মিথ্যার মতো সুন্দর

আমাকে বলতে হবে, ভদ্রমহিলা দেখতে আমার মায়ের মতো। কেন, এরকম আকাট একটি মিথ্যা কেন বলতে যাব? যে দুটি চেহারার মধ্যে সুদূর সামঞ্জস্যও নেই, তাদের মধ্যে সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা কেন করব আমি? তার চেয়ে বরং বলতে পারি, আপনি আমার মায়ের চেয়েও দেখতে সুন্দরী। না, সেটাইবা বলব কেন, এখানে আমার মা’র প্রসঙ্গটি তুলতেই হবে, এমন তো কথা নয়। তুলনার ব্যাপারটা আসছেইবা কেন। এমনিতেই এই বয়সে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সুশ্রী, একটা আভিজাত্য আছে চেহারায়, সেটা বলা যায়। মানে, সরাসরি তো বলা যায় না, একটু কৌশলে বলতে হবে যে, বাড়িটা বেশ সুন্দর, সামনে একফালি বাগানও আছে … ঘরটা তো বেশ সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন, আসলে আপনার রুচিটা বোঝা যায় … তা ছাড়া আপনি কিন্তু দেখতেও বেশ সুন্দর আন্টি, মানে গর্জিয়াস।

আমার বাবা বিরক্ত হয়েছিল, তার কথা, এত ধানাই-পানাই করার দরকার কী, যদি একটা মাত্র বাক্য এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর হয়!

কিন্তু কেন এখানে মা’র কথা টানব? আমি সেবার একটু গোঁয়ার্তুমি করেছিলাম।

 তিনটা কারণ দেখিয়েছিল আমার বাবা। এক. তাতে আমার কোনো ক্ষতি নেই, দুই. ভদ্রমহিলা খুশি হবেন, তিন. আমার বাবার তাতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

– শেষ পর্যন্ত বাবার অনুরোধ রেখেছিলে?

– না রেখে উপায় আছে? ধুরন্ধর মানুষ, ছলেবলে কৌশলে তোমাকে রাজি করাবেই। আমি অনেকটা তার মতো হলেও কিছুটা তো নিজের মতো ছিলাম, তাই সহজে বলতে পারছিলাম না। লোকটার আগের স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা ছিল না, অবশ্য কারো প্রতিই কখনো কোনো স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা তার ছিল বলে আমার মনে হয় না। শুধু নিজেকে নিয়েই থাকা, নিজের জন্যই থাকা। কিন্তু আমার তো মা’র জন্য টান ছিল, আফটার অল মা তো …।

– তোমার মা কি অনেক সুন্দরী ছিলেন?

– না না, সাদামাটা টিপিক্যাল প্রাইমারি স্কুলশিক্ষিকার চেহারা। এরকম অনেককেই দেখবে প্রফেশন ও চেহারায় অদ্ভুত মিল, চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে দেওয়া যায়, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ বা উকিল। তার ওপর এরকম একটা লোকের সঙ্গে

ঘর-সংসার করেছে, তার সন্তানের মা হয়েছে, তার চেহারায় লাবণ্য বলতে কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। এই ভদ্রমহিলা সে-তুলনায় অনেক সুশ্রী। তখন চল্লিশোর্ধ্ব, চল্লিশের ঘর পেরিয়েও সৌন্দর্যটা ধরে রেখেছেন। তবু ধরো, আমার মা তো আমার মা-ই, আর কারো সঙ্গে তাকে মেলাতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে সেই বয়সে, তখন আমি কলেজে পড়ি।

– তো বলার পর কী রিঅ্যাকশন হলো ভদ্রমহিলার?

– সবে উনি কয়েক পদের খাবার দিয়েছেন টেবিলে। পুডিংয়ে কামড় দিয়ে অপূর্ব স্বাদ জিহ্বায়, এসব জিনিস তো সচরাচর খাওয়া হতো না … ওই উপযুক্ত সময়টাতেই বলেছিলাম, আপনি দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো।

– রিঅ্যাকশন?

– উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল চোখ-মুখ। আমার মাথায় হাত বোলালেন, নিঃসন্তান ভদ্রমহিলা তারপর বোধহয় কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন, গলতে শুরু করলেন। চোখের পানি লুকাতে দ্রুত পাশের ঘরে চলে গিয়েছিলেন।

– আহা!

– তুমি বলছ আহা, আর আমার বাবা চোখ টিপে নিচু গলায় বলেছিল, সাবাস!

– তাতে তার কী লাভ হয়েছিল?

