ফাঁকা একটা প্রথম শ্রেণীর কামরার ভিতর দিয়া আসিয়া জমিলা রকীবাকে ছোট্ট একটা কুঠুরীর ভিতর প্রায় ধাক্কা দিয়া ঢুকাইয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল। রকীবার পেটে পিঠে শাড়ীর নীচে চটের থলিতে সুপারী বাঁধা। হাতে মবিলের টিন। দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল। নিজের পেটের দিকে নজর পড়িতে মনে হইল যেন আট-নয় মাস। মেরা-জান যখন পেটে আসিয়াছিল, তখনকার কথা রকীবার মনে পড়িল। অনেক অনেক দিন আগের কথা। বুকের দুরু দুরু ভাব ছাপাইয়া কেমন যেন একটা শরমরাঙা অনুভূতি তাহার মনের অতলে শিহরণ জাগাইল।
দশটার গাড়ী ঝক্ ঝক্ করিয়া আগাইয়া চলিয়াছে। মানুষেরা হালে বাঁচিয়া থাকার জন্য এই নূতন জীবিকার পথে নামিয়া পড়ে। শুধু আজকের জন্য বাঁচিয়া থাকা, কালের ভরসা কাল। গরীবের শুধু দিনের দিন বাঁচা, ভবিষ্যৎ ত শুধু বড়লোকের। রকীবার অন্তরলোকের চিড় খাওয়া ভাবনা। রকীবার বুকে হাতুড়ি পেটার আওয়াজ। প্রাপ্তির হিসাব পাঁচটার গাড়ী নাভারণে ফিরিলে, এখন শুধু ভয়, মারধর আর জেলফাটকের ভয়।
জমিলারই মুখে শুনা ‘সব বেটাই না কি দু পয়সা করে খাচ্ছে’ – তা সাহেব সুবা-ই-হোক, আর মজুর ফকির-ই হোক। বেনাপোলে অনেকক্ষণ গাড়ী থামে। থামার কিছু পরেই জমিলা আসিয়া বলে, নেমে একটু হাঁটাহাঁটি কর!
রকীবা বলে – ভয় করে, যদি ধরে?
ধরবার হলে কি আর আমি-ই নামতাম? আর ধরলেই বা কি? ওষুধ জানা আছে। চার আনা, আট আনা, বড়জোর এক টাকাই নিল! আর তাই বা নেবে কেন? খেপে খেপে যে পেট ভরাই তাই বা কি এমনি নাকি। ধরবে কোন শালা!
প্রতি মুহূর্তেই রকীবা ভাবে, এই বুঝি একটা বিপত্তি বাধে।
গাড়ী থামিয়াছে ত থামিয়াই আছে। নড়িবার নাম করে না। ধরা যদি পড়ে ত কি হইবে? খুব নাকি মারধর করে। কিন্তু কতজনকে মারধর করিবে? জমিলাই দেখাইয়া দিয়াছে – উরা সবাই। জমিলার মত প্রৌঢ়া ত আছে-ই, বুড়া বুড়ি, ছেলে মেয়ে জোয়ান অগুণতি। ইহাদের ভরসাই বা কম কিসের।
গাড়ী ছাড়িবার আগেই জমিলা বলিয়া দিল – দেখ, ঘাটে ঘাটে গাড়ী থামবে, আমাদের দরকার মতই থামবে। এখান থেকে ছাড়ার পর, পয়লা দু’বারে নামবি না, তার পরের বার, বুঝলি?
রকীবা মাথা নাড়ে। এত বড় কলের গাড়ী যাহা গাঁয়ের পিসিডেন্ট কিম্বা থানার বড়বাবুও নাকি থামাইতে পারে না, তাহাকে নিজেদের কথা মত থামাইতে চালাইতে পারে যাহারা নিজেকে তাহাদের-ই একজন ভাবিয়া রকীবা গর্ব অনুভব করিতে লাগিল।
তৃতীয়বার গাড়ী থামার সঙ্গে সঙ্গে রকীবা টিন হাতে করিয়া নামিয়া পড়িল।
ফাঁকা মাঠ। অনেকগুলি নানা বয়সের মেয়ে পুরুষ নামিয়া ত্রস্ত পায়ে মাঠের মধ্য দিয়া চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। ছোট বড় সবগুলিকেই যেন মনে হয় ভরপেট। হাতে টিন।
রকীবা স্তব্ধ হইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। হঠাৎ পিছন হইতে জমিলা তাহার কনুই চাপিয়া ধরিয়া বলিল – চল, দাঁড়ালে চলবে না।
বনগাঁয়ে জিনিস বেচাকেনার কারবারটা নির্ঝঞ্ঝাট নয়। ভোগান্তি অনেক। যাহাদের মহাজন সঙ্গে – তাহাদের ত পোয়াবারো। আর যাওয়া আসার হাঙ্গামা যতটুকু রকীবা আঁচ করিয়া রাখিয়াছিল – আসলে তার সিকিও নয় – ভয় শুধু মনেই।
পাঁচটার গাড়ীতে রকীবা যখন ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার কোমরে গোঁজা কিছু-টা খুচরা পয়সা, আর টিনে ভর্তি সের চারি সরিষার তেল।
সেরে কমসে কম দেড় টাকা। রকীবা শুধু হিসাব করে। আঙুলের আঁকে আঁকে গুণিতে গিয়া তাল-গোল পাকাইয়া ফেলে।
ঘরে ফিরিবার সময় রকীবা যেন আর হাঁটিতে পারে না। অভূতপূর্ব একটা উত্তেজনা। দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করিয়া বেড়ান বা শুধু পেট-ভাতে রাতদিন গৃহস্থের বাড়ী খাটুনি, পান হইতে চুন খসিলে অকথ্য অত্যাচার সব কিছু যেন অনেকদিন আগেকার দেখা দুঃস্বপ্নের মত বলিয়া মনে হইতে লাগিল। হাওয়ালাদার বাড়ীর সেই কল্কী সেকার ঘা’টা পিঠের উপর অনুভব করিতে চেষ্টা করিল রকীবা। না, জ্বালা আর আছে বলিয়া মনে হয় না। দুই এক দিন পরেই সে মেরাজানের জন্য একখানা দশহাত শাড়ী কিনিয়া আনিবে। একটুকরা তেনা পরিয়া থাকে মেয়েটা। ভাল করিয়া পরিলে নয় হাতে হইবার নয়। আর যা