মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাদব পণ্ডিত

যাদব পণ্ডিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে এক পরম বিস্ময়। পুতুল নাচের ইতিকথায় ছোট একটি চরিত্র যাদব। 888sport alternative linkের মূল ঘটনাস্রোতে তার প্রভাব বেশি নয়। তবু আকাশের ধ্রুবতারার মতো শক্তিতে, মহিমায় চরিত্রটি অনন্য, অবিনশ্বর। পরিসরে সীমিত, দ্বীপসদৃশ হলেও চরিত্রটির আবেদন অসামান্য, এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে রহস্য, বিহ্বলতা। পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়ার মতোই যাদবের অপূর্বতা – যদিও কেতুপুরের জেলেজীবন নিয়ন্ত্রণে ও ময়নাদ্বীপের উপনিবেশ তথা জীবনধারা নির্মাণে হোসেন মিয়ার প্রতিপত্তি ও ব্যাপকতা যাদব চরিত্রে নেই। তারপরও যাদব পণ্ডিত আমাদের গভীর মনোযোগ দাবি করে, আমাদের মর্মমূলে নাড়া দিয়ে যায়।

আপাত সহজসরলতায় ঘেরা যাদব পণ্ডিতের জীবন। শশী ও যামিনী কোবরেজের বাড়ির মাঝখানে একটি সুপ্রাচীন, ভাঙাচোরা দালানে একান্ত সাদামাটা গেরস্থালিতে যাদবের দিনযাপন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলিতে যাদবের প্রথম অভিব্যক্তি এরকম, ‘… একহাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ, একহাতে লাঠি, বগলে ছাতি, পায়ে চটি, গায়ে উড়ানি, যাদব পণ্ডিত পথ হইতে শ্রীনাথের দোকানের সামনে উঠিয়া আসিল। বুড়া মানুষ, শরীরটা জীর্ণ, কিন্তু হাড় ক’খানা মজবুত।’

নিঃসন্তান যাদবের ঘরে পক্বকেশ বৃদ্ধা স্ত্রী পাগলাদিদি। দাঁত নেই, মুখে শত বলিরেখা, চলেনও কিঞ্চিৎ কুঁজো হয়ে। সব হারিয়েও হতাশ^াস নেই পাগলাদিদির। আনন্দে সে আনন্দময়ী, হাস্যোৎফুল্ল, এক প্রকার আত্মসুখে পরিতৃপ্ত। নিজের বার্ধক্য, গৃহের বার্ধক্য, কোনোকিছুতে ভ্রƒক্ষেপ নেই, সবকিছু উপেক্ষা করে অমায়িক পথচলা। সবকিছুতে সুখের ছোঁয়া, সবকিছু পরিপাটি। ‘গুছানো সংসার পাগলাদিদির। উপুর করা বাসনগুলি সাজানো, হাঁড়ি-কলসীর মুখগুলি 888sport app, আমকাঠের সিন্দুকটার গায়ে ধৌত পরিচ্ছন্নতা, পিলসুজে দীপটির শিখা উজ্জ্বল, ঘরে এখনো ধূপের মৃদু গন্ধ আছে। আর শান্তসব এখানে শান্ত। মৃদু মোলায়েম প্রশান্তি ঘরে ব্যাপ্ত হইয়া আছে।’ শিক্ষাসমৃদ্ধ আধুনিক ডাক্তার শশীও এ-পরিবেশে আপ্লুত হয়, হয় অভিভূত, ‘শুধু আজ নয়, এখানে আসিলেই তাহার মন জুড়াইয়া যায়।’

ঘর এবং পাগলাদিদির মতো, যাদবের চরিত্রেও একটা সরল সৌন্দর্য আছে, স্নিগ্ধ মাদকতা আছে। সে সারল্যের আকর্ষণ অসীম, অভাবনীয়। গ্রামের অজ্ঞ নির্বোধ লোকেরা শুধু নয়, শশীর মতো মার্জিত বুদ্ধি, ক্ষুরধার ব্যক্তিও তাঁর প্রতি আবিষ্ট না হয়ে পারে না।

যাদব শাস্ত্রজ্ঞানী মহাপণ্ডিত নন, গৃহত্যাগী নিস্পৃহ বিবাগীও নন। সংসারে থেকেই তাঁর সাধনা, গৃহেই তাঁর অতীন্দ্রিয় কর্মযোগ। তিনি সংসারী সাধক পুরুষ, সহজাত অলৌকিক শক্তির অধিকারী। ধর্মসাধনায় বিভিন্ন স্তর অতিক্রমকারী সফল পুরুষ তিনি – সাধারণ্যে এ-বিশ্বাস তিনি সযত্নে লালন করেন, সুকৌশলে বাঁচিয়ে রাখেন। তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তির সীমা নেই। ধুরন্ধর মানুষটা কিন্তু নিজেকে প্রকাশে কৌশলী, সাবধান – অপরের ভক্তিগ্রহণে কোনো উচ্ছ্বাস দেখান না, আবেগও প্রকাশ করেন না। তিনি যে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, সিদ্ধপুরুষ হয়েছেন, ভক্তদের এমন ধারণাকে নীরবে প্রশ্রয় দেন – চাতুর্যের সঙ্গে স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটা না করে। এই নিরাবেগ নিরাসক্তির ফলে ভক্তহৃদয়ে তাঁর অবস্থান আরো দৃঢ় ও সংহত হয়েছে।

যাদব ধীরস্থির সংযমী সাধক – জোরেজারে নিজেকে জাহির করেন না, করার পক্ষপাতী নন। কিন্তু এমন কৌশলে প্রকাশের রীতি রপ্ত করেছেন, জাহির করার চেয়ে তা অনেক বেশি শক্তিশালী, কার্যকর ও ফলদায়ক। সাধারণের সরল বিশ্বাসকে এভাবে তিনি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন।

