রক্তকরবীর গন্ধ

যখন বাগানে নেমেছিলেন সুতপা তখনো রোদের শরীরে যথেষ্ট ঝাঁঝ ছিল। এখন সেটা বিবর্ণ হতে হতে ফ্যাকাশে মেরে গেছে। এখনো দক্ষিণ দিকের গাছগুলোতে জল দেয়া বাকি। কিন্তু শরীর আর বইছে না। জলের বালতিটা টেনে টেনে কোমরে ব্যথা ধরে গেছে। বাধ্য হয়েই খানিকটা বিশ্রাম নেয়ার জন্য সুতপা চাঁপা গাছটার কাছে দাঁড়ালেন। ভাবলেন, এভাবে হুট করে না নেমে পড়লেই বোধ হয় ভালো হতো। এই বয়সে কী আর গোটা বাগানটা ঘুরে প্রতিটা গাছের খোঁজখবর নেয়া সম্ভব!

জমির পরিমাণও কম কিছু নয়, প্রায় কাঠা সাতেক। শহরের এই অঞ্চলটায় এতটা জমি নিয়ে বাড়ি করার কথা আজতো কল্পনাই করা যায় না, যখন তৈরি করা হয়েছিল তখনো যেত না। এদিকটা বাড়িঘরে চিরকালই জমজমাট। শুধু কী একটা গণ্ডগোলের কারণে এই প্লটটা ফাঁকাই পড়ে ছিল, জমি-জমা সংক্রান্ত দপ্তরে কাজ করার সুবাদে অক্ষয়ের অসুবিধে হয়নি সেই ফাঁকে নিজের মালিকানা স্বত্বটাকে কায়েম করতে। একেই তো সুতপার তখন বয়স কম, এইসব ঘাতঘোঁত বোঝার সুযোগ হয়নি, তারপর বাড়ির চারপাশে এতটা জমি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। অক্ষয়ের দখল-কৌশল নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মনেই আসেনি।

গাছপালার নেশাটা সুতপার ছোটোবেলা থেকেই। টাইপ ওয়ান রেল কোয়ার্টারের সামনে কতটুকু জমিই বা থাকে! তবু তাতেই বাবা অনেক গাছ পুঁতেছিলেন। অন্যদের মতো শাকসবজি নয়, ফুল ফলের গাছ। আর অতগুলো ভাইবোনের মধ্যে বাবার নেশাটা একমাত্র সুতপার মধ্যেই চাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই নেশাটা তো কমেইনি বরং দিনকে দিন বেড়ে গিয়েছে।

মানুষের মতো গাছেরাও বড় হয়ে উঠতে উঠতে কেমন পালটে যায়, সেটা দেখাটা সত্যিই মজার। সদ্য গজানো কচি ডালগুলো যখন হাওয়ার ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে ওঠে তখন মনে হয় সত্যিই যেন একটা মানবশিশু সদ্য হাঁটতে শিখে ভয় পাচ্ছে, এই বুঝি পড়ে যাবে। তারপরের পালাটা দুবেণি বাঁধা কিশোরীর। সবসময়ে বাতাসের সঙ্গ পাওয়ার আকাক্সক্ষায় উন্মুখ। একটু ছোঁয়া পেল কী কলকল হাসি আর গল্প দিয়ে নিজেকে উজাড় করার চেষ্টা। যেই কুঁড়ি কিংবা মুকুল এল সাথে সাথে গম্ভীর, সারাটা শরীরময় তখন লেপটে থাকে গর্ভিণীর অহংকার। আর যখন ফুল-ফলে ভরে ওঠে শরীর তখন দেখে কে বলবে সেদিনও এই মেয়েটি ছিল নিতান্তই একচলা! সবসময়ে সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত, এই বুঝি কেউ চোট পেল, বুঝিবা কারো অযত্ন হলো।

এসব লক্ষ করার নেশা যেহেতু খুব কম লোকেরই আছে তাই অক্ষয় রাগ করতেন। বলতেন, কী যে আদিখ্যেতা বুঝিনা বাপু, বাড়িটাকে একেবারে জঙ্গল বানিয়ে তুললে! দেবো একদিন খাণ্ডবদাহন করে।

সুতপাকে গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দেখলেই বলতেন, এই যে মালীর বেটি, ঘর-সংসারের দিকে একটু মন দাও।

