যুধিষ্ঠিরের সহোদর

পূরবী বসু

না, অবুঝ বালক সে নয়। হঠাৎ করে বা তাৎক্ষণিকভাবে মন-উচাটনের কারণে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বার মতো তরুণ বয়সও তার নেই। সে খুব ভালো করেই জানে নিজের অবস্থান। যথেষ্ট সজাগ প্রতিটি পদক্ষেপে। কর্মকাণ্ডে।
সে জানে, তার চিন্তার কিংবা লেখার পরিধি এটা নয়, যেখানে কল্পনাকে সে আকাশের অন্য পাড়ে পৌঁছে দিতে পারে। পারে ইচ্ছা করলে সাগরের অতলে ডুবিয়ে দিতে। এমনকি চাইলে দুটোর মাঝামাঝিও রাখতে পারে কোথাও – যেমন, এই মাটিতে সমতল ভূমিতেই, কিংবা ভাসমান অবস্থায় উড়িয়ে দিতে, অন্তরীক্ষে। কিন্তু সেসবই তো কল্পনা।
তার নিজস্ব চলাচলের গণ্ডির কথা, তার সীমাবদ্ধতার কথা, সে সাধারণত ভোলে না। ব্যক্তিগতভাবে, স্বভাবে, আবেগতাড়িত সে নয় – কোনোদিনও ছিল না। এছাড়া বাইরের লোকের কাছে, পরিবারের মানুষের কাছে ভালো মানুষ, ভদ্রমানুষ, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ হিসেবে তার একটা পরিচিতি – একটা সুনাম রয়েছে। নেহায়েত কোনো শখ বা প্রবৃত্তির কাছে সেই ইমেজটা নষ্ট করে ফেলার প্রশ্ন আসে না।
সে এটা ভালো করেই জানে একটি রাতের দৈর্ঘ্য একই রকম হয় না বা থাকে না সবসময়। ঘণ্টার বিচারে খুব বেশি তারতম্য না হলেও কোনো কোনো রাত আসে যা মনে হয় অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত, যেন চিরস্থায়ী। আবার কোনো কোনো রাত বিগত দিনটার মতোই নাতিদীর্ঘ। বৈশিষ্ট্যহীন সেসব রাত বিনা বৈচিত্র্যে হুশ করে কেটে যায়। তবে বেশির ভাগ রাতকেই মনে হয়, অন্তত ইদানীং তার মনে হয়, অতি সংক্ষিপ্ত। ঘুমের বড়ি খেয়ে একটা লম্বা ঘুমে কাটিয়ে দেবার মতো আর কী। তবে গতকালের রাতটি তেমন ছিল না।
সে জানে যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বাস করেও একজন মানুষ আরেকজন সম্পর্কে কিছুই না জানতে পারে, আগ্রহী বোধ করতে না পারে। আবার সেই একই ব্যক্তিদ্বয় কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতিতে একই ছাদের নিচে, অথবা খোলা আকাশের তলায় মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা যৌথ যাপনে খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারে। স্থির ও স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে একত্রে-কাটানো মুহূর্তগুলো, কালের গতিকে রুদ্ধ করে দিয়ে। পরে সেই স্বল্প ও বিশেষ কয়েকটি মুহূর্ত আস্তে আস্তে দীর্ঘায়িত হয়ে, বিস্তারিত হয়ে একসময় পুরো জীবনটাকেও ছেয়ে ফেলতে পারে। সেটাও সম্ভব।
এত দূরে এই ভিনদেশের এক বার্ষিক 888sport live footballসভায় যোগ দিতে আর প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতে এক সপ্তাহের জন্যে দেশ ছেড়ে বাইরে আসার কোনো বাসনাই তার ছিল না। অন্তত প্রাথমিকভাবে। এমন ধরনের আমন্ত্রণ সে অতি অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেছে বেশ কয়েকবারই, এর আগে। এবার সীমার একান্ত আগ্রহেই ঘটে গেল এই সংক্ষিপ্ত সফর। সাম্প্রতিককালে তার স্বামীর জনপ্রিয়তার কিঞ্চিৎ নিুগতি আর লেখালেখির 888sport free betর কমতি সীমাকে ঠিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না