– লাভ বলতে লাভ! রানী ও রাজত্ব পেয়ে লোকটা এখনো রাজার সুখে দিন কাটাচ্ছে।

– ইন্টারেস্টিং!

– ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভদ্রমহিলা ছিলেন ডিভোর্সি। ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে। প্রথম স্বামীকে কেন ছেড়েছিলেন জানো?

– কেন?

– লোকটা নাকি প্রচুর মদ খেতো। শুনে আমি হাসব, না কাঁদব ভেবে পাই না। মদ্যপ লোকটাকে ছেড়ে ভদ্রমহিলা অলমোস্ট একটা মদের দোকানই বিয়ে করে বসলেন। হা হা হা।

– মানে?

– মানে আবার কী, মদ্যপানের ব্যাপারে আমার বাবা ছিল ফুলটাইমার, বাকি সব কাজ পার্টটাইম। সকালে নাস্তার পর থেকে শুরু …।

– কিন্তু এই বিয়েটা তো টিকে গেল।

– হ্যাঁ, আট-দশ বছর পেরিয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যায় টিকে গেছে।

অদিতিকে বাবার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে ধারণা দিতে গিয়ে আমার অনেক কথাই মনে পড়ছে। অনিল কাকার কথা মনে পড়ল। বাবার বন্ধু। তবে তার বন্ধুদের মধ্যে এই একটা লোককে আমার মা মোটামুটি একটু 888sport apk download apk latest version-সমীহ করত, বাকিদের একই গোয়ালের গরু ভেবে সব সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তো, একবার সেই অনিল কাকা আমার মাকে জানালেন, দিবাকর, মানে আমার বাবা, তাঁর কাছ থেকে পাঁচ-সাতদিনের জন্য হাজার বিশেক টাকা নিয়ে দু-বছর ধরে দিচ্ছে না। আমার মা বিরক্ত হয়ে দুই চোখের ভ্রু এক করে জিজ্ঞেস করেছিল, এতদিন ধরে চিনেও ওই লোকটাকে কী করে টাকা ধার দিলেন তিনি। আমি তখন অনেক ছোট; কিন্তু অনিল কাকা যে-কথাটা বাবার সম্পর্কে বলেছিলেন সেটা এখনো মনে আছে। তাঁর মতে, দিবাকর হচ্ছে চারুবাক, মানে চার্বাক, কথার জাদুকর। চার্বাক ছিলেন দার্শনিক, দিবাকরের মতো তাঁর অনেক অনুসারী এখনো রয়ে গেছে। লোকগুলো কথা দিয়ে অর্ধেক দুনিয়া জয় করতে পারে। চার্বাক দর্শনের মূল কথা হচ্ছে, ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ, মানে ঋণ করে ঘি খাও …। এ নিয়ে এদের কোনো অপরাধবোধ নেই। ঋণের টাকা ফেরত না পেয়েও বেচারা অনিল কাকা বেশ হাসি-ব্যঙ্গ মিশিয়ে মাকে বলেছিলেন, টাকা যে ফেরত দেবে না, সে তো জানি; কিন্তু তার প্রতিভা দেখে অবাক মানতে হয়, তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে বলে কী করুণ চেহারায় গিয়ে টাকাটা চেয়েছিল আমার কাছে, হা-হা-হা।

