মমতাজের জন্য? কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি তিনি।
হ্যাঁ। হাসিনার মাকে ডাকো। আমি নিজের হাতে ওকে চকলেট খাওয়াব।
সত্যি বলতে কী, আমার জন্য এদিনটি ছিল খুবই আনন্দের। এরকম 888sport app download for androidীয় দিন আমার জীবনে খুব কমই এসেছে। তিনি যখন আমাকে কোলে তুলে নিলেন, তখন মনে হলো, এটা কী বাবার স্পর্শ? বাবারা কী এমন মায়া-মমতা মাখা মানুষ হয়?
আমি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম। তিন বছর বয়সে আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হলো। জয়তুন্নেসা অবশ্য আমার পড়াশোনার ব্যাপারে অনেকটাই নাখোশ। এতদিন যে আমি বাড়িতে পুলিশের ড্রাইভারের কাছে বাল্যশিক্ষা পড়েছি, সে-সম্পর্কেও তার আপত্তি ছিল। ড্রাইভার আলীকে আমি মামা বলে ডাকি। আলী নিজেও বলেছে, আমি নাকি পড়াশোনায় বেশ ভালো। আমি খুব সহজে বইয়ের পড়া বুঝে নিতে পারি। এসব শুনে জয়তুন্নেসা নাক সিঁটকে দূরে সরে গেছেন। কিন্তু এখন আমি স্কুলে ভর্তি হবো শুনে তিনি বললেন, ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে কী হবে? হিজড়ারা কি কখনো পড়াশোনা করে? ওরা তো পথে গাড়ি থামিয়ে ভিক্ষা করে। বড় জোর, কারো বাড়িতে নতুন সন্তান-সন্ততি এলে নাচগানের আসর বসিয়ে জোর করে টাকা আদায় করে।
এ-কথা শুনে নেয়ামতউল্লাহ স্ত্রীর ওপরে ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন, খবরদার! ওকে কখনো হিজড়া বলবে না। ওকে কেউ হিজড়া বললে আমি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।
এমন কঠিন কথা শোনার পর জয়তুন্নেসা কাঁদতে থাকলেন। সেদিকে কর্ণপাত না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন নেয়ামতউল্লাহ।
একটা প্রশ্ন আমার সবসময় মনে জাগে। আমি হিজড়া হলে সেটা পরিচয় দিতে আপত্তি কী? কেউ তো ইচ্ছা করে হিজড়া হয় না। সৃষ্টির নিয়মের মধ্যে সর্বদাই কিছু না কিছু ব্যতিক্রম থাকে। আমি সেই নিয়মের ব্যতিক্রম। কিন্তু এজন্য আমি নিজে তো দায়ী নই। হাসিনার মা বলেছিল, সাধারণ মানুষ নাকি ঘৃণা করে হিজড়াদের। কিন্তু কেন? আমার মনে আরো প্রশ্ন জাগে, হিজড়ারা কি মানুষ নয়? তারা কি অদৃশ্য কোনো প্রাণী? মানুষ সবাইকে সমান বলা হয়ে থাকে, বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে। তাহলে হিজড়াদের ব্যাপারে এত বৈষম্য কেন? এসব ভাবনা মনের মধ্যে সাজিয়েও একটা বিষয় বুঝতে পারলাম, আমি যে হিজড়া, সে-কথা কাউকে প্রকাশ করা যাবে না। নেয়ামতউল্লাহ অন্তত তা চান না। উনি যা চান না, তা আমি কখনোই করতে যাব না, বলতে যাব না।
পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়ে গেলাম। লেখাপড়াটা যে এত আকর্ষণীয়, তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। কিন্তু স্কুলের পড়া আমার তেমন ভালো লাগে না। কতগুলো বাঁধাধরা বইয়ের কিছু অংশ বছরব্যাপী পড়তে হয়। কেন যে স্কুলগুলোয় এই নিয়ম চালু হয়েছে আমি তা বুঝতে পারি না। আমার ভালো লাগে স্কুলের বইয়ের বাইরে নতুন নতুন বই পড়তে, নতুন নতুন বিষয় জানতে। কলা বা 888sport apk, যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি বিষয়ে এত বিস্তৃত জ্ঞানের খোরাক আছে, তা ভাবতে অবাক হতে হয়। প্রতিটি নতুন বই-ই যেন এক একটা নতুন জগতের দুয়ার খুলে দেয়। যেন এক অনাবিষ্কৃত রাজ্য আমি আবিষ্কার করে চলেছি। নতুন জ্ঞানের ভাণ্ডার আমার স্পর্শের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
স্কুলের স্যারদের আগ্রহের কমতি নেই আমাকে নিয়ে। তারা উৎসাহ জোগাচ্ছেন আমি ঠিকমতো লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমি ভালো ফল করব। আমি নিজেও এ-বিষয়ে তাদের অনুপ্রেরণায় আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। নেয়ামতউল্লাহ মারা যাওয়ার ঘটনায় আমার জীবন ওলটপালট হয়ে গেল। মারা যাওয়ার আগের দিন আমার জন্য এক সেট প্যান্ট-শার্ট কিনে এনেছিলেন তিনি। সেদিন আমার সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। কাপড়গুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি
বললেন, আমি জানতাম পরীক্ষায় তুই প্রথম হবি। প্রতিবছর পরীক্ষার ফল বেরোলে আমি তোকে প্যান্ট-শার্ট কিনে দেব।
রাতে হার্ট অ্যাটাকের পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, তুই অনেক বড় হবি মমতাজ। জানি না তোর বড় হওয়া আমি দেখে যেতে পারব কি না!
