মোহনলালের চা

মামা আর এক কাপ চা দাও তো।
মোহনলাল এই বাক্যটা শোনার জন্য সারাজীবন এভাবে মগ্ন হয়ে চা বানিয়ে যেতে চায়। বাস করতে চায়, এই শহরের মানুষের জীবনের চায়ের স্বাদ হয়ে। হিন্দু-মুসলমান ভাবনা তো পরের কথা, ‘মামা’ ডাকটা শুনলেই মনে হয় এ-শহরের সবাই ক্যামেলিয়া অথবা তার মায়ের সহোদর! মনে হয়, সে মোহনলাল নয়, ‘ক্যামেলিয়া’র ডাকা ‘মোহন’।
আমরা মোহনের চায়ের দোকান থেকে তিন দশক কাল পেছনে যাই –
উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হলেও মোহনলালের বাবা মতিলাল বস্তুত মনেপ্রাণে একজন কৃষক। স্কুল থেকে ফিরেই তিনি নিজের জমির ক্ষেত, সবজি এসব দেখতে যেতেন যেন তার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটছেন।
মতিলালের মনে হয়, করতোয়ার রেখে যাওয়া এই ভূমির বাতাস অন্যরকম। জোছনার মায়াটুকুতে করতোয়ার প্রাণতোয়ায় লুকিয়ে থাকে অতীত সব আরো আরো প্রাণ। সময়ে-অসময়ে, চৈত্রের নির্জন অথবা বসন্তের গুঞ্জন, পলাশ-শিমুল, আম-জামের মুকুল অথবা কুল-ফুল – সবকিছুতে থাকে ফেলে আসা সময়ের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে থাকে শনশন হাওয়ার দুপুর, সাঁতার-কাটা একলা কিশোরীর একটা পুকুর। গল্পও থাকে। মাঠের কিনারের জামবাগানে পাতাকুড়ানো কিশোরী মেয়েটার গল্প। নির্জন চৈত্রের দুপুর গড়িয়েছে। হঠাৎ ওপরে তাকিয়ে মেয়েটা দেখল আকাশের মতো উঁচু থেকে একটা পরির হাত নেমে আসছে। মেয়েটা জ্ঞান হারাল। তারপর? তারপর কয়েকদিন অনেক জ্বর। তারপর …?

করতোয়া থেকে মাত্র এক মাইল দূরে মতিলাল পরিবারের চৌহদ্দি। তাদের সেই বাস্তুভিটায় বাঁশবাগান, আম-জামের ঘন সারি আর বড় পুকুরটায় ঘন ছায়ারা নিরিবিলি শান্তির স্নানে মগ্ন। তাদের একান্নবর্তী পরিবার যুগ যুগ ধরে করতোয়াবিধৌত এই নিভৃত পল্লিতে বাস করে আসছিল। স্বাধীনতার পরও কিছুদিন তাদের বিভিন্ন উৎসবে মুসলমানরাও একে অন্যের নিমন্ত্রণে পরিবারসহ অংশগ্রহণ করেছে। ছোট্ট বাচ্চা বয়সে দেখা এসব দৃশ্য মতিলাল ভোলেননি।
গ্রামের কাদের আলী সারাজীবন যাত্রাপালা নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষ। যাত্রা-নাটক থেকে আয়-রোজগারের চিন্তা করলেও প্রতিবছর তার নাকি লোকসান হয়। পরিবারের খরচ সামলাতে তিনি মতিলালের কাছে গেলে মতিলাল গোপনে তাকে সাহায্যও করতেন।
ততদিনে চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির প্রকোপে ভেতরে ভেতরে আরো অদৃশ্য এক সমাজ তৈরি হয়েছে। এই শ্রেণির সম্পদ আর লোভ সমানুপাতে বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা। চাঁদাবাজিতে ফুলে-ফেঁপে ওঠার পর কাদের মতিলালকে একদিন ডাকল। কয়েক বছর হলো, গ্রামেই কাদেরের বিরুদ্ধ পক্ষ তৈরি হয়েছে। দিন দিন তাদের 888sport free bet বেড়েছে। তাদের অভিযোগ, দুশ্চরিত্র কাদের আজকাল যাত্রাপালার নামে নগ্ন-নৃত্য, জুয়ার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে নষ্ট করছে। যাত্রার জন্য চাঁদাবাজিসহ কাদেরের সব অপকর্ম নিয়ে তারা সোচ্চার হলেও কেন যেন মুক্তিযুদ্ধে তার রাজাকার অথবা পাকিস্তানের দোসর হওয়ার ভূমিকা নিয়ে কেউ কথা তোলে না। অবশ্য কাদেরের হাতে রয়েছে তার জন্য মোক্ষম অস্ত্র। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী শাহাদত হুজুর কসাইয়ের মতো কত মানুষকে খুন করেছে, কত 888sport promo codeকে ধর্ষণে সহযোগিতা করেছে – তার চাক্ষুষ সাক্ষী কাদের। তাছাড়া, অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়া কাদেরকে শাহাদতের দল অধর্মের পথ থেকে ফিরিয়ে ইসলামের পথে আনার জন্য গোপন এক স্বপ্নকেও লালন করে।
বড় ছেলে কুদ্দুস ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর এত বড় সম্মানের ব্যাপারকে কাদের নষ্ট হতে দিতে চায় না। সুতরাং যাত্রাপালা, গান-নাচের আসর বাদ দিয়ে সে ক্রমশ মিলে গেল শাহাদতের দলে। নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে হাফেজ তৈরির জন্য একটা হেফাজতখানা চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। পুরনো দিনগুলো মনে করে কাদের এখন নিজেকে আর বিব্রত করাতে চায় না। কিন্তু এতদিন পর কাদের কেন মতিলালকে 888sport app download for android করল, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়।
মতিলাল তার বাড়িতে গেলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন,
– ভাই, আমাকে 888sport app download for android করেছেন?

– কাজে ডাকছি আপনাক, দাদা। গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হবে। প্যান্ডেল তৈরির খরচ আপনি দেবেন।
তার দিকে চমকে তাকান মতিলাল। প্যান্ডেল তৈরির খরচ আগেও তিনি দিয়েছেন। তবে তা ওয়াজ মাহফিলের জন্য নয় – যাত্রাপালা আর নাটকের জন্য। যাত্রা-নাটক, মারফতি-শরিয়তি, জারি-সারি এসবের আসরের জন্য সব সময় তার ভাগে প্যান্ডেল তৈরির খরচের ভাগ পড়েছে। কিন্তু, ওয়াজ মাহফিল? মতিলালকে কোনো কথা বলতে না দেখে কাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,

– গ্রামে ভালোমতো যদি বেঁচে থাকতে চান, আমার কথা শুনতে হবে। না হলে আপনার পূজার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।
এসব কত আগের কথা। মোহনলাল যখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করেছে – সেই সময়ের এই গল্পগুলো সবই বাবার মুখে শোনা।

