মৈত্রেয়ী দেবী (১৯১৪-৯০) এত রক্ত কেন? নামে একটি বই লিখেছিলেন, সে-বই কলকাতায় প্রকাশ পায় ১৯৮৫-এর আগস্টে। রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) রাজর্ষি (১২৯৩) আখ্যানে হাসি নামের একটি ক্ষুদ্র বালিকা মন্দিরে পশুবলির ‘রক্তস্রোতের রেখা’ লক্ষ করে সবিস্ময়ে রাজাকে প্রশ্ন করে, ‘এত রক্ত কেন!’ এই প্রশ্ন রাজার মনেও জাগে অভিন্ন কাহিনির ভিন্ন প্রেক্ষাপটে – রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন (১২৯৭) কাব্যনাটকে। এখানে মন্দিরে বলির রক্তদর্শনে ব্যথিত-বিমর্ষ রাজার কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘এত রক্ত কেন’ – ‘এত ব্যথা কেন’! প্রাণিহত্যার এক হৃদয়হীন নির্মম প্রথার বিপক্ষে মানবিক প্রতিবাদের চেতনাই মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর গ্রন্থনাম হিসেবে গ্রহণ করেছেন – যে-পটভূমিতে এই বইটি রচিত সেখানেও মানবরক্তের ধারা একটি শ্যামল দেশের মাটিকে রঞ্জিত করেছে। তাই ভিন্ন তাৎপর্যে সার্থক এই নামকরণ।
কেন এই বই সে-কথা বইয়ের ‘ভূমিকা’ থেকে জানা যায় – সেখানে তিনি উল্লেখ করেন :
১৯৭১ সালের ঘটনা, ১৯৮৩ সালে লিখতে শুরু করেছি। … যখন ঘটনাগুলি ঘটছিল তখনই ভেবেছি এ বিষয়ে আমার সমস্ত অভিজ্ঞতা লিখব। লেখা হয়নি। ভালই হয়েছে। যে দূরত্ব থেকে সত্যকে স্পষ্ট দেখা যায় – সেই দূরত্বে না গিয়ে লিখলে তার অভাবে রচনা সত্য-ভ্রষ্ট হত। তখন আমার আবেগই সত্যকে চালিত করত। … বইটা … অসম্পূর্ণ। কিন্তু অসম্পূর্ণ হলেও তখনকার একটা মোটামুটি ইতিহাস রয়ে গেল। পরবর্তী বংশধরেরা পড়ে অন্ততঃ কিছুটা জানতে পারবে যে, ভারত সরকার ও ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয়েরা 888sport appsের বেদনাকে, যন্ত্রণাকে কতখানি নিজের করে নিয়েছিল।১
স্পষ্টতই বোঝা যায়, এ-বই মূলত 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে। তবে এই কাহিনি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের সময়কাল ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। সেই সূত্রেই মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর (১৯২০-৭৫) সাক্ষাৎ ও আলাপ এবং তাঁর মর্মান্তিক নিধনের উল্লেখ।
দুই
রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ সঙ্গ-সান্নিধ্য মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনকে এক স্বতন্ত্র বিশ্বাস-আদর্শে গড়ে ওঠার প্রেরণা জোগায়। এক-অর্থে রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ‘জীবনদেবতা’। প্রখ্যাত দার্শনিক ও রবীন্দ্রানুরাগী জনক শিক্ষাবিদ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের (১৮৮৭-১৯৫২) প্রভাবে স্নাত হয়েছেন জীবনের প্রথম পর্বে। মৈত্রেয়ী নিজেকে নানাভাবে নানাকাজে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন – লেখক, সংগঠক, সমাজসেবী, পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে। লেখার কথায় এলে দেখা যায় – 888sport app download apk, 888sport sign up bonusচর্চা, 888sport live-সমালোচনা, 888sport slot gameকাহিনি, এমনকি 888sport alternative link রচনাতেও মগ্ন হয়েছেন। তবে রবীন্দ্র-অনুধ্যান ও চর্চাতেই তাঁর মূল মনোযোগ নিবদ্ধ থেকেছে। কবির মৃত্যুর দুবছর পরে ১৯৪৩-এ তাঁর 888sport sign up bonusচারণার যে-বই বের হয় মংপুতে রবীন্দ্রনাথ নামে, সেই বই-ই রবীন্দ্র888sport sign up bonus ও বীক্ষণের সবচেয়ে সমাদৃত রচনা। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ এই বইটির ইংরেজি-তরজমা করেন মৈত্রেয়ী নিজেই – তার নাম দেন Tagore By Fireside। এরপরে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাংলা-ইংরেজিতে তাঁর আরো বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ পায় : কবি সার্বভৌম (১৯৫১), বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১), স্বর্গের কাছাকাছি (কবিপক্ষ ১৩৬৭), হিন্দু-মুসলমান ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৪), কুটিরবাসী রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৫), রবীন্দ্রনাথ : গৃহে ও বিশ্বে (১৩৮৩/ ১৯৭৬), Religion of Tagore (১৯৫৪),The Great Wonderer (১৯৬১, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ বইয়ের 888sport app download apk latest version), Rabindranath : The Man Behind His Poetry (১৯৭৩, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা)।
মৈত্রেয়ী দেবীর লেখালেখির সূচনা অবশ্য 888sport app download apk দিয়ে। প্রথম 888sport app download apkর বই উদিতা প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা নিয়ে, ১৯৩০ সালে। পরেও কয়েকটি 888sport app download apkর বই প্রকাশিত হয়, সেসব বইয়ের নাম : চিত্তছায়া (১৯৩৮), স্তবক (১৯৬৩), আদিত্য মারীচ (১৯৭৩), হিরণ¥য় পাখী (১৯৭৭)। এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকার বেশকিছু দেশ 888sport slot gameের সুযোগ তাঁর হয়েছিল নানা উপলক্ষে।
ন হন্যতে (১৯৭৪) তাঁর একমাত্র 888sport alternative link – এই আত্মজৈবনিক উপাখ্যান লিখে তিনি দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হন। It Does Not Die : A Romance নামে 888sport alternative linkটির ইংরেজি 888sport app download apk latest versionও প্রকাশিত হয়। ন হন্যতে এক বিধুর 888sport sign up bonusর কৈশোর-আলেখ্য, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক প্রেমিক বিদেশির নাম। এই কাহিনি অন্তরের অবিরল রক্তক্ষরণের শুদ্ধতায় অপরপক্ষের অনৃত ভাষণকেও উপেক্ষা ও মার্জনা করেছে। কম বাংলা উপাখ্যানই আবেদনে – মর্মস্পর্শের জাদুতে এমন হৃদয়গ্রাহ্য হওয়ার দাবি জানাতে পারে।
নানা বিষয়ে 888sport live ও আলোচনার আরো কিছু বই লিখেছিলেন মৈত্রেয়ী – বিধি ও বিধাতা, ঋক্বেদের দেবতা ও মানুষ, এত রক্ত কেন? (১৯৮৫) – দর্শন বা 888sport sign up bonus-আলেখ্য। উদ্বাস্তু-পুনর্বাসন নিয়ে তাঁর চিন্তার পরিচয় ধারণ করে আছে Exodus (১৯৭৪) বইটি। সম্পাদনা করেছেন : পঁচিশে বৈশাখ (১৯৪৬, রবীন্দ্রবিষয়ক রচনা-সংকলন), গান্ধীদর্শন (888sport live-সংকলন), পূর্ব পাকিস্তানের 888sport live সংকলন (১৯৭০)। নবজাতক ও Brother’s Face নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা তাঁর উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।
তিন
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলা হয়, তাঁর জীবনে একসময়ে কবির সঙ্গে এক কর্মী এসে মিশেছিল। কথাটি রবীন্দ্রদর্শনে স্নাত মৈত্রেয়ী দেবীর ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য। তাঁর লেখকসত্তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কর্মীসত্তা। মৈত্রেয়ীর বিবেচনায় এলো সমাজ – সমাজের কাজে নিজে যুক্ত হলেন, সঙ্গে টেনে আনলেন কর্মস্পৃহ সমমনা বন্ধু ও অনুরাগীদের।
জাত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে মানুষকে 888sport apk download apk latest version ও ভালোবাসা এবং তার দুর্দশা-বিপন্নতায় তার পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বেদনাবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে যায়। এই দাঙ্গা তাঁকে গভীরভাবে পীড়িত করে – লাঞ্ছিত মানবতার সংকটে বিচলিত হন। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রেরণা জোগায় ‘কাউন্সিল ফর প্রমোশন অফ কমিউনাল হারমনি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলায় – সাহস ও প্রেরণা নিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২), পান্নালাল দাশগুপ্ত (১৯০৯-৯৯), বিচারপতি এস.এ. মাসুদ, গৌরকিশোর ঘোষ (১৯২৩-২০০০), গৌরী আইয়ুব (১৯৩১-৯৮) এবং সেইসঙ্গে মুক্তবুদ্ধির উদার মনের আরো কিছু লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী। নবজাতক নামে একটি দ্বিমাসিক পত্রিকার জন্ম হয় এই কর্মকাণ্ডেরই সূত্র ধরে। স্বল্পজীবী Brother’s Face পত্রিকাটিও একই উদ্দেশ্যে প্রকাশ পায়।
এর সাত বছর পরে শুরু হয় স্বাধীন 888sport apps রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ববঙ্গের বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রেয়ী দেবীর কর্মকাণ্ড হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। প্রথমে শরণার্থীদের জন্যে আশ্রয়শিবির নির্মাণ – তাদের অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সহায়তা-দান, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বেশকিছু লেখক-888sport live chatী-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীর আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা, তাঁর গৃহে স্থাপিত ছাপাখানায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারণার নানা কাগজপত্র এবং সেইসঙ্গে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী 888sport apps সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্যদলিল মুদ্রণ, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্যে মাঝেমধ্যে প্রশিক্ষণ-শিবিরে গমন, মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্যে কখনো কখনো মুক্তাঞ্চল সফর, 888sport apps সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি-মুক্তিযোদ্ধা ও পদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ-রক্ষা। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী শিবিরের অনাথ শিশুদের লালন-পালন-তত্ত্বাবধানের জন্যে তিনি ‘খেলাঘর’ নামে একটি আশ্রম গড়ে তোলেন – প্রথমে কল্যাণী এবং পরে মধ্যমগ্রামে। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘খেলাঘর’ আন্তর্জাতিক মনোযোগও লাভ করেছিল। সমাজহিতের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