করলেও, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিয়েছে। তাই এই সফরকে কেন্দ্র করে স্বামীর সুনাম সংবাদপত্র আর প্রাইভেট টেলিভিশন পরিবেশিত টুকরো খবরের মধ্য দিয়ে যদি আরেকটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর ওর লেখার ব্যাপারে কেবল পাঠক নয়, ও নিজেও যদি আরেকটু উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে। মন্দ কী? আর সেজন্যেই মনে হয় এই আমন্ত্রণে সীমার উৎসাহটা প্রথম থেকেই বেশ জোরালো ছিল।
সে যা-ই হোক, অবশেষে সে নিজেও রাজি হয়েছিল। স্ত্রীর আগ্রহে খানিকটা, নিজেরও করার তেমন কিছু ছিল না হাতে, সেটাও একটা কারণ। অবসরগ্রহণের পর থেকে সবসময় ঘরে বসে সময় কাটানো যে সর্বতো সুখের ব্যাপার নয়, এই উপলব্ধিও খানিকটা কাজ করে থাকবে। দৈনন্দিন অফিসের কাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এক বিশাল পরিবর্তন আনে জীবনে, যার সবটাই খুব শুভ বা সুখকর নয়। এমনকি তার মতো লেখকের জন্যেও নয়, যার নিরবচ্ছিন্ন সময়ের দরকার পড়ে মাঝে মাঝে। দাড়ি কেটে, চান করে, ভালো পোশাক-টোশাক পরে প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্যে কর্মস্থলের উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়া, আবার নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফিরে আসা Ñ দীর্ঘদিনের এই রুটিনটি হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেলে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। আসা-যাওয়ার পথে অথবা অফিসের ভেতরে নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, তাদের মধ্যে কথাবার্তা, পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন এবং বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা তর্ক-মন্তব্য, ব্যাখ্যাহীন ও অমীমাংসিত বহু ছোটখাটো ঘটনা, আচরণ তাকে বরং লেখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিতই করতো একসময়। এখন, এই বাড়তি সময়টা অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগানো খুব সহজ মনে হয় না তার কাছে। কেমন এক শৃঙ্খলার অভাবও বোধ করে প্রাত্যহিক জীবনে। ফলে অফুরন্ত সময় পেলেও সৃজনশীল কোনো রচনায় হাত বাড়াতে আলস্যে ভর করে মন। দিন কেটে যায়। লেখা হয় না কিছু।
গত পাঁচদিন ধরে এই অচেনা শহরে যেমনটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা যা করার বা দেখার কথা ছিল, সব-ই যথারীতি সম্পন্ন হয়েছে। নির্বিঘেœই। কিন্তু গত রাতে, অর্থাৎ ফিরে আসার আগের রাতটিতে, সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে গেল। আচমকা। তার ছককাটা জীবনের বাইরে নিজের একখানা পা Ñ অতিপরিচিত কড়ে আঙুলের ওপর একটি কালো তিলসহ তার পায়ের সম্পূর্ণ পাতাখানা হঠাৎ আবিষ্কার করে বসে সে। অথচ চোখ-কান বন্ধ করে বহমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলার মতো বেহিসেবি লোক সে মোটেও নয়। অভিজ্ঞ, অন্তরমুখী মানুষ সে। সবসময়ে সব ব্যাপারেই একটু বেশি সতর্ক। সে ভালো করেই জানে, সময়টা খুব নাজুক। শুধু হৃৎপিণ্ডে নয়, হৃদয়েও হাতুড়ি পেটানো শুরু হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এসময় Ñ এই প্রান্তিকালে, যখন