দুই
চায়ের জন্য এই শহরে মোহনলালের খ্যাতি কম নয়। খ্যাতি নিয়ে মাথাব্যথা নেই মোহনের। সে শুধু মাথার ওপর কৃষ্ণচূড়াগাছটার পাতায় বাতাসের ঝিরঝির কাঁপন দেখতে চায় আর ‘মামা’ ডাক শুনে হৃদয় জুড়াতে চায়।
মোহনের চায়ের দোকানে নিয়মিত আসেন কবি-লেখক, শিক্ষক থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মোহনলালের চা তাদের মধ্যে একধরনের সুস্থ আড্ডার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। পূর্ণিমার রাতে আবাসিকের উত্তর-পূর্বের নির্জন ফাঁকা জমিগুলোতে জোছনার বিহার। সেই সঙ্গে এই চা! আহা, তাদের জীবনে এই অপূর্ব স্বাদের ঠিকানা মোহনলালের চা-ঘর।
কিন্তু ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার দোকানে ভাটা পড়ল। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় একজন রাজনীতিকের নাম উঠে আসে যিনি নাকি এককালে মোহনলালের মতো চা-বিক্রতা ছিলেন! কোথায় গুজরাট আর কোথায় মোহনলালের চায়ের দোকান। তবু অনেকে তাকে কটাক্ষ করল। মোহন ভেবে পায় না, একজনের অপকর্মের দোষ কেন তার কাঁধে লোকজন ফেলছে? মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় জটিল।
এই সুযোগে রাস্তার অন্য পাশে বসল আরো কয়েকটা চায়ের দোকান। সব পেশার লোকজন একটু একটু করে মোহনকে ত্যাগ করলেও কবি-888sport live footballিকরা তার চা ছাড়া অন্য কারো চায়ে মাতল না। এই লোকগুলোর চরিত্রে কী যে একটা দোষ আছে! বড় মায়াঘোরে আটকাপড়া এই মানুষগুলোর জন্যও মোহনের কেমন দরদ হয়! এরা জগতের সবকিছুকে যেমন তাচ্ছিল্য করতে জানে তেমনি সামান্য জিনিসকে আঁকড়ে ধরতে এবং বড় করে দেখতে জানে।
মোহনের 888sport app download apk এখন এই চায়ের ধোঁয়া-ওঠা সকাল আর সাঁঝের বেলা। ‘চা’শব্দটার মাঝে সে ঢেলে রাখে জীবনের মায়ার অমৃতটুকু। শুধু মনে হতে থাকে, একটু পরেই ক্যামেলিয়া তার বানানো চা কাপে নিয়ে একটা জোর-চুমুক দেবে। তারপর চোখ বন্ধ এমন করে সেই স্বাদটুকু নেবে যেন সে জন্মেছিল এই স্বাদের ভেতর মগ্ন হওয়ার জন্য।
888sport live chatীমনা মানুষগুলোর এক একটা শব্দ সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে হয় এই 888sport live chatীদের সঙ্গে একজন ক্যামেলিয়াও আছে। একজন জাত 888sport live chatী ছাড়া আরেকজনকে 888sport live chatী বানানো অথবা 888sport live chatের পথে আনা কারো পক্ষে কি সম্ভব? মোহনই শুধু জানে কার জন্য তার হাত চা বানাতে গিয়ে একজন 888sport live chatময় হয়ে ওঠে।
জীবনের চড়াই-উতরাই কত গেল! একদিনের তরুণ কবি বিখ্যাত হয়ে গেল। তরুণ প্রভাষক একদিন অধ্যাপক হয়ে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য, মোহন যেমন ছিল তেমনই আছে। সে কি থেমে আছে পুরনো, পরিত্যক্ত একটা মন্দিরে থমকে থাকা সময়ে? মনে পড়ে বাবার কথা। দেশভাগের পর তাদের বেশকিছু আত্মীয়স্বজন যখন ভারতে থিতু হতে দেশ ছাড়ছিল তখন তরুণ মতিলাল নাকি তাদের বলেছিলেন, – দেখিস, এই মাটির মায়ায় তোদের আবার একদিন ফিরে আসতে হবে। তার স্বজন তাকে বুঝিয়েছিল,

– এই মাটির মায়া না ছাড়লে তোমাকে মানুষই মাটিছাড়া করবে। ধর্মের ভিত্তিতে যে ভূমি ভাগ হয়, সেখানে কি আর মানুষ থাকে?
মতিলাল কোনো কথা বলেননি। সারাজীবন ধরে তিলতিল তৈরি করা 888sport sign up bonus রেখে তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। এত ঘ্রাণের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সময় আর এত প্রাণের মাঝে রেখে দেওয়া এত 888sport sign up bonusর আকর ফেলে কি কোথাও যাওয়া যায়। তার কাছে করতোয়ার এই জমি-ভূমি পৃথিবীর পবিত্রতম তীর্থভূমি। সেই অনুভূতি প্রবাহিত হয়েছে মোহনলালের মাঝেও। তার বাড়ির পাশে পূজামণ্ডপে কত কত পূজা আর মানুষের পদধূলির 888sport sign up bonus। 888sport sign up bonus তার পুকুরে গোসল করা ঘন ছায়ার সঙ্গে।
একশ তেরো বিঘা জমির মালিক মতিলাল পরিবারের প্রভাব এতদঞ্চলে থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কবে থেকে এদেশে তাদের 888sport free betলঘু শব্দের তকমা দেওয়া হয়েছে! তা নিয়ে তার আক্ষেপ নেই। তিনি স্বগোক্তি করেন,

– এই মাটি ছেড়ে যাওয়া মানে তো মৃত্যু।
কিন্তু মৃত্যুও মনে হয় ভালো ছিল। তাহলে আরো আরো বাজে 888sport sign up bonus নিয়ে তাকে এই মাটি ছাড়তে হতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা-বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো দেখে মতিলাল হতাশ হচ্ছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বাজে ঘটনা ঘটল বাবরি মসজিদ ভাঙার বছর। ফুঁসে-ওঠা মুসলমানরা ভেঙে ফেলল তাদের গ্রামের ছোট্ট মন্দির, পূজামণ্ডপ। বখাটে ছেলেরা মেয়েদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করল না। ঘটনা এখানে সীমাবদ্ধ থাকলে তাও সহনীয় হতো। বড় ছেলে মোহনলালের সহপাঠী ক্যামেলিয়া রওনকের লাশ পাওয়া গেল শহরের অনেককাল আগে পরিত্যক্ত এক ভাঙা মন্দিরে। হিন্দু পরিবারের হয়ে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ার অপরাধে কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও শুধু মিথ্যা রটনার সূত্র ধরে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল মোহনলালকে। তার নিরীহ সন্তানটাকে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ায় অস্থির হয়ে উঠলেন মতিলাল। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না – এরই মাঝে রাতের অন্ধকারে তাদের মেয়ের ঘরে কে বা কারা প্রবেশের চেষ্টা করল। চিৎকার-চেঁচামেচিতে সে পালালেও গ্রামের মাতবর গোছের লোকজন প্রকাশ্যে বলে বসল,

– মেয়েটা আহামরি সুন্দরী নয়! তার ঘরে কেউ ঢোকেনি। কয়েকদিনের ঘটনা-দুর্ঘটনায়, ভয়ে সে উলটা-পালটা বকছে। মতিলাল ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,

– তার মানে কী? তার ঘরখানির জানালা বাইরে থেকে ভেঙে ফেলা হয়েছে, দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে …
মাথায় টুপিপরা এক তরুণ ক্ষিপ্তস্বরে তেড়ে এলো মতিলালের দিকে,

– তোর মেয়েকে গ্রামের সবাই মিলে যে কিছু করেনি – এই তোর সৌভাগ্য। তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙছিস। মতিলাল বাকরুদ্ধ হলেন। আলেক মাস্টার তরুণকে তিরস্কার করে বললেন,