একজন মানবতাবাদী সমাজকর্মী হিসেবে 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সমর্থন পেয়েছিল এবং বিতাড়িত ছিন্নমূল অসহায় মানুষ অর্জন করেছিল তাঁর সাহায্য ও সহানুভূতি। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর ও তাঁর পূর্বপুরুষের ছিল নাড়ির বন্ধন। তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল বরিশালের গৈলা গ্রামে। পিতা ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের জন্ম তাঁর পিতার কর্মস্থল কুষ্টিয়া শহরে, শৈশবও কেটেছে এই শহরে। মৈত্রেয়ী দেবী জন্মেছিলেন অধ্যাপক-পিতার পেশাস্থল চট্টগ্রামে – প্রথমে তাঁর শৈশবের অনেকগুলো বছর কাটে চট্টগ্রামে এবং তারপরে গৈলা গ্রামে পূর্বপুরুষের ভিটেতে। তাই মৈত্রেয়ী দেবীর মনে পূর্ববঙ্গ ও তার মানুষের প্রতি একটি আলাদা অনুরাগ, আকর্ষণ ও 888sport sign up bonusকাতরতা থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
চার
এত রক্ত কেন? বইয়ের শুরুতেই মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছেন, ‘অনেক দিন ধরে ভাবছি ১৯৭১ সাল অর্থাৎ যে বছর 888sport appsের জন্ম হল সেই বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়ে কিছু লিখব।’ এই ‘অভিজ্ঞতা’ ‘এত বিচিত্র’ ও ‘অকল্পনীয়’ এবং এর ‘আস্বাদ এত অভূতপূর্ব’ যে তা লিখে প্রকাশ করা দুরূহ। তবুও অনুভূতির গাঢ়তা ও অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যে ১৯৭১-এর ঘটনাপ্রবাহ তাঁর লেখনীতে আন্তরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য ‘888sport appsের জন্মের ইতিহাস’ তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকাশ করতে গিয়ে পটভূমি স্পষ্ট করার প্রয়োজনে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এই আলোচনায় অনিবার্যভাবে এসেছে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, দেশভাগ, দুই বঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে বিভক্ত বঙ্গের পূর্বাংশ শুরু থেকেই অসুখী ছিল – ভাষার প্রশ্নে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে। বাঙালির ভাষা-আন্দোলনকে পূর্ববঙ্গের ‘নবজাগরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, ‘যার ফলে 888sport appsের জন্ম’ হয়। এক-অর্থে পাকিস্তানের ‘উপনিবেশ’ পূর্ববঙ্গে ভাষা-888sport live football-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে-পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, বাঙালিত্বের যে-সাধনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল তা মুক্তবুদ্ধির লেখকদের রচনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মৈত্রেয়ী দেবীর উপলব্ধিতে তা এইরকম :
888sport appsের অভ্যুদয়ের সম্ভাবনায় আমরা যে উৎসাহ পেয়েছিলাম সেটা প্রধানতই আবুল ফজল, বদরুদ্দিন [বদরুদ্দীন] উমর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কাজী মোতাহার হোসেন প্রভৃতির লেখা থেকে। আমরা যে চিন্তাধারার আভাস পেয়েছিলাম তাতে সন্দেহ ছিল না যে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তরের মধ্যে যে শুভ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া আমাদের একান্ত প্রয়োজন শুধু নয়, গৌরবের কথাও হবে। বিশেষ করে আমার আনন্দ ছিল এই যে একটা দেশের বিপ্লবী চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ এতটা প্রাধান্য পেলেন। পাকিস্তানের মুসলমান রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গানে চিন্তায় সম্প্রদায়ের বেষ্টন থেকে, মোল্লা শাসনের বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখতে পেলেন। মুক্তির জোয়ার এল রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন ধরে।…২
এই বক্তব্যের সূত্র ধরে মৈত্রেয়ী যে-মন্তব্য করেছিলেন – ‘…পূর্ব-পাকিস্তানের মর্ম থেকে 888sport appsের অভ্যুদয়ের সম্ভাবনায় আমরা যে উৎসাহ পেয়েছিলাম তার মধ্যে কোন ছলনা ছিল না’৩ – এই কথা প্রায়-সর্বজনীনভাবে সত্য পশ্চিমবঙ্গের উদারচিত্ত ও বাঙালিত্বের চেতনায় প্রাণিত মানুষের ক্ষেত্রে। মৈত্রেয়ী তাঁর নবজাতক পত্রিকার মাধম্যে 888sport live football-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমিত সাধ্য ও পরিসরে সখ্য ও সৌহার্দ্যরে সেতু-রচনার চেষ্টা করেন – এই যোগাযোগ ও ভাববিনিময় একেবারে নিষ্ফল হয়নি। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রেয়ী দেবীর আন্তরিক সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপট এইভাবেই রচিত হয়েছিল।
পাঁচ
একাত্তরের মার্চ মাসের শুরু থেকেই 888sport appর খবর আসছিল কলকাতায় – লোকমুখে, রেডিয়োয়, খবরের কাগজে সেসব খবর চাউর হতে সময় লাগেনি। পাকিস্তানের সামরিক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ঘোষিত অধিবেশন যখন মার্চের তিন তারিখে কোনো কারণ ছাড়াই স্থগিত করেন, তখন সকলের মনেই জেগে ওঠে – রাজনৈতিক মহাসংকট আসন্ন। সাতই মার্চ নির্বাচন-বিজয়ী 888sport free betগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন 888sport appর রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ – তখন আর অস্পষ্ট রইলো না কী ঘটতে যাচ্ছে। এরপর শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন – আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পূর্ববঙ্গের মানুষের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক বিচ্ছেদের পটভূমি তৈরি হয়ে গেল। বাঙালি তখন এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত, আপস বা প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ আর খোলা থাকে না। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের আঠারো দিনের মাথায় পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাক-সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে – তবে আটক হওয়ার আগ-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু 888sport appsের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রাণবন্ত 888sport app শহরকে মৃতের নগরীতে পরিণত – পাক-সেনা গণহত্যার নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে – সেই পৈশাচিক বর্বরতার বিবরণ প্রদানে ‘হৃদয় ব্যথিত, চিত্ত অবসন্ন’ হয়ে পড়ে।
পরের দিন এই খবর প্রকাশ পায় কাগজে-কাগজে – এর প্রতিক্রিয়া কলকাতার বাঙালি সমাজে কেমন হয়েছিল তার বিবরণ দিয়েছেন মৈত্রেয়ী দেবী :
২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সালে কাগজে 888sport appর হত্যাকাণ্ডের বিবরণী প্রকাশ হলে, পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারত স্তম্ভিত হয়ে যায়। … লেবাননের জন্য, আরবদের জন্য, পলপটের রাজত্বে লাওসিয়ানদের জন্য যে রকম দুঃখ হয় ততটুকুই, মানুষ অত্যাচারিত হলে অন্য মানুষদের ব্যথা লাগবেই। কিন্তু 888sport appsে বাঙালীর ওপর অত্যাচার হলে, সেদিন যা হয়েছিল সে অন্য রকম। পাকিস্তানীদের সে গুলিবর্ষণ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর বুকেও এসে লেগেছিল। ২৬ তারিখে রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটে অন্য বিষয়ে সেমিনার ছিল। সেখানে বিদগ্ধজন উপস্থিত থাকবেন। যাচ্ছি, কিন্তু যেতে পা উঠছে না। অন্য কোন সমস্যা যেন আর মনেই নেই। সভাস্থলে পৌঁছে দেখি সকলেরই এক অবস্থা। নির্ধারিত বিষয় কোথায় উড়ে গেল, 888sport appsের সমস্যাই আলোচিত হতে লাগল উত্তেজিতভাবে। যেন এখনই আমাদের কিছু করা উচিত।৪
888sport appর এই নৃশংস-নির্মম গণহত্যা কলকাতার 888sport appsপ্রেমী, উদার ও মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ মানুষকে বিচলিত, ভারাক্রান্ত, আবেগাপ্লুত, উত্তেজিত করে তুলেছিল। এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্যে অনেক মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ও উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। মৈত্রেয়ী দেবীর সূত্রে জানা যায় – এ-বিষয়ে খুব বিচলিত হয়েছিলেন তাঁর কাছের মানুষ ও কর্মসঙ্গিনী গৌরী আইয়ুব। তিনি টেলিফোন করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেন : ‘ওরা পড়ে পড়ে মার খাবে আর আমরা বসে বসে দেখব?’ এই কথার মধ্যে গভীর বেদনা ও সহানুভূতিবোধ জড়িয়ে আছে। অতি দ্রুততম সময়ে বিবেকী মানুষেরা সংগঠিত হলেন – সেই বিবরণ মেলে মৈত্রেয়ী দেবীর রচনায় :
