॥ ৩ ॥
ত্রনাট্যটি সেদিন আর পড়া হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রীর জরুরি ডাক পেয়ে রশিদকে তক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হলো। কখন ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। পুলিশের চাকরি, চব্বিশ ঘণ্টার।
রশিদের বাড়িতে রশিদকে বাদ দিয়েই চলতে লাগলো পার্টি। ওর স্ত্রী নাসিম বড়ই নরম প্রকৃতির, সে কিছুই সামলাতে পারে না, শক্তি সব দায়িত্ব নিয়ে নিল। এবং শক্তিই আমাকে বাঁচিয়ে দিল একটা অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে।
হাবিব নামে ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরেছে দেখে শক্তি বেশ অবাক হয়ে বললো, এই ছোকরা, তুমি সুনীলের গায়ে হাত দিয়েছো কেন? জানো না, সুনীল পুরুষমানুষদের স্পর্শ একদম সহ্য করতে পারে না? ওর অ্যালার্জি হয়!
কয়েকজন হেসে উঠলো। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। অল্প বয়েসে, শক্তি এবং অন্য বন্ধুদের কেউ কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাঁধে হাত দিলে আমি তক্ষুনি ঝেড়ে ফেলতাম। আমার বিবমিষা হতো।
হাবিব বোধহয় হাসতে জানেই না। তাছাড়া তার মেজাজ টং হয়ে আছে।
সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে শক্তির দিকে রক্তচক্ষে তাকিয়ে বললো, আপনে আমাকে ছোকরা বললেন কেন?
দু’এক পাত্র পেটে পড়লেই শক্তির গলার আওয়াজে খানিকটা হুংকারের ভাব আসে। সে আবার বললো, ছোকরাকে ছোকরা বলবো না তো কি বুড়ো বলবো, না কচি-কাঁচা।
হাবিব তেড়ে উঠে বললো, নো, ইউ হ্যাভ নো রাইট।
কামাল তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে হাবিবকে জড়িয়ে ধরে বললো, এই, আসো আসো, তুমি কী খাবে বলো?
হাবিব তবু বললো, এনার সাথে আমার পরিচয় হয় নাই। তবু ছোকরা বলে ডাকবেন কেন?
কামাল বললো, এনাকে চেনো না? ইনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!
যতদূর মনে হয়, কবি বা লেখকজাতীয় প্রাণীদের প্রতি হাবিবের খুবই অবজ্ঞার ভাব আছে।
সে মুখ কুঁচকে বললো, তাই বলে ইনি আমাকে ইনসাল্ট করবেন, কোন অধিকারে?
শক্তি বললো, ইনসাল্ট আবার কোথায় করলুম রে বাবা! তুমি আমাকে যত ইচ্ছে বুড়ো বলো না!
কামাল হাবিবকে টেনে নিয়ে গেল। আমিও এই সুযোগে অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়ালাম।
শাবানা আজমি ভালো বাংলা বোঝে না। সে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, শক্তিদা, তুমি সুনীলদার অ্যালার্জি নিয়ে কী বললে?
শক্তি পুরুষের স্পর্শ ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতেই শাবানা উঁচু গলায় হেসে উঠলো। সেই হাসিতে আবার যোগ দিল অনেকেই।
সুভাষদা বললেন, সুনীলের গায়ে একটি মেয়ে হাত রাখুক একবার। তাহলে পুরুষের স্পর্শের দোষ কেটে যাবে। স্বাতী, তুমি ওকে ছুঁয়ে দাও না।
স্বাতী বললো, নিজের বউ ছুঁলে হবে না! অন্য কোনো মেয়ে…
একজন অল্পচেনা 888sport promo code আমার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বললো, এই তো আমি ছুঁয়ে দিলাম!
কামাল প্রাণপণে হাবিবকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সত্যি কথা বলতে কী, ছেলেটির প্রতি আমার এখন বেশ মায়া হলো। আনোয়ারার ব্যাপারে ছেলেটি এতই উত্তেজিত হয়ে আছে যে কাণ্ডজ্ঞানবোধ চলে গেছে। এটা যেন নিজের ভাবির জন্য শুধু উদ্বেগ নয়, তারচেয়েও আরো বেশি কিছু।
একটু পরে কামাল আমার কাছে হাবিবকে টেনে এনে বললো, তুমি সুনীলের কাছে মাফ চাও!
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না, না, মাফ-টাফ চাইতে হবে না। হাবিবকে দেখলেই তো বোঝা যায়, ও বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। হাবিব, তুমি একটু মেজাজটা শান্ত করো। শুধু শুধু রাগারাগি করে লাভ নেই। আনোয়ারার ব্যাপারে আমরা সবাই যথাসাধ্য সাহায্য করবার চেষ্টা করব।
কামাল বললো, আমরা এয়ারপোর্টে গেছিলাম। রয়াল জর্ডন এয়ারলাইনস অফিসে…
আমি বললাম, সে যে কাল প্লেনে উঠে চলে গেছে, তা তো আমি আর স্বাতী নিজের চোখেই দেখেছি। তাকে আটকাবার কোনো উপায় ছিল না। তবে, সে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় চলে আসেনি। তোমরা এবার চেষ্টা করো, তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে আনা যায়।
হাবিব চাপা গলায় বললো, এর মধ্যে নীলোফারের নাম জড়ানো হইতাছে কেন?
হঠাৎ আমার মনে হলো, এনাফ ইজ এনাফ! আনোয়ারার জন্য আমার মন খারাপ লাগছে ঠিকই। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে আর বেশি জড়িয়ে থাকতে যাবো কেন? আমার কি অন্য কাজ নেই! আমি আর কিছু সাহায্যও করতে পারবো না। এবার ওদের ব্যাপার ওরা বুঝে নিক।
শুধু গয়নার ব্যাপারটা রয়ে গেল। সেটা আনোয়ারাকেই ফেরত দিতে হবে। কিংবা শামীম নিজে এসে যদি চায়, তার হাতেও তুলে দেওয়া যেতে পারে। আর কারুকে দেওয়া যুক্তিসংগত নয়।
তবু, লেখকরাও তো পাঠকদেরই মতন, কোনো একটা কাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়লে শেষটা না জানলে কৌতূহল জেগেই থাকে।
কামাল আর হাবিব ফিরে গেল পরের দিন।
আমি লেখালেখির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়তে লাগলো আনোয়ারার মুখ। এবং বারবার মনে হলো, আনোয়ারার দেশত্যাগের কারণ ঠিক ত্রিভুজ-প্রণয়-সংকট নয়, সম্ভবত সেটা চতুর্ভুজ। এই হাবিব ছেলেটি খুব সম্ভবত নীলোফার নামে মেয়েটির প্রেমিক। নীলোফারের সঙ্গে তার বড় ভাইয়ের নাম জড়ানো হয়েছে বলেই হাবিবের অমন তিরিক্ষি মেজাজ। আবার কামাল ইঙ্গিত দিয়েছিল যে আনোয়ারার সঙ্গেই তার দেবরের একটা অম্লমধুর সম্পর্ক আছে। তাহলে ব্যাপারটা তো আরো জটিল।
তা হোক না। আমি এখন লিখে চলেছি ঊনবিংশ শতাব্দির পটভূমিকায় এক ছড়ানো কাহিনী, তার মধ্যে 888sport appsের এই চরিত্রগুলো মাথায় ঢুকিয়ে রাখা ঠিক নয়।
দু’দিন বাদে একটি বাংলা কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরে আমার দৃষ্টি আটকে গেল।
বারাসাতের কাছে একটি গ্রামে 888sport promo codeপাচারচক্রের একটি বড় দল ধরা পড়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে এগারোটি মেয়েকে। গ্রেফতার হয়েছে তিনজন। সেই তিনজনের মধ্যেও দু’জন মহিলা। এই উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইজি আয়ান রশিদ খান।
ডাকাত ধরে অন্যরা, কৃতিত্ব নেয় রশিদ। এবার সে স্বয়ং অভিযানে গেছে? পুলিশের কাজে তাহলে মন দিয়েছে দেখা যাচ্ছে। সরকারি উঁচু মহলের ধারণা, রশিদ সবসময়ে আর্ট-কালচার নিয়ে মেতে থাকে, পুলিশের কাজে অযোগ্য। তার প্রমোশন হয়ে চলেছে নিজস্ব নিয়মে।
রশিদ আগে যখন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার ছিল, তখন বসতো লালবাজারে। বেশ কয়েকবার তার অফিসে আড্ডা মারতে গেছি। সেটি একটি বিশাল কক্ষ, ঐতিহাসিকও বটে। দেওয়ালে বহু প্রাক্তন ডিসি-ডিডির ছবি, তার মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত টেগার্ট সাহেব। আরো এমন অনেকের, যারা পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছে।
মনে আছে, একবার মুম্বাইয়ের তরুণ চিত্র পরিচালক সৈয়দ মীর্জা সেই অফিসে গিয়েছিল, আমিও তখন উপস্থিত ছিলাম। সেই সময়ে, ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো ইত্না গুস্যা কিউ আতা’ এই নামে একটা নতুন ধরনের ফিল্ম বানিয়ে সৈয়দ মীর্জার খুব নাম হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন, শাবানা, ওম পুরীরাও তখন নতুন। মুম্বাইয়ের live chat 888sport জগতের এই নতুন দঙ্গলের অনেকের সঙ্গে রশিদের খুব ভাব।
সৈয়দ মীর্জা খানিকটা চ্যাংড়া ধরনের। সে রশিদের অফিসঘরে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ালের ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলেছিল, ‘বাবাঃ, এত বড় বড় সব লোক এখানে কাজ করতো? ইয়ে নোকরি অপকো কেইসে মিলা?’
প্রমোশন হয়ে রশিদ এখন বেঙ্গল পুলিশে এসেছে। ওর অফিস আলিপুরের ভবানী ভবনে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি।
সন্ধের সময় রশিদের সঙ্গে দেখা হলো এক পার্টিতে। উপলক্ষ গান-বাজনা, আসল আকর্ষণ পান-ভোজন। ব্যারিস্টার ইন্দ্রনীল চৌধুরী একজন সংগীত-রসিক হিসেবে প্রসিদ্ধ হতে চান। প্রায়ই কোনো গায়ক-গায়িকাকে ডেকে এনে আসর জমান, আর আমন্ত্রিতদের জন্য থাকে অঢেল স্কচ। সেকালের জমিদারদের নতুন সংস্করণ।
একজন রূপসী মহিলা রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন।
আমি জানি, রশিদ রবীন্দ্রসংগীত একেবারেই পছন্দ করে না। তার শ্রবণযন্ত্র শুধু ক্লাসিকাল গান-বাজনার জন্য তৈরি। উচ্চাঙ্গ সংগীতের 888sport live chatীরা অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতকে পাত্তা দেয় না। কারণ তারা ভাষার মাধুর্য কিছুই বোঝে না। রশিদের বাড়িতে একবার ওস্তাদ আমীর খান রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড শুনে বলেছিলেন, লেকিন ইস মে সংগীত কাঁহা?
শক্তি আবার শুধু রবীন্দ্রসংগীতেরই ভক্ত। তাকে রাগাবার জন্য রশিদ বলে, স্যার আর এন টেগোর বড় কবি হতে পারেন, কিন্তু গানগুলোও শুধুই 888sport app download apk!
রশিদ ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথ বলে না, বলে স্যার আর এন টেগোর! যদিও একসময় ও ছিল বীরভূম জেলার এসপি, প্রায়ই যেতে হতো শান্তিনিকেতনে। তখন সেখানে গিয়ে বলতো, গুরুদেব! গানের আসরে বসে থাকতো ভক্তিভাব নিয়ে।
ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ির দোতলার হলঘরে গান চলছে, পাশের ঘরটি বার। ক্রমশ দ্বিতীয় ঘরেই ভিড় বাড়ছে।
কোনো গানের আসরের মাঝপথে আমি উঠে যাই না। তাছাড়া গায়িকাটির সুন্দর মুখশ্রীর মতো গলার আওয়াজও মিষ্টি। চোখ আর কান দুটোই তৃপ্তি পাচ্ছে। তবু এক সময় রশিদ এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।
এখানে একটি শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীকে ঘিরে আছে অনেকে। সে এসেছে হাঙ্গেরি থেকে। ইংরেজি জানে, সম্রাট অশোকের শিলালিপি সম্পর্কে গবেষণা করতে এসেছে। শ্বেতাঙ্গিনীদের সম্পর্কে আমাদের দুর্বলতা নির্লজ্জভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর দু’একটা কথা বলে বুঝতে পারলাম, সে এমন কিছু বিদুষী নয়। একজন ছাত্রী। অশোকের শিলালিপি সম্পর্কে এতদূর এসে গবেষণা করার কী আছে! সবই তো বইতে পাওয়া যায়। তবু তাকে এতগুলো পুরুষ ঘিরে ধরেছে কেন?
আমি সরে গেলাম জানালার কাছে।
পুরোনো আমলের বাড়ি, বাইরে অনেকখানি বাগান। আজকাল শহরের মধ্যে এরকম বাগানসমৃদ্ধ বাড়ি খুবই দুর্লভ। ব্যারিস্টার সাহেব খুবই সফল ব্যক্তি, আপাতত এ বাড়ি ভেঙে মালটি-স্টোরিড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
দু’হাতে দুটি হুইস্কির গ্লাস এনে রশিদ বললো, ভদ্রমহিলা যে গানটি গাইছেন, আজি এ আনন্দসন্ধ্যা, তাতে পূরবীর সুর লাগছে বুঝতে পারছো? খাঁটি পূরবী হবে এই রকম-
সে নিচু গলায় পূরবী রাগিণীর একটা খেয়ালের সুর ধরলো। রশিদ গান-বাজনা যেমন বোঝে, তেমনি সব রাগ-রাগিণীর স-র-গ-ম জানে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার গলায় সুর কম। একটু বাদেই বেসুরো হয়ে যায়।
তাকে থামাবার জন্য আমি বললাম, আজকের কাগজে তোমার নাম ছাপা হয়েছে। ভুল করে ছেপেছে, তাই না…? বারাসাত না বসিরহাটের গ্রামে তুমি নিজে নিশ্চয়ই যাওনি!
রশিদ বলল, ইয়েস স্যার, আই পার্সোনালি লেড দা রেইড। তুমি নিশ্চয়ই বাংলা কাগজ পড়েছো। স্টেট্সম্যানে অনেকখানি, ডিটেইলড স্টোরি বেরিয়েছে। তুমি কী ভাবো, ইয়ার? আমি কোনো কাজ করি না?
আমি বললাম, তাই তো দেখছি। হঠাৎ তোমার কাজে মন গেছে।
রশিদ বলল, শোনো, আমি অর্ডিনারি পুলিশম্যানদের মতো রুটিনওয়ার্ক অ্যাটেন্ড করি না। কিন্তু মাঝে মাঝে একটা-দুটো যা কাজ করে দিই, তাতেই সেনসেশান পড়ে যায়। সেদিন কখন বেরিয়েছি জানো বাড়ি থেকে? রাত সাড়ে তিনটে!
এবার আমার সত্যি অবাক হবার পালা। রশিদের রাতপাখির স্বভাব। দেড়টা-দুটোর আগে কখনো ঘুমোতে যায় না। জাগে সকাল নটার পর। অনেকদিন সকাল আটটায় রশিদকে ফোন করে শুনতে হয়েছে, সাহেব এখনো জাগেননি।
আমি বললাম, তুমি রাত সাড়ে তিনটেয়? তার মানে বাড়িতে একটুও ঘুমোওনি?
রশিদ বললো, একজ্যাক্টলি! ঘুমোলে আর ওঠা যেত না। আর ও ব্যাটাদের বাড়ি ভোরের আগে ঘিরে ফেলতে হয়। দিনের আলো ফুটলেই খবর পেয়ে যায়। এর আগে একবার ফুড়ুত করে উড়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে রশিদ বললো, তুমি গ্রামটা চেনো, সুনীল। তুমি যে-গল্পটা লিখেছো, খুদা কা বস্তি, যে-গ্রামটার ব্যাকগ্রাউন্ডে, তুমি ফিরোজদের যে-গ্রামে গিয়ে অনেকদিন ছিলে, কী যেন গ্রামটার নাম?
আমি বললাম, স্বরূপনগর।
রশিদ বললো, ইয়েস, ইয়েস, যে-গ্রামটায় আমরা শাবানাকে নিয়ে লোকেশান দেখতে গিয়েছিলাম, তার ঠিক পাশের গ্রামটার নাম মুগবেড়িয়া, সেটাই তো। সে-গ্রামে একটা বিশাল বটগাছ আছে। দুশো-তিনশো বছরের পুরোনো, একটা ভাঙা শিবমন্দির, তুমি সেটা দেখতে যাওনি।
আমি বললাম, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো! খুব ভালো লেগেছিল, গ্রামটা বেশ সুন্দর। বেশ খাঁটি গ্রাম গ্রাম, লোকগুলো ভালো, খুব শান্তিপূর্ণ! সেখানে এমন কাণ্ড হয়?
রশিদ বলল, ওসব ফাসাড! যেসব গ্রামকে মনে হয় খুব পিসফুল, সেখানেই ক্রিমিনালদের ডেরা হয়, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। ওখানে একটা বিরাট গ্যাং অপারেট করছে, আমরা মাত্র কয়েকজনকে ধরেছি। টিপ অব দ্য আইসবার্গ বলতে পারো।
আচ্ছা, রশিদ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি যাদের অ্যারেস্ট করেছো, তাদের মধ্যে দু’জন মহিলা? মহিলারা মেয়েপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকে কী করে? মেয়ে হয়ে মেয়েদের এমন সর্বনাশ করে?
তুমি একটা অদ্ভুত কথা বললে! পুরুষরা যদি পুরুষদের খুন করতে পারে, বাচ্চা ছেলেকে পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে, তাহলে মেয়েরা পারবে না কেন? মেয়েরা কি আলাদা ধরনের কোনো জীব? মেয়েরা মেয়েদের সর্বনাশ করে না? শাশুড়িরা বউদের পুড়িয়ে মারে না? ক্রিমিনালদের মধ্যে পুরুষ আর মেয়ের কোনো তফাৎ নেই। শুধু মোডাস অপারেন্ডি আলাদা। তুমি এক কাজ করতে পারো, সুনীল। কাল দুপুর আড়াইটের সময় আমি ওই দুই মেয়েছেলেকে জেরা করবো। তুমি এসে আমার অফিসে বসে থাকো, দেখো, ওদের অবজারভ করো।
তুমি জেরা করার সময় আমি বসে থাকবো? বাইরের লোক হয়ে! সেটা কি অ্যালাউড?
অ্যালাউড নয়। কিন্তু আমি চাইলে, ইয়েস ইউ ক্যান কাম, আমার বন্ধু হিসেবে, গুলি মারো ফর্মালিটিজ। তবে, তুমি চুপ করে বসে থাকবে, তুমি কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। শুধু অবজারভ করবে!
এইরে, কাল দুপুরে? কাল সকালের প্লেনে যে আমাকে শিলচর যেতে হবে! তোমার অফিসে ব্যাপারটা দেখতে পারলে ভালোই লাগতো!
শিলচরে আবার কী আছে?
‘প্রকৃতি-পরিবেশ’ নামে একটা সংস্থার সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়েছি। ওদের একটা সেমিনার আছে। দু’দিন বাদে ফিরবো।
যাও, তাহলে ওইসবই করো। প্রকৃতি-পরিবেশ না ছাই! এদিকে যে মাফিয়ারা জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে, তা তোমরা কতটুকু জানো?
মাফিয়ারা আবার জঙ্গলও কাটে? সত্যিই, এটা আমার জানা ছিল না।
দ্যাখো সুনীল, আমরা মোটামুটি মিডল ক্লাসের লোকেরা এক ধরনের জীবন কাটাচ্ছি। আর্ট-কালচার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। এর আড়ালে যে কত কত রকম জঘন্য কাণ্ড-কারখানা ঘটে চলেছে, তা আমরা কিছুই জানি না। যাক গে, চলো, আমরা আরো মদ খাই। এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই।
রশিদের পাল্লায় পড়ে এরপরে এত মদ্যপান হলো যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দেড়টা বেজে গেল। তারপর ভর্ৎসনা।
স্বাতী গানের আসরে যায়নি। ওর এক বোনের বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর জেগে বসেছিল আমার জন্য।
এরকম পরিবেশে আমি শুধু ফুরফুর করে হাসি। স্বাতীর অভিযোগের উত্তর দিতে গেলে বিরাট ঝগড়া শুরু হয়ে যেতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় একটু একটু আয়ু নষ্ট হয়।
রশিদের পাল্লায় পড়ার ছুতোটা স্বাতী মানতে চায়নি। আমি কি বাচ্চা ছেলে? বেশি রাত পর্যন্ত হুল্লোড় করার ঝোঁক আমারও ছিল নিশ্চয়ই। শেষের দিকটা আমার ভালো মনেই নেই।
শিলচরের ফ্লাইট সকাল সাড়ে সাতটায়।
স্বাতী ডেকে দিল না। আমিও জাগিনি। ঘুম ভাঙলো আটটার সময়।
শিলচরে যেতে না পারার জন্য অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ থাকলেও গুপ্তভাবে খুশিও বোধ করছিলাম। এর আগে কতবার শিলচর গেছি। এবার আমি না গেলেও সেমিনার ঠিকই চলবে। এখন থেকে সভা-সমিতি কমিয়ে দিতে হবে!
দাঁত মাজতে মাজতে মনে হলো, আজ আমার শিলচরে থাকার কথা ছিল। যাইনি, তার মানে সারাদিন ছুটি। তাহলে আজ লিখতে না বসলেও চলে। তাহলে আজ কী করা যায়? স্বাতীকে নিয়ে কোলাঘাট বেড়িয়ে আসবো? ওখানে একটা ছোট হোটেলে দুর্দান্ত ইলিশ মাছের ঝোল পাওয়া যায়। তারপর রূপনারান নদীতে নৌকো করে কিছুক্ষণ বিহার করলে স্বাতীর মেজাজ নিশ্চিত শান্ত হবে।
তারপর মনে পড়লো, দুপুরবেলা রশিদ ওর অফিসে যেতে বলেছিল।
খোঁয়ারি ভাঙার জন্য পরপর চা খাচ্ছি। আর খবরের কাগজ পড়ছি, এর মধ্যেই রশিদ ফোন করলো স্বাতীকে।
রশিদের মজা এই, আমি ফোন ধরলে শুধু আমার সঙ্গেই কথা বলে। স্বাতীর নামও উচ্চারণ করে না। আর স্বাতী ফোন ধরলে, ওর সঙ্গেই গল্প করে তিরিশ-চল্লিশ মিনিট। স্বাতীর সঙ্গে ওর বেশ একটা মাগো-মাগো ভাব আছে।
আজ ফোন ধরেছে স্বাতী।
আমি লম্বা করে কাগজ পড়তে পড়তে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা শুনছি ওদের।
এক সময় স্বাতী বললো, আমার কর্তাটিকে তুমি কাল এত মদ খাইয়েছো যে সে আজ ভোরে শিলচরের ফ্লাইট মিস করেছে। সকাল থেকে লিখতেও বসেনি। শুধু কাগজই পড়ে যাচ্ছে।
আমি হাত দিয়ে ইশারা করে বললুম, আমাকে ফোন দিও না। আমি বাথরুমে।
আমি টেলিফোন যন্ত্রটি এক-দু’মিনিট কানে রাখতে ভালোবাসি না। রশিদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে যেতে ভালোবাসে। বিশেষত সকালের দিকে।
আমি এক একটা সকালে একটাও কথা বলা পছন্দ করি না।
লিখি না, কিন্তু শুধু চুপ করে বসে থাকতেই ভালো লাগে। তখন নিজের সঙ্গে সংলাপ চলে। মানুষের তো নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্যও সময়ের দরকার।
ভবানী ভবন লালবাজারের মতন অত পুরোনো নয়। এর নামকরণ হয়েছে স্বাধীনতা-সংগ্রামী শহীদ ভবানী ভট্টাচার্যের নামে। অবশ্য সে-কথা এখন আর ক’জন মনে রেখেছে!
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখা হয়ে গেল লাচ্চুদার সঙ্গে।
লাচ্চুদা, অর্থাৎ রথীন ভট্টাচার্য রশিদের বস। শিগ্গিরই তিনি রিটায়ার করবেন। পুলিশ মহলে লাচ্চুদা শেক্সপিয়ার-বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। শেক্সপিয়ার থেকে তিনি অনর্গল মুখস্থ বলতে পারেন। একজন ইংরেজ সাংবাদিক লাচ্চুদার সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, কলকাতার এই একজন পুলিশ অফিসার অনেক ইংরেজ পণ্ডিতের চেয়েও শেক্সপিয়ার ভালো জানেন, সেই জন্যই কলকাতার চোর-ডাকাতরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়।
লাচ্চুদাকে দেখলে পুলিশ বলে বোঝার কোনো উপায় নেই, মনে হয় অধ্যাপক। বড় পোস্টের পুলিশ অফিসাররা আজকাল গোঁফও রাখে না।
লাচ্চুদা ধরেই নিলেন, আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। খানিকটা বকুনির সুরে বললেন, কী ব্যাপার? তুমি টেলিফোন করে আসোনি কেন? আর একমিনিট পরে এলে আমাকে পেতে না।
আমি বললাম, এই দিকেই এসেছিলাম, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। তাই ভাবলাম, একবার দেখা করে যাই। আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন?
লাচ্চুদা বললেন, হ্যাঁ। এখনো লাঞ্চ খাওয়া হয়নি। চলো আমার সঙ্গে, ক্যালকাটা ক্লাবে লাঞ্চ খেয়ে নেবে।
আমি তো দুপুরে খেয়ে বেরিয়েছি। পেট ভর্তি।
আমার সঙ্গে বসবে চলো। খাবার খেও না, বিয়ার খাবে।
না লাচ্চুদা, আমি দিনের বেলা ড্রিংক করা বন্ধ করে দিয়েছি।
সে কি? কবে শুনবো, শক্তি কোলড ড্রিংকস খাচ্ছে রাত্তির বেলা! বাঘে ঘাস খাচ্ছে। চলো, চলো!
না লাচ্চুদা, আমি বরং রশিদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যাই।
রশিদ? সে কোনোদিন লাঞ্চ আওয়ারের পর অফিসে থাকে? তুমি পাগল হয়েছো? নেহাৎ চিফ মিনিস্টার ওকে স্নেহ করে, তাই ওর চাকরিটা এখনো বজায় আছে!
আজকাল রশিদ খুব কাজ করছে শুনছি!
হ্যাঁ, কাজ করছে। তবে পুলিশের কাজ না। ওর মাথায় গজ গজ করছে সিনেমা।
একটু থমকে গিয়ে লাচ্চুদা বললেন, ও হ্যাঁ, আজ রশিদকে ওর ঘরে দেখলাম যেন একটু আগে। আজ একটা ক্রিমিনাল গ্যাংকে ইন্টারভিউ করার কথা আছে। তুমি ওর ঘরে গিয়ে বসো। আমি লাঞ্চ খেয়ে ফিরে আসছি তাড়াতাড়ি।
দু’তিন ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাচ্চুদা আবার বললেন, সুনীল, তুমি তো মাঝে মাঝেই 888sport appsে যাও, আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারো না? মরার আগে অন্তত একবার বিক্রমপুরে আমাদের দেশের বাড়িটা দেখে যেতে চাই।
আমি হাসলাম। লাচ্চুদা কি ছেলেমানুষ যে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে? যে-কেউ তো ভিসা নিয়ে 888sport apps ঘুরে আসতে পারে। শেক্সপিয়ারের মতন, বিক্রমপুরও লাচ্চুদার অবসেশান। চল্লিশ বছর আগে ছেড়ে-আসা নিজের গ্রাম সম্পর্কে প্রায় প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু বলবেনই। সে-গ্রামের গাছপালার বর্ণনাও আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে।
ওপরে এসে একজনের কাছ থেকে রশিদের ঘরটার হদিস জেনে নিলাম।
সে-ঘরের বাইরে একজন পাহারাদার আছে। আমাকে একটা কাগজে নাম লিখে দিতে হলো।
এ ঘরখানি তেমন সুসজ্জিত নয়। তবে টেবিলটি মস্ত বড়। সে-টেবিলে অন্তত দু’তিনজন লোক শুয়ে থাকতে পারে। চেয়ারগুলো চামড়ার গদিতে মোড়া। একটা ফুলদানিতে টাটকা ফুল।
রশিদ একটা ফাইল পড়ছে মনোযোগ দিয়ে।
আমাকে দেখে মুখ তুলে শুধু বললো, একটু বসো।
আবার সে ফাইলে চোখ বোলালো।
দরজার ঠিক পাশে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে দু’জন স্ত্রীলোক। একজন বেশ গাট্টাগোট্টা, অন্যজন শালিক পাখির মতো। সাধারণ শাড়ি-পরা।
আমার বেশ অস্বস্তি হলো। ঘরে এতগুলো চেয়ার, ওদের মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে কেন? এটা অন্যায়। হয়ত ওরা শিক্ষিত-ভদ্রঘরের মেয়ে নয়, তবু 888sport promo code তো বটে!
রশিদ একবার ফাইল থেকে মুখ তুলতেই আমি চোখের ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কারা?
রশিদ ইংরেজিতে বললো, কাল তো ওদের দু’জনকেই ধরা হয়েছে। তুমি ওদের দিকে তাকিয়ো না। ওদের জেরা করা হবে, তবে আরও পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে।
অতক্ষণ বসিয়ে রাখবে? কেন?
এটাই নিয়ম। ওরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলার জন্য তৈরি হয়ে আসে। প্রথম দিকে খুব স্মার্ট ভাব দেখায়। ওদের টাকা-পয়সার জোর আছে। ক্ষমতাও কম নয়। কিন্তু ওদের কুকুর-বেড়ালের মতো ট্রিট করলে আস্তে আস্তে মনের জোর কমে যায়। আমরা তো মেয়ে ক্রিমিনালদের মারি না। টর্চারও করি না। সাইকোলজিক্যাল প্রেসার দিতে হয়। চা খাবে তো?
বেয়ারা আসবার পর রশিদ বেশ জোরে জোরে বলল, দু’কাপ ভালো দেখে চা নিয়ে এসো। সঙ্গে বিস্কিট আনবে। আমার সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে।
শালিক চেহারার স্ত্রীলোকটি বললো, সাহেব, আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি। আমরা একটু চা খেতে পারি না? আমার আবার চায়ের নেশা।
রশিদ আমাকে ইংরেজিতে বলল, কী রকম স্মার্ট দেখলে?
তারপর সেই স্ত্রীলোকটির উদ্দেশে বললো, তোমার চায়ের নেশা? পান-দোক্তার নেশা নেই? বাংলা মদ? ওসব ফাঁসির আগে খেও। তখন যা চাইবে, দেবো? এখন চুপ করে বসে থাকো।
ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই দ্যাখো, ওদের নাম। মোটা মেয়েটার নাম মতিবিবি। আর রোগাটার নাম শেফালি। ক্রিমিনালদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানদের কোনো ভেদ নেই। ওদের সঙ্গে যে পুরুষটা ধরা পড়েছে, সেটার নাম ছোটলাট, আসল নাম পরাণ দাস। ছোটলাট নামটা খুব কমন, প্রায় অনেক দলেই একটা করে ছোটলাট থাকে। বড় লাটটার পাত্তা পাওয়া যায় না। পালের গোদা যেটা, পালিয়েছে। সেটা আবার বিহারি মুসলিম।
যে-সব মেয়েকে তোমরা উদ্ধার করেছো, তারা কোথাকার?
এগারো জনের মধ্যে চারজন 888sport appsের, আর বাকিরা নেপালি মেয়ে।
আগেও কাগজে পড়েছি, এইসব র্যাকেটে যেসব মেয়ে ধরা পড়ে, তারা 888sport apps কিংবা নেপালের। কেন, এদিকে কি গরিব মেয়ের অভাব আছে?
না, এদিকেও গরিব মেয়ে আছে লক্ষ লক্ষ। তাদেরও অনেককে পাচার করা হয়। কিন্তু তাদের এনে কলকাতা কিংবা ওয়েস্ট বেঙ্গলে একদিনও রাখা হয় না। তাদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মুম্বাই কিংবা পাঞ্জাবে। 888sport apps আর নেপালের মেয়েদের এখানে রাখে, কারণ বাড়ি থেকে দূরে চলে এসে, তারা ভয়ে ভয়ে থাকে, কারুর সঙ্গে কথা বলারও সাহস পায় না। অচেনা জায়গায় পালিয়ে যেতেও চায় না।
চা ও দু’তিনরকম বিস্কিট এল।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যদের না দিয়ে কিছু খেতে কি ভালো লাগে? উপায় নেই। এখানে রশিদের নির্দেশ মানতেই হবে।
চুমুক দিতে দিতে রশিদ বললো, তোমরা গল্প-888sport alternative link লেখার সময় এইসব ক্রিমিনালকে বড্ড রোমান্টিসাইজ করো। যেন শুধু অবস্থার চাপে পড়েই ওরা ক্রিমিনাল হয়েছে। ভেতরে ভেতরে মানবিকতা এখনো রয়ে গেছে। সেসব কিছু না। এদের মন বলে কিছু আছে কি-না সন্দেহ! এরা এদের কাজটাকে মনে করে ব্যবসা। সেই ব্যবসায়ে যতদূরসম্ভব লাভ করার জন্য এরা কোনো নিষ্ঠুরতাতেই পিছু-পা হয় না। দেখেছো, এদের মুখে 888sport promo code-সুলভ লালিত্য একটুও নেই।
কিছুক্ষণ পরে ঘড়ি দেখে রশিদ বললো, এইবার শুরু করা যায়। তুমি ঘুরে বসো সুনীল। ইচ্ছে করলে নোট নিতে পারো।
নোট-টোট নেওয়া আমার স্বভাব নয়। মাথার মধ্যে যেটুকু থাকে, সেটুকুই কাজে লাগাই। তাছাড়া আমি এখানে আমার লেখার উপাদান সংগ্রহ করতে আসিনি। এসেছি অন্য কৌতূহলে।
রশিদ বললো, মতিবিবি, এগিয়ে বসো। তোমার আসল নাম কী?
মতিবিবি বললো, আমার অন্য নাম নেই!
রশিদ বলল, প্রথম থেকেই মিথ্যে কথা শুরু করলে? তোমার নাম শরিফন। জানো তো, আমি মুসলমান। এখানে এই যে আর এক সাহেব বসে আছেন, ইনি এক মৌলবি সাহেবের ছেলে। আমরা আমাদের জাতের লোকদের সাহায্য করি। তুমি যদি আমার কাছে সত্যি কথা বলো, ঠিক ঠিক উত্তর দাও, তাহলে তোমার যাতে শাস্তি না হয়, তা আমি দেখবো! কতদিন ধরে এই কারবার চালাচ্ছো?
মতিবিবি নিরীহ মুখ করে বললো, কী কারবার সাহেব?
এই মেয়েমানুষ চালান দেওয়ার কারবার?
সে সম্পর্কে তো আমি কিছুই জানি না।
তোমাদের বড়ি থেকে যে মেয়েগুলোকে উদ্ধার করা হলো, তারা কোথা থেকে এল?
তাও জানি না সাহেব। আমি হোটেল চালাই। লোকেরা এসে থাকে, আবার চলে যায়।
তাই বুঝি? তোমার হোটেলে শুধু মেয়েরা থাকে?
পুরুষরাও থাকে। যে টাকা দেয়, সে-ই থাকতে পারে।
এই মেয়েরা নিজের ইচ্ছেতে আসে? কেউ নিয়ে আসে না?
অনেক সময় অন্য লোক নিয়ে আসে। কে কাকে নিয়ে আসে, তা আমি জানতে চাই না। তাহলে হোটেল চলে না!
বটে! যারা নিয়ে আসে, তাদের তুমি চেন না?
দু’একজনের মুখ চেনা হয়ে গেছে। আর কিছু জানি না।
অন্য মেয়েটি এবার বলে উঠলো, আমি ওই হোটেলে শুধু রান্না করি। আমাকে কেন ধরে এনেছেন স্যার!
রশিদ তাকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললো, চোপ! তুমি একটা কথাও বলবে না। তোমার তো ফাঁসি হবেই!
আবার মতিবিবির দিকে ফিরে রশিদ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, তোমার হোটেল থেকে মেয়েগুলোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, তাও তুমি জানো না?
মতিবিবি বলল, না সাহেব!
একটি মেয়ে কিছুই খেতে চাইছিল না। দু’তিনদিন কিছু না খেয়ে শুধু
কেঁদেছে। তুমি তার পাছায় গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছিলে। হোটেল চালাতে গেলে বুঝি এইসবও করতে হয়?
কে বললো, আমি ছ্যাঁকা দিয়েছি? একদম ঝুট বাৎ! এইসা কভি নেই কিয়া। আমি কোনোদিন খুন্তি হাতেই নিই না!
তোমার ডেরা থেকে দুটো মেয়েকে মজঃফরপুর চালান দেওয়া হয়েছিল। তুমি তাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে।
ইয়ে ভি ঝুট বাৎ! আমি কোনোদিন মজঃফরপুরে যাইনি।
আলবাৎ গিয়েছিলে! সেই মেয়েদুটোকেও উদ্ধার করা হয়েছে। তারা জবানবন্দি দিয়েছে। আমাদের ধর্মে এইসব নোংরা কাজ করলে হাবিয়া দোজখে যেতে হয় জানো না?
আমি কোনো নোংরা কাজ করি না, সাহেব। গরিব মানুষ, রোজা রাখি। ঘরে বসে নামাজ পড়ি।
একটা বালিশের খোলের মধ্যে বালি ভরা আছে। সেটা দিয়ে মেয়েদের মারো! যখন তারা কাঁদে। রাত্তিরে।
আমি কখনো মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না। মায়ের দিব্যি!
কোন মা? মা কালী, না তোমার নিজের মা? তোমাদের ছোটলাট কালী-পুজো করে!
ও হারামি কী করে তা আমি জানবো কী করে?
ছোটলাট তোমার কে হয়?
কেউ না। ম্যানেজার।
ও আর তুমি এক ঘরে থাকো?
কভি নেহি, সাহেব। সন্ঝের পর ওর সঙ্গে আমার দেখাই হয় না!
তবে মদ খাও কার সঙ্গে বসে? বড়ে লাট আসে?
এইরকম চললো অনেকক্ষণ। মতিবিবি কিছুতেই মচকাবে না। রশিদ এক-একটা অভিযোগ আনছে। তাতে সে একটুও চমকে উঠছে না পর্যন্ত। মুখের একটাও রেখা কাঁপে না। সব অভিযোগ সে অস্বীকার করে যাচ্ছে। সে জানে, আদালতে এগুলো প্রমাণ করতে হবে।
সিগারেট ধরাবার জন্য রশিদ একটু থামতেই আমি নিম্নস্বরে বললাম, রশিদ, তোমাকে আনোয়ারার কথা বলেছিলাম। 888sport appsের এক অধ্যাপকের স্ত্রী। আমার যতদূর ধারণা, এইরকম একটা গ্যাং-ই তাকে সৌদি আরবে চালান করেছে। এদের কাছ থেকে আনোয়ারার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে না?
রশিদ বলল, দেখতে হবে। তবে এদের দৌড় বম্বে পর্যন্ত। সেখান থেকে আর একটা দল মেয়েদের মধ্য থেকে বেছে বেছে বিদেশে চালান দেয়।
আমি বললাম, আনোয়ারা আমাদের বাড়িতে ছিল। কিন্তু এয়ারপোর্টে দেখেছি, আরো কিছু মেয়ে গেল ওর সঙ্গে। তারা নিশ্চয়ই এরকম কোনো ডেরাতেই ছিল।
রশিদ বলল, একবার যখন ধরেছি, আমি শেষ না দেখে ছাড়বো না। ওই আনোয়ারা আগে দুবাই গেছে বললে না? রয়াল জর্ডন এয়ারলাইনস! ইদানীং রয়াল জর্ডন তো বম্বেতেও স্টপওভার দিচ্ছে। ওকে যদি বম্বেতে নামিয়ে দিয়ে থাকে? দাঁড়াও, দেখছি, দেখছি!
আবার সে জেরা শুরু করার একটু পরেই লাচ্চুদা এসে উপস্থিত হলেন। নিজে জেরায় অংশ না নিয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন চুপচাপ।
হঠাৎ একসময় আপন মনে বলে উঠলেন,
It is but foolery; but it is such a
kind of gain-giving, as would perhaps
trouble a woman. …
নিশ্চয়ই শেক্সপিয়ার। কোন নাটকের বুঝতে পারলাম না। হ্যামলেট হলেও হতে পারে।
তারপর বললেন, রশিদ, এ অতি শক্ত বাদাম! ফাটাতে পারবে না। বরং এক কাজ করো, যে-মেয়েগুলোকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের একজনকে ডাকো। নেপালি না, ওর ভাষা বুঝবো না। 888sport appsী মেয়েকে আনো।
মেয়েগুলোকে উদ্ধারাশ্রমে পাঠানো হবে। আপাতত এ বাড়িতেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। আর্দালি একজনকে এই ঘরে নিয়ে এল।
মেয়েটির বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। মলিন চেহারা, একটা কস্তা ডুরে তাঁতের শাড়ি-পরা। মাজামাজা গায়ের রং, স্বাস্থ্যও ভালো নয়। চোখদু’টিতে বাংলার পলিমাটির আভা যেন লেগে আছে।
লাচ্চুদা যদিও রশিদের ওপরওয়ালা, তবু বিনীতভাবে বললেন, রশিদ, আমি যদি এই মেয়েটিকে কিছু কোশ্চেন করি, তুমি কিছু মনে করবে?
রশিদ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার, আপনিই বলুন। আমি তো আপনার কাছ থেকেই শিখেছি।
লাচ্চুদা খুবই নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী মা?
মেয়েটি কিছু উত্তর দিল না।
লাচ্চুদা আবার বললেন, এসো, তুমি এই চেয়ারটায় বসো। তোমার আর কোনো ভয় নেই। বলো, তোমার নামটা বলো!
আরো দু’তিনবার অভয় দেবার পর মেয়েটি একটি চেয়ারে আধখানা বসে মুখ নিচু করে কী যেন নাম বললো মিনমিন করে। আমি বা লাচ্চুদা তা বুঝতে পারলাম না। রশিদ বললো, নাম বলছে ইফফাত আরা।
লাচ্চুদা বললেন, ইফফাত! কমন নাম। একজন গায়িকা আছে না? মা, ইফফাত, তোমার বাড়ি কোথায়? কোন গ্রামে?
মেয়েটি এবারেও অস্পষ্ট করে বলল, মাওয়া।
লাচ্চুদা বললেন, কী বললে, মাওয়া? সে আবার কোথায়? কোন জেলায়?
এ ব্যাপারে রশিদের চেয়ে আমার জ্ঞান বেশি।
আমি বললাম, মাওয়া তো আপনাদের বিক্রমপুরের পাশ দিয়েই যেতে হয়। ওখানে ফেরিঘাট আছে। পদ্মা পার হওয়া যায়।
লাচ্চুদা বললেন, কী জানি, আমাদের সময় ছিল না।
তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, বিক্রমপুরের মেয়ে। তার মানে তো আমার আত্মীয়। আমার এলাকার মেয়েকে কুপথে এনেছে, এদের সবকটাকে শূলে চড়াতে হবে! রশিদ, এদের পালের গোদাটাকে যেমন করে পারো ধরো!
আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি সেখানে কী করতে? শাদি হয়েছে?
মেয়েটি প্রথমে দু’দিকে মাথা নাড়লো। অর্থাৎ শাদি হয়নি। তারপর বললো, সেখানে আমার আব্বুর একটি পান-বিড়ির দোকান আছে।
লাচ্চুদা বললেন, বেশ। তুমি সেই দোকানে বসতে? এদের পাল্লায় পড়লে কী করে? নিজের জায়গা ছেড়ে এলে কেন?
মেয়েটি চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল।
লাচ্চুদা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকলেরই তো প্রায় একই গল্প। দারিদ্র্য, অসুখী পরিবার, ক্ষীণ আশার হাতছানি আর তারপর দেওয়ালি পোকার মতো আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়া।
মেয়েটিকে একটুক্ষণ কাঁদতে দিয়ে তারপর লাচ্চুদা জিজ্ঞেস করলেন, ক’দিন ধরে এখানে এনেছে?
মেয়েটি বলল, পাঁচদিন। না, সাতদিন।
লাচ্চুদা বললেন, দিন গুণতেও ভুলে গেছে। ঠিক মতন খেতে-টেতে দেয়? ভাত না রুটি?
মেয়েটি বলল, ভাত।
লাচ্চুদা বললেন, যাক, ভাত দেয়। রুটি! আমি তো এখনো রুটি খেতে পারি না। আর কী দেয় ভাতের সঙ্গে?
মেয়েটি বলল, একটা সবজি, ঢ্যাঁড়শ কিংবা কদু।
লাচ্চুদা বললেন, রশিদ ব্যাটা নিশ্চয়ই কদু মানে জানে না। কদু মানে লাউ। তা মন্দ না। আর কী দেয়?
আর কিছু না!
আর কিছু না? শুধু ভাত আর একটা তরকারি?
একদিন নাইরকোলের বড়া দিছিল।
নারকোলের বড়া খুব ভালো জিনিস। ডাল দেয়নি?
না।
একদিনও ডাল দেয়নি?
না।
লাচ্চুদা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলেন, ডাল দেয়নি? এমন চশমখোর! 888sport appsের মানুষ ডাল ছাড়া খেতে পারে? এরা দু’বার ডাল খায়। মাছ-মাংস না হয় না দিক, তা বলে ডাল দেবে না? এগুলো কি মানুষ! এই রশিদ, একজন লেডি পুলিশকে ডাকো না। ওই মাগীটাকে কয়েকটা থাবড়া মারুক। আমারই হাত নিশপিশ করছে! সামান্য একটু ডালও দেয়নি। এমন নৃশংস!
ডাল নিয়ে লাচ্চুদার বাড়াবাড়ি দেখে আমাদের হাসি সামলানো মুশকিল হলো।
এরই মধ্যে আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো, রয়াল জর্ডন এখন মুম্বাইতে থামে। আনোয়ারাকে যদি সেখানে নামিয়ে রেখে থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধার করা খুব একটা অসাধ্য হবে না। (ক্রমশ)


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.