মাঝে মাঝেই মনে হয় দিন ফুরিয়ে আসছে, সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে, জীবনের কিছু কিছু অপূর্ণ সাধ আর আকাক্সক্ষা যখন তীব্রভাবে অনুভূত হয়, বুকে তোলপাড় করে, মোচড় দেয়, অথচ সংসারের রজ্জুগুলো চারপাশ থেকে যখন আষ্টেপৃষ্ঠে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হয়। সে তখন আরো বেশি করে নিজের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আরো সাবধানী হয়ে ওঠে। হয়ে পড়ে আরো মিতভাষী।
সে বোঝে, টের পায়, বয়স হয়েছে তার। জীবনে দেখেছে প্রচুর। পড়েছে এবং লিখেছে তার চেয়েও বেশি। মানুষের জীবনে সময়ের আপেক্ষিকতা তার চেয়ে ভালো বা বেশি জানে কজন? সে বোঝে, এই মুহূর্তে সে কী করে, এই বিশেষ সময় বা ঘটনাটিকে কীভাবে নাড়াচাড়া করে বা কেমন করে তার প্রতিক্রিয়া জানায়, তার ওপরই নির্ভর করবে পরের মুহূর্তের করণীয় বা বাকি জীবনের চেহারা। সব জানা সত্ত্বেও সবসময় যথোচিত ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, সেও তো মানুষই, সাধারণ, স্বাভাবিক একজন মানুষ। অলৌকিক কোনো শক্তির বা বিশেষ ক্ষমতাধারী কেউ তো নয়। আসলেই।
তার লেখার একাগ্র অনুরাগী স্বদেশি তরুণীটিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত আর ভনিতাহীন মনে হয়েছিল তার, প্রথমদিন নিজে থেকেই কাছে এসে পরিচয় দিয়েছিল যখন, তখনই। সে বলেছিল, তার শেষ বইটি পড়ে সে খানিকটা হতাশ হয়েছে। কথাটা গোপন করার কোনো চেষ্টাই করেনি সে। হয়তো অন্যরকম প্রত্যাশা ছিল তার। তবে গত বছরে প্রকাশিত তার দুটো 888sport alternative linkই অসাধারণ মনে হয়েছে তার। কেন তার কাছে সেগুলো অসাধারণ লেগেছে, দু-চার কথায় সেটাও ব্যক্ত করেছে মেয়েটি। সন্দেহ নেই বুদ্ধির দীপ্তি ছড়ানো সেই মুখমণ্ডলের দিকে সোজা তাকিয়ে তার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। ভাবখানা এমন, যেন মেয়েটিই বলে দিচ্ছে কী আছে ওই বইগুলোর ভেতর আর সে নিজে যেন ওই বই সম্পর্কে কিছুই না, জেনে হাঁ করে তার কথা শুনেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মেয়েটির 888sport live footballে যথেষ্ট পড়াশোনা আছে – বাংলা, ইংরেজি দুই 888sport live footballেই, যদিও সে এখানে এসেছে স্থাপত্যবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। মাত্র বছর দুয়েক হলো দেশ ছেড়ে এসেছে, ফলে পিছুটানটা এখনো একটু বেশিই। বিশেষ করে বাংলা 888sport live football-888sport live chatে কেমন যেন মোহগ্রস্ত, আবিষ্ট হয়ে আছে তার মন-প্রাণ – সার্বক্ষণিকভাবেই। গতকাল রাতে মেয়েটি তার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস ডরমিটরির ঘরে নিজের হাতে রাঁধা খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেতে যাওয়ার জন্যে সপ্রতিভ আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাকে। সেও সাগ্রহেই তা গ্রহণ করেছিল, তার চার তারা-খচিত হোটেলের মামুলি বিদেশি খাবার প্রত্যাখ্যান করেই।