প্রথম প্রথম দুঃখ পেতেন সুতপা। অক্ষয়কে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। পরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেননা অক্ষয়ের মগজ জুড়ে ছিল অন্য নেশা। মারাত্মক

সেই নেশার ধারে কাছে দাঁড়ানোর ক্ষমতা গাছের নেশার ছিল না।

বিল্টুটা মায়ের স্বভাব পেয়েছিল। সেই ছোটোবেলা থেকেই গাছেরা ছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ওদের সাথেই ছিল ওর যতো রাজ্যের দুষ্টুমি আর খেলাধুলো। অক্ষয় খুব রাগ করতেন। বলতেন, আমার ছেলেটা দেখছি ভেড়া হবে শেষ পর্যন্ত। বাপের নাম ডোবাবে।

কথাটা শুনে সুতপা মনে মনে বলতেন, তাই যেন হয়, তাই যেন হয়।

আজ এই বাগানটা সুতপার কাছে যেন এক মস্ত অ্যালবাম। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য 888sport sign up bonusর টুকরো। একেকটা গাছের সামনে দাঁড়ালেই 888sport sign up bonusগুলো যেন সজীব হয়ে ওঠে।

গেটের সামনের ইউক্যালিপটাস গাছ দুটো হলো আশাদি আর বিলাস জামাইবাবু। এখনো কোনো কোনো সন্ধ্যায় গাছ দুটোর কাছে গিয়ে সুতপা বিড় বিড় করে বলেন, আমি চেষ্টা করেছি, জানি না মাথা উঁচু করে বাঁচতে পেরেছি কী-না!

আশাদি অক্ষয়ের দিককার আত্মীয়। বিলাস জামাইবাবু ছিলেন রাঙামাটি চা বাগানের ম্যানেজার। বিয়ের পরপর অক্ষয় নিয়ে গিয়েছিলেন রাঙামাটিতে। বিলাস জামাইবাবুর সাথে ব্যবসার ব্যাপারে শলাপরামর্শ করার দরকার পড়েছিল। হয়ত সুতপা থাকলে সুবিধে হতে পারে, এ-জন্যই অক্ষয় সেবার সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

বিলাস জামাইবাবুর অনুরোধে সুতপা একটা গান শুনিয়েছিলেন, ‘আমার সকল কাঁটা ধন্য করে,

ফুল ফুটবে।’

গান শুনে জামাইবাবু বলেছিলেন, তুমি একটি রত্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বানরের গলায় ঠাঁই হয়েছে তোমার। তাই জানি না তোমার কাঁটা ধন্য হবে কী-না!

কথাটা খারাপ লেগেছিল সুতপার। মনে হয়েছিল বিলাস জামাইবাবু হিংসে করে কথাগুলো বলছেন। কেননা তখনো তো সুতপা ভালো করে চিনতেই পারেননি অক্ষয়কে।

দুতিন দিন থাকার কথা ছিল রাঙামাটিতে, কিন্তু ফিরে আসতে হয়েছিল পরদিনই। অক্ষয় থাকতে রাজি হননি। কারণ বিলাস জামাইবাবু অক্ষয়ের প্রস্তাবকে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, বিজনেস যদি কখনো করি তবে তোমার সাথে অন্তত কোনোদিন করব না, এটা জেনে রেখো।

আসার সময় চারাদুটো চেয়ে এনেছিলেন সুতপা। সেটা জানতে পেরে অক্ষয় রাগ করেছিলেন। বলেছেন, বাঁশঝাড় চেয়ে আনলে না কেন? মরার পর তুমি আর

বিলাস হারামজাদা মিলে ভূত-পেত্নী হয়ে আমার ঘাড় মটকাতে পারতে।

বলেছিলেন, গাছ এনেছ সেটা মেনে নিচ্ছি, তবে বিলাস হারামজাদাকে যেন আবার টেনে এনো না। তাহলে কিন্তু দুজনকেই কেটে দুটুকরো করে ওই দিয়ে চিতা বানাবো।

বিলাস জামাইবাবু অবশ্য এসেছিলেন। কিন্তু তখন কেটে দুটুকরো করতে চাওয়া লোকটারই দুটুকরো করা লাশ পাওয়া গিয়েছিল শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের জঙ্গলে।

সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে বিলাস জামাইবাবু বলেছিলেন, এ বোধহয় ভালোই হলো সুতপা, অল্পে রেহাই পেয়ে গেলে। আর কিছু না হোক মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা অন্তত করতে পারবে। সেদিন আর কথাটা খারাপ লাগেনি সুতপার। কেননা ততদিনে অক্ষয়ের অর্থলোলুপতার নেশাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে ফুটে উঠেছে প্রকৃত চরিত্রটা।

পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল, কাউকে সন্দেহ করেন কি-না? উত্তরে মাথা নাড়িয়েছিলেন সুতপা। কার নাম বলতেন? যে বিশ্রী চেহারার লোকগুলো অক্ষয়ের খোঁজে আসত তাদের কারো নাম তো তিনি

জানতেন না।

ঠকানোর ব্যবসায় সহকর্মীদেরও ছাড় দেননি অক্ষয়, তবু ওরা সেদিন সুতপার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। নাহলে চাকরিতো দূরের কথা হয়ত অক্ষয়ের গ্র্যাচুয়িটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলোও পাওয়া যেত না। কেননা অক্ষয়ের নামে দু’দুটো তদন্ত চলছিল।

পুবদিকের রক্তকরবী গাছটা রঞ্জনের এনে দেয়া। অফিসে গিয়ে রঞ্জনের সাথেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল সুতপার। দুজনেই পাশাপাশি টেবিলে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। রঞ্জন নিজের হাতে চারাটা পুঁতে দিয়ে বলেছিল, যেখানে রঞ্জন আসবে সেখানে রক্তকরবী গাছ থাকবে না, সেটা হতে পারে?

যখন তখন আসত রঞ্জন। বয়সে সুতপার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোটো ছিল। আর স্বভাবটা ছিল আরো ছেলেমানুষের মতো। বিল্টু তখন সবে পাঁচ বছরের, বাবাকে সেভাবে কখনো না-পেয়ে কাকুর বাধ্য হয়ে উঠেছিল। হওয়াটা স্বাভাবিকও ছিল। রঞ্জন বানিয়ে বানিয়ে যত রাজ্যের আজগুবি গল্প শোনাত। আর সেসব অকপটে বিশ্বাস করত বিল্টুটা।

কিন্তু সুতপা তো আর বাচ্চা ছিলেন না। একে পঁয়ত্রিশ বছরের বিধবা বুড়ি, তার ওপর আবার দু’দুটো সন্তানের মা, সুতরাং তাকে আজগুবি গল্পে ভোলানো কি অতো সহজ? একটা মিথ্যে স্বপ্নের ফানুসে চেপে তিনি যে আকাশে উড়বেন, যেদিন ফানুসটার কাছে সুতপাকে বোঝা মনে হবে সেদিন পতনের আঘাতটা সামলাতে পারতেন? তিনি যদি-বা পারেন, বিল্টু, মিল্টু? সামান্য একটু সুখের লোভে সুতপা কি

অক্ষয় হতে পারেন? রঞ্জন এখান থেকে বদলি হয়ে গিয়েছিল তাই সুতপাকে কোনো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়নি!

মিল্টু তখন সবে দুবছরের। বাবাকেই যার মনে নেই, কাকুকে তো তার মনে থাকার কথাই নয়। সময়ের নিয়মে বিল্টুও একদিন ভুলে গিয়েছিল। খানিকটা সুতপাও। শুধু কোনো কোনো ঘুম না-আসা রাতে যখন ঘরটা আচমকা রক্তকরবীর গন্ধে ভরে উঠত তখন কেমন যেন দিশেহারা লাগত সুতপার। নিজেকে জোর করে বোঝাতে চাইতেন রক্তকরবীর কোনো গন্ধ হয় না। ওটা নিছকই দেখনসই ফুল, মানুষের কোনো কাজে আসে না। তবু বুকের ভেতরটা বেয়াদবি করলে বিল্টু-মিল্টুকে একদম কাছে টেনে এনে সেই কাঁপন থামাতেন।

বহুদিন পর আবার এসেছিল রঞ্জন। বিল্টুর খবরটা শুনে ভর্ৎসনা মাখা গলায় বলেছিল, আপনি কি কিছুই টের পাননি বউদি?