বাড়ন্ত গড়ন। পাড়ার বদ ছোকরারা এখন হইতেই বদ-নজর দিবার চেষ্টায় আছে। বুকে বুকে আগলাইয়া রাখে রকীবা। মান ইজ্জত-ই যদি রাখা না যায় তবে দুনিয়ায় থাকিয়া কি লাভ? বজলটাকে লইয়াও চিন্তা কম নয়। ময়লা একটুকরা নেংটী পরিয়া সারাদিন টো টো করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ঘরে থাকিলে রকীবার প্রাণে শান্তি থাকে। মেরাকে দেখিবার একটা লোক থাকে। হোক না দুধের ছেলে। খোদাতালা যখন মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন, বজলের জন্য একটা লাল শার্ট আর একটা পেন্ট। পেটের দায়ে মেরাকেও ঘরে রাখা যায় না। একটা লোকের বাড়ী এটা সেটা কাজ কর্ম করিতে হয়। বাঁধা ধরা কিছু নয়, তবু রকীবার ভয় কাটে না! গায়ের ড্যাকরাগুলার যা রকম সকম।
মেরাজানের শাড়ী হইয়াছে। মাথায় নারিকেল তেল লাগিয়াছে। বজলের পেন্ট শার্ট সব কিছু।
দিন গড়াইয়া চলে। ধুকিয়া ধুকিয়া বাঁচার দিন নয়, পেট ভরা, বেশ হাসি খুসীর দ্রুত চলমান দিন।
কয়েকদিন যাইতেই, রকীবা একদিন কালের পিছন ফিরিয়া তাকায়। নিজের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়। ভাল করিয়া যেন বুঝিতে পারে না কি করিয়া বজল ও মেরা দুই জনেই মায়ের সঙ্গে কারবারে নামিয়া পড়িয়াছে। নেহাৎ যেন একটা গতানুগতিক ব্যাপার। তাহার প্রথম অভিযানের মত ইহাদের আসায় কোন বৈচিত্র নাই। মনে রাখিবার মত কিছু নয়।
তিনজনেই ভিন্ন ভিন্ন মহাজনের সঙ্গে ভিড়িয়া পড়িয়াছে। ঠিকা কাজে হাঙ্গামা যেমন কম, লাভও সেই অনুপাতে কম। তাই বা মন্দ কি, ঝক্কি সাত মহাজনের ঘাড়ে।
নয় দশ বছরের বজল। ভয়ানক চটপটে। টিন হাতে সরিষার তেল আনাটা যেন তাহার ধাতে সয় না। দুই একদিন টিন লইয়া চলিয়াছিল, কিন্তু তারপরই বাদ দিয়াছে, হয়ত মহাজনের নির্দেশে। ফিরিবার পথে লবণ লইয়া আসে। দ্বিতীয় বা মধ্যম শ্রেণীর বেঞ্চের তলায় – সের কয়েক লবণ বিছাইয়া দিয়া সরিয়া পড়ে। ধরা পড়িবার প্রশ্নই উঠে না। যায় ত শুধু মালই যাইবে। গাড়ী যখন চলে বজল তখন গাড়ীর তলায়, একটা লোহার রডের উপর অনেকগুলি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসিয়া বিড়ি টানে। লাল পাট সিল্পের একটা রুমাল গলায় বাঁধা, হাতে পিতলের একটা আংটি। কানে আধপোড়া বিড়ি। রকীবা যখন প্রথম শুনিল যে বজল গাড়ীর তলায় বসিয়া চলা ফিরা করে, ভয়ে তখন সে প্রায় কঁকাইয়া উঠিয়াছিল। বলা যায় না কখন কি হয়। বজল মায়ের কাছে কসম করিয়াছে যে, গাড়ীর ভিতর বসিয়াই সে যাওয়া আসা করিবে। কিন্তু গাড়ী যখন চলে তখন গাড়ীর নীচটা দেখিবার সুযোগ থাকে না বলিয়াই রকীবা ভাবে – মা-অন্তপ্রাণ ছেলে নিশ্চয়ই মায়ের কথা রাখিতেছে।
মেরাজানকে রকীবা চোখে চোখে রাখিতে চেষ্টা করে, কিন্তু সম্ভব আর হয় কই। বেনাপোলে গাড়ী থামিলেই রকীবা মেরাকে খবর করে। রকীবা প্রায়ই 888sport app download for android করাইয়া দেয় – দেখিস, ঐ ছোড়াগুলির সঙ্গে মিশবি না কিন্তু, বুঝলি? মেরা বুঝিয়াছে বলিয়া মাথা হেলায়।
আর শোন, ঐ যে সেপাইগুলো, তা বেনাপোলেরই হোক, আব বনগাঁয়েরই হোক, বুঝলি, সব বেটাই বদমাসের ধাড়ী। এই লাইনে সব শেয়ালের এক রা। খবরদার বলে দিলাম।
উঠতি বয়সের মেরাজান বুঝে সব কিছুই।
সরসপুর হইতে নাভারণ – অনেকখানি পথ। প্রত্যেকদিন এতটুকু পথ হাঁটিয়া গাড়ী ধরা সোজা কথা নয়। তাহা ছাড়া বৃষ্টি পড়িলে, রাত্রে ঘুমানো যায় না। ঝর ঝর করিয়া পানি পড়ে।
মেরা বলে – এখন ত আর সে রকম অভাব নেই, ঘরটাকে মেরামত কর।
সময় কোথায়? লোক লাগালে দু তিন দিন কামাই দিতে হয়। রকীবা নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জবাব দেয়।
সন্ধ্যার দিকে আর রকীবা ঘর হইতে বাহির হয় না। মাঝে মাঝে মোল্লা পাড়ার মজিদ আসে। অবস্থা মন্দ নয়। টিং টিং-এ চেহারা, শেয়ালের মত পিট পিটে ধূর্ত চোখ। সারা গায়ে পাঁচড়া নাকি, লোকে বলে খারাপ ব্যারাম। কোন জন্মের কুটুম্বিতা নাই, ঘেন্নাই করিয়াছে হয়ত এতদিন, এখন বলে – চাচি আছ কেমন? আর আড়চোখে মেরাজানের দিকে তাকায়।
রকীবার হুকুম আছে – ঐ ছোকরা মজিদ আসলে, খবরদার বলে দিলাম, ঘোমটা তুলবি না।
মেরা ঠোঁট বাঁকাইয়া বলে – তা এই খেয়োটাকে ঘরে ঢুকতে দিস কেন?