– মুখ সামলে কথা বল। সে কি বাবরি মসজিদ ভাঙছে নাকি? গ্রাম্য সালিশ গড়াল তর্ক-বিতর্ক, হইহই আর ফ্যাসাদে। এবং তা শেষ হলো হাতাহাতি, মারামারি ও একে অন্যের সঙ্গে নতুন শত্রুতার সম্পর্কের বাঁক নিয়ে। মাঝখান থেকে ধামাচাপা পড়ে গেল মূল বিষয়।
হতাশ এবং ত্যক্ত-বিরক্ত মতিলালের কাছে রাতের অন্ধকারে যে-ই এসে তার জমিগুলো কেনার প্রস্তাব দিলেন – তাদেরকেই তিনি নামমাত্র মূল্যে জমিগুলো বিক্রি করে দিলেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে সব বিক্রি করে, গুছিয়ে নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন মতিলাল। বাদ সাধল পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মোহনলাল। সে কিছুতেই দেশ ছেড়ে যাবে না। কিন্তু বাবার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার সম্ভাবনা নেই দেখে তারও কিছু করার থাকল না।
মোহনলাল পরিবারের সঙ্গে দেশ ছেড়ে গেল বটে। কিন্তু দেশে পুঁতে রাখা নাড়িটা তাকে অস্থির আবেগে হাতছানিতে কাছে ডাকল। সেই মায়ার কুহেলিকায় পড়ে পরিবারের মায়া ছিন্ন করে একদিন ভোররাতে মোহন বের হলো। লোকচক্ষুর আড়ালেই সে রেলস্টেশনে পৌঁছাল। আপাতত তার গন্তব্য হিলি রেলস্টেশন।

দেশে ফেরার পর নিজ গ্রামের লোকজন কেউই যেন তাকে চিনতে পারল না। কয়েক মাস আগে যেন নয়, তারা এদেশ ছেড়ে গেছে কয়েক যুগ আগে! যারা তার পিতার কাছ থেকে কম মূল্যে উর্বর সব সোনা-ফলানো জমি কিনে নিয়েছিল, তারা মোহনলাল ফিরে আসায় শঙ্কিত হয়ে উঠল। ফলে একটু আশ্রয় তো গ্রামে জুটলই না, এক লোকমা খাবার দিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত মোহনলালের প্রতি কেউ করুণাও দেখাল না। অথচ তাদের বিপদে এই মানুষগুলোর অনেককেই সে বাবার পকেট থেকে চুরি করে টাকাও দিয়েছে। হায়, জগৎ! একবার পা পিছলে গেলে, বাস্তুচ্যুত হলে তার মায়াগুলো কুহেলিকা হয়ে যায়। বুকের ভেতর যে কুহেলিকা শুধু দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, বুকে নেয় না।
মোহনলালের মনে পড়ল তার স্কুলশিক্ষক শিশিরকুমার পালের কথা। খুব ভালো ছাত্র না হলেও গ্রাম থেকে আসা কবি-প্রকৃতির একটা ছেলের চোখের মাঝে লুকানো মায়াময় নিরীহ চাউনি বাংলার শিক্ষকের দৃষ্টি কেড়েছিল। তারপর খাতায় লুকিয়ে রাখা 888sport app download apkটাও তাঁর চোখে পড়লে, জীবনানন্দের ধাঁচে লেখা 888sport app download apk পড়ে তিনি বলেছিলেন,
– তুই তো দেখি আমাদের ছোট জীবনানন্দ দাশ!
তারপর থেকেই শিশিরকুমার মোহনকে বড্ড ভালোবাসতেন। প্রবল ক্ষুধা আর আশ্রয়ের অনিশ্চয়তা নিয়েই সে শিশির স্যারের বাসার উদ্দেশে রওনা হলো। পথে যেতে যেতে তার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হলো, শিশির স্যারের মতো যারা শিক্ষকতা করেছেন তারা এদেশে বহালতবিয়তে টিকে আছে। কিন্তু যারা তার বাপ-দাদাদের মতো জোতদার ছিল – তারা কেউই টিকে নেই। তাই তো! এর সমীকরণ নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার কবিমনে প্রথম যে-দর্শন স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে, এই বাংলায় বাস্তুভিটা আর জোত-জমি যাদের পায়ের নিচে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল, সেই বাস্তুভিটাই তাদের বাস্তুচ্যুতির বড় কারণ।
দুর্বল লাগছিল তার। সবকিছু কেমন ঝাপসা! ঝাপসা এই অনুভূতির ভেতর শৈশব-কৈশোরের 888sport sign up bonus আর ক্যামেলিয়া নামটা খুব স্পষ্ট। যেন সামনে কুয়াশার আস্তরণ পার হলেই সে পৌঁছে যাবে ঝলমলে এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল মাঠে। বৈচিত্র্যময় সবজিক্ষেতে ভরা মাঠের দৃশ্যকল্প ক্যামেলিয়ার চোখের মায়া হয়ে, তার প্রাণময় হাসির রিনিঝিনি হয়ে ছড়িয়ে যায় বুকের কোন অলিন্দে। তার ভাবনাগুলো 888sport sign up bonusর ভেতর গিয়ে কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সে ঘামতে থাকে। করণীয় সবকিছু তার মাথার ওপর দিয়ে যায়।
তাই তো! জীবনানন্দ দাশ কেন এত উদাস ছিলেন?
এই প্রশ্ন মাথায় আসামাত্র ভোঁ-শব্দে একটা ট্যাক্সি তার গায়ের ওপর প্রায় উঠেই গেল। কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলে উঠতেই সে শুনতে পেল তাদের গ্রামের পরিচিত ট্যাক্সিচালক তাকে গালমন্দ করছে,

– সারাজীবন শালা আল-কানা। কী যে ভাবিচ্চে তো ভাবিচ্চেই। ক্যা রে মালুর বাচ্চা, তুই আবার দেশত ফিরলু, কী খাওয়ার জন্য …?
হতভম্ব হয়ে মোহনলাল ভাবে, গ্রাম ছেড়ে বাস থেকে নেমে কখন সে শহরে এসে পৌঁছাল? গালি খেয়ে ধাতস্থ হয় সে। তার মনে হয়, জীবননান্দ দাশও সেদিন হয়তো একদিকে প্রবল ভালোবাসার অনুভব অন্যদিকে সেই ভালোবাসার অস্তিত্বকে খুঁজে না পাওয়ার রাজ্যজোড়া হতাশার ভাবনায় উদাসীন ছিলেন। কখন ট্রাম এলো, তার তাজা রক্তের স্রোত কখন বাঙালির অনুভবের লালিমায় ইতিহাস হয়ে গেল – তিনি তা টেরই পেলেন না। সেদিন তিনিও মোহনলালের মতোই কি ভাবছিলেন, মরার আগে বাঙালি কাউকে চিনতে চায় না?