দুদিন বাদ দিয়ে ২৮শে মার্চ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ’ মিটিং ডাকল। সভাগৃহে লোক উপচে পড়ছে। অত অল্প সময়ের মধ্যে অত লোক দেখে বুঝলাম এই বাংলা দেশের চিত্তও কিরকম মথিত হয়ে উঠেছে। সেদিন আমাদের আমন্ত্রণে যাঁরা যাঁরা এসে বক্তৃতা করেছিলেন, তার মধ্যে অমøান দত্তের বক্তৃতা আমার সবচেয়ে মনে আছে। … অমøান বললেন, “কিছুদিন থেকে বাঙালী পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হচ্ছিল। আজ আমি গর্বিত। মুজিবর [মুজিবুর] রহমান আমার নীচু মাথা উঁচু করে দিয়েছেন।” সভায় আঁচল পেতে মেয়েরা কিছু অর্থ সংগ্রহ করল। … আমাদের কেবল মনে হচ্ছে, বাঙালীর এই বিপদে বাঙালীকে দাঁড়াতে হবে। সত্য বলতে কি, আমরা যে কয়জন এই কাজে অগ্রণী হয়ে ছিলাম, অর্থাৎ আমাদের এই ক্ষুদ্র দলটি – এমন করে বাঙালী বলে নিজেদের কখনো ভাবিনি। … সে সময়ে পূর্ববাংলার উচ্ছ্বাস এবং জয়বাংলার ধ্বনি আমাদের বাঙালিত্ব সম্বন্ধে দারুণভাবে সচেতন করেছিল।৫
888sport appsের মুক্তিসংগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কিভাবে আলোড়িত ও উজ্জীবিত এবং বৃহত্তর ভারতীয়ত্বের চেতনায় আচ্ছন্ন বাঙালিসত্তাকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ করে দিয়েছিল, তা বেশ বোঝা যায় মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি থেকে।
‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদে’র সভার পর থেকেই প্রবল সদিচ্ছা-সহানুভূতির জোরে সাহায্য-সহায়তার কাজ শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় মৈত্রেয়ী দেবীর গোপন ও প্রকাশ্য অভিযান। প্রথম তিনি গেলেন নদীয়ার করিমপুর সীমান্তে বি.এস.এফ-এর পি.আর.ও. সমর বসুর সঙ্গে – উদ্দেশ্য, সীমান্তের ওপার থেকে আসা মুক্তিফৌজের এক ক্যাপ্টেনের হাতে যুদ্ধের জন্যে প্রাথমিকভাবে জরুরি কিছু অসামরিক উপকরণ যেমন টর্চ, ব্যাটারি, জুতো ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। এই কমান্ডারের কাছে তাঁরা পাক-বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের খাঁটি খবর শোনার সুযোগ পান।
দিনে দিনে মৈত্রেয়ী দেবীর নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদে’র কাজের বহর বাড়তে থাকে। মহা উদ্দীপনা ও সমারোহে ‘সম্প্রীতি পরিষদে’র সদস্য ও সহযোগীরা যুক্ত হন কাজে। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িই হয়ে ওঠে এই কর্মকাণ্ডের প্রধান ঠিকানা – শুধু পরিবারের লোকজনের থাকা-শোয়ার ঘর ছাড়া আর সবই দখল হয়ে যায় এই কাজের জন্যে। প্রত্যহ ভিড় জমতে শুরু করে শরণার্থী লেখক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু তরুণ, সরকারি-সামরিক-অসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং সেইসঙ্গে কিছু সন্দেহভাজন ও সুবিধালোভী মানুষেরও। প্রতিদিন করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে ‘সম্প্রীতি পরিষদে’র সভা-শলা-পরামর্শ এবং পূর্ববঙ্গ থেকে আগত নানা মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। এই জমাট পরিবেশ ‘উৎসব’-এর মেজাজ তৈরি এবং সেইসঙ্গে এই উদ্দীপনা আশাবাদ জাগিয়ে তোলে – ‘এক দিকে এত যন্ত্রণার খবর, গৃহচ্যুত, পথশ্রান্ত মানুষদের, অন্যদিকে কি বিপুল উৎসাহ – বাংলার জয় হবেই – “জয় বাংলা”।৬
অল্পদিনেই মৈত্রেয়ী-নিবাস ছোটখাটো বুদ্ধিজীবী-শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়। বাড়ির লাগোয়া তাঁর বড়ো স্কুলবাড়িটার ‘ঘরে ঘরে কার্পেট বিছিয়ে তার ওপরে চাদর দিয়ে ঢালা বিছানা’য় জন-পঞ্চাশেক লোকের থাকার ব্যবস্থা হয়। আর খুব ঘনিষ্ঠ শরণার্থী মেয়েরা মাঝেমধ্যে এসে মূল বাড়িতে মৈত্রেয়ীর সঙ্গেই থাকতেন। কখনো কখনো লেখক-888sport live chatী-রাজনীতিকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে আড্ডা জমাতেন – যেমন 888sport live chatী কামরুল হাসান বা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বা চিত্রনায়িকা ববিতা। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আসতেন প্রয়োজনীয় কাজে, তাঁর কোনো অবসর ছিল না আড্ডা দেওয়ার বা দু-দণ্ড বসে সুখ-দুঃখের কথা বলার। মৈত্রেয়ী দেবীর আবাসিক শরণার্থী শিবিরে একদিন এসে ওঠেন খ্যাতিমান live chat 888sportনির্মাতা ও লেখক জহির রায়হান। এই শিবিরে দু-একজন ভদ্রবেশী তস্করও যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, অচিরেই তা বোঝা গেল জহির রায়হানের মূল্যবান ফিল্মের রিল ও মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ চুরি যাওয়ার ঘটনায়।
পূর্ববঙ্গের কিছু উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মানুষের আচার-আচরণ ও মনমানসিকতা মৈত্রেয়ী দেবীকে খুশি করতে পারেনি। এঁদের দেশপ্রেম ও ত্যাগের মনোভাব সম্পর্কে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ‘বিলাসিতায় অভ্যস্ত’ এই ব্যক্তিবর্গ – কেউ আমলা, কেউ অধ্যাপক, কেউ ব্যবসায়ী-888sport live chatপতি, কেউবা রাজনীতিবিদ – অ্যাটাচ্ড বাথরুম ছাড়া থাকবেন না, কম আলোর বাড়ি চলবে না, এই ধরনের বায়নাক্কা তাঁদের। আবার একজন শরণার্থী-অধ্যাপক কাতর ও কুণ্ঠিত হন পরনের স্যুট ছাড়া ওয়াড্রোব-ভর্তি স্যুট ফেলে আসতে হয়েছে বলে। এক কূটনীতিক সীমান্তে রাত্রিযাপনের জন্যে নাইট গাউন নিতে না-পারায় যাত্রা বাতিল করেন। 888sport appsের মর্যাদাবান, প্রভাবশালী ও উচ্চশিক্ষিত বাঙালি যাঁরা সপরিবার কলকাতা ও দিল্লিতে আশ্রয়লাভের বিশেষ সুযোগ পেয়ে ‘রাজার হালে’ ছিলেন – সীমান্তে শরণার্থী-সমস্যা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। এইসব বেশরম ‘সাহেব’-বাঙালি সম্পর্কে তিতিবিরক্ত হয়ে মৈত্রেয়ী দেবী যে ‘পরের দেশে এসে বিপ্লব করতে গিয়ে খাওয়া শোওয়া নিয়ে এত খুঁত-খুঁতানি’র মানসিকতাকে ভর্ৎসনা করেছেন, তা খুবই খাঁটি প্রতিক্রিয়া।
ছয়
ঘরোয়া বৈঠকের পর্ব শেষ করে মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর ‘সম্প্রীতি পরিষদে’র সহকর্মীদের নিয়ে একসময় বেরিয়ে পড়েন সীমান্তের পথে – সাতক্ষীরায়। তখনো মনে স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠতে পারেনি, তাঁদের কাজের ধারাটা কেমন হবে – সে-ছকটাও ঠিকমতো আঁকা হয়নি – কাজের ভাবনাটা দানা বাঁধেনি। মৈত্রেয়ী জানিয়েছেন :
কিন্তু ঠিক কি ভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হতে পারব তা ঠিক করতে পারছিলাম না। তবে সীমান্তে গিয়েই যে কিছু করতে হবে এটা মোটামুটি ঠিক হয়েছিল। তাই এবার বেনাপোলের দিকে যাওয়া ঠিক করলাম, এপ্রিল মাসে ১৯৭১ সালের দুই কিংবা তিন তারিখে আমরা রওনা হলাম।…৭
এবারের গন্তব্য বনগাঁ হয়ে বেনাপোল স্পর্শ করে বাইশ মাইল দূরের বয়রা গ্রাম। এতোটা দূরে মৈত্রেয়ী দেবীদের রিলিফ ক্যাম্প করতে হবে – কারণ, আগেই ভারত সেবাশ্রম সংঘ কাছে-দূরে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছে বয়রার আগের গ্রাম পর্যন্ত – আর, বয়রা গ্রামটি মধুসূদনের 888sport sign up bonusবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের ধারে অবস্থিত – এখানে তরুণ ছেলেদের একটি ক্লাবও আছে, ক্যাম্পের কাজেকর্মে তাদের সহায়তা পাওয়া যাবে।
নানা অসুবিধা-অব্যবস্থা-যোগাযোগসংকট সত্ত্বেও এখানেই – এই বয়রা গ্রামেই ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদে’র উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় – গ্রামের ‘উদয়ন ক্লাব’-এর তরুণেরা এই কাজে বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে অংশ নেয়। তারা জানায় : ‘…ওদের ওষুধ দরকার, ডাক্তার দরকার, একটা গাড়িও দরকার। দু’চারদিন অন্তর ওপার থেকে আহত মানুষ আসছে। তাদের অন্তত First aid দিয়ে বনগাঁ পাঠাতে তো হবে।’৮ অবশেষে কলকাতা থেকে ডাক্তার এলো, ওষুধপত্র এলো, আরো-আরো ত্রাণসামগ্রী এলো মৈত্রেয়ী দেবী ও সহকর্মীদের আন্তরিক চেষ্টায় – ক্যাম্প গুছিয়ে তোলার কাজে নিজেরা হাত লাগালেন। ত্রাণসামগ্রী আসার বিরাম নেই – চাল-ডাল-তেল-নুন, শিশুখাদ্য, জামাকাপড়, চাদর-কম্বল, ওষুধপত্র। মৈত্রেয়ী কিছুটা আবেগেই লিখছেন :
২৫শে মার্চ 888sport appsের কামান চলল, ট্যাংক চলল আর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সারা পশ্চিমবঙ্গ সাহায্য ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে উদ্যত। এ সাহায্য শুধু জিনিসপত্র দেওয়া নয়, হৃদয় দেওয়া।৯
কলকাতা থেকে যথেষ্ট দূরত্ব সত্ত্বেও বয়রা ক্যাম্পের সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ ছিল। ঘন ঘন কলকাতা-বয়রা যাতায়াত করতেন – বয়রাতে প্রায়ই থেকেও যেতেন দিন-কতকের জন্যে। বয়রা ছিল প্রাণের ভয়ে নিগৃহীত দেশত্যাগী পূর্ববঙ্গবাসীর ভারতে আসার অন্যতম পথ। তাই মৈত্রেয়ী খুব কাছ থেকে উৎপীড়িত শরণার্থী-আগমন ও পাক-সেনার বর্বরতায় আহতদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেতেন। একদিনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন :
… প্রতিদিনই ওপার থেকে আহত মানুষরা আসতে লাগল। আর শরণার্থীর স্রোত ক্রমেই তীব্রগতি লাভ করল।
