মৃত্যুতেও তিনি মহীয়ান

রামেন্দু মজুমদার 

ভেরর সাড়ে তিনটার দিকে তিনি ঘুম থেকে জেগে গেলেন। উঠে বাথরুমে গেলেন। পানি খেলেন। পরিচারিকা কাছেই ছিল, টের পেয়ে জিজ্ঞেস করল কিছু লাগবে কিনা, শরীর খারাপ লাগছে কিনা। তিনি সব ঠিক আছে জানিয়ে ওকে শুতে বললেন। নিজেও আবার ঘুুমিয়ে পড়লেন। সেই ঘুম থেকে তিনি আর জাগলেন না। ভোর ছটায় পরিচারিকা তাঁকে ওষুধ খাওয়াতে এসে দেখে তিনি গভীর ঘুমে, হাত-পা সব হিমশীতল। কাউকে জানান না দিয়ে তিনি অনন্তলোকে চলে গেছেন। মুখে বিন্দুমাত্র কষ্টের চিহ্ন নেই। প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে মুখমন্ডলে। কী অসাধারণ ভঙ্গি তাঁর চলে যাওয়ার। কাউকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিলেন না। নিজেও কষ্ট পেলেন না। সারাজীবনের সুকৃতির ফলেই বোধহয় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এমন মৃত্যু অর্জন করেছিলেন। ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট তিনি ইংরেজিতে তাঁর একটি ইচ্ছাপত্র রচনা করেন। তার বয়ান এরকম :

Last Wishes

1. I would like to be buried promptly, definitely within seven or eight hours of my last breath. The members of my extended family and other dear ones can be informed over phone.

2. The namaje-janaja should be held in the nearest mosque. There should be only one janaja prayer and no more.

3. I would like to be buried in a public graveyard, at Azimpur or Banani or some such place, where another deceased could find his last resting place over my grave.

4. There should be no milad, qul-khani or challisha to mark my passing away. If it is considered necessary a Citizens Condolence/Memorial Meeting may be held, but that also can be dispersed with.

Why do I with these things? Perhaps a deep dislike for show and for formal routine group activity is increasingly gripping my heart. I sometimes think, why can’t I die like Tolstoy, not by the tracts of a rural railway station but perhaps by a lake in Dhaka’s Suburbs? But this in mere wishful thinking. However, my last wishes as expressed above are most genuinely and strongly felt ones, and I hope they will be honoured.

ওইদিন রাতে 888sport cricket BPL rateে টিভিতে পুনঃপ্রচারিত তাঁর একটি পুরনো সাক্ষাৎকারে দেখলাম তিনি বলছেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে যেন আনুষ্ঠানিক 888sport apk download apk latest version প্রদর্শনের জন্যে শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমী বা 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে না নেওয়া হয়। কারণ তিনি এসব আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী ছিলেন। সারাজীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন, তাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ও আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই শেষ-শয্যা নিতে চেয়েছিলেন। তিনি চাননি তাঁর কবর সংরক্ষিত হোক।

২০০৫ সালে তাঁর আত্মজীবনী নাই বা হলো পারে যাওয়ার ষষ্ঠ খন্ডের শেষে নিজেই তাঁর এপিটাফ রচনা করেছেন এভাবে :

‘কখনো করেনি আপস অশুভের সাথে

বীর না হলেও ভীরুতাকে কদাপি দেয়নি প্রশ্রয়

রয়েছে সতত অাঁকড়ে মহৎ আদর্শ মানবতার।

চৌদিকে যখন মৌলবাদী দানবের হিংস্র হুংকার

ধুলায় আচ্ছন্ন, যখন তাবৎ শুভ মূল্যবোধ

রীতির কপটবন্ধন সে তখনো অনায়াসে করেছে চুরমার \’

তবে এটাও বলেছেন কোনো ফলকে এ-লিপি উৎকীর্ণ হোক তিনি চাননি। ‘জলের আখরে’ কেউ হয়তো লিখে রাখবেন এসব কথা। উল্লেখ্য, এপিটাফের সব লাইনের প্রথম অক্ষর ওপর থেকে নিচে সাজালে তাঁর নামটি দেখতে পাই।

আশি বছর পেরোনোর পর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি প্রায়ই বলতেন, বয়সটা দেহের, মনের নয়। মনে তিনি তরুণই রয়ে গেছেন। তখন বাঁচতে চেয়েছিলেন আরো বছর দশেক, কারণ অনেক লেখার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

