জাকির তালুকদার
তাকে ‘গোপন তারকা’ বলে ব্যঙ্গ করা শুরু হয়েছে বেশ অনেকদিন থেকেই। ছেলে এবং ছেলের মা এমনভাবে আড়ালে কথাটা বলে যেন সে ঠিকই শুনতে পায়। ছেলে হয়তো আরো পরিষ্কার করার জন্য বলে – না মা, গোপন শব্দটা এখানে ঠিক অ্যাপ্রোপ্রিয়েট না। বলতে হবে চিরকালের গুপ্ত তারকা।
ছেলের মা-ও কম যায় না। বলে – কিংবা বলতে হবে কেউ চিনল না এমন তারকা।
এত বড় করে বলতে গেলে মুশকিল। তাহলে বরং সংক্ষিপ করে বলা যেতে পারে কেচিনাতা – ‘কেউ চিনল না তারকা’।
দারুণ তো! জাপানি-জাপানি নাম।
তারপর থেকে ছেলে বা মা কথায়-কথায় বলে কেচিনাতা, আর নিজেরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে এটা হাসি নয়, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা এবং কিছুটা ঘৃণাও। টলাতে না পারার ঘৃণা।
তার কি এখন আত্মহত্যা করা উচিত? কিংবা চলে-যাওয়া বাড়ি ছেড়ে?
কিন্তু কোনোটাই করে না সে। বরং তারকা শব্দটি শুনে একটু হাসতেই ইচ্ছা করে। বছরবিশেক আগেও তাদের শহরে সিনেমার নাচনেওয়ালি শর্বরী আর কৌতুক-অভিনেতা মতি আসায় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গিয়েছিল সবগুলো রাস্তায়। আর এখনকার সিনেমার
নায়ক-নায়িকারা এসে রাস্তার মোড়ে-মোড়ে শুটিং করে গেলেও কেউ ফিরে তাকায় না। আর টেলিভিশনের নায়ক-নায়িকাদের নামই তো বোধহয় জানে না শহরের বেশিরভাগ মানুষ। এত যে খুলস্নাম খুলস্না ছবি রঙিন ছাপায় পত্রিকাগুলোতে, কই তবু তো কেউ এখন আর স্টারের মর্যাদা পায় না মানুষের কাছে। শাকিব খান, আমিন খানদের খাওয়া নেই। এদেশের মানুষ এখন টিভি খুললেই শাহরুখ খানকে, আমির খানকে দেখতে পায়। মৌসুমী, শাবনূরকে কে দেখতে চায় ঐশ্বরিয়া, দীপিকাদের ফেলে! লম্ফঝম্ফ করে যারা এত গান-টান গায়, তাদেরও অবস্থা সুবিধার নয়। কুদ্দুস বয়াতী আর মমতাজের রমরমা দেখে কিছুদিন তারাও মরমি, কবিগান আর ঝাঁপতালের গানের দিকে ট্রাই করেছে। কিন্তু পাবলিকে নেয়নি। 888sport appsের ফিল্মের-টিভির কেউ আর স্টার হতে পারবে না। বরং স্টার যদি সান্তবনাসূচকভাবে বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে টকশোর লোকদের নাম।
বউ-ছেলেকে এসব কথা বলে লাভ নেই। এমন নয় যে, তারা বুঝবে না। আসলে বুঝতে চাইবে না।
তার ওপর এত ক্ষোভ কেন পরিবারের মানুষদের?
সে কোনোদিনই এলিট হতে চায়নি। এটাই কি কারণ? নাকি সে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে রাজি নয় – এটাকে অযোগ্যের জেদ বলে রেগে যাওয়া?