তুলে ধরার এ-কৌশলকে আমরা দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রতিপন্ন করতে পারি। শশী কলকাতার পাশ-করা ডাক্তার, আধুনিক চিকিৎসা888sport apk আয়ত্ত করে, আত্মস্থ করে তার চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি ও গভীরতা। কিন্তু যাদব পণ্ডিত আধ্যাত্মিক পথের পথিক, অধ্যাত্মদর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট। স্বভাবত আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের অসারতা প্রমাণ করতে তাঁর চেষ্টার শেষ নেই। বিলেতি চিকিৎসা – অপারেশন, ইনজেকশন, ওষুধ বা 888sport app উপায় যার অন্তর্ভুক্ত, আরোগ্যলাভের পথ, তাকে ধর্মজ্ঞানী যাদব তুচ্ছজ্ঞান করেন। তাঁর কাছে আসল জ্ঞান সূর্য888sport apkের জ্ঞান, সব 888sport apkের আদি 888sport apk হলো সূর্য888sport apk। সূর্যের রশ্মিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে, তাকে যথাযথভাবে চিকিৎসায় প্রয়োগ করা তাঁর লক্ষ্য। এক্ষেত্রে, ডাক্তার কবিরাজ সবাই তাঁর দৃষ্টিতে অন্ধ, অস্বচ্ছ, কাণ্ডজ্ঞানহীন। শশী ডাক্তারকে যাদব বলেন, ‘… যেমন তোমরা সব একালের ডাক্তার, তেমনি সব কবিরাজ – দৃষ্টিহীন অন্ধ সব। গাছের পাতার রস নিংড়ে ওষুধ করলে, গাছের পাতায় ওষুধের গুণ এলো কোথা থেকে? সূর্য888sport apk যে জানে সে শেকড়পাতা খোঁজে না শশী, একখানি আতশি কাঁচের জোরে সূর্যরশ্মিকে তেজস্কর ওষুধে পরিণত করে রোগীর দেহে নিক্ষেপ করে – মুহূর্তে নিরাময়। মোটা মোটা বই পড়ে ছুরি-কাঁচি চালাতে শিখে কি হয়।’

কি হয়, সেটা জানে আধুনিক চিকিৎসাবিশারদ শশী ডাক্তার। যাদব জানে না, জানার কথা নয় তাঁর, তবু নিজের প্রতিষ্ঠাকে নিরাপদ রাখতে মিথ্যা জেদ ও অহমিকা। মনগড়া আরোগ্যের দর্শন কি যাদব পণ্ডিত আবিষ্কার করে ফেলেছেন? তাকে রোগনিরাময়ে বা অন্য কোনো কাজে প্রয়োগ করে সফলতা অর্জন করেছেন? একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করতে, বা বিভ্রান্ত করতে সুচতুর যাদব কিন্তু কম যান না – সূর্য888sport apk যে নিজে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন, তার যথাযথ ফিরিস্তি পর্যন্ত হাজির করেন।

ব্রাহ্মণ হিসেবে উপবীত ব্যবহার করেন যাদব, সে উপবীত তিনি প্রচলিত পথে (যথা সাবান, সোডা দিয়ে) পরিষ্কার করেন না, মাজেন না, সূর্যরশ্মিতে মেলে ধরে তা পরিষ্কার করেন। অলৌকিকতাবিরোধী শশী ডাক্তার তা মানতে চায় না, মানতে পারে না। অসম্ভবকে মানবে কি করে? ধূর্ত যাদব তা বুঝে মজার ব্যাখ্যা দেন, ‘সূর্য888sport apkে বিশ্বাস কর না, তাই অবাক হও, নইলে এতো তুচ্ছ। সূর্য888sport apk যে জানে, তার উপবীত কখনো ময়লা হতে পারে? কি করে জান? স্নান করে উঠে রোজ একবার মেলে ধরি, ধবধবে সাদা হয়ে যায়। আজ খানিকটা বাদ পড়েছিল, কেমন ময়লা হয়ে আছে, দ্যাখ।’

শশী যাদবের উপবীতের অংশবিশেষ ময়লা ও মলিন দেখে এটা সত্য – কিন্তু জলমেশানো পাতলা কালিতে ডুবিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে যে সেটা করা হয়েছে, সেটা শশী বুঝতে পারে। বোঝে, এটা তার অপকৌশল, ছলনা। এই দ্বিচারিতা, গোপন চালাকির মধ্য দিয়ে নিজের অলৌকিক শক্তি প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা। সেজন্য সূর্য888sport apk শেখার প্রস্তাবে শশী অস্বীকৃত হয়, নীরবে তাতে অনাস্থা দেখায়। যাদবের এতসব আয়োজন বক্তৃতার মূলেও ওই অবিশ্বাস। যাদব সেটা টের পান, ‘শশীর অবিশ্বাস যাদব টের পান। শশীকে জয় করিবার জন্য এত বেশী আগ্রহের কারণও বোধহয় তাই।’

সূর্য888sport apkে যে শুধু রোগের আরোগ্য হয়, উপবীত পরিচ্ছন্ন হয়, তা নয়। এর কল্যাণে মানুষের অনেক অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, দিব্যজ্ঞান লাভ করা যায়। যাদব পণ্ডিতের ভাষায়, ‘সূর্য888sport apk যে জানে, তার অসাধ্য কী? অতীত ভবিষ্যৎ তার নখদর্পণে। কবে কি ঘটিবে জীবনে কিছুই তাহার অজানা থাকে না। মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত দশবিশ বছর আগে থেকে জেনে রাখতে পারে।’

এই আকস্মিক ঘোষণা, জিহ্বার তাৎক্ষণিক বিচ্যুতি পরে যাদবকে বিপদে ফেলে দেয়, ইচ্ছেমৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

যাদবের চরিত্রে একটা দুর্মর প্রাণশক্তি, একটা অদ্ভুত শক্তিমত্তা আছে। মৃত্যুকে অতিক্রম করে, জয় করে সাধক যাদব অমর হতে চান। বাঁচার সাধ অন্যের চেয়ে কি কম যাদবের? মৃত্যুর নিঃসীম শীতলতা কি যাদবকে তটস্থ করে না? করে বইকি। যাদব সব মানুষের মতো জীবনকে ভালোবাসেন, হয়তো বেশিই বাসেন। প্রাথমিক পরিচয়ের সময় যাদবকে আমরা রাতে লাঠি ঠুকে ঠুকে পথ চলতে দেখি। সাপখোপভরা গাঁওগেরামে আঁধারে লাঠি ঠোকার অর্থ স্পষ্ট। ‘শশী জানে, এত জোরে লাঠির শব্দ করা সাপের জন্য।’ জীবনমৃত্যু সমান বলে মুখে যত ঘোষণা দিক, যাদব জীবনকে ছেড়ে যেতে চান না। একটা কঠিন আত্মসংযম যাদবের জীবন ঢেকে রেখেছে – মানুষের অগাধ ভক্তি ও সিদ্ধিলাভের প্রচারণা যাদব সযত্নে টিকিয়ে রাখতে চান। সাধনায় সিদ্ধির বিষয় তিনি নিজে স্বীকার করেন না, আবার এ-বিশ্বাস খণ্ডাতে চতুরতার সঙ্গে প্রতিবাদও করেন না। এমনি ভারসাম্য, সুনিয়ন্ত্রণ যাদবের, এমনি সংযত জীবনবীক্ষা।