উত্তর দেননি সুতপা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন রঞ্জনকে। দেখে হাসি পেয়ে গিয়েছিল। কে বলবে এই টাকমাথা, ভুঁড়িওয়ালা, চশমা চোখের লোকটা একদিন এতটাই ছেলেমানুষ ছিল যে পাঁচ বছরের বড় এক বিধবা আর তার দুই সন্তানের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল।

একবার মনে হয়েছিল কথাটা মনে করিয়ে দেবেন কী-না, বহুকষ্টে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, চা নেবে, না কফি?

প্রশ্নটা শুনে অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল রঞ্জন। একটা কথাও না বলে চলে গিয়েছিল। হয়ত মনে মনে সুতপাকে পাষাণী, আত্মসুখী, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভেবে নিয়েছিল। সেসব ভাবলেও সুতপা ছিলেন নিরুপায়। রঞ্জনকে বোঝানো যেত না। বোঝানো সম্ভব নয়। সুতপাই কি আর ঠিকঠাক বুঝেছিলেন সবটা? এই সেদিনও মায়ের পিছু পিছু বাগানে ঘুরে বেরানো ছেলেটার মুখে বিপ্লব, শ্রেণিশত্রু, সংশোধনবাদ শব্দগুলো শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কোথা থেকে শিখল এসব কথা বিল্টু? কে শেখাল? মানে বোঝে এসব শব্দের?

টের পেয়েছিলেন সুতপা। পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। ঠেকানোর কথা মনেই আসেনি। কেন আসবে? অক্ষয়ের ছেলে দেশের কথা, দশের কথা ভাবছে আর তিনি কী-না ঠেকাতে যাবেন!

যে-ছেলেগুলো বিল্টুর কাছে আসত তাদের প্রত্যেককে খুঁটিয়ে দেখতেন সুতপা। প্রত্যেকের চেহারায় রুচি, শিক্ষার ছাপ দেখে বুকটা গর্বে ভরে উঠত। আর তাই বিল্টুর লাশ শনাক্ত করতে নিয়ে গিয়ে পুলিশ যখন জিজ্ঞেস করেছিল, কাউকে সন্দেহ হয়, তখন আর আগের মতো মাথা নাড়েননি সুতপা। দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ, হয়। আপনাদের।

বিল্টুর সে-সময়ের বন্ধুরা আজ অনেকেই কেউকেটা। কেউ আর খোঁজখবরও রাখে না। তার জন্য সুতপার কোনো খেদ নেই। এমন কী এ শহরের কোথাও যে বিল্টুর 888sport app download for androidে কোনো শহীদ-বেদি নেই, তাতেও কোনো দুঃখ পান না। বিল্টু কি একা শহীদ হয়েছিল না-কি? সে-সময় যতো ছেলে মারা গিয়েছিল তাদের প্রত্যেকের নামে নামে বেদি গড়তে হলে এই বাংলার সমস্ত রাস্তাঘাট ভরে যেত।

তাছাড়াও ইট-সিমেন্টের শহীদ-বেদির চেয়ে বড় 888sport sign up bonusটা তো বাড়ির উঠোনেই রয়ে গেছে। বিল্টুর নিজের হাতে পোঁতা চাঁপা গাছ, যার নিচে দাঁড়িয়ে বিল্টু আবৃত্তি করত, আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি …

এখনো ভালো করে যখন ফুল ফোটে তখন সুতপা স্পষ্ট বুঝতে পারেন বিল্টু এসেছে। পরখ করে দেখতে চাইছে মা চিনতে পারে কী-না। এই এখন চাঁপা গাছটার কাছে দাঁড়ানোর পর থেকেই গাছটা যে ডালাপাতা দিয়ে সুতপার ঘাড়ে পিঠে সমানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, এসবই বিল্টুর দুষ্টুমি। ছেলেবেলার মতোই মাকে কাছে পেয়ে খুনসুটি শুরু করে দিয়েছে।

কথাটা মনে হতেই বহুদিন পর হঠাৎই সুতপার দুচোখ ঝেঁপে জল ভরে এল। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হলেন সুতপা। যতই কষ্ট হোক তবু এই গাছটার সামনে কখনো কান্নাকাটি করেন না। তাতে বিল্টুকে কষ্ট দেয়া হয়। আর সেই কষ্টটাও স্পষ্ট বোঝা যায়।

চোখের জল কৌশলে মুছে নেবার জন্য গাছের গোড়ায় জল দেবার ছলে উবু হয়ে বসলেন সুতপা। আর সে-সময়েই চোখে পড়ল চকচকে জিনিসটা।