দুই
সাড়ে এগারোটা বাজার সঙ্গে-সঙ্গেই মৃদুলা খুবই মৃদুকণ্ঠে জানিয়ে দেয় – কাল আমাকে ভোরে উঠতে হবে। প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস নিতে হবে।
তার মানে এখন লাইট অফ করতে হবে। তারও আগে বন্ধ করতে হবে কম্পিউটার। অর্থাৎ লেখা আজকের রাতের মতো বন্ধ।
নিঃশব্দে উঠে পড়ে সে। কম্পিউটার অফ করে।
প্রচ- গরম চলছে কয়েকদিন ধরে। এরকম গরমে মাথা বেশিক্ষণ কাজ করে না। তাদের শোবার ঘরটা তুলনামূলক ঠান্ডা। চালাটা উঁচু। নিচে ফলস সিলিং আছে। ফ্যান চালিয়ে রাখলে রাত দশটা নাগাদ মোটামুটি সহনযোগ্য একটা পরিবেশ তৈরি হয়। একটু হলেও লেখাটা এগোয়। কিন্তু আজকে এখানেই ক্ষান্ত দিতে হবে।
তার মুখের দিকে তীক্ষনদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মৃদুলা। কিন্তু কোনো অনুভূতির ছায়া ফুটতে না দেখে একটু বোধহয় খারাপ লাগে তার। এতদিনে তার মুখস্থ হয়ে গেছে স্বামীর সব ধরনের আচরণ। মুখে কোনো ছায়া না-ফোটা মানে সে মনে-মনে অসহায়। মেনে নেওয়া অসহায়ত্ব।
বিছানা ঝাড়তে-ঝাড়তে মৃদুকণ্ঠেই বলে মৃদুলা – কী খবর বলো! যতক্ষণ তুমি মাথার কাছে বসে লিখবে, ততক্ষণ আমার ঘুম আসবে না। তার ওপরে এই গরমে মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। ঘুমাতে যদি না পারি কাল সকালে কলেজে যেতেই পারব না।
ঠিক আছে। সে-ও মৃদুকণ্ঠে আশ্বস্ত করে স্ত্রীকে – আজ আর না লিখলেও চলবে।
তার অবয়বে কিংবা কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র রাগ বা ক্ষোভের চিহ্ন না পেয়ে একটু বোধহয় হতাশই হয় মৃদুলা। বিড়বিড় করে বলে, বারান্দায় ডাইনিং টেবিলে গিয়ে যে বসবে, তারও উপায় নেই।
ওখানে ফলস সিলিং নেই। তাই গনগনে হয়ে তেতে থাকে সবসময়। দুপুরে তো দূরের কথা, রাতেও ওখানে বসে খাওয়া-দাওয়া করা মুশকিল। তাই বাড়ির সবাই নিজের-নিজের থালায়
ভাত-রুটি-তরকারি নিয়ে নিজেদের ঘরের মেঝেতে বা টেবিলে বসে খায়। চৈত্র মাস শুরু হয়েছে। ভাদ্র পর্যন্ত অন্তত চলবে একই ব্যবস্থা। টিনের বাড়িতে থাকলে এমনটি মেনে নিতেই হবে।
এই টিনের চালা নিয়ে প্রায়ই খোঁটা শুনতে হয় তাকে। কোনো লোককে বাড়ির লোকেশন বলার সময় মৃদুলা তাকে শুনিয়ে বেশ
জোরে-জোরে বলে – ওই যে জেলা স্কুলের আগে তিন মাথার মোড়। সেখানে দাঁড়িয়ে ডানদিকে তাকালেই চিনতে পারবেন। গোটা পাড়ার মধ্যে ওই একটাই টিনের বাড়ি।
টিনের বাড়ি। শব্দটা আসলে তাকেই জোর করে শোনানো। তার অনেক অযোগ্যতার আরেকটা প্রমাণ যেন ওই টিনের বাড়ি।
লেখা না হয় বন্ধ হলো। কিন্তু এখন সে করবে-টা কী? তার ঘুমের সময় হয়নি। বই পড়তেও পারবে না। কারণ লাইট নিভিয়ে দিতে হবে। তাকে এখন বউয়ের পাশে শুয়ে থাকতে হবে মটকা মেরে। যতদূর সম্ভব নড়াচড়া কম করে। মৃদুলার ঘুম পাতলা। পাশে শুয়ে নড়লে-চড়লেই ভেঙে যায়। সে তাই অনেক সময় জোর পেচ্ছাপ চাপলেও ওঠে না। চেপে রেখেই ঘুমানোর চেষ্টা করে।