যাদব জন্মবিরাগী। বাইশ বছর বয়সে বাসা বেঁধেছে গাওদিয়া গ্রামে, চল্লিশ বছর ধরে চলছে একটানা বসবাস। অদ্ভুত বৈরাগ্য তাঁর অন্তর্গত চেতনায়। পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়পরিজন – সবাইকে ছেড়ে এসেছেন চিরকালের জন্য। জন্মভিটেও ছেড়েছেন চিরকালের জন্য, ফিরেও আর তাকাননি। যাদবের মধ্যে একধরনের অদম্য অনাসক্তি আছে, যাকে হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয়। কেবল ব্যক্তিজীবনের পরিক্রমায়ই নন, পরদুঃখেও তাঁর প্রতিক্রিয়া হয় শুষ্ক, দায়সারা কাতরতা থাকে না। কলকাতা থেকে ফিরে বালক ভূতোর মৃত্যুর সংবাদ তিনি গ্রহণ করেন অবিচলচিত্তে – শুধু আহা উচ্চারণ করে। এভাবে বিরাট মানবিক ট্র্যাজেডি জলো ও পানসে হয়ে যায়। দুঃখে সিক্ত হন না, সুখে হন না আপ্লুত – এত তাঁর স্বভাবের জোর। ভক্তের গলেপড়া ভক্তি-উচ্ছ্বাসকে ওই নিস্পৃহতা দিয়ে নির্বিকারে গ্রহণ করেন। যাদব পণ্ডিতের সমস্ত জীবনজুড়ে এবংবিধ ভারসাম্য স্থান করে নিয়েছে।

যাদব পণ্ডিতের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ইচ্ছামৃত্যু – নিজের ইচ্ছাতে নিজের মৃত্যু ঘটানো। স্বাভাবিক অর্থে ইচ্ছামৃত্যু আত্মহত্যার শামিল – কোনো অবাঞ্ছিত উপায়ে অকালে নিজের জীবনের ইতি টানা। ইচ্ছামৃত্যুর নামে যাদব কি স্ত্রীসহ নিজেকে হত্যা করেছে? সিদ্ধান্তে আসার আগে সেটা অনুসন্ধান ও বিচার করে দেখা দরকার। তবে সব ভক্ত জানে, নির্দিষ্ট দিনে, স্বেচ্ছায় পরিকল্পিতভাবে, মনের জোরে যাদব স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। শশীকে যে যাদব বলেছেন, সূর্য888sport apkের বদৌলতে অতীত-ভবিষ্যতের সব অবহিত হওয়া সম্ভব। ‘মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত দশ-বিশ বছর আগে থেকে জেনে রাখতে পারে।’ এর পর শশীর কৌতূহলের মুখে যাদব যখন মুখ ফসকে বলে বসেছেন, রথের দিন তাঁর মৃত্যু হবে, তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ যাদব নানাভাবে তাঁর অলৌকিক সত্তাকে মেলে ধরতে চেয়েছেন, অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। ঘটনাক্রমে রথের দিন যাদবের মৃত্যুর খবর সত্যি যখন প্রকাশ হয়ে পড়ল, তাকে পরিপুষ্ট করতে তিনি কোনো উপায় বা ফন্দিই বাদ দিলেন না। ভক্তদের আস্থা-বিশ্বাসকে দৃঢ়, অনড় করে তুললেন। যাদবের সার্থকতা এখানে যে, মানুষের কাছে নিজেকে সৎ ও বিশ^স্ত করে গড়ে তুলতে বাহ্যত ত্রুটিহীন হওয়া। বুদ্ধিমান ও ধুরন্ধর যাদব এভাবে একটা সৎ, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তুলে ইচ্ছেমৃত্যুর পরীক্ষায় পার হয়েছেন, সবাইকে তা সত্য বলে বিশ্বাস করিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

যাদব পণ্ডিত কি মৃত্যুকে ভয় করেন না? করেন বলেই মনে হয়। না হলে সাপের ভয়ে লাঠি ঠুকে পথ চলবেন কেন? অলৌকিক শক্তিধর যাদবের তো আঁধারে আগেই সাপের অস্তিত্ব অনুভব করার কথা, জানার কথা। যিনি সূর্য888sport apkের অলৌকিক শক্তির ব্যাখ্যা দেন, সূর্যের আলোতে ধরে বিস্ময়করভাবে নিজের উপবীত পরিষ্কার করেন, বহু আগে থেকে নিজের মৃত্যুর তারিখ জেনে বসে থাকেন, তাঁর পক্ষে তো সাপের অস্তিত্ব জানা একটা তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু যাদবের আচরণে আমরা তার কোনো প্রমাণ পাই না।

নির্বোধ অজ্ঞ মানুষদের অন্ধবিশ্বাস যাদব পণ্ডিতের কৃতিত্ব অর্জনের মূল পুঁজি। যাদব জীবনকে ভালোবাসেন, সব মানুষের মতোই তাঁর জীবনপ্রেম, জীবানুরাগ। তবে মৃত্যুর সময়ের ঘোষণা দিয়ে সস্ত্রীক যাদব সে-মৃত্যুকে বরণ করলেন কেন? আমরা বিষয়টা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করব।