এই মজিদেরই জ¦ালায় আর ঝর ঝরে পচা চালের দৌলতে একদিন মেয়ে ও ছেলের হাত ধরিয়া, রকীবা নাভারণের তালেব মিয়া মহাজনের বারান্দায় আসিয়া উঠিল। তালেব মিয়ার-ই কাজ করে সে। এই লাইনে যাহারা কাজ করে তাহারা অনেকেই থাকে ইষ্টিশনে, প্লাটফরমে কিম্বা কোন দোকানের বারান্দায়, রকীবাই ছিল দূরে। গরীব বলিয়াই শুধু – গ্রামে এত লোকের মাঝে, নিজের ভিটায় থাকিয়াও ছিল নির্বান্ধব। ইহাদের মাঝে আসিয়া সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল। চারিদিকে শ’য় শ’য় যেন আপনার লোক। জমিলা, নন্দ, কুদরতের মা, জৈতুন এরা সবাই যেন কতকালের আত্মীয়। ব্যবসায়ীরা নাকি মিলিয়া মিশিয়া থাকিতে পারে না অথচ আশ্চর্য, তাহারা সকলে একই কারবার করে কিন্তু অভিন্ন আত্মা। সুখে দুঃখে খবর করে, লাইনে কোনদিন কোন অফিসার চলে, কোথায় কিভাবে টিপলে কি ফল পাওয়া যায়, সবাই সবাইকে বলে, দীল খুলিয়া আলাপ আলোচনা করে। আশে পাশে সারা রাতই প্রায় বাতি জ্বলে। খোলা বারান্দা, তবু যেন ভয় নাই আর। গাড়ী ধরারও নাই তাড়াহুড়া।
বয়স যেন আর তাপ রাখিতে পারিতেছে না। মেরার শরীরের গড়ন বয়সকে যেন পিছনে ফেলিয়াই আগাইয়া চলিয়াছে।
বেনাপোলে বনগাঁয়ে ঠোঁট লাল করিয়া পান খায় মেরাজান। রকীবার একদিন চোখে পড়িয়া গেল। দুইজন সেপাই মেরাজানের খুব কাছাকাছি দাঁড়াইয়া আছে। একজন বনগাঁয়ের আর অন্যজন বেনাপোলের। প্রায় সব সেপাইরই মুখ চিনে রকীবা। ইহাদের পাকিস্তান হিন্দুস্থান নাই, সব এক। একজন সেপাই হাত বাড়াইয়া কি যেন দেওয়া নেওয়া করিল মেরাজানের সাথে। সেপাই দুইটি সরিয়া যাইতেই রকীবা জোর পায়ে আগাইয়া গিয়া খপ করিয়া মেরাজানের চুলের মুঠি ধরিল।
মেরাজান চমকাইয়া উঠিল।
হিড় হিড় করিয়া লোহার বেড়াটার কাছে টানিয়া আনিয়া রকীবা চাপা গর্জন করিয়া উঠিল – হারামজাদী, এই সেপাই ষণ্ডা দুটোর সঙ্গে কি করছিলি?
মুখের উপর কোনদিন মেরা উত্তর দিত না, কিন্তু আজ দিল – তোর সব তাতেই সন্দ’। এত লোকের মাঝে চুল ধরে টানাটানি করিস না বলছি।
রকীবা যেন কিছুটা থতমত খাইয়া গেল।
মেরাজান ততক্ষণে সামলাইয়া লইয়াছে।
– বুড়ি হয়ে গেছিস, তাল মান টের পাস না। এদের সঙ্গে খাতির রাখতে হয়।
– তোর খাতির ধুয়ে পানি খা গে, যা। হাজার বার করে মানা করেছি হারামজাদীর কানে যায় না। ওই ড্যাকরা হাত বাড়িয়ে তোকে কি দিচ্ছিল?
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মেরা বোধ হয় উত্তর ঠিক করিল। – বাঃ রে ও আবার কি দেবে! পান কিনেছিলাম, ওরাই বলল পান খাওয়াতে। তাই দিয়ে দিলাম একটা। আমিই ত দিলাম। পুলিসের লোক আবার কাউকে কিছু দেয় নাকি কোনদিন?
– কাজ নাই বাপু পান খাওয়ানোর। একটু বুঝেসুঝে চলিস! রকীবা দরদ মিশাইয়া বলে।
মাঝে মাঝে, মাসে দুই মাসে, অনেকগুলি সেপাই আর বোর্ডার পুলিসের বড় সাহেবরা আসিয়া হানা দেন। ধর পাকড় হয়, মারধর লাগে, কিন্তু কপাল গুণে রকীবার কিছুই হয় নাই। একদিন ব্যবস্থাটা হইল বড় কড়ারকমের। 888sport app দিন আগে হইতেই কিছুটা আভাস পাওয়া যাইত, কিন্তু সেই দিন হঠাৎ যেন পৌষের আকাশে মেঘ ডাকিয়া উঠিল। গাড়ীর পিছন দিয়া নামিতেই, লোহার বেড়ার ওপর পাশের জঙ্গল হইতে অনেকগুলি সেপাই মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল। কয়জন বেড়া টপকাইয়া প্লাটফরমের ভিতর আসিয়া পড়িল। হাতে লাঠি, যাহাকে ধরে, তাহাকেই দুই এক ঘা লাগায়। হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছে। রকীবা স্তম্ভিতের মত পেটে বাঁধা সুপারীর থলিটার উপর হাত রাখিয়া পথ খুঁজিতে লাগিল। হঠাৎ নজরে পড়িল একজন সেপাই বজলকে দৌড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার পা-টা যেন বেড়ার মাথা অল্প স্পর্শ করিল মাত্র। রকীবার বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল, বজল ততক্ষণে বেড়ার অপর পাশে জঙ্গলের সাথে তালগোল পাকাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। হতভম্ভ রকীবা পাগলের মত বেড়ার দিকে দৌড়াইল কিন্তু পরক্ষণেই তাহার পিঠের উপরে লাঠির একটা প্রচণ্ড ঘা অনুভব করিল এবং সঙ্গে সঙ্গে পড়িয়া গেল।
সেই দিন আর রকীবার বনগাঁও যাওয়া হইল না। সুপারী, তেলের টিন, ট্যাকে যা কিছু ছিল সর্বস্ব দিয়া সে নিস্তার পাইল। রকীবার মাথা টন টন করিতেছে। পিঠে জ্বালা। হাত দিলে টের পাওয়া যায় পিঠের চামড়া যেন বাইন মাছের মত হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। প্লাটফরমের উপরই সে আঁচল বিছাইয়া শুইয়া পড়িল।
ফিরতি গাড়ীতে যাহারা বেনাপোলে নামিল তাহাদিগকে দেখিয়া রকীবার মনে হইল কেহই কমে নাই। 888sport app দিনের মত পুরা দলটাই যেন ফিরিয়া আসিয়াছে। ইহাদের সঙ্গেই মেরা ও বজল গাড়ী হইতে নামিল।
রকীবা ছুটিয়া গিয়া বজলকে বুকে জড়াইয়া ধরিল। পিঠে মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল – কোথাও লাগে নি ত রে?