মৃদুলার পাশে শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে সে। মৃদুলার জন্য মায়া হয় খুব। মৃদুলার জীবনটা নষ্ট করেছে সে। খুব ভালো ঘর-বর পেতে পারত মৃদুলা। সবই ছিল তার। ভালো উঁচু বংশ, টাকা-জমি, খুব সুন্দরী সে, লেখাপড়াতে ভালো, পরিবারে একাধিক 888sport live chatপতি, এমপি, আমলা, মেজর জেনারেল পর্যন্ত রয়েছে। শুধু তার মতো একটা হতচ্ছাড়া লেখককে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে অন্ধকার করে ফেলেছে মৃদুলা।
কিন্তু প্রেম করার সময় মনে হয়েছিল, মৃদুলা তার এই লেখালেখিকেই পছন্দ করে। এমনকি ছাত্র অবস্থাতেই বের করা প্রথম 888sport app download apkর বইয়ের খরচ মৃদুলাই দিয়েছিল তাকে। তখন তার লেখা নিয়ে কী গর্ব মৃদুলার! ক্যাম্পাসে পরিচিত সবাই জানত মৃদুলার এই গর্বের কথা। অথচ বিয়ের অনেক পরে মৃদুলা স্বীকার করেছে যে, সে তার লেখকত্বের প্রেমে পড়েনি। প্রেমে পড়েছিল ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটির। ভেবেছিল লেখালেখি শৌখিন কাজ। অবসরে করার কাজ। যেহেতু খুব ভালো ছাত্র, ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। বাড়ির সবার অমতে বিয়ে করেছিল তাকে মৃদুলা। কিন্তু প্রথম ধাক্কা এলো ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েও ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করতে না পারায়। ওটার জন্যে যে রাজনীতির সংস্রব দরকার, তাদের ছায়া মাড়াতে পর্যন্ত রাজি নয় সে। সে করে বাম রাজনীতি। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। তাকে কে দেবে জয়েন করতে! বিসিএস দিতে অনীহা। করপোরেটের চাকরি করা যাবে না নীতিগতভাবে। এনজিও তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে?
অবশেষে এই গবেষণা সংস্থায় যোগ দেওয়া।
বেচারা মৃদুলা! পরিবারের অন্যদের কাছে তার মুখ দেখানোর আর কোনো সুযোগই রইল না।
মৃদুলার এই দুঃখ বোঝে সে। নিজেকে খুব অপরাধীও লাগে। কিন্তু কী করতে পারে সে? নিজেকে বদলানোর কোনো ইচ্ছা বা উপায় তার নেই। তার কাছে নিজেকে বদলানো আর নিজের হাতে নিজেকে মেরে ফেলা একই কথা।
তাই মৃদুলা তাকে অহোরাত্র লোকজনের সামনে অপমান-অপদস্থ করার চেষ্টা করলেও সে এটাকে মৃদুলার কষ্ট প্রশমনের পথ হিসেবে মেনে নেয়। কখনো-কখনো সহ্যের অতীত হয়ে যায় বটে, কখনো-কখনো তীব্র ক্রোধ জন্মে, কান্না পায়, মৃদুলার কাছ থেকে সরে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হয় না। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিয়ে শান্ত করে – আহা বেচারার খুব কষ্ট!
