মাউন্ট ম্যান্সফিল্ড
১০ অক্টোবর ২০১৯ : সিএনএন তাদের টুইটারে এক ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করল – আমেরিকার মেইন অঙ্গরাজ্যে আকাশ থেকে তোলা ফল ফলিয়েজের ছবি। সে কি রঙের বাহার! গাছের পাতা কত রঙের হতে পারে এরকম ছবি না দেখলে ধারণা করা যায় না। হলুদ, লাল, কমলার মতো উজ্জ্বল সব রং পাশাপাশি, মনে হচ্ছে একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে, অথবা একটু জায়গা করে নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে।
আমেরিকায় শরৎকালকে বলে ফল (পাতা ঝরার সময় বলে এই নাম); আর সে-সময় অনেক গাছের পাতা ঝরে পড়ার আগে নিজের সবুজ রং ছেড়ে নানা রঙে সাজে। শরৎকালে পাতাদের এই রং বদলকেই বলে ফল ফলিয়েজ। শরৎকাল আসার সময় হলেই সংবাদমাধ্যম, ব্লগ ইত্যাদিতে কোথায় কখন ফলিয়েজের সময় হবে সে-বিষয়ে লেখা শুরু হয়ে যায়।
পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ভারমন্ট গিয়েছিলাম সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ভারমন্ট এবং মেইনের পাশাপাশি অবস্থান আমেরিকার উত্তর-পূর্বদিকে। সেসব এলাকা ফল ফলিয়েজের রঙের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া নিউ হ্যাম্পশায়ার, ম্যাসাচুসেট্স, পেনসিলভানিয়াসহ অন্য আরো অনেক রাজ্যেই ফলিয়েজ দেখা যায়। যাওয়া যায় কানাডাও। কিন্তু আমরা গেলাম ভারমন্ট। কেন ভারমন্ট – সে-কথায় আসছি একটু পরে। আমরা জানতাম যে, ফলিয়েজের আসল সময় অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাঝামাঝি নাগাদ। অবশ্য কোথায় কখন রংবদল ঘটবে তা নির্ভর করে সেখানকার আবহাওয়া, দিন এবং রাতের তাপমাত্রা ইত্যাদি অনেক বিষয়ের ওপর। সে যাই হোক, আমরা যাচ্ছি বলেই গাছের পাতারা তাদের রং একটু তাড়াতাড়ি বদলে ফেলবে, তা আমি আশা করিনি। কিন্তু আমার পক্ষে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আমেরিকায় থাকা সম্ভব ছিল না বলে আমরা গিয়েছিলাম সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে।
কেন ভারমন্ট? সাউন্ড অব মিউজিক সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন তাঁদের হয়তো মনে থাকবে, অস্ট্রিয়ার ভন ট্রাপ এবং তাঁর পরিবার নাৎসিদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ১৯৩৮ সালে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই পরিবারের প্রায় সকলেই ছিল গানবাজনার 888sport live chatী এবং অস্ট্রিয়া থেকে পালানোর পর তারা বিভিন্ন দেশে গানের অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছিল তিন বছর। ১৯৪১ সালে তারা গিয়েছিল ভারমন্টের স্টোতে। জায়গাটির প্রাকৃতিক অবস্থান এবং সৌন্দর্য দেখে তাদের মনে পড়ে গিয়েছিল ফেলে আসা দেশের কথা এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেখানে বসতি স্থাপনের। তারা অনেক কষ্টে বানিয়েছিল একটি বাড়ি, যা পরে পরিচিত হয়েছিল ভন ট্রাপ লজ নামে। তারপর অনেক দশক পেরিয়ে গিয়েছে এবং ইতিহাসের নদীতে অনেক পানি গড়িয়েছে। প্রথমদিকে ট্রাপ পরিবারের বংশধররা সেই লজে অতিথিদের থাকতে দিত। পরে সেই লজের পাশে গড়ে উঠেছে একটি বড় আকৃতির হোটেল। এই ইতিহাস শুনে আমি বলেছিলাম, উত্তরের কোনো জায়গায় গেলে সেখানেই যেতে চাই।