– এটাকে আপনি প্রতিভা বলছেন দাদা? আমার মা রাগে-দুঃখে উচ্চারণ করেছিল।

– প্রতিভা তো বটেই। তোমার স্বামীকে তুমি এখনো চিনতে পারোনি নমিতা।

– আমার আর চেনার দরকার নেই। আমার মা মুখ ঝামটা দিয়েছিল।

অবশ্য পুরোপুরি চেনার আগেই তো আমার মা মরে গেল। অনিল কাকা বেশ খোশমেজাজে বাবার সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিল সেদিন, সেসব আমার মনে গেঁথে আছে এখনো। তার মতে, দিবাকর যদি খোদ সত্যজিৎ রায়ের সামনে গিয়ে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, তাহলে সত্যজিৎবাবু অন্তত প্রথম দশ মিনিট মুগ্ধ হয়ে শুনবেন। এগারো মিনিটের মাথায় তাঁর মনে কিছুটা সন্দেহ জাগবে, পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় হয়তো তিনি বুঝে ফেলবেন লোকটা আসলে স্রেফ কিছু ইনফরমেশন হাতে নিয়ে জ্ঞান ফলাতে চাচ্ছে। তো এই যদি হয় সত্যজিৎ রায়ের অবস্থা, বাকিদের কথা সহজে বোধগম্য। কত নব্য লেখককে বিখ্যাত কানাডিয়ান রাইটার হিসেবে মোটর পার্টসের নাম বলে ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিয়েছে দিবাকর। নামটা পরিচিত লাগছে, আবার তার সম্পর্কে ঠিকঠাক ধারণাও নেই, কী যে মুশকিলে পড়ে যেত বেচারারা, হা-হা-হা। যতই তারা দিশাহারা, ততই দিবাকর জ্ঞানী। চারু-বাক মানে চার্বাক। তাকে ঋণ দিতে পেরে বা তার সামান্য উপকারে লেগে এই লোকগুলো ধন্য। তবে একসময় তাদের মোহমুক্তি ঘটে যায় নিশ্চয়। তাতে অসুবিধা নেই, দিবাকর নেমে পড়ে নতুন মুখের সন্ধানে। অনিল কাকার পর্যবেক্ষণ কত নির্ভুল এখন তা বুঝতে পারি। এই যেমন তার সর্বশেষ বড় সাফল্য বিপাশা সাহাকে টোপে ফেলা।

– আচ্ছা, ভদ্রমহিলাকে কী করে পটালেন তোমার বাবা? অদিতি জানতে চাইল।

– প্রতিভা অদিতি, প্রতিভা। আমার বাবার আবৃত্তির গলা চমৎকার। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে শক্তি-সুনীল-শামসুর রাহমানের অনেক দীর্ঘ 888sport app download apk তার মুখস্থ। বিপাশার তাপিত হৃদয়ে সেসব 888sport app download apk শান্তির বারি হয়ে উঠেছিল। ভদ্রমহিলা আবার একটু গান-টান গাইতেন। বাবার মতো সমঝদার পেয়ে তিনি একটু হেলে পড়েছিলেন, পরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের ওপর তাঁর জ্ঞান (আসলে কিছু ইনফরমেশন) দেখে তিনি একেবারে কুপোকাত।

– সাংঘাতিক।

– চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা যাকে বলে, যেটুকু দোনামনা ছিল বিপাশা সাহার মনে, আমার মুখ থেকে যেদিন শুনলেন দেখতে তিনি আমার মায়ের মতো, ব্যস প্রেম আর করুণা মিলেমিশে একাকার … একেবারে ভেসে গেলেন!

– মাই গড!

– ইয়েস। দিস ইজ মাই ফাদার।

– কিন্তু তোমাকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দিলেন কেন?

– আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে বলে। তাছাড়া আমি তো তার অনেক মিথ্যার সাক্ষী। এরকম সাক্ষী-সাবুদ সরিয়ে দেওয়াই ভালো।

– তাই বলে নিজের ছেলেকে?

আমি হাসলাম। আমার বাবার পরিপূর্ণ পরিচয়, মানে প্রয়োজনে লোকটা কতদূর যেতে পারে তার একটি ধারণা দেওয়ার জন্য আমার আট-নয় বছরের বয়সের একটা অভিজ্ঞতা অদিতিকে বলা দরকার।

প্রাইমারি পড়েছি মায়ের স্কুলে। প্রতিদিন তার হাত ধরেই যাওয়া, আবার ছুটির পর একসঙ্গে ফেরা। একদিন ছুটির পর স্কুলে একটা মিটিং ছিল মা’র, সকালে ঘর থেকে বেরোনোর সময় বাবাকে বলে রেখেছিল আমাকে যেন দুপুরে নিয়ে আসে। আমাকে বলেছিল, সোজা বাড়ি ফিরে আসতে, বাবা বললেও যেন অন্য কোথাও যেতে যেন রাজি না হই। ওই লোকটাকে আমার মা’র চেয়ে বেশি আর কে চেনে!

ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাস ছিল সম্ভবত। এটা আমার অনুমান, কারণ তখন শীতকাল ছিল এবং আমার পরনে যে একটা নীল ফুল হাতা সোয়েটার ছিল এ-কথা মনে আছে। স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য আমরা শর্টকাট হিসেবে রেলওয়ে স্টাফ কলোনির রাস্তাটা বেছে নিতাম। দু-পাশে টালির ছাউনি দেওয়া পাকাঘর, মাঝখানে ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া সরু একটা পিচের রাস্তা। তবে এই পথের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল
দু-পাশে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু ফুলের গাছ। সেই বয়সে ওই পথটি তাই আমার বড় ভালো লাগত। সবুজ ডাল-পাতার ফাঁকে অজস্র লাল ফুল আর হলুদ রঙের সোনালু ফুলের ওপর রোদের ঝিকিমিকি আমার চোখে-মনে ঘোর লাগিয়ে দিত।

গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে কিছুদূর গেলেই ‘হোটেল জামান অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস’ নামের একটি বড় রেস্তোরাঁ ছিল। রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডটি বড় আজগুবি, এখনো মনে পড়লে মানুষের উদ্ভট কল্পনাশক্তি আমাকে অবাক করে। হোটেলের নামের দু-পাশে আঁকা আছে দুটি বড় মোরগের ছবি, তাদের ঠোঁটে দুটি মোরগ বা মুরগির ঠ্যাং। ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য মুরগির ঠ্যাংয়ের ছবি দেওয়া হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মোরগ নিজেই একটি মোরগ বা মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছে এমন অদ্ভুত চিন্তা হোটেলের মালিক বা অংকন888sport live chatীর মাথায় কী করে এলো সেটা এখনো ভেবে পাই না!

‘হোটেল জামান অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস’-এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার নাকে লাগত বিরিয়ানির গন্ধ। আর ক্ষিধে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ওই সুঘ্রাণ আমার ক্ষিধেটা চাগিয়ে দিত। কিন্তু ভুলেও কখনো ওই জিনিস খাওয়ার ইচ্ছা মুখে আনিনি। মা’র হাত ধরে হনহন করে হেঁটে চলে যেতাম। সেইদিন হঠাৎ বাবা বলল, বিরিয়ানি খাবি?

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি ওই শিশুবয়স থেকেই লোকটাকে বিশ^াস করতাম না। আমি তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আদৌ সত্য বলছে কি না। একগাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বাবা বলল, খাবি কি না বল।

আমি লোভে পড়ে গেলাম, আমার মায়ের পইপই বারণ ভুলে গেলাম। রাজি হয়ে মাথা নেড়েছি।

বাবা পিঠে একটা ছোট চাপড় মেরে বলল, চল।

সেই প্রথম হোটেলে বসে বিরিয়ানি খেয়েছি। স্বাদে-গন্ধে এমন মহার্ঘ্য খাদ্যবস্তু পৃথিবীতে আছে এর আগে আমার জানা ছিল না। মুখে হাসি আর চোখে বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বাবা। আট-নয় বছরের একটি বালককে পুরো এক প্লেট বিরিয়ানি চেটেপুটে খেতে দেখলে বিস্মিত হওয়ারই কথা। খাওয়া শেষে হাত-মুখ ধুয়ে এসে পরিতৃপ্ত চেহারায় যখন বসেছি, তখন গলা নামিয়ে বাবা বলল, তুই বোস, আমি যাচ্ছি। একটু পরে তুই এখানকার বয়-বেয়ারাদের জিজ্ঞেস করবি আমার বাবা কোথায়? ওরা কিছু বলতে পারবে না, তখন কাঁদতে শুরু করবি। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়বি।

আঁতকে উঠেছিলাম আমি, হাত ধরে ফেলেছিলাম বাবার, না, আমি পারব না, আমি কিছুতেই পারব না।

নির্বিকারভাবে লোকটা বলেছিল, কেন বুঝতে পারছিস না, আমার কাছে টাকা নেই। টাকা দিতে না পারলে ওরা দুজনকেই আটকে রাখবে, থালা-বাসন ধুতে দেবে। মারধরও করতে পারে।

– তাহলে কেন আনলে? টাকা না থাকলে কেন আনলে আমাকে? আমি ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম।

আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তুই খেতে চাইলি তো …। এখন আমি যা বলছি কর, কোনো প্রবলেম হবে না। আমি সিটি কলেজের পাশের বইয়ের দোকানটাতে আছি।

এরকম ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে একটা শিশুকে ফেলে দিয়ে তার নিজের পিতা পালিয়ে যেতে পারে, এরকম আমি আর আগে-পরে কখনো দেখিনি, শুনিওনি।

চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ অসার হয়ে বসেছিলাম। তারপর সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করেছি, আমার বাবা কোথায়?

