ভরা বর্ষা! চারদিকে সবুজের উৎসব। গলিতে গলিতে সুগন্ধ। কোথাও কামিনী, কোথাও বা বেলি আবার কোথাও লেবু ফুলের গন্ধে ভরপুর চারিধার। প্রতিটি বাড়ির গেট সবুজে লতায় ছাওয়া। এমনকি বাড়িতে ঢোকার সদর দরজাটিও সবুজের দখলে। মেঘ মেঘ আকাশ। বৃষ্টি নামি নামি করছে। ধানমন্ডির এই গলিটায় বহুকাল বাদে এলেন ফয়সল হক সাহেব। গলির সমস্ত খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে যে বাড়িটিতে যেতে চান তারই ঠিকানা এখন মনে হচ্ছে ভুলে গেছেন। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন এমন কেউ ধারেকাছে নেই। তবু একবার ভেবে দেখলেন মৃতের বাড়ি যখন, লোকজন থাকবে। কান্নার শব্দ থাকবে। সেই সাথে থাকবে একটা গম্ভীর থমথমে আবহাওয়া। বার চারেক ঘুরেও এমন কোনো বাড়ি পেলেন না তিনি। অথচ গতকালই নিউজ ফিডে দেখেছেন তাঁর কলিগ অধ্যাপক প্রশান্ত দে মারা গিয়েছেন। সকাল সকাল বারিধারা হতে ছুটতে ছুটতে এসেও এখন 888sport sign up bonusর ভেতর থেকে বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আজ ড্রাইভারের ছুটির দিন। তাই মেট্রো ধরে আসা। শহর হতে রিকশা উঠে গেছে বহুকাল আগেই। তাই হেঁটে হেঁটে প্রায় ক্লান্ত ফয়সল হক সাহেব। রাতে খবরটি দেখার পর রিমেম্বার মেশিনে চাপ দেবার কথাও ভুলে গেছেন। ফলে সকালে ফোনটিও পকেটে পোরা হয়নি। নইলে তো অধ্যাপক প্রশান্ত দে হাউজ লিখলেই সমস্ত তথ্য হাজির হত স্ক্রিনে। তবু এই সাতষট্টি বছর বয়সে এসেও তিনি দিব্যি মনে করতে পারছেন লেকের শেষ মাথাতেই ছিল বাড়িটি। খুব দাদা দাদা সম্পর্কও ছিল ভেতর ভেতর। প্রশান্তদার বনসাই প্রীতি এতটাই তুঙ্গে ছিল যে নতুন কিছু পেলেই হইহই করে টেলিফোন করতেন। সে প্রায় বিশ বছর আগের কথা। ওহ! এখন তো বছরেরও হিসেব বদলে গেছে। বয়সের মতো দ্রুত ধাবমান 888sport free betর হিসেব। তিনি কুলিয়ে ওঠেন না সবটা। শুধু মনে হয় বিশ বছর আগে সব মানুষ জ্যামে নাস্তানাবুদ হতে হতে সরকারের পিণ্ডি চটকাতো। তবু কি বিপুল উৎসাহে ছুটে আসতেন ফয়সল সাহেব বামুন বৃক্ষ দর্শনে। অবশ্য আরো একটি আকর্ষণ ছিল বাড়িটিতে। ক্যান্সার গিলে খেয়েছে সে দুর্দান্ত প্রবল ছটফটে টান অনুভব করা মানুষটিকেও। দম নিলেন কিছুটা। একটি বাড়ির নিচে রঙিন দোলনা দুলছিল, সেখানে বসতেই পুরোনো কথারা জীবন্ত হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। যেন তারাও এই বর্ষার মতো সতেজ আর এক্ষুনি ঘটে যাওয়া সব কাণ্ড। যেন ওই তো রিকশা করে এসে নামলেন প্রশান্তদা। ওই, ওই তো দুহাতে টব আগলে ধরে নামছেন বনসাইপাগল মানুষটি। আড়ালে তাকে কেউ কেউ অবশ্য বামুনদা বলতো। দেখতে খাটোখুটো হলে কি হবে, বিদ্যে বোঝাই মাথা ছিল তাঁর। অমন চৌকস মাথা কম লোকেরই ছিল সে সময়। বৌদি ছিলেন সদাহাস্য মানুষ। গানের গলা ছিল জবাবহীন, শেখাতেনও ছায়ানটে। এখনো শুনতে পেলেন যেন বৌদি গাইছে… “আজি ঝড়ের রাতে বন্ধু আমার পরাণ সখা”… কি এক ধাক্কা লাগতো যে বুকে। সেই গানে, সেই টানে!