উনি মারা যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে আকাশ ভেঙে পড়ল আমার মাথার ওপরে। জয়তুন্নেসা স্থির করলেন, তিনি আর 888sport app শহরে থাকবেন না। ময়মনসিংহে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যাবেন। হাসিনার মা প্রশ্ন করল, তাহলে মমতাজ যাবে কোথায়?
সে আমি কী জানি? সাহেব যে এত কম বয়সে মারা গেল, সে তো ওর জন্য। ওর পাপেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কী যে বলেন বেগম সাহেবা! ছেলেটা এতিম। আপনি ওরে সঙ্গে করে নিয়ে যান।
একটা হিজড়াকে নিয়ে গিয়ে বাবার বাড়িতে আমি মুখ দেখাব কীভাবে? লোকে কী বলবে?
বেগম সাহেবা, ও লেখাপড়ায় অনেক ভালো। ওকে পেলে সবাই খুব খুশি হবে।
তুমি আর ওর হয়ে ওকালতি করতে এসো না। তুমি আমার সঙ্গে না যাও, না যাবে।
তাহলে আমিও আমার দেশের বাড়ি চলে যাই।
তা-ই যাও।
সমস্ত ঘটনাতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। আমি যাকে বাবা বলে ভাবতাম, তিনি মারা গেলেন, যাকে মা মনে করতাম, তার সঙ্গে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই আমার। আমি একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়লাম। মনে হলো, আমি এমন একটা গাছ, যার শিকড়গুলো ঝড়ে উপড়ে গেছে। একবার মনে হলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেসব হিজড়া মানুষের কাছে হাত পাতে, আমারও কি পরিণতি তা-ই? ওদের মধ্যে আমি তো কখনো পুরুষ মানুষ দেখি না, সবাই মেয়েদের পোশাক পরে, আমিও কী মেয়েদের পোশাক পরব? নাচগান করব ওদের মতো? না, তা করব না। আমি পুরুষের পোশাকেই থাকব। যেটুকু লেখাপড়া করেছি, তাতে একটা চাকরি জোগাড় করে নেওয়া কী এতই কঠিন হবে? চাকরি না পাই বাসাবাড়ির কাজ তো জোগাড় করতে পারি।
স্কুলের হেডস্যার আমাকে খুব স্নেহ করেন। সব কথা খুলে বলার পর তিনি বললেন, চাকরি বা কাজ নয়। তোমার একটা আশ্রয় প্রয়োজন। আমি আদনানকে বলে দেখি।
আদনান কে স্যার?
সে একটা এনজিও চালায়। মানে, তৃতীয় লিঙ্গদের নিয়ে কাজ করে। আদনান নিশ্চয়ই তোমার কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে।
আমাকে কী ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে হবে?
স্যার এগিয়ে এলেন আমার কাছে। আমার মাথার ওপর হাত রেখে বললেন, বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া সবচেয়ে ভালো। একটা কথা তোমাকে বলি, পৃথিবীতে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ নিজের প্রতিভাবলে বিখ্যাত হয়েছেন। তুমি যদি তোমার লেখাপড়া ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারো, তাহলে তুমিও বিখ্যাত হবে। আর বিখ্যাত তো কেউ আপনাআপনি হয় না। নিজের কাজ দিয়ে দেশের প্রতি অবদান রাখলেই কেবল মানুষ বিখ্যাত হয়।
হেডস্যার নিজেই আমাকে মোহাম্মদপুরের একটা অফিসে নিয়ে গেলেন। অফিসের নাম ‘প্রান্তিক’। প্রান্তিক চাষি কথাটা বোধহয় শুনেছি। কিন্তু প্রান্তিক কথাটার মূল অর্থ জানা নেই। আদনান সাহেব এর নির্বাহী পরিচালক। তার ঘরটি বেশ সাজানো-গোছানো। দেয়ালে কয়েকটা ছবি আছে। তা থেকে বোঝা যায়, এরা হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে। হেডস্যার অবশ্য হিজড়া কথাটা ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন তৃতীয় লিঙ্গ। তৃতীয় বিশ্ব কথাটা বেশ চালু আছে। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ কথাটা আমি আর শুনিনি। এটা কী স্যারের নিজের উদ্ভাবন?
আদনান সাহেব আমার কথা জেনে স্যারকে বললেন, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে ওর থাকার একটা জায়গা করা দরকার। দেখি লাবণীর সঙ্গে কথা বলে।
লাবণী কে?
লাবণী একটা গ্রুপের লিডার। মোবাইল করে দেখি।
মোবাইলে পাওয়া গেল লাবণীকে। আদনান বললেন, তোমার বাড়িতে একজন মেম্বার বাড়াতে পারবে? খুব আর্জেন্ট।
কী করে বাড়াব? আমার ঘরটাই ছেড়ে দিতে পারি।
সেটা তো সম্ভব না। ওকে কিছুটা আলাদা রাখতে হবে।
কেন? সে আসমান থেকে পড়েছে নাকি?
কথাটা তোমাকে সামনাসামনি বুঝিয়ে বলা দরকার। তুমি কী এখনই একটু আসতে পারো?
