রইস উদ্দিনের ফাঁসি

মণীশ রায়

বারান্দায় দাঁড়িয়ে টবচর্চা করছিল দেয়া।
বেশ কটি টব রয়েছে ওর দখিনমুখো ছোট বারান্দাজুড়ে। সবগুলোই গোলাপের চারা। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে লতিয়ে উঠতে চাইছে। ফুটি-ফুটি করছে ফুল, তবু ফুটছে না বলে একবুক আক্ষেপ আর হতাশা নিয়ে এদের পরিচর্যা করে চলেছে সে।
গাছেদের সঙ্গে দেয়ার বড় ভাব, গোপনে কথা বলে বিড়বিড় করে। রুম-লাগোয়া বারান্দা হওয়ায় গভীর রাতে একচিলতে নাগরিক চাঁদ আকাশের কোনায় উঁকি মারলে দেয়া এই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। অনুচ্চ চাপা গলায় সুর ভাঁজে, ‘জোছনা করেছে আড়ি/ আসে না আমাদের বাড়ি।’
ভেতরে আবেগ বলক তুললে বরাবর রাগাশ্রয়ী গান গাইতে ভালোবাসে সে। নইলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ কিংবা রজনীকান্ত। নিজের লেখা দু-একটা 888sport app download apkও
ঠোঁটের দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়ে, ‘দেয়া, বাড়ি আছো?’ মোদ্দাকথা, নয়শো পঞ্চাশ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটির এই বারান্দাটা দেয়া নামের এই ভার্সিটিপড়ুয়া মেয়েটির প্রাণভোমরা। কেননা, ব্যাংকার বাবার কেনা এই ফ্ল্যাটের বারান্দাটি ওকে শিখিয়েছে 888sport app download apk ভালোবাসতে, 888sport app download apkর জন্য শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে, পত্রিকা অফিসে ধরনা দিয়ে কবিদের সঙ্গে দু-দন্ড সময় কাটাতে এবং মাঝেমধ্যে নানা ঘষামাজার পর এক-দুটো 888sport app download apk কোনো হৃদয়বান কবির বদান্যতায় 888sport live football-সাময়িকীতে ঠাঁই করে নিতে।
দেয়া যে খুব সুন্দরী, তা বলা যাবে না। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং, যা কি না ফর্সা হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়নি। টানা ভুরু জোড়া, কুচকুচে কালো চোখের মণি, তাকাতাকি হলে যে-কোনো রোমান্টিক পুরুষের হৃদয় আর্দ্র না হয়ে যায় না। সাদা-কালো শাড়ি, হাতভর্তি চুড়ি , লাল টিপ আর খোলা চুলের দেয়াকে দেখার পর অনেক উঠতি কবি উদ্দীপিত হয়েছে, নিজেদের ভেতর অদৃশ্য কাড়াকাড়ি-হাতাহাতির পর আবেগ থরথর গলায় কঁকিয়ে উঠেছে, ‘তুমি কেন আমার 888sport app download apkর চরণ হতে পারো না?’
পুরনো খ্যাতিমান কবিরা সবার অগোচরে এক-দুটো 888sport app download apk ওকে উৎসর্গ করে রমনার অশ্বত্থতলায় ওর অাঁচলের বাতাস খেতে খেতে কাঁপা সুরে আর্তনাদ করে উঠেছেন, ‘তুমি আরো আগে এলে না কেন, দেয়া?’
এদেরই একজন আজ শয্যাশায়ী। যশস্বী কবি, 888sport live football সম্পাদক হিসেবে সুনাম রয়েছে। তাঁরই বদান্যতায় 888sport app download apk না হয়েও বেশ কটি 888sport app download apk পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে দেয়ার। কত কথা, কত আবেগ, কত যে স্বপ্ন রচনা এই কবির টেবিলকে ঘিরে। বয়স হয়েছে কবির, বাবরি চুল সব এখন সাদা, তবু হার মানতে রাজি নন তিনি। দেয়ার ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খাওয়ার অসম্ভব শখ ছিল তাঁর। সেই অধরা চুমুকে ঘিরে তাঁর রয়েছে দুটো দীর্ঘ 888sport app download apk, যার ভেতরের কথা কেবল দেয়া জানে আর মহাপ্রাণ কবি নিজে। সেই আরাধ্য কবি অসুস্থ, প্রতিটি পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন নিয়মিত উঠছে। তাঁকে কি না দেখে পারা যায়?
ওর একচিলতে টবসর্বস্ব বাগানে একটা ফুল ফুটলেও হতো, রুগ্ণ কবির শিয়রে দাঁড়িয়ে বলতে পারত, ‘এটা আমার বাগান থেকে তোলা। আপনাকে দেখতে আসছি। তাই নিয়ে এলাম।’ স্বরক্ষেপণে আবেগের খানিকটা আতিশয্য তো থাকতই, যা শুনে কবির চোখ জোড়া অসম্ভব ভালো লাগায় বুজে আসত আপনা-আপনি। মুখাবয়বের পরতে পরতে ছড়িয়ে পরত সেই আবেশ।
দেয়া ঠিকই দুটো সাদা গোলাপ নিয়ে নিল শাহবাগ থেকে। মনে মনে ভাবল – সে মিথ্যে বলবে কবির কাছে। ন্যাকা গলায় জানাবে, ‘কাল টেলিভিশনে আপনার অসুস্থতার কথা শুনে আমি রাতভর এতটুকু ঘুমুতে পারিনি। কখন সকাল হবে, কখন ছুটে আসব আপনার কাছে, কেবল এগুলোই ভেবেছি সারারাত।’
কবির ওষ্ঠে মলিন হাসি পেট্রোলিয়াম জেলির মতো লেগে থাকবে, যা দেখে মনে মনে বেশ খুশি হবে দেয়া। মিথ্যে দিয়েও যে মাঝে-সাঝে মানুষকে মুগ্ধ করা যায়, কিঞ্চিৎ হলেও যে আনন্দ সঞ্চারিত হয় অন্যের মাঝে – ভেবে মন্দ লাগবে না দেয়ার।
সে প্রথমে ফুল দুটো নাক থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করল। গন্ধ নেই কোনো। গোলাপ আজকাল কেবল দেখেই বোঝা যায়, গন্ধ দিয়ে নয়।
কেন নয়? প্রশ্ন করে নিজেকে সে।
দেয়া রুমাল চেপে ওর তামাটে নাকটা বারকয়েক মুছে নিল। ফুলে দেওয়া অদৃশ্য পোকা মারার বিষ যাতে নাক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কাজটা সারল দেয়া। পরক্ষণে কী ভেবে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটি শিশি থেকে কিছুটা সুগন্ধি ছড়িয়ে দিল ফুলের শরীরে। এবার সে একহাত দূরে ফুল দুটো রেখে শোঁকার চেষ্টা করল। আহ! এবার বোঝা যাচ্ছে এটা ফুল। একইভাবে দ্বিতীয়বার নিরাপদ দূরত্বে থেকে ফুলের এই সুগন্ধি আবেশ নিতে চাইল দেয়া। আর তখনই মনে হলো – আরে, এটা তো রজনীগন্ধার মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বলে মনে হচ্ছে। গোলাপের কড়া নিদহারা আবেশ কই?
অসুস্থ কবি, মরো-মরো অবস্থা। যে-কোনো সময় শহীদ মিনারে ঠাঁই হতে পারে যাঁর, তাঁর পক্ষে কি ফুলের গন্ধ শুঁকে কোনটা রজনীগন্ধা আর গোলাপ, তা ঠাহর করা সম্ভব? ভাবল দেয়া। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে হাঁটতে শুরু করল পিজির দিকে।
কবির রুমের সামনে ছোটখাটো একটা জটলা। সবাই উঠতি কবি। দু-একজন পত্রিকার লোক। ক্যামেরা হাতে চ্যানেলের লোকজন। ওরা সবাই দেয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দরজা ঠেলে কবির কেবিনে ঢুকে পড়ল সে। ভেবেছিল, ভেতরে স্ত্রী-আত্মীয়-পরিজন ঘিরে রাখবে কবিকে। কবির রোগ-জরজর চেহারার ওপর ঝরে পড়বে সবার আকুল দৃষ্টি। হারিয়ে ফেলার বেদনা সবাইকে এতটাই মুহ্যমান করে রাখবে যে, কারো মুখে কোনো কথা ফুটবে না। এই সরব নীরবতা যে কত 888sport sign up bonus, কত আবেগ বয়ে আনবে, তা বাইরে থেকেও দিব্যি টের পাচ্ছে দেয়া।
কিন্তু কেবিনের ভেতরে ঢুকে সে বুঝল, পত্রিকা পড়ে ও টেলিভিশনে খবর দেখে কবিকে যতটা অসুস্থ ভেবেছিল, তিনি আসলে ততটা নন। ওকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে কবি বলে উঠলেন, ‘এসো রাধে। তোমা বিহনে আমি বড়ই কাতর হয়ে রয়েছি।’ পাশে বসা তাঁর এক বন্ধু, তিনিও কবি, সাতসকালেই 888sport app download apk শোনাচ্ছিলেন, এ কথায় তিনিও হেসে উঠলেন উচ্চৈঃস্বরে। দেয়া কিছুটা অপ্রস্ত্তত, হাতে ধরা ফুল দুটো দেবে কি দেবে না, তা বুঝতে পারছে না।
কবি ওর এই ইতস্তত ভাব লক্ষ করে নিজে থেকে বলে উঠলেন, ‘আমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছো। বাহ্।’ সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ওর হাত থেকে ফুল দুটো নিয়ে এমন মুগ্ধতার সঙ্গে শুঁকতে লাগলেন যে রীতিমতো লজ্জা করতে লাগল ওর।
কবিবন্ধুটি আফসোসের সুর কণ্ঠে নিয়ে গান গেয়ে উঠলেন, ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো।’
দেয়া কেবিনের ভেতর দাঁড়িয়ে রইল। ওর অন্তরজুড়ে ভালো লাগার অনির্বচনীয় আবেশ। সে এই শ্রেণির মানুষগুলোর প্রতি একধরনের টান বোধ করে। যে-জীবন ধরাছোঁয়ার বাইরে, এই মানুষগুলো সত্যি সত্যি সেখানেই পাড়ি জমাতে চায়। গভীর রাতে ওদের ১২ তলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটির ওপর যখন নিঃশব্দে চাঁদ ওঠে, তখন এই চাঁদ এখানে আর কাউকে জাগায় না; কেবল সে-ই এসে বারান্দায় দাঁড়ায়, টবে বেড়ে ওঠা গোলাপের চারার ওপর চাঁদের কিরণের মাখামাখি দেখে এবং নিঃশব্দে এদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, আমিও তোমাদের। তখন নিজেকে চাঁদে পাওয়া মানুষ বলে মনে হয় দেয়ার।
এখন, চোখের সামনে যে দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ কবি বসে রয়েছেন, তাদেরও চাঁদে পাওয়া মানুষ লাগে, ঠিক ওরই মতো। ওরাও যে জীবনের অনেক রাত ছারখার করে এই পর্যন্ত উঠে এসেছে, তাতে দেয়ার কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের কোনো কথাই ওর কাছে অসংলগ্ন লাগে না, কোনো আবদার মনে হয় না অযৌক্তিক। পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধে তাঁদের থাকা উচিত অধিকার। কারণ, ওই লোকগুলোর কল্যাণেই সবাই সুন্দরকে সুন্দর বলে জানে।
এ-সময় একটি উঠতি বয়সের ছেলে দৌড়ে এসে কবির সামনে দাঁড়াল। তারপর হন্তদন্ত সুরে বলে উঠল, ‘প্রধানমন্ত্রী যে-কোনো সময় আপনাকে দেখতে আসতে পারেন। শিউর।’
‘কীভাবে বুঝলে কবি রইস উদ্দিন?’ কবির কণ্ঠে আকুলতা। কিছুটা আশকারাও।
‘প্রধানমন্ত্রীর পিএ হান্নান শিকদার বলল – সবগুলো পত্রিকাই আপার কাছে পাঠানো হয়েছে। আপা আপনার 888sport app download apkর বড় ভক্ত, আপনার অসুস্থতার খবর শুনে উনি কি না এসে পারেন?’ কথাগুলো দেয়ার কাছে অতিশয়োক্তির মতো লাগল। সে ছেলেটিকে চিনতে পারছে না। তবে মনে হলো, রাজনীতি-সম্পৃক্ত কবি সে। বলার মধ্যে যে-রকম আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় মনোবল প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তাকে প্রভাবশালী বলেই মনে হচ্ছে।
কবি উঠে বসেছিলেন বিছানার ওপর। ছেলেটির ব্যাখ্যা শুনে তিনি ধপ করে ফের শুয়ে পড়লেন। চোখ বুজে খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর তিনি রইসকে ইশারায় দরজার বাইরে যেতে বলে দেয়ার দিকে তাকালেন, ফিসফিস করে বললেন, ‘এসো।’
কাছে আসার পর কবি বললেন, ‘888sport app download apk শোনাও। তোমার নয়, জীবনানন্দের।’
পাশ থেকে কবিবন্ধু মন্তব্য করলেন, ‘জয় গোস্বামী হউক। ওর মতো 888sport promo codeদের আর কেউ অত মমতা দিয়ে বোঝে না। শোনাও।’
ওরা 888sport app download apkচর্চায় মেতে ওঠে।
ফেরার সময় কবি বলেন, ‘আবার এসো। তোমার বাসা তো কাছাকাছি।’
‘ভাবিরা আসেন না?’ অনেকক্ষণ থেকে ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রশ্নটি। বলে দিয়ে নিস্তার পেল যেন।
‘ও তো ব্যস্ত মানুষ, কাজকর্ম করে খায়। আমাদের মতো তো অপদার্থ নয়। মাঝেমধ্যে রাতের বেলায় ফ্রি হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখে যায়। আর যেখানে মাউলা রয়েছে, সেখানে বউর দরকার কি?’ বলে হো হো করে হেসে ওঠেন। হাত দিয়ে চাপড় লাগান পাশে বসা কবিবন্ধুটির কাঁধে।
‘এখানে কদিন থাকবেন?’ দরজার দিকে যেতে যেতে শেষ প্রশ্ন করে দেয়া।
‘ও যদ্দিন রাখে।’ চোখের ইশারা কবিবন্ধুর দিকে।
কথার মানে দেয়া ঠিক বুঝতে পারে না। ফুল, পাখি ও মনোরম পঙ্ক্তিমালা ছাড়া ওর মগজে আর কিছু চটজলদি ঢুকতে চায় না। ও এতটাই আবেগপ্রবণ যে সামান্য গানের কলি পর্যন্ত ওর চোখ ভিজিয়ে দেয়। চোখের সামনে যা-কিছু মুগ্ধকর, তা-ই ওকে আপ্লুত করে রাখে।
এ জন্য মায়ের কাছে প্রায়ই বকা খেতে হয়।
ঘাড় ঘুরিয়ে কবিবন্ধুটির দিকে তাকালে তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘পত্রিকার পাতায় নজর রেখো। সব জেনে যাবে। এসো।’
আর কথা না বাড়িয়ে দেয়া চলে এলো সেখান থেকে।

দুই
যে-ছেলেটির সঙ্গে দেয়া আসলে স্টেডি হতে চেয়েছিল, অনেক পরে সে জেনেছে – ছেলেটি ক্লীব।
কী অসম্ভব উদাত্ত কণ্ঠস্বর। কী যে স্পষ্ট উচ্চারণ, পাশে বসলে দেয়ার মনে হতো, সে কেবলই শিখছে। কষ্টিপাথরের মতো গায়ের রং, চোখ দুটো এর চেয়েও কালো। তাকানোর সময় দেয়া ভাবত, সে কোনো টাওয়ারের শীর্ষে দাঁড়িয়ে সদ্য বৃষ্টি ধোয়া আদি-অন্তহীন ঘনকৃষ্ণ জঙ্গলের শ্যামলতাকে উপভোগ করছে। প্রায় ছয় ফুট লম্বা মানুষটির এলোমেলো প্রতিটি চালচলনে সে খুঁজে পেত নিজের পছন্দের সঠিক মানুষকে। তৃপ্তির ঢেঁকুর নয়, বুক থেকে নিঃসরিত হতো এক সুগন্ধি আতর, যা ওকে আর সবার চেয়ে আলাদা করে রাখত। সে যেমন সম্পূর্ণ এক 888sport promo code, পাশে যে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে রয়েছে, সে-ও এক পূর্ণ পুরুষ – দুজন মিলেই তো জগৎ গড়বে, লড়বে এবং জয় করে বুকে জড়াবে ভালোবাসার উষ্ণ চাদর।
ছেলেটি যেদিন নিজে থেকে প্রথম জানাল সে ক্লীব, সেদিন সে হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিলো ওর কথা। বাসায় গিয়ে আরো হাসল। এ রকম রসিকতার কোনো মানে হয়?
ছেলেটি যখন দ্বিতীয়বার একই কথা বলল, তখন কেন যেন আর হাসি পেল না দেয়ার। মনে হলো, ওর সামনে এক রোগী বসে রয়েছে। রোগী দেখতে এলে চোখের মণিতে যে-রকম ভিজে ছায়া পড়ে, ওরও তা-ই হলো।
তৃতীয়বার যখন ছেলেটি ওকে একই কথা জানাল, তখন দেয়া চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি কি জৈব-সম্পর্কের বাইরে যেতে পারো না?’
ছেলেটি মাথা নুয়ে রইল কিছুক্ষণ। দেয়া ভাবল, ওদের সম্পর্ক একই জায়গায় থাকবে, ঠিক আগের মতো। কিন্তু মাসখানেকের ভেতর সে বুঝতে পারল, ছেলেটিকে দেখলে ওর আর আগের মতো ভালো লাগছে না। কিঞ্চিৎ বিরক্তিবোধ অযাচিত চুলকানির মতো ওকে দগদাতে থাকে। কদিন যেতে-না-যেতেই মনে হতে লাগল, যে সম্পূর্ণ পুরুষের সঙ্গ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে, সেই স্বপ্ন এখন ঝরাপাতা। সে ছেলেটিকে আর বেশিদিন সহ্য করতে পারল না। আর ছেলেটিও ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ওর চোখের সামনে থেকে সরে গেল।
এটুকু শোনার পর কবি বলে উঠলেন, ‘বাহ। আমি একটি 888sport app download apk লিখব এর ওপর।’
888sport app download apk তিনি লেখেননি সত্য। কিন্তু পরিচয়ের কিছুদিন বাদে নিজের ভেতরকার বোবা কাহিনি কবিকে বলতে পারায় এক অসাধারণ আনন্দ আর স্বস্তিবোধে সিক্ত হয়েছিল দেয়ার সমস্ত অন্তর।
এ ঘটনার পর সমবয়স্ক আর যারা ওর কাছে ঘেঁষতে চেয়েছিল, সবাইকে অপরিপক্ব বলে মনে হয়েছে। আরিফকে গেঁয়ো লাগত। কথা বলতে জানে না। সুমনকে একটা গুন্ডা ছাড়া কিছুই মনে হতো না। নয়ন 888sport app download apk লিখত বটে, তবে কাব্যমন বলে ওর কিছু ছিল না। রাহাত তো রীতিমতো আবৃত্তি করত। কই, তাকেও তো আড্ডায় মনে হতো একটা গাড়ল। জুয়েল রানা গান সাধত। মান্না দের গান গেয়ে জমাতে চাইত আসর। কিন্তু ওকেও মনে হয়েছে একটা ধান্দাবাজ।
একজন সৎ, নির্ভীক, স্বাধীনচেতা, রুচিশীল, বিনয়ী, স্বপ্নপাগল সংবেদনশীল এক মানুষ চায় দেয়া। না পেয়ে সে ছুটে বেড়াচ্ছে। কবির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ওর মনে হলো – উনি হচ্ছেন সেই মানুষ, যাকে সে রাতের অাঁধারে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের দিকে তাকিয়ে খুঁজেছে। কেননা, কবির মুখে সে যেসব কথা শোনে, তা মোটেই পরিচিত উচ্চারণ নয়। এসব সচরাচর শোনা যায় না। সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে গড়ে ওঠা এক জগৎ। দেয়া যত শোনে, তত ভালো লাগে এসব নিয়ে আকাশকুসুম ভাবতে।
কবির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে সে-ও বলে, ‘জানেন, আমারও ইচ্ছে করে, ভরা বর্ষায় নৌকায় করে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে।’ উত্তরে তিনি হাসেন।
‘জানেন, কত রকম আজগুবি ইচ্ছে যে আমাকে পেয়ে বসে। প্রতিদিন মিনিমাম বিশ রকম ইচ্ছে জাগে মনে। রেহাই পাবো কীভাবে?’
তিনি ফের হাসেন এবং হাসি থামিয়ে বলেন, ‘888sport app download apk লেখো। দেখবে, একেকটি 888sport app download apk একেকটি ইচ্ছেকে ধরে রয়েছে।’
তখন থেকেই 888sport app download apk লেখার মকশো করছে দেয়া।
888sport app download apk লিখে ছুটে গেল কবির কাছে। কবি মেজাজ করলেন। কিছু হলো না বলে দোষারোপ করলেন ওকে, এমনকি দেয়ার শিক্ষককুল নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুললেন। 888sport app download apkর ক্লাসের নতুন ছাত্রী সে, কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে সহ্য করল সবকিছু। নাড়িছেঁড়া অদ্ভুত এক আকর্ষণ – শব্দ, ছন্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প – সবকিছু মিলে ওকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, যা সে চেনে না, কখনো দেখেনি, তবু দৃঢ়ভাবে মিশে থাকতে চায় এর সঙ্গে। যে না-পাওয়ার বেদনা সংগোপনে কুরে কুরে খায় ওকে, যে-নিঃস্ববোধ রাতজাগা তারাদের দিকে চোখ রাখলে সে টের পায় ভেতরে, যে-নির্বোধ একাকিত্ব মনের গহিনে বাসা বেঁধে নিরন্তর ওকে রক্তাক্ত করে, 888sport app download apkর ভাব ও ভাষার টনিক ভেতরে নেওয়ার পর দেয়া প্রথমবার নিজেকে হালকা ভাবে।
ও লিখে ফেলে 888sport app download apk এবং তা কবি নিজের পাতায় ছাপিয়ে দেয়। জাতীয় দৈনিকের 888sport live football পাতায় নিজের নাম ও 888sport app download apk ছাপা হওয়ার পর সে এতটাই বিহবল হয়ে পড়েছিল যে, সারাদিন পত্রিকাটি হাতে করে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে 888sport appর রাস্তায়। কবিকে মনে হয়েছে এক ফেরেশতা, যিনি ডুব দিয়ে ওর বুকের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলেন অপার্থিব সব সম্পদ, যা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘একে দেখো। ওরও জীবনকে দেখার, একে খোঁজার একটা ভঙ্গিমা আছে। দেখো।’
সেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন হাসপাতালের বিছানায়, মন খারাপ তো হবেই দেয়ার। তিনি আরোগ্য লাভ করুন, দ্রুত নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসুন, তা মনেপ্রাণে সে চায়। তবু পত্রিকার পাতা উলটে নিয়মিত কবির শারীরিক খবরাখবর রাখে সে। ভালো লাগে। পত্রিকার পাতায় কবির মুদ্রিত চেহারাখানি দেখলেও আরামবোধ জন্মে মনে। বাড়ির আর সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। ব্যালকনিতে এসে টবের গাছগুলোকে বলে, ‘কবি সুস্থ হচ্ছে। কোনো চিন্তা নেই।’
গাছেরা উত্তর দেয়, ‘কবি অসুস্থ হলে তোমার কী আসে-যায়?’
দেয়া মুখ ফোলায়, অভিমানের বাষ্প কণ্ঠে জমা রেখে উত্তর দেয়, ‘কবি অসুস্থ হলে তোরা মরে যেতি। এক ফোঁটা বৃষ্টি হতো না। সবকিছু খরায় ঝলসে যেত। তোরা পুড়ে খাক হয়ে যেতি। বুঝলি?’
চারাগাছগুলো ওর কথা বুঝতে পারে না। তবু বাতাসে হেলেদুলে ওর কথায় সায় জানায়।
দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমায়। রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে ঠিকই ফুচকা-চটপটি খায়। খিলখিল করা হাসিতে ভেঙে পড়ে। শাড়ি কিংবা ওড়নার কোনা রাস্তায় লুটায়। সব ঠিক যাচ্ছে। তবু একা হলেই কোত্থেকে একরাশ উদাসীনতা এসে ভর করে। ভাবে, কবি আজ কী দিয়ে খেল? কবির পাশে আজও কি কবিবন্ধু এসে বসে 888sport app download apk শোনাচ্ছে?
দেয়া নিজের ভেতর উচাটন বোধ করে। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে সোজা চলে যায় পিজিতে। কিন্তু কেবিনের সামনে এসে সহসা মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকজন গিজগিজ করছে সেখানে। অনেক মেয়ে দলবেঁধে এসেছে কবির খবরাখবর জানতে। সাংবাদিক ভাইবোনেরা তো আছেই, কবির শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিটি ওঠানামায় রয়েছে তাদের সার্বক্ষণিক শিকারি দৃষ্টি। মায়ের বয়সী দুজন মহিলা হাতে কিছু খাবার নিয়ে আনমনা হয়ে কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্ভবত আত্মীয়স্বজন, নয়তো কোনো হারানো দিনের কবি-লেখক। কজন প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতাকে দেখতে পাচ্ছে সে। তাঁরাও এসেছে, কবির শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিতে। তাঁদের ভেতর নেতৃস্থানীয় যিনি, তিনি ইতোমধ্যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। হয়তো কিছু বলবেন কবিকে নিয়ে। ক্যামেরাম্যান বারবার করে অ্যাঙ্গেল বদলাচ্ছে আলোহীনতার কারণে, পাশাপাশি রাশভারী মানুষটিকে বদল করতে হচ্ছে দিক। শেষমেশ তাঁর ঠাঁই হলো নিচে, পিজির শাহবাগ গেটটার কাছে, সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন কবি সম্বন্ধে। নিয়মিত টক শোতে যাতায়াতকারী, মাত্র দুই মিনিটে কবির এই দীর্ণ দশার পেছনে নিরন্তর বঞ্চনা আর অবহেলার ইতিহাস লেজ ধরে টেনে বের করে আনলেন, সরকারসহ সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিলেন আসামির কাঠগড়ায়। তিনবারে টেক হলো, আশপাশে জটলা বেঁধে গেলে শেষ পর্যন্ত কবিকে না দেখেই পিজির গেট থেকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। লোকটিকে বেশ প্রফুল্ল লাগছিল তখন। যাওয়ার আগে সংগঠনের লোকজনকে কিছু একটা বলে গেলেন। রোগীকে না দেখেও কী এমন বার্তা ছড়িয়ে গেলেন, দেয়া দূর থেকে বুঝতে পারে না। এমনকি আন্দাজ করাও কঠিন হয়ে পড়ে ওর জন্য। ওর মনে হলো, সে একটা ব্যস্ত সময়ে এখানে চলে এসেছে। আরো সকালবেলায় এলে হয়তো ফাঁকা পাওয়া যেত, কবির সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারতে পারত।
আফসোস হলো, তবু কবিকে বিরক্ত না করে ভিআইপিটির মতো সে-ও কবির সঙ্গে দেখা না করে বাসার উদ্দেশে পা বাড়াল।

তিন
মেঘলা আকাশ। একটু পরপর তারিয়ে তারিয়ে বৃষ্টি ঝরছে। এর দু-চার ফোঁটা এসে পড়ছে দেয়ার গোলাপের বাগানে। শিরশির করে উঠছে গোলাপ চারার কচি পাতাগুলো।
সচরাচর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে দেয়ার। ঘুম ভাঙার পর একবার আকাশের দিকে না তাকিয়ে কোথাও নড়ে না সে। এই সময়টায় কেন যেন মনে হয়, পুরো আকাশটাই ওর। চোখের একোণ-ওকোণ দিয়ে যতটুকু আকাশ সে নিজের ভেতর নিতে পারে, তাই বারবার ঘুরেফিরে পরখ করে দেখতে থাকে। এই সময়টুকুর ভেতর সারাদিনের কাজের একটা ছক কষে ফেলে সে। সেই ছকে বাঁধা থাকে ওর সারাদিন।
বৃষ্টিভেজা ভোরবেলা। ‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে…’ গানটা মিলে যাচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে। এসময়টায় নানা রকমের 888sport sign up bonus মনে পড়ে যায় দেয়ার। রূপা নামের এক ক্লাসমেট ছিল ওদের কলেজে। অদ্ভুত সব কথা বলত মাঝেমধ্যে। এসব অদ্ভুত কথার জন্য কেউ ওকে বন্ধু হিসেবে মানতে না পারলেও দেয়ার কাছে ওর একটা অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। মেয়েটির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। এখন কোথায় আছে কে জানে!
রূপা বলত, ‘বৃষ্টি হলে আমি বাগানে চলে যাই। ছোট ছোট পাতার ওপর পড়া বৃষ্টির বিন্দুগুলো আমি উলটো করে ঢেলে দিই চোখের ওপর।’
‘তাতে কী হয়?’ কিশোরী দেয়ার প্রশ্ন রূপার কাছে।
‘বৃষ্টির জল যত চোখে নিবি, তত সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আসবে, চোখ বুঝলেই তুই টের পাবি। ভেজা ভেজা নরম নরম সব স্বপ্ন। কখনো শেষ হবে না।’
এমন সহজাত নিবিড় অনুভবের ছোঁয়া আর কারো কাছে পায়নি দেয়া। রূপাকে নিয়ে ওর মা-বাবার চিন্তার অন্ত ছিল না। প্রায়ই ওর মা জিজ্ঞাসা করত, ‘রূপা ক্লাস করে তো?’ তখন বড় বিস্মিত হতো রূপার মায়ের এই অহেতুক আদিখ্যেতায়। এখন ভাবে, মায়ের চোখ ঠিকই টের পেয়ে গিয়েছিল তখন, তাঁর মেয়েটি অন্যরকম। সবাই যখন খেলছে, তখন ও স্কুলের মাঠে একটি ঝোপের বাহারি পাতার মাঝখানে হাত ঢুকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোহাবিষ্ট হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকত। কোমায় পাওয়া মানুষের মতো স্থির, অচঞ্চল – চোখের পাতা পর্যন্ত নড়ে না। জিজ্ঞাসা করলে কোনো উত্তর মিলত না। কেবল দেয়াকে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব কথা শোনাত। দেয়া বাসায় ফিরে ওর মায়ের সঙ্গে সেসব কথা নিয়ে হাসাহাসি করত।
আজ অনেক বছর পর কেন যেন মনে হচ্ছে, রূপা নামের সেই পাগলি মেয়েটি ওর ভেতর ঢুকে পড়ছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সে এখন আর সাধারণ মানুষের কাতারে নেই। কিছু একটা ঘটছে ভেতরে, কিছু ভাঙচুর। নইলে এই ভোরবেলায় চোখেমুখে বৃষ্টির ছাট নিয়ে আকাশের দিকে নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কেন? একটা খাঁ খাঁ নিঝুম অনুভব কেন প্রায়ই ওকে শিকার বানায়?
প্রশ্নটা করতেই কবির মুখজুড়ে হাসির ছটা, বললেন, ‘তোমার ভেতর তোমার কাছে ধরা দিতে চাইছে। যত ভেতরটাকে বুঝতে পারবে, যত আকুলি-বিকুলিগুলোর ব্যাখ্যা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে, তত 888sport app download apk তোমার হাতে ধরা দেবে। বুঝলে?’
দেয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কবির দিকে। এসব বুঝতে পারে না। তবু ভালো লাগে, অন্যরকম মনে হয়।
আজ এই মেঘলা ভোরবেলায় কেন যেন ঘুরেফিরে কবির কথাই মনে হচ্ছে বারবার করে। অসুস্থ কবি, বড় দুঃখী আর কাঙাল বলে মনে হয়, ভেজা আকাশটার মতো।
সে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে লাগল। আজ যে-করেই হোক কবির সঙ্গে দেখা করতে হবে ওর। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে সে কবিকে দেখে যাবে। চাইলে সে মোবাইলে ধরতে পারে কবিকে। কিন্তু একজন অসুস্থ কবির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলাটা কেন যেন ওর কাছে শোভন বলে মনে হচ্ছে না।
সে দ্রুত তৈরি হয়ে ৭টা-সাড়ে ৭টার ভেতর পিজির গেটে চলে এলো। এত সকালেও মানুষের কমতি নেই হাসপাতালে। সবার চোখেমুখে কেবল উৎকণ্ঠার ছায়া। প্রাণপণে ছুটছে, কারো হাতে একগাদা ওষুধ, কারো হাতে বিপজ্জনক রিপোর্টস। কেউ রোগী, কেউ রোগীর সঙ্গে আসা গার্জিয়ান। রোগীকে ঘিরে যত আয়োজন এখানে, কোথাও রোগীকে দুজন দুই পাশ থেকে ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছে। কেউ একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটছে, প্রশ্ন একটাই, আমি (আমরা) ভালো তো?
এ রকম রোগ-জরা-শঙ্কা আর অনিশ্চিত জীবনপ্রবাহের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। একটা উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এটা স্যাভলন, নাকি অসুস্থ মানুষের ঘা থেকে নির্গত পুঁজের গন্ধ, তা বলা কঠিন। তবে এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে ক্লান্তি চলে আসে। একধরনের বিষণ্ণতা ভর করে ভেতরে-বাইরে সবখানে।
দেয়া ওপরে ওঠার আগেই দেখা পেয়ে যায় কবির। সম্ভবত হাসপাতাল ছেড়ে আজই চলে যাচ্ছেন কবি। সঙ্গে কবিবন্ধু। ট্যাক্সিক্যাবে তোলা হচ্ছে অকিঞ্চিৎকর মালসামান। কবি ও কবিবন্ধু ট্যাক্সিক্যাবটির সামনে দাঁড়ানো। কবিকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। দেয়া কাছে আসতেই হাসার চেষ্টা করলেন কবি। হাসিটা ফুটল না। ম্রিয়মাণ লাগল ওর কাছে।
দেয়া প্রশ্ন করল, ‘চলে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। কিছু হলো না তো।’ বেশ খানিকটা উদাসীন দেখাল কবির সৌম্যকান্ত চেহারাখানি। কথার সুরে হতাশা।
টেকো মাথার আশপাশে গজিয়ে ওঠা রাশি রাশি লম্বা রুপালি চুলের গোছা বাদল হাওয়ায় দুলে উঠল এসময়। দেয়ার অস্বস্তি লাগতে থাকে। সে এতটাই কাছে চলে এসেছে যে এখান থেকে ফেরারও কোনো উপায় নেই। আবার কবির ক্ষুব্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে কোনো কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না। অগত্যা সে দর্শকের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।
বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কবি তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলেন, ‘এটা কোনো কাজ হলো?’
সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু উত্তর দিলেন, ‘রইস যে এতটা বখে যাবে, তা কেমন করে বুঝব?’
‘এতে তোমারও কিছুটা প্রশ্রয় রয়েছে। তোমার বোঝা উচিত ছিল, কোন ঘোড়া কতটুকু দৌড়াতে জানে। মাঝখান থেকে এতগুলো টাকা খসে গেল আমার। বাসায় ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গেছে এই বিষয় নিয়ে। হাসপাতালে এদ্দিন পড়ে থাকার কোনো মানে হয়?’
‘রইসটা তো এ রকম ছিল না। ওর কথায় বিশ্বাস রাখা যেত। প্রধানমন্ত্রী ওকে স্নেহ করেন বলেই জানতাম।’ মিনমিন করে উত্তর দেন কবিবন্ধু।
‘কচু! ও একটা টাউটে পরিণত হয়েছে। ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চলে। একটা ইডিয়ট, একটা পাষন্ড।’ দেয়ার মনে হলো, রাগে কবির সারাটা শরীর জ্বলছে। এর কারণ অহেতুক অর্থব্যয় নয় শুধু, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আশাভঙ্গের নিদারুণ হতাশা।
‘ওর কবি হওয়ার শখ চিরতরে মিটিয়ে দেব। বানচোত কোথাকার!’ কবিবন্ধুর মুখে এ-ধরনের গালি ঠিক মানাচ্ছে না। তবু তিনি বলে চলেছেন।
কবি দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন। চোখের মণি দুটো চরকির মতো ঘুরতে লাগল। কবির যে চিরায়ত মৌন মহান রূপ, উল্কির মতো কাটা হয়ে রয়েছে দেয়ার মনে, তার সঙ্গে এই রুদ্র-রুষ্ট চেহারাখানি ঠিক যাচ্ছে না। দেয়া চোখ ঘুরিয়ে নিল।
কবি বললেন, ‘ওরে রাস্তা থেকে তুলে এনে কবি বানিয়েছি এই আমি। আর প্রধানমন্ত্রীর লাঠিলজেন্স দেখিয়ে আমার সঙ্গে ফাজলামো করে? আমি ওরে শুধু 888sport appছাড়া নয়, 888sport appsছাড়া করব। ওর কাব্য-প্রতিভা যদি আমি গুহ্যদ্বার পর্যন্ত না নিই তো আমি মনুষ্য সন্তান নই। দেখো।’ বলে তিনি ট্যাক্সিক্যাবের ভেতর সেঁধিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুটিও, পাশে যে দেয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে দৃকপাত পর্যন্ত করলেন না। দাঁড়ানো কমবয়সী শিষ্য- সেবকদের ভদ্রতাবশে হাতটুকু নেড়ে পর্যন্ত সান্ত্বনা দিলেন না। মনে হলো, কবি সমস্ত পৃথিবীর ওপর খেপে রয়েছেন।
দেয়া এ রকম পরিস্থিতির জন্য ঠিক তৈরি ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে কপালের দুই পাশ ব্যথায় টনটন করে উঠল। ইদানীং এ রকম হয়, সামান্য উৎকণ্ঠা কিংবা উদ্বেগ ওর মাথাব্যথার মতো অসুখের উদ্রেক ঘটায়।
সে পিজি থেকে বের হয়ে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর রইস নামের সেই ছেলেটি সহসা পথ আগলে দাঁড়ায় ওর, ‘চিনতে পারছেন? সেদিন কেবিনে দেখা হলো।’
‘আপনার নাম রইস? কবি তো ভীষণ খেপে রয়েছেন আপনার ওপর। এখানে কী করছেন?’ কোনো ভণিতা ছাড়া বলে ফেলল।
‘আমি কী করব? চেষ্টা তো করেছি। তিনি যে এককালে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট গুল মোহাম্মদের সভাকবি ছিলেন, তা কে জানত? সে জন্যই তো ভেস্তে গেল সবকিছু।’ বলে ছেলেটি উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তা পার হয়ে বারডেমের ভেতরে হারিয়ে গেল।