কানের আধ পোড়া বিড়িটা ধরাইতে ধরাইতে বজল জওয়াব দিল – দূর, লাগবে কেন? দেখেছিলি না কি – আমার লাফ দেওয়াটা? বাবা, কত পেট্রিস করে শিখেছি! পুলিসের বাবার সাধ্য আছে ধরবে!
নাক দিয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া বীরের মত ভঙ্গী করে বজল।
ছেলের বীরত্বে রকীবাও যেন কিছুটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।
মেরা মায়ের কাছে আগাইয়া আসিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বলে, দেখি মা তোর কোথায় লাগল?
মায়ের পিঠে হাত বুলাইয়া সমবেদনায় যেন ককাইয়া উঠে। রকীবা চুপ করিয়া থাকে।
কিছুক্ষণ পর, মেরা আঙুলের ডগা হইতে বাড়তি চুনটুকু দাঁতে কাটিয় লইয়া, ঠোঁটটাকে একটু বাঁকাইয়া বলে – মা, তোরও যেমন, বললে ত শুনবি না, বলেছিলাম না, খাতিরে কাজ হয়। দেখলি, ধরতে পারল আমাকে!
রাগ করে রকীবা – ঝাড়ু মারি এমন খাতিরের মুখে। মুখপুড়ী, দাঁত সিটকাবি না বলছি।
তেরছা করিয়া হাসিয়া মেরা বলে – তা হলে পড়ে পড়ে মার খা’। যেমন আক্কেল।
বাড়ন্ত শরীরে একটা ঝাঁকানি দিয়া মেরা টিন হাতে লইয়া সরিয়া পড়ে।
তালেব মিয়া মহাজনের বারান্দায় শুইয়া শুইয়া রকীবা পিঠের ব্যথায় ককায় আর ষ্টেশনের দিকে চায়। ঘুম আসে না। বজল পাশে শুইয়া নাক ডাকাইতেছে। মেরাজান আজ আর ফিরে নাই। সেই যে বেনাপোলে দেখিল আর পাত্তা নাই। জমিলা, জৈতুন ইহাদের প্রায় সকলের কাছেই রকীবা খবর লইয়াছে কিন্তু সঠিক খোঁজ কেহই দিতে পারে নাই। যে ব্যাপারীর ঠিকায় মেরা কাজ করে তাহার লোকজনের কাছেও খবর লইয়াছে। মেরা নাকি নন্দর কাছেই বেনাপোলে মাল সমঝাইয়া দিয়া কোথায় সরিয়া পড়িয়াছে। নন্দকেও খুঁজিয়া পায় নাই রকীবা। সে নাকি কিছুটা বাড়তি লবণ আনিয়াছিল তাহাই লইয়া একেবারে যশোর চলিয়া গিয়াছে। নাভারণের কাজটা ঠিকমতই সারিয়া দিয়া গিয়াছে। বেশ লেখাপড়া জানা ছেলে নন্দ, কিন্তু কেমন যেন পাগলাটে পাগলাটে।
রাত যতই বাড়িতে লাগিল, পিঠের ব্যথা ছাপাইয়া ততই মেরাজানের অন্য রকীবার দুশ্চিন্তা বাড়িতে লাগিল। যদি খারাপ লোকের পাল্লায় পড়িয়া থাকে; কাষ্টমের অফিসারগুলি একদিক হইতে মন্দ নয়। ইহাদের লইয়া বড় মাথা ঘামায় না। তাহারা আছে তাহাদের তালে। গাড়ী শুধু তাল্লাশীই করে। কি যে পায় তাহারাই জানে। খুব ভাল লোক কি না তাই বা কে বলিতে পারে? সন্দেহ জাগে রকীবার মনে। ব্যাপারী দালালদের সঙ্গে হয়ত যোগসাজস আছে, তাই কিছু করে না। কিন্তু ঐ যে সেপাইগুলি, তা বনগাঁয়েরই হউক আর বেনাপোলেরই হউক ভালোর ভালো আর খারাপের খারাপ। দুই দেশের হিন্দু মুসলমানে এত যে মারামারি কাটাকাটি, ইহাদের কাছে তাহা কিছু নয়। কেমন মিল ঝিল। খাও দাও আর ফুর্তি কর, মাঝে মাঝে শুধু ছটার্বদারী আর পয়সা কুড়ানো। কোন মেয়ের গতরটা একটু ভাল তাই খোঁজ নেওয়া; তা এপারেই হউক আর ওপারেই হউক। অবশ্য সাতে সতেরয় একদিন বড় সাহেবরা আসিলে তোড়জোড় করিয়া লাঠির র্কেদানী দেখানো, ইহাদিগকে বিশ্বাস করা যায় না। বদমায়েসের হাড্ডি সব। বিয়ে শাদী একটা মেরার না দিলে, মানইজ্জত আর রাখা যাইবে না। বিবাহের প্রশ্নে যেন রকীবার মনে অনেকটা স্বস্তি জাগে। দুই একদিন কথাটা কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনাও করিয়াছিল কিন্তু এক নন্দ ছাড়া সবাই বলে আরও বড় হোক। ছেলেটা লেখাপড়া জানে মনে হয়, বড় বড় কথা বলে বোধ হয় বই পুথির শেখা কথা। একদিন নিজেই সে বলিয়াছিল – চাচি, তোর মেহেরকে বিয়ে দে। হিন্দু মুসলমান যাই হোক, ছেলে একটা হলেই হল। আমাদের আবার জাত বেজাত কি? আগের কালে হিন্দুদের কাজ দিয়ে জাত ঠিক হত। কিছুদিন পর দেখবি – বনগাঁ বেনাপোলের আমরা সবাই একজাত হয়ে গেছি। আমার ছেলে বা নাতির নাম হবে – অমুক চন্দ্র স্মাগলার। এমনি সব পাগলাটে কথা। সব কথা গুছাইয়া রকীবার মনে পড়ে না। কিন্তু যে যাহাই বলুক মেয়ের শাদী বলিয়া কথা – জাত বেজাতের প্রশ্ন আসে বৈ কি! জাতধর্ম ত আর দেশ হইতে উঠিয়া যায় নাই, এখনও চান্দ সুরুজ উঠে। রকীবা ভাবে, নন্দর সঙ্গেই ব্যাপারটা লইয়া কাল আরেকবার আলোচনা করিবে।
রাত তিনটার গাড়ীর ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রকীবা উঠিয়া ষ্টেশনের দিকে পা বাড়াইল। এই গাড়ীতেও মেরা আসিতে পারে।
আসুক হারামজাদি আজ। এত রাত বাইরে থাকা বার করছি। রকীবা মনে মনে গরজায়।
মেরা সত্য সত্যই গাড়ী হইতে নামিল। ঢুলু ঢুলু চোখ, শ্লথ গতি। কেমন যেন খোঁড়ার মত পা টানিয়া প্লাটফরমের বাহির হইয়া আসিল। রকীবা একটু অন্ধকার জায়গায় দাঁড়াইয়াছিল। মেরা বাহিরে আসিতেই খপ করিয়া খোঁপাটা চাপিয়া ধরিয়া চাপা গলায় গরজাইয়া উঠিল।
হারামজাদি, বল, কোথায় ছিলি?