আপনি ডাকলে কখনো না গিয়ে পারি? এখনই আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লাবণী এলেন। মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা। মধ্যবয়স্ক হলেও সাজগোজের কমতি নেই তার। মোটা করে ভ্রু আঁকা। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। লাবণী ঘরে ঢুকে আমার বিষয়ে সব কথা শুনলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাম তোর?
আমি উত্তর দেওয়ার আগে আদনান বললেন, ভুল করলে লাবণী। ওকে তুই না বলে তুমি করে বলবে।
কেন?
তুমি তাকে তুই বললে অন্যরাও তুই-ই বলবে। আর তুমি যদি তুমি বলো, অন্যরা তুই বলতে সাহস করবে না।
ঠিক আছে। তুমিই বলব।
আরো কিছু শর্ত আছে।
কী শর্ত?
ও নাচগান করবে না, রাস্তায় গিয়ে কারো কাছে হাত পাতবে না।
এ কীরকম শর্ত? তাহলে ও করবেটা কী?
পড়াশোনা করবে। পড়াশোনা ছাড়া ওর আর কোনো কাজ নেই।
পাগল নাকি? পড়াশোনা করে হবেটা কী? খাবে কী?
সে ব্যবস্থা আমি করব। যখন অবসর থাকবে তখন সে আমার অফিসে কাজ করবে।
ব্যাপার কী বলেন তো স্যার? ও বড়লোকের কেউ বুঝি? ওর পরিচয় কী?
ওর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এখন থেকে তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। তুমি ওর থাকার ব্যবস্থাটা করে দাও।
ঠিক আছে, দিলাম। আমাদের বাড়িতে একটা চিলেকোঠা আছে। সেখানে ও একা থাকতে পারবে। কেউ ডিস্টার্ব করবে না। কিন্তু আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।
শোনো। তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে এসে আমার মনে একটা স্বপ্ন আছে। আমি চাই তোমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেটা কেবল মুখের কথায় সম্ভব নয়। এমন দু-একজনকে তোমাদের মধ্য থেকে তুলে আনতে হবে, যে তোমাদের ভাবমূর্তি পালটে দিতে পারবে। তোমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য সেটা হবে প্রথম ধাপ।
স্যার, কী যে কঠিন কথা বলেন আপনি। আমি লেখাপড়া জানি না, মূর্খ মানুষ।
হেডস্যার এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার তিনি বললেন, আপনাদের কোনো ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়তে চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দেবো।
আমরা ছেলেমেয়ে পাব কোথায়? তবে আমার নিজেরই ছোটবেলায় পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। দু-তিন বছর স্কুলে পড়েছিলাম। স্কুলের মাতবররা পরে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়।
তাহলে তুমি এখনই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আদনান স্যার কিছু টাকা তুলে দিলেন লাবণীর হাতে। বললেন, ওর জন্য যখন যা প্রয়োজন হবে, আমাকে জানালেই চলবে।
রিকশা চড়ে মোহাম্মদপুরে একটা দোতলা বাড়ির সামনে নামলাম আমরা। এই বাড়িটা অনেকটা পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ির মতো মনে হলো। লাবণী সরাসরি আমাকে তিনতলার চিলেকোঠায় নিয়ে এলেন। জায়গাটা একটা গুদামঘর বলা যায়। অনেক পোঁটলাপুঁটলি বাক্সপেঁটরা রাখা আছে সেখানে। একপাশে একটা জানালা আছে। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির পাশে এই ঘরে দরজা রয়েছে।
লাবণী বললেন, তোমার নামই তো জানা হলো না।
মমতাজ।
মমতাজ কী?
মমতাজউল্লাহ হতে পারে। তবে শুধু মমতাজই আমার নাম।
তুমি যে থাকবে তোমার জিনিসপত্র কোথায়?
সবই আছে। আমি বিকেলের মধ্যে নিয়ে আসব।
ঠিক আছে। আমি ততক্ষণ জায়গা সাফ করে দিতে বলি। একটা চকি হলে ভালো হতো।
মেঝেতে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
কিন্তু তোমার পড়াশোনার জন্য
টেবিল-চেয়ার দরকার। দেখি আদনান স্যারকে বলে।
লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই ব্যবস্থা হয়ে গেল। 888sport free bet login রাখার শেলফ পর্যন্ত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, এখানকার অবস্থান আগের চাইতে স্বস্তিকর। সৃষ্টিকর্তার পরম অনুগ্রহ। তিনি আমাকে ডাস্টবিন থেকে আজ কোথায় তুলে এনেছেন। কিন্তু জীবনের সবটুকুই যে সরল সমীকরণ করা যাবে, এমন নয়।
এ-বাড়ির চারটি ঘরে গাদাগাদি করে বারোজনের বসবাস। ওরা নিজেরা পালাক্রমে রান্না করে, ঘরদোর পরিষ্কার করে। কিন্তু লাবণী খালা আমাকে কোনো কাজই করতে দেন না। প্রথমদিকে একজন খাবারের টেবিলে রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করল আমাকে নিয়ে। বলল, এটা কেমন কথা? আমরা গাদাগাদি করে থাকব, আর সে থাকবে একা। ঘরদোরের কোনো কাজই সে করবে না। আমরা রান্না করব, সে শুধু বসে বসে খাবে। এটা কোন ধরনের আইন?