এই রকম একটা দিনে কিছু জামাকাপড় নিয়ে বয়রা গেলাম। সেদিন জনস্রোত ঢুকছিল। দলে দলে লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসছে। বাঁশের স্ট্রেচারে করে আহতদের আনছে। একটি গুলিবিদ্ধ মানুষকে এনে সেই ভাঙা বাড়ির বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হল। তার ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, কিন্তু ওখানে রক্ত দেবার ব্যবস্থা ছিল না। সে এত দুর্বল যে তাকে বনগাঁয়ের হাসপাতালে সরানো যাবে না। … এই লোকটির কোনরকম কষ্টের অভিব্যক্তি ছিল না। শুধু একটা মরা চোখে তাকিয়ে ছিল। সে দৃষ্টি নিষ্পলক, সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। আমরা তার শুশ্রƒষা করতে চেষ্টা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টার পরে সে মারা গেল।১০
মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে কপোতাক্ষ-তীরের এক নিভৃত ও প্রত্যন্ত পল্লি বয়রার সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর পরিচয় ও সখ্য। মুক্তিযুদ্ধের শেষে ক্যাম্প উঠে গেলে এ-গ্রামের সঙ্গে তাঁর চির-বিচ্ছেদ ঘটে – কিন্তু তাঁর 888sport sign up bonusতে রয়ে যায় গ্রামটির প্রাকৃতিক পরিবেশের রূপ-রসের চিহ্ন। মৈত্রেয়ীর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনায় পাই :
বয়রার কথা বারবার মনে পড়ে। এত ভীড় বেড়ে উঠবার আগে জায়গাটা কি সুন্দরই না ছিল – বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায়। তির তির করে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষর জল। বড় বড় গাছগুলোর মধ্যে জোনাকি জ্বলছে, থোকা থোকা পাতার ঘন অন্ধকারের মধ্যে আলোর চমক। একটা উঁচু টিলার উপরে বি.এস.এফ-এর ক্যাম্প, সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে বসতাম। ওপারে 888sport appsে সন্ধ্যাবেলা গ্রামের মধ্যে ছোট ছোট আলো জ্বলে উঠত। যেন এ পারের জোনাকির সঙ্গে আলোর ভাষায় কথা কইছে।১১
সাত
কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মৈত্রেয়ী দেবী ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদে’র উদ্যোগে মার্চের শেষদিকেই কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেই কাজের পরিধি বাড়তে থাকে এবং সেইসঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগও। পূর্ববঙ্গের পরিচিত বা অপরিচিত নানা অঙ্গনের মানুষ, এমনকী 888sport apps সরকারের প্রতিনিধিরাও তাঁর সহায়তাপ্রার্থী হন। যেমন রাজশাহী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক নদী পেরিয়ে ‘একবস্ত্রে বহু মাইল চরের ওপর দিয়ে হেঁটে’ ভারতে প্রবেশ করেন এবং মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে আশ্রয় চান, তেমনি 888sport appsের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ‘কাছ থেকে একটি ব্যক্তি একটা ঘরের সন্ধানে’ মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে আসেন – ঘরের সুরাহা হয় – ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এসে প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদ জানিয়ে যান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম, পরে 888sport apps সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান, তিনি বিদেশে যাবেন, অতি-দ্রুত তাঁর পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে হবে – সেই দায়ও মৈত্রেয়ী দেবীর। তা তিনি সেই কাজ করেও দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে কিছু শিক্ষিত সুবিধাবাদী লোক তাঁকে নানাভাবে বিভ্রান্ত ও ব্যবহার করেছিলেন – ‘জাকেরিয়া’ ও ‘ওবেদ’ – এই দুজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন – অধ্যাপক নুরুল ইসলামও হয়তো সাময়িকভাবে এদের খপ্পরে পড়েছিলেন। পূর্ববঙ্গ থেকে উপদ্রুত ‘শিক্ষিত, তথাকথিত ইন্টেলিজেনসিয়া’ যাঁরা কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে মৈত্রেয়ী দেবীর সহায়তা পেয়েছিলেন। কী আন্তরিক শ্রম ও সময় তাঁকে দিতে হয়েছে তার কতটুকুই বা তিনি লিখে প্রকাশ করতে পেরেছেন!
888sport appsের মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রেয়ী দেবীর কাজের ধারা ছিল বিচিত্র। তাঁর বাড়ির নিচতলায় একটি ছাপাখানা ছিল, মূলত তাঁর পত্রিকা নবজাতক ও সংগঠনের নানা কাজের জন্যে। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের বাঙালি জনসংযোগ অধিকর্তা সমর বসু ওই প্রেসে 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ‘কতগুলো গোপনীয় কাগজপত্র’ ছাপার প্রস্তাব দেন মৈত্রেয়ী দেবীকে – সেইসঙ্গে কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন : ‘আমরা একটি প্রেস খুঁজছি, যেখান থেকে কখনও কথা বেরুবে না।’ মৈত্রেয়ী সাগ্রহে ও সানন্দে রাজি হন এবং গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই ‘গোপনীয়’ লেখাটি যথারীতি কম্পোজের পর বৈঠকখানায় বসে মৈত্রেয়ী যখন প্রুফ দেখছেন, হঠাৎ তখন খেয়াল করেন ‘সামনে ছিপছিপে সুন্দর চেহারার একটি অল্পবয়সী ছেলে’। খুবই অপ্রস্তুত হয়ে প্রুফের কাগজ দ্রুত কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চান। নাটকীয় ভঙ্গিতে যুবক জবাব দেন :
আমার নাম মহম্মদ আলি। যে কাগজটা লুকিয়ে রাখলেন ঐটা চাই। ওটা একটু সংশোধন করতে হবে। তাজউদ্দিন সাহেবের স্পিচ। আমি তাঁর চীফ এইড। সেটা স্বাধীন বাংলার উদ্বোধনের সময় পড়া হবে।১২
কিন্তু সতর্ক মৈত্রেয়ী দেবী অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে এ-বিষয়ে কোনো আলোচনা করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তখন ‘অপরিচিত’ যুবক তাঁর পরিচয়ের রহস্য উন্মোচন করেন, দাড়ি কামিয়ে ফেলার জন্যে মৈত্রেয়ীও তাঁর পরম প্রীতিভাজন মহম্মদ আলি ছদ্মনামের ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সহজে চিনতে পারেননি। 888sport apps সরকারের পক্ষে এই ছদ্মনামধারী মহম্মদ আলিই বি.এস.এফ-এর সমর বসু ও ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদে’র মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
মৈত্রেয়ী দেবীর ছাপাখানা 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে অত্যন্ত সুচারুভাবে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত নানা পুস্তিকা-ভাষণ-প্রচারপত্র ছাপা হয়। মৈত্রেয়ী দেবীর সূত্রে জানা যায় :
এইভাবে আমার প্রেসে 888sport appsের প্রয়োজনের প্রচুর ছাপার কাজ হতে পাগল। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস ছাপা হল আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো। এ সমস্ত কাগজপত্র আমীরুল (ছদ্মনামে মহম্মদ আলি) নিয়ে আসত। 888sport appsের ম্যাপও ছাপা হয়েছিল। এতো গোপনীয়তার কারণ (এখন আর গোপনীয়তার অর্থ নেই) … তখন আমাদের সরকার চেষ্টা করছিলেন যেন পৃথিবীতে কেউ না টের পায় যে আমরা 888sport appsকে সাহায্য করছি।১৩
এই যে 888sport appsের মানচিত্র, তা ভারত সরকারের রিলিফ বা মুক্তিযুদ্ধের কাজেও বিশেষ প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়।
আট
পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্যে মৈত্রেয়ী দেবীর কী গভীর উৎকণ্ঠা ও মমত্ববোধ ছিল তা তাঁর কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দিনের পর দিন তিনি পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলের শরণার্থী শিবিরে গেছেন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে – তাদের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বাসনায় – এই পরিক্রমণ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে নেশার মতো। বলেছেন তিনি :
এই সময়ে সীমান্তের শিবিরগুলিতে আমি প্রত্যহ যেতাম। অনেক কাজ থাকত। … তবে আমার বয়সী সহকর্মীরা কেউই রোজ যেতে পারতেন না। … তাই বেশ কিছু অল্পবয়সী স্বেচ্ছাসেবী জুটিয়ে নিয়েছিলাম। অনেক সময় যাকে হাতের কাছে পেতাম সঙ্গে নিয়ে যেতাম। এই সময় কবি স্বর্গীয় জীবনানন্দ দাশের কন্যা মঞ্জু আমার সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন।১৪
সীমান্তে কেন যেতেন, সেই কথায় তিনি জানান – ‘কোন অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে টানত’। কেন টানতো তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন – অসংখ্য মানুষের ‘অসীম দুর্গতি’ তাঁকে বিচলিত করেছিল, তাই তাদের জন্যে কিছু করার আকাক্সক্ষা ও প্রেরণা তাঁর মনে জেগেছিল।
একাত্তরের মাঝামাঝি মৈত্রেয়ী দেবীর মাথায় আসে বিভিন্ন ক্যাম্পে স্কুল খোলার চিন্তা। এ-বিষয়ে খ্রিষ্টান মিশনারিরা শুধু উৎসাহই নয়, সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন – সঙ্গে সঙ্গেই কিছু শিক্ষা-উপকরণ পাওয়া যায়। ক্যাম্পে এই স্কুল করার ও মেয়েদের সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ-শেখানোর পেছনে তাঁর চিন্তার মূলে ছিল এই উদ্দেশ্য :
প্রতি ক্যাম্পে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে উলঙ্গ ও অর্ধ-উলঙ্গভাবে মাঠে মাঠে পথে পথে ধুলোয় কাদায় উদ্দাম হয়ে ঘুরছে। এদের একটা জায়গায় একত্র করে কোণে কোণে ব্লাকবোর্ড রেখে একটু পড়ানো বা শান্ত করে রাখা এই ছিল সে স্কুলের অর্থ। আর শিবিরে শিবিরে মহিলাদের মধ্যে সেলাই-এর চর্চা করে একটু মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনা, সামান্য পড়াশোনা করানো।১৫