অনেকক্ষণ ধরে দেখেও জিনিসটা যে কী বুঝতে পারলেন না সুতপা। মনে হলো দামি কিছু নয়তো! কাছেই তো মিল্টুর ঘরের জানালা, কে জানে ছেলেটা কোনো কিছু ছুড়ে ফেলেছে কি-না! ক্ষুধা-তৃষ্ণা, সুখ-দুঃখ বোধই যার হারিয়ে গেছে সে কী আর দামি-সস্তার মূল্য বোঝে? কী যে অদ্ভুত অসুখ, নিজের চোখে না-দেখলে কারো বিশ্বাসই হবে না। পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে দুরন্ত ছেলেটা। একটা কথাও বলে না। সবসময়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তো চেয়েই আছে। সেই দৃষ্টিতেও কোনো অনুভূতির লক্ষণ নেই। কখনো কখনো আবার ভীষণ রেগে ওঠে। বিনা কারণে। তখন হাতের কাছে যা পায় ছুড়ে ফেলে দেয়। তখন সুতপার পক্ষেও সামলানো দায় হয়ে ওঠে।

সত্যি বলতে কি, মিল্টুকে এখন ভয়ই পান সুতপা। ছেলেটা যখন একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকায় তখন কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মনে হয় মিল্টু বুঝি এই অসুস্থতার জন্য তাকেই দায়ী করছে। যেন নিষ্পলক চোখ দুটো মেলে তাকে উপহাস করে বলছে, মা হয়ে তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। ভুল বুঝেছো। তোমার জন্যই আমার এই দশা!

এটা ঠিকই যে মিল্টুকে বুঝতে ভুল করেছিলেন সুতপা। ওর ডাকাবুকোপনার মধ্যে অক্ষয়ের অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেতেন। বিল্টুর ঘটনাটার সময় ছায়াটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মিল্টু মুখ বুজে দাদার শেষ কাজ করেছিল। একফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। আর ওইটুকু ছেলের মনের জোর দেখে যে যতই খুশি হোক, সুতপা ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। স্বার্থপরতা কি তবে জন্মগত? হাজার চেষ্টাতেও  তাকে পালটানো যায় না!

কিন্তু এটাও তো সত্যি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে দিশেহারা হয়ে উঠেছিলেন সুতপা। প্রায়শ্চিত্তের জন্য কম ছোটাছুটি করেননি। শুধু ডাক্তার ওষুধ নয়, ছুটেছিলেন মেয়েটির খোঁজেও। খুঁজতে গিয়ে আরো অবাক হয়েছিলেন। অক্ষয়ের ছেলে এত বোকা হতে পারে নাকি? মন দেয়া-নেয়ার খেলার স্পৃহা কোথা থেকে পেল? তাও কি-না একটা পরিযায়ী পাখির সাথে। না, পরিযায়ী পাখি নয়, ওরা তবু বছরের একটা নির্র্দিষ্ট সময়ে হাজার মাইল ডিঙিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু মেয়েটার সেরকম কোনো ইচ্ছেই ছিল না। নাহলে অন্তত ঠিকানাটা রেখে যেত। আর সুতপা অন্তত সেই ঠিকানায় নিজেই গিয়ে উপস্থিত হতে পারতেন। তাতে কাজ যতটুকুই হোক অন্তত খানিকটা শান্তি তো পাওয়া যেত!

বাগানের শুকিয়ে যাওয়া চালতা গাছটাকে দেখিয়ে আরতি যখন বলে, এটা একদম ছোড়দার মতো, তাই না দিদা, তখন বুকটা হুঁ-হুঁ করে ওঠে সুতপার। গাছটা যেভাবে নিঃশব্দে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, মিল্টুও কি এভাবেই চোখের সামনে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাবে?