বৃষ্টিটা নামল। মাতাল বেগে ভিজিয়ে দিতে লাগলো ফয়সল সাহেবকে। সইবে না জানেন তবু ভিজতে লাগলেন। ফিরে যেতে মন চাইছে না তাঁর। এই যে এতকাল পরে এই পথে আসা তার সমস্ত না নিংড়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন না আজ। পরক্ষণে মনে হলো, বাড়ি খুঁজে পেলেও ঢুকতে পারবেন না সেখানে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাসওয়ার্ড নিয়ে নিতে হয় আগে থেকে। সেটি গেটে নির্দিষ্ট মেশিনে চাপলেই তবে খুলবে গেট। এরপর সেখানে হাউজ হোল্ডারের নাম উচ্চারণ করলে তবেই চালু হবে লিফট। সমস্ত সুনির্দিষ্ট করা। নাগরিক সুবিধা, সুখ আর সমৃদ্ধির বিপুল আয়োজন। এতসব মনে থাকছে না আজকাল ফয়সল সাহেবের। এমনকি নিজের বাড়ির ডোর লক পাসওয়ার্ডও ভুলে যান। এজন্য অবশ্য সাতদিনের একটি ট্রেনিং করতে হয়েছে তাঁকে। মগজের ব্যায়াম করেও কিছু ফল পাচ্ছেন না। ট্রেনিংটি করিয়েছিল যে মেয়েটি তার হাতের নেইল পলিশের রং ছাড়া কিছুই মনে করতে পারেন নি দুদিন। অদ্ভুত! মেয়েটি দেখতে অবিকল দিনার মতো। কি আপন লেগেছিল মনে পড়াতে মেয়ের মুখ। সে কথা বলতেই ইংরেজিতে ট্রেনার বলেছিল – ইটস্ ইয়োর প্রাইভেট মেমরি মি. হক। অথচ তাঁর কেমন কাঁপুনি এসেছিল দিনার মুখের মতো মুখ খুঁজে পেয়ে। এখনো কাঁপছেন তিনি সেই সুখ অনুভূতিতে। কিন্তু না তিনি তো ভিজে একসা। এ বয়সে হাড়ে কুলাবে না বৃষ্টি, বুঝলেন। তবু বৃষ্টিটা ধরে এলে আর একবার চেষ্টা করবেন, অন্তত দুটো গলি তো দেখবেনই যেখানে মৃত্যুর গন্ধ আছে। মৃত্যুর চিহ্ন আছে। এতদিনে নিশ্চই প্রশান্তদার বনসাইগুলো তাদের বয়সের চেয়েও বয়স্ক আর সুন্দর হয়ে উঠেছে। প্রশান্তদা ঠাট্টা করে বলতেন, “শোন এদের বয়স যত তত এদের রূপ যৌবন! এরা হলো চির যৌবনা! যত ভালোবাসবে তত সমৃদ্ধ হবে!”
সে সময় মেয়ের স্কুলে ভর্তি, গাড়ির সিকিউরিটি মেশিন, বাড়ির সিকিউরিটি রোবট ক্যামেরা, রেহানার লেডিস ক্লাবে ডোনেশন সবটা মিলিয়ে এত এত হামলেপড়া প্রবলেম মিটাতে গিয়ে কত কত সুখ কথা চলে গেছে কানের দুপাশ দিয়ে! কিছুই আর হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি। শুধু পাসওয়ার্ড আর পাসওয়ার্ড মনে রাখা তখন। শহরে তুমুল ভাঙন, বদলের বিপ্লব, তুখোড় তুখোড় মেশিনে সয়লাব। দেশের সব মানুষ অদ্ভুত এক সুখে ভাসছিল। হঠাৎ যেন মৃত কবরখানাও শোরগোল করে উঠেছিল তখন। এত এত সুখবাষ্প চারদিক এমন ভরাট করে ফেলেছিল যে ফয়সল সাহেব পাশের মানুষটিকেও দেখতে পেতো না ঠিকমতো। তিনিও চরম পুলকে আত্মহারা। এত সুখ! এত সাফল্য। এরপর অনেক হু-হু 888sport free betর গমন আর আগমন তাঁর জীবনে, সবার জীবনে তখন। সেই ঢালাও বদলের স্রোতে কখন যে চলে গেল সময়! যেন উধাও সমস্ত চিৎকার, অসন্তোষ, মিটিং, মিছিল, নির্বাচন, হরতাল, সরকার, বিরোধীপক্ষ, ভাঙচুর, গোলাগুলি, পুলিশের জলকামান – সব, সব এক কাল্পনিক যুগ বুঝিবা। ধূসর সমস্ত শব্দেরা! এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই। এক