কিন্তু এই চিন্তা বাস্তবায়নের মুখেই নতুন একটি প্রস্তাব বিবেচনার জন্যে সমুখে আসে ‘অনাথ ও স্থানচ্যুত ছেলেমেয়েদের জন্য’ আলাদা একটি ক্যাম্প করার। এই হলো ‘খেলাঘর’ শিশুনিবাস গড়ে তোলার সলতে পাকানোর পর্ব।
নয়
শরণার্থী শিশুদের নিয়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার ধারণা মৈত্রেয়ী দেবী ও তাঁর প্রিয় সহকর্মীদের কাছে সাদরে গৃহীত হয়। এতে সরকারি আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং খ্রিষ্টান মিশনারিদের সহায়তা ও সমর্থন উদ্যোক্তাদের উদ্যমী ও আশান্বিত করে তোলে। তবে কাজে নেমে তাঁরা বুঝতে পারেন কাজটি কম দুরূহ নয়।
নদীয়ার কল্যাণীতে একটি শরণার্থী শিবির ছিল – তার ব্যবস্থাপনা বা পরিবেশ কোনোটাই ভালো ছিল না। ওই ক্যাম্প থেকে যথেষ্ট দূরে কল্যাণীর পিকনিক গার্ডেন-সংলগ্ন পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টের পড়ে-থাকা জমিতে শিশু অনাথ-আশ্রম প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। এপ্রিল মাসের শেষে সব ঠিকঠাক হলেও ‘ক্যাম্প বাঁধা’র কাজ পিছিয়ে জুলাই মাসে গিয়ে গড়ালো। এই বিলম্বের কিছু কারণও ছিল। এ-বিষয়ে মৈত্রেয়ীর ভাষ্য : ‘… ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজের বিরাম ছিল না আমাদের। নানা কারণে ক্যাম্পে যেতে হত।’১৬
কল্যাণীতে শরণার্থী শিশুনিবাস প্রতিষ্ঠা নানা কারণে পিছিয়ে যায়। নির্ধারিত স্থানে শিশুশিবিরের কাঠামো-নির্মাণ বিলম্বিত হতে থাকে। তাই সাময়িক বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হয় :
কল্যাণীতে অনাথ-আশ্রম হবে নির্দিষ্ট হবার পরেও অনেক দেরি হতে লাগলো। তাই আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম। সেখানেই প্রথম ‘খেলাঘর’ আশ্রম খুললাম। কল্যাণীতে আরতি সেন ছিলেন। তাঁর সুন্দর বাড়িটি আমাদের খুব কাজে লাগতো, ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তিনি অনাথ বালক-বালিকা সংগ্রহ করে এনে তাদের ধুয়ে মুছে পাঁচড়ায় ওষুধ লাগিয়ে আশ্রমবাসী করে তুলতেন। কাজটা বড়ো সোজা নয়।১৭
‘খেলাঘর’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের কাজে শরণার্থী তরুণ-তরুণীরাও যুক্ত হয় – এদের মধ্যে গাইয়ে-নাচিয়ে-আঁকিয়ে ছিল – তারা আশ্রমে নাচ-গান-ছবি আঁকা শেখাতো। শিক্ষিত শরণার্থী তরুণ-তরুণীদের ভেতর থেকে স্বেচ্ছাসেবীও পাওয়া গেল। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ‘অবশেষে অন্য ক্যাম্প থেকে অনেক দূরে একটা প্রকাণ্ড লম্বা মাঠের মধ্যে … ক্যাম্প হল। বড়ো বড়ো চালাঘর, উপরে পলিথিন। জায়গাটা খুব সুন্দর, নির্জন, পরিচ্ছন্ন।’১৮ এই আশ্রমের আর্থিক দায়-দায়িত্ব ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের – পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার সহায়তা করেছিল ‘ক্যাম্প বেঁধে’ দিয়ে। এই কাজে অর্থ ও উপকরণের উদার সহযোগিতা বরাবর করে এসেছে খ্রিষ্টীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ‘খেলাঘরে’ জাতধর্মের কোনো বালাই ছিল না – ভেদমুক্ত এই উদার পরিবেশে তাই একদিন আড়াই-তিন বছরের মুসলিম-শিশু আমিনা এসে মিশে গেল সব হিন্দু ভাইবোনের সঙ্গে।
‘পরিত্যক্ত ম্যারাসমাসগ্রস্ত রিকেটে পঙ্গু’ অনাথ শিশুদের খোঁজে মৈত্রেয়ী দেবীকে মাঝেমধ্যেই নানা শরণার্থী শিবিরে যেতে হতো। এইসব শিবিরে ঘুরে ‘মানুষের দুর্দশা ও নির্মমতার ছবি’ দেখেন ও সেইসঙ্গে অর্জন করেন নানা মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা। এই অনাথ-আশ্রমের কাজে মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে পড়েন। বলেছেন তিনি :
খেলাঘর ক্যাম্প বাঁধবার পর 888sport appsের কাজের এই অংশটা আর যুদ্ধের কথা মনে করাচ্ছিল না। শিশুদের দিকে বেশী মন দিলাম। বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঁচটা স্কুল চলছিল বটে কিন্তু খেলাঘরই আমাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র হয়েছিল। আশ্রমটা শিশুদের বাসযোগ্য এবং দর্শনীয় করবার চেষ্টা করলাম। … কয়েকটা আমগাছের ঝোপের পাশে একটা গোল কুটির বানালাম। বেশ আশ্রম-আশ্রম দেখতে হল।১৯
কল্যাণীর ‘খেলাঘর’ শিশুনিবাসের ‘নাম-খ্যাতি’ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে, ফলে দেশি-বিদেশি অনেক কীর্তিবাস মানুষই এই অনাথ-আশ্রম দেখতে আসেন। এঁদের মধ্যে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
‘খেলাঘরে’র মুক্তিযুদ্ধকালের কর্মকাণ্ডের কথা দীর্ঘ-ব্যবধানেও মৈত্রেয়ী দেবী ভোলেননি। পাঁচুকে সংগ্রহ করেছিলেন কোনো এক শরণার্থী শিবির থেকে – তাকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘জগৎ পারাবারের তীরে’। কান্না নিয়ে একদিন ‘খেলাঘরে’ এসেছিল ছোট্ট আমিনা। নাম – পেঁচো, সত্তর মাইল দূরের এক শিবির থেকে এসে ঠাঁই পেল শিশুনিবাসে। পেঁচো ভাত নয় – রুটি নয়, শুধু খেতে চায় ভাজা – সারা রাস্তা তার এই এক দাবি, এক বায়না। এক সন্ধ্যায় স্বেচ্ছাসেবক ভরত সাহা অনাথ দুই বোন যমুনা ও সুমিত্রাকে এনে হাওলা করে দেয় মৈত্রেয়ী দেবীর হাতে। দুই বোন – দুই মন, একজন উচ্ছল-লাস্যময়ী – অপরজন ম্রিয়মাণ-শোকতপ্ত। পাঁচ বছরের সাদা-সোজা কেষ্ট কার হাত ধরে যেন এসে ভর্তি হয় ‘খেলাঘরে’ – কেষ্টর সাদা জামায় রক্তের ছিটে – কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দেয়, রামদা দিয়ে ঠাকুরদার গলা-কাটার সময় যে ছিল পাশেই, সেই রক্তের দাগ। সল্ট লেক ক্যাম্প থেকে আসা দুই ভাইবোন – রিকেটি নকুল ও নিত্য জ্বরে-ভোগা গৌরী – এদের বাঁচার আশা কমই ছিল। ‘খেলাঘরে’র চেষ্টায় তারা সেরে ওঠে – পরে দত্তক পুত্র-কন্যা হিসেবে প্যারিসে বড়ো হয়। শরণার্থী অনাথ শিশুর লালন-পালনে মৈত্রেয়ী দেবী ‘খেলাঘরে’র মাধ্যমে যে-অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন, তা আর-কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
দশ
মৈত্রেয়ী দেবী সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহায়তার কথাও ভেবেছিলেন। এজন্যে তিনি খ্রিষ্টীয় ত্রাণ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগও করেন, কিন্তু তাঁরা নীতিগতভাবে যুদ্ধের কাজে কোনো সাহায্য করতে রাজি হননি। মৈত্রেয়ী তবুও কৌশলে তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বেশকিছু কেড্স-জুতো সংগ্রহ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত কিছু বাঙালি সামরিক অফিসারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল – এঁদের কেউ কেউ মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতেও কখনো কখনো আসতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা-রিক্রুটের প্রাথমিক প্রস্তুতি-প্রক্রিয়াও সরেজমিনে দেখার সুযোগ পান নদীয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে – তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এতে তাঁর যে অমøমধুর অভিজ্ঞতা হয়, তা তিনি খোলামেলা লিখে যেতে দ্বিধা করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পেও গেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, সঙ্গে ভারতীয় লোকসভার সদস্য সুভদ্রা যোশী। সেই ক্যাম্পে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাঁর পূর্ব-পরিচিত মহবুব নামের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। সেই যাত্রার বিবরণ মেলে মৈত্রেয়ীর লেখায় :
এপারে গাড়ি রেখে ইছামতী নদী নৌকোয় পার হলাম। ইছামতী তখন বর্ষার জলে থৈ থৈ করছে। আমি রোদ্দুরের জন্য মুখ ঢেকেছি। আর সুভদ্রা মুখ ঢেকেছে তার পরিচয় গোপনের জন্য। সুভদ্রা এত সুন্দরী যে তাকে একবার দেখলে লোকের চিরকাল মনে থাকবে। তাই চিনতে পারা অসম্ভব নয়। নৌকো চড়ে ওপারে পৌঁছে খানিকটা হাঁটতে হল। একটা প্রশস্ত আমবাগানের মধ্যে ক্যাম্প – বেশ বড়ো ক্যাম্প। অনেক ছেলে থাকে …। অনেক ছেলে ‘অ্যাকশনে’ চলে গেছে। …২০
সুভদ্রা যোশীর খুব ইচ্ছে ছিল 888sport apps ভূখণ্ডে যাওয়া – ‘মুক্তিফৌজের ক্যাম্পে এসে ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওদের উৎসাহ দেখে’ সুভদ্রাও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু বি.এস.এফের অনুমতি না পাওয়ায় সীমান্ত অতিক্রম করে 888sport appsে প্রবেশ সম্ভব হয়নি। তবে ক্যাম্পে ‘চারদিকে অস্ত্রশস্ত্র পরিবৃত হয়ে’ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মৈত্রেয়ী-সুভদ্রার ছবি তোলাতে বাদ সাধেনি কেউ।