২০০৫ সালে সংবাদ পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন :

‘ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিষয়টি আমাকে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখে। সবাই বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে এবং একমুখী চিন্তাকে লালন করছে। বড় পৃথিবীতে যে যায়, বড় সমাজে যে প্রবেশ করতে চায়, তাকে বহুত্ববাদ ও সমন্বয়ের সাধনা করতে হয়। বহুত্ববাদী সমাজ গড়া খুব জরুরি, আমরা তা থেকে দূরে সরে আছি ও সরে যাচ্ছি। মানুষের সব ইচ্ছাকে কেন আমরা এক পথে নিয়ে যাব? কিছু মৌলিক মূল্যবোধকে অবশ্যই অাঁকড়ে ধরে রাখতে হবে, কিন্তু সেখানেও ভিন্নমত থাকলে তা নিয়ে আমরা আলাপ করবো, বিতর্কে লিপ্ত হবো, সৌজন্য ও সহনশীলতা বজায় রেখে তা করবো। ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার নীতি কখনো গ্রহণ করবো না।…

মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, শঙ্কাবোধ একদম করি না। চিরবিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হলে আমিও হাসিমুখে বিদায় নিতে চাই। আর মৃত্যুর পর আমি চাই না যে, কোনোরকম পাকা সমাধি হোক, শিলালিপি লেখা হোক, নাম-ধাম জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি কোথাও উৎকীর্ণ হোক। এসবের কোনো দরকার নেই। আমি এসব চাই না। আমাকে যদি মানুষ 888sport app download for android করতে চায়, মনে রাখতে চায়, তাহলে অনেকভাবেই তা করতে পারবে। আমার শিক্ষকতার কথা তারা 888sport app download for android করতে পারবে, আমার রচিত বই-পুঁথির কথা  তারা 888sport app download for android করতে পারবে, আমার মৌলবাদবিরোধী ভূমিকার কথা, আমাদের সুশীল সমাজকে অধিকতর শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আমার প্রয়াসের কথা 888sport app download for android করতে পারবে। এসবের মধ্য দিয়েই আমার 888sport sign up bonus বেঁচে থাকবে। যদি কেউ বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সেজন্যই আমি পাবলিক গ্রেভইয়ার্ডে সমাধিস্থ হতে চাই, সরকারি গোরস্তানে শেষ-শয্যা পাততে চাই। যেখানে বছর তিনেক পরে নতুন কবর হবে আমার কবরের উপরে।’

ভাবতে অবাক লাগে, এ-বয়সেও তিনি নিয়ম করে দিনে অন্তত আট ঘণ্টা লেখালেখি করতেন। বেশিরভাগই করতেন 888sport app download apk latest versionের কাজ। তিনি আবার একসঙ্গে দু-তিনটি গ্রন্থ 888sport app download apk latest versionে হাত দিতেন। তাঁর আগ্রহ ছিল নানা বিষয়ে। চিত্রকলা, 888sport app download apk, 888sport alternative link, নাটক, 888sport live – নানা বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মতো এত 888sport app download apk latest version বোধহয় আমাদের দেশে কেউ করেননি। তাঁর বাংলা থেকে ইংরেজি 888sport app download apk latest version গ্রন্থের 888sport free bet অর্ধশতাধিক এবং ইংরেজি থেকে বাংলা গ্রন্থ পঁচাত্তরের কম নয়। একদিকে যেমন তিনি 888sport appsের সহিত্যকে 888sport app download apk latest versionের মাধ্যমে বিদেশে পরিচিত করিয়েছেন, অপরদিকে বিশ্ব888sport live footballকে বাঙালি পাঠকের কাছে নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে তিনি চিন্তাশীল 888sport live রচনা করে গেছেন নিরলসভাবে। বিশেষ উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার অনুরোধে তিনি নিবন্ধ লিখেছেন, সারগর্ভ লিখিত বক্তৃতাও করেছেন অনেক। আগামী 888sport cricket BPL rateে বইমেলাতেও তাঁর  অন্তত দশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। অবিশ্বাস্য তাঁর কর্মক্ষমতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সাহচর্যে আসার। তখন মাঝে মাঝে মুনীর ভাইয়ের বাসায় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে দেখেছি। তিনি সে-সময়ে থাকতেন 888sport appর বাইরে, তাই তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে মুনীর ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমি কবীর ভাইয়ের (আমরা ডাকতাম মানিকভাই) খুব কাছে চলে আসি। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীতে তাঁর কক্ষে বসে আমরা প্রতিষ্ঠা করি থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আমৃত্যু সে-পদে থেকে আমাদের ধন্য করেছেন। ১৯৯০-তে যখন আমরা থিয়েটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করি, স্বাভাবিকভাবে তাঁকে আমরা অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করি। তিনি সানন্দে সে-দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু সে-পদে থেকে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন।