কাল রাতে তেমন সাংঘাতিক কিছু যে ঘটেছে তা নয়। তবু বলতেই হবে, স্বীকার করতেই হবে, আজকের সকাল আর কালকের সন্ধ্যার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। সে জানে গত বারো ঘণ্টায় প্রায় এক জীবন অতিক্রম করে এসেছে সে। সে এও জানে, ইচ্ছে করলেই আর আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া যাবে না। যাওয়া যায় না। অথচ তার এই স্থানান্তর, এই বিচ্যুতি, তা কেবল তাকে নিজেকেই নিঃশব্দে বহন করে যেতে হবে – সারাজীবন।
বিমানবন্দরে সিকিউরিটি শেষে তাকে সি-অফ করতে আসা প্রবাসী তরুণদের উদ্দেশে হাত নাড়িয়ে বিদায়-সম্ভাষণ জানাবার সময় সে হঠাৎ লক্ষ করে, লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে যারা তার দিকে তাকিয়ে হাত দোলাচ্ছিল তাদের সঙ্গে সে-ও কখন এসে দাঁড়িয়েছে চুপচাপ। একপাশে। কিন্তু তার উত্থিত হাতখানা নড়ছিল না মোটেই। এ যেন ঠিক আদালতে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার প্রতিশ্র“তিতে শূন্যে স্থাপিত ঊর্ধ্বমুখী একখানা বাহু ও হাত। ডান হাত উঁচু করে ধরে স্থির ও অনড় দাঁড়িয়েছিল সে, কাঠগড়ায় সত্যভাষণের অঙ্গীকারে যেমন করে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো সাক্ষী বা অভিযুক্ত আসামি। অন্যদের মতো যতটা সম্ভব কাছে ছুটে এসে জনারণ্য আর দেয়ালের  ফোকড়-ফাকড় দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল না সে, শেষ মুহূর্তে অপস্রিয়মাণ তাকে আরেকটু ভালো করে, আরেক মুহূর্ত বেশি দেখার জন্যে। অটোগ্রাফের জন্যে কোনো খাতা বা নোটবুকও ছিল না তার হাতে যা প্রায় তার দলের অন্য সকলের হাতেই রয়েছে। সে কি ইচ্ছে করেই দেরি করে এলো বিমানবন্দরে? নাকি সোমবারের ‘রাশ আওয়ারে’ পথে আটকা পড়েছিল? কোনোদিন আর তা জানা হবে না। স্থির, নিশ্চল, ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল সে একই জায়গায়, একই রকমভাবে Ñ যেন জ্যান্ত মানুষ নয়, পাথরের মূর্তি। পরনে তার গতকাল রাতের সেই একই তাঁতের শাড়ি। গাঢ় নীল রঙের। সাদা পাড়, জমিনে অসংখ্য সাদা বুটি। সেই সঙ্গে সাদা লম্বা হাতার ব্লাউজ।
এদিকে সিকিউরিটি চেকের পর, চলন্ত যান্ত্রিক রাস্তা দিয়ে প্লেনের কাছে ক্রমশ অপসারিত হয়ে যাচ্ছিল সে। শেষবারের মতো সে পেছন ফিরে তাকায় অপস্রিয়মাণ পরিচিত মুখগুলোর দিকে। একপাশে দাঁড়ানো সেই স্বল্পভাষিণী, আর তার তারুণ্যে দীপ্ত মুখশ্রী এইমাত্র চোখের আড়ালে চলে গেল, আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। অন্য যারা, সেই পাঁচ-ছয়জন তরুণ, এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়েছিল এতোক্ষণ আশেপাশেই, তারাও আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাকে বিদায় দিতে এর চেয়ে বেশি লোকের বিমানবন্দরে আসা সম্ভব ছিল না। আশাও করেনি সে। বরং কুণ্ঠিতই বোধ করেছে আদৌ কেউ এসেছে বলে। আজ সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। দীর্ঘ উইকেন্ডের পর আজ কাজ থেকে ছুটি নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তারপরও ওরা কয়েকজন সংগঠক নিশ্চয়ই অতি কষ্ট করেই ছুটির ব্যবস্থা করে এসেছে এখানে। এসেছে সদা স্মিতমুখী সেই 888sport promo code যার সদ্য জলে ধোয়া প্রসাধনহীন মুখমণ্ডলে এখন আর গতকাল রাতের সেই হাসি বা উচ্ছলতা নেই। কাল রাতে ওকে অনেকটাই জানতে ও বুঝতে পেরেছে সে। এর আগে এত অল্প সময়ের মধ্যে আর কাউকে এতখানি কাছে পায়নি সে, এত বেশি জানাও হয়নি। আর তাই কাল রাতটি ছিল তার জীবনের একটি অভিনব রাত Ñ সবচেয়ে দীর্ঘ রাতও বটে।