তিল সমস্যা নেই। কেবল মাত্র ফয়সল হকের মস্তিষ্ক জুড়ে মাঝে মাঝে প্রবল কামড়! যা কিছু মনে করতে পারেন, সেসব এক বাক্যে নাকচ করে দেন তাঁর ডক্টর। সেজন্য হালকা সবুজ রঙের একটি পিল তাঁর বেড ড্রয়ারে রাত সাড়ে নটার দিকে রোজ টিকটিক আওয়াজ করবে। তাই খেলে তবেই ঘুম। না খেলে মেশিন আওয়াজ বাড়িয়ে দেয়। শহরে এ নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। নেই কথোপকথন। অথচ আগে আলু – পেঁয়াজের দাম বাড়লেও বাসে, বাজারে, কত উৎকণ্ঠা, কত অনুযোগ! এই তো সেদিনের কথা! রাস্তায় বের হলেই ভিখিরির প্রশস্ত হাত। হকারের ডাক! চায়ের দোকানে ইলিশের দাম নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা। ডিমগুলো নকল কিনা তা নিয়ে কত সন্দেহ। সব কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল… আবার সেই কামড় খেলেন মগজের ভেতর। কোথাও কোনো মৃতের গন্ধ নেই। শোক নেই। এমনকি কাকেদেরও স্বজন কান্নার নেই কোনো দৃশ্য এ শহরে আর। মেট্রো স্টেশনের দিকে পা বাড়ালেন একমাত্র শোক পালন করতে আসা ফয়সল হক।
বাতাসে বেলির গন্ধ! সেই যেমন নীলা বৌদি চুলে গুঁজতেন! চায়ের ট্রে হাতে ঝুঁকলেই সে গন্ধ গিয়ে প্রবেশ করতো হৃদয়ে। বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠতো। আহা! যৌবন! অমৃত কাল!
এ সময়টা কাজের। ফলে পথে কোথাও মানুষজনের চলাচল নেই। মেট্রো আসতে সময় নিল না খুব একটা। কার্ড চেপে উঠে পড়লেন। সাঁইসাঁই করে সময়কে তাড়িয়ে এগুলো যখন মেট্রো, তখন আচমকা ফয়সল সাহেব দেখলেন একটি ফুটফুটে বাচ্চা তাঁর পাশেই বসা। বছর সাতেক হবে হয়তো। স্কুলড্রেস পরনে। চোখে চশমা। ফয়সল হক সাহেব আনন্দের আবেশে বলে বসলেন – হ্যালো, কেমন আছ? বাচ্চাটি তাঁর হাতের ঘড়িটির দিকে তাকিয়েছিল। সেখানে নয় নম্বরের 888sport free bet জ্বলজ্বল করছিল। মুহূর্তে নয় নম্বরে এসে মেট্রোর গেট খুলে গেল। বাচ্চাটি হালকা নীল রঙের জামা উড়িয়ে নেমে গেল। যেন শরতের আকাশ পলকে উধাও। একটিও বাক্যবিনিময় হলো না তাঁদের। শুধু রঙ কথা বলে, দৃশ্যরা কথা বলে। বলে বলে অস্থির করে তোলে ফয়সল হকের মস্তিষ্ক কোটর। আবার বৃষ্টির পাগলা নাচ সমস্ত জগৎজুড়ে। শহর ভিজতে লাগলো একা একা। মেট্রোতে খুব একটা যাতায়াত করেন না তিনি। অনেক নিয়মের বালাই। তাই মনে রাখেন না অনেক তথ্য। বারিধারা স্টেশনে নামতেই চালক মেশিন থেকে বের হওয়া একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। মুখটি তাঁর মেশিনের মতোই ধাতব কঠিন! কাগজে লেখা “ডোন্ট টক উইথ অ্যা বেবি”। জরিমানার তারিখ ও অর্থের পরিমাণ দেয়া রয়েছে নিচে। ফয়সল হক হো-হো হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রকাশ্য এই হাসিতে বারিধারা কম্পমান। শাস্তিপত্রটি হাতের মুঠোয় পুরে বাড়িতে ঢোকার পর থামল সে হাসি। তাঁর এই হাসি দেখার মতো আদতে কোথাও কোনো মানুষ ছিল না। সকলে যে যার কর্মস্থলে। বাহিরে কেউ না থাকলেও ঘরে এসে থামিয়ে