তিন
শিশিরকুমার সব শুনে হতাশ হলেন। বললেন, – পরিবার ছাড়া কি এই মাটি-প্রকৃতি ভালো লাগবে, বোকা! মানুষ কোথাও যায় না, তারা যায় অথবা ফিরে আসে আসলে মানুষের কাছে। প্রিয়জনরা না থাকলে নিজের ঘরটাও পর হতে থাকে …
প্রিয় মানুষ? তাই তো। মোহন হারিয়ে যেতে থাকে একজোড়া মায়াবী চোখের ভেতর। সেই নবম শ্রেণিতে থাকতেই ঘটেছিল ঘটনাটা। ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের দোতলায় ছিল তাদের শ্রেণিকক্ষ। অবকাশ পিরিয়ডে সব সহপাঠী খেলতে মাঠে গেলেও মোহন একা একা চলে যেত বারান্দার শেষ প্রান্তে। কাঁঠালবাগানের শুরুতে কৃষ্ণচূড়াগাছ। কৃষ্ণচূড়ার ডাল থেকে নুয়েপড়া পাতা আর ফুলকে এই বারান্দা থেকে হাত দিয়ে বারবার ছোঁয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হয়। পাতার একটু অংশ হয়তো নাগালের মাঝে আসে। ওইটুকুই। শরীরকে রেলিংয়ের ওপর গলিয়ে বাইরের দিকে এগিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হয় না। তবু এভাবে বারবার হাত দিয়ে একটা টকটকে লাল ফুল ধরার জন্য এই ব্যর্থতাকেই কেন তার অনন্য এক খেলা মনে হয় – তা সে জানত না। একদিন ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ অথচ মেধাবী মেয়েটা বারান্দার শেষ প্রান্তে এলো। তার হাতেও একটা বই। ডন কুইক্সোট (দন কিহোতে)। এত শান্ত আর চুপচাপ একজন সহপাঠী এ-ধরনের মজার বই পড়ে? মোহন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

– এত হাসির একটা বই! তুমি হাসির বই পড়ো?

– শোনো যারা খুব চুপচাপ তারা নিজের ভেতরের আনন্দটাকে অন্যের কাছে আসলে ধরা দিতে চায় না। যেমন তুমি। লুকিয়ে লুকিয়ে জীবনানন্দ পড়ো। ভেতরে কত উচ্ছ্বাস থাকলে, মনের কত চোখ থাকলেই না জীবনানন্দকে পড়তে কারো এত এত ভালো লাগে।
বাপরে, মোহন তো ক্যামেলিয়া রওনককেই দেখছে তার সামনে! এই মেয়েটা পড়াশোনার বাইরে এত কথা জানে? সে যে জীবনানন্দের 888sport app download apk পড়ে তাও মেয়েটা জানে? কী আশ্চর্য! সে হা হয়ে ক্যামেলিয়ার দিকে তাকিয়েই থাকে। ক্যামেলিয়া তাকে ধমক দিয়ে বলে,

– তুমি ছেলেমানুষ। চাইলে তুমি ওদের সঙ্গে তো ফুটবল খেলতে পারো। রোদ-বৃষ্টি গায়ে মেখে ছেলেদের সংগ্রাম করতে শিখতে হয়। না হলে জীবনযুদ্ধে তারা হেরে যায় …
এত সুন্দর কথা এক কিশোরীর মুখে নয়, মোহনের মনে হলো সে তার কোনো শিক্ষিকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার উপদেশটুকু শোনামাত্র মোহনের চোখ ছলছল করে উঠল। তার কি খেলতে ইচ্ছা হয় না? কিন্তু …
ওরা তোমাকে খেলতে কি মানা করেছে?
এ-প্রশ্নে এবার মোহন মাথা নিচু করল। সে অনেকবার খেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদেরই গ্রামের মৌলভি শাহাদতের ছেলে সজীব আর তাদের এত কাছের কাদের চাচার ছেলে হয়েও কুদ্দুস তাকে খেলতে নেওয়ার ঘোর বিরোধী। হিন্দুদের সঙ্গে খেলা-মেলামেশা তারা পছন্দ করে না। কুদ্দুস তো তাকে মাঠে দেখেই ক্ষিপ্ত কুকুরের মতো দৌড়ে এসে বলেছিল, ‘মালোয়ান কা বাচ্চা কাভি নাহি আচ্ছা … তুই যা, ভাগ এখান থেকে।’ মুহিত, রশিদ ছাড়াও আরো কয়েকজন চায় মোহন খেলুক।
ওদের সমর্থন পেয়ে মোহন একটু প্রতিবাদ করেছিল,

– মালোয়ানদের নায়িকা শ্রীদেবীর নাচ না দেখলে তো তোদের পরিবারের কারো পেটের ভাত হজম হয় না … তেজাব দেখতে দেখতে না তুই তেজি হয়ে উঠলি!
সঙ্গে সঙ্গেই গালে কষে একটা চড় খেয়ে সেই যে মোহন মাঠ ছেড়েছিল, সেদিকে আর পা বাড়ায়নি। কুদ্দুসের বাবা কাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ছিল রাজাকার। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই সে যোগ দিলো রাজনীতিতে। এখন অনেক টাকার মালিক। যুদ্ধের সময় তার হাতে অনেক বাঙালির জীবন হরণ এবং অনেক 888sport promo code ধর্ষিত হলেও তার এই টাকার ক্ষমতার কারণে কেউ মুখ খোলে না। তাছাড়া অনেক মক্তব-মাদ্রাসা আর এতিমখানার ত্রাতা একজন নেক বান্দাকে শহরের মানুষ কেনই-বা হারাবে? কুদ্দুসের বাবার মতো লোকেরাই এই সমাজের কর্ণধার। তাদের সঙ্গে লাগতে গেলে বিপদে পড়তে হবে – এই বয়সে এই বাস্তবজ্ঞান তৈরি হয়েছে মোহনের। সুতরাং তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব থাকার এই পথই বেছে নিয়েছে মোহনলাল।
তার 888sport sign up bonusচারণে ছেদ পড়ল। ক্যামেলিয়া হাত ধরল মোহনের। তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

– এসো আমার সঙ্গে। খেলার মাঠ কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় নয়। কে বাধা দেয় আমি দেখব। জগতে নিজের অধিকারটুকু জোর করেই আদায় করতে হয়।
সেদিন থেকে ফুটবল খেলতে কেউ আর মোহনকে বাধা দেয়নি। ক্যামেলিয়া রওনক শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী। কুদ্দুস উলটা সেদিন মোহনকে বলেছিল,

– কিছু বললেই মন খারাপ করিস ক্যান? মাঠে নাম, শালা।
কুদ্দুস আর সজীব বুদ্ধি করে মোহনকে প্রতিপক্ষ দলে রাখল এবং খেলার মাঝে মোহনের সঙ্গে যত ধরনের ফাউল আছে সব করার চেষ্টা করল। তবে, মোহনের শরীরে মনে হয় করতোয়া তার পলির সব উর্বরতা ঢেলে দিয়েছিল। তাকে বিপক্ষে দলে পাঠিয়ে পা ভাঙা তো পরের কথা, কুদ্দুসের দল প্রতিদিন পরাজিত হতে থাকল। আর দিন দিন প্রতিদিন ‘মোহন’ নামের এক ‘শব্দ’ কুদ্দুস-সজীবসহ প্রতিপক্ষের কাছে বড় এক ‘শত্রু’ হয়ে উঠল। সেই শত্রুতার মূলে বাস করল ক্যামেলিয়া। চুপচাপ মেয়েটা এখন আর টিফিনে অথবা অবসর-ক্লাসে বসে বিশ্ব888sport live footballের ক্ল্যাসিক পাঠ করে না। বান্ধবীদের নিয়ে মাঠে এসে খেলা দেখে। গোল হলেই লাফিয়ে উঠে হাততালি দেয়।
একদিন স্কুলবাস থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার পথে ক্যামেলিয়া মোহনকে ব্যাগের ভেতর থেকে পেয়ারা বের করে তার হাতে দিতে দিতে বলল,

– তুমি এত ভালো খেল মোহন, আমি খুব এনজয় করি। এই প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছিলে কেন? লাজুক ভঙ্গিতে পেয়ারা হাতে নিয়ে মোহন বলল,

– স্কুল ছুটি হলেই সকাল-বিকাল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে এই খেলাই খেলতাম।

– তাই তো বলি, তুমি হঠাৎ এত ভালো খেল কীভাবে!
ক্যামেলিয়ার কথায় কী এক প্রেরণায় ধুয়ে যায় মোহন। খেই হারিয়ে লাজুক ছেলেটা বলে বসে,

– তুমি মাঠে থাকলে তো আমি ফড়িং হয়ে যাই …
এ-কথায় ক্যামেলিয়া থমকে দাঁড়ায়। তারপর মিষ্টি হেসে বলে,

– আচ্ছা মোহন, তুমি এই খেলা, বই পড়া এসবের বাইরে আর কোন কাজটা ভালো পারো? যাদের গুণ থাকে তাদের নাকি একটা-দুটো নয়, অনেক গুণ থাকে। এই কথায় মোহনের চোখ-মুখ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সে বলে,

– আমার বানানো চায়ের সবাই খুব প্রশংসা করে। পিসি তো বলে, মোহনের চা খাওয়ার জন্যই আমি ভারত থেকে বারবার 888sport appsে আসতে চাই।

– তাই? ওমা, চা আমার কী ভীষণ পছন্দের। দারুণ তো। গরুর দুধের চা?