888sport apps পুরোপুরি শক্রপক্ষের দখলমুক্ত হওয়ার অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয়ের সামান্য আগে শেষবারের মতো মৈত্রেয়ী দেবী রাজশাহী সীমান্তে লালগোলায় গিয়েছিলেন। এবারে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন গৌরী আইয়ুব। লালগোলায় মুক্তিযুদ্ধের অ্যাডভানস্ড ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর বিশেষ পরিচিত ক্যাপ্টেন গিয়াস। তাঁর অনুরোধে ‘একটা বড় ম্যাটাডর ভর্তি করে কম্বল, জামা-কাপড়, ওধুষপত্র নিয়ে’ মৈত্রেয়ী ও গৌরী ভোরবেলা কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে বিকেলে ‘লালগোলা মুক্তিফৌজের ক্যাম্পে’ এসে পৌঁছান। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা হয়, পরের দিন সকালে স্পিডবোটে তাঁরা গঙ্গা পেরিয়ে রাজশাহীর মুক্তাঞ্চলে যাবেন – দুদিন আগে পাক-বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন – তাঁদের কবরে ফুল দিয়ে 888sport apk download apk latest version জানাতে। মৈত্রেয়ীর লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি :
পরদিন [২৪ নভেম্বর] সকালে উঠে জীপে করে আমরা গ্রামের মধ্য দিয়ে নদীর তীরে পৌঁছলাম। নদী একেবারে তীর ছুঁয়ে চলেছে। খরস্রোতা সুন্দরী গঙ্গা ছোট ছোট বীচিভঙ্গে সজ্জিত হয়ে 888sport appsের অভিমুখে গতিশীলা। তীরে একটা স্পীড-বোট বাঁধা আছে। … গৌরী, আমি ও আর একটি ছেলে স্পীড-বোটে টালমাটাল করতে করতে উঠলাম। …
নৌকোর মোটর ফট ফট করে জীবন্ত হয়ে উঠলো। তরতর করে এগিয়ে চলল ওপারের তটরেখার দিকে। একটু পরেই আমরা রাজশাহীর খাড়া পাড় বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়লুম। গিয়াস আমাদের নিয়ে গেল কবরগুলির দিকে। সেখানে মাটি তখনও ভেজা। আমরা কিছু নয়নতারা ফুল যোগাড় করে তার উপর পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে নদীর তীরে এসে বসলাম। বিশাল জলরাশির নিরন্তর ধাবমানতা চিরদিনই আমার মনকে এক অদ্ভুত আবেগে ভরে দেয়। …২১
ভাষা-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমানের আদর্শিক চেতনার বোধন হয়েছিল। এই পথ ধরেই সার্বিক মুক্তির গন্তব্য দৃশ্যমান হয়। সেই 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মৈত্রেয়ী দেবীর অভিজ্ঞান ছিল এইরকম :
888sport appsের ছেলেরা ধর্মযুদ্ধ করছিল অর্থাৎ যে কারণে তারা লড়ছিল সেটা আদর্শগত। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার এবং Secularism ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য। অপর পক্ষে পাকিস্তান লড়ছে তাদের অধিকার এবং ধর্মান্ধতা ও প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য। এ দুয়ের মধ্যে তফাত আছে।২২
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো ১৯৭১-এর ষোলোই ডিসেম্বর, 888sport appয় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক-অধিনায়ক নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে। মৈত্রেয়ী দেবীর মনে প্রশ্ন জাগে : ‘কে জানে কি কারণে তাদের মনোভাব এত ভেঙে গিয়েছিল যে নব্বই হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করল। এরকম ঘটনা কমই ঘটেছে।’ এই প্রহেলিকার রহস্য তো উদ্ঘাটিত হয়েছে তাঁরই ব্যাখ্যায় – 888sport appsের লড়াই ছিল ‘আদর্শগত’ আর ‘ধর্মান্ধ’ পাকিস্তানের লড়াইয়ের মূলে ছিল ‘প্রভুত্বে’র চেতনা।
এগারো
স্বাধীন 888sport appsে মৈত্রেয়ী দেবী বেশ কয়েকবার এসেছেন, কখনো সপরিবার কখনো সবান্ধব। প্রথম তিনি 888sport appsে প্রবেশ করেন ১৯৭২-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে – 888sport appsের চূড়ান্ত বিজয়ের তিন সপ্তাহের মধ্যেই। পাক-বাহিনী কেমন পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছিল তার চিহ্ন 888sport appsের গ্রাম-নগর-জনপদ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। সেসব মৈত্রেয়ী দেবীর যাওয়া-আসার পথে বেশ ভালোই নজরে পড়েছে। শুধু দূর থেকে পাখির চোখেই এই বর্বরতার চিহ্ন দেখেননি – কাছে গিয়েও সাক্ষী হন। মা তাঁর নিখোঁজ সন্তানকে এখনো খুঁজছেন, যদি তাকে পাওয়া যায়! মানবপ্রেমী বৃদ্ধ পাদরির রক্তের দাগ কখনো কি শুকাবে? গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে নিতাই-রমেশ-হরিপদ-হামিদ-বক্কর-আসমত কিংবা সম্ভ্রম-হারানো মিনতি-সুরবালা-হরিদাসী-সকিনা-কোমেলা-জয়গুন একই সমতলের বাসিন্দা হয়ে যায় – সেখানে জাত আর ধর্মের কোনো ভেদ থাকে না। এসব শুনে ভারাক্রান্ত হন মৈত্রেয়ী। তবে যুদ্ধজয়ী মানুষের প্রতিজ্ঞায় মৈত্রেয়ী ভাবেন, এই দেশ একদিন ভস্মের ভেতর থেকে নতুন প্রাণের স্পন্দন নিয়ে জেগে উঠবে।
মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারত সরকার পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের অতি-দ্রুত স্বাধীন স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। অনাথ শরণার্থী শিশুদের 888sport apps সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সরকারি নির্দেশ আসে ‘খেলাঘর’ কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এক মানবিক সমস্যায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন সকলে। মৈত্রেয়ী দেবী জানান :
আমরা খুব মুস্কিলে পড়েছি। মানুষ নিয়ে কাজ করবার প্রধান বিপদ এই যে ভালবাসা জন্মে যায়। তখন কে বা 888sport appsের কে বা এ দেশের এ সব বোধ থাকতে পারে না। 888sport appsে যুদ্ধে সব লণ্ডভণ্ড। 888sport appsের আভ্যন্তরীণ অবস্থা বেসামাল। এখন এই সব ছোট ছোট শিশু যাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, কলেরায় মৃত মায়ের পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল যে শিশু, সে আজ প্রাণবন্ত হাসিখুশী। এদের কার হাতে সমর্পণ করব? … এই সব দিন-রাত ভাবছি।২৩
সরকারি নির্দেশ মান্য করে ১৯৭২-এর ১৮ই মার্চ ‘খেলাঘরে’র অনাথ শিশুদের 888sport appsে নিয়ে আসা হয়। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে এদের 888sport free bet ছিল সত্তর-আশিজন। ট্রাকে করে আশ্রমের মালপত্রসহ এদের যশোরে নিয়ে আসেন মৈত্রেয়ী দেবী। সেই সময়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেবের আনুকূল্যে ‘খেলাঘরে’র অস্থায়ী ঠিকানা হয় যশোরের সুন্দর একটি বড়োসড়ো বাংলো। অবশ্য মৈত্রেয়ী দেবীর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন – এ-বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন : ‘আমার কিন্তু আকাক্সক্ষা ছিল শিলাইদহে ‘খেলাঘর’ নিয়ে যাব ও তাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রচর্চার প্রতিষ্ঠান বা দ্বিতীয় শান্তিনিকেতন গড়ে উঠবে। সে আশা পূর্ণ হবার প্রতিবন্ধকতা যে কত তা ঠিকমত অনুমান করতে পারিনি।’ শেষ পর্যন্ত ‘খেলাঘরে’র স্থায়ী আবাস আর গড়ে উঠতে পারেনি 888sport appsের মাটিতে।
বারো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর সরাসরি দেখা ও আলাপ হয় ১৯৭৩ সালে 888sport appয়, যেবার তিনি সরকারি আমন্ত্রণে 888sport appsে আসেন পঁচিশে বৈশাখ শিলাইদহে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নাম ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিচয় সম্পর্কে কখনোই অবিদিত ছিলেন না। কেননা নানা সূত্রে, বিশেষ করে তাঁর পত্রিকা নবজাতকের কারণে, পূর্ববঙ্গের উদার-মুক্তমনা-প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এঁদের লেখা, চিঠিপত্র ও ক্বচিৎ দেখাশোনার সুবাদে পূর্ববঙ্গের সব-ধরনের খবর কমবেশি তাঁর পাওয়ার সুযোগ ছিল। উদার-অসাম্প্রদায়িক শেখ মুজিব যে বঞ্চিত বাঙালির প্রধান মুখপাত্র, ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা – তা তাঁর অজানা ছিল না।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর 888sport apk download apk latest version ও অনুরাগ জন্মেছিল বেশ আগেই। কলকাতার প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্র-পত্রিকায় পূর্ববঙ্গের আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবরকেও অনেকসময় তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না – দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি আগরতলা মামলার উল্লেখ করে বলেছেন :
… আগরতলার কেসের মতন বিরাট কেস যাতে মুজিবুর রহমানকে ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও রাজদ্রোহিতার অপরাধে কাঠগড়ায় খাড়া করা হয় সে খবরও আমাদের কাগজে খুব বেশী প্রাধান্য পায়নি।২৪
কিন্তু যখন পূর্ববঙ্গে একাত্তরে গণহত্যা শুরু হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেয়, বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাক-সামরিক জান্তা নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে – মৈত্রেয়ী দেবী লক্ষ করেছেন, এই মহা-সংকটের কালে ভারতীয় গণমাধ্যম আর নীরব থাকতে পারেনি – মূলত একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমের প্রধান প্রসঙ্গ ছিল পাক-বর্বরতা, শরণার্থী-সমস্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা, বিশ্ব-বিবেকের জাগরণ, বাঙালির বিজয় ও স্বাধীন রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিব।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র সত্যতা সম্পর্কে সংশয় ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর মনে। তাই সরাসরিই তিনি সে-কথা তুলেছেন :