যাদব চরিত্রগতভাবে নিস্পৃহ ধরনের মানুষ। তিনি আবার একরোখা, একগুঁয়ে, সঙ্গে প্রচণ্ড জেদ। বাইশ বছর বয়সে বাবা-মা, ভাইবোন, জন্মভূমি, চেনা পরিমণ্ডল – সব ছেড়ে আসার মধ্যে তার পরিচয় আছে। ‘নতুন ঘর বাঁধতে হলে পুরানো খড়কুটো বাদ দিতে হবে না?’ তাঁর এ-উক্তিও প্রণিধানযোগ্য। যাদব যেমন সংসার-পৃথিবীকে ভালোবাসেন, তেমনি মৃত্যু-উত্তর অমরতাও কামনা করেন। মানুষমাত্রই পৃথিবীতে টিকে থাকতে চায়, মৃত্যুর পরও তার বেঁচে থাকার সাধ। সে অস্তিত্ব রক্ষার উপায় কারো সন্তানের মধ্যে দিয়ে, কারো ব্যতিক্রমী কর্ম বা অবদানের মধ্য দিয়ে। যাদব এই দ্বিতীয় ধারার প্রতিনিধি। তাই বলে ইচ্ছামৃত্যুকে তিনি হাসিমুখে বরণ করেননি কিংবা পরিকল্পনামাফিক ও সুস্থিরভাবে তাকে বাস্তবায়ন করেননি। ঘটনাটা অনেকটা আকস্মিক, কাকতালীয়। যাদবের মধ্যে কেমন একটা স্ববিরোধিতা আছে। যাদব ‘পদধূলি দেন না, আশীর্বাদ করেন না, পাষাণ দেবতার মত উপেক্ষা করেন ভক্তিকে – শশীর সন্দেহ জাগে লোকের মনে ভয় ও 888sport apk download apk latest version জাগানোর কৌশল এসব।’ তাঁর কোনো মন্ত্রশিষ্যও নেই – তিনি একা, তিনি আলাদা, তিনি বিচ্ছিন্ন। সন্দেহ নেই, এসব তাঁর অভিনব কৌশলের অংশ। উচ্চাকাক্সক্ষী যাদব নিজেকে তুলে ধরতে, নিজের অলৌকিক ক্ষমতাকে জাহির করতে ভালোবাসেন। সূর্য888sport apkের আজব জ্ঞানের যে ভয়ানক শক্তি, মৃত্যুর সময়ের আগাম খবর পর্যন্ত যাতে পাওয়া যায় – গল্পছলে, বাহাদুরির লোভে যাদব শশীকে তা বলে বসেন। এবং শশীর উদ্ধত প্রশ্নের মুখে যাদবের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় তাঁর মৃত্যুর অস্পষ্ট সময়, ‘রথের দিন। আমি রথের দিন মরব শশী।’

স্বেচ্ছায়, সচেতনভাবে তারিখ উল্লেখ করে প্রথমে যাদব কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি, বলেছেন ভাসাভাসাভাবে, বিমূর্তভাবে। সেটা বলেও এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ায় তটস্থ হয়ে পড়েছেন, দিশেহারা বোধ করেছেন। ‘কবে কোন সালের রথের দিন যাদব দেহত্যাগ করিবেন ঠিক হইয়া আছে, শশী আর সে কথা জিজ্ঞাসা করে না, কারণ কথাটা বলিয়াই যাদব এমন ভীতভাবে স্তব্ধ হইয়া যান এবং পাগলাদিদি এমনভাবে অস্ফুট একটা শব্দ করিয়া ওঠেন যে শশী লজ্জাবোধ করে।’

শুধু তাই নয়, এটা যে যাদবের মনের কথা নয়, অন্তরের চাওয়া নয়, তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনামাত্র, তাও বোঝা যায়। শশীর উপলব্ধি 888sport app download for androidীয়, ‘অবিশ্বাসের পীড়নে উত্তেজিত করিয়া এমন অসাবধানে যাদবকে ওকথা বলানো তাহার উচিৎ হয় নাই।’

অর্থাৎ সুচিন্তিতভাবে, ঠান্ডা মাথায় যাদব এসব করেননি, অবিশ্বাসী শশীকে থামাতে ঝোঁকের মুখে বলে ফেলেছেন।

বলা বাহুল্য, ঘোষণার প্রথম ও একমাত্র সাক্ষী শশী ডাক্তার। শশী সময় অনির্দিষ্ট রেখে গল্পের ছলে কুসুমের স্বামী পরানকে এ-কথা বলে। ওতেই হলো সর্বনাশ। এ-কান থেকে ও-কানে, একমুখ থেকে শতমুখে যাদবের ডিনামাইটের মতো বিস্ফোরক ঘোষণাটি ছড়িয়ে পড়ল। এবং তাতে ডালপালা গজিয়ে সত্যমিথ্যা মিশে প্রচার পেল যে, যাদব আগামী রথের দিন স্বেচ্ছায় দেহরক্ষা করবেন (লক্ষণীয়, যাদবের বলা কোনো এক রথের দিন হয়ে গেল আগামী রথের দিন)।

এবার আমরা যাদব পণ্ডিতের পরবর্তী ভূমিকা লক্ষ করব। গ্রামের অত্যুৎসাহী ভক্ত শ্রীনাথ এর সত্যাসত্য জানার জন্য যাদবের কাছে এসে কেঁদে পড়লো। যাদব পড়লেন ফাঁপরে – কি জবাব দেবেন তিনি। ইচ্ছামৃত্যুর কথা তিনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন, রথের দিনে যে হবে (কোন রথের দিনে তা অবশ্য বলেননি) তাও বলেছেন। শেষমেশ পথ না পেয়ে আগামী রথের কথাই কবুল করে নিলেন। অথবা বাধ্য হয়ে এ-প্রচারণাকে মেনে নিলেন। এভাবেও বলা যায়, হুজুগপ্রিয় মানুষদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ভক্তির কাছে আত্মসমর্থন করলেন।

কিইবা করবেন যাদব পণ্ডিত? মেনে নিলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, না মানলে মিথ্যাবাদী, ভণ্ড হয়ে নিগৃহীত হওয়া, নিন্দিত হওয়া। ‘মানুষের অন্ধ ভক্তি ছাড়া বাঁচিয়া থাকিবার আরতো কোন অবলম্বন তাঁহার নাই।’ অকারণ অন্ধ ভক্তি পেয়ে পেয়ে যাদব সবার উপরে উঠেছেন, উচ্চতম একটা আসন দখল করেছেন। সে-উচ্চতা থেকে তিনি কি ছিটকে পড়বেন? ‘রথের দিন যাদব যদি না মরেন, মানুষের কাছে মিথ্যেবাদী হইয়া থাকিতে হইবে তাঁকে, তাঁর সিদ্ধিতে তাঁর শক্তিতে লোকের বিশ্বাস থাকিবে না – যাদবের কাছে তাহা মৃত্যুর চেয়ে শতগুণে ভয়ঙ্কর।’