সে জানে এই মেয়েটির সঙ্গে জীবনে কোনোদিনই হয়তো আর দেখা হবে না তার। পারস্পরিক ঠিকানা, ফোন নম্বর, ই-মেইল অ্যাড্রেসের আদান-প্রদান কিছুই করেনি তারা। প্রয়োজন ছিল না হয়তো। ওর কথা বলতে পারবে না; কিন্তু সে নিজে বুঝতে পারছে, এই জীবনে এই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়ের এবং ওকে এত কাছে থেকে জানার বড়ই প্রয়োজন ছিল তার।

দুই
বিমানে উঠে নির্দিষ্ট সিটে বসতে যাওয়ার আগেই টুং করে একটি টেক্সট মেসেজ আসে তার পকেটে রাখা মোবাইল ফোনে। কৌতূহলী সে বসার আগেই সিটের ওপরে হাতব্যাগখানা ফেলে রেখে বার্তা দেখতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। সীমার টেক্সট। দুবার করে তা পড়ে সে। তারপর সিটে বসে ধীরে ধীরে সিটবেল্ট লাগায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় একবার। বিমানবন্দরের বিশাল চত্বরে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না।
খুব ক্ষেপে গিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছে সীমা। সাধারণত সে ফোনই করে। মেসেজ পাঠাতে পছন্দ করে না সীমা। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হয়তো ইচ্ছে করেনি সীমার। মেসেজটা আবার পড়ে সে। মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যেই সীমার গভীর হতাশা, তার ক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস আর কণ্ঠের ঝাঁজ টের পায় সে, এখানেই এতদূরে এই প্লেনের ভেতরে বসেই। সীমা জানিয়েছে, সুদীর্ঘ ২৬ বছর একত্রে ঘর করার পর সে কিনা এক অনাত্মীয় তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে এক্ষুনি জানতে পেল তার স্বামী ধনেপাতার গন্ধ মোটেই সইতে পারে না। ওই বস্তুটি দেখলেই নাকি গা গুলিয়ে ওঠে তার। অথচ সীমা বছরের পর বছর কত যতœ করে কতরকম রান্নায় তার অতিপ্রিয় ধনেপাতা ব্যবহার করে আসছে, আর শখ করে সেই খাবার নিজের হাতে তুলে দিয়েছে স্বামীর পাতে। কোনো কোনো দিন হয়তো জোর করে আরো খানিকটা খাইয়েছে ধনেপাতা দিয়ে রাঁধা বিশেষ কোনো পদ। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এভাবে কেটেছে। সীমা লিখেছে, নিজেকে আজ বড্ড প্রবঞ্চিত ও বোকা লাগছে তার। এই কথাটা শোনার পর থেকে সীমার এখন সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে, তার স্বামীকে এত বছরেও সে জানতে বা বুঝতে পারেনি।
একটাই মেসেজ, কিন্তু আকারে যথেষ্ট বড় হওয়ায় দুটি অংশে দুবারে তার মোবাইলে এসেছে।
সীমা যে সত্যি সত্যি অত্যন্ত আহত হয়েছে, তার বড় প্রমাণ জীবনে প্রথমবারের মতো আজ সে বিমানবন্দরে আসেনি তাকে ঘরে নিয়ে যেতে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় ব্যতিক্রম। ছেলে তার নিজের গাড়ি চালিয়েই চলে এসেছে। সঙ্গে এসেছে ছোট মেয়েটি।
ঘরেই ছিল সীমা। তেমন জরুরি কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল বলে মনে হলো না।
সে জানত এই ঝড় সামাল দিতে বেগ পেতে হবে তার, যদিও তার এই ব্যবহার, এই গোপনীয়তার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বা প্রতারণার অভিপ্রায় ছিল না কখনো।
