আমার নাম আরএনসি। লোকে আমাকে আরএনসিবাবু বলে ডাকে।
– আরএনসি মানে?
– রঘুনাথ চৌধুরী। পদবি জমিদারের, আসলে স্ট্রিট বেগার। একসময়ের জমিদারের উত্তরাধিকারীরা স্ট্রিট বেগার হবেন না?
– কেন? স্ট্রিট বেগার হবেন কেন?
– ওঁরা তো লুটেরা ছিলেন। পাপ ছিল অনেক। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে না পরের জেনারেশন?
– সব জমিদার তো লোভী-পাপী ছিলেন না!
– অধিকাংশই ছিলেন।
– এত এত পুকুর-সরোবর খনন, রাস্তাঘাট তৈরি, মন্দির-প্রাসাদ-মসজিদ নির্মাণ, নানারকম জনহিতকর কাজ তো সেই সময়ের জমিদাররাই করেছেন।
– কেড়েও নিয়েছেন অনেক। সাধারণ গরিব-গুরবাদের পথেও বসিয়েছেন অনেক জমিদার।
– সব জমিদার সম্পর্কে এ-কথা খাটে না।
– খাটে, খাটে মশাই। সাক্ষী চান?
– সাক্ষী!
– হ্যাঁ, একেবারে রাজসাক্ষী। জমিদারপুত্রের সাক্ষী। শুধু পুত্র কেন, নিজেও জমিদার ছিলেন। এতেও শেষ না, জমিদারের নাতিও ছিলেন তিনি।
– কার কথা বলছেন? মাথায় আসছে না তো!
– আচ্ছা -, ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো – এই লাইনটি কার লেখা?
– দুই বিঘা জমি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’তেই তো আছে লাইনটি!
– ঠিকই ধরেছেন আপনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জমিদারদের অত্যাচারের দলিল লিখে গেছেন।
– আপনার কথার মানেটা ঠিকঠাক মতন ধরতে পারছি না।
– দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে সমান করে বাগান করবার শখ হয়েছিল জমিদারবাবুর। কোপটা দিয়েছিলেন কার ঘাড়ে? উপেনের ঘাড়ে। জোর করে উপেনের ভিটেটা কেড়ে নিয়েছিলেন। দেশছাড়া করেছিলেন উপেনকে। দেশান্তরি মানুষের কষ্টের তো শেষ নেই। নিজ ভূমি যে তাকে টানে! ফিরে এলো উপেন, নিজের ভিটেয়। ক্ষুধার্ত ছিল খুব। নিজের ভিটের দুটি আম খেতে গিয়ে মালির হাতে ধরা পড়ল। ভূস্বামী তাকে চোর বলে সাব্যস্ত করলেন। রবীন্দ্রনাথ শেষের লাইনটি কী লিখলেন? লিখলেন – তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে। রবীন্দ্রনাথ নিজে জমিদার হয়েও অপরাধবোধ করতেন নিজের মধ্যে। তা-ই তো 888sport app download apkটি লেখা। তো এই জমিদার বংশেরই লোক আমি। প্রায়শ্চিত্ত করছি এখন, প্রায়শ্চিত্ত।
– প্রায়শ্চিত্ত করছেন বলছেন কেন?
– অভিশাপ আছে না আমাদের ওপর?
– কার অভিশাপ?