এত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা ভক্তির সুরম্য প্রাসাদ – চোখের সামনে সামান্য ভুলে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে? এমনটা কল্পনাও করতে পারেন না। অন্যদিকও ভাবার মতো। যাদবের বয়স হয়েছে, বার্ধক্য বিধ্বস্ত, নিস্তেজ করেছে – সন্তানসন্ততি নেই, বৃদ্ধা বিগতযৌবনা স্ত্রীও তেমন আকর্ষণ নয়। অতএব ভক্তিকে জীবন্ত রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া, অমরত্বকে বরণ করা – এরচেয়ে ভালো কী হতে পারে।

তবু উচ্চাকাক্সক্ষা কি মৃত্যুচিন্তাকে একেবারে দূর করে? যাদব অমর হতে চান, সর্বোচ্চে অধিষ্ঠিত হয়ে সসম্মানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চান। হাসিখুশি, সরলপ্রাণ পাগলাদিদি ভেঙে পড়েছেন, যাদবকে মনে হয় নিশ্চল, নির্বিকার। একদম কি বিচলিত নন? ইচ্ছেমৃত্যুর ডামাডোলে, মূর্খ মূঢ়দের উন্মাদনায় যাদব বেশ অবসন্ন, ক্লান্ত। জীবনের বৃত্ত অতিক্রম করে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো সহজ নয়। শেষ ক’টা দিনে আমরা দেখতে পাই, ‘ভিড়ে গরমে যাদব ঘামিয়া বিবর্ণ হইয়া গিয়াছেন, পাগলাদিদি তাড়াতাড়ি পাখা আনিয়া বাতাস করিতে লাগিলেন।’ যাদবের যন্ত্রণা অন্তর্নিহিত, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না, জনসমক্ষে ধরা পড়তে চান না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শশী ডাক্তার মৃত্যুদিন পিছাতে অব্যাহতভাবে চেষ্টা করে, যাদবকে আগামী রথের দিন ইচ্ছেমৃত্যুর দিন না বলে যে-কোনো রথের দিন বলাতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু যাদব অনন্যোপায়, ফাঁদে-পড়া জন্তুর মতো ছটফট করা ছাড়া তাঁর উপায় নেই। শশীকে স্পষ্ট জবাব, ‘তুমি এত বিচলিত হচ্ছ কেন শশী? আমার কাছে কি জীবনমরণের ভেদ আছে? গুরুর কৃপায় সূর্য888sport apk যেদিন আয়ত্ত হলো, যেদিন সিদ্ধিলাভ করলাম, ও পার্থক্য সেদিন ঘুচে গেছে শশী।’

সেই সহজাত আত্মম্ভরিতা, সেই দেমাক আর একগুঁয়েমি। একদিকে জীবনের মায়া, অন্যদিকে আত্মপীড়ন, অসহায়ত্ব – যাদব ছিন্নভিন্ন। আত্মদ্বন্দ্বে আকুল, অনুতপ্ত শশী (ইচ্ছামৃত্যুর খবর প্রথম প্রকাশ করায়) তবু হাল ছাড়ে না, যাদবকে অন্যপথ অবলম্বন করতে প্ররোচিত করে, ‘মনের জোরে আপনি ত মরার দিন পিছিয়েও দিতে পারেন? তাই বলুন না সকলকে। বলুন যে আপনার অনেক কাজ বাকি, তাই ভেবেচিন্তে দুই বছর পিছিয়ে দিলেন দিনটা।’

এ-প্রস্তাবে যাদব একটু আলো দেখেন, আশান্বিতও হন হয়তো, ‘… শশীর মনে হয় একটি ফাঁদে পড়া জীব যেন বেড়ার গায়ে একটা ফাঁক দেখিতে পাইয়াছে।’ কিন্তু যাদব যে বিপন্ন, হাত-পা বাঁধা, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে বসে আছেন। তাঁর বুঝতে দেরি হয় না, ভক্তদের উচ্ছ্বসিত ভক্তিকে এভাবে প্রশমিত করতে গেলে ঝুঁকি আরো বাড়বে, সমস্যা হবে।

‘লোক হাসবে শশী, টিটকারি দেবে।’ যাদব বুঝেসুঝে একথা বলেন।

স্বীকারোক্তির প্রথমদিকে (ইচ্ছামৃত্যু সম্বন্ধে) যাদব কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন, পরিণাম বিষয়ে চিন্তান্বিত ছিলেন। যত দিন গিয়েছে, মানুষের ভক্তি-উচ্ছ্বাস তত প্রবল হয়েছে, যাদবের ভয়সংশয়ও হ্রাস পেয়েছে। সারাজীবন ধরে যাদব অধ্যাত্মপথের নায়ক হওয়ার স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। সে-সুযোগ যখন সবার বাঁধভাঙা 888sport apk download apk latest version-প্রণতির মধ্য দিয়ে দোরগোড়ায় হাজির, তাকে পায়ে ঠেলতে পারলেন না যাদব, কিছুটা ভারমুক্ত বোধ করলেন, একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। ভিন্নভাবে ভাবার, অন্যভাবে অগ্রসর হওয়ার অবকাশ আর থাকল না। তাছাড়া, ইচ্ছামৃত্যুর ঘোষণা এমন আলোড়ন তুলবে, এত সাড়া জাগাবে, তাও কি ছিল কল্পনার মধ্যে! ‘যেরকম অপূর্ব ও লোভনীয় হইয়া উঠিয়াছিল মরণ, মানুষ কি সে লোভ ছাড়িতে পারে?’

শশী নাছোড়বান্দা। যুক্তিবর্জিত ধর্মান্ধদের এসব অসুস্থ বিকার, বন্য তাণ্ডবকে শশী মেনে নিতে পারছে না। প্রহসনের এ-প্রলয়কে থামাতে তাই সে প্রাণপণ প্রয়াস চালায় – এখানে না করে পুরীতে গিয়ে তা বাস্তবায়িত করতে যাদবকে অনুপ্রাণিত করে। রথের সবচেয়ে বড় উৎসব পুরীতে, কাজেই তাঁর ইচ্ছামৃত্যুও বেশি অর্থবোধক ও বর্ণাঢ্য হবে সেখানে। অনেক মাথা খাটিয়ে শশীর এ-ছক তৈরি করা, এভাবে যাদবকে আত্মঘাতী হওয়া থেকে যেনতেন প্রকারে রক্ষার চেষ্টা।