মেরা বোধ হয় এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুতই ছিল, ভড়কাইল না। বরঞ্চ বেশ তিক্ত গলায়ই জবাব দিল – যেখানেই থাকি, তোর কি?
রকীবার মাথায় যেন খুন চড়িল। চটপট পিঠে মাথায় কিল চড় চালাইতে সুরু করিল।
হারামজাদী খান্কী, মান ইজ্জত আর রাখলি না।
মেরা ফোঁপাইতে ছিল, ঘোঁৎ করিয়া উঠিল – ও বড় ইজ্জতওয়ালীরে। চোরাই কারবার করেন – আবার মান!
কথা কইস না হারামজাদী, সারাদিন ছিনালী করে আবার তেজ দেখায়। খবরদার আমাকে আর মা বলে ডাকবি না। বারান্দায় আর উঠবি ত তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
দপ দপ করিয়া পা ফেলিয়া নিজের জায়গায় গিয়া চুপ করিয়া শুইয়া পড়িল। মেয়ের চরিত্রহীনতার অপমানে সারা অঙ্গে যেন সে বিছুটির জ্বালা অনুভব করিতেছে। এমন মেয়ে পেটে ধরিয়াছিল বলিয়া নিজের সত্তাটাই যেন অপবিত্রতার গ্লানিতে কালো হইয়া উঠিতেছে।
অনেকক্ষণ পর টের পাইল মেরা আসিয়া ছোট ভাইয়ের কাছে শুইয়া পড়িয়াছে। রকীবা চোখ মেলিল না, একটা বোবা করুণা যেন আবসাদের আকারে তাহাকে চাপিয়া ধরিয়া ঝিম লাগাইয়া দিয়াছে। সে নড়িতেও পারিল না।
একখানা হাত রকীবার পিঠে পড়িল। ফোলা জায়গাটায় মেরা হাত বুলাইতেছে। কাচের চুড়িগুলি টুন টান করিয়া বাজিল। রকীবা নির্জীবের মতই চুপ করিয়া রহিল।
এই মা ঘুমিয়ে পড়েছিস?
রকীবা চুপ।
খুব লেগেছিল, নারে?
রকীবা উঃ করিয়া শব্দ করিল।
জানিস মা, ওই যে কপালে মোটা আঁচিলওলা সাদেক আর বনগ্রামের সুবেন্দ্র, তারা বলেছে আমাদের কোন ভয় নেই। বিপদে আপদে তারাই দেখবে।
পেট্রলের মধ্যে জ¦লন্ত দেয়াশলাইর কাঠি ফেলিয়া দিলে যে ভাবে দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, রকীবার মগজও যেন সেইভাবে জ্বলিয়া উঠিল। অন্ধকারে হাত নাড়ার সময় একটা আধ-পোড়া চেলার গায়ে হাত লাগিয়াছিল – নিঃশব্দে তাহাই তুলিয়া দমাদম মেরাজানের উপর চালাইতে লাগিল। চীৎকার করিয়া মেরা অন্ধকারের ভেতর যেন মিশিয়া গেল। ঘুমন্ত বজলের উপরও দুই এক ঘা পড়িয়াছিল, সেও কাঁদিয়া উঠিল। রকীবা সুর তুলিয়া অশ্রাব্য ভাষায় মেরার উদ্দেশ্যে গালি পাড়িতে লাগিল। সোরগোলে লোকজন উঠিয়া পড়িয়াছিল, তাহারা আসিয়া জোট পাকাইল। রকীবাকে বোঝাইল সুঝাইল।
বাকী রাতটুকু রকীবা আর ঘুমাইতে পারিল না। বজলকে বুকের মাঝে চাপিয়া ধরিয়া পড়িয়া রহিল। চোখ দিয়া পানি পড়িতে লাগিল। কিসের দুঃখ তাহার? রকীবার নিজের মনকেই যেন প্রশ্ন করে। যে মেয়ে মান ইজ্জতের ধার ধারে না, তাহার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক! সে যেখানে খুশী যাক রকীবা আর তাহার মুখ দেখিবে না। মেয়ের ইজ্জত বন্ধক দিয়া পয়সা রোজগার করিবার আগে যেন তাহার মরণ হয়। মেরাজান তাহার মেয়ে নয়। কোন খান্কীর মেয়ে হয়ত ভুল করিয়া আসিয়া তাহার পেটে জুটিয়াছিল কে জানে! ভোরের দিকে রকীবার চোখ দুইটা জড়াইয়া আসিল।
চলতি গাড়ীতে বসিয়া প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া সুখ দুঃখের কথা হয়। একদিন জমিলা বলে, মেরাকে কি সত্যি বিদায় করে দিলি নাকি? এ লাইনে এসব ধরলে চলে না। হাজার হোক পেটের মেয়ে ত! বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ধন।
গুম হয়ে থাকে রকীবা কিছুক্ষণ, তারপর শান্তকণ্ঠে বলে – একটা কথা এতদিন তোকে বলেনি বু’, মেরা আমার পেটের মেয়ে নয়। বিন্নার ঝোপে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।
শেষের কথাগুলি খুব কষ্টে উচ্চারণ করে রকীবা। গাড়ী চলার খট খট শব্দে গলার আওয়াজের বিকৃতি হয় ত জমিলা ধরিতে পারে নাই।
শাড়ীর আঁচল দিয়া রকীবা দুই চোখ চাপিয়া ধরে। এক গাড়ী লোক। পায়ে পায়ে ঠাসা।
একটা ককাইয়া ওঠার শব্দ জমিলার কানে যাইতেই সে ব্যগ্র হইয়া প্রশ্ন করিল – কি হল রকীবা?