কিন্তু মায়ের দেখাদেখি ছেলেও যখন তাকে অবজ্ঞা করা শুরু করে, সেদিন সে মৃত্যুবরণের সমান কষ্ট পেয়েছিল।
আর এখন দ্যাখো, সেটাও তার সয়ে গেছে! সত্যিই সয়ে গেছে!
এরকম অদ্ভুত দাম্পত্য কীভাবে যে চলছে বছরের পর বছর! নিজের মা-বাবা, কিংবা ভাই-বোনও তার প্রতি খুব একটা সহানুভূতিশীল নয়। বাবা-মা তো স্পষ্টই অসন্তুষ্ট। তারা মনে করে ছেলে তাদের যথেষ্ট ভালোভাবে রাখছে না।
এই অবস্থাকে কী বলা যায়?
মতাদর্শের পার্থক্য না বলতে চাইলেও মানসিকতার দুস্তর ব্যবধান তো বলাই যায়।
কী পরিণতি যে অপেক্ষা করছে তার জন্যে?
নিজেকে গুটিয়ে রাখতে-রাখতেও হঠাৎ মাঝে-মাঝে মেলে ধরতে ইচ্ছা করে। পুত্রকে কাছে ডেকে গল্প করতে ইচ্ছা করে। একদিন ম্যাক্সিম গোর্কির কথা তুলেছিল। ছেলে ঠোঁট উল্টে বলেছিল – ও তো সমাজতন্ত্রের কথা। ওটা খুব পচা জিনিস। রাশিয়ার মানুষ রিজেক্ট করেছে।
সে আর্তস্বরে পুত্রকে বোঝানোর চেষ্টা করে – না বাবা, ম্যাক্সিম গোর্কি মানে কেবল সমাজতন্ত্র নয়। আর পৃথিবীর মানুষ গোর্কিকে ছুড়ে ফেলেনি আজো। ফেলবে না কোনোদিনও। তুই অন্তত মা 888sport alternative linkটা একবার পড়!
পুত্র শুনছে কি শুনছে না, তা না দেখেই সে 888sport alternative linkটির কথা বলতে শুরু করে।
888sport alternative linkটার নাম মা। মার একটি নাম আছে। পেলাগেয়া নিলভ্না। কিন্তু সেই নামটি উচ্চারিত হয়েছে পুরো 888sport alternative linkে মাত্র দুবার। বাকি সময় তিনি শুধু মা। নিতান্তই সাধারণ একজন গৃহিণী ছিলেন তিনি। স্বামী বেঁচে থাকতে সবসময় ভয়ে-ভয়ে থাকতেন। কারণ তার সঙ্গে কোনোদিনই মানবিক ব্যবহার করেনি স্বামী। ইচ্ছামতো মারধর করেছে, গালমন্দ করেছে। সেই জীবনকেই স্বাভাবিক জীবন হিসেবে ধরে নিয়ে তিনিও কোটি-কোটি রুশ রমণীর মতো নিজের জীবনকে কাটিয়ে দেওয়ার প্রস্ত্ততি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অন্যরকম হয়ে উঠতে হলো। হলো ছেলে পাভেলের কারণে। সাধারণ একজন মা থেকে বিশ্ববিপস্নবের মা হয়ে ওঠার যে বিবর্তন-চিহ্ন, সেই বিবর্তনই আসলে এই 888sport alternative link।
কেমন ছিলেন মা? কেমন ছিল মায়ের চেহারা? কোন ধারণাটি ফুটে উঠত মায়ের মুখের দিকে একবার মনোযোগের সঙ্গে তাকালে? ছেলে পাভেল যেদিন প্রথম পরিপূর্ণভাবে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল, বুকটা মুচড়ে উঠেছিল তার। মনে পড়েছিল, ‘বাবা বেঁচে থাকতে সারা বাড়ির মধ্যে মাকে যেন কোথাও দেখাই যেত না। মুখে একটিও কথা ছিল না, স্বামীর মারের ভয়ে সর্বক্ষণ যেন কাঁটা হয়ে থাকত। লম্বা দেহটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে খানিকটা; হাড়ভাঙা খাটুনি আর স্বামীর ঠ্যাঙানিতে শরীরটা গেছে ভেঙে। একেবারে নিঃশব্দে চলাফেরা-নড়াচড়া করে একপাশে একটু কাত হয়ে, যেন সর্বদাই কিসের সঙ্গে ধাক্কা খাবে এমন একটা ভয়। চওড়া-লম্বাটে ফোলা-ফোলা কোঁচকানো মুখ। তাতে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া ঘন ভীরু আর্ত চোখ, বস্তির আর দশটা মেয়ের মতোই। ডান ভুরুর ওপর দিকে একটা গভীর কাটা দাগ থাকায় ভুরুটা একটু ওপর দিকে টানা। মনে হয় ডান কানটাও বাঁ-কান থেকে কিছু ওপরে। এর ফলে, সর্বদাই যেন উদ্বেগের সঙ্গে কানখাড়া করে আছে এমনই একটা ভাব মুখে।
