দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি। ভিন্ন দুই ক্ষেত্র। উভয় ক্ষেত্রেই আছে সম্পর্কের নানা স্তর। তুলনা করে দেখলে গভীর কিছু মিল-অমিল চোখে পড়ে। বিষয়টা ভেবে দেখবার যোগ্য।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা হতে পারে সহযোগিতার, প্রতিযোগিতারও। সীমাবদ্ধ সম্পদের বণ্টন নিয়ে ঘটে দ্বন্দ্ব। সম্পদের বর্ধনের জন্য প্রয়োজন হয় সহযোগিতা। জীবনের পথ মসৃণ নয়; প্রশ্ন ওঠে বারে বারে ঘটনার বাঁকে বাঁকে, সহযোগিতা কি সম্ভব? সংঘর্ষ কি অনিবার্য? সম্ভাবনা রয়েছে একাধিক, কী ঘটবে সেটা নির্ভর করছে কিছুটা কী ভাবা হচ্ছে তার ওপর। ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।’ দৃঢ়ভাবে কিছু ধরে নিলে ভিন্ন ভাবনা তখন ভুল মনে হয়, ভুল অথবা সেই সময়ের জন্য অবাস্তব। ভারতবিভাগ কি অনিবার্য ছিল? দুই ব্যক্তি, দুই গোষ্ঠী, দুই শ্রেণি, দুই দেশ, সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য দ্বন্দ্বমূলক চিন্তা, সম্ভাব্যবাদ, অনিশ্চয়তার তত্ত্ব। যাঁরা বলেন ধনিকের সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ক সর্বাংশে বিরোধের, নিশ্চিতভাবেই বিরোধের, তাঁদের চিন্তাটা আসলে বড়ই যান্ত্রিক। দ্বন্দ্ব আছে বটে, তবে সেটাই সব নয়। 888sport live chatপতি ও শ্রমিক হাত মিলিয়ে গড়ে তুলেছে নতুন জাপান। আরো সহজ কথায় আসা যাক। আপনার সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক কী হবে, সহযোগিতার অথবা কলহের অথবা নিতান্তই পারস্পরিক উপেক্ষার? ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন হবে আজ অথবা আগামীকাল? প্রতিযোগিতায় নেমেও কিন্তু দুই সম্ভাবনা থেকে যায়, মিত্রভাব নিয়ে প্রতিযোগিতা অথবা অনড় বৈরভাব। দুই বাংলার ভেতর কী হবে সম্পর্ক? কেউ বলবেন, ব্যাপারটা বাস্তব পরিস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায়। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়, কিছুটা ঠিক বটে। ভারত-পাকিস্তানের ভেতর ক্রিকেট খেলাটা মিত্রভাব নিয়ে হবে কিনা, সেটা খানিকটা আমাদের ভাবনার ওপরই নির্ভর করেছে। জার্মানি ও ফরাসি দেশের ভেতর রাজনীতির খেলাটা কেমন হবে, সেটা পূর্বনির্ধারিত নয়। বলা হয়েছে, মানুষ তার নিজ ইতিহাসের নির্মাতা। ভাবনার কিছুটা স্বাধীনতা না থাকলে নির্মাতা হওয়া যায় না। মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের পথটা পূর্বনির্ধারিত নয়। দ্বন্দ্বের ধরনের সঙ্গে যোগ আছে চেতনার স্তরের।
এবার তুলে ধরা যাক মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য। মানুষ প্রকৃতিকে ভয় পায়। মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কিছু প্রাথমিক কারণ আছে। মা যেমন শিশুকে স্তন্য দেয়, প্রকৃতিও তেমনি মানুষকে জীবনধারণের উপকরণ জুগিয়ে দেয়। প্রকৃতির সহায়তা ছাড়া জীবনলাভ ও জীবনযাপন কোনোটাই সম্ভব নয়। আবার ভয়েরও কারণ আছে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করে। মানুষ ক্রমে ভাবতে শেখে যে, প্রকৃতির সঙ্গে তার সংগ্রামের সম্পর্ক। যে-মানুষ একদিন প্রকৃতিকে ভীতির চোখে দেখেছে সে এখন 888sport apkের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করবার ভাবনা ভাবছে। আদিম অসহায় ভয়ার্ত ভাবে ছিল তামসিকতার প্রকাশ। আজকের রাজসিক প্রভুত্বপরায়ণ ভাবকেও কিন্তু প্রজ্ঞা বলা যাবে না।
দর্পিত প্রভুত্বকামিতাকে প্রজ্ঞা বলা যাবে না একাধিক কারণে। প্রকৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষ পরিবেশের এমনই ক্ষতিসাধন করেছে যে, এ-ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে ভূপৃষ্ঠে মানবজীবনের স্থায়িত্ব শীঘ্রই বিপন্ন হবে। এ-বিষয়ে গত কয়েক দশকে এত কথা বলা হয়েছে যে, অধিক ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। মানুষ ও পরিবেশের ভেতর রয়েছে এক সুদূরবিস্তৃত পরস্পরনির্ভরতা। একটা উদাহরণই যথেষ্ট। দীর্ঘ যুগ ধরে মানুষ ও তরুলতা একত্রে বাস করে চলেছে এক নিগূঢ় সামঞ্জস্যের সহায়তায়। মানুষ বায়ু থেকে গ্রহণ করে প্রাণরক্ষক অমøজান বা অক্সিজেন। নিশ্বাসের সঙ্গে সে ত্যাগ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস, যাতে পরিবেশ দূষিত হয়। মানুষের পক্ষে হানিকর এই গ্যাসকে বৃক্ষ গ্রহণ করে আর দান করে অম্লজান। এইভাবে পরিবেশ মানুষের প্রাণধারণের জন্য সুরক্ষিত থাকে। জন888sport free betর বৃদ্ধি একটা সীমা ছাড়াবার পর আর কলকারখানার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে বৃক্ষসংহার ঘটে চলেছে বিপজ্জনকভাবে। ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে নিপুণভাবে গঠিত ভারসাম্য। এটা উদাহরণমাত্র।
এখানে ইঙ্গিত আছে এক সর্বব্যাপী সংকটের। এই সংকটকে ঠেকাবার জন্য কী চাই? চাই আর্থব্যবস্থা ও সমাজসংগঠনের পরিবর্তন, আরো চাই নতুন জীবনদর্শন। সমাজসংগঠনের অন্তর্ভুক্ত পল্লীসংগঠন। এ-নিয়ে অন্যত্র লিখেছি বহুবার, যেমন অন্য এক বিপ্লব নামে 888sport liveে ও পুস্তকে (মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা)। জীবনদর্শন নিয়ে কিছু বিশেষ কথা এবার বলা যাক।
সংকটের দুই মুখ, লৌকিক ও আত্মিক। লৌকিক দৃষ্টিতে প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাব। অন্তর্মুখী দৃষ্টিতে ধরা পড়ে অন্য এক তাড়না, নিঃসঙ্গতা আর আগ্রাসী শূন্যতাবোধ। সামান্য অনুসন্ধানে জানা যায়, যেসব দেশ আজ আর্থিক দিক থেকে উচ্চস্থানে আছে তারাও সুখে নেই। আমরা নিজেরাও সবসময়ে সচেতন নই নিজেদের অন্তরের গভীরতর আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে। মানুষ মানুষের সঙ্গ চায় শুধুই সাংসারিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য নয়। সে আরো কিছু চায়। তৃষ্ণার্ত হৃদয় এমন এক নিঃসঙ্গতা পূর্ণ করে নিতে উৎসুক, যাকে প্রকাশ করবার ভাষা সে সম্পূর্ণ জানে না। প্রকৃতির কাছেও মানুষের প্রত্যাশা শুধু প্রাণধারণের উপকরণ নয়, অতিরিক্ত আরো কিছু। তাই যদি না হতো তবে বৃথাই কবি যুগ যুগ ধরে কাব্যরচনা করেছেন, বৃথাই সংগীতসাধক গান গেয়ে চলেছেন। এই সংগীত শুধু রাজদরবারের জন্য নয়। রাজ্য-সাম্রাজ্য ভেঙেছে-গড়েছে, দরবারি বিলাস 888sport sign up bonus হয়ে দূরে সরে গেছে। তবু সুদিনে দুর্দিনে লোকসংগীতের সুর ক্ষান্তিহীন ধ্বনিত হয়ে চলেছে পল্লীর মাঠে মাঠে, নদীর বক্ষে, জনতার মেলায় আবার সাধকের নিঃসঙ্গ কুটিরে। হৃদয়ের কোন্ গহনে এর উৎস? মানুষের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির সম্পর্কের কোন্ গভীর স্তরে? একে উপেক্ষা করলে কিন্তু অবজ্ঞা করা হয় নিশ্চিতভাবে জনমানসকেই।
ঝড়, ঝঞ্ঝা, বন্যায় মানুষের পাতানো সংসার তছনছ হয়ে যায়। মানুষ আবারও ঘর বাঁধে বহু কষ্টে। তবু প্রকৃতির প্রতি তিক্ততা সে ধরে রাখে না, মাঠে মাঠে নদীবক্ষে আবারও সে গান গেয়ে চলে। সংসারে ভালোবাসার এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ নয়। মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা হৃদয়হীনতা মানুষের পক্ষে ক্ষমা করা কঠিন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কবি স্থাপন করেছেন নিঃশর্ত প্রেমের সম্পর্ক 888sport app download for androidাতীত কোন্ যুগ থেকে। প্রকৃতির অত্যাচার মানুষকে দুঃখী করে, তবু প্রকৃতির সঙ্গে কোনো স্থায়ী বিচ্ছেদ তাতে সৃষ্টি হয় না।
আচারসর্বস্ব ধর্মে মুক্তি নেই। যদি রক্ষার যোগ্য হয় অধ্যাত্মমুখী জীবনদর্শন, তবে তার অন্যতম প্রশস্ত আশ্রয় আছে প্রকৃতিপ্রেমে। বিশ্বপ্রকৃতির কাছ থেকে মানুষ পেয়েছে যুগে যুগে এমন এক শুদ্ধ যোগের আনন্দ, হৃদয়ের গভীর থেকে যা সে চেয়েছে, কিন্তু সংসারে যে-জিনিস বড় দুর্লভ। প্রকৃতি থেকে পাঠগ্রহণ করে মানুষ তাকে স্থাপন করে সংগীতে, সেই সংগীত সংসারে তাকে দুদণ্ড শান্তি দেয়। আর এই আরোহণ সত্য শুধুমাত্র সংগীতের ক্ষেত্রে নয়। যেখানেই ছন্দ আছে এবং মানুষের অনুভূতিতে সেটি ধরা পড়ে সেখানেই শুরু হয় 888sport live chatীর রূপসৃষ্টির খেলা। মানুষ পৌঁছে যায় নিজ নিজ সাধ্য-অনুযায়ী আপন সত্তার উন্মোচনের পথরেখা ধরে বাহ্য প্রয়োজনের জগৎ ছাড়িয়ে মুক্তির বিশ্বে।
এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় একাধিক। তবে প্রশ্নগুচ্ছ এমনই হলে ভালো, যার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা এগিয়ে যাই সেই জীবনদর্শন ও সমাজসংগঠনের দিকে, যেখানে মানুষের অস্তিত্বের ভৌতিক ও আত্মিক দুই স্তরের দাবিরই স্বীকৃতি আছে সুস্পষ্ট। প্রয়োজনেরও নানা স্তর আছে, কোনোটাই তুচ্ছ নয়। সমন্বয়ের পথের সন্ধান করাটাই বড় প্রয়োজন। সমন্বয়ের অভাব বেদনাদায়ক। সেই বেদনাকে ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় নিযুক্ত হয়েছে আধুনিক ভোগবাদ। বাইরের পাওয়া তুচ্ছ নয়, একটা মাত্রা অবধি জরুরি, তবু অন্তরের প্রাপ্তিতেই জীবন ধন্য হয়। এরই জন্য মানুষ অপেক্ষা করে আছে অন্তহীন কাল। প্রতীক্ষা হয়ে ওঠে বিরহের বাণী, জাগতিক উদ্যোগ আবার মরমিয়া দর্শন।
সন্ধানটাই পথ। পথের শেষ নেই। আছে শুধু মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ানো, আছে অন্তর্জগতে চমকে ঝলকে অন্য এক আলোকের অনুভূতি। ‘যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে।’ এই প্রার্থনার নিহিত অর্থ কী? 888sport live chatেরও জাতিভেদ আছে, এখানে বলা হচ্ছে সেই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা যার অবস্থান 888sport live chatসৃষ্টির আদিতে। জীবনের বিচিত্র জটিল অভিজ্ঞতা পেরিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আমরা যে-অমূল্যের সাক্ষাৎ পাই কদাচিৎ, তার সঙ্গে প্রথম দিনের অনুভবের অমিল স্বীকার্য বাহ্য দৃষ্টিতে। তবু সৃষ্টির প্রতিটি 888sport app download for androidীয় মুহূর্ত এক নবজন্ম। তাকে ছুঁয়ে থাকে আদিম বিস্ময়বোধ। ভেদ ও অভেদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এই অনন্য বোধ। কোনো এক 888sport live chatী সেদিন বলছিলেন, তিনি যখন একটি পেরেক আঁকেন তখন তিনি তাতেই মগ্ন, অভেদ সম্পর্ক। মগ্নতার অভেদ থেকে সংসারের ভেদবোধে পুনঃপুনঃ প্রত্যাবর্তন, সাংসারিক জীবন থেকে আবারও মগ্নতায় প্রবেশ, সৃজনশীলতার এই পথ। পথ উন্মুক্ত থাক, এটাই কাম্য, স্বাধীনতার এই শর্ত। স্বাধীন জীবনদর্শনে রক্ষা পাক এই দৃষ্টি।
আমরা মানুষ, তাই মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটাকেই প্রথম কথা বলে মানি। তবু এ-ও সত্য, আমরা প্রকৃতির সন্তান। মহাপ্রকৃতির উদার আকাশই চেতনার আদি স্বদেশ। সংসার সংকীর্ণ। ছোটো গণ্ডির ভেতর অস্তিত্বের একটা অভাব আছে, যেটা পূর্ণ হয় বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে যোগের সূত্রে। প্রকৃতি শুধু ভোগের বস্তু নয়। স্রষ্টা মানুষের জন্য প্রকৃতিতে আছে সৃষ্টির মন্ত্র। আরো আছে সেই প্রসারিত উজ্জ্বল আত্মপরিচয়, সুবেদী মানুষকে যা ত্রাণ করে অন্ধ ভয়ের শাসন থেকে। মানুষের পরিচয় পূর্ণতা পায় মহাবিশ্বে আশ্রিত অতিক্রান্তী মানবতাবাদে।
* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ অষ্টম 888sport free betয় (সেপ্টেম্বর ২০০৪/ আশ্বিন ১৪১১) প্রকাশিত হয়েছিল।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.