দিলেন রোবোক্যামের জন্য। এমন ঠা-ঠা হাসি দেখতে পেলে সঙ্কেত পাঠিয়ে দেবে ডক্টরের ল্যাবে। এমনকি কাঁদলেও সে তৎপর কর্মীর মতো সঙ্কেত পাঠাবে। এরপর ব্রেন টেস্ট, স্টুল টেস্ট, ইউরিন টিউবে ভরা; সে এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার-স্যাপার। সেদিন দিনার কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা মনে পড়ে কাঁদতেই এই টেস্টের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে। হাসির একগাদা কৌতুক মনে পড়তে শুরু করে দিল হঠাৎ করে। জামা ছাড়তেই আবার হাসির ঝলক সারাদেহে। ধাঁই করে সহসা সোফার কচ্ছপ কুশনে মুখ গুঁজে দিলেন তিনি। দুহাতে কান ঢাকলেন। না কোনো মেশিনের কৃত্রিম আওয়াজ শুনতে চান না। কিন্তু তাঁকে ডেকে তুলতে বিকেলের নাস্তা মেশিন সুর তুললো। আজ তিনি নাছোড়ের মতো পড়ে রইলেন।
স্বাদহীন আলুর বল মেশিনে লাফিয়ে ঝাঁকিয়ে ঘুরতেই লাগলো। টানা পাঁচ মিনিট পর নিস্তব্ধ হলো আলুর ঝাঁকুনি। মেশিনে জমা হলো তথ্য। মিঃ ফয়সল হক আমাকে গ্রহণ করেননি। এরকম আরো দুটো তথ্য জমা হলেই ডক্টর হাজির হয়ে যাবেন। অথচ ফয়সল সাহেব লোহার মতো মুখের শক্ত আর কোদালের মতো দাঁতওয়ালা ডাক্তারের অনুপ্রবেশ চান না। গত চার বছর ধরে তাঁকে এইরকম রুটিনের চাকায় ঘুরতে হচ্ছে আলুর বলটির মতো। রেহানা মারা যাবার পর দিনা ডাবল ডাবল মেশিন বসিয়ে গেছে বাড়িতে। একমাত্র টেলিফোন বাদে সমস্ত মেশিন জীবন্ত। আঠারো তলার এ বাড়িটি রেহানার কত যে প্রিয় ছিল। তাঁদের ফ্ল্যাটের অ্যাকুরিয়ামে তখন রঙিন মাছের ঘরকন্না। আজ সেই মাছগুলো থাকলেও একটু তো প্রাণ থাকতো ঘরে। কিন্তু দিনা সে সব মাছ প্যাকেটে পুরে সোজা নিউজিল্যান্ড। মাছেরা নাকি কষ্ট পাবে একা একা! তারা নাকি ফিমেল ইমেজে সুখী হয়। দিনার প্রাণী প্রেমে আঘাত দেবার সাহস হয়নি সে সময়। প্রশান্তদা বুঝি এতক্ষণে পুড়ে মারা গেছেন। ওমা সেকি! প্রশান্তদা তো গতকাল রাতেই মারা গেছেন। কচ্ছপ আকৃতি কুশনটির সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। এতদিনে অভ্যস্ত ব্যবস্থা থেকে আজ বের হয়ে আসতে চাইছেন খুউব। খুউব।
– কচ্ছপের চোখ বিব্রত বুঝি।
– না না পাগল হইনি রে। আমি পাগল হইনি। আশ্রয় পাবার জন্য মরিয়া হয়ে বলে উঠলেন ফয়সল হক।
– আমি কি ন্যাংটা? ই ই করে দাঁত বের করে কচ্ছপকে দেখালেনও। এই দেখ রোজ দুবার করে দাঁত মাজি। পাগলেরা দাঁত মাজে না রে।
এই কথাগুলো বলার পর তিনি খানিকটা সুখ পেলেন। আরো সুখ পেলেন যখন দেখলেন সোফার ওই পারে বসে আছেন প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক প্রশান্তদা। হেসে হেসে বলে উঠলেন,
– কি বলেছিলাম না। এই যন্ত্রই তোদের খাবে। দেখলি তো। মিলিয়ে নিতে বলেছিলাম একদিন, দেশের ঘরে ঘরে জানালা খুলে আকাশ দেখতে ভুলে গেলে শিশুরা কথা বলাও ভুলে যাবে। ওরে ভাবছিস পুড়ে গেছি, না রে এখনো মর্গে আছি। বরফে ঠেসে রেখেছে। কাল ভিডিও করে দেখাবে ছেলেকে মরা মুখ। তবেই মুখাগ্নি!