যাদব কি এতে দোদুল্যমান হন না? হন তো অবশ্যই। কিন্তু  যাদবের সমস্যা গুরুতর, এতদূরে এসে পিছাবার পথ নেই। শশী যত নীলনকশা করুক, যত আত্মরক্ষার দাওয়াই বাতলাক – যাদব যে নিজের কারাগারে নিজে আটকা পড়েছেন, যাদব যে অসহায়। সরে এসে যাদব লাঞ্ছনায় পড়তে চান না, কলুষিত হতে চান না। বুদ্ধিমান যাদব শশীর চাল ধরতে পেরে তাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তিরস্কার করেন শশীকে। প্রকারান্তরে, যাদবকে পুরীর নামে যে নির্বাসনে যেতে বলছে, সরে যেতে বলছে, সেটা যাদবের বুঝতে বাকি থাকে না। যাদবের ক্ষোভের অন্য কারণ আছে। যাদবের প্রকৃত স্বরূপ, অসুস্থ মানসিকতা, জটিল দ্বিচারিতা, সবই শশীর কাছে অনাবৃত। কেবল শশী ধরে ফেলেছে তাঁকে, আবিষ্কার করে ফেলেছে তাঁর অন্তর্সত্তা। শশী ছাড়া কেউ তাঁর অসততার নাগাল পায়নি, কেউ তাঁকে ব্যবচ্ছেদ করতে পারেনি। যাদবের চাতুর্য, পৌরুষ, গগনস্পর্শী অহংকার – মার খেয়েছে সেখানে, ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এসবও শশীর প্রতি যাদবকে রুষ্ট করেছে।

বাঁচার সাধ কার নেই? কিন্তু যাদব পণ্ডিতের সামনে পথ অবরুদ্ধ। তার ওপর, যে-কোনো অবস্থা অনভিপ্রেত ও অপাঙ্ক্তেয় হয়েও, অব্যাহতভাবে চললে একটা সময় সহনীয় হয়ে যায়। ইচ্ছামৃত্যু ঘোষণার পর প্রথম পর্যায় কষ্টকর ছিল, দুর্বিষহ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবসান হয়, অসহ্য যন্ত্রণাক্লেদ কিছুটা কেটে যায়। ইচ্ছামৃত্যুর ঘোষণায় যখন ভক্তি888sport apk download apk latest versionর বান ডাকে, মানুষ হন্যে হয়ে তাঁর পায়ের ধুলা নিতে চায়, আশীর্বাদ নিয়ে কৃতার্থ হতে চায়, যাদব তাতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, সাহসও পায়। মনে হয়, এটাই সত্য, এভাবে মৃত্যুবরণ করাতেই সার্থকতা, গৌরব। পাগলাদিদি ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কায় লন্ডভন্ড হয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, তাঁকেও সাহস ফিরে পেতে দেখি। পুরীর প্রস্তাবে পাগলাদিদির সায় থাকলেও, সময়ের ব্যবধানে ভয় ও উদ্বেগ কেটে স্থিতি আসে, মানুষের ভাবাবেগ প্রধান ও সত্য হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে শশীকে পাগলাদিদি, ‘পালিয়ে গিয়েইবা কি হবে বল? ক’বছর আর বাঁচব। বিদেশে নতুন লোকের মধ্যে কত কষ্ট হবে, মনে একটা আপশোসও থেকে যাবে। … তারচেয়ে এভাবে যাওয়া ঢের বেশী গৌরবের।’

ইচ্ছেমৃত্যু বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে শশী প্রশ্ন তুললে (যেমন – ‘নিজের ইচ্ছায় যখন খুশি কেউ কি যেতে পারে দিদি?’) পাগলাদিদি তখন আপামর কুসংস্কার-ক্লিষ্ট মানুষের সারিতেই, তাকেও দেখি বিভ্রান্ত, স্বামীর অলৌকিকত্বে পূর্ণ আস্থা – ‘ও যে সিদ্ধিলাভ করেছেরে পাগল। ওর অসাধ্য কিছু আছে।’

যাদব পণ্ডিতের ইচ্ছামৃত্যু শশী কোনোভাবে ঠেকাতে পারেনি।

না পারলেও ইচ্ছামৃত্যুতে বিশ্বাস স্থাপনও করতে পারেনি। শশী কলকাতার ডাক্তার, আধুনিক 888sport apkমনস্ক মানুষ – চিকিৎসা888sport apkের নাড়ি-নক্ষত্র তার নখদর্পণে। জন্মমৃত্যুর রহস্য তথা কারণ তার অজানা নয়। কেউ ইচ্ছে করলে আধ্যাত্মিক শক্তির বলে নির্দিষ্ট দিনে নিজের মৃত্যু সংঘটিত করতে পারে (আত্মহত্যার মতো অস্বাভাবিকতার কথা আলাদা), এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শশী অশিক্ষিত আমজনতা নয়, যুক্তিহীন ধর্মবিশ্বাসীও নয়, ভাবাবেগে তার বিশ্বাস নেই। যুক্তির কষ্টিপাথরে বেড়ে উঠেছে তার বোধ ও মনন। তাই এ-বিষয়ে পাই তার যুক্তির ধার, ‘এখন তো তাহার বিশ্বাস হয় না যে মানুষ নিজের ইচ্ছায় মরিতেও পারে, মরিবার আগে জানিতে পারে কবে মরণ হবে।’

যাদব পণ্ডিতের ইচ্ছামৃত্যু উপলক্ষে গাওদিয়ার কায়েতপাড়ায় নেমেছে মানুষের ঢল। জোয়ান, তরুণসহ আবালবৃদ্ধবণিতার ভিড়, ঠেলাঠেলি, মহাপুরুষ যাদবের পদধূলি ও আশীর্বাদ নেওয়ার প্রতিযোগিতা। অলৌকিকতা যে স্বেচ্ছায় ঘটাতে পারে, সে তো সাধারণ কেউ নন, অসাধারণ, মহাপুরুষ – তাঁর দর্শনমানে দিব্যদর্শন, নিশ্চিত স্বর্গলাভ। অবোধ, অন্ধভক্তরা সে-কাজে উন্মত্ত হবে, কাণ্ডজ্ঞান হারাবে, এ তো স্বাভাবিক।