কারখানা-বস্তির অন্যসব তরুণের মতো শুরুর দিকে পাভেলও একই রকম জীবনযাপন শুরু করেছিল। এমনকি রোববার রাতে ভদকা খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরাও বাদ যেত না। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক, বিপস্নবী গোপন রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগের ফলে আমূল বদলে যায় পাভেলের জীবনযাপন। পরিবর্তিত হয়ে যায় তার মুখের ভাষাও। কারখানা-বস্তিতে নিজেদের মাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না কোনো যুবক। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে পাভেল। মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিনম্র ভাষায়। এমনকি বস্তির কেউ যা কল্পনাও করতে পারে না, সেই ঘটনাও ঘটে এই ঘরে। ছেলে কারখানার কাজ সেরে এসে ঘরের কাজে মাকে সাহায্যের জন্য হাত লাগায়। নিজেই ঘর ঝাঁট দেয়, নিজের বিছানা নিজেই গুছিয়ে রাখে। আর কাজের পরে বাইরে না বেরিয়ে ঘরে
বসে-বসে বই পড়ে। মা সব পরিবর্তনই খেয়াল করেন। খেয়াল করেন যে, ‘ছেলের মুখখানা দিনে-দিনে ধারালো হয়ে উঠছে, চোখদুটির গাম্ভীর্য বাড়ছে, আর ঠোঁটদুটি যেন একটি কঠিন রেখায় আশ্চর্য সংবদ্ধ।’
ছেলে যে অন্যদের চেয়ে অন্যরকম তা নিয়ে মায়ের খুশি এবং কৃতজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু ছেলে যে অন্যরকম কিছু কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত, এটা জানার পরে মা ভয় পেয়ে যান। সেই ভয় চরমে ওঠে যখন জানতে পারেন যে, ছেলে যেসব বই পড়ে সেগুলো নিষিদ্ধ বই, যাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তারা সবাই পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন ও বিপজ্জনক, যে গোপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সেই সংগঠনকে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে রেখেছে জারের পুলিশবাহিনী। সব মা-ই এই সময় যা করে, ছেলেকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা, এই 888sport alternative linkের মা সেই কাজটি করেননি। কারণ, মনে হয়েছিল, মনে হওয়ার পেছনে যথেষ্ট বাস্তব কারণও ছিল, যে – তার ছেলে কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না।
ছেলের কাজ দেখতে-দেখতে একসময় মা নিজের অজান্তেই ছেলের কাজের সহযোগী হয়ে দাঁড়ান। তার সম্পৃক্তির সূত্রপাতও ঘটে খুব সাধারণভাবে। তাদের বাড়িতে একদিন বৈঠকে বসে পাভেল ও তার সহযোদ্ধারা। সেই প্রথম মা দেখা ও চেনার সুযোগ পান পাভেলের সহযোগীদের। আন্দ্রেই ও নাতাশা বাইরের শহর থেকে আসে। আর অন্যরা মায়ের আগে থেকেই চেনা। দাগি চোর দানিলার ছেলে নিকোলাই, কারখানার পুরনো কর্মী সিজভের ভাইপো ফিওদর এবং কারখানার আরো দুজন পরিচিত শ্রমিক। তারপরে একের পর এক বৈঠক হতে থাকে তাদের ঘরে। আসতে