তবে আমরা থেকেছিলাম অন্য একটি হোটেলে, যার সামনের দিকে ম্যান্সফিল্ড পর্বত। আমার ঘর থেকেই দেখা যাচ্ছিল সেই পর্বতের একটি চূড়া। কিন্তু প্রথম দিন পৌঁছতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল, আর সূর্য ছিল পাহাড়ের পেছনে। তাই পাহাড়ের গায়ে বনের গাছগুলোর রং তেমন ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। পরের দিন ছিল মেঘলা, কিন্তু তৃতীয় দিন ভোরেই সূর্য তার নরম আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল সেই পাহাড়ের গায়ে। কোত্থেকে কয়েক টুকরো মেঘও এসে জুটেছিল। ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-ছায়ায় লুকোচুরির’ বদলে পাহাড়চূড়ায় চলছিল রৌদ্র-ছায়ার খেলা। সে-সময় দেখলাম, পাহাড়ের কোলে গাছের পাতারা এরই মধ্যে তাদের রংবদল করতে শুরু করেছে। তবে রং ফোটানোর তুঙ্গে ওঠার যে খানিকটা দেরি আছে সেটাও বুঝে গেলাম।
কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের ফলিয়েজ ড্রাইভের পরিকল্পনা বাদ দিইনি। সাধারণভাবে আমেরিকার উত্তরাংশে এবং কানাডায় তাড়াতাড়ি গ্রীষ্ম শেষ হয় এবং রাতের তাপমাত্রা বেশি নেমে যায় বলে সেসব অঞ্চলে গাছের পাতাও তাড়াতাড়ি রং বদলায়। সুতরাং আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্টো থেকে আরো উত্তরদিকে যাওয়ার। আগেই শুনেছিলাম উত্তরে যাওয়ার পথে পড়বে স্মাগলার্স নচ – যেটি পাহাড় এবং বনের মাঝখান দিয়ে যাওয়া একটি গিরিপথ। আসলেই নাকি চোরাকারবারিরা একসময় সে-রাস্তা ব্যবহার করত আমেরিকা থেকে জিনিসপত্র কানাডায় পাচারের জন্য। অষ্টাদশ শতকের কোনো একসময় আমেরিকার সরকার বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। সে-কারণে মার্কিন পণ্য অবৈধপথে কানাডায় এবং সেখান থেকে পরে ইউরোপে পাচার হতো। সে-রাস্তা দিয়ে নাকি পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসরাও দেশ থেকে বেরিয়ে যেত।
ভারমন্টের দক্ষিণদিক থেকে উত্তরে যাওয়ার প্রধান রাস্তা রুট ১০০। আমাদের হোটেল থেকে সে-রাস্তা ধরার সহজ উপায় স্মাগলার্স নচ দিয়ে যাওয়া। হোটেলের গেট থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গেলে কয়েক মিনিট পরেই এক বনের মধ্য দিয়ে সেই আঁকাবাঁকা গিরিপথ। প্রথমে উঠে যেতে হয় পাহাড়ের ওপর। ওঠার পথ একসময় এমন সরু যে পাশে নোটিশ লাগানো – সামনে রাস্তায় কোনো বিভাজন চিহ্ন নেই। আসলে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রাস্তাটি এতই সরু যে, দুদিক থেকে দুটি গাড়ি একসঙ্গে যাওয়া-আসা করতে পারে না। কয়েকটি জায়গায় রাস্তার বাঁক এমন আর তার দুপাশেই পাহাড়ি পাথর এমনভাবে খাড়া হয়ে উঠে গেছে যে, অন্যপাশ থেকে আসা কোনো যানবাহন একেবারেই দেখা যায় না। সেসব জায়গায় গাড়ির গতি একেবারে কমিয়ে আগে দেখা এবং তারপর যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আমাদের গাড়িবহরের তিনটি গাড়িই সে-রাস্তা নিরাপদে পার হলো। তার একটু পর আমরা থামলাম রাস্তার পাশের একটি জায়গায়, যেখানে কয়েকটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছিল। আমরা একটু দূর থেকেই দেখেছিলাম চারদিকে সবুজের মাঝখানে হলুদ আর লালের ছোপ। মনে হচ্ছিল, আমাদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় সেখানে কয়েকটি গাছ একটু আগেভাগেই তাদের পাতার রং বদলে নিয়েছে। আমরা সবাই নামলাম সেখানে। দেখা গেল সেখান থেকে একটি ছোট্ট পথ বনের ভেতরের দিকে চলে গেছে। বুঝলাম, সেটি একটি হাইকিংয়ের ট্রেইল। শুরুতেই একটি ছোট পানির নহর, তার ওপর কালভার্ট বানানো আছে যাতে ওপাশে যেতে কোনো অসুবিধা না হয়। আমাদের কেউ কেউ বনের ভেতরে বেশ খানিক দূর চলে গেল। কেউ কেউ রং বদলে যাওয়া পাতার ছবি তুললাম। বনের পথে পড়ে থাকা ঝরা পাতারা জানিয়ে দিচ্ছিল, তাদের সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে তাদের বললাম, আমি তোমারই দলে!