এ-জাতীয় গ্রাম্য কুসংস্কারের বন্যায় গ্রামের ছেলে শশী কি একটুও আক্রান্ত হয়নি? সে-ঝাপটা সামান্য হলেও তার গায়ে লেগেছে বলা যায়। শশীর কোনো কোনো সময় এমন ভাবান্তর হয়, ‘এক এক সময় তাহার মনে হয়, বাঁধা যুক্তির অতিরিক্ত কিছু হয়তো আছে জগতে, যাদব আর যাদবের মত মানুষেরা যার সন্ধান রাখেন।’ কিন্তু হলেও এসব অস্থায়ী, সাময়িক প্রতিক্রিয়ামাত্র – শশী যুক্তিতে একনিষ্ঠ থেকেছে বরাবর। যুক্তিবাদী যুবক ডাক্তারটি কিছুতেই মেলাতে পারছে না, একটা সুস্থ, জলজ্যান্ত মানুষ কি করে যখন-তখন নিজের ইচ্ছায় পরলোকগমন করতে পারে। তাই তো তার কৌতূহল, সে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধিৎসু, সত্যান্বেষী – হুজুগে বিশ্বাসীদের জোয়ারে গা ভাসাতে পারেনি। সাধারণরা যখন অন্ধভাবে বিশ্বাস করে মাতামাতি করছে, অলৌকিক মহিমায় আত্মহারা হচ্ছে, শশী তখন নীরবে করছে পর্যবেক্ষণ। চিকিৎসক শশীর চোখে সে-দৃশ্য, ‘যাদবের মুখ ঢাকিয়া গিয়াছিল চটচটে ঘামে আর কালিমায়, চোখের তারা দুটি সঙ্কুচিত হইয়া আসিয়াছিল।

তিন-চার হাজার ব্যস্ত উত্তেজিত লোকের মধ্যে ডাক্তার শুধু শশী একা, সে শিহরিয়া উঠিয়াছিল। তবু পলক ফেলিতে পারে নাই। যাদব  ও পাগলাদিদির দেহে পরিচিত মৃত্যুর পরিচিত লক্ষণগুলির আবির্ভাব একে একে দেখিয়াছিল।’

পাগলাদিদির ইচ্ছামৃত্যুর কথা ছিল না, সেও যখন যাদবের সঙ্গী হলো, মানুষের উত্তেজনা ক্ষ্যাপামিতে পৌঁছাল। শুধু নীরব দর্শক শশী ডাক্তার, যার কাছে মৃত্যুর কারণ তথা রহস্য সন্দেহাতীতভাবে অবারিত, সুস্পষ্ট।

আফিমের বিক্রিয়া জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে যাদব ও পাগলাদিদির।

যবনিকা পড়লো যাদব পণ্ডিতের ইচ্ছামৃত্যুর এ-নাটকের। সন্দেহ নেই, এ-নাটকে সফলতম অভিনেতা তথা নায়ক যাদব। দিনে দিনে পরিকল্পনামাফিক ঠান্ডা মাথায় নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলে শেষমেশ ইচ্ছামৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সার্থক পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। প্রায় নিখুঁত ও উচ্চাঙ্গের এ-অভিনয় যাদবের সকল সীমাবদ্ধতাকে আড়াল করেছে, সিদ্ধপুরুষ থেকে তাকে মহাপুরুষে রূপান্তরিত করেছে। ভাবাবেগপীড়িত, যুক্তিবোধশূন্য মানুষের কাছে যাদব যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ করা মহান সাধক – যিনি আত্মাকে নিজের ইচ্ছায় বিদায় দিয়ে দেহরক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। যুক্তিবর্জিত, শিক্ষিত বিশ্বাসীদেরও তিনি নাড়া দিয়েছেন, তাঁর প্রতি আস্থাস্থাপনে অনুপ্রাণিত করেছেন। রামতারণের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ উকিল – যার কাছে যাদবের হাসপাতাল নির্মাণের উইল গচ্ছিত ছিল, তিনিও সমানভাবে তাড়িত, আলোড়িত। শশীর কাছে তার প্রতিক্রিয়া, ‘স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করবেন এরকম একটা খবর কানে এসেছিল, গুজব বলে বিশ্বাস করিনি। নইলে একবার দেখতে যেতাম। এখন আফশোস হয়। কতবার পায়ের ধুলা দিয়েছেন, এতবড় মহাপুরুষ ছিলেন জানলে পরকালের কিছু কাজ করে নিতাম।’ ভক্তি এখানেই শেষ হয় না, ‘মরছে সবাই, অমন মরণ হয় ক’জনের? অসুখ নেই, বিসুখ নেই, ইচ্ছে হলো আর আত্মা দেহ ছেড়ে অনন্তে মিশিয়ে গেল। তোমার ডাক্তারী শাস্ত্রে একে কি বলে শশী?’ ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যে এমন জ্ঞানের উন্মেষ হয়নি, প্রকাশ হয়নি, তাও তিনি বলেছেন। মোট কথা, যাদব তার মহাপুরুষসত্তা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে অমরত্ব লাভ করেছেন।

যাদবকে সবাই সৎ ও সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছে, অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছে, কেউ এতটুকু অবিশ্বাস করেনি। অথচ সত্য উদ্ঘাটনের মূল অস্ত্র হলো সন্দেহ। সেটা সাধারণভাবে হয়নি বলে মিথ্যাই সত্যে রূপলাভ করেছে। যাদবের অসততা, যাদবের বুজরুকি একমাত্র শশী ডাক্তারের চোখে উদ্ঘাটিত হয়েছে, আর কারো কাছে নয়। মিথ্যার শক্তিও মাঝে মাঝে প্রবল হয়, বিশাল হয়। ফলে মিথ্যাই প্রকটিত হয়ে স্থায়ীরূপ লাভ করেছে, যাদব চিরকালের জন্য পরিণত হয়েছেন মহাপুরুষে, সাধকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপলব্ধি এ-বিষয়ে 888sport app download for androidীয়, ‘সত্যিমিথ্যায় জড়ানো জগৎ। মিথ্যেরও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।’

যাদবের মিথ্যারও অভিন্ন পরিণতি হয়েছে, সত্যরূপে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।