কোলাহল শুরু হয়ে গেল। লোকটা গেল কোথায়? বিল তো দেয়নি, ছেলেকে ফেলে চলে গেল কেন ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নানা দিক থেকে। বয়-বেয়ারা-ম্যানেজার থেকে হোটেলের 888sport app খদ্দের সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল। নানা মত ও মন্তব্য সহ্য করে আমি হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছি। এর মধ্যে এক একটা মন্তব্য ছিল ভয়াবহ, ছেলেটাকে বেঁধে রাখ, ঠিকই শালা টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।

কিন্তু আমি তো জানতাম আমার বাবা ছাড়িয়ে নিতে আসবে না, আবার ভাবছি, আসতেও পারে। এরকম দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে সময় কেটেছে। অন্তত আধাঘণ্টা নানা শলাপরামর্শের পর এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক বলল, তুমি একা বাড়ি ফিরতে পারবে?

বললাম, পারব।

উনি ওকালতি করলেন আমার পক্ষে, ছেলেটাকে আটকে রেখে কী লাভ, ছেড়ে দাও।

মুক্তি পেলাম। চোখ মুছতে মুছতে হেঁটে সিটি কলেজের পাশে বইয়ের দোকানে এসে দেখি, দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসি চেহারায়, বলেছিলাম না?

রাগে-দুঃখে, হয়তোবা ঘৃণায়ও কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না লোকটার সঙ্গে। শুধু ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম আরেকবার।

– তোর মাকে কিছু বলিস না প্লিজ। মানে বিরিয়ানি খেয়েছিস তা তো বলবি …, কিন্তু এই যে টাকার ব্যাপারটা …।

কী আশ্চর্য, মাকে ঠিকই বিরিয়ানির স্বাদের গল্পটা বলেছি, কেন যেন আমাকে ফেলে বাবার পালিয়ে যাওয়ার গল্পটা বলতে পারিনি। এরপর থেকে এটা আমার নাইটমেয়ার। একদল লোক ঘিরে রেখেছে আমাকে, বাবা পালিয়ে গেছে …। আমি ঘুমের মধ্যে গোঁ-গোঁ করতাম। আমার মা বলত, স্বপ্ন দেখছিস? দুঃস্বপ্ন?

মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে, পানি খাইয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিত।

এরপর থেকে স্কুল থেকে ফেরার পথে খুব সতর্ক থাকতাম। ‘হোটেল জামান অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস’-এর সামনে এলে আমার বুকের ধুকপুক শব্দটা কানে শুনতে পেতাম। নিজের চেহারাটা আড়াল করতাম মায়ের শরীরে প্রায় লেপ্টে থেকে।

এখনো মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্নটা ফিরে আসে। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি বিছানায়। বাকি রাত আর ঘুমোতে পারি না। মা তো নেই, এখন কেউ আর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় না। আমি সব সময় চাইতাম, লোকটা মরে যাক; কিন্তু দিব্যি বেঁচে আছে, শুধু আমার মা’টা মরে গেল!

ব্যথা ও বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদিতি। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, কিন্তু দুই ফোঁটা অশ্রুপাত আড়াল করতে পারলাম না। নিজের জন্য নয়, আট-নয় বছরের অবোধ বালকটির জন্য এখনো বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে।

বেশ কিছুটা সময় বিমর্ষ ভাব কাটানোর পর অদিতির বোধহয় মনে হলো, পরিস্থিতিটা সহজ আর স্বাভাবিক করা দরকার। বলল, কবি নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসানও কিন্তু হোটেলে ভরপেট খেয়ে টাকা না দিয়ে পালিয়েছিলেন একবার। জানো গল্পটা?

– না। আমি কৌতূহল বোধ করি।

এবার অদিতির চেহারায় অনাবিল আনন্দ, সম্ভবত সেই মুহূর্তটা কল্পনায় দৃষ্টিগোচর হলো তার। একচোট হেসে নিয়ে বলল,

কোথায় পড়েছি মনে নেই, খুব সম্ভব গুণের আত্মজীবনীতে। দুই কবি গুলিস্তানের এক হোটেলে ভরপেট আহার সেরে বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ কী দুর্বুদ্ধি খেলে গেল গুণের মাথায়, নিজে তো দৌড়াতে শুরু করলেনই, পেছনে থাকা আবুল হাসানের উদ্দেশে বললেন, দৌড়াও। বেচারা হাসান কী আর করেন, বন্ধুর পেছনে ছুটতে শুরু করলেন। ছুটতে ছুটতে রাস্তার একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন তাঁরা, হা-হা-হা।

আমিও যোগ দিলাম হাসিতে। কবি হিসেবে তখনই দুজন যথেষ্ট খ্যাতিমান। সে-কথা না হয় বাদই দিলাম। ভদ্রবেশী দুজন যুবককে, তার মধ্যে একজন আবার শ্মশ্রুধারী, খাওয়া-দাওয়ার পর হঠাৎ এমন ছুটে পালাতে দেখে হোটেলের ম্যানেজার, বয়-বেয়ারা বা খদ্দেরদের চেহারা কেমন হয়েছিল সেটা কল্পনা করে সত্যি হাসি পায়।

অদিতির পরিবেশ স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা সফল হলো বলে প্রসন্ন দেখাল তাকে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন করল, এখন বলো, এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?

কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি।

– আমি তো পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার পরিচিত এক সাংবাদিক জানাল, পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞাপন দিতে গেলে আগে থানায় জিডি করতে হবে। থানা-পুলিশ হুজ্জোতের কথা ভেবে আর বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো না।

এ-কথা কতটা ঠিক কে জানে। অদিতির সবটা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না। অনেক সময় হেঁয়ালি করে কথা বলে, তার সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমি রীতিমতো ধন্দে পড়ে যাই। তবে এ-কথা ঠিক গত প্রায় আট-দশদিন আমি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। টেকনাফে আমার এক কামরার ভাড়া ঘরের দরজায় ছোট একটি তালা ঝুলিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তালা না দিলেও চলত। সস্তা দামি তক্তপোশ আর টেবিল-চেয়ার, ততোধিক সস্তা একটা আলমারিতে কয়েকটা জিন্স-গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, টি-শার্ট শার্ট ছাড়া আর তেমন কিছুই প্রায় নেই। একগাদা বই অবশ্য আছে, চোর-ছ্যাঁচোড়দের সেদিকে চোখ যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং দরজায় তালা ঝোলানোর একমাত্র সার্থকতা হচ্ছে বন্ধু বা সাবেক কলিগদের জানিয়ে দেওয়া, আমি নেই।

অদিতিও হয়তো দু-একবার ঢুঁ মেরে গেছে। আট-দশদিনে একবার দেখা না হওয়া কিছুটা অস্বাভাবিক, তদুপরি সেলফোনের সুইচ বন্ধ থাকা বিস্ময়করও বটে। কিন্তু আত্মহত্যার মতো সাহস নেই বলে আমি আপাতত সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী হওয়া যায় কি না ভাবছিলাম।

– তো এতদিন পর হঠাৎ কেন বাসায় এসে হাজির হলে? আর এসেই তোমার বাবার 888sport sign up bonusচারণ করতে শুরু করেছ …, সরি 888sport sign up bonusচারণ শব্দটি বোধহয় অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হলো না … তিনি তো এখনো বেঁচে আছেন …।

অদিতির প্রশ্নটার মধ্যে একটু ধমকের সুর যেমন আছে, তেমনি কিছুটা কৌতুকও বোধহয় মেশানো। ওই যে বললাম, অদিতির সবটা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না। কক্সবাজারে অদিতির ফ্ল্যাটে আসার জন্য আমার কোনো কারণ দর্শানোর প্রয়োজন হয় না। বরং ছুটির দিনে বা যে-কোনো অবকাশে আমার উপস্থিতি যে তার জন্য আনন্দদায়ক এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘জাগরণ বিডি’র বড় কর্মকর্তা অদিতি বিশ্বাস একাই থাকে দুই বেডরুম, ড্রইং-ডাইনিং-কিচেন মিলিয়ে অন্তত দেড় হাজার বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটে। খণ্ডকালীন পরিচারিকা সকালে এসে রান্নাবান্না, ঘর মোছার কাজ সেরে চলে যায়, তার কাছে একটা চাবি দেওয়া আছে। অদিতি কখনো দুপুরে খেতে আসে, কখনো আসে না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ড্রাইভারকেও থাকতে হয় না সন্ধ্যার পরে। 888sport appয় বাবা-মা-পরিবার ফেলে আসা একা একটি মেয়ে চারতলা বাড়িটির তিনতলায় কী করে রাত কাটায় এ নিয়ে কলিগ বা অন্যদের দুশ্চিন্তা বা কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু এসব বিষয়ে মাথা ঘামালে সে অদিতি বিশ্বাস কেন!

888sport app থেকে আমরা বেশ কজন তরুণ-তরুণী প্রায় একই সময়ে এসেছিলাম টেকনাফে। মিয়ানমারের সেনাদের অত্যাচার-নিপীড়নে ঘরবাড়ি-আশ্রয় হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত জনস্রোত নদীপথে টেকনাফ আসছিল তখন। শত, হাজার, লক্ষ … জলে ও ডাঙায় 888sport promo code-পুরুষ-শিশু ও যুবা … মানুষ আর মানুষ!