– ওই উপেনের অভিশাপ! সর্বহারা উপেনদের অভিশাপ। রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বিঘা জমি’তে লুণ্ঠনের কাহিনি লিখেছেন, অভিশাপের কথা লেখেননি। উপেন তো অভিশাপ দিয়েছিলই। ওই অভিশাপের ফল আমরা, আমার মতো স্ট্রিট বেগার এই রঘুনাথ চৌধুরীরা ভোগ করছি এখন। এই-ই ছিল রঘুনাথবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম দিনের কথাবার্তা। সরি, প্রথম দিন নয়, প্রথম সন্ধ্যার কথোপকথন।
ছোট শহর চট্টগ্রাম। দীর্ঘদিন বসবাস করছি এই শহরে। রঘুনাথবাবুরও কম বছর থাকা হয়নি এই শহরে। কিন্তু আগে কখনো তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দেখাশোনার সম্ভাবনাটা বেশি হবার কথা। তাঁরও বইপ্রেম আছে, আমিও বই সংগ্রহ করতে পছন্দ করি। শহরে লাইব্রেরিও যে খুব বেশি, এমন নয়। মাত্র গোটাতিনেক। তার পরও রঘুবাবুর সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয়নি।
এই যে চট করে তাঁকে রঘুবাবু বলে ফেললাম, ঠিক হলো না। তাঁর সঙ্গে আমার বয়সের তফাৎ পনেরো বছরের। তাঁর আশি, আমার পঁয়ষট্টি। সদ্য পরিচিত এবং পনেরো বছরের বড় একজন মানুষকে পুরো নামে ডাকা উচিত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মনে হলো – তিনি আমার বড্ড আপনজন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় বলে আমার মনে হলো। তাই তিনি আমার কাছে অচিরেই রঘুনাথ চৌধুরী থেকে রঘুবাবু হয়ে গেলেন। আমার আরো মনে হলো – তাঁকে রঘুদা ডাকলে সম্পর্কটা যথাযথভাবে নির্ণীত হবে।
রঘুদার বয়স আশি ঠিকই, কিন্তু তিনি বৃদ্ধ নন। মানে বৃদ্ধ হলে মানুষের মধ্যে যে গুণ-অগুণ তৈরি হয়, দেহকাঠামো চোখে লাগার মতো পরিবর্তিত হয়। রঘুদার মধ্যে সেরকম কিছু দেখিনি। এটা প্রথমদিন দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না, পরের অনেকদিন, অনেকটা রাত্রির অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান থেকে বলছি।
প্রথমদিন, মানে প্রথম সন্ধ্যায় তাঁকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার এরকম। রঘুদা রোগা নন, আবার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, তা-ও নন। বেশ লম্বা। একসময় ছ-ফুট ছাড়ানো দেহ ছিল, এখন কিছুটা কমেছে। বড় বুড়া হাড় গুঁড়া যে! ঈষৎ কুঁজো। কোমর থেকে নয়, বুকের একটা নিচ থেকে ঘাড় পর্যন্ত। ঘাড়টা নিচের দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকে। কথা বলবার সময় জোর করে তোলেন। মাথায় অল্প চুল। কাঁচাপাকা। এই বয়সে সব চুল পাকা হবার কথা। কিন্তু বয়স চুলের রংকে হার মানাতে পারেনি পুরোপুরি। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মুখটা লম্বাটে। দাঁতগুলো আসল, না নকল বোঝার উপায় নেই। মুখের অনুপাতে কানদুটো ঈষৎ বড়।