যাদব পণ্ডিত সত্যিই পুতুলনাচের ইতিকথার বিস্ময়কর চরিত্র। সমগ্র বাংলা 888sport live footballে এমন বিচিত্র চরিত্র বিরল, চোখে পড়ে না। জীবিত যাদবের চেয়ে মৃত যাদবও কম অভিনব, কম অভূতপূর্ব নন। সাদামাটা পথচলা, ভাঙাচোরা ঘর গেরস্থি, সামান্য চাহিদা, অনাড়ম্বর জীবনযাপন – এসবের মধ্যে যাদবের উইল স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো চমকপ্রদ। গ্রামে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য তিনি সবকিছু উইলের মাধ্যমে দান করে গেছেন। শশীসহ তাতে সবাই হতভম্ব, বাকরুদ্ধ, ‘হাজার পনর টাকার কোম্পানীর কাগজ, বারতের হাজার নগদ, আর যেখানে যাদব বাস করিতেন সেই বাড়ি ও জমি।’ অর্থমূল্যে বিরাট না হোক, যাদবের জন্য কম নয়, বলতে গেলে মহাবিস্ময়। আরো সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার ট্রাস্টি করে গেছেন শশী ডাক্তারকে। শশীকে যাদব স্নেহ করতেন বটে, কিন্তু দুজনের স্বরূপ, আদর্শ ও মূল্যবোধে দুজন দু-প্রান্তে, তাদের মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ। অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর মধ্যে যাদবের গভীর জীবনবোধ, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ও বাস্তব চিন্তার পরিচয় আছে। যাদব কম জ্ঞানী মানুষ নন। পুরীতে চলে যাওয়ার উপদেশে শশীর উপর যাদব বিরূপ ও বিরক্ত হয়েছেন, রাগে শশীর মুখ আর দেখতে চাননি। কিন্তু শশী ডাক্তার যাদবের কাছে তুচ্ছ নয়, হেলাফেলার নয় – প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান ব্যক্তি। ‘এ জগতে পাগলাদিদির পর সেই যে তাঁর সবচেয়ে স্নেহের পাত্র।’ সে স্নেহময়তা ছড়িয়ে আছে যাদবের সকল তৎপরতায়। শশী তিরস্কারে অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ হলে তাকে উপেক্ষা করতে পারেননি যাদব। প্রথমে শ্রীনাথের মাধ্যমে ডেকে পাঠানো হয়েছে, পরে স্বয়ং পাগলাদিদি গিয়ে ডেকে এনেছে বাড়িতে। শশীর গুরুত্ব সব মিলে অসাধারণ, অপরিসীম, অনুধাবন করার মতো। শশীকে পেয়ে যাদব কতভাবে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন, প্রেরণাও দান করছেন কম নয়। যাদবের উক্তি লক্ষণীয়, ‘তোমার কথা ভাবছিলাম শশী। … মায়ার বশে কুপরামর্শ দিয়ে গেলে, থেকে থেকে কথাটা বিমনা করে দিয়েছে, সহজে তুচ্ছ তো করতে পারি না তোমার কথা।’ অর্থাৎ শশীকে সামান্য জ্ঞানে নয়, অসামান্যভাবেই হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন, আপন করে গ্রহণ করেছিলেন। দূরদৃষ্টি দিয়ে, মানবচরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষমতা দিয়ে যাদব শশীর গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পেরেছেন, তাঁর মূল্যায়নে ভুল হয়নি। শশীর সততা, শশীর নৈতিকতা, শশীর সত্যবাদিতা, এসব কি যাদবের অজানা? হাসপাতাল নির্মাণের জন্য যাদব যে উইল করে গেছেন তা পালনের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে শশীর ওপর। ‘ব্যবস্থার ভার শশীর, দায়িত্ব শশীর।’ একমাত্র শশীর হাতে যে যাদবের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা সঠিকভাবে প্রতিপালিত হতে পারে, অন্য কারো দ্বারা নয়, জ্ঞানঋদ্ধ যাদবের চেয়ে সেটা কি কেউ বেশি জানে! যাদব এত স্ববিরোধী অথচ এত বাস্তববাদী যে, আমরা হতবাক না হয়ে পারি না। তিনি আমাদের প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছেন, আমাদের মূল্যবোধে ধস নামিয়েছেন। যার সঙ্গে চিন্তাচেতনার কোনো মিল নেই, যাদবের ঐশী শক্তিতে যার রীতিমতো সন্দেহ, সেই শশী কি না হলো যাদবের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি। এরচেয়ে আশ্চর্যের আর কি হতে পারে?

যাদব-চরিত্রের নানা বৈচিত্র্য ও বাঁক আগ্রহভরে লক্ষ করার মতো। যাদব আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তাতে আস্থা নেই – তবু সেই আধুনিক চিকিৎসার হাতপাতালের জন্য সর্বস্ব দান করে গেলেন। এর হেতু কি আমরা বুঝতে পারি? মানবকল্যাণে যাদবের অবদান আপাতদৃষ্টিতে অবশ্যই স্ববিরোধী, গোলমেলে; কিন্তু তা যে যথাযথ, বাস্তবসম্মত, প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকরও, যাদবের চেয়ে সে সত্য কে বেশি বোঝে! সূর্য888sport apkের কল্পিত চিকিৎসা, যার কথা যাদব বারবার উল্লেখ করেছেন, তার মূল্য না দিয়ে যুগোপযোগী চিকিৎসার পথে এগোলেন কেন? আধুনিক চিকিৎসা যে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণসাধনে সক্ষম, মানবসেবায় সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে, তাও যাদব পণ্ডিত নির্ভুলভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন। যাদব চরিত্রকে এসবও কম উজ্জ্বলতা দান করেনি, কম অনন্যতা দেয়নি।

888sport alternative linkের আরেকটা চমক সৃষ্টি করার মতো ব্যাপার – যাদব মৃত্যুর আগে শশীর কাছে উইলের কথা প্রকাশ করে যাননি। এখানেও যাদবের দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর আছে। যাদব চাননি, উইলের খবরে শশী কোনোভাবে প্রভাবিত হোক, যাদবের প্রতি তার আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসুক। যাদবের এতগুলো টাকার দায়িত্ব পেয়ে শশী তাঁর প্রতি প্রসন্ন ও প্রীত হয়ে উঠবে, তাঁকে মনভুলানো কথায় খুশি করার চেষ্টা করবে, এরূপ অযাচিত, অতিরিক্ত কোনোকিছু যাদবের কাম্য নয়। যাদব শশীর সহজ, স্বাভাবিক ব্যবহারই টিকিয়ে রাখতে চান – মৃত্যুর পরও চান, শশীর চরিত্রে সে স্বাভাবিকতা যেন বহাল থাকে। শশী তার সহজাত চরিত্রশক্তি দিয়ে, স্বাভাবিক বুদ্ধিবিবেচনা দিয়ে উইলের দায়িত্ব পালন করুক, প্রভাবিত হয়ে নয়, যাদব সেটাই প্রত্যাশ্যা করেন।

সংযমী, অদ্ভুতকর্মা যাদবের চরিত্রের এই দিকটিও কম বিস্ময়কর নয়।