থাকে সাশা, ইয়াকফ সোমভ, মাজিন, ইভান বুকিন, রিবিন, আরো অনেকে। তাদের খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন মা। চেষ্টা করেন তাদের আলোচনার বিষয়বস্ত্তগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে। তারপর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এরা খারাপ কোনো কিছু করছে না। এদের আলোচনা থেকে সাধারণ মানুষের যে-অবস্থার কথা বেরিয়ে আসে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই সেগুলোকে সত্যি বলে বুঝতে পারেন মা। এটাও বুঝতে পারেন যে এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য ওরা যে সংগ্রামের পথ ধরছে, সেই সংগ্রামেরও কোনো বিকল্প নেই।
কোনো-কোনো বিষয়ে একটু দ্বিমতও যে তার তৈরি হয় না, তা নয়। যেমন ধর্ম এবং ভগবান প্রসঙ্গে। যখন ওদের আলোচনা থেকে এমন মতামত বেরিয়ে আসে যে, ‘ধর্মটর্ম মিথ্যে’ তখন মা কথা না বলে পারেন না। দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রতিবাদ করেন – ‘দ্যাখো, ভগবান নিয়ে ও কথাগুলো একটু রয়ে-সয়ে বলো তোমরা… তোমাদের মনে যা খুশি থাক, কিন্তু আমার কথা ভেবো একবার। আমি বুড়োমানুষ। আমার দুঃখের মধ্যে ওইটুকুই তো ভরসা। ভগবানকে তোমরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে কোথায় দাঁড়াব আমি বলো তো?’
মায়ের এই অনুভূতিকে কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়নি।
বরং বলেছে – ‘পবিত্র স্থান কখনো শূন্য থাকে না। ভগবানের যেখানে আসন সেই জায়গাটা ক্ষতবিক্ষত। মানুষের হৃদয়ে ওটা ভারি ব্যথার জায়গা। ভগবানকে যদি বিলকুল বার করে দাও, তবে দগদগে ঘা হয়ে থাকবে ওখানটায়।’
এই বিপস্নবীদের নিয়ে চিন্তা করতে বসে তাদের মহত্ত্বে অভিভূত হয়ে পড়েন মা। নিজেকে বিশ্লেষণ করে মা বুঝতে পারেন যে, ‘আমরা শুধু ভালোবাসি নিজেদের যতটুকু দরকার, তার ওপরে যেতে পারিনে।… যেসব ছেলে জেলে পচছে, সাইবেরিয়ায় যাচ্ছে, কেন? না, দুনিয়ার মানুষের জন্য… জান দিচ্ছে সব। কচি-কচি মেয়েগুলো হিমের রাত্তিরে জল-কাদা-বরফ ভেঙে ক্রোশের পর ক্রোশ একলা হেঁটে শহর থেকে এখানে আসছে… কেন? কেন এত কষ্ট সয় ওরা? কে এসব করায় ওদের? না, ওদের বুকের ভেতর আছে খাঁটি ভালোবাসা।’
নিজেকে তাদের তুলনায় নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হয় তার। তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু আন্দ্রেই তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, মা যে ভূমিকা পালন করছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও প্রয়োজনীয়। কারণ, তার ভাষায় – ‘আমরা সবাই বৃষ্টির মতো। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ফসল ফলাবার কাজে লাগে’।