ছেলেমানুষের মতো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সীমাকে সে বলতে বাধ্য হয়, ‘তোমাকে এটা মানতেই হবে, কুরুক্ষেত্র বাধাবার মতো অপরাধ এটা নয়।’
কোনো উত্তর দেয় না সীমা।
সে তখন আবার বোঝাতে চেষ্টা করে, ধনেপাতার গন্ধ তার যে অপছন্দ, সেটা এত বছর ধরে সীমাকে জানতে না দেওয়ার মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র বা দুরভিসন্ধি ছিল না তার। একটি মাত্রই কারণ যার জন্যে এ-কথা সীমাকে কখনো সে বলেনি, আর সেটা হলো, সে জানে সীমা ধনেপাতা কী ভীষণ পছন্দ করে। কেন মিছেমিছি তাকে বঞ্চিত করবে তার  প্রিয় একটি বস্তু ভোগ করা থেকে, যেখানে সত্যিকারের ভালো লাগার জিনিস এত কম পৃথিবীতে? তাছাড়া বছরের পর বছর খেতে খেতে আজকাল আর ধনেপাতার গন্ধটা আগের মতো তেমন তীব্র আর জংলিও মনে হয় না তার কাছে। এমনকি কখনো-সখনো, কোনো কোনো তরকারিতে এই গন্ধ এখন ভালোও লাগে মাঝে মাঝে। মানুষ নতুন কিছুতে, প্রাথমিকভাবে অপছন্দের কোনো কিছুতে, আস্তে আস্তে ’taste develop’-ও তো করে! করে না? সে বোঝাতে চেষ্টা করে সীমাকে। যেমন, ধরা যাক, সীমা বিয়ের পর প্রথম প্রথম চায়নিজ খেতে তো একদম পছন্দ করত না। আর এখন তো প্রতি মাসে একবার অন্তত চায়নিজ খাবার না খেলে চলে না তার। তাহলে?
কিন্তু এসব যুক্তির কথা সীমা মানতে রাজি নয়। তার একেবারে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন, এটা এতদিন, এত বছর একত্রে ঘর করার পরও কেন তার কাছে গোপন করে রাখল সে? কেমন করে তা পারল? কেন তাকে বোকার মতো বাইরের একজন তৃতীয় এক ব্যক্তির মুখ থেকে তা জানতে হলো আজ? তাহলে কি সে তার জীবনের এমন আরো অনেক কিছুই গোপন করে রেখেছে সীমার কাছে? তার নিজস্ব এবং ভিন্ন একটা জগৎ কি রয়েছে যেখানে তার স্ত্রীর প্রবেশ নিষেধ? তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ, জয়-পরাজয়, মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কে, এসব ব্যাপারে আরো নতুন নতুন তথ্য কি ভবিষ্যতে আবিষ্কার করবে সীমা যা অজ্ঞাত ছিল তার কাছে এতদিন? সত্যি বলতে কী, এত বছর পরে আজ তার ওপর বিশ্বাস হারাতে বসেছে সীমা। ধনেপাতা এমন কিছু মহাখাদ্য নয় যে সীমাকে তা খেতেই হতো। তার অপছন্দ জানলে সীমাও না হয় খেত না তা। অথবা ভিন্ন করে রেঁধে খেত। ধনেপাতা তো রান্নার পরে শেষ মুহূর্তেই ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তাই না? তাছাড়া, পৃথিবীতে রকমারি  খাবার-দাবারের অভাব আছে? ধনেপাতা খাওয়া-না-খাওয়া, সেটা কোনো ব্যাপারই ছিল না তার কাছে।
পুরো এক সপ্তাহ কেটে যাবার পরেও যখন সীমার মাথা ঠান্ডা হয় না, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা যখন প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম সামান্য ধনেপাতাকে কেন্দ্র করে, তখন প্রকৃতই কিছুটা রাগান্বিত হয়ে পড়ে সে। সেদিন বিকেলে বাইরে হাঁটতে যাবার মুখে একটা কঠিন প্রশ্ন রেখে যায় সে সীমার জন্যে। সীমাকে ভেবে দেখতে বলে, তার স্বামীর চরিত্রে বা তার ভালো লাগার জিনিসের মধ্যে এমন কিছুই কি নেই যা সীমা মোটেও পছন্দ করে না, কিন্তু মুখ বুজে