যে-শহরে এখন শেষরাত

নুরুল করিম নাসিম

মধ্যরাতে গোলকধাঁধার মতো ঘুরতে লাগল মগবাজারের ভয়ংকর মোড়ে। এতরাত তবু 888sport app শহরের যানজট একটুও কমে না। একটুও কমেনি। কী বিচিত্র, কী দুর্বিষহ এই শহর। সে চলে গেছে, ভালো হয়েছে। সে বেঁচে গেছে। শৈশবের এই প্রিয় শহর এখন তার কাছে খুবই অপ্রিয়। সে চলে গিয়ে বেঁচে গেছে। যে-শহরে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় যেখানে কেটেছে, এখন জীবনের এই সময়ে এসে কেন এমন অনীহা এলো তার? এই শহর দিন-দিন জনারণ্য হয়ে যাচ্ছে, কোথাও পৌঁছানো যায় না, কোথায়ও স্বছন্দে যাওয়া যায় না।
আরেকবার চেষ্টা করলো। দুটো গলি পাশাপাশি ভাইবোনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা একই রকম। ঢুকল সাহস করে। অনেক ঝকঝকে
হাইরাইজ বিল্ডিং উঠেছে এখানে। আগে কি এসব ছিল? বছর কয়েক আগে সে যখন এখানে এসেছিল, এ-বিল্ডিংগুলো কি ছিল? এমন ঝকঝকে শরীর নিয়ে, যেন যৌবন ফেটে পড়ছে, এমন কি ছিল নতুন অট্টালিকাগুলো?
ঠিকঠাক কিছুই মনে পড়ে না। আজকাল কিছুই সে চিনতে পারে না। মানুষ, কিংবা বিল্ডিং কিছুই হঠাৎ করে ঠাহর করতে পারে না। তার মস্তিষ্কের নিউরোনে কি কিছু হয়েছে? 888sport app download for androidশক্তি কমে এসেছে বয়সের কারণে? 888sport promo codeকেও সে মনে রাখতে পারে না আজকাল। বয়স হলে কি মানুষের এরকম হয়? সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তার বয়স কত হয়েছে? এই শহর তাকে ক্লান্ত, অথর্ব এবং বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের আগে না পরে তার জন্ম? সেসবও মনে পড়ে না। তার জন্মদিন কবে যেন? খুব অজপাড়াগাঁয়ে এক ঝড়ের রাতে তার জন্ম হয়েছিল, মা বলেছিলেন। সেই সাদামাটা মা, খুব লেখাপড়া না-জানা মা, দুবছর আগে গত হয়েছেন। তিনি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। শহর তারও ভালো লাগেনি শেষের দিকে। তবে কি সেও তার মায়ের মতো হয়ে যাচ্ছে? তার জন্মদিনের তারিখটা মা-বাবা লিখে রাখেননি। বাবা তো সারাজীবন জনগণের সেবা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার সময় কোথায়? মা মহীরুহের মতো আগলে রেখেছেন বিশাল এই নিুমধ্যবিত্তের সংসার, টানাপড়েনের এই সংসার। চার ভাই আর দুই বোনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা খুব সাধারণ সংগ্রামমুখর এক সংসার। যে-সংসারে মা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ভূতের মতো খাটতেন। বাবা ঘুরে বেড়াতেন গ্রামময়, কখনো আইন-সালিশি করতে পাশের গায়ে যেতেন। এই  ছিল তার মানবসেবা সমাজসেবা। ঘরে কে কী খাবে, কীভাবে সংসার চলবে, তিনি তার খবর রাখতেন না, সেসব খবর রাখতেও চাইতেন না। মা মুখ বুঁজে সব সহ্য করতেন। সৃষ্টিকর্তা অস্বাভাবিক এক সহনশীলতা তাকে দিয়েছিলেন। সেও তার মায়ের এই গুণটা পেয়েছে ছিটেফোঁটা। তা না-হলে এই মধ্যরাতে এরকম গোলকধাঁধার ভেতর এতক্ষণ চক্কর খেয়েও কোনোরকম বিরক্তি হচ্ছে না তার। কোনো অভিযোগও করছে না বন্ধুর প্রতি। আলম একটা ইডিয়ট অথবা মহান কবি। একটিবার একটি টেলিফোনও করলো না শালা। বন্ধু আলম 888sport live chatী মানুষ। মঞ্চ আর টেলিভিশন তার একমাত্র প্রেম, একমাত্র আশ্রয় এবং পেশাও। তিনি বলেছিলেন, ১২টা-সাড়ে ১২টা বাজতে পারে ঘরে ফিরতে। তার স্ত্রী, কন্যা ও তারা  থাকবে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে, 888sport appর অন্যপ্রান্তে, উত্তরায়। সে হোটেলে উঠতে চেয়েছিল। আলম  দেয়নি। তার বন্ধু। তার সহপাঠী। ইউনিভার্সিটি জীবনে তার শ্রেণিবন্ধু, একান্ত সুহৃদ, এই শহরে অনেকটা পথ অনেকদিন তারা একসঙ্গে হেঁটেছে। যৌবনের সেই রঙিন দিনগুলোতে একসঙ্গে হেঁটেছে তারা। নাটকে বন্ধুটির হাতেখড়ি তার কাছে। সে নাটকে যায়নি। ভালো লেগেছিল, ভীষণ প্রেম হয়েছিল নাটকের সঙ্গে, তাও যায়নি। কিছুদিন ছিল, ব্যস ওই পর্যন্তই। আলম পুরোপুরি নিবেদিত হয়েছিল নাটক-থিয়েটারে। কিংবা বলা চলে, নাটক তাকে টেনেছিল গভীরভাবে। এই হলো মানুষের জীবন। মানুষের পেশা, মানুষের জীবন এসব কিছু হিসাবমতো সরলরেখা ধরে চলে না বলেই তার মনে হয়েছে। হঠাৎ সেলফোন বেজে উঠল। না, আলম নয়। আলম বিয়েবাড়িতে ব্যস্ত ও হই-হল্লোড়ের ভেতরে হয়তো ভালো আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই খুব হইচই পছন্দ করে। ধীরে-ধীরে শহরের যানজট কমে আসছে। প্রচণ্ড শীত নেমেছে শহরে আজ। সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে ওপারের ফুটপাত। আলম কি তাকে এড়াতে চাচ্ছে? সে তো আগেই বলেছে, তারও একটি নিমন্ত্রণ আছে, সে তার ওখানে খাবে না। শুধু রাতটুকু কাটিয়ে ভোরবেলা চলে যাবে। সামান্য সময় পেলে কথা হবে, আড্ডা হবে, 888sport sign up bonusচারণ হবে। পেছনের ফেলে আসা দিনগুলো তাকে আজকাল খুব ডাকে। কে জানে কেন। হোটেলে থাকা 888sport app শহরে নিরাপদ নয়। প্রতিদিন খবরের কাগজে কত নিদারুণ সব খবর ছাপা হচ্ছে। বড় হোটেলে ভিন্ন কথা। কিন্তু মাঝারি মাপের হোটেল কোনোভাবেই নিরাপত্তা দিতে পারে না। অনেক অঘটন ঘটার খবর ছাপা হয় দৈনিকে। সে বেঘোরে তার জীবন বিসর্জন দিতে পারে না। তার ছেলেমেয়েরা এখনো মানুষ হয়নি। তার স্ত্রীকে তাহলে পথে নামতে হবে। তার সহায়-সম্পত্তি নেই তেমন একটা। আবারো সেলফোন খুব করুণ সুরে ডেকে উঠল। তার স্ত্রীর উদ্বিগ্নতা ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠে। একটু বদমেজাজিও। সে মিথ্যে বলল। তার অসহায় অবস্থার কথা চেপে গেল। এসব কথা শুনলে রাগে ফেটে পড়বে। আলমের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে।
সে কি একবার সেলফোনে আলমকে তাড়াতাড়ি আসতে বলবে? এভাবে বলা যায় না। নিমন্ত্রণে গেলে তাড়াতাড়ি আসা যায় না। উত্তরা থেকে মগবাজার আসতে একটু সময় তো লাগবেই। হঠাৎ সেলফোন অতিক্রান্ত মধ্যরাতের নীরবতাকে আবারো ভেঙে টুকরো-টুকরো করে ফেলল। আলম বলল, বাসার খুব কাছাকাছি এসে গেছে। দিকনির্দেশনা দিলো। সে এবার খুঁজে পেল একতলার বাড়িটা। যথারীতি কলাপসিবল গেট। তার হাতে দুটো ব্যাগ। একটা সদ্য কেনা অসম্পূর্ণ 888sport alternative link, মারিয়া ভার্গোস যোসার, খুব কষ্ট দিচ্ছে কদিন ধরে বইটা। শেষ না করা পর্যন্ত মুক্তি নেই। খুব জটিল। বাক্যগুলো বেশ দীর্ঘ। রাজনীতি আছে। সমাজের ছবি আছে। 888sport promo codeও আছে কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে, আমাদের দেশের ঔপন্যাসিকদের মতো নয়। একটু অন্যভাবে দেখা, একটু অন্যরকম অবলোকন।
অনেকটা সময় কেটে গেল, কিন্তু আলম এলো না। বইটি ব্যাগ থেকে বের করে কলাপসিবল গেটের পাশে দাঁড়িয়ে সে পড়তে শুরু করল। এছাড়া আর কী করার আছে? হঠাৎ একজন শ্মশ্র“ময়, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একজন বর্ষীয়সী মানুষ সিঁড়ির ওপর থেকে নেমে এলেন। চোখভরা বিস্ময়। তার চোখ দুটোতে একরকম দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। সে একটা ঘোরের ভেতর হারিয়ে গেল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। যখন ঘোর কেটে গেল, দেখতে পেল এক শ্মশ্র“ময় মানুষের মুখোমুখি সে বসে আছে। সারাঘরে আলোছায়ার রহস্যময়তা খেলা করছে।

দুই
ভদ্রলোক অনেক বছর আগে মগবাজারের এই জায়গাটি কিনেছিলেন। তখন এটা জলাশয় ছিল। চারদিক ছিল ফাঁকা ও নির্জন, দু-একটা টিনের চালা উঠেছিল মাত্র। কাছে বাজার ছিল না। একটু দূরে একটি মসজিদ ছিল, শুধু টিনের আর বেড়ার। তখন পাকিস্তান আমল। তিনি একটি ওষুধ কোম্পানিতে ম্যানেজারের চাকরি করতেন। তাকে বাজারজাত করতে হতো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ। তিনি দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। বেশ সফল হয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তার ওপর। পশ্চিম পাকিস্তানে মূল অফিস, মালিক পাঞ্জাবি।
তারপর একাত্তর এলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল কোম্পানি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোম্পানির বেকার লোকেরা তাকে অনুরোধ করলেন একটি নতুন কোম্পানি দাঁড় করানোর জন্য। যেহেতু তিনি ছিলেন সৎ ও কর্মঠ, তিনি উদ্যোগীও ছিলেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই লাইনে তার অভিজ্ঞতা এবং যোগাযোগ ছিল। সবাই মিলে বিনিয়োগ করলেন। কোম্পানি ভালোভাবে জমে উঠল। তার হাতেও প্রচুর টাকা-পয়সা এলো। তিনি একসময় বাড়ি নির্মাণে হাত দিলেন। তার একটি মাত্র ছেলে। লেখাপড়ায় মোটামুটি মাঝারি মাপের, একটা ছোটখাটো চাকরি করে। তিনি বেশ কটা ফ্ল্যাট গড়ে তুললেন। ভাড়া দিলেন। আলমরা নিচের তলায় থাকে। অনেক বছর হয়ে গেল। সে যখন নিচে কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বই পড়ছিল, বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক  তাকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে তাকে ওপরে দোতলার বসার ঘরে নিয়ে এসেছিলেন।
কথায় কথায় রাত বাড়তে লাগল। কিন্তু আলম এলো না। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের একমাত্র ছেলেটি তার সঙ্গে থাকে না। গুলশানে থাকে। তাকেও বলেছিল যেতে সেখানে। তিনি যাননি। তার রক্ত ও ঘামে তৈরি করা এই জায়গা-জমি, কত 888sport sign up bonus জড়িয়ে  আছে প্রতিটি ইটপাথরে। কেন যাবেন এসব ছেড়েছুড়ে? তার ছেলে আগে প্রতি সপ্তাহে বাবা-মায়ের কাছে আসত। এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। নিয়মিত আসা হয় না। এখন মাসে একবার আসা হয় কখনো-কখনো। রক্তের সম্পর্ক অথচ কেমন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে সবকিছু। মাঝে-মাঝে তার খুব খারাপ লাগে। ভীষণ নিঃসঙ্গ বোধ করেন। তার স্ত্রী একা নীরবে কাঁদেন। তিনি  বাস্তবতা বোঝেন না। এখন সময়টা অন্যরকম। এখন আগের নিয়মে চলছে না সবকিছু। সংসারের সব নিয়ম বদলে যাচ্ছে। এই কথাটা তার স্ত্রীকে বোঝানো যায় না। শুধু বলে, খোকাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। একি হয় কখনো? খোকার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। ওর স্ত্রীর একটা মতামত আছে। চাইলেই তো আর সবকিছু হয় না। সংসারের বাস্তবতা বুঝতে হবে। জীবনের বাস্তবতা বুঝতে হবে।
তিনি ভালো আছেন। তিনি জীবনকে দেখেছেন। তিনি দাঙ্গা দেখেছেন, মন্বন্তর দেখেছেন। দু-দুবার দেখেছেন দেশবিভাগ।  তার অনেক কিছু সয়ে গেছে। হঠাৎ সিঁড়ির নিচ থেকে কে যেন চিৎকার করে ডাকছে তাকে। আলমের কন্যা। সেলফোন বেজে উঠলো। আলম ডাকছে। সে উঠে দাঁড়াল। তিনিও উঠে দাঁড়ালেন, যার গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্স আছে। একটি পুত্রসন্তানও আছে। কিন্তু দূরে, অনেক দূরে। কিন্তু কাছে কেউ নেই। সে হাত বাড়ালো বিদায় নেওয়ার জন্য। তাকে খুব অসহায়, বিপর্যস্ত এবং খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। রাতও অনেক বুড়ো হয়েছে। একটা ঘোরের ভেতর পার হয়ে গেল অনেকটা সময়। এতটা সময় পার হয়ে গেল! শহরটা এখন নীরব হয়ে এসেছে। যেন একটা ক্লান্ত প্রাণী মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
দ্রুত নামতে থাকল সে। পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, আর পেছনে পড়ে রইল একটি শহর, যে-শহরে এখন শেষ রাত।