হা – হতভম্ব! ফয়সল সাহেব দৌড়ে এসে ধরার চেষ্টাও করলেন তাঁকে। কিন্তু হাওয়ার ভেতর হাবুডুবু খেল কেবল তাঁর দুটি হাত। আবহাওয়ার মেশিন বলে দিচ্ছে, খুব বৃষ্টি হবে আগামী আরো তিন-চার দিন। সে যেন সতর্ক থাকে। বর্ষা এলে মুড়ি মাখা আর খিচুড়ি। জিভের ভেতর স্বাদ আর আনন্দ একসাথে সারা পড়ে গেল মুড়ি আর খিচুড়ি মনে পড়তেই। এই যে ভাবতে পারছেন এই নিয়ে 888sport live লিখে বছর দুই আগে তাঁর পড়ানোর পার্টটাইম কাজটাও চলে যায়। তিনি নাকি অবাস্তব জিনিস ছাত্রদের বোঝান। শুধু তাই না, তাঁকে নজরে রাখা আছে যেন এসব লিখে সিস্টেমে ভাইরাস ছড়াতে না পারেন। তবু তিনি দুপাতা করে লিখছেন। যতটুকু মনে পড়ে। সেই যে সেগুনবাগিচার বাসায় ছোট্ট বুকসেলফ। থরে থরে সাজানো 888sport app download apkর বই। তাঁর ভেতর রেহানার দেয়া ময়ূরের পাখা! সেসব দিনের কথা লিখছেন তিনি। ২০১৩ সাল! উত্তাল শাহবাগ। মশাল মিছিলে রেহানার উত্তপ্ত গাল! রাজাকার নিপাতের স্লোগানে শহরের দেয়ালগুলো লকলকে জিভ বের করে হুঙ্কার দিচ্ছিল….. তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা! ফাঁসি ফাঁসি…চাই…! সব ঝাপসা হয়ে তালগোল লেগে যায় তাঁর। সালগুলো দপ দপ করে জ্বলে মাথার ভেতর ১৯৫২, ১৯৭১, ২০১৩ …. ২০২৫ … ২০৬০ … নাকি ২০৯০! কিছুই মনে পড়ে না তাঁর। ইতিহাসের ডেটা খুলে পড়তে গিয়ে দেখেন একদিন সব ঝাপসা হয়ে গেছে। কবে নেট লাইব্রেরি, নেট হেলথ, নেট বিউটি, নেট শপিং এসমস্ত ডেটা জমে জমে মেমোরি খেয়ে ফেলেছে তা মোটেও টের পান নি।
রাতের খাবার ডাকছে। উঠে গিয়ে কোনমতে গিলে ফেললেন তিনি। সুবিন্যস্তভাবে মানুষের চাহিদামতো মেশিনে করে পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে খাদ্য। সেই যে বাজার গিয়ে দেখে দেখে মাছ কেনা, ডাঁসা ডাঁসা পটোল, শসা কেনা সবকিছুই এখন মেশিনের দখলে। নিটোল জীবন। না আছে ঝক্কি। না আছে ঝুঁকি। বাড়িঘর সমস্ত ঝকঝকে। কোথাও খুচরো অবসর নেই। রাজ্যের কমিউনিকেশন বিধি-ব্যবস্থা। কিন্তু কোথাও কোনো গা ঘেঁষা-ঘেঁষি নেই। তর্ক-বিতর্ক কিছুই নেই। ঠাসা-ঠাসি, সেই জন-মানুষের স্রোত পলকা বাতাসের মতো কি করে উবে গেল এ যেন রীতিমত বিস্ময়। ঘিলুর ভেতর জাবর কেটেই যাচ্ছে সেই সব ঘাম, ভিড়, কোলাহলের ইতিহাস। কিন্তু সেও ঝলকে ঝলকে। জোর দিয়ে করতে গেলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। যেন মাংসপেশিতে জ্বালা ধরে যায় তাঁর। এতদিনের অচল অনড় শরীর যে অভ্যেস গুছিয়ে নিয়েছে সে কি আর বিদ্রোহ মানে? ওদিকে ঘুমের ওষুধ তারস্বরে চেচিয়ে উঠছে। সেই চিৎকার থামিয়ে ওষুধ নিলেন তিনি। খুব সাবধানে রোবোক্যামকে ফাঁকি দিয়ে ঢোক গিলে আরাম করে