লাবণী খালা ধমক দিয়ে উঠলেন, পাখি! চুপ করো। মমতাজ তোমাদের মতো নয়। ও তোমাদের মতো মেয়েদের পোশাক পরে রাস্তায় গিয়ে হাত পাতবে না। কারো ছেলেমেয়ের জন্মকালে নাচগানের আসর বসাবে না।
কিন্তু খালা, আমরা কী দোষ করলাম?
দোষের বিষয় নয়। ওর মতো পড়াশোনায় তোমরা যদি এগিয়ে যেতে পারো, তাহলে তোমাদের জন্য এই ব্যবস্থাই হবে। আদনান স্যার বলেছেন ওর যাবতীয় খরচ তিনিই জোগাবেন। ওর ব্যাপারে তোমরা আর কিছু বলো না। এটা আমার হুকুম।
কয়েকদিন পার হলেই বুঝতে পারলাম, সবাই আমাকে কেমন এড়িয়ে চলছে। ওরা নিজেদের মধ্যে সবসময় গল্পগুজব, খুনসুটি নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু আমাকে দেখলে আলগোছে সরে যায়। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর। একবার ভাবলাম লাবণী খালাকে আমার অস্বস্তির কথা খুলে বলি। পরক্ষণে মনে হলো, আমি নিজেই তো সবার সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করতে পারি। এতে লাবণী খালারও আপত্তি হবে না। হলোও তাই। আমি ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুললাম।
আদনান স্যারের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি আমার সবরকম খোঁজখবর নেন। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে জানতে চান। সত্যি বলতে কী, পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। নিয়মিত স্কুলে যাই। আজকাল বুঝতে পারি, স্কুলে আমাকে নিয়ে কিছু কানাঘুষা হয়। এক সহপাঠী একদিন জিজ্ঞেস করল, তুমি ছেলে না মেয়ে?
কেন? তোমার কি অসুবিধা?
সবাই বলে তুমি মেয়ে। তোমার চালচলন সব মেয়েদের মতো। তাই জানতে চাচ্ছিলাম।
এসব জেনে তোমার কোনো লাভ নেই। আমাদের স্কুলে মেয়েরাও তো পড়াশোনা করছে। ছেলে বা মেয়ে সবার জন্যই এই স্কুল। সুতরাং আমি তো কোনো অসুবিধা দেখি না।
এসএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। হেডস্যার আমাকে ডেকে বললেন, এখন থেকে তোমাদের পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রস্তুতির প্রয়োজন। স্কুলের সাধারণ পড়ায় হবে না। আমরা পাঁচজন পরীক্ষার্থীকে বাছাই করেছি। তুমিও আছো। সবাইকে কোচিং ক্লাস করতে হবে।
কোচিং করতে কি অনেক টাকা লাগবে স্যার?
সেটা তোমার ভাবনার বিষয় নয়। স্কুল কমিটি ঠিক করেছে, এই পাঁচজন ছাত্রের কোচিংয়ের জন্য কোনো টাকা লাগবে না। আগামীকাল থেকেই তোমাদের কোচিং শুরু হবে।
পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু ভাবনার অবকাশ নেই এখন। স্কুলের পড়া পড়েই আবার আমাকে কোচিং ক্লাস করতে হচ্ছে। কোচিং শুরু হওয়ার পরদিনই লাবণী খালা আমাকে ডেকে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী কথা?
তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
ভালো। গতকাল থেকে কোচিং শুরু হয়েছে।
তোমাকে এখন দিনরাত পড়তে হবে। তাই ঠিক করলাম, সকালে তুমি ডিম খাবে আর রাতে এক গ্লাস দুধ।
সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।
আমার নিজের কিছু জমানো টাকা আছে। টাকার জন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
খালা! আমি আপনার টাকা নিতে পারব না।
কী পাগলের মতো কথা? আমি টাকা জমিয়ে কী করব?
আপনার তো ভবিষ্যৎ আছে।
অসুখ-বিসুখ হলে …
আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। আমার একটা ছেলে থাকলে আমি তার জন্য এটুকু করতাম। আরেকটা কথা তোমাকে বলি। কেউ জানে না, শুধু আদনান স্যার ছাড়া।
কী কথা?
আমার একটা অসুখ আছে। ক্যান্সার।
এর কি কোনো চিকিৎসা নেই?