যথারীতি তাদের বাড়িতে পুলিশের হামলা হয়। খানাতলস্নvশি চলে গভীর রাতে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দ্রেইকে, যে মায়ের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তারপর একের পর এক ঘটতে থাকে ঘটনা। পাভেলও গ্রেফতার হয় এক পর্যায়ে। সেই সময় ছেলের কিছু-কিছু কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন মা। তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পুলিশবাহিনীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে নিষিদ্ধ পত্রিকা কারখানার মধ্যে নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে বিলি করা।
ছেলে এর মধ্যেই দু-তিনবার হাই তুলেছে। বলেছে – ঠিক আছে, বইটা আমাকে দিও, পড়ে দেখব।
ছেলে আর তার কথা শুনতে রাজি নয়। বুঝতে পেরেও সে কথা চালিয়ে যায়। ছেলে যেটুকু শোনে শুনুক। বাকিটুকু সে নিজেকেই শোনাতে থাকে।
নিষিদ্ধ পত্রিকা। তাতে সত্য কথা লেখা থাকে বলেই তা নিষিদ্ধ। খুবই বিপজ্জনক কাজ। কিন্তু মা সেই কাজ করে চলেন দ্বিধাহীন সাহসিকতার সঙ্গে।
অনিবার্যভাবেই পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয় মাকেও। কিন্তু মা ততদিনে জেনে গেছেন – ‘যে আত্মার নতুন করে জন্ম হয়েছে’ তাকে মারতে পারবে না কেউ-ই।
ছেলে এবার উঠে পড়ার উদ্যোগ করে – বইটা দিও। আমি উঠছি।
সে তখন চোখের সামনে কেবল দেখছে পাভেলের পরিবর্তন। পাভেলদের ‘রবিবারগুলোয় ছোকরারা অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফেরে ছেঁড়া কাপড়ে, সর্বাঙ্গে ধুলো-কাদা মাখা, কালশিটে-পড়া চোখ, জখমি নাক; কখনো আবার বন্ধুদের ঠেঙিয়ে এসে বিদ্বেষের সঙ্গে আস্ফালন করে, আর নয়তো গুঁতোনি খেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে আসে।’ বাপ মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে পাভেলও সেই রকম ভোদকা খেয়ে পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় বাড়িতে এসেছিল। বেতনের টাকা পেয়ে একটা অ্যাকর্ডিয়ন কিনেছিল, আর কড়া ইস্ত্রির কড়কড়ে শার্ট, জমকালো টাই, গালস, ছড়ি – ফুলবাবু সাজার সব উপকরণ। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেনে নিয়েছিলেন নিজের ভবিতব্য। এখানে সব পুরুষ যেমন অমানবিক হয়ে ওঠে, তার ছেলেও তেমনই হবে, এ আর নতুন কী! কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য নতুন ঘটনাটাই ঘটে পাভেলে জীবনে। কোনো এক সোনার কাঠির স্পর্শে আমূল বদলে যেতে থাকে পাভেল। ফুলবাবু সাজার খরচ কমতে থাকে, বাড়তে থাকে ঘরের তাকে বইয়ের 888sport free bet। বাদবাকি মাইনের টাকা পুরোটাই তুলে দেয় মায়ের হাতে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার ভাষাও বদলে গেছে আমূল। এমন সম্মান এবং ভালোবাসা মিশিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলে না
কারখানা-বস্তির কোনো ছেলে। মায়ের অতীত-জীবনের দুঃখের প্রতি সহানুভূতি জানায় না কোনো ছেলে। একা পাভেলই সেটা করে।
তিন
পুত্রের টেবিলে মাসের পর মাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা রেখে দিয়েছে সে। ছেলে ছুঁয়েও দ্যাখেনি।
সে এখন চে গুয়েভারার মু-ুর ছবিওয়ালা টি-শার্ট পরে করপোরেট অরণ্যে নিজের নিবাস খুঁজতে হন্যে হয়ে ছুটছে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.