আরতিকে দিয়ে প্রতিদিন ওই চালতা গাছটায় জল দেয়ান সুতপা। আরতি যখন হেসে বলে, তুমি যতই চেষ্টা করো দিদা, মরা কি কখনো জ্যান্ত হয়, তখন ভীষণ রেগে ওঠেন। কদাচিৎ কখনো কোনো ভ্রমরকে ভুল করে চালতা গাছটার কাঠ হয়ে যাওয়া ডালে বসতে দেখলে মনটা নেচে ওঠে।

অনেক চেষ্টাতেও সুতপা চিনতে পারলেন না চকচকে জিনিসটা কী হতে পারে! মাটি থেকে তুলে চোখের সামনে ধরলেন। যেহেতু আলো এখন নেই, যেটুকু আভা আছে, সেটা সন্ধ্যার সম্পত্তি। তাই বুঝতে পারলেন না। তবে এটুকু বুঝলেন দামি কিছু নয়।

– অ্যাই কেরে? হ্যাট হ্যাট। কলকল করতে করতে এগিয়ে এল আরতি। কাছে এসে হেসে গড়িয়ে পড়ল, ওমা, দিদা তুমি! আমি তো ভাবলাম গরু ঢুকেছে! যেই আমি বাজারে গেছি অমনি বাগানে জল দিতে নেমে গেছ, না?

মেয়েটার এই এক দোষ। সবসময়ে বকবক করে, আর যখন-তখন হেসে গলে পড়ে। প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন মেনে নিয়েছেন সুতপা। বরং কখনো কখনো ভালোও লাগে। আরতি আসাতে তবু বাড়িটাতে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়। এতদিন তো বাইরে থেকে বোঝা যেত না এটা বাড়ি, না শ্মশান।

আরতিকে যোগাড় করে দিয়েছে অফিসেরই এক সহকর্মী। একে উঠতি বয়সের মেয়ে তার ওপর শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালো, তাই সহজে কোথাও কাজ পাচ্ছিল না। সুতপা নির্দ্বিধায় রেখে দিয়েছেন। ঠিকে কাজের লোক দিয়ে আর চলছিল না, বয়স তো হয়েছে।

– এখানে অন্ধকারে বসে কী করছো? ঘরে চলো।

আরতির ধমকের উত্তরে একটা কথাও বললেন না সুতপা। হাতটাকে আঁচলের আড়ালে রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

পা টিপে দিতে দিতে হাসি আর বকবকানি চালিয়ে যাচ্ছিল আরতি। সুতপা একবর্ণও শুনছিলেন না। ঘুমোনোর চেষ্টা করছিলেন। ওষুধটা খাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়তে না-পারলে পরে আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। পরদিন অফিস করতে খুব কষ্ট হয়।

চেষ্টা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নিজেও টের পাননি সুতপা। কিন্তু মাঝরাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যাওয়ায় খুব অবাক হলেন। বাথরুম পায়নি! এমনও নয় যে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন, ঘুমটা এমন আচমকা ভেঙে গেল কেন?

আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করার বদলে বিছানায় উঠে বসলেন সুতপা। তাকালেন মেঝেতে পাতা আরতির বিছানার দিকে। নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দু’দুটো মশারি ভেদ করে কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবু চেষ্টা করলেন। তারপর একসময় বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালেন আরতির বিছানার কাছে। কেন দাঁড়ালেন সেটা নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। আরতি যদি হঠাৎ সুতপাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পায়? চিৎকার করে ওঠে, তাহলে? তবু ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো আরতির মশারির চালের ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করলেন সুতপা। এবং ব্যর্থ হলেন। তারপর একটা কোণ ধরে টেনে তুললেন মশারিটাই। অবাক হয়ে দেখলেন আরতি বিছানায় নেই।

কোথায় গেল মেয়েটা! বাথরুমে? কিন্তু সেদিককার দরজায় তো ছিটকিনি তোলা?

ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে খাটের একটা বিশ্রী আওয়াজ ভেসে এল। চমকে উঠলেন সুতপা। তবে কি ঘুমের ঘোরে একরম আওয়াজই শুনেছিলেন? এই আওয়াজই কি তবে ঘুম ভাঙিয়েছে?

কিন্তু এটা তো মিল্টুর পাশ ফেরার আওয়াজও হতে পারে। মাত্র ছয়টা বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে ছিলেন সুতপা। সে-পর্বও চুকেবুকে গিয়েছে আজ থেকে আঠারো বছর আগে, এখনো কি খাটের শব্দের ফারাক বোঝা তার পক্ষে সম্ভব? মিথ্যা সন্দেহের বশে কোনো ভুল হচ্ছে না তো!