আঁচলের মধ্যেই মুখ রাখিয়া রকীবা জবাব দিল – কিছু না, চোখে কয়লা পড়েছে।
তালেব মিয়া মহাজনের বারাণ্ডায় শুইয়া রাতের আঁধারে বজলকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া রকীবা চোখের পানি ফেলে। আঁচল আর চাপা দিতে হয় না। মেরা গেছে – যাক। বজল তাহার সোনা মানিক। ঘুমন্ত বজলের মুখটা নিজের বুকের উপর চাপিয়া ধরে। যেন কোলের শিশুকে দুধ খাওয়াইতেছে।
একদিন বেনাপোলের ডিষ্ট্যান্ট সিগনালের কাছে গাড়ীটা
থামিতেই হৈ হৈ একটা রব উঠিল। একটি ছেলে কাটা পড়িয়াছে। নীচের রডে বসিয়া আরেকটি ছেলের সঙ্গে বিড়ি লইয়া ঝগড়া করিতেছিল, ফল যাহা হইবার হইয়াছে। এতগুলি লোকের মুখে মুখে ছেলেটার পরিচয় তালগোল পাকাইয়া হোঁচট খাইতে খাইতে রকীবার কানে যখন পৌঁছিল তখন গাড়ী চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। শফিক, মনীন্দ্র, না হয় বজল। এই তিনজনের মধ্যেই একজনের। ঘটনা ঘটিয়াছে দুই দেশের সীমানায় পাথরটার কাছে। তেলের টিনটা হাতে লইয়া রকীবা পাথরের মত দাঁড়াইয়া রহিল। যে যাহার জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করিয়া উঠিয়া পড়িল। চলন্ত গাড়ী হইতে কয়েকটি কণ্ঠ চীৎকার করিয়া উঠিল – ও রকীবা, তাড়াতাড়ি উঠ। জলদি কর। রকীবা পাথর।
গাড়ীটা যখন অনেকখানি আগাইয়া গেল রকীবা তখন হাতের টিনটা সেইখানেই ফেলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে লাইন ধরিয়া বনগাঁয়ের দিকে দৌড়াইতে আরম্ভ করিল।
শুধু রক্ত আর রক্ত।
মানুষ বলিয়া চিনিবার যো নাই। থেঁতলাইয়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া বীভৎস আকার ধারণ করিয়াছে। মনীন্দ্রেরও হইতে পারে, শফিকেরও হইতে পারে। হঠাৎ নজরে পড়িল একখানা অক্ষুণ্ন হাত আর সেই হাতের আঙুলে পিতলের আংটি। রকীবা আর কিছুই টের পাইল না শুধু সমস্ত রেল লাইনটা যেন ঘুরিতে ঘুরিতে একটা রক্তের বন্যার মত আসিয়া তাহাকে ভাসাইয়া লইয়া গেল!
পাশের গ্রামের একটা পড়ো দালানের দাওয়ায় অসুস্থ অবস্থায় কয়দিন পড়িয়া রহিয়াছিল রকীবা। হয়ত কোন সহৃদয় গ্রামবাসী লাইন হইতে উঠাইয়া আনিয়াছে। টের পায় নাই।
রকীবা ভাবে, মেরাজান খবর পাইলে নিশ্চয়ই ছুটিয়া আসিত; কিন্তু পরমুহূর্তেই মনের গলাটা টিপিয়া ধরিয়া ভাবনাটার দম বন্ধ করিয়া মারিতে চায়। না, না, মেহেরজান বলিয়া কেহ তাহার কোন দিন ছিলই না। ধুকিয়া ধুকিয়া মরিবে – সেও ভাল।
ট্যাঁকে যে কয়টা টাকা ছিল তাহাও আর খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। এই কয়দিনেই যেন বয়স তাহার দশ পনর বৎসর বাড়িয়া গিয়াছে। পিঠটা বাঁকা হইয়া সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। ভর না দিয়া ভাল করিয়া চলিতে পারে না। রাস্তার পাশ হইতে একটা বাঁশের টুকরা কুড়াইয়া লইয়া, রকীবা – কোণাকোণি পথে ভিক্ষা করিয়া করিয়া তিনদিনে সরসপুরে আসিয়া পৌঁছিল।
নিজের ঘরটার শুধু ভিটার চিহ্ন আছে আর কিছুই নাই, একটা পোতা। ক্লাস্ত রকীবা পোতার ওপর বসিয়া পড়িয়া বজলের মৃত্যুর পর এই প্রথম চোখের পানি ফেলিল।
কাজ লইবার আশায় বাড়ী বাড়ী ঘুরিয়া ফিরিল। যেখানেই যায় সেইখানেই প্রশ্ন হয় – বলি রকীবা, তোর মেরা আর বজল কোথায়?
নোংরা ছেঁড়া আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া রকীবা উত্তর দেয় – মরে গেছে।
আহা-হা, কি করে ম’ল?
গাড়ীতে কাটা পড়ে।
সবাই আহা-হা বলে, কিন্তু চাকুরী দেয় না কেহই। হয়ত বা সাত কলস পানি আর দুইটা ঘর লেপানোর বদলে দেয় আধ থালা পান্তা। ভাত মুখে রুচে না তবু ভুখের মুখে জোর করিয়া গিলে।
মজিদ একদিন বলে – ও চাচি, তুই যে বলিল মেরাজান মারা গেছে – তা যে সেদিন দেখে এলুম বনগাঁয়ে। কি সুন্দর যে লাগল – কি করে বোঝাই, যেন ভদ্দরলোকের মেয়ে। তা ব্যাপারখানা কি, বল দিখি!
রকীবা ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চায় যেন সে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পর সে উত্তর দেয় – তা বাবা, এতলোকের মাঝে কাকে কি দেখলে তার ঠিক নেই আর বলছ আমার মেরা। আমার মেরা যদি –
কথাগুলি বলিতে বুকটা ফাটিয়া যাইতেছিল, হঠাৎ হাউ হাউ করিয়া রকীবা কাঁদিয়া উঠিল।
মজিদ থতমত খাইয়া রকীবার পিঠে হাত দিয়া বলিল – কেঁদে কি হবে চাচি, – আল্লার মর্জি।
মজিদ ভাবে, হয়ত তাহার নিজেরই ভুল হইয়াছে। এত মেয়েছেলের মাঝে কোথাকার কাকে দেখিয়া সে হয়ত ভুল করিয়া বসিয়াছে।
শরীরটা যেন সারিয়াছে কিন্তু আগের মত যেন আর বল পাওয়া যায় না। বড় ক্লান্ত মনে হয়।
শুধু দুই মুঠো পান্তাভাতের বদলে এত খাটনী আর রকীবার সহ্য হয় না। না খাইতে পাইলে শরীর সারিবে কি করিয়া। তবু মরি বাঁচি করিয়া দিন কাটাইয়া দেয়! দীর্ঘ, ক্লান্ত, খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া চলা দিন।
শরীফ মোল্লাদের মস্ত বড় খামার। অর্ধেক রাত্রি জাগিয়া রকীবা তাহাদের প্রায় পনর বিশ টিন ধান একা সিদ্ধ করিয়াছে। পরদিন রৌদ্র উঠিতেই উঠানে মেলিয়া দিয়া সে লম্বা বাঁশে হাঁস মোরগ তাড়াইতেছে। সকাল হইতে পেটে কিছু পড়ে নাই, তার উপরে ভ্যাপসা গরম। রকীবার একসময় ঝিমানি আসিল।
হঠাৎ মাথায় একটা প্রবল ধাক্কা অনুভব করিয়া ব্যাপারটা বুঝিবার আগেই টের পাইল পেটে পিঠে লাথি পড়িতেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর মালিকের তৃতীয় বউয়ের গর্জন –
বুড়ী মাগী, কাইর কাই ভাত খায় আর পড়ে ঘুমায়। নাক ডাকায়। রাজ্যের সব মোরগ এসে আমার সব উজার করে দিল সে হুঁস নাই।
রকীবার কপাল কাটিয়া তখন রক্ত চুয়াইতেছে।
স্লথ পায়ে রকীবা বাড়ীর বাহিরে আসিয়া কাঁঠাল গাছটার নীচে স্তব্ধ হইয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। একটা লোক সমবেদনা জানাইল না বা ফিরিয়া ডাকিলও না। তারপর এক সময় রকীবা রাস্তা ধরিল। কপালের রক্তের ক্ষীণ ধারাটি যেন তাহাকে লোহার লাইন পাথর আর সিøপারের উপর ভাসিয়া যাওয়া কোন বৃহত্তর রক্তধারার দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
বজল গিয়াছে – সেও যাইবে! কিন্তু মেরা গেল না কেন? সেও হয়ত গিয়াছে, কে জানে? কথাটার নৈঃশব্দিক উচ্চারণেই যেন তাহার মন গোঙাইয়া উঠিল। বালাই ষাট্, মরিবে কেন – বাঁচিয়াই থাক! ছিনাল বেশ্যার পেশা লইয়া যদি পেট চালাইতে পারে – তবে তাহাই করুক। রকীবার তাহাতে কি? মেয়ে বলিয়া স্বীকার না করিলেই হইল। মেরা তাহার কে? কিছু না। বিন্না ঝোপে পাওয়া – পালিতা মেয়ে।
প্রথম যৌবনের প্রথম পোয়াতি রকীবা মেরাকে পেটে ধরিয়া যে অস্বস্তি অনুভব করিত তেমনি একটা উপলব্ধির 888sport app download for androidে তাহার চোখ ফাটিয়া পানি ছুটিল। কপালে হাত চাপা দিয়া সে ষ্টেশনের পথেই চলিতে লাগিল। নিশি পাওয়া পদক্ষেপে।
একটা পেট বইত নয়। না হয় মহাজনকে বলিয়া কহিয়া দুই তিন দিনে একবার খেপ দিবে। খোদার রাজ্যে বিচার যখন উঠিয়াই গিয়াছে, গতর থাকিতে যখন খাটিয়াও মানুষের মত মোটা ভাতে মোটা কাপড়ে বাঁচিয়া থাকা যায় না, তখন ওই চুরির পথই ভাল। যে পথে বজল গিয়াছে, সেই পথে সেও যাইবে। পেট ভরা থাকিলে লাথিটা চড়টাও খাওয়া যায়। রক্ত যদি ঝরে, তবে চুয়াইয়া চুয়াইয়া ঝরিবে কেন – গল গল ধারেই ঝরুক। সঙ্গে সব শেষ হইয়া যাক। কিন্তু এই অবস্থা দেখিয়া মেরাজান যদি আগাইয়া আসে? বলে তোকে কিচ্ছু করতে হবে না, আমিই ত আছি। হাজার হোক পেটের মেয়ে ত। না-না, মেরা সম্বন্ধে কোন দুর্বলতাই সে মনে স্থান দিবে না। মেরা তাহার কেউ না – কেউ না, কোন দিন কিছু ছিলও না।
এই বারে আর নাভারণের তালেব মিয়া মহাজনের বারান্দা নয়। সেই খানে আর পা ফেলিবার জায়গা নেই। নূতন লোক জুটিয়াছে।
অনেক হাঁটাহাঁটি করিয়া কলিমুদ্দিনের সঙ্গে চুক্তি হইল। তাহারই পড়ো গুদাম ঘরটার পিছনের একচালায় জায়গা পাইল।
নূতন মহাজনের ঘর হইতেই পাওয়া গেল মবিলের টিন। কিছুটা চট যোগাড় করিয়া, সূচ সূতালি চাহিয়া আনিয়া থলিয়াও তৈয়ার হইল।
আবার সেই দশটায় গাড়ী।
প্রথম দিনেই বেনাপোলে চোখে পড়িল মেরাকে। চেনা যায় না যেন। নূতন লাল-সবুজ চেক শাড়ী, ছাপার ব্লাউজ। একপোচ পাউডারও হয়ত লাগাইয়াছে পুষ্ট মুখের উপর। চাহিলে চোখ ফিরানো যায় না! রকীবা চোরের মত সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চায় – বিদ্রোহী কড়া মনটা হয়ত পাহারা দিতেছে কখন ধরা পড়িয়া যায় কে জানে।
পুরানো পরিচিতরা ছেঁকিয়া ধরিয়াছে।
ছিলি কোথায় এ্যাদ্দিন?
এমন হোল কি করে?
রকীবা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জওয়াব দেয় – যাব কোন চুলায়! অসুখ করেছিল।
গাড়ীটা ছাড়িতেছে না। কাষ্টমের চেকিং শেষ হইয়া গিয়াছে তবু কেন দেরি করিতেছে কে জানে।
রকীবা প্ল্যাটফরমের পিছন দিকে – রেলিংএর কাছে নুড়ি পাথরের স্তূপের উপর একা একা বসিয়া সুপারী চিবাইতেছিল। পিছন হইতে মেরা আসিয়া তাহার পিঠে হাত রাখিল।
রকীবা নিরুদ্বিগ্ন গতিতে মাথা ঘুরাইল।
এ্যাই মা।
প্রকম্পিত করুণ অথচ মিষ্টি দুইটা শব্দ।
বহু বছরের পরিচিত।
অন্তরের নিরুদ্ধ মণিকোঠার গলা টিপিয়া রাখা অন্ধ মাতৃত্বটা যেন সশব্দে অলকাইয়া উঠিয়া অর্থ প্রকাশ করিল।
মেরা?