তবে বেমানান নয়। প্রথম সন্ধ্যায় এই-ই খেয়াল করেছিলাম আমি তাঁর। পরে পরে তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে, অনেকটা সময়ও কাটিয়েছি আমরা একসঙ্গে। আমারও পরিচয় দেওয়া দরকার। খাতুনগঞ্জের একটা সওদাগরি অফিসে কাজ করতাম। হিসাবপত্র মেলানোর কাজ। সরকারের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য গোঁজামিলের খাতাপত্রও তৈরি করতে হতো আমাকে। দীর্ঘদিন কাজ করেছি আমি ওই অফিসে। 888sport cricket BPL rate থেকে পঁয়ষট্টি কম বছর তো নয়। এত বয়স পর্যন্ত আমার চাকরিতে থাকার কথা নয়। কিন্তু হিসাবপত্তরে আমি নাকি চৌকস। তাই কাশেম চৌধুরী আমাকে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সেদিন কাশেম চৌধুরীর ছেলে রাশেদ চৌধুরী আমাকে ছাঁটাই করে দিলেন। বললেন, আমি নাকি কোনো হিসাব বইতে ভুল করে রেখেছি। এবং তা নাকি ইচ্ছা করে। তাতে সওদাগরি অফিসটির বড় লোকসান হয়ে গেছে। ঘটনাটা ঠিক তা নয়। বয়সের কারণে কাশেম চৌধুরী অফিসে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন রাশেদ চৌধুরী। তিনি ট্যাক্স-অফিসারদের ম্যানেজ করতে জানেননি। তবে আমাকে ছাঁটাই করার প্রকৃত কারণ তা-ও না। রাশেদ চৌধুরীর এক শ্যালক বিকম পাশ করে ঘরে বসা। স্ত্রীর চাপাচাপিতে আমাকে ছাড়িয়ে শ্যালককে চাকরি দিয়েছেন।
এতে আমি খুব যে অখুশি হয়েছি, এমন নয়। শরীরটাও আর সইছিল না। আগে বারকয়েক চাকরি ছাড়তে চেয়েছিলাম, কাশেম চৌধুরী রাজি হননি। চাকরি যাওয়াতে তেমন আর্থিক সংকটে পড়িনি। ছোট সংসার আমাদের। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবার পর একেবারে ঝাড়া হাত-পা। স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। চাকরি শেষে আমার পাওনা আর স্ত্রীর বেতন দিয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন।
পড়ার অভ্যেস ছিল আগে থেকেই। বিচিত্র বিষয় নিয়ে পড়তে আমার ভালো লাগে। যেমন বাঙালির খাওয়া-দাওয়া, ঠাকুর পরিবারের রূপচর্চা-গৃহসজ্জা, গোপালভাঁড়ের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ-বিশ্বাস – এসব। চুপে চুপে বলি যৌনজীবনও আমার অধ্যয়নের বিষয়-আশয়। এ-জীবন বড় রহস্যময়, রসময় কৌতূহল-উদ্দীপক যে! কত রকম প্রাণীর যে যৌনজীবন আছে! পিপীলিকা, মাছ, ভোঁদড়, তেলাপোকা, ইঁদুর। এই বিষয়ের বই যেখানে-সেখানে পাওয়া যায় না। ‘লাইট হাউস’ নামের একটা বইদোকান গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। ওখানে সপ্তাহে দুটি সন্ধ্যায় যাই আমি। ওখানেই এক সন্ধ্যাতে রঘুদার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তিনি বইয়ের পোকা। 888sport alternative link-গল্প তাঁর দু-চোখের বিষ। যত আত্মজীবনী পান; গোগ্রাসে গেলেন তিনি। ব্রিটিশ যুগের বিপ্লবীদের বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। ব্রিটিশ আমলে যে তাঁর জন্ম! তাঁর সংগ্রহ বিপুল এবং বিচিত্র – জেনেছি তাঁর কথা থেকে।
এই কাহিনিতে আমার ভূমিকা গৌণ, রান্নার সময় রাঁধুনিকে লবণ-মশলা এগিয়ে দেওয়ার বুয়ার মতো। গোটা গল্পটা রঘুদাকে ঘিরে। গুয়াতলি গাঁয়ে জন্ম তাঁর। গ্রামটা 888sport appsের অন্য দশটি গ্রামের মতো। মাঝখান দিয়ে চিকন মেটেপথ। দু-ধারে খাল। পাড়ে কেয়াবন। ওখানে সাপ-বেজি। মাঝে মাঝে বাঁশবন।