চিকিৎসা করেই বা লাভ কী? আজ হোক, কাল হোক, চলে যেতেই হবে। আমার একমাত্র দুঃখ, আমি তোমাকে ডাক্তার দেখে যেতে পারলাম না। হিজড়াদের মাঝ থেকে প্রথম ডাক্তার।
আমার জন্য দোয়া করবেন খালা। আর আপনার অসুখের ব্যাপারে আমি আদনান স্যারের সঙ্গে কথা বলি।
এখন তোমার পরীক্ষার সময়। এখন তাকে কিছু বলার দরকার নেই। পরীক্ষা শেষ হোক, তারপরে যা করার করা যাবে।
পরীক্ষা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার তেমন কিছু ছিল না। স্যাররা বলেছেন, আমার প্রস্তুতি বেশ ভালো হয়েছে। ঠিক তাই। পরীক্ষার হলে বসে মনে হলো, সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা। পরীক্ষার খাতায় কীভাবে কতটা উপস্থাপন করতে পারব, সেটাই ভাবনা। আরেকটা বড় সুবিধা আছে আমার। সেটা হচ্ছে হাতের লেখা। স্যাররা বলেছেন, হাতের লেখা ভালো হলে পরীক্ষার্থীর ব্যাপারে পরীক্ষকের ধারণা ভালো থাকে। কথাটা এবার যাচাই হয়ে যাবে।
ফলাফল বেরোনোর আগে সবারই একধরনের মানসিক চাপ থাকে। আমারও কিছুটা থাকা স্বাভাবিক। যেদিন ফল বেরোবে, সেদিন সকালবেলায় হেডস্যার আমাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি হেডস্যারের ঘরের সামনে এলাহী কাণ্ড। কয়েকজন সাংবাদিক আর টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাধারীরা ভিড় করে আছেন। হেডস্যারের ঘরে জড়ো হয়েছেন স্কুলের প্রায় সব শিক্ষক। শিক্ষকদের মাঝখানে একটা চেয়ারে বসতে বললেন স্যার। স্যারদের সামনে কোনোদিন চেয়ারে বসিনি। আজো বসলাম না। আমি স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী?
তুমি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছো। 888sport app বোর্ডের মধ্যে। এমনকি, সব বোর্ড মিলিয়ে আর্টস-সায়েন্সের মধ্যে তুমিই প্রথম। সকালবেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফোন করে খবরটা আমাকে জানিয়েছেন। এতক্ষণে হয়তো রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে।
একটু পরে টেলিভিশনের সাংবাদিকরা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। তারা ক্যামেরা তাক করল আমার দিকে। আমার জন্য এটা কল্পনাতীত দৃশ্য। কল্পনাতীতই বা বলি কেন? শুনেছিলাম, আমাকে পালক নেওয়ার সময় নেয়ামতউল্লাহ স্যার প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন। তখনকার সেই ছবি আর পত্রিকায় প্রকাশিত খবর হাসিনার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলাম আমি। হাসিনার মা তা কোত্থেকে পেয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা ড্রাইভার আলীর কাছ থেকে তা পেয়ে থাকবে।
বিকালবেলা স্কুলে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। সেটা শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে দেখি সেখানেও এক অবাক কাণ্ড। সারাটা বাড়ি লাল-নীল বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। আমি বাড়িতে ঢুকতেই আদনান স্যার আর লাবণী খালা ফুলের মালা দিয়ে আমাকে বরণ করলেন। বাড়ির বাসিন্দারা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিলো আমার ওপরে।
পরদিন সব পত্রপত্রিকায় আমার ছবিসহ খবর ছাপা হলো। কোনো কোনো সাংবাদিক আমার ব্যক্তিজীবনের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করল। আমাকে যে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল, পুলিশ অফিসার নেয়ামতউল্লাহর কাছে প্রতিপালিত হয়েছিলাম, সেসব কথাও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। শুধু আমার সংবাদ নয়, আদনান স্যারের সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়েছে দু-একটি পত্রিকায়। তিনি বলেছেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে আমি সমাজ বদলের হাতিয়ার। আমি তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার প্রতীক। অন্য দু-একটি পত্রিকায় হেডস্যারের বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাদের স্কুলের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পাবলিক পরীক্ষায় এ-ধরনের ফল কেউ করতে পারেনি। অন্যদিকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিনব্যাপী আমার ছবিসহ সংবাদ প্রচার করল।
বিছানায় শুয়ে আমি মনে মনে ভাবছিলাম, সৃষ্টিকর্তার এ এক অকল্পনীয় ম্যাজিক। আমার তো ডাস্টবিনের মধ্যেই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ভাগ্যচক্রে সেখান থেকে আজ এ-পর্যন্ত এসেছি। পথের গন্তব্য কোথায় শেষ হবে জানি না। কিন্তু আমার জীবনের সবটাই এক অলৌকিকত্বের মোড়কে মোড়া। সামনে একটা লক্ষ্য স্থির করা আছে। ঠিকমতো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলে আমি ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হতে চাই। এদেশে হিজড়াদের চিকিৎসার তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। অসুখে-বিসুখে অনেকেই অকালে মারা যায়। আমি কি এ-অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারব?
বিকালে লাবণী খালা আমাকে দেখতে এলেন। সঙ্গে একজন কমবয়েসি মেয়ে, আমার চেয়ে দু-চার বছর কম হতে পারে। মেয়েটা এ-বাড়িতেই থাকে। তবে আমার সঙ্গে তার খুব বেশি কথাবার্তা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
লাবণী খালা একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী আছে এতে?
একটা মোবাইল। আমরা সবাই মিলে কিনেছি তোমার জন্য।
আমি মোবাইল দিয়ে কী করব? আমার তো কথা বলার কেউ নেই।
কেন? আমি আছি, আদনান স্যার আছেন, তোমার হেডস্যার আছেন। কলেজে ভর্তি হলে তোমার কত বন্ধুবান্ধব হবে।
আমার কাছে কেউ আসবেই না। স্কুলেও আমার বন্ধুবান্ধব বলতে তেমন কেউ ছিল না।
মমতাজ! জীবন কারো কখনো একরকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন অনেক পালটে যায়। তোমার জীবনই কি আর আগের মতো আছে?