বালিশে হেলান দিলেন। যতক্ষণ জেগে থাকবেন ততক্ষণই তো ভাবনা। মনে করা। কথা বলা। কবরের মতো নিস্তব্ধ বাড়িটি গিলে খাবার আগে তিনি ভেবে ভেবে লিখবেন, কি করে আবার মানুষ হাসতে পারবে, কাঁদতে পারবে, কথা বলতে পারবে সে সব কথা। আবার বদলের বিপ্লব। মানুষের কণ্ঠস্বর চারদিকে আবার কলরব তুলবে। সব লেখা চাই তাঁর। ফয়সল সাহেব কিছুতেই আর ধরা দেবেন না নিরাপত্তার কাছে। শহরের সবাই. দুনিয়ার সবাই অভিযোগ না করলেও তাঁকে অভিযোগ করতেই হবে। তাঁকে কথা বলতেই হবে। রাতের শেষ নিউজ ফিড দেয়ালে ভাসমান। ফয়সল হকের দৃষ্টি নিবদ্ধ তাতে।
– বনসাই ক্লাব অধ্যাপক প্রশান্ত দে-কে আজীবন সদস্য স্বীকৃতি প্রদান!
– মৃত্যুর যন্ত্রণা হতে মুক্তি দেবার যন্ত্র আবিষ্কার।
আহ! চোখ বুজে আসছে যেন ফয়সল হকের। কাল ঠিক কথা বলবেন, চিৎকার করবেন। হাসবেন। তার মস্তিষ্কে মরণ কামড় আসবার আগেই … ঘুমে তলিয়ে গেলেন ফয়সল হক সহসা। দেয়ালে তখনো ভাসমান নিউজ ফিড।
– শহরের ভয়ানক নাগরিক নিরাপত্তার হুমকি স্বরূপ একজনকে দেখা গিয়েছে। সকলকে সাবধান থাকতে বলা হচ্ছে।
– উন্নত মানুষের জিন আবিষ্কৃত।
পাঁচ মিনিটের খবর মেশিনে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। এর চেয়ে বেশি খবর দেখতে হলে দশ মিনিটের কার্ড প্রবেশ করাতে হবে। যা কিনা বয়স্ক মানুষের জন্য নিষিদ্ধ!
বৃষ্টিমুখর রাত শেষে আবার বৃষ্টি সকাল। বড় সুন্দর সকাল। অধ্যাপক ফয়সল হকের ঘুমন্ত শরীর স্ট্রেচারে তোলার সময় এই সকাল দেখার চেয়ে শুভ্র পোশাকে 888sport app মানুষটি দেখলেন সাবজেক্টের হাতের মুঠোয় ঘুমের পিলটি ঘাপটি মেরে আছে। পকেট থেকে ছোট্ট প্যাকেট নিয়ে তাতে পুরে দিল সে যত্ন করে পিলটি। নিরাপত্তার কারণে ডাক্তার রাতের খাবারেই ওষুধ মিশিয়ে পাঠাচ্ছেন গত কয়েকদিন ধরেই। নিয়মমাফিক এখন এই ঘুমন্ত শরীর সাদা অ্যাম্বুলেন্সে করে চলে যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কর্মীরা খুব তৎপর। অ্যাম্বুলেন্সটি ছুটে চলছে বৃষ্টির ভেতর। গাড়ির গতির চেয়েও দ্রুতগতিতে আঙুল চালিয়ে ডাটা প্যাডে লিখে যাচ্ছে দায়িত্বরত কর্মীটি।
সাবজেক্ট ইনফরমেশন :
বয়স : সাতষট্টি
ঘন কাঁচা-পাকা চুলের চৌকো মুখের ভেতর মাঝারি নাক।
ডান ভ্রুতে সামান্য চোটের দাগ।
লম্বা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। ফর্সা স্বাস্থ্যবান।
রোগ : অনর্থক হাসি। মস্তিষ্কেও গোলমাল। পর্যবেক্ষণ সময় : গত তিনদিন।
গাড়িটি বারিধারা ছেড়ে উত্তরা অভিমুখে ছুটছে। বৃষ্টির তোপে সাদা চিহ্নের মতো ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সটি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.