দলে-দঙ্গলে রোহিঙ্গারা এসে যে যেখানে পারে ঠাঁই নিয়ে এখানকার প্রাকৃতিক-সামাজিক ভারসাম্যের যেমন বারোটা বাজিয়েছে, তেমনি দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর কারণে প্রচুর তরুণ-তরুণীর চাকরিও হয়েছে। আমাদেরও চাকরিসূত্রেই এখানে আসা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে এসেও আমরা কয়েকজন কী করে যেন পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছিলাম। হয়তো কর্মক্ষেত্রের সম্পূর্ণ নতুন জায়গা ও পরিবেশ আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। কাজ শেষে একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। প্রথমদিকে আমরা থাকার মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলাম, চাকরিটার স্থায়িত্ব কদিনের তা নিয়েও ভাবছিলাম। ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে থিতু হয়েছিলাম।

আমরা জোটসঙ্গী তিনটি মেয়ে পাঁচটি ছেলে বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করি। তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও লোভনীয় চাকরিটা জুটেছিল অদিতির ভাগ্যে। ভাগ্য না যোগ্যতা সেটা নিশ্চয় তর্কসাপেক্ষ। সবচেয়ে খারাপ চাকরিটা ছিল আমার। অদিতি যেমন কক্সবাজার শহরে একটা অফিসে জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পেয়েছে, সেরকম কিছু তো দূরে থাক, টেকনাফের অফিসে চেয়ার-টেবিলও জুটল না আমার। শরণার্থী শিবিরের অলিগলিতে ঘোরাঘুরি আমার সেই প্রথম থেকেই চলছে। মানে ফিল্ড অফিসার পদ থেকে আমার আর উন্নতি হয়নি। অথচ অদিতি কি না আমাকেই পছন্দ করল!

আমি অনেক ভেবে এই মীমাংসায় এসেছি, শুধু একই সম্প্রদায়ভুক্ত বলে আমার প্রতি তার এই পক্ষপাত। আটজনের মধ্যে আমরা দুজনই শুধু হিন্দু। অদিতি বোধহয় ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়’ আপ্তবাক্যটি মনে রেখে আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আমি আঁচ বাঁচিয়ে চলতে চেয়েও আগুনের মধ্যে পড়লাম।

– এই কদিন কোথায় ছিলে? অদিতি আবার জানতে চাইল।

– 888sport app চলে গিয়েছিলাম। জানো তো আমাদের প্রজেক্ট শেষ, নতুন করে ফান্ড পাওয়ার কোনো চান্স নেই। আসলে বাজে অরগানাইজেশন, শুধু টাকা মারার ধান্দা। এখন প্রজেক্ট শেষ, আমার চাকরিও খতম। ভাবলাম এখানে পড়ে থেকে আর কী হবে?

– ভালো। কিন্তু ফোন বন্ধ রাখার কারণটা জানতে পারি? অদিতির গলায় চাপা ক্ষোভ।

– কোনো কারণ নেই, জাস্ট মুড অফ ছিল, তাই ফোনের সুইচ অফ।

– বাহ্, চমৎকার যুক্তি। অদিতির গলায় শ্লেষ; কিন্তু ফোনের সুইচ অফ করে দিলেই তো সবকিছু অফ হয়ে যায় না। তোমাকে নিয়ে কারো দুশ্চিন্তা হতে পারে, এটা তোমার মাখায় এলো না একবারও? তো, ফিরে এলে কেন আবার?

– ভাবলাম, তোমাকে কিছু বলে যাওয়া হয়নি …।

– ও, তার মানে তোমার মনে হলো আমাকে বলে যাওয়া উচিত ছিল? গুড, ভেরি গুড, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ ফর ইয়োর কনসার্ন।

এই কথার মধ্যে ক্ষোভ যেমন আছে, তেমনি চাপা অভিমানও আছে। সুতরাং নিরুত্তর থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে অদিতিই আবার কথা বলল, কিন্তু সেই সকাল থেকেই তোমার বাবার গল্প করে যাচ্ছিলে … আজ হঠাৎ তোমার বাবার প্রসঙ্গে এত কথা বললে কেন বুঝতে পারছি না। আমি কখনো জানতে চেয়েছি বলেও তো মনে পড়ে না …।