থিয়েটার সভাপতি হিসেবে তিনি দলের নানা সাফল্যে যেমন গর্বিত হয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, নানা সংকটেও আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গুণী মানুষের অবমাননা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না, দলের বিভিন্ন সভায় তাঁর এ-মানসিকতার প্রমাণ আমরা দেখেছি। তাঁর ও বেগম মেহের কবীরের অর্থানুকূল্যে আমরা ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর থিয়েটার থেকে মুনীর চৌধুরী সম্মাননা প্রদান করে আসছি। প্রতি বছর তিনি উপস্থিত থেকে প্রাপকের হাতে সম্মাননা তুলে দিয়েছেন। গত ২৭ নভেম্বর জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে তিনি মনোজ মিত্রের হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেন। সেটাই ছিল প্রকাশ্য সভায় তাঁর শেষ উপস্থিতি। সকালে যখন জানতে পারি তাঁর শরীর ভালো নয়, বুকের পেসমেকার বদল করতে হবে, আমি তার মেয়ে রীনুকে ফোন করে বললাম, তাঁর শরীর খারাপ থাকলে এ-অনুষ্ঠানে না এলেও চলবে কারণ প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম রয়েছেন। রীনু জবাব দিলো, অনুষ্ঠানে না যেতে পারলে আববার শরীর আরো খারাপ লাগবে। মেজমেয়ে বেনুর বর সেলিম  জাহানকে নিয়ে তিনি অনুষ্ঠানে এলেন এবং যথারীতি সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন, বক্তৃতা দিলেন। তিনি আমাদের থিয়েটার স্কুলের অধ্যক্ষ হলেও প্রতি ব্যাচেই পাশ্চাত্য নাটকের ইতিহাস, আধুনিক ভারতীয় নাটক ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। থিয়েটার স্কুলে ক্লাস নিয়ে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। মাসছয়েক ধরে তাঁর কষ্ট হবে বলে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম ছেলেমেয়েরা তাঁর বাসায় গিয়ে ওই ক্লাসটা করত। পড়ানো তিনি ছাড়তে চাননি।

তাঁর চিত্তের ঔদার্যের একটি দিক তুলে ধরে এ-888sport sign up bonus অর্পণ শেষ করব। তিনি যখন তাঁর গুলশানের বাড়িটা বিক্রি করেন তখন বেশকিছু টাকা পেয়েছিলেন। তা থেকে তিনি তিন মেয়ের জন্যে নয়াপল্টনে গাজী ভবনে তিনটি সুপরিসর ফ্ল্যাট কেনেন। কিছু টাকা নিজেদের চিকিৎসা ইত্যাদির জন্যে রেখে দিয়ে বাকি প্রায় এক কোটি টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করে দেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমী, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, থিয়েটার স্কুল, বারডেম, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রভৃতি। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে চেক প্রদানের সময় আমি তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম। তিনি কোনো বিত্তবান মানুষ ছিলেন না। বলতেন, ইনফ্লেশনের কারণে টাকা পেয়েছি, এটা তো আমি অর্জন করিনি। সবচেয়ে বড় কথা, এ-অর্থদানে তাঁর তিন কন্যার সানন্দ সম্মতি ছিল। যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা।

মেরী ভাবির (বেগম মেহের কবীর) জন্যে তাঁর ভালোবাসা ও যত্ন শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণণ ছিল। ভাবি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু সব কথা ভাবিকে জানাতেন, কী পোশাক পরেছেন বলতেন, হাতে হাত রেখে পাশাপাশি শুয়ে থাকতেন। মানিক ভাই চলে যাওয়ার পর ভাবি যে ধৈর্য দেখিয়েছেন, তা কল্পনাতীত।

যিনি এমন সুন্দরভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন,  অনন্তলোকেও তিনি নিশ্চয়ই অপার শান্তি লাভ করবেন।