আনন্দ-বেদনায় মেশানো সেই সময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না; মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে আমাদের তাড়িয়ে তুলল গাড়িতে। যদিও বৃষ্টির কারণে সেদিনের বাকি সময় আর বাইরে কাটানো যায়নি, আমরা আরো কয়েকবার সুযোগ পেয়েছি পাতার রংবদল দেখার। একবার ছিল প্রকৃতির পাশাপাশি এক টুকরো ইতিহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ – ভন ট্রাপ লজ এবং এর আশপাশে। লজের সঙ্গে গড়ে ওঠা হোটেলটির কথা একটু আগেই বলেছি। সেখানে একটি ছোট্ট প্রদর্শনী : ছবির মাধ্যমে ট্রাপ পরিবারের দেশত্যাগ, বিভিন্ন দেশে ঘুরে গানের অনুষ্ঠান করা, ভারমন্টের স্টোতে এসে বসতি স্থাপন, লজ নির্মাণ ইত্যাদি কাহিনি। সাউন্ড অব মিউজিক ছবিটি এবং অস্ট্রিয়ার যে-এলাকায় ট্রাপ পরিবারের আদি বাস ছিল, সেটিও আগে দেখা ছিল বলে সেই কাহিনির বাস্তবচিত্র দেখতে দেখতে তার সঙ্গে কিছুটা হলেও একাত্মতা বোধ করছিলাম। লজের আঙিনায় ফলে ভরা আপেলের বাগান, আশপাশে দিগন্তবিস্তৃত ঢেউ-খেলানো সবুজ প্রান্তর, দূরে সবুজ গাছের মাথায় হলুদ লালের ছোপ – সবমিলিয়ে ছিল এক ভালো লাগার পরিবেশ। লজের সামনেই দুটি গাছের পাতা ছিল একেবারেই রক্তলাল। তবে ট্রাপ পরিবারের ছবিগুলো দেখতে দেখতে এটাও মনে হচ্ছিল যে, কিছু মানুষের নৃশংসতা সমাজে কী ধরনের অবস্থা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে দেশ ছাড়তে হয়, অভিবাসী মানুষেরা সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে কীভাবে আবার জীবন শুরু করে, এসব কথা।
দিনটি ছিল রোদ-ঝলমল। আমরা হোটেলে ফিরে সেখান থেকে ক্যাবল কারে চড়ে উঠে গেলাম ম্যান্সফিল্ড পাহাড়ের চূড়ার প্রায় কাছাকাছি। যাওয়ার পথে দুধারের ঘন বনের মাথায় দেখা গেল সবুজের মাঝে মাঝে হলুদ আর লালের ছোপ – বোঝা গেল সেখানেও রংবদলের পালা শুরু হয়েছে।
ভারমন্টের যে-এলাকায় আমরা গিয়েছিলাম সেখানে শীতকালে লোক যায় স্কি করার জন্য, আর গ্রীষ্ম এবং শরতের আকর্ষণ গলফ, হাইকিং ইত্যাদি। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি ছিল বেশকিছু হাইকিং ট্রেইল। আমাদের পরিবারের কয়েকজন – মেয়ে শমী এবং তার স্বামী ফারাজ আর দুই ছেলের বউ – ফে এবং প্রতীক্ষা – উৎসাহী হাইকে যাবে। তারা খোঁজখবর করে ঠিক করল স্টার্লিং পন্ড ট্রেইলে যাবে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই মাইল। যাওয়া-আসা মিলিয়ে পাঁচ মাইলের একটু কম, এবং পাহাড়ে এক হাজার ফুটের একটু বেশি উঠতে হবে। তবে 888sport app download bd হিসেবে আছে পাহাড়ের চূড়ায় স্টার্লিং পন্ড নামে এক অনিন্দ্যসুন্দর পুকুর। আমি সাহস সঞ্চয় করে ঢুকে পড়লাম দলে।
পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালিতে 888sport app সেই পাহাড়। হেঁটে উঠলে সব দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। কোন গাছের পাতার রংবদল শুরু হয়েছে আর কোনটির হয়নি, তা দেখা যাবে একেবারে কাছ থেকে। পাশে পাওয়া যাবে পাহাড়ি ঝরনা। ভাগ্য প্রসন্ন হলে দু-একটি বন্যপ্রাণীরও সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে। এ-ধরনের সুযোগ আর কবে আসবে এই ভেবে দলে ঢোকা। তিন ঘণ্টা পর মনে হলো, কী ভালোই না হয়েছে গিয়ে।
হাইক শুরু হলো পাহাড়ের ছায়ায় 888sport app দিক থেকে। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছিল বলে সকালে বেশ ঠান্ডা ছিল। তবে একটু পরেই পাতার ফাঁক গলে সূর্যের কিরণ এসে গায়ে পড়তে শুরু করল। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই বেয়ে উঠতে উঠতে কিছুটা পরিশ্রম তো হচ্ছিলই। সুতরাং কিছুক্ষণ পর গায়ের জ্যাকেট খুলে কোমরে জড়িয়ে নিতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম এই ট্রেইল খুবই জনপ্রিয়। সামনে-পেছনে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের দল। যদিও বেশিরভাগই ছিল তরুণ বা মধ্যবয়সী, আমার মতোও যে দু-একজন ছিল না তা নয়। একটি পুরো পরিবার ছিল আমাদের সামনেই – কমবয়সী পুরুষ-888sport promo code, সঙ্গে বছরপাঁচেকের একটি ছেলে। পুরুষটির পিঠে একটি বাস্কেটের মতো ব্যাকপ্যাকে শিশুকন্যা। ছোট্ট ছেলেটি বেশ ভালোই হাঁটছিল, যদিও দু-একবার ঝরনা পার হওয়ার সময় লোকটি তাকে ধরে সাহায্য করেছিল। আমার মেয়ে এবং জামাইও তাদের আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে নিয়েছিল বুকে একটি স্ট্র্যাপ বেঁধে।
যদিও এই হাইকের ওয়েবসাইটের বর্ণনায় ছিল এটি মাঝারি ধরনের কঠিন, আমার কিন্তু মনে হলো মাঝারির চাইতে একটু বেশিই কঠিন। যদিও অনেক জায়গায় হাঁটা ছিল মোটামুটি সহজ – বনের পথে; বেশ কিছু জায়গা – বিশেষ করে প্রথম আধমাইল – ছিল খাড়া এবং পাথুরে। কোনো কোনো জায়গায় পাথর এতই খাড়া ছিল যে দুহাতে না ধরে ওপরে ওঠা যাচ্ছিল না; হাঁটার চাইতে পাহাড়ে ওঠার মতোই বেশি করতে হচ্ছিল। আগের দিন এবং রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বনের পথ এমনিতেই ছিল পিচ্ছিল। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আসছিল পাহাড়ি ঝরনার পানি। তবে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে উষ্ণতা দিচ্ছিল। আসা-যাওয়ার পথে অন্য হাইকাররা একে অপরকে সাহস দিচ্ছিল। যারা আস্তে হাঁটছিল তারা একটু পাশে সরে জায়গা করে দিচ্ছিল অন্যদের। হাই এবং হ্যালো ধরনের সম্ভাষণ-প্রত্যুত্তর চলছিল। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেল; আর তখনই ফিরতি পথের দুজন সাহস দিয়ে বলল, আর একটু!