অনেকদিন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী প্রচেষ্টা চলছিল মিলিটারী শাসনবিরোধী বাঙালীদের ভারতের সঙ্গে চক্রান্ত প্রমাণ করবার। আগরতলা কেস নামে প্রসিদ্ধ কেসে মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করে চরম সাজা দেবার চেষ্টা চলেছিল। বাঙালী সমস্ত আইনজীবী এ নিয়ে লড়েছিলেন। এ কেসের কতোটা সত্যতা ছিল জানি না। এখনও লোকের মুখে সন্দেহের কথা শুনি।২৫
মৈত্রেয়ী দেবীর এই ধারণার কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। তবে আগরতলা মামলার ঘটনা মোটের ওপর মিথ্যা ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিজেও অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপে এর কিছু ঘটনার উল্লেখ করেন। তাঁদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে কিভাবে তা ব্যর্থ হয় সে-কথাও বলেছেন বঙ্গবন্ধু।২৬ এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত, পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শওকত আলী এই মামলা নিয়ে একটি বই লেখেন, সে-বইয়ের নাম দেন সত্য মামলা আগরতলা (প্রথম প্রথমা সংস্করণ : 888sport app, জানুয়ারি ২০১১)। এই নামকরণও প্রমাণ দেয় আগরতলা মামলার সত্যতা।
তেরো
পঁচিশে মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছা-বন্দিত্ব বরণ করেন। পাক-সামরিক-জান্তা তাঁকে গোপন কোনো স্থানে আটক করে রাখে। পরে পাকিস্তান সরকার তাঁকে বন্দি করার খবর প্রকাশ করলেও তাঁর হালহকিকত সম্পর্কে রহস্যজনক নীরবতা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে 888sport appsের মানুষ যেমন বিদেশের মানুষও তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন। শরণার্থী বাঙালির প্রশ্ন – ‘মুজিব আছেন কি নেই, ভবিষ্যৎ কি রকম হবে’! মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে জানাচ্ছেন : ‘দেখলাম 888sport appsের রাজনীতির মানুষ যাঁরা, তাঁরা একেবারে চুপচাপ, চোখে শূন্য দৃষ্টি। সকলেই কেবল বলছেন – মুজিবের খবর পাওয়া গেল না।’২৭
পূর্ববঙ্গের মতো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও শঙ্কা-চিন্তায় কম ব্যাকুল হননি – তাঁরাও মুজিবের কুশল জানতে উৎসুক। সেই আগ্রহ-উৎকণ্ঠার ধরনটা কেমন তার পরিচয় দিয়েছেন মৈত্রেয়ী দেবী। পূর্ববঙ্গের কয়েকজন বিশিষ্ট শরণার্থী বাঙালির জরুরি একটি কাজের জন্যে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের আলিপুরের বাড়িতে যান। এর পরের অংশটুকু মৈত্রেয়ী দেবীর জবানিতেই শোনা যাক :
অজয় মুখার্জীর বাড়ি পৌঁছে দেখি তাঁরা সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। থালা ভরে মিষ্টি সাজানো। সকলেই কৌতূহলী। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে অজয়বাবুর বিধবা বৌদি গল্প শুববেন বলে প্রস্তুত, একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছেন – কোন পথে পালিয়ে এলেন? মুজিবের কি হল? কি হতে পারে? জীবিত কি মৃত? ইত্যাদি।২৮
এই কৌতূহল ও শঙ্কা আমজনতার মধ্যে কমবেশি লক্ষ করা গেছে সেই সময়ে।
তবে পঁচিশে মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, আটক বা বন্দি করার যে-ঘটনা ঘটেছিল, সে নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে এক ‘সুদর্শন যুবক’ হঠাৎ এসে সবাইকে চমকিত করে গল্প ফাঁদেন যে, বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসা থেকে পাক-বাহিনী রাতে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তিনি ‘মুজিবকে ধরতে আসা, ধরার ও নিয়ে যাওয়ার বিস্তৃত বিবরণ’ সেদিন দিয়েছিলেন। তবে তখন তাঁর সেই বক্তব্য যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না।
সেই সময় বঙ্গবন্ধুর অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে নানা কথা ছড়িয়ে পড়ে – তাঁকে নিয়ে প্রবল ‘দুশ্চিন্তা’ ও ‘উদ্বেগ’ মানুষের মধ্যে ছিল। মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন :
কিছু বোঝা গেল না – তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল? তাঁকে যে অ্যারেস্ট করতে আসবে তা তো জানাই ছিল। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পালাতে রাজী হননি। ভোটের জোরে তখন তো তিনি সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্য। কিন্তু বেয়নেটের জোরে, কামানের জোরে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গেল। সমস্ত যুদ্ধের সময়টা বোঝা যায়নি তিনি কোথায় ছিলেন, জীবিত কি মৃত? এই দুশ্চিন্তা সকলকেই বড় উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল।২৯
চোদ্দো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন 888sport appsের প্রাণপুরুষ – বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। তাঁর নামের মাহাত্ম্যে পরিচালিত হয়েছে সার্বিক মুক্তির লড়াই। মৈত্রেয়ী দেবী ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা বা শরণার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো বিরূপ সমালোচনা তাঁর কানে আসেনি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উৎসাহ-উদ্দীপনা-888sport apk download apk latest version-অনুরাগের কোনো অভাবও তিনি লক্ষ করেননি। পৃথিবীর দেশে দেশে ‘888sport apps’ ‘888sport apps’ ধ্বনি উঠেছে। জোয়ান বোজের গান ‘888sport apps 888sport apps’ মার্কিন মুলুকে ‘মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে ফিরেছে’। কত-না বিদেশি প্রতিষ্ঠান এসেছে 888sport appsের জন্যে কাজ-করার স্পৃহা ও ব্রত নিয়ে। মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বলেই না মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে এই অভূতপূর্ব সাড়া! অবশেষে দেশ স্বাধীন হয় – টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ধ্বনি ওঠে ‘জয় বাংলা’ – বীরের বেশে দেশে ফেরেন মুক্ত মুজিব।
পনেরো
যেসব ভারতীয় বাঙালি অকৃত্রিম সেবা, আন্তরিক সহায়তা, অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে 888sport appsের মুক্তির সংগ্রামকে সফল ও সার্থক করে তোলার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবী একটি উজ্জ্বল নাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি মৈত্রেয়ীর কখনো দেখা হয়নি – ঘটেনি আলাপের সুযোগ। তাই বলে কেউ কারো কাছে অপরিচিত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু তাঁকে জানতেন লেখার সূত্রে, আর মৈত্রেয়ীর কাছে বাঙালির মুক্তিদাতা মুজিব ছিলেন বহুবর্ণে চিত্রিত রাজনীতির এক বীর নায়ক।
১৩৮০ (১৯৭৩) সালে কবিতীর্থ শিলাইদহে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ সমারোহে পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন মৈত্রেয়ী। তিনি কেন জানি ভেবে নিলেন এই আমন্ত্রণ হয়তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের একটা সুযোগ বা উপায়। অবশেষে হলোও তাই। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের কালে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় এমন কয়েকজনের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। আসলে এই সাক্ষাতের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর হাতে তিনি একটি ‘মহামূল্য উপহার’ তুলে দিতে চান বলেই এতো আগ্রহ।
পরম যত্নে বহুকালের সঞ্চিত সেই আদরের স্পর্শমাখা 888sport sign up bonusর সম্পদ ‘মহামূল্য উপহার’টি কী তা খোলাসা করে বলেন মৈত্রেয়ী :
888sport appয় যাবার কথা হতেই ভেবেছিলুম মুজিবরকে (মুজিবুর) নিজের হাতে কিছু উপহার দেব। একটা চামড়ার কেস কিনলাম। তার এক পাশে রবীন্দ্রনাথের নিজের সই করা ফটোগ্রাফ – অন্য পাশে তাঁর নিজের হাতে লেখা সেই প্রসিদ্ধ গান – ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’। এর সঙ্গে মুজিবকে উদ্দেশ্য করে আমি একটি অভিনন্দন লিখেছিলাম। তাতে কি লিখেছিলাম তা আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে তাকে আমি ‘নরোত্তম’ বলে সম্বোধন করেছিলাম।৩০
এই অসামান্য উপহারটির বিষয়ে মৈত্রেয়ীর একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল – বলতে গেলে খানিক অহংকারও এর সঙ্গে এসে মিশেছিল। উপহার-প্রদানে পরিচিত একজনের সহায়তা চেয়ে উপহারের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সরাসরিই বলেছেন :
এসে অবধি ভাবছি কি করে তাঁর হাতে এই মহামূল্য উপহারটি দেব। … আমি বললাম – আমি মুজিবরকে (মুজিবুর) একটা উপহার দিতে চাই। উপহারটি কিন্তু সামান্য নয়। আমি ছাড়া এই দুনিয়ার আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেউ নেই যে ওঁকে এমনটি দিতে পারে, ইন্দিরা গান্ধীও নয়। … তারপর উপহার দেখে তো তার চক্ষু স্থির। বললে – এটা আপনি দিয়ে দেবেন? আমি বললুম – … ওনাকে দেব না তো কাকে দেব। মুসলমানের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাবার জন্য ওনার মতো কষ্ট আর কে করেছে?৩১
শিলাইদহে পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পরে মৈত্রেয়ী দেবীর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয় – স্থান রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন – সময় সন্ধ্যাবেলা। ঘরভর্তি লোক – সাক্ষাৎপ্রার্থী, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী। ঘরে ঢুকতেই সৌজন্য-বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু আন্তরিকতার সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীকে তাঁর পাশে বসান। মৈত্রেয়ীর বিবরণ থেকে জানা যায় :