কিন্তু পরমুহূর্তেই ঝটতি বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ফাটিয়া পড়িল – ছিনালীর আর জায়গা পাওনি না? মা ডাক গিয়ে যে বেবুশ্যে তোকে পেটে ধরেছিল তাকে। কোথাকার কোন আঁস্তাকুড়ের ময়লা আমাকে বলে কি না মা!
রকীবা একটা বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গী করিয়া সামনের দিকে হন হন করিয়া আগাইয়া গেল।
দুই একজন ব্যাপারটা দেখিয়া কিছুটা হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল, পিছন পিছন গিয়া রকীবাকে জেরা শুরু করিল। সে একটি প্রশ্নেরও জওয়াব দিল না। রেলিং ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
দশটার গাড়ীতে যাওয়া আর পাঁচটার গাড়ীতে ফিরিয়া আসা। জীবন সংস্থানের দুরূহ পরিক্রমা।
শরীরে যথেষ্ট বল হইয়াছে। আর কিছু না হোক, দুই মুঠা ভাত ত পেট তরিয়া খাওয়া যায়।
আজকাল সকলের মুখে মুখে একটা কথা ঘুরিয়া ফিরিতেছে। সেপাইরা নাকি গুলি করিয়া চোরাকারবার বন্ধ করিবে। কাগজে নাকি লিখিয়াছে। কেউ বলে, ধরিয়া নিয়া গুলি করিবে। কেউ বলে, গুলি করিয়া ধরিবে। নানা মুখে নানা কথা। তবে গুলি যে করিবে এই সত্যটুকু সবার মুখেই এক – শুধু সময়ের তফাৎ। মহাজনেরা বলে, করুক দেখি, – কত গুলি করতে পারে। বন্দুকের নালের মুখেও ছিপি আঁটা যায় – বুঝলি! চান্দির ছিপি। তোরা কিছু ঘাবড়াবি না। আমরা আছি।
রকীবারও ভয় হয়, কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবে – করুক-না গুলি। চুইয়া চুইয়া ত রক্ত পড়িবে, না, – বজলের মত হয়ত লহমার মধ্যেই সব শেষ হইয়া যাইবে। তাহা ছাড়া এত শ’তে বিশতে যদি ভয় না পায় তবে সেই বা পাইবে কেন। গুজবটা উঠার পর হইতে কমিয়াছে না কি কেউ? না লাইন ছাড়িয়া দিয়াছে?
কিন্তু সত্যি একদিন ঝামেলা বাধিল। বেনাপোলে গাড়ী থামার সঙ্গে সঙ্গেই ধুম ধুম করিয়া শব্দ হইল। লোকজনের চীৎকারে প্লাটফরম মুখরিত হইয়া উঠিল! ছেলেমেয়ে বুড়াবুড়ী জোয়ান সকলেই প্রাণ হাতে করিয়া বিশৃঙ্খলভাবে ছুটাছুটি করিতেছে। হাটের মধ্যে একটা পাগলা মহিষ ঢুকিয়া পড়িলে যে বিক্ষিপ্ততার সৃষ্ট হয় তেমনি যেন একটা কিছু হইয়াছে। রকীবা গার্ডের গাড়ীর সঙ্গে লাগানো একটা কামরায় ছিল। মাটিতে নামিয়া হতভম্বের মত গাড়ীটার প্রান্ত ধরিয়া রহিল।
সন্ত্রস্ত-চাপা গুঞ্জন ধ্বনিত কলরবের মাঝে ‘গুলি, গুলি’ শব্দের কাটা আওয়াজ। রকীবার বুকে আত্মরক্ষার আকুল মত্ততা। চোখে মৃত্যু-ভয়ের বিভ্রান্তি।
রেলিং যেখানে শেষ হইয়াছে সেই দিকে সেপাই-সান্ত্রী যেন অপেক্ষাকৃত কম। লোকজনও যেন সেই দিকে বেশী দৌড়াইতেছে না। এই কি সুযোগ? ইতস্তত দৃষ্টি সঞ্চালনে হঠাৎ রকীবার নজরে পড়িল ইষ্টিশনের পাশে প্লাটফরমের একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া মেরাজান একটি সেপাইর সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া কি আলাপ করিতেছে। মুহূর্তে রকীবার মনে পড়িল মেরার সেই কথাগুলি – ‘বিপদে আপদে তারাই দেখবে। আমাদের কোন ভয় নাই।’
না, না, মরণ, – সেও ভাল। পেটের মেয়ের যৌবন বেচিয়া থাকিতে চাই না।
ধুম ধুম করিয়া আরও কয়টা শব্দ হইল। কে একজন ছুটিতে ছুটিতে যেন পড়িয়া গেল। এমনিই কি সব লাল হইয়া যাইবে। সীমানার পাথরের কাছে লাইন সিøপার, পাথরের মত? রকীবা হাতের টিন ফেলিয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে রেলিংএর মাথা ঘেঁষিয়া পাশের ঝোপের দিকে দৌড়াইল।
এক জায়গায় হোঁচট খাইয়া সে পড়িয়া গেল। না উঠিয়া এই জায়গায় লুকাইয়া থাকিলেও হয়, কথাটা মনে পড়িতেই দেখিল একটি সেপাই তাহারই দিকে ধাওয়া করিয়াছে, হাতে লাঠি না বন্দুক কে জানে। রকীবা মরি বাঁচি করিয়া দৌড়াইতে লাগিল। পরনের কাপড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন – কাঁটায় লাগিয়া অনেক জায়গায় রক্ত ঝরিতেছে – কিন্তু সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। কয়েক পা যাইতেই ঝোপের ভিতর হইতে আরেকটি সিপাই তাহার দিকে যেন ঝাঁপাইয়া পড়ার মত আগাইয়া আসিল। লহমার মধ্যে রকীবা চিনিতে পারিল – কপালে সেই মোটা আঁচিল – কি যেন নাম তাহার! হাতে কি, বন্দুক!
রকীবা রুদ্ধনিশ^াসে অতিকষ্টে যেন চীৎকার করিয়া উঠিল ‘আমি আমি মেরাজানের মা। চিনতে পারছ না?’
মির্জা আ. মু. আবদুল হাই
তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার আবদা গ্রামে। কথা888sport live footballিক। ১৯৪২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বাংলা একাডেমি 888sport live football 888sport app download bd ও আলাওল 888sport live football 888sport app download bd লাভ করেছেন। ১৯৮৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি 888sport appয় পরলোকগমন করেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.