– হুম।

– তা, তুমি কবে আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে?
এরপর সত্যি সত্যি মোহনলালের হাতে বানানো চা খেয়ে মুগ্ধ হলো ক্যামেলিয়া। এতই মুগ্ধ যে, অদ্ভুত স্বাদের সেই চায়ের গল্প সে বাবা-মায়ের কাছে বলেই ক্ষান্ত হলো না। টেলিফোনের নাম্বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আত্মীয়স্বজনকেও উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই গল্প বলতে দ্বিধা করল না,

– তোমরা জানো। আমাদের ক্লাসমেট মোহন কী অদ্ভুত চা বানায়। ওর হাতে নিশ্চয়ই কোনো জাদু আছে!

চার
আর মোহনের কী হলো, সে চা নিয়ে মগ্ন হলো। চায়ের ইতিহাস জানল। চায়ের সর্বোচ্চ গুণাগুণ কীভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে বই জোগাড় করল। নিজের জমানো টাকায় বেড়ানোর নামে গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটিতে শ্রীমঙ্গলের চা গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে পরিচালকের কাছে ধরনা দিলো। চা নিয়ে গবেষণা এবং ডক্টরেট করা মাইনুল ইসলামের কাছে অনুনয়-বিনয় করে ফ্যাক্টরির কর্মীদের সঙ্গে কয়েকদিন তালিম নেওয়ার অনুমতিও গ্রহণ করল। তাদের কাছ থেকে মোহন জানল, পানি ভালোমতো ফোটালে – অক্সিজেনটুকু বের হলে চা পাতা সবচেয়ে ভালো লিকারটুকু দিতে থাকে। তিন মিনিটের বেশি লিকার জ্বাল দিতে হয় না। আর সবচেয়ে ভালো চা চেনার উপায় হলো, দানাগুলো হাতে নিলে সেগুলো হাতের তালুতে ঘুরতে থাকে। কালো-সোনালি বর্ণ মিশ্রিত দানার মতো চা-ই সর্বোৎকৃষ্ট। একটি পাতা দুটি কুঁড়ি নিয়ে বানানো চা সবচেয়ে দামি বলে সে জানল। আরো জানল, যত নবীন পাতা তত ভালো চা।
চা যে-কোনো কিছুর সংস্পর্শে নিজের সবটুকু গুণাগুণ উজাড় করে ঢেলে দিয়ে সেই বস্তুর ঘ্রাণ এবং গুণাগুণ গ্রহণে চায়ের জুড়ি নেই। শ্রীমঙ্গল থেকে ফেরার পথে, সেখানকার কর্মীদের তথ্যমতে সে 888sport apps টি রিসার্চ সেন্টারের অকশনে বিক্রি হওয়া চায়ের দোকানি গুপ্ত টি-ঘরে গেল। বেছে বেছে কয়েক কেজি গোল্ডেন বিওপি, ক্লোন জিবি-৪ গোত্রের চা সংগ্রহ করল।
আর এই সবকিছুই এত মগ্নতার সঙ্গে সে করল ক্যামেলিয়া নামে একটি মেয়ে চায়ের মাঝে জীবনের এত স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ খুঁজে পায় বলে। ক্যামেলিয়া নিশ্চয়ই ঐশ্বরিকভাবে মেধাবী, ভাবে মোহন। না হলে এই বয়সেই এমন একটা স্বর্গীয় খাবারের মাঝে এত রহস্যকে কীভাবে ভালোবাসে সে? এই চা-মগ্নতা অনেক অল্প বয়সেই মোহনের কাছে বড় এক দর্শনকে স্পষ্ট করল। তা হলো, ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারীরাই ঐশ্বরিক রহস্যকে শনাক্ত করতে আগ্রহী হয়। হায়, ভালোবাসা! তার চেয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো জায়গা আর কোথাও নেই। চায়ের বৈশিষ্ট্য আর এত গুণাগুণ জেনে ‘চা’ শব্দটার প্রতি তার কেমন মায়া তৈরি হলো। সে পণ করে, কেউ হোক না হোক – সে চায়ের মতোই হবে। নিজেকে অন্যের মাঝে বিলিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো আর বড়ত্ব কিসে?
মোহনলালের চা-খ্যাতি ক্যামেলিয়ার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছাল। তারপর থেকে ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মাঝে ক্যামেলিয়া বাবা-মাসহ মোহনের হাতের চা খেতে ছুটল তাদের গ্রামের বাড়ি। রওনক বিস্ময় প্রকাশ করে নিজেই বলে বসলেন, – তুই, যাই-ই বলিস, মা। মোহন ছেলেটার হাতে জাদু আছে।
দিন দিন শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটার সৌন্দর্য মুগ্ধ করল ক্যামেলিয়ার বাবা-মাকেও। উদার দুই পরিবার একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠল। তার মাঝখানে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করল মোহনলালের চা!
মোহনের গ্রামের বাসা থেকে তরতাজা শাক-সবজি আর ফল পেলে তিনি আর অস্বস্তিবোধ করেন না। মতিলাল এই পরিবারকে ভালোবেসে পুরো সপ্তাহের গরুর দুধ তাদের বাসায় একদিন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। দুই পরিবারের এই আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছিল ক্যামেলিয়ার। ঘরে-বাইরে সর্বত্র সে একটা হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বলে কুদ্দুস এবং সজীব গ্রাম-শহরের পাড়া তোলপাড় করল।
এভাবেই গেল একটা বছর। ক্যামেলিয়া আর মোহন তখন দশম শ্রেণিতে। ১৯৯০ সালের মার্চের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কুদ্দুস এবং সজীবের দল এক গোপন বৈঠকে মিলল। সজীব বলল,

– আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভালো মেয়েটাকে দখল করেছে এক মালোয়ানের বাচ্চা। আমাদের মান-ইজ্জত আর থাকল না। কুদ্দুস তুই ক্যামেলিয়াকে প্রেমের প্রস্তাব দে …
তাদের আপ্রাণ প্রেম-চেষ্টায় ত্যক্ত-বিরক্ত ক্যামেলিয়া ক্লাস-টিচার শিশিরকুমারের কাছে লিখিত অভিযোগ করল। ক্যামেলিয়া এতদিন পর এও জানাল যে, আজিজুর রহমান ডাকুয়া স্যারের বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার পথে সজীব-কুদ্দুস তার ওড়না কেড়ে নিয়েছিল এবং প্রেম না করলে গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল।
ক্যামেলিয়ার অভিযোগে কুদ্দুস এবং সজীব দুজনকেই স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানে এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও শহরের কয়েকটা পাড়ায় পরিস্থিতি মোড় নিল অন্যদিকে। এক হিন্দু ছেলের প্ররোচনায় আরেক হিন্দু শিক্ষক মুসলমান সন্তানদের ক্ষতি করেছে বলে তাদের পরিবারগুলোতে সন্ধ্যার ফিসফিস চাউর হতে থাকল।
এসব নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের মাঝে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তার কয়েক দিন পরই পুরো ভারতবর্ষ উন্মাতাল হয়ে উঠল। বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় যোগ হতে থাকল আগের আক্রোশ। মোহন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেলিয়াকে পাওয়া গেল না। রওনক ভাবলেন, মোহনের সঙ্গে হয়তো সে তাদের গ্রামে গেছে। চিঠি ছাড়া তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল টিঅ্যান্ডটির ফোন। সুতরাং তারা ক্যামেলিয়ার খোঁজে মোহনদের বাসায় এসে হাজির হলেন।
দুই পরিবার অস্থির হয়ে ক্যামেলিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে মধ্যরাতের আগে পুলিশ এসে মোহনকে অ্যারেস্ট করল। আজিজুর রহমান ডাকুয়া স্যারের বাসা থেকে ফেরার পথটা বেঁকে একটা ভাঙা মন্দিরের দিকে গেছে। করতোয়ার ওপরেই সেই বহুদিনের পরিত্যক্ত মন্দিরের ভেতর ক্যামেলিয়ার লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা, ক্যামেলিয়া আত্মহত্যা করেছে এবং তার কারণ মোহনলাল। তার সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়তেও পারছে না, মানতেও পারছে না বলে ক্যামেলিয়ার মতো অতিসংবেদনশীল মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
কিন্তু হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পর কী হলো, পুলিশ কেসটা আর সামনে নিল না। দশদিনের মাথায় মোহনকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু তারপর থেকেই মোহনের মনোভূমিতে বাস করা সব স্বপ্ন ওলটপালট হয়ে গেল। ক্যামেলিয়ার মৃত্যুর জন্য তার নিজেকেই দোষী মনে হতে লাগল। গ্রামের 888sport free betলঘু এক পরিবারের শিক্ষক কাম কৃষকের সন্তান হয়ে শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের মেয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া এ-সমাজে নিঃসন্দেহে বড় এক অপরাধ। তার চেয়েও বড় অপরাধ তাকে মুগ্ধ করার জন্য চা নামের সামান্য এক বস্তুর মাঝে অসামান্য মগ্নতা ঢেলে দেওয়া! দিন দিন কী এক ঘোরের ভেতর ডুবে যায় মোহন। নিজের কাছে নিজেই শত্রু হয়ে ওঠা এক মোহনকে সে খুঁজে বেড়ায় ক্যামেলিয়া নামের এক উদার, মোহনীয় ফুলের মাঝে। সেই খুঁজে বেড়ানো ছাড়া তার বেঁচে থাকাটা মিথ্যা মনে হয়। আশপাশের মানুষগুলোর মাঝে কি ক্যামেলিয়ার মতো প্রজ্ঞা আছে? যাদের মাঝে একটু প্রজ্ঞা আর 888sport app download apkর ছোঁয়া পায় তাদেরকেই কেন চা বানিয়ে খাওয়াতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে?

পাঁচ
মোহনের কোনো ওজর-আপত্তি মতিলালের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। ফলে পরিবারের সঙ্গে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে সে চুপিচুপি বাইরে এসে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। অদ্ভুত এক ঘ্রাণ তাকে আচ্ছন্ন করল। কোন ফুলের ঘ্রাণ এমন? ক্যামেলিয়া ফুলের ঘ্রাণ আছে কি? অশ্রুভরা চোখে সে আকাশের তারাগুলোকে আরো ঝাপসা দেখল। সারারাত জেগে, নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করল বাংলার গ্রামগঞ্জকে পেছনে ফেলা ছুটে চলা ট্রেনের কামরায়!
ভারতের শুকনো, ঊষর মাটি দেখে কেন মোহনের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। তার ফেলে আসা গ্রাম-মাটি কিছু নয়; মনে পড়ল একজোড়া মায়াবী চোখের চাউনি। সেই চোখের চাউনি মিশে আছে উপশহরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার চারপাশের প্রকৃতি হয়ে বাতাস-আকাশের বজ্রনিনাদিত একলা কোণে। ক্যামেলিয়া, ক্যামেলিয়া শব্দ তাকে সারারাত ঘুমাতে দিলো না। মনে হলো, কৃষ্ণচূড়াগাছটার নিচে ক্যামেলিয়া স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কে এই ক্যামেলিয়া? ক্যামেলিয়া কি তার শুধু বন্ধু? আর জন্মের বড় দিদি? মোহনের চোখে একটা দৃশ্যকল্প ভাসতে থাকে, একটা নির্জন পুকুরের কোণে ক্যামেলিয়া শব্দটা দোয়েলের লেজে দুলছে! হ্যাঁ, ক্যামেলিয়া। তার বন্ধুর চেয়ে অনেক বড় কিছু। ক্যামেলিয়া – মনে হলেই কেন একটা বাক্য তার মাথায় ঘুরপাক খায়?
‘ত্বকে তোমার তখনো ধরেনি কলকলে রঙ!’
তারপর যে কতবার তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখল মোহনলাল! দেশ ছাড়ার সাত মাস পর সে স্বপ্নে দেখল, একটা নিষ্পাপ জীবনের মৃত্যুর জন্য আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। কী এক ঘোরের বশে রাত জেগে লিখল সে জীবনের প্রথম 888sport app download apk। তার কয়েকটা লাইন এমন,
অনেকবার গিয়েছি তোমার কাছে।
ত্বকে তোমার তখনো ধরেনি কলকলে রং,
কত যে বার দেখেছি তোমায় লুকিয়ে লুকিয়ে।
জগৎ মাতানো তোমার ঘ্রাণে আকুল আকাশের পর আকাশ
আকাশের পর ওই যে পদ্ম পাতার পুকুর, আমি কতবার গিয়েছি
তোমার চোখের পাতার পাপড়িময় মাঠে মাঠে!
ঝাপসা 888sport sign up bonusগুলো পেরিয়ে শিশিরকুমার স্যারের মুখটা স্পষ্ট হয় মোহনের সামনে। শিশিরকুমার বলছেন, – আমি তো মতিলালকে চিনি, বড় জেদি মানুষ। যেহেতু তুই বাবা-মার অবাধ্য হয়েছিস সুতরাং সে তোকে অর্থকড়ি দিয়ে আর সাহায্য করবে না।

– আমি কারো সাহায্য চাই না, স্যার। আমার পরিবার দেশ ছেড়ে এখন ভারতে।
আমি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। আর ফিরতে চাই না। আমি আপনার একটু সাহায্য চাই।

– অবশ্যই। বল দেখি। কী করতে পারি তোর জন্য?

– উপশহরে কৃষ্ণচূড়াগাছটার নিচে সামান্য একটু জায়গা আমার প্রয়োজন।

– তারপর?

– আমি চায়ের দোকান দেবো।

– চায়ের দোকান, মানে তুই চা বানিয়ে বিক্রি করবি?

– হ্যাঁ, স্যার।

– মতিলাল পরিবারের ছেলে হবে চা-বিক্রেতা? বলিস কী! তোর পড়াশোনার কী হবে?

– কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। আর পড়ব না।

– ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করেছিস, পারবি তো? চা-বিক্রেতা হয়ে জীবনকে মেনে নিতে?

– আমি আর কিছু হতে চাই না। কারো পরিচয় নিয়ে বাঁচতেও চাই না। কে কী ভাবল তা নিয়ে আমার কিছু এসেও যায় না। শুধু জানি, আমি জীবনে ওই একটা কাজই ভালো করে করতে শিখেছি। ওই একটা কাজ করতেই আমি ভালোবাসি।
মনে পড়ে, শিক্ষক হয়েও তার বাবা কৃষকের মতো মাঠে কাজ করে বলে মোহন লজ্জা পেত। ক্যামেলিয়া তার এই হীনমন্যতা বুঝত। সেজন্য সে মোহনকে বলেছিল বয়সের চেয়ে ভারী সেই কথাগুলো,

– কোনো কাজই ছোট নয়। যে কাজ মানুষ মগ্ন হয়ে করতে ভালোবাসে তাই-ই তাদের শ্রেষ্ঠ কাজ। সমাজের এক শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে ছোট-বড় ধারণা তৈরি করে। কিন্তু যারা অন্ন সৃষ্টিতে স্রষ্টার সহায়ক তাদের চেয়ে বড় আর কে আছে? হ্যাঁ, মোহন? বলো, ঠিক কি না?
দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটাকে তার আর জন্মের বন্ধু মনে হতো। সেই বন্ধু যে তার বয়সের চেয়ে কম করে হলেও দশ বছরের বড়। তার শাসন-বারণ মানতে বড় ভালো লাগত।
শিশিরকুমার তার ছাত্রদের সহায়তায় কৃষ্ণচূড়ার গাছটার নিচে চায়ের দোকান তৈরিতে সব সহযোগিতা করলেন। বেশ খোলামেলা জায়গা নিয়ে দোকানের নাম হলো, মোহনলালের চা। তারপর কেটে গেল দেড় যুগ।

ছয়
সম্প্রতি ইন্ডিয়ায় কী যেন এক আইন হয়েছে। নাগরিকত্ব আইন ধরনের কিছু। মোহন অতসব জানতে চায় না। কিন্তু এ নিয়ে তার দোকান সরব। মুসলমানদের তাড়াতেই নাকি এমন আইন তৈরি করা হচ্ছে। কিছুদিন হলো উলটা পাশের চা দোকানের নাম বদলে, মুসলমান-মঙ্গল চা ঘর রাখা হয়েছে। দেশে ইয়াবার চল প্রকট হওয়ায় নতুন প্রজন্ম মনে হয় চায়ের স্বাদের পার্থক্য খুব একটা বোঝেও না। তবে সমাজকে দেখানোটা তারা খুব ভালো বোঝে। বোঝে জনপ্রিয় হওয়ার ধরন-ধারণ। পুরো সমাজের অন্তরালে দিন দিন প্রকট হয়ে ওঠা ধর্মীয় বিভাজনকেও এরা কাজে লাগায়। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারত তোলপাড় হওয়ার প্রাক্কালে একজন তরুণ কবি, মুসলমান-মঙ্গল চায়ের দোকানে আর সব কবিদের নিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিলো, – মালুদের বানানো চা খেলে মাথার মাল থাকবে না। যারা নাগরিকত্ব বিল বানায় তাদের পরিত্যাগ করুন। আমরা বিশুদ্ধ 888sport app download apkর জন্য হালাল চা পান করি।

দুই কাপ চা দাও মোহনলাল …
চেনা গলার ডাকে নয়, মোহনলাল শব্দটা শুনে চমকে তাকাল সে। এই নামে তাকে বহু বছর আর কেউ ডাকে না। সে সবার মামা। ছোট-বড় সবাই তাকে মামা বলেই সম্বোধন করে। কী আশ্চর্য সোবহান মিয়া তাকে ‘মোহনলাল’ ডাকছে? ভেতরে ভেতরে আজকাল সোবহান কিসের যেন আক্রোশ পুষে রাখে। আবার মোহনের জন্য তার দয়াও হয়। উদাস, বিষণ্ন এবং চিন্তিত সোবহানকে মোহন বলল, – আপনি কেন যেন আজকাল আর মামা ডাকেন না, মামা! মোহনের আদুরে আবদারেও ফুঁসে উঠল সোবহান,

– আরে বে, শালা। ফ্যাতলা না পেরে চা বানা এক কাপ। ছোট জাত – শালারা মানুষ হয় না! এরা পদ পেলেই গণ্ডারের শরীর আর হায়েনার চোখ পায়। এরা যতটা ধর্ম চিনে, ততটা মানুষ চেনে না। নাগরিকত্ব বিল বানিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়। চা-ওয়ালা কি মানুষের জাতে ওঠে? এদের মামা ডেকে আমার নানার গোষ্ঠীকে অপমান করতে চাই না।
লিকার-চিনির সঙ্গে দুধের মিশ্রণের অনুপাত ঠিক হলো না মোহনের। তার হাত আর আগের গতিতে চলতে চাইল না। তবু, মাথা হেঁট করে সে মনে করার চেষ্টা করল ছোটবেলায় একটা ক্ষেত দেখিয়ে তার বাবা তাকে বলেছিলেন, এর শরবত থেকে চিনি হয়। সারাজীবন চেনা সেই চিকন চিকন বাঁশের মতো গাছটার নাম আজ সে কোনোভাবেই মনে করতে পারল না।
এদেশে, সেদেশে কিসব উত্তেজনা তৈরি হয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অথবা ধর্মে-ধর্মে বিদ্বেষ-দাঙ্গা হয়; আর এভাবেই মোহনের চায়ের দোকানের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। পুরনোরা অনেকেই তার দোকান ত্যাগ করলেও সারাজীবন ভালো পরামর্শ দেওয়া, পাশে থাকা কবি আবিদ আহসানসহ কয়েকজন মানুষের মনোভাব কোনোভাবেই বদলাল না। ধর্মের পরিচয়ের চেয়ে এই মানুষগুলো মোহনের চায়ে 888sport live chat-পরিচয়কে বড় করে দেখে। বড় করে দেখে তার মানুষ পরিচয় এবং এতদিন তার পাশে বসে আড্ডা এবং চা পানের মধুর 888sport sign up bonus রোমন্থনকে ভালোবাসে। বি888sport sign up bonus তাদের কাছে মৃত্যুর তুল্য হয়তো!
আবিদ আহসানের মতে, আত্মার সারথিকে ব্যবসায়ীরা ত্যাগ করতে পারে, মানবিক সম্পর্কের চেয়ে আর্থিক-দৈহিক সম্পর্ককে বড় করে দেখতে পারে। কিন্তু একজন কবি যদি তা করেন তাহলে শুধু তার নয়, সমগ্র মানবাত্মার পরাজয় ঘটে। কবিকে শুদ্ধতম আত্মার লালন এবং পালন নাকি করতেই হয়। এবং তিনি তার কথার মতোই এ-ব্যাপারে সৎ। তার জন্য আবিদ আহসানদের মতো মানুষকে যে কত ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার চাক্ষুষ সাক্ষী মোহন।
চা পানের মানুষ কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাওয়ায় একদিন আবিদ আহসান মোহনকে তার ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখার জন্য গোপনে একটা পরামর্শ দিলেন,

– শোনো, মোহন। তুমি এখন এই দোকানের নামটা পালটে ফেল। নতুন কবিদের দল ফেসবুক প্রচারণায় শক্তিশালী তো। পরিস্থিতি এখন এমন, ওদের দলের বাইরে গেলে এ-শহরে বড় কবিদেরও অস্তিত্ব থাকবে না। মোহন অবাক হয়ে বলল,

– ওরা কবি? ওদের 888sport app download apk তো গোখাদ্যের অনুপযুক্ত, দাদা। ওসব যদি 888sport app download apk হয়, তাহলে আমার চায়ের কাপগুলো অনেক বড় কবি। ধোয়ার সময় ওগুলো ছন্দবদ্ধ শব্দ করতে জানে …

– আরে এখন কি আর 888sport app download apkর যুগ! এখন আত্মঘোষণা দিলেই কবি হওয়া যায়। আত্মপ্রচার আর সিন্ডিকেট কবির দল থাকলেই হলো। মানুষের অনুসন্ধিৎসা বলে আর কিছু নেই, বড় কলির যুগ, মোহন! তুমি 888sport app download apk পড়ো, তা জানি। তাই বলে, ওদের খবরও …? মোহন এ-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,

– দোকানের কী নাম দেবো, বলুন দাদা?