… প্রথম কথাই বললেন, দিদি, আপনার বই (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ) আমি কলেজে থাকতে পড়েছি। আমার মনে আছে এই বইয়ের মতো বই – ইত্যাদি। আমি বুঝলাম এই মানুষ মানুষকে খুশি করার মন্ত্র জানেন। … লেখককে খুশি করার এই একটি মন্ত্র – তোমার লেখা আমার ভালো লেগেছে।৩২
এর পরের পর্ব – আসলে সেটিই প্রধান পর্ব, উপহার-হস্তান্তর। মৈত্রেয়ী জানাচ্ছেন :
… আমার উপহার পেয়ে উনি অবাক হলেন। তারপর আমি আমার অভিনন্দন পাঠ করলাম। উনি ছবি আর 888sport app download apkটি নিয়ে দেখলেন। তার পরে অ্যালবামটি বন্ধ করে মাথায় ছুঁইয়ে … [সহকারীর] হাতে দিলেন। তিনি বললেন – … রাখো। আমাদের রবীন্দ্র মিউজিয়ম হবে, সেখানে রাখা হবে। এ আমার ব্যক্তিগত জিনিস হতে পারে না। – তিনি বললেন – দেখুন দিদি, আমরা বাঙালী হয়েও তাঁর জন্য কিছুই করতে পারি নাই, এবার করব।৩৩
বৈঠকী গল্পে মজলিশ জমিয়ে রাখার আশ্চর্য নৈপুণ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর। কথা-বলা যে একটা 888sport live chat, তা-তিনি জানতেন। তাই প্রসঙ্গের তারতম্যে তাঁর বক্তব্য কখনো গুরুগম্ভীর, কখনো লঘু, আবার কখনো প্রসন্ন-অনুভূতির প্রতীক হয়ে উঠতো। নাটকীয় আবহ রচনায় তাঁর ঘরোয়া আলাপ যে কত রমণীয় হয়ে উঠতে পারে, তার নমুনা পাওয়া যায় মৈত্রেয়ীর 888sport sign up bonusচারণে :
আপনি কি জানেন উনিও [রবীন্দ্রনাথ] 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ। …
মুজিব বললেন – … উনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একজনের বাড়িতে দেওয়ালে তাঁর মস্ত বড়ো ছবি টাঙানো ছিল। সৈন্যরা বাড়ি সার্চ করতে এসে সেই ছবি দেখে ঐদিকে বন্দুক তুলে গুলি করে দিলে ছবিখানা চৌচির হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আমরা গল্পও শুনেছিলাম যখন পাক সৈন্যরা প্রতি বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখত এবং জিজ্ঞাসা করলেই শুনতো উনি আমাদের নানা, একবার তারা দারুণ চটে গিয়েছিল। বলেছিল শ্যালক বাঙালীদের সকলেরই এক নানা। – মুজিব বলে চলেছেন – আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিন্তায় প্রেরণা, উনি আমাদের চরম শক্তি। আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গুলিও খেয়ে গেলেন।৩৪
এই আবেগঘন বিবরণ শুনে মৈত্রেয়ী অভিভূত – তাঁর ‘চোখে জল এসে গেল’। রবীন্দ্রমগ্ন মুজিব জানালেন – সব গুছিয়ে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নামে একটা ইনস্টিটিউট করার ইচ্ছা আছে তাঁর। আনন্দিত মৈত্রেয়ী বললেন – ‘শিলাইদহে করুন – যদি সত্যই তাই করেন তবে সেখানে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দেব।’৩৫ বঙ্গবন্ধুর অস্বাভাবিকভাবে অকালে চলে যাওয়ায় তাঁর সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।
এই-ই মুজিবের সঙ্গে মৈত্রেয়ীর প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে তিনি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এই মানুষটিকে খুব কাছে থেকে দেখেন। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের পোশাকি দূরত্ব ছাপিয়ে সেদিন এক ভিন্ন মানুষকে মৈত্রেয়ী দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন – এক বিশুদ্ধ বাঙালি স্বজনকে – সে-888sport sign up bonus চিরঅমলিন।
ষোলো
১৯৭৫-এর পনেরোই আগস্ট প্রায় সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় – এ ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলাফল। এই নিন্দার্হ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন – ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’। আর মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে :
সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-যুদ্ধের সময়টা মুজিবুর রহমান 888sport appsের অবিসম্বাদী নেতা হিসেবে আমাদের মনের সামনে জ্বলজ্বল করতেন। সেই যে পঁচিশে মার্চ তাঁকে ধরে নিয়ে গেল – তিনি কোথায় গেলেন কেউ জানে না। তিনি জীবিত কি মৃত কে বলতে পারে? … যুদ্ধ শেষ হবার পরে পরেই শোনা যাচ্ছিল যে পাকিস্তানে তাঁর বিচার হবে। বঙ্গবন্ধু পরে বলেছিলেন বিচার হয়েছিল এবং কবরও খোঁড়া হয়েছিল কিন্তু কবরে যেতে হয়নি। ১৯৭২-এর ৩রা জানুয়ারী তাঁকে জুলফিকার আলি ভুট্টো বিনাশর্তে মুক্তি দেন।৩৬
এইটুকু লেখার পর তিনি আক্ষেপ আর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে বলেছেন :
আজ মনে হয় পাকিস্তানের কবরে গেলে ভালোই হত – তিনি শহীদ হতেন। এভাবে পুত্রতুল্য বাঙালী ছেলেদের চক্রান্তে মধ্যরাত্রে সপরিবারে নিহত হবার মতো পরিতাপজনক ঘটনা ঘটত না। মুজিব এত কাজ করলেন – কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে সময়মতো মরতে পারলেন না।৩৭
মুজিব ছিলেন 888sport appsের স্থপতি। তাঁর সংগ্রাম, ত্যাগ ও নেতৃত্ব ছাড়া একটা জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব ছিল। ইতিহাসের ট্র্যাজিক-চরিত্র তিনি। অথচ তাঁর কাছে বাংলা ও বাঙালির ঋণ অপরিশোধ্য। তাঁর খ্যাতি ও কর্মকৃতির কথা 888sport app download for android করে মৈত্রেয়ী দেবী বলেছেন :
মুজিবর রহমান – যিনি সে সময় বিশ্ববন্দিত মানুষ, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তাঁর নাম, খ্যাতি ও প্রশংসা, সুদূর স্পেন দেশে তাঁর নামে গান বাঁধা হয়েছে – ভিভা মুজিবুর – সেই মুজিবুর কেমন মানুষ, কি তাঁর শক্তি ক্ষমতা পৃথিবীতে কেই বা তা [না] জানে। সমস্ত 888sport appsের মানুষ তাঁকে বরণ করে নিয়েছে পিতা বলে, জাতির পিতা বলে।৩৮
সেই ‘জাতির পিতা’কে যারা হত্যা করে তারা কৃতঘ্ন শুধু নয়, তারা অমানুষ। সেই পামরদলের একজন মেজর ডালিম। পাকিস্তান থেকে সে ভারতে পালিয়ে আসে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কলকাতায় 888sport apps মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির কন্যা ছিল তার প্রণয়িণী – অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের বিয়ের গোপন আয়োজন হয়। এই কাজে মুখ্য ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ক্যাপ্টেন (?) নুরুজ্জামানের (পরে কর্নেল) কলকাতায় অবস্থানরত পরিবার – বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী সুলতানা এবং দুই কন্যা লায়লা ও লুবনা [মরিয়ম]। মৈত্রেয়ী দেবীকে না জানিয়েই তাঁর বাড়িতে এঁরা গোপনে ডালিমের বিয়ের আয়োজন করেন – বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কে মৈত্রেয়ী বলেন : ‘যদিও আমার বাড়িতে বিবাহ নিষ্পন্ন হল, তবু
আমার ভূমিকা ছিল দর্শকের ভূমিকা মাত্র’।৩৯ পরে মৈত্রেয়ী যখন জানতে পারেন, মেজর ডালিম মুজিবহত্যার পরিকল্পকদের প্রধান একজন – তখন ডালিমের ‘ভয়ানক কুকীর্তি’র জন্যে ক্ষুব্ধ এবং বিবেক-দংশনে জর্জরিত ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন। মৈত্রেয়ী ন হন্যতে নামে 888sport alternative link লিখেছিলেন – ‘ন হন্যতে’র অর্থ, অহননীয়। যিনি একটি জাতির মুক্তিদাতা, একটি রাষ্ট্রের স্থপতি – সেই মানুষটি কি হননযোগ্য?
সতেরো
১৯৮৪-এর ৩১শে অক্টোবর দেহরক্ষী-ঘাতকের হাতে নিহত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করে শোকার্তচিত্তে তাঁর বই সমাপ্ত করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত বাংলা আর ভারতের মাটিতে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে। ১৯৭১-এ মার্চ থেকে ডিসেম্বর তিরিশ লক্ষ বাঙালির রক্ত, ১৯৭৫-এর পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রক্ত, ওই একই সালের তেসরা নভেম্বর জাতীয় চার নেতার রক্ত আর তার নয় বছর পর ১৯৮৪-তে 888sport appsপ্রেমী ইন্দিরা গান্ধীর যে-রক্ত ঝরেছে – তার দাগ বা 888sport sign up bonus কোনোটাই মোছেনি। তাই ‘এত রক্ত কেন’ – এই আর্তিও কাল থেকে কালান্তরে বয়ে চলেছে।
তথ্যসূত্র
১. মৈত্রেয়ী দেবী : এত রক্ত কেন?। কলকাতা, আগস্ট ১৯৮৫; পৃ ‘ভূমিকা’-১।
২. ওই; পৃ ২৭-২৮।
৩. ওই; পৃ ২৮।
৪. ওই; পৃ ৩৬-৩৭।
৫. ওই; পৃ ৩৭।
৬. ওই; পৃ ৪২।
৭. ওই; পৃ ৫৯।
৮. ওই; পৃ ৬১।
৯. ওই; পৃ ৬২।
১০. ওই; পৃ ৬৫-৬৬।
১১. ওই; পৃ ৬৬।
১২. ওই; পৃ ৭২।
১৩. ওই; পৃ ৭২।
১৪. ওই; পৃ ৭৮।
১৫. ওই; পৃ ৯৮।
১৬. ওই; পৃ ৯৯।
১৭. ওই; পৃ ১০৭।
১৮. ওই; পৃ ১০৯।
১৯. ওই; পৃ ১২২।
২০. ওই; পৃ ১৩৪।
২১. ওই; পৃ ১৪২, ১৪৪।
২২. ওই; পৃ ১৩৬।
২৩. ওই; পৃ ১৮১-৮২।
২৪. ওই; পৃ ৩২।
২৫. ওই; পৃ ১১২।
২৬. অন্নদাশঙ্কর রায় : কাঁদো, প্রিয় দেশ। দে’জ সংস্করণ : কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৯৮; পৃ ২১-২৩।
২৭. এত রক্ত কেন? : পূর্বোক্ত : পৃ ৯১।
২৮. ওই; পৃ ৭০।
২৯. ওই; পৃ ৮৬।
৩০. ওই; পৃ ১৯৬।
৩১. ওই; পৃ ১৯৬।
৩২. ওই; পৃ ১৯৭।
৩৩. ওই; পৃ ১৯৭।
৩৪. ওই; পৃ ১৯৭।
৩৫. ওই; পৃ ১৯৭-৯৮।
৩৬. ওই; পৃ ১৯৫-৯৬।
৩৭. ওই; পৃ ১৯৬।
৩৮. ওই; পৃ ১৩৮। ৩৯. ওই; পৃ ১৩৭-৩৮।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.