তা অবশ্য ঠিক।
আর একটা কথা। মেয়েটাকে কাছে টেনে লাবণী খালা বললেন, এর নাম সখিনা। আমি ওকে আমার মেয়ে বলে ডাকি। সখিনার খুব ইচ্ছা লেখাপড়া করে বড় হওয়ার। তোমার তো এখন পড়াশোনার চাপ কম। তুমি ওকে পড়াটুকু পড়িয়ে দিতে পারো। সখিনা খুব ভালো মেয়ে।
আমার আপত্তি নেই।
তাহলে কাল থেকেই শুরু হোক। তুমি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আর তো বেশি সময় দিতে পারবে না।
আমার তেমন কোনো অসুবিধা হবে না।
সখিনা পড়তে এলো। 888sport free bet login কিছু আগেই কেনা হয়েছিল। পড়াশোনার বিষয়ে বেশ আগ্রহী সে। আমাকে বলল, স্যার! আমিও তো আপনার মতো লেখাপড়া শিখতে পারতাম। আল্লাহ যে কেন আমাকে এমন করল?
ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তুমি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে দেখো। ওদের চেয়ে আমরা কি ভালো নেই? প্রতিবন্ধী হলে অন্যের সাহায্য ছাড়া আমরা চলাফেরা করতে পারতাম না। অবশ্য স্কুলে ওদের পড়াশোনার বিশেষ ব্যবস্থা আছে।
আমাদের জন্য আলাদা স্কুল কেন নেই, এটা আমার এক জিজ্ঞাসা। সাধারণ স্কুলে সবাই আমার মতো পড়ার সুযোগ পেলে কথা ছিল না। সেটা না হলেও আলাদা স্কুল হতে অসুবিধা কী?
সখিনার জীবন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ওরও একমাত্র ভাই প্রতিবন্ধী, বাবা দিনমজুর। সামান্য আয় দিয়ে দুটি সন্তানকে প্রতিপালনের শক্তি তার নেই। প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেল না। তার চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা হলো না। উপায়ান্তর না দেখে ওর বাবা লাবণী খালার হাতে তুলে দিয়ে গেছে সখিনাকে।
আপাতদৃষ্টিতে সখিনাকে দেখে হিজড়া বলে মনে হয় না। দেখতেও বেশ সুন্দর সে। ওকে পড়াতে গিয়ে আমার মনে হলো, ছোটবেলা থেকে পড়ার সুযোগ পেলে অনেক ভালো করতে পারত। আমাদের, অর্থাৎ যাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলা হয়, তারা যে হাত পাতা ছাড়া আরো কিছু করতে পারে, তা কেউ ভেবে দেখে না। তবে আদনান স্যারের কথা আলাদা। আদনান স্যারের মতো আরো কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু তারা কতজনের ভার নিতে পারেন? কতজনের কথা চিন্তা করতে পারেন?
মাঝখানে লাবণী খালার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল। আদনান স্যার নিজেই ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তার লাবণী খালাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, অপারেশন ছাড়া এখন আর অন্য কোনো উপায় নেই। এজন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
আপনি দয়া করে সব ব্যবস্থা করে দিন। টাকার ব্যবস্থা আমি করব। আদনান স্যার বললেন।
আদনান স্যার ও ডাক্তার চলে যাওয়ার পর লাবণী খালা আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, তোমার ডাক্তার হতে আর কতদিন লাগবে?
মাত্র তো এইচএসসিতে ভর্তি হলাম। এরপর মেডিক্যাল কলেজে পাঁচ বছর। কিন্তু এ-কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন খালা?
আমি হয়তো অতদিন বেঁচে থাকব না। তোমাকে ডাক্তার হিসেবে দেখতে পাব না।
খালা, আপনি অকারণে ভাবছেন। ডাক্তার তো বলে গেলেন অপারেশন হলে আপনি ভালো হয়ে যাবেন।
ক্যান্সার কখনো ভালো হয় না রে।
দিনকয়েকের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন লাবণী খালা। আমি আর সখিনা বিকেলে প্রায়ই দেখতে গেলাম তাকে। কয়েকদিনের মধ্যে অপারেশনও করা হলো খালার। ডাক্তার বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। তাকে বেশ কিছুদিন পুরো রেস্টে থাকতে হবে। সত্যি বলতে কী, লাবণী খালাকে নিয়ে ভাবনা ছাড়া আমার জীবনে আর নতুন কোনো কথা নেই।
এইচএসসিতে 888sport apkে আমিই সেরা। তবে চারটি বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় আমার অবস্থান তৃতীয়। আসলে এসব পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়া ছাত্রের ওপর নির্ভর করে বলে আমার মনে হয় না। এ-বিষয়ে পরীক্ষকদের সচেতনতা, নিবিষ্টতা এমনকি ছাত্রের ভাগ্যের ওপরও নির্ভরশীল বলে আমার ধারণা। যাই হোক, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে তেমন অসুবিধা হলো না। ভর্তি বেতন ইত্যাদির সব ব্যবস্থা আদনান স্যারই করলেন। প্রথম থেকেই আমার পড়াশোনার সব ব্যাপারে আদনান স্যার সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এইচএসসি পরীক্ষার সময় কলেজে কোনো কোচিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় তিনি নিজেই কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। অনেকটা ফুটবল মাঠের কোচের মতো। না, উপমাটা হয়তো ঠিক হলো না। ফুটবলের কোচ তো নিজেই প্রশিক্ষণ দেন, তাকে মাঠেও দেখা যায়। আদনান স্যার অবশ্য কখনো সামনে আসেন না।
মেডিক্যাল কলেজে আমার শেষ বর্ষের প্রারম্ভে আদনান স্যার একদিন আমাদের বাসায় এসে বললেন, তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।
কী খবর স্যার?