জীবনের বহুক্ষেত্রে যেভাবে সুতপার চিন্তাটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, আজ, এই মাঝরাতে সুতপা চাইলেন এবারও তার সন্দেহটা ভুল হোক। কিন্তু তাকে ব্যঙ্গ করার জন্যই আওয়াজটা আবারো ভেসে এল, একবার, দুবার।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার বিছানায় ফিরে এলেন সুতপা। মাথার কাছে রাখা টর্চটা জ্বালিয়ে বালিশের তলা থেকে টেনে বের করলেন, সেই চকচকে জিনিসটা যেটা সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তিন ব্যাটারির টর্চের জোরালো আলোর সামনে জিনিসটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। মনে হলো কিছু একটার প্যাকেট। কীসের প্যাকেট বোঝার চেষ্টা করতে করতে একসময়ে পড়ে ফেললেন খুদে খুদে অক্ষরের ডটেড কনডম শব্দ দুটি।

মাথার ভেতর আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলেন সুতপা। টের পেলেন নাক-মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে লেলিহান লাভা। সেই আগুনসহ নেমে দাঁড়ালেন বিছানা থেকে। আগুনটাকে উসকে নিলেন, আরো, আরো খানিকটা। আজ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেবেন সবকিছু। কার জন্য মায়া করবেন? নিজের বলতে কে আছে? এই পৃথিবীর কোথাও নিজের রক্তের এক ছিটেফোঁটাও নেই। যা আছে সবই সে শয়তানের বদরক্তে ভরপুর। আজ সেই রক্তের শেষ দেখে ছাড়বেন সুতপা। তাতে যদি নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যান, ভালোই হবে। আফসোস থাকবে না। মাথা উঁচু করে বাঁচতে না-পারলেও মরতে তো পারবেন!

দ্রুত পায়ে পাশের ঘরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সুতপা। সে-সময়ই মিল্টুর স্পষ্ট উচারণ শুনতে পেলেন, তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো? না হলে দেখো আমি ঠিকই ভালো হয়ে উঠব।

উত্তরের কেউ একজন হেসে উঠল। বললও কিছু। কিন্তু সেই কথা, সেই উচ্চারণ এত মৃদু যে কিছুই বুঝতে পারলেন না সুতপা। মনে হলো যেন কোনো মানবীর কথা কিংবা হাসি নয়, যেন বা ভ্রমরের গুঞ্জন।

দাঁড়িয়ে পড়লেন সুতপা। এটা কী করতে চলেছেন! গাছেদের ভালোবেসে এতটা জীবন কাটিয়ে দেবার পর আজ একটা মরা গাছ যখন আবার বেঁচে ওঠার চেষ্টা করছে, সেই প্রাণপণ লড়াইটাকে থামিয়ে দিতে চাইছেন? যে-ভ্রমর পরখ করে দেখতে চাইছে মরা গাছে ফুল ফোটানো যায় কী-না, ব্যর্থ করে দিতে চাইছেন তাকে?

একেকটা গাছের বেঁচে-থাকার পদ্ধতি একেক রকম। মানুষদেরও তাই। মানুষও তো এক ধরনের গাছই। তবে কি তেপান্নটা বছর ধরে সুতপা গাছদের ভালোবাসার ছলে গাছ-জীবনকে ঘৃণাই করে এসেছেন? নিজেকে মহামানবী ভেবে সবকিছুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন? চেয়েছেন গোটা চরাচরকে ইচ্ছাধীন রাখতে?

এরপর নিজেকে একদম স্থির করে নিলেন সুতপা। নিভিয়ে দিলেন জ্বলে-ওঠা আগুনের শিখা। তারপর নিজেকে নিজে বললেন, এবার অন্তত গাছ হও। হয়ে ওঠো সমস্ত আঘাত সহ্য করে চলা প্রাচীন মহীরূহ। যার কোনো আশা নেই, আকাক্সক্ষা নেই, নেই প্রতিশোধ-স্পৃহা।

আর তখনই সুতপার হাত দুটো লম্বা হয়ে দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল দুপাশে। সেই দুহাত থেকে নেমে এল অসংখ্য ঝুরি। শরীরটা লম্বা হয়ে টিনের চাল ফাটিয়ে উঠে গেল আকাশের দিকে। পা দুটো শেকড় হয়ে ঢুকে গেল মাটির গভীরে। এই মাঝরাতে, এ বাড়িতে, এখন আর কোনো মানুষ নেই। শুধু গাছ আর গাছ। শুধুই গাছদের জীবনযাপন। এখানকার বাতাসে এখন শুধুই রক্তকরবীর গন্ধ।