মেনে নেয় তা বা কোনোমতে সহ্য করে কেবল এই জেন্য যে, হয় সেটা তার স্বামীর বিশেষ পছন্দের, না হয় যার ওপর মানুষটির তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই – যা প্রাকৃতিক বা জেনেটিকভাবে পূর্বনির্ধারিত? ভাবনার জন্যে বেশিদূর এগোবার আগেই সীমা আবিষ্কার করে, তার স্বামীর বিশেষ পছন্দের পুরনো দিনের হলিউডের ক্ল্যাসিক সেইসব ছায়াছবি যেমন, It Happened One Night, Citizen Caine, North by North-West, An Affair to Remember, Christmas Story, Mr. Smith Goes to Washington, African Queen, Casablanca ইত্যাদি পুনঃপুন রাত জেগে জেগে দেখে তার স্বামী এবং চায়, অন্তত আশা করে, সীমাও তার পাশে বসে তারই মতো করে সেগুলো উপভোগ করে। সেসব ছবি দেখতে দেখতে সীমার প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে সব সংলাপ। ঘরভরা এত নতুন ও ভালো ভালো ছবি থাকতে ঘুরেফিরে সেই কয়েকটি অতি পুরাতন ছবিই বারবার করে দেখতে মাঝে মাঝে বড়ই একঘেয়ে, বিরক্ত লাগে সীমার। সেসব সত্ত্বেও, মনে মনে যতই বিরক্ত হোক না কেন সীমা, মুখে হাসি অক্ষুণœ রেখে, বেশ আগ্রহ সহকারেই সম্পূর্ণ ছবিটি স্বামীর পাশে বসে পুনরায় দেখে এই ধারণাই কি দেয় না তাকে যে, এইসব ক্ল্যাসিক ও হিট ছবি তার মতোই সীমারও খুব পছন্দের? তাহলে?
সীমার উদ্দেশে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো একা একাই হেঁটে বেড়ায় সে পার্কের আশেপাশে। সীমা যদি জানত জীবনের ঘটনাপ্রবাহে ধনেপাতা ভালো লাগা-না-লাগা কতটা তুচ্ছ ব্যাপার! তাহলে এটা নিয়ে এমন তুলকালাম করত না সে। অন্তত এইসময়। শেষ বিকেলের ভ্যাপসা গরমে পার্কের বাইরে লম্বা বেঞ্চিটিতে একা একা বসে বসে, ধনেপাতা নয়, অন্য কিছু অন্য কারো কথা মনে পড়ে তার।
সন্ধ্যা নেমে আসার পরে ঘরে ফেরে সে। ঘামে সিক্ত পাঞ্জাবিটা খুলতে যাবে, সীমা এসে কাছে দাঁড়ায়। নিজের বাঁ বাহুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে স্বামীর সামনে এগিয়ে ধরে সীমা।
আমাকে ছুঁয়ে বলো দেখি, তোমার জীবনে এমন কিছু কখনো ঘটেনি, এমন কোনো কিছু নেই, যা ধনেপাতা অপছন্দের মতো আমার কাছে আজো সচেতনভাবে গোপন করে আছ?
স্মিত হাসি নিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সীমা। তার কথা বলার ভঙ্গি, ওইভাবে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, সবকিছুই সাক্ষ্য দেয়, সন্ধি করতে প্রস্তুত সীমা। আর কত?
মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নেয় সে তার পরবর্তী করণীয়। তারপর দ্বিধাহীন সে অতি অনায়াসে তার ডান হাতখানা দিয়ে সীমার বাড়িয়ে দেওয়া বাঁ হাতখানা ধরে ফেলে শক্ত করে। তারপর স্পষ্ট গলায় প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে, না, তোমার কাছে গোপন করেছি তেমন কোনো কিছুই নেই, তেমন কিছুই ঘটেনি আমার জীবনে।
কথাগুলো বলতে একবারও তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যায় না। গলা শুকিয়ে আসে না।
পরম নিশ্চিন্তে দুচোখ বুজে গভীরভাবে একটা নিশ্বাস নেয় সীমা। সেই সঙ্গে মৃদু হাসে।
সীমার বাহুছোঁয়া তার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হাতখানা এক ফোঁটাও কেঁপে ওঠে না।