আমরা এক ঘণ্টায় আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারলাম না। তবে তার প্রধান কারণ, আমি মাঝে মাঝে একটু থেমে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কোনো কোনো যাত্রায় নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে না – যাত্রাটিই গন্তব্য। আমাদের হাইকে অবশ্য গন্তব্য ছিল স্টার্লিং পন্ড; তবে আমার নিজের জন্যও যাত্রাটির গুরুত্ব ছিল। পথের দৃশ্য না দেখে শুধুই চলার জন্য আমি যাইনি। চারদিকে তাকালে আরো কত কী দেখা যায়! পাওয়া যায় মাটির গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ; শোনা যায় ছোট্ট ঝরনার ধারার একটু শব্দ। ঝরা পাতারা কত রঙের হতে পারে! শুধু শুকনো পাতাই ঝরেনি; কিছু রঙিন, এমনকি কিছু সবুজ পাতাও পড়ে রয়েছে গাছের নিচে। মানুষের মতোই ওরা – কেবল বৃদ্ধরাই ঝরে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, একটু অসাবধান হলে বা পা পিছলে গেলে পড়ে যেতে পারতাম অনেক নিচে। আবার এমন জায়গাও ছিল, যেখানে বেশ খানিকটা প্রায় সমতল। সুতরাং পথে আমি ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নিলাম।
কয়েক মিনিট দেরিতে হলেও আমরা পৌঁছে গেলাম একটি জায়গায়, যেখানে বনের পথ ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে, এবং সাইনবোর্ডে লেখা কোন দিকে গেলে স্টার্লিং পন্ড। সেদিকে একটু গিয়েই পথ বেঁকে গেল আবার, আর সামনেই দেখা গেল আমাদের গন্তব্য। প্রথমে একটু সরু জলের ধারা এবং তার ওপর ছোট-বড় পাথরের টুকরো পড়ে আছে। আর তার পরই সেই পুকুর। তবে আমার কাছে মনে হলো, পুকুর বললে তাকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হবে না; অন্তত দিঘি বলা উচিত। কোনো পুকুর বা দিঘির জল এত টলটলে আর নীল হতে পারে তা সেই স্টার্লিং পন্ডের জল না দেখলে জানা যেত না। দিঘির অন্য তিন পাড়ে ঘন বন, যার ছায়া পড়েছে জলে। তবে কোনো গাছের পাতাই রংবদল করেনি।
ছোট ছোট পাথরের পাশে ছোটখাটো টিলা আকৃতির এক বিশাল পাথর, যার ওপর বসে ছিল আগে আসা কয়েকজন হাইকার। মনে হচ্ছিল প্রকৃতি সেসব মানুষের কথা ভেবেই এখানে এই পাথর ফেলে রেখেছে, যারা এক ঘণ্টার বেশি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখানে আসবে, দুদ- বসে বিশ্রাম করবে আর উপভোগ করতে চাইবে দিঘির এবং এর আশপাশের দৃশ্য। কেউই সেখানে বেশিক্ষণ বসছিল না। সুতরাং আমরা শিগগির সুযোগ পেলাম সেই পাথরের ওপর উঠে একটু বসার এবং ছবি তোলার। আমি অন্যদের ছবি তুলছি দেখে এক সহৃদয়বান মহিলা এসে আমাকে বললেন, যারা ছবি তোলে তারা বেশিরভাগ সময় ছবিতে থাকে না; তুমি চাইলে আমি তোমাকে নিয়ে অন্য সবার ছবি তুলে দিতে পারি। যদিও আমি এখন সেলফি তোলায় কিছুটা দক্ষতা অর্জন করেছি, আমি জানি যে সেলফি আর কয়েক ফুট দূর থেকে তোলা ছবির মধ্যে অনেক তফাৎ। সুতরাং খুশি হয়ে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমার ফোনটি তাঁর হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম অন্যদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য।
স্টার্লিং পন্ড – এটাকে পুকুর বলি আর দিঘিই বলি – কেউ মাটি কেটে এটা বানায়নি। আগের দিনের এবং রাতের বৃষ্টির পর ওঠা সূর্যের পরিষ্কার আর মিষ্টি আলোয় এটাকে লাগছিল সদ্যস্নান সেরে আসা সুন্দরী তরুণীর মতো। যারা প্রায় আড়াই মাইল হেঁটে (এবং এক হাজার ফুট পাহাড়ে উঠে) একে দেখতে আসছিল তারা এর সৌন্দর্যকে নষ্ট করার মতো কিছু করছিল না। কাউকে দেখিনি এর পাড়ের সেই পাথরে বসে কোনো কিছু খেয়ে পানির বোতল বা খালি প্যাকেট ফেলে যেতