মূল : নাডিন গর্ডিমার
888sport app download apk latest version : রওশন জামিল
আমরা যখন শুনলাম মুক্তি পেয়েছে সে, খবরটা প্রত্যেককে জানানোর জন্য খামারের আরেক প্রান্তে ছুটে গিয়েছিলাম আমি, বেড়া টপকে পাশের খামারে আমাদের জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়েছিলাম। অনেক পরে টের পেয়েছিলাম, কাঁটাতারের বেড়ায় পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছি আমি, এবং কাঁধের এক জায়গায় ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছে।
আট বছর আগে এখান থেকে চলে যায় সে, শহরে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়, ওরা যাকে বলে নির্মাণ কোম্পানি তেমনি এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে – আকাশছোঁয়া কাচের দেয়াল তুলবে। প্রথম দুবছর মাসে সপ্তাহান্তে একবার এবং বড়দিনের সময় দুসপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছিল সে; আর তখনই আমার বাবার কাছে আমার পাণিপ্রার্থনা করেছিল। সেই থেকে কন্যাপণের টাকা মেটাতে শুরু করে সে। আমরা, মানে সে আর আমি, ভেবেছিলাম আমাদের বিয়ের জন্য এভাবে সে তিন বছরের মধ্যে পর্যাপ্ত টাকা পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু এরপর ওই টি-শার্টটা পরতে শুরু করল সে, আমাদের বলল ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে, বলল ধর্মঘটের পর কয়েকজনকে ছাঁটাই করায় ওপরঅলাদের সঙ্গে আলোচনা করতে যারা গিয়েছিল সেই দলে সে-ও ছিল। কথাবার্তায় বরাবরই চৌকশ সে, এমনকি ইংরেজিতেও – ফার্ম স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল, দোকানে সাবান কিংবা চিনি কিনতে গেলে ভারতীয়রা জিনিসগুলো যেসব খবর কাগজে মুড়িয়ে দেয় সেগুলোও পড়ত সে।
শহরে ভাড়া দেওয়া নিয়ে দাঙ্গা হয়েছিল একবার, ঝামেলা হয়েছিল হোস্টেলে যেখানে একটা বিছানা ছিল ওর, এবং আমাকে সে বলেছিল – শুধু আমাকেই, বুড়োদের নয় – যেখানেই মানুষ আমাদের প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারা নাকি আমাদের সবার জন্য লড়ছে, খামারের এবং শহরের সবাই, কেউ বাদ নেই, ইউনিয়নগুলো আছে ওদের সঙ্গে, সে আছে ওদের সঙ্গে, ভাষণ দিচ্ছে, মিছিল করছে। তৃতীয় বছরে, আমরা খবর পেলাম সে কারাগারে। বিয়ে করার পরিবর্তে। আমরা জানতাম না কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, শুনানি শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। অনেক দূরের একটা শহরে শুনানি হয়েছিল মামলাটার। আমি প্রায়ই যেতে পারতাম না কোর্টে কেননা ততদিনে আমি আট ক্লাস পাস করেছি এবং ফার্ম স্কুলে চাকরি করছি। তাছাড়া আমার বাবা-মা যারা এই পৃথিবীতে এনেছেন আমাকে, তারাও টানাটানিতে ছিলেন তখন। আমার যে-দুই ভাই শহরে গিয়েছিল কাজ করতে তারা বাড়িতে পাঠাত না কিছু; আমার অনুমান বান্ধবীদের সঙ্গে থাকত ওরা এবং তাদের জন্য ওদেরকে কেনাকাটা করতে হতো। আমার বাবা এবং আরেক ভাই এখানে ব্যোরের জন্য কাজ করেন, কিন্তু বেতন খুব কম। দুটো ছাগল, চরাবার অনুমতি আছে এরকম কয়েকটা গরু, আর ছোট্ট একচিলতে জমি আছে আমাদের, যেখানে মা সবজি চাষ করতে পারেন। নগদ কিছু আসে সেখান থেকে।
ওকে যখন দেখলাম আদালতে, ডোরাকাটা শার্ট আর খয়েরি টাইয়ের সঙ্গে নীল স্যুটে সুন্দর লাগছিল ওকে। অভিযুক্ত সবাই – সে বলেছিল ওরা তার সহযোদ্ধা – ভালো জামাকাপড় পরে ছিল। ইউনিয়ন কিনে দিয়েছিল পোশাকগুলো যাতে বিচারক এবং অভিযোগকারী বুঝতে পারেন তারা কিছু নির্বোধ ‘জি-হুজুর’ মার্কা কালা আদমির সঙ্গে কারবার করছেন না, যারা নিজেদের অধিকারের কথা জানে না। আমাকে যখন কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তখন এসব বিষয় এবং আদালত আর বিচারকাজের খুঁটিনাটিগুলো আমাকে ব্যাখ্যা করেছিল সে। বিচার চলাকালে ভূমিষ্ঠ হয় আমাদের ছোট্ট মেয়েটা এবং আমি যখন মেয়েকে প্রথমবারের মতো আদালতে নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে দেখাবার জন্য, ওর সহযোদ্ধারা প্রথমে ওকে এবং তারপর আমাকে আলিঙ্গন করে কাঠগড়ার ওপাশ থেকে। মেয়েটির জন্য উপহার হিসেবে আমাকে দেওয়ার জন্য কিছু টাকা তুলেছিল ওরা। ওর নাম রাখল সে ইংকুলুলেকো।
এরপর শেষ হয়ে গেল বিচার। ছয় বছরের সাজা হলো তার। দ্বীপান্তর দেওয়া হলো তাকে। আমরা সবাই জানতাম দ্বীপটার কথা। আমাদের নেতারা সেখানে আছেন কতকাল ধরে। স্কুলে নীল রং দিয়ে ছবি অাঁকার সময়ে ছাড়া কখনো সমুদ্র দেখিনি আমি; সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত একখন্ড দুনিয়ার কথাও কল্পনা করতে পারিনি কখনো। আমি কেবল ভাবতে পেরেছিলাম, একদলা ঘুঁটের কথা, গবাদিপশু ফেলে গেছে, বৃষ্টির জমে-থাকা জল পেরোবার সময়ে, জলে আয়নার মতো দেখা যায় আকাশ, নীল। সে আমাকে বলেছিল, একটা দালানের মাথায় কাজ করার জন্য পাটাতনে চড়িয়ে ক্রেন যখন তাকে ক্রমশ আকাশপানে তুলতে থাকে, কাচের দেয়ালগুলোয় কীভাবে রাস্তার গাছপালা এবং 888sport app দালানকোঠা আর গাড়ির রং এবং মেঘ প্রতিবিম্বিত হয়।
মাসে একটা চিঠির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ওকে। আমারই চিঠি হতো সেটা, কারণ ওর মা-বাবা লিখতে জানতেন না। তাঁরা কী খবর পাঠাতে চাইছেন জানতে আরেকটা খামারে যেতাম আমি। মা সবসময়ে কাঁদতেন আর কপাল চাপড়াতেন, কিছুই বলতেন না; আর বুড়ো, যিনি প্রতি রোববার মাঠে ধর্মকথা শোনাতেন আমাদের, বলতেন আমার ছেলেকে বলে দাও আমরা প্রার্থনা করছি, ঈশ্বর তার জন্য সবকিছু ঠিক করে দেবেন। একবার সে জবাবে লিখেছিল, ওটাই সমস্যা – খামারে কাজ করা আমাদের মানুষদের, ওদেরকে বলা হয়েছে ঈশ্বরই নির্ধারণ করবেন ওদের জন্য কোনটা ভালো যাতে তারা নিজেদের জীবন পরিবর্তন করার জন্য কোনো শক্তি খুঁজে না পায়।
দুবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর, আমরা – ওর মা-বাবা এবং আমি – ওকে দেখতে কেপ টাউনে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা জমাতে সমর্থ হলাম। ট্রেনে করে গেলাম আমরা এবং রাতটা স্টেশনের মেঝেতে ঘুমিয়ে, পরদিন, ফেরির রাস্তাটা জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম। সদয় ব্যবহার করলেন মানুষজন; তারা জানতেন, ফেরির কথা জানতে চাওয়ার অর্থ তোমার আপন কেউ আছে দ্বীপে।
আর ওখানেই দেখা পেলাম ওটার – সমুদ্রের। সবুজ এবং নীল, আকাশ অবধি উঠছে আর নামছে, ফেটে পড়ছে শুভ্র ফেনায়। ঝোড়ো হাওয়া তাকে আছড়ে ফেলছিল একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে; দ্বীপটাকে আড়াল করেছিল ওটা, কিন্তু আমাদের মতো আরো লোকজন, তাঁরাও অপেক্ষা করছিলেন ফেরির জন্য, হাত ইশারায় দেখালেন কোথায় থাকার কথা দ্বীপটার, দূর-সমুদ্রে, যা কখনো আমার কল্পনাতেও আসেনি।
আরো নৌকো, এবং বাড়িঘর সমান বিশাল জাহাজও ছিল, যেগুলো দুনিয়ার 888sport app জায়গায় যায়, কিন্তু ফেরিটা শুধু ওই দ্বীপের জন্য, দুনিয়ার আর কোথাও যায় না ওটা, শুধু দ্বীপেই যায়। ফলে সেখানে অপেক্ষমাণ সবাই দ্বীপের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, আর তাই আমরা ঠিক জায়গায় দাঁড়াইনি এমন ভুল করার প্রশ্নই ওঠে না। ওর জন্য মিষ্টি, বিস্কুট, ট্রাউজার্স এবং গরম কোট এনেছিলাম আমরা (আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে-থাকা এক মহিলা বললেন, ওকে জামাকাপড় দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না আমাদের) আর আমার পরনে, খামারের মেয়েরা যেমন পরে থাকে, মাথা গলিয়ে পরতে হয় এমন একটা পুরনো বেরেট ছাড়া আর কিছুই নেই, বাইসাইকেলে চেপে বাক্সভরা রকমারি পশরা নিয়ে যে-লোকটা খামারে আসে তার কাছ থেকে রিল্যাক্সার ক্রিম কিনেছি, আর আমার চুল আঁচড়ে ফুলিয়ে, ফুল-তোলা স্কার্ফের নিচে বাঁধা; স্কার্ফটা আমার কানের সোনার দুল দুটো ঢেকে দেয়নি। ওর মা জামার ওপর কম্বল জড়িয়ে নিয়েছেন, কিন্তু আমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে-থাকা আর যে-কোনো মেয়ের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছিল। ফেরিটা যখন তৈরি হলো আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য, আমরা নীরবে সবাই ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ালাম, খোঁয়াড়ের দরজা খোলার অপেক্ষায়-থাকা গরুমোষের মতো। একটা লোক বারবার মাথা এপাশ-ওপাশ করে চিবুক ওঠানামা করছিল, গুনছিল সে, নিশ্চয় ভয় পেয়েছিল অনেক মানুষ দেখে, কারণ সে পেছনে পড়ে থাকতে চাইছিল না। আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম কর্তব্যরত পুলিশটার কাছে, এবং আমাদের সামনে যারা ছিল তারা উঠে পড়ল ফেরিতে। কিন্তু যখন আমাদের পালা এলো, পুলিশটা হাত বাড়াল কিছু একটার জন্য, আমি জানতাম না কী সেটা।
পারমিট ছিল না আমাদের কাছে। আমরা জানতাম না কেপ টাউনে আসার আগে দ্বীপান্তরী কয়েদিদের দেখার জন্য তোমাকে পুলিশের অনুমতি জোগাড় করতে হয়। আমি সুন্দর করে জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করলাম তাকে। বাতাস আমার কথা উড়িয়ে নিয়ে গেল।
ফিরিয়ে দেওয়া হলো আমাদের। আমরা দেখলাম দুলছে ফেরিটা, সরে যাচ্ছে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেই পাটাতনটাকে নাড়িয়ে, সুনীল জলরাশির ধাক্কায় উঠছে এবং নামছে, ছোট হয়ে আসছে আস্তে আস্তে, এবং একসময়ে আমরা আর ঠাহর করতে পারলাম না আমরা আসলেই ফেরিটাকে দেখছি নাকি দূরদিগন্তে কোনো কালো পাখি দেখছি, যেটা উঠছে এবং নামছে।
একটা ভালো কাজ হয়েছিল অবশ্য। মিষ্টি আর বিস্কুটগুলো ওর জন্য নিয়ে গিয়েছিল এক লোক। ওগুলো সে পেয়েছিল, জানিয়েছিল চিঠিতে। তবে সুন্দর ছিল না চিঠিটা। আমার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল সে; আমার জেনে নেওয়া উচিত ছিল, জানা উচিত ছিল পারমিটের ব্যাপারটা। ওর কথাই ঠিক – আমি ট্রেনের টিকিট কিনেছি, আমি জিজ্ঞেস করেছি ফেরির জন্য কোথায় যেতে হবে, আমারই জানা উচিত ছিল পারমিটের বিষয়টা। আমি আট ক্লাস পাশ। শহরে পরামর্শ কেন্দ্র আছে একটা, গির্জার পরিচালনে, সে লিখেছিল। কিন্তু আমাদের খামারটা শহর থেকে এতদূরে, আমরা যারা খামারে থাকি তারা এসবের কিছুই জানি না। ব্যাপারটা এরকম যা সে বলে : আমাদের অজ্ঞতা দিয়েই আমাদেরকে দাবিয়ে রাখা হয়; এই অজ্ঞতাকে তাড়াতেই হবে।
ট্রেনে করে ফিরে এসেছিলাম আমরা এবং আর কখনো দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা করিনি – আরো যে তিনটা বছর সে ছিল ওখানে আমরা তাকে দেখিনি। একবারও না। ট্রেন ভাড়া জোগাড় করতে পারিনি আমরা। ওর বাবা মারা গেছেন, এবং আমাকে আমার বেতন থেকে সাহায্য করতে হয় ওর মাকে। শিখলাম, আমাদের জনগণের আসল দুশ্চিন্তা টাকা। কবে আমাদের টাকা হবে? এরপর সেই সুন্দর চিঠিটা লিখল সে। এসব কারণেই আমি দ্বীপান্তরী, তোমার থেকে অনেক দূরে, আমি এখানে এসেছি যাতে একদিন আমাদের জনগণ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো লাভ করে; খাবার, জমি, অজ্ঞতার অবসান। আরো একটা জিনিস লেখা ছিল – আমি শুধু ‘ক্ষমতা’ শব্দটা পড়তে পারলাম, যেটা কারা কর্তৃপক্ষ কালো কালিতে মুছে দিয়েছিলেন। চিঠিগুলো শুধু আমার জন্যই ছিল না; আমি পড়তে পারার আগেই কারা অফিসার পড়তেন ওগুলো।
পাঁচ বছর বাদে বাড়ি আসছে সে!
এটাই মনে হয়েছিল আমার কাছে, যখন শুনলাম – অকস্মাৎ হারিয়ে গেল পাঁচ বছর – আরো পুরো একটা বছর অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমার – আমাদের – ছোট্ট মেয়েটাকে ওর ছবিটা আবার দেখালাম আমি। এ-ই তোমার বাবা, তিনি আসছেন, তুমি তাকে দেখবে। আমার একটা বাবা আছে, স্কুলে 888sport app ছেলেমেয়েকে বলল সে, ঠিক যেভাবে বাড়িতে সে তার ছমাসের ছাগলছানাটাকে দেখিয়ে বলে বেড়ায়।
আমরা চাইছিলাম সে এক্ষুনি আসুক, আবার সেইসঙ্গে প্রস্ত্ততির জন্য সময়ও চাইছিলাম কিছুটা। ওর মা, ওর এক চাচার সঙ্গে থাকেন; এখন যেহেতু প্রয়াত ওর বাবা, আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে এরকম কোনো বাড়ি ওর নেই। যদি সময় থাকত,আমার বাবা খুঁটি কাটতেন, আমার মা ও আমি আগুনে পুড়িয়ে ইট তৈরি করতাম, ছন কাটতাম এবং ওর আর আমার এবং আমাদের বাচ্চাটার জন্য ঘর তুলতাম।
আমরা নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক কোন দিন বাড়ি আসবে সে। আমরা শুধু আমার রেডিওতে ওর এবং আরো কয়েকজনের নাম শুনেছিলাম যারা মুক্তি পেয়েছে। তারপর ভারতীয়দের দোকানে কালোদের খবর কাগজ, দ্য নেশন, চোখে পড়ল আমার, প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি, বহু লোক নাচছে, হাত নাড়ছে – আমি তক্ষুনি দেখতে পেলাম ওটা সেই ফেরি। কিছু লোককে কাঁধে নিয়ে নাচছে অন্যরা। আমি অবশ্যি দেখতে পাইনি সে কোন জন। অপেক্ষা করছিলাম আমরা। ফেরিটা তাকে দ্বীপান্তর থেকে ফিরিয়ে এনেছে কিন্তু আমাদের মনে আছে কেপ টাউন আমাদের থেকে অনেকদূরে। তারপর সত্যিই ফিরল সে। এক শনিবারে, কোনো স্কুল ছিল না, তাই আমার মায়ের সঙ্গে কাজ করছিলাম আমি। কুমড়ো আর ভুট্টার ক্ষেত নিড়াচ্ছিলাম, আমার চুল পরিপাটি রাখতে চাইছিলাম বলে একটা ডুক দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। একটা কম্বি এলো তৃণপ্রান্তর পেরিয়ে; ওর সাথিরা নিয়ে এসেছে ওকে। ছুটে পালাতে চাইছিলাম আমি, মুখ-হাত ধোব, কিন্তু পা ফাঁক করে পথ আগলে দাঁড়াল সে, ডাকতে লাগল, হেই!, হেই! আর ওর সঙ্গীরা একটা আওয়াজ তুলল ওকে ঘিরে এবং আমার মা পুরনো দিনের রীতি অনুসারে তারস্বরে চিৎকার জুড়লেন – আই! আই! আর আমার বাবা হাতাতালি দিতে দিতে, শব্দ করে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন ওর দিকে। আমাদের উদ্দেশে দু-হাত প্রসারিত করল সে, পলিশ-করা জুতো, শহুরে পোশাকে বিশালদেহী এক পুরুষ, এবং আমাকে যখন আলিঙ্গন করল, আমি তার পেছনে আমার ধুলোকাদা-মাখা হাত সন্তর্পণে সরিয়ে রাখলাম, পাছে তার কাপড়ে ময়লা লাগে। তার দাঁতগুলো জোরে কামড়ে ধরল আমার ঠোঁট, আমার মাকে খপ্ করে ধরে ফেলল সে এবং তিনি আমাদের মেয়েটাকে ওর সামনে তুলে ধরতে বেগ পেলেন। প্রমাদ গুনলাম আমি, বুঝি পড়েই যাব সবাই। তারপর নিশ্চুপ হয়ে গেল সকলে। মেয়েটা মুখ লুকোল আমার মায়ের পেছনে। সে কোলে তুলে নিল ওকে, কিন্তু বাচ্চাটা তার কাঁধের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে মৃদুস্বরে কথা বলল মেয়ের উদ্দেশে কিন্তু মেয়েটা কথা বলতে চাইল না। ওর বয়স এখন ছয় বছর। আমি ওকে ছেলেমানুষি করতে মানা করলাম। কিন্তু ও বলল, এই লোক সে নয়।
সাথিভাইয়েরা হেসে উঠল সবাই, আমরা হাসলাম, মেয়েটা দৌড়ে পালাল। আর সে বলল, আমাকে চেনার জন্য সময় দিতে হবে ওকে।
মোটা হয়েছে সে, হ্যাঁ, যথেষ্টই। বিশ্বাস হবে না আপনার। এত রোগা ছিল সে যে দেহের তুলনায় বড় দেখাত তার পায়ের পাতা দুটো। ওর হাড় টের পেতাম আমি, কিন্তু এখন – সেই রাতে – বেজায় ভারী মনে হচ্ছিল তাকে যখন সে উঠল আমার ওপর, আমি মনে করতে পারলাম না আগে এরকম লেগেছে। অনেকদিনের ব্যাপার। বন্দিশালায় আরো সবল হওয়ার ব্যাপারটা অদ্ভুত; আমার ধারণা ছিল সে যথেষ্ট খাওয়া পাবে না, এবং দুর্বল হয়ে মুক্তিলাভ করবে। সবাই বলল, দ্যাখ ওকে – কেমন জোয়ান মরদ লাগছে। সে হাসল, বুকে তাল ঠুকল, বলল সবাইকে, কীভাবে সাথিভাইয়েরা ব্যায়াম করেছে কারাকক্ষের ভেতর, সে রোজ দৌড়েছে তিন মাইল, নিজের নির্জন ছোট্ট কারা প্রকোষ্ঠে, যেখানে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তার মেঝেয় একজায়গায় ওঠবোস করে। আগে রাতে মিলিত হওয়ার পর অনেকক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলতাম আমরা, কিন্তু এখন আমি অনুভব করতে পারি সে কিছু একটা ভাবছে, যা আমি জানি না। আর আমি কথা বলে তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারি না। তাছাড়া জানিও না কী বলব। তাকে জিজ্ঞেস করব কেমন লেগে ছিল সেখানে, পাঁচ বছর সবকিছু থেকে দূরে থাকতে; কিংবা তাকে স্কুল বা মেয়েটা সম্পর্কে কিছু বলব। আর কী ঘটেছে, এখানে? কিচ্ছু না। স্রেফ অপেক্ষা। দিনে কোনো একসময়ে আমি বলতে চেষ্টা করলাম আমার অবস্থা কেমন ছিল খামারে, বাড়িতে এই পাঁচ বছর। সে শুনল আগ্রহভরে, ঠিক একইভাবে যখন 888sport app খামারের লোকজন এসে তাকে জানায় তার দ্বীপান্তরকালে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কী সব ঘটনা ঘটেছে। স্মিত হাসে সে, মাথা ঝাঁকায়, প্রশ্ন করে একটা-দুটো, তারপর উঠে আড়মোড়া ভাঙে। আমি বুঝে যাই সে এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করছে ঢের হয়েছে, এখন তার মন ফিরে যাচ্ছে সেখানে যা নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল লোকগুলো আসার আগে। আমরা খামারের লোকেরা ভীষণ মন্থর; আমরা খুব ধীরে ধীরে কথা বলি; সেও বলত।
আরেকটা কাজের জন্য নাম লেখাল না সে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না; আমরা ভেবেছিলাম পাঁচটা বছর, দূরে, ওই সবুজ আর সুনীল সাগরের মাঝখানে বসবাসের পর, আমাদের মধ্যে কিছুদিন বিশ্রাম নেবে সে । যখনই কোন কম্বি বা গাড়ি আসে তাকে নিয়ে যেতে, সে বলে দুশ্চিন্তা করো না, কবে ফিরব আমি জানি না। প্রথম প্রথম আমি জিজ্ঞেস করতাম, কোন্ সপ্তাহে ফিরবে, পরের সপ্তাহে? সে আমাকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে : আন্দোলন ব্যাপারটা ইউনিয়নের মতো না, যেখানে তুমি রোজ কাজ করো এবং পরে মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাক; আন্দোলনে তুমি জানো না আমাকে কখন কোথায় যেতে হবে, বা এরপর কী ঘটবে। টাকার ব্যাপারেও কথাটা খাটে। আন্দোলন, এটা চাকরির মতো না যে নিয়মিত বেতন আছে – আমি জানি সেটা, ওর বলে দেওয়ার দরকার ছিল না – ব্যাপারটা দ্বীপান্তরে যাওয়ার মতো, তুমি এটা করো আমাদের জনগণের জন্য যারা কষ্ট পাচ্ছে কারণ আমাদের টাকা নেই, আমাদের জমি নেই – দ্যাখ, সে বলল, আমাদের মা-বাবার কথা বলতে গিয়ে, আমার বাড়ি, সেই বাড়ি যেটি অপেক্ষা করছিল তার জন্য, তার সন্তানসহ: এই জায়গাটা দ্যাখ যেখানে শাদারা জমির মালিক আর তোমাকে গুটিসুটি হয়ে থাকতে দেয় কাদা আর টিনের কুটিরে, যতক্ষণ তুমি তার স্বার্থ দেখছ – বাবা আর তোমার ভাই তার ফসল বুনছেন, তার গরুবাছুরের যত্ন নিচ্ছেন, মা তার বাড়ি সাফ করছেন এবং তুমি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যথাযথ প্রশিক্ষণ পাচ্ছ না। কৃষকেরা আমাদের মনিব, বলল সে। দ্বীপান্তর থেকে সে ফেরার আগে আমি ভাবতাম আমাদের বাড়ি নেই কারণ তৈরি করার সময় হয়নি; কিন্তু আদপে আমাদের কোনো বাড়ি ছিলই না। এখন আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা।
আমি বোকা নই। সাথিভাইয়েরা যখন কম্বি নিয়ে এখানে আসে ওর সঙ্গে কথা বলতে, মায়ের সঙ্গে ওদের জন্য চা অথবা (যদি তিনি সপ্তাহান্তের জন্য তৈরি করে থাকেন ওটা) বিয়র নিয়ে যাওয়ার পর আমি সেখান থেকে সরে আসি না। মায়ের বিয়র পছন্দ করে ওরা, তারা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলে এবং ওদের মধ্যে একজন মাকে জড়িয়ে ধরে এর প্রমাণ দিতে চায়, তাকে ওদের সবার মা, আফ্রিকার মা, সম্বোধন করে। মাঝে-মাঝে তাকে ওরা ভীষণ খুশি করে কীভাবে দ্বীপে ওরা গান গাইত সেকথা বলে এবং তাকে পুরনো একটা গান গাইতে বাধ্য করে যেটা আমরা সবাই জেনেছি আমাদের নানি-দাদিদের কাছ থেকে। তারপর পুরুষালি কণ্ঠে বক্তব্য রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। আমার বাবা পছন্দ করেন না এই আওয়াজ তৃণপ্রামত্মরের ওপাশে পৌঁছক; তিনি ভয় পান ব্যোর যদি জানতে পান আমার মরদ একজন রাজনীতিক, দ্বীপান্তর থেকে ফিরেছে, এবং সে ব্যোরদের জমিতে সভা করছে, তিনি আমার বাবাকে, সপরিবারে, বিতাড়িত করবেন। কিন্তু আমার ভাই বলে ব্যোর যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলতে, এটা হচ্ছে প্রার্থনা সভা। তারপর গান শেষ হয়; আমার মা বুঝতে পারেন তার এখন অন্দরে ফিরে যেতে হবে।
আমি থাকি, এবং শুনি। আমার উপস্থিতি সে বিস্মৃত হয় যখন কথা বলে, তর্ক করে, কোনো বিষয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার দৃষ্টিতে, আমরা যখন একা থাকি তখন পরস্পরকে বলতে পারার মতো যে-কোনো বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাঝে মাঝে, যখন সাথিভাইদের কেউ কথা বলে তখন আমি তাকে আমার দিকে মুহূর্তের জন্য এভাবে তাকাতে দেখি যেভাবে আমি তাকাব স্কুলে আমার কোনো প্রিয় ছাত্রের দিকে তাকে বিষয়টি বোঝার জন্য উৎসাহিত করতে। পুরুষেরা আমার সঙ্গে কথা বলে না এবং আমিও বলি না। তাদের আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে খামারে মানুষদের সংগঠিত করা – আমার বাবা এবং ভাইয়ের মতো, এবং তার পিতামাতা যেমন ছিলেন সেরকম কর্মীদের। আমি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে শিখলাম : ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা সীমিতকরণ, ধর্মঘটের অধিকার, বার্ষিক ছুটি, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, পেনশন, অসুস্থতা এমনকি প্রসূতি ছুটি। আমি গর্ভবতী, অবশেষে আমার ভেতরে আরেকটি শিশু এসেছে, তবে সেটা মেয়েদের সমস্যা। তারা যখন বড় খোকা, বুড়ো খোকাদের কথা বলে, আমি জানি তারা কারা: আমাদের নেতারাও কারাগার থেকে ফিরেছেন। আমি তাকে অনাগত সন্তানের কথা বললাম; সে বলল, এই শিশু হবে নতুন এক দেশের জন্য, সে স্বাধীনতাকে সমুন্নত করবে, যার জন্য আমরা লড়াই করেছি! আমি জানি বিয়ে করতে চায় সে কিন্তু বর্তমানে সেজন্য সময় নেই। বড়জোর বাচ্চাটা সৃষ্টি করার সময় ছিল। সে আমার কাছে আসে ঠিক যেভাবে সে এখানে আসে একবেলা খাবার খেতে বা পরিষ্কার কাপড় পরতে। ছোট্ট মেয়েটাকে তুলে নেয় সে, এপাশে-ওপাশে দোলায়! – এবং দায়িত্ব শেষ, সে কম্বিতে উঠছে, এরই মধ্যে সাথিভাইদের সামনে তার সেই চেহারা মেলে ধরেছে যা শুধু জানে তার মাথার ভেতর কী আছে, ওই চোখগুলো ঘুরছে সদাচঞ্চল যেন সে একটা কিছু তাড়া করছে, যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। ছোট্ট মেয়েটা এই মানুষটার প্রতি টান অনুভবের সময় পায় না। কিন্তু আমি জানি ও তার জন্য গর্ববোধ করবে, একদিন!
ছয় বছরের একটা শিশুকে একথা আপনি বলবেন কীভাবে? কিন্তু আমি তাকে বড় খোকা আর বুড়ো খোকাদের কথা বলি, আমাদের নেতাদের কথা বলি, যাতে সে জানে তার বাবা ওঁদের সঙ্গে দ্বীপান্তরে ছিলেন, এই মানুষটাও একজন বিশাল মানুষ।
শনিবার, স্কুল নেই, মায়ের সঙ্গে বাগানে কাজ করি আমি, তিনি গান করেন কিন্তু আমি করি না; আমি চিন্তা করি। রোববার কোনো কাজ নেই, শুধু মাঠে প্রার্থনা সভা, কৃষকদের চলাচল পথের বাইরে, গাছতলায়, এবং বিয়রপান টিন আর কাদামাটির কুটিরে যেখানে কৃষকেরা আমাদের অনুমতি দেয় তাদের জমিতে আমাদের উবু হয়ে বসতে। আমি নিজের পথে চলে যাই, যেমন করতাম যখন ছোট ছিলাম, খেলা তৈরি করতে কিংবা নিজের সঙ্গে কথা বলতে যেখানে কেউ আমার কথা শুনবে না বা আমাকে খুঁজবে না। বহু উঁচুতে, শেষ বিকেলে তপ্ত পাথরে বসে আছি আমি, আর গোটা উপত্যকা একটা পথ হয়ে গেছে পাহাড়পর্বতের মাঝ দিয়ে, আমার পায়ের থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়ে। এটা ব্যোরের খামার কিন্তু কথাটা সত্যি নয়, কেউ এর মালিক না। গরুবাছুরগুলো একথা জানে না কেউ তাদের মালিকানা দাবি করছে, ভেড়ার পাল – ধূসর পাথর ওরা, এবং তারপর একটা চলমান ধূসর, মোটা অজগর হয়ে যাচ্ছে – জানে না। আমাদের কুঁড়েঘর, বুড়ো মালবেরি গাছ আর ছোট্ট খয়েরি মৃত্তিকার মাদুর যেটি আমার মা খুঁড়েছেন গতকাল, দূর নিচে, এবং ওপাশে চিমনি আর শাদা চকচকে জিনিসটা যা আসলে খামারবাড়ির টিভি মাস্ত্তল, এগুলোর চারপাশে দাঁড়ান গাছপালার ঝাড় – সব অর্থহীন, এই ধরিত্রীর বুকে। একঝটকায় ওগুলোকে উপড়ে ফেলতে পারে সে, যেভাবে কুকুর তাড়ায় মাছি।
আমি মেঘের কোলে বসে। আমার পেছনে আকাশের রং বদল করছে সূর্য আর মেঘগুলো নিজেরাই বদলাচ্ছে, আস্তে, আস্তে। কিছু শাদা, বুদ্বুদের মতো বিস্ফোরিত হচ্ছে নিজেরাই। নিচে ধূসর একটা রেখা, বৃষ্টি তৈরির জন্য যথেষ্ট নয় ওটা। 888sport app মেঘ গোলাপি, এবং দীর্ঘতর ও কৃষ্ণতর হয় রেখাটা, একটা লম্বা শুঁড় তৈরি করে যার পেছনে থাকে পুচ্ছ। একটা বিশাল ধূসর ইঁদুর ঢেকে ফেলছে আকাশটাকে, গ্রাস করছে।
ছবিটা চিনতে পারল শিশু; সে বলল, ওটা সে নয়। আমি বসে আছি এখানে যেখানে প্রায়শ আসতাম সে যখন দ্বীপান্তরে ছিল তখন। আমি আসতাম অন্যদের থেকে দূরে সরতে, একা একা অপেক্ষা করতে।
আমি দেখছি ইঁদুরটা, নিজেকে হারিয়ে ফেলছে ওটা, নিজের আকৃতি হারিয়ে ফেলছে, আকাশটাকে খেয়ে ফেলার সময়ে, এবং আমি এখানে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি তার ফিরে আসার জন্য।
অপেক্ষা করছি। আমি অপেক্ষা করছি নীড়ে ফেরার জন্য।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.