– চা, 888sport app download apk এবং ক্যামেলিয়া।
স্থির দৃষ্টিতে 888sport apk download apk latest versionভরে মোহন তাকিয়ে থাকল বয়োজ্যেষ্ঠ কবির দিকে। তার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

– নতুন প্রজন্মের কবিরা না জানলেও আমি জানি হে, চায়ের ভেতর কিসের মায়া তুমি লুকিয়ে রাখো!
মোহনলালের চা-ঘরের ব্যানারটি বদলে গেল। আবিদ আহসান একদিন ফুলসহ বড় একটা চারাগাছ এনে পাশের ফাঁকা স্থানে সমমনা লোকদের নিয়ে রোপণ করলেন। বললেন,

– বুঝলে, মোহন। এই হলো তোমার ক্যামেলিয়া। একে যত্ন করো আর ভালোবেসো। আমি মরে গেলে – ক্যামেলিয়া আর আমার কবরে একটা করে ঝরে যাওয়া ফুল মাঝে মাঝে রেখে এসো।
সবাই চলে গেলে, আবিদ আহসানের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে টলটল চোখের জল লুকাল মোহন।
রাতে ঘরে ফেরার আগে ফ্রেশ দুধ আর গুপ্ত চা ঘর থেকে আমদানি করা চা দিয়ে দুই কাপ চা বানায় মোহন। নিজের কাপে এক চুমুক পরিমাণ নিয়ে সমপরিমাণ চা সে ঢেলে দেয় গাছটার গোড়াতে। ক্যামেলিয়ার সঙ্গে তার চা-পানের এই মুহূর্তের জন্য সে সারাসন্ধ্যা অপেক্ষা করে। ঘরে ফেরার আগে গাছটির কাণ্ডে-পাতায় স্নেহমাখা হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে,
ভালো থেকো আমার ক্যামেলিয়া
ভালো থেকো রাতের চাঁদ-ছায়া!
কিছুদিনের মধ্যেই গাছটা তেজি হয়ে উঠল। ছড়াতে থাকল ক্যামেলিয়া ফুলের ঘ্রাণ। কী আশ্চর্য, সেই গন্ধে অদ্ভুতভাবে মিশে থাকে চায়ের অপূর্ব ঘ্রাণ! আর নামের কারণেই তার চা-ঘরে তরুণ-তরুণীর আনাগোনা বেড়ে গেল। লোকজন আবার একটু একটু করে ফিরতে শুরু করল। কবিরা কতবড় স্বপ্নদ্রষ্টা – ভেবে অবাক হয় মোহন।

সাত
কিন্তু ফেরার মাঝেও সমাপ্তির ইঙ্গিত থাকে। শনশন উদাস চৈত্রের এক পড়ন্ত দুপুরে একদল পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল মোহনের চায়ের দোকান। মোহনই যে মোহনলাল তা নিশ্চিত হয়ে তারা তাকে গ্রেপ্তার করল। সেখানে সবে এসেছেন কবি আবিদ আহসান। তিনি প্রতিবাদের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠতে চাইলেন। শুনলেন পুলিশ মোহনকে বলছে – – ‘চা’ দিয়ে একটা মুসলমান মেয়েকে পটাইছিলা। তুমি যেদিন মন্দিরে চা খাইয়ে রওনককে রেপ করে খুন করো, সেদিন তোমার চরিত্রের অনুরূপ এক সহযোগী ছিল। তার বাম কনুইতে কাটা দাগ আছে …
ভাষা হারিয়ে মোহন ফ্যালফ্যাল করে দারোগার দিকে তাকিয়ে থাকল। দারোগা বলল,

– তোমার সেই সহযোগী কবিবন্ধু এই ক্যামেলিয়া গাছটার চারা তোমাকে দিয়েছিল। চলো, তার বাসাটা চিনিয়ে দাও।
কবি আবিদ আহসান চায়ের কাপ রাখলেন এবং ধীর পদক্ষেপে 888sport app download apkর চারণভূমি ছেড়ে চিরদিনের তরে পালাতে চাইলেন অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে! মুসলমান-মঙ্গল চা-ঘরে তার দৃষ্টি গেল। ছুটির দিনে এই অসময়ে তিনি অনেক উঠতি কবিকে দেখে অবাক হলেন। আরো অবাক হলেন, তাদের দলনেতা স্থানীয় এক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আল তৌহিদকে দেখে। যিনি একজন প্রচারসর্বস্ব লেখকও বটে। বশির একদিন তাকে অফিসে ডেকেছিল।
একটা নিম্নমানের জগাখিচুড়ি মার্কা দেড়শো পাতার 888sport alternative link হাতে ধরিয়ে বলেছিল,

– আপনি খুব গ্রহণযোগ্য মানুষ। আমার এই 888sport alternative link নিয়ে একটা রিভিউ লেখেন। আপনার নাম থাকলে 888sport appsের সবচেয়ে বড় পত্রিকায় রিভিউটা পাবলিশ করাতে সুবিধা হবে। আমার বই নিয়ে, ফেসবুক-পত্রিকা বা কোনো ব্লগে লিখতে প্রতি শব্দের জন্য তরুণদের দিই পাঁচ টাকা। কিন্তু আপনাকে দেবো দশ টাকা, আপনি চাইলে আরো বেশি!
ভদ্রতা করে আবিদ আহসান বইটা নিয়েছিলেন। পড়ার পর তিনি আর রিভিউ লেখেননি। বশির ফোন করে প্রায় ধমকের স্বরে বলল,

– কী ভাই, আর কত মাস লাগবে এক বই নিয়ে রিভিউ লিখতে? বশিরের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথায় তিনি তাকে স্পষ্ট বলেছিলেন,

– এমন মানহীন বই নিয়ে রিভিউ লিখলে আমার সারাজীবনের সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে। আপনাকেও বলি, সৃষ্টিশীল কাজের চেয়ে আপনি বরং 888sport live-নিবন্ধ চেষ্টা করে দেখুন। বশির তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল,
– আমার দলে এলে লাভ করতেন, স্মার্ট হতে পারতেন। আফসোস, পায়ে পুরনো স্যান্ডেল আর কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়েই আপনার জীবন যাবে।

আবিদ আহসান দৃষ্টি ফেরালেন পথে। সুনসান নীরব রাস্তাটির দিকে। আরো সামনে …

… যেখানে 888sport app download apkয় রক্ত নেই, আছে মোহন নামের এক প্রেমিকের বানানো চায়ে ক্যামেলিয়ার ঘ্রাণ।

Published :

,

Comments

Leave a Reply