এই প্রশ্নই কথা জুগিয়ে দিলো আমার মুখে। আসলে হাতে-কলমে ব্যাপারটা অদিতিকে বোঝানোর জন্যই আমার বাবার অতীত, তার কীর্তিকলাপ তুলে ধরতে চেয়েছি। বললাম, বাবার সম্পর্কে এত কথা বলার কারণ কি জানো, আমার জেনেটিক ব্যাপারটা তোমাকে বোঝানো। সারা জীবন সুন্দর করে কথা বলে, সেটা বিশ্বাস করিয়ে মানুষকে ধাপ্পা দিয়েছে আমার বাবা, এখনো দিচ্ছে। তার সন্তান হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছি সেই ‘মহাগুণ’টি। তোমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছি, এসব স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্য আমার নেই। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, নিউইয়র্কের এম্পায়ার এস্টেট বা ম্যানহাটন …।

– ওসব জায়গায় আদৌ তুমি যাওনি। সে তো তুমি যখন বলছিলে তখনই আমি বুঝেছি সৌরভ। তুমি তোমার বাবার মতো দক্ষ নও; কিন্তু তোমার কল্পনা বড় সুন্দর, মোহময়। তুমি আমার সঙ্গে কাশ্মিরে ডাল লেকের হাউসবোটে রাত কাটানোর কথা বলেছ, আমি শরীর-মনে সেটা অনুভব করেছি। খুব ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফচূড়ায় সূর্যোদয়ের লাল রং এসে পড়ে, তখন ছোটবেলাকার সেই স্যাকারিন দেওয়া কাঠি-আইসক্রিমের মতো লাগে … এই কল্পনার ঘোর তুমি আমার চোখে ছড়িয়ে দিয়েছ। দার্জিলিংয়ের প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাঁটু পর্যন্ত বুট জুতা আর ওভারকোট পরে আমরা দুজন একে অপরের মাথায়-মাথা আর কোমরে হাত জড়িয়ে রেখেছি …। ভালোবাসা না থাকলে এভাবে কল্পনা করা যায় না।

– এসব তোমাকে বলেছি, কিন্তু আমি তো পারব না।

– একটা চাকরি গেল, আর অমনি মনে হলো পারবে না? এত্তবড় জীবন …। নিশ্চয়ই পারবে। দুজনে মিলে পারব। আর যদি না-ও পারো, এই যে কল্পনা … এটা তো মূল্যহীন হয়ে গেল না।

– আমি তোমাকে ঠকিয়েছি অদিতি।

– ঠকাতে চাইলে তুমি ফিরে আসতে না। কিছু মিথ্যা আছে সত্যের চেয়েও সুন্দর। সেই মিথ্যা সবাই বলতে পারে না। তুমি পারো, কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি অদিতির দিকে। এ-কথা সত্য, আমি অদিতিকে ভালোবাসি। কিন্তু তারচেয়েও হয়তো নির্মম সত্য, আমি তাকে অজস্র মিথ্যা বলেছি। আমাকে কী করে এতটা বিশ্বাস করতে পারছে মেয়েটা।

– তুমি ভাবছ তোমাকে এতটা বিশ্বাস করছি কী করে তাই না?

– আশ্চর্য, তুমি কি আমার মনের কথাও পড়তে পারো আজকাল?

– নিশ্চয়ই, ভালোবাসা মানে তো একে অন্যের মনের কথা পড়তে শেখা। খোঁজ নিয়ে দেখো তোমার বাবাকে বিয়ে করেছেন যে ডিভোর্সি ভদ্রমহিলা, কী যেন নাম বলেছিলে … বিপাশা, বিপাশা সাহা। তিনি হয়তো তোমার বাবার মিথ্যাগুলো সব ধরতে পারেন। জেনে-বুঝেই একসঙ্গে আছেন, আমার তো ধারণা তিনি সেটা উপভোগও করেন।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি অদিতির দিকে। মিথ্যাও উপভোগ্য হতে পারে! ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে ডিসেম্বর মাসের মিঠেকড়া রোদ এসে পড়েছে ঘরে। কলাতলী এলাকায় এই ফ্ল্যাট থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। তবে জোয়ারের সময় তার গর্জন শোনা যায়। এখন জোয়ার। আমি উঠে অদিতির পাশে গিয়ে বসলাম। মুখ ফিরিয়ে জানালায় চোখ রেখে আকাশ দেখতে লাগল সে। আমি তার হাত দুটো চেপে ধরলাম। এবার আমার অনুতপ্ত চেহারার দিকে তাকাল অদিতি, চোখের কোণটা চিকচিক করছে তার, বলল, আই লাভ ইউ, ডিয়ার লায়ার।