তুমি আমেরিকা যাচ্ছ।
কেন স্যার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমেরিকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের একটা সোসাইটি আছে। দু-বছর পরপর তারা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা এতে যোগ দেয়। এ-বছর উদ্যোক্তারা পাঁচজন অতিথি বক্তার মধ্যে তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দিন পনেরোর মধ্যে তোমাকে নিউইয়র্কে রওনা হতে হবে। ভিসা ও 888sport app ব্যবস্থা এর মধ্যেই হয়ে যাবে।
স্যার, আমি কী বক্তৃতা দেবো? আমার তো বক্তৃতা দেওয়া মোটেই আসে না।
সে সব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার বক্তৃতার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘888sport appsে হিজড়াদের বর্তমান অবস্থা’। এটা লিখে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এর একটা খসড়া তোমাকে দেওয়া হবে। তাছাড়া, আমি ও তোমার সঙ্গেই থাকব। তোমার যাতায়াতের খরচ ওরা দেবে। আমার খরচ আমাদের প্রতিষ্ঠান জোগাবে।
তাহলে তো ভালোই হয়।
পৃথিবীর এত বিস্ময় যে অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য, বিদেশ যাওয়ার আগে তা কখনো ভাবতে পারিনি। যে-সম্মেলনে আমি যোগ দিতে গেছি, সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় এক হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছেন। যে পাঁচজন বক্তা বক্তব্য রাখবেন, তাদের স্টেজে বসানো হলো। প্রথমেই আমার ডাক পড়ল। যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, তখন করতালিতে ফেটে পড়ল সারা হলরুম। আমি বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমার জীবনের সব কথা বলার পাশাপাশি হিজড়াদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরলাম। হিজড়াদের যে ভোটাধিকার নেই, সে-কথাও বলতে ভুললাম না। তবে মিডিয়া ও এনজিওগুলোর দাবির মুখে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে বলে সরকারের তরফে আশ্বাস পাওয়া গেছে। এর অর্থ, জাতীয় পরিচয়পত্র পেলেই আমরা ভোটাধিকার লাভ করব। বক্তৃতাকালে অসংখ্য ক্যামেরাম্যান ছবি তুলতে থাকল আমার। আমার বক্তৃতার শেষে আবার তুমুল করতালি পড়ল। সেশন শেষ হওয়ার পর আদনান স্যার বললেন, নিউইয়র্ক টাইমস ও সিএনএন তোমার সাক্ষাৎকার নিতে চায়। ওরা সন্ধ্যায় হোটেলে আসবে।
সম্মেলনের কাজ শেষ হলে নিউইয়র্ক থেকে আমাদের ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা। কিন্তু সে-প্রোগাম বাতিল করে আদনান স্যার বললেন, আমাদের যত শিগগির সম্ভব দেশে ফিরে যেতে হবে।
হঠাৎ দেশে ফিরতে হবে কেন?
লাবণীর অবস্থা খুব খারাপ। ওরা আমাকে খবর দিয়েছে।
আসার সময় তো ভালোই দেখেছিলাম।
আমিও তাই ভাবছি। দু-চার দিনের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য তেমন শঙ্কিত হওয়ার কিছু ঘটার কথা নয়। তাহলে তাকে হাসপাতালে নিতে হলো কেন?
অবশেষে আমরা নিউইয়র্ক থেকে সরাসরি 888sport appয় চলে এলাম। বিমানবন্দরেই খবর পাওয়া গেল লাবণী খালা আর নেই। দুদিন আগে তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেছেন। পরদিন তাকে দাফনও করা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে আদনান স্যার ও আমি মোহাম্মদপুরের বাড়িতে পৌঁছালাম। সখিনা এসে একটা কাগজ তুলে দিলো আদনান স্যারের হাতে। আদনান স্যার সেটা পড়ে আবার আমার হাতে দিলেন। চিঠিখানা লাবণী খালার জবানীতে সখিনার হাতে লেখা। আমরা আমেরিকা চলে যাওয়ার পরপরই চিঠিটা সখিনাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন লাবণী খালা। ভেবেছিলেন ফিরে আসার পর দেবেন। কিন্তু সে-সুযোগ তার আর হয়নি। দীর্ঘ চিঠির একটি অংশে আমার কথা আছে। তাতে বলেছেন, আমি কবে ডাক্তার হবো সেই অপেক্ষায় তিনি এখনো বেঁচে আছেন। আরো বলেছেন, সখিনার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত। মেয়েটাকে তিনি নিজের মেয়ে বলে মনে করেন। সখিনা যদি এসএসসি পাশ করতে পারে তাহলে মরেও শান্তি পাবেন। আদনান স্যারকে তিনি আরো বলেছেন, মমতাজ ও সখিনার বিয়ে হলে তিনি খুশি হতেন। এটা তার ইচ্ছা হলেও তিনি তা কখনো প্রকাশ করেননি। আমার ডাক্তার হওয়ার পূর্বে এসব কথা বলে তিনি আমাকে বিড়ম্বিত করতে চাননি। তবে আদনান স্যার যেন এ-বিয়েটা কার্যকর করেন। চিঠিখানা পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ল, লাবণী খালাকে একবার আমি বলেছিলাম, বিশ্বের কোনো কোনো দেশে মেয়ে-মেয়ে ও ছেলে-ছেলেতে বিয়ে হয়। এ-বিষয়ে সে-দেশে আইনও আছে। লাবণী খালা শুনে বলেছিলেন, কী অসভ্য!
চিঠির বিষয়বস্তু চাপা পড়ে গেল কিছুদিনের মধ্যে। এমনকি সখিনার মধ্যেও কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। তবে আমার বসবাসের কিছু পরিবর্তন হলো। লাবণী খালার ঘরে নেমে আসতে হলো আমাকে। অন্যদিকে সখিনা লাবণী খালার ঘরে একসঙ্গে থাকত। সে উঠে গেল চিলেকোঠার ঘরে। বাড়ির 888sport app বাসিন্দার কারো একা এক ঘরে থাকার উপায় নেই। কিন্তু আমার আর সখিনার পড়াশোনার কারণেই এই ব্যবস্থা। লাবণী খালা নাকি আগেই এই ব্যবস্থার কথা বলে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে কারো মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ করা যায়নি। আমার জন্য সবারই মনে একধরনের গর্ব বোধ।
এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল সামনে। পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতির জন্য কিছুদিনের ছুটিও পাওয়া গেল। দিনগুলো গতানুগতিক। আমার জীবনে গতানুগতিকার মাঝখানেও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমী ঢেউ ওঠে। ঠিক তেমনি একটি ঘটনা ঘটল। একদিন বিকেলে সখিনা এসে খবর দিলো, একজন মহিলা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। তবে কী কারণে তা তিনি বলেননি।
আমি মহিলাকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম। চেয়ারে বসালাম তাকে। আমি বসলাম খাটের ওপর। বললাম, কী ব্যাপার? আপনি কি কোনো চিকিৎসার বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন? আমি এখনো ডাক্তার না হলেও অনেকেই আসেন চিকিৎসা সম্পর্কে কথা বলতে।
মহিলা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমিও তাকে নিবিষ্টভাবে দেখলাম। তিনি মধ্যবয়স্ক, পঞ্চাশের কাছাকাছি সম্ভবত তার বয়স। পোশাকে-আশাকে মধ্যবিত্ত বলেই মনে হয়। চিকিৎসার ব্যাপারে তার তো আমার কাছে আসার কথা নয়। আমার কাছে আসে নিম্নবিত্ত মানুষ। পয়সা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর সাধ্য যাদের নেই।
আমি আবার জিজ্ঞসা করলাম, আপনি কি আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন?
মহিলা যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, জি।
কী কারণে জানতে পারি কী?
তোমাকে, মানে আপনাকে দেখতে।
আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন। কিন্তু আমাকে দেখতে আসার কোনো কারণ আছে কি?
মহিলা কী যেন ভাবছেন। বললেন, তোমার কথা সবসময় পত্র-পত্রিকায় আসে। পুলিশ যখন রাস্তার পাশ থেকে তোমাকে উদ্ধার করে …
এসব কথা আপনি জানেন কী করে?
সবই তো পত্রিকায় এসেছিল। এসএসসি পরীক্ষায় তুমি যখন প্রথম হও, তখন টিভি চ্যানেলগুলো তোমাকে দেখিয়েছে।
কী আশ্চার্য! সেসব দেখেছেন আপনি?
কেন? এসব দেখা কি অন্যায় কিছু?
অন্যায় নয়। তবে আমি ভাবছি আমাকে নিয়ে আপনার এই আগ্রহ কেন?
এটা খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক আগ্রহ।
আমার বিষয়ে কারো কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে করতাম না।
কেন?
আমি তো একজন পরিত্যক্ত মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছি।
পরিত্যক্ত মানুষ হিসেবে কেউ জন্ম নেয় না।
সমাজের কাছে আমি এখনো পরিত্যক্ত।
কিন্তু সেই সমাজকে তো তুমি বদলে দিয়েছ। তুমি ডাক্তার হতে চলেছ।
এসব কথা কেন আপনি আমাকে বলছেন? আপনার আসার উদ্দেশ্য কিন্তু আমার জানা হলো না।
আমার আসার কোনো উদ্দেশ্য নেই।
তাহলে?
আমি শুধু তোমাকে দেখতে এসেছিলাম।
মহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, আচ্ছা আসি।
আর কোনো কথা না বলে তিনি চলে গেলেন।
তার চলে যাওয়ার পর এক অজানিত বিস্ময়ে আক্রান্ত হলাম আমি। কে এই মহিলা? কেনইবা তিনি আমাকে দেখতে এসেছেন! আমার সব বিষয়ে তার এই আগ্রহের কারণইবা কী?
একসময়ে আমার মনে হলো, পৃথিবীতে একজনেরই কেবল আমার জন্য আগ্রহ থাকার কথা ছিল। তিনি আমার মা। কিন্তু আমার তো কোনো মা নেই। ছিল কি কোনো দিন? আমি কি কোনো মায়ের সন্তান হিসেবে জন্মেছি? কি জানি! মা কি কখনো আপন সন্তানকে পরিত্যাগ করতে পারে?
জানি না, জানতে চাই না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.