শিরীষ-শিমুল, কাঁঠাল-নারকেল – এসব গাছ বাড়ি বাড়ি। বাড়িগুলোর অধিকাংশই মাটির। কোনো কোনোটা দ্বিতল। গরিবদের ঘর বেড়ার। ওপরে ছনের ছাউনি। একসময়ে এ-গাঁয়ে জমিদারবাড়ি ছিল। গ্রামের মাঝখানে একটা প্রাসাদের কাঠামো। জরাজীর্ণ। এধার ধসে পড়েছে, ওধারের ইটগুলো কে বা কারা নিয়ে গেছে। জমিদারবাড়িটির অনেকটাই লতাগুল্মে 888sport app। ওখানে এখন সাপখোপের বসবাস। তবে জমিদারবাড়ির পুকুরটা এখনো জলভর্তি। ঘাটটা ভেঙে গেছে। ওই পুকুরজলেই আশপাশের মানুষের নিত্যদিনের পয়ঃপরিষ্কার হওয়া। ওই পুকুরের একটু ওপাশে একটা ছনের ঘরে জন্মেছিলেন রঘুদা। বাবা হরনাথ চৌধুরী নাকি বলতেন, জানিস রঘু, যেনতেন বংশের মানুষ নই আমরা। পাক্কা জমিদার বংশে জন্ম আমাদের। তাই তো চৌধুরী আমরা। কাঁচা গলায় রঘুদা জিজ্ঞেস করতেন, জমিদাররা তো পয়সাওয়ালা। আমরা গরিব কেন বাবা? বাবা হরনাথ নাকি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতেন। ছেলের কথার কোনো জবাব দিতেন না।
রঘুদা আমাকে বলেছেন, বাপের চৌদ্দপুরুষের কে না কে জমিদার ছিলেন। কালে কালে জমিদারির সবকিছু চুকেবুকেও গেছে। বাবা কিন্তু অহংকার করত, জমিদার বংশের লোক বলে। বাবা আসলে নিজের গরিবি হালকে ভুলবার জন্য অতীতচারী হতো।
কী করতেন আপনার বাবা – জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। কিছু না। এককালে কিছু জমিজমা ছিল বোধহয়। কিন্তু আমার দাদু নিজের জীবিতকালে ওসব শেষ করে দিয়ে গেছেন। চোখ বোজার সময় শুধু বাস্তুভিটেটা আমার বাপের হাতে গছিয়ে দিয়ে গেছেন। ও, আরেকটা কাজ করেছিলেন তিনি, বাপকে আমার বিয়েও করিয়ে গেছিলেন। ঘরে তখন আমরা পাঁচ ভাইবোন – দুই ভাই, তিন বোন। মা আমাদের সামাল দিতে দিতে গলদঘর্ম হতো। বাবা প্রথম দিকে ভিটের গাছগাছড়া বেচত। শেষে বেচল ভিটের অর্ধেকটা। উপায় না দেখে টিউবওয়েল বসানোর মিস্ত্রি হলো। বাড়ি বাড়ি তখন বিশুদ্ধজলের চাহিদা। তারপর বাবা একদিন টুপ করে চোখ বন্ধ করল। ছোট ভাইটিও তার পিছু নিল। মা তখন আধা পাগলা। আমাদের বয়স আর কত! আমার আট-দশ। আমার বড় দুবোন, ছোট একটা। আমাদের মধ্যে বছর-দেড়েকের ব্যবধান।
তারপর! আপনাদের কী হলো? প্রশ্ন করি আমি।
সেই সন্ধ্যায় কথায় পেয়ে বসেছিল রঘু দুকে। ‘লাইট হাউসে’র একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম আমরা।
রঘুদা বলেছিলেন, গাঁয়ের মানুষরা আমাদের চার ভাইবোনকে প্রবর্তকের অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিলো।
মা, মায়ের…? আমার মুখের প্রশ্ন কেড়ে নিলেন রঘুদা। বললেন, মানুষরা ঠিক করল – আমাদের মা গাঁয়েই থাকবে। ওরা মাকে খাওয়াবে-পরাবে। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এলো আমাদের অর্ধেক ভিটে কিনে নেওয়া সুধীরবাবু। বললেন, আমিই নিলাম বউদির দায়ভার। আসলে বাকি অর্ধেক অংশের দিকে তার লোভী চোখ পড়েছিল।
– তারপর!
– তারপর আমরা চলে গেলাম অনাথ আশ্রমে। অনেক দিন পরে শুনলাম – মা মারা গেছে। পাশের পুকুরেই ডুবে মরেছে মা। মাথাটা তো এমনিতেই আউলাঝাউলা ছিল। না সুধীরবাবুর কারসাজি, জানতে পারিনি।
– যাননি কোনোদিন গাঁয়ে?
– না। নির্বিকার উত্তর দিলেন রঘুদা।
– কেন?
– যেতে ইচ্ছে করেনি। বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন রঘুদা। তারপর চাপাস্বরে প্রায় ফোঁসানো কণ্ঠে বললেন, ‘কার কাছে যাব? কেন যাবো?’
আমি তাঁর হঠাৎ রেগে যাওয়ার মানে বুঝলাম না। হয়তো দীর্ঘদিনের অসহায়তার ক্ষোভ তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই সন্ধ্যায়।
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর মুখ খুলেছিলেন রঘুদা। বলেছিলেন, আমি প্রবর্তকের অনাথ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করলাম। দিদিটার বিয়ে হয়ে গেল। তার হাজবেন্ডটা ভালো ছিল। দুই বোনকে নিজের কাছে নিয়ে গেল সুশীলাদি।
– আপনি! আপনাকে নিলেন না?
– আমি কেন যাব? এক অনাথ আশ্রম থেকে আরেকজনের আশ্রয়ে কেন যাব? ওই আশ্রয়দাতা তো আমার বোনজামাই-ই। অভিমানে গলার দুপাশের শিরা ফুলে উঠল রঘুদার। তারপর নিজেকে সংযত করে বললেন, আমাকে তখন অনাথ আশ্রম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ম্যাট্রিক পাশ করে ফেলেছি যে আমি! ম্যাট্রিক পাশের পর আশ্রমে আর থাকার নিয়ম নেই।
– এরপর কী করলেন আপনি?
– ভেসে যাওয়া – এ-ঘাট থেকে ও-ঘাটে। কিল-লাথি-চড়। ফুটপাতে, সিঁড়ির নিচে থাকা। পকেটে পয়সা থাকলে হোটেলে-রেস্টুরেন্টে খাওয়া। না থাকলে কোনো বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে হাঁক দেওয়া – দুটো ভাত দেবেন গো মা। দুবেলা খাইনি।
দেখলাম – অশ্রম্নর দুটো চিকনধারা রঘুদার গ- বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সেদিন আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনি আমার। রঘুদার বাক্ রম্নদ্ধ হয়ে এসেছিল। চুপচাপ দুজনে মুখোমুখি বসে ছিলাম, দীর্ঘক্ষণ।
দুই
সেদিন বিকেলে ডিসি হিলে হাঁটতে গিয়েছিলাম। এক চক্কর দেওয়ার পর হঠাৎ চোখ পড়েছিল রঘুদার ওপর। সিঁড়ির মাঝামাঝি একটা ধাপে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন। এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর দিকে। পাশে বসেছিলাম। একপলক তাকিয়ে মৃদু একটু হেসেছিলেন।
যেন গভীর একটা ঘুম থেকে জেগে উঠলেন রঘুদা। একটু করে গলা ঝাড়লেন। আপনা থেকেই বলতে শুরম্ন করলেন তিনি, ওই গুয়াতলি গাঁ থেকে, ওই প্রবর্তক আশ্রম থেকে যে একটা ছেলে কোথায় চলে গেল, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। যেন আপদ গেছে। শুধু নিজেদের চাহিদার জোগান ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তাতেই ব্যস। অন্যরা জাহান্নামে যাক, তাতে আমাদের কী!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রঘুদা। তারপর বললেন, এই আশি বছরের জীবনে আমি বুঝেছি – কেউ কারো নয়। যতক্ষণ ছুটতে পারছি তোষামোদ করবে সবাই, যেই না হাঁপিয়ে পড়েছি অমনি গেট আউট। কেউ ফিরে তাকাবে না।
আমি আচমকা প্রশ্ন করে বসলাম, বিয়ে! বিয়ে করেননি রঘুদা!
– আরে না না। হেসে উঠলেন। যত তাড়াতাড়ি হেসে উঠেছিলেন, তত তাড়াতাড়ি হাসা বন্ধ করলেন। কী-রকম একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন যেন। বললেন, নিজের ছন্নছাড়া জীবন। আরেকটা জীবনকে নষ্ট করব কোন সাহসে!
– ইচ্ছে করেনি কখনো, বিয়ে করতে!
– ইচ্ছে করেনি যে এমন নয়, তবে করিনি। ঈষৎ হেসে বললেন রঘুদা। তাঁর হাসি স্বাভাবিক নয়।
– যাক গে। শরীরে মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিলেন তিনি। বললেন, শেষ পর্যন্ত একটা পরিবহন অফিসে চাকরি হয়েছিল আমার। এনসি ব্যানার্জি পরিবহন। সদরঘাটের স্ট্র্যান্ডরোডে অফিস ছিল। ওখান থেকে দেশের নানা জায়গায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চালান দেওয়া। আমার কাজকর্ম দেখে খুশি হলেন নারায়ণবাবু। ও – , নারায়ণবাবু কে তা তো আপনাকে খুলে বলতে হয়। ওই যে এনসি ব্যানার্জি পরিবহন বললাম না, তারই মালিক নারায়ণ চন্দ্র ব্যানার্জি। বহু বছর কাজ করেছি আমি ওই অফিসে। একাত্তরে যুদ্ধ লাগল। ব্যানার্জিবাবুরা দেশ ছাড়লেন। আমিও পথে নামলাম আবার।
– তারপর?
– তারপর যুদ্ধ গেল, দেশ স্বাধীন হলো। সদ্যস্বাধীন দেশে আইনশৃঙ্খলা এলোমেলো। কী করব – বুঝে উঠতে পারছি না। একজন বলল, আন্দরকিল্লায় একটা প্রেস দিয়েছে, ওখানে যান। কিছু একটা জুটে যেতে পারে। গেলাম। চাকরি জুটল। প্রেসের মাল-মশলা কিনে আনার। কাগজ-কালি-রং।
– দাদা, কিছু মনে করবেন না। থাকেন কোথায় আপনি? উপহাসের একটা হাসি দিলেন রঘুদা। বললেন, শয়নং যত্রতত্র, ভোজনং মঠ-মন্দিরে। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বহুদূর থেকে তাঁর কণ্ঠ ভেসে এলো যেন – গত পঁচিশ বছর ধরে একটা হোটেলে থাকি। একটা রুম ভাড়া নিয়েছি। কমন বাথরুমে
স্নান-পায়খানা করি। পাশের একটা হোটেলে খাই।
– মানে!
– আর মানে! থাকতাম আগে ছোট্ট একটা বাসায়, ব্রিকফিল্ড এলাকায়। একসময় মনে হলো – বয়স হয়ে গেছে আমার। হঠাৎ যদি কিছু হয়, দেখবার লোক নেই। তাই হাজারিগলির ওই হোটেলে উঠে এলাম। অসুস্থ হলে অন্তত হোটেল মালিক তো আমাকে হাসপাতালে পাঠাবে!
– বোনদের সঙ্গে…।
সঙ্গে সঙ্গে রঘুদা বললেন, না, ওদের সঙ্গে আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখিনি। শুনেছি অন্য বোনদুটিরও বিয়ে হয়েছে। সুখের সংসার নাকি ওদের। আমি ওদের সুখের সংসারে বোঝা হতে চাইনি।
– ওঁরা চেষ্টা করেননি যোগাযোগের?
– জানি না। হয়তো করেছে, হয়তো করেনি। বিশাল একটা অভিমান রঘুদার চোখে-মুখে।
হঠাৎ রঘুদা ঘড়ি দেখলেন। বললেন, একটা জায়গায় আমার যাওয়ার আছে। আজ উঠি। ও হ্যাঁ, একদিন আসুন না আমার ঘরে। আমার ছেলেমেয়েদের দেখাব আপনাকে। বলে হনহন করে হাঁটা দিলেন।
ছেলেমেয়ে! কার ছেলেমেয়ে? বললেনই তো ওঁর ছেলেমেয়ে। তবে রঘুদা এতদিন বলে এলেন যে তিনি বিয়ে করেননি! সেই বিকেলে এসব প্রশ্ন করবার সুযোগ দেননি রঘুদা আমায়। দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিলেন।
তিন
দীর্ঘদিন রঘুদার সঙ্গে দেখা নেই। আমার কন্যা সন্তান-সম্ভবা। স্ত্রীকে নিয়ে কন্যার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। ওঁরা ছাড়ছিলেন না আমাদের। থেকে যেতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন।
এক সন্ধ্যায় ‘লাইট হাউসে’র একটা টেবিলে বসে আছি। সামনে পিনাকী ভট্টাচার্যের খানা তলস্নাশি, সোমব্রত সরকারের বাঙালির ইন্দ্রিয় দোষ ও ছোটলোকের
সংস্কৃতি বই দুটি। উলটে-পালটে দেখছি।
হঠাৎ আধবয়সী একটা লোক সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনিই কি শ্যামলবাবু?’
আমি বললা ম, ‘হ্যাঁ। তো?’
– আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে শ্যামলবাবু।
– কেন? আপনার সঙ্গে যাব কেন?
– রঘুনাথবাবু আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।
আমি তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, কোন রঘুনাথবাবু? রঘুনাথ চৌধুরী?
লোকটি সম্মতির মাথা নাড়ল।
– কী হয়েছে রঘুদার? অজানা আশঙ্কায় মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কথাটা।
– তিনি ভীষণ অসুস্থ। ঘোরের মধ্যে শুধু আপনার নাম বলছেন। কিছুক্ষন আগে একটু সংবিতে এসেছেন। তাঁর পাশের রম্নমেই থাকি আমি। আমাকে ডেকে আপনার নাম বললেন। বললেন, এখন গেলে লাইট হাউসে পাবে। তুমি গিয়ে বলো – একবার আমি তাঁকে দেখতে চাইছি।
আমি কথা বলব কী, তড়িঘড়ি করে বইদোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। লোকটা একটা রিকশা নিল।
আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন রঘুদা। চোয়ালদুটো উঁচু হয়ে গেছে। গণ্ড বসে গেছে নিচের দিকে। চোখদুটো গভীর গর্তে। মুখে খোঁচা দাড়ি। বিছানার পাশ দেখিয়ে বসতে বললেন।
জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন?
কী জবাব দেবো আমি! গভীর অসুখে নিমজ্জিত একজন মানুষ জিজ্ঞেস করছেন একজন সুস্থ মানুষকে, কেমন আছেন? আমি বুকে ছড়ানো তাঁর হাতদুটোর ওপর আমার হাত রাখলাম। বললাম, দাদা, এরকম অসুস্থ আপনি, আমাকে কোনো খবর দেননি কেন?
– ভাবলাম ভালো হয়ে যাব।
– কালকেই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
– তার দরকার নেই। বুঝতে পারছি – বেশিদিন নেই আমি। গতরাতে মাকে স্বপ্ন দেখেছি।
– দাদা, আমি আপনার কথা মানছি না। হঠাৎ রঘুদা বললেন, আমাদের শেষ দেখায় বলেছিলাম, আমার ঘরে এলে আমার সন্তানদের দেখাব। জানি, ভীষণ চমকে উঠেছিলেন আপনি। বিয়ে না-করা রঘুদার সন্তান কোত্থেকে?
হাঁপিয়ে উঠলেন রঘুদা। একটু জল দেবেন? বললেন তিনি। আমি জলের গ্লাস এগিয়ে ধরলাম। জল খেয়ে একটু স্বস্তি পেলেন যেন। তারপর ডান হাত দিয়ে চারদিকের দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলেন। উচাটনে এতক্ষণ খেয়াল করিনি। দেখলাম – চারদিকের দেয়ালে থরে থরে শুধু বই আর বই।
– ওরাই আমার ছেলেমেয়ে। আমি বেশিদিন বাঁচব না শ্যামলবাবু। সারাজীবন ধরে এদের লালন করেছি। ওদের নিয়েই আমার জীবনযাপন। আমার মৃত্যুর পর ওরা এতিম হয়ে যাবে শ্যামলবাবু। আমার হাতদুটো ওঁর দিকে টেনে নিলেন রঘুদা। অশ্রুসজল চোখে বললেন, আমাকে কথা দিন – ওদের এতিম হতে দেবেন না আপনি। সন্তান-স্নেহে আপনার ঘরে তুলবেন?
একটু ঘড়ঘড়ে ভাব এলো রঘুদার কণ্ঠে। ওই অবস্থাতেই বললেন, বাপ অকালে মরে যাওয়ায় আমরা ভাইবোনেরা এতিম হয়ে গেছিলাম। আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানরা যাতে এতিম হয়ে না যায় শ্যা-ম-লবাবু!
ওই রাতেই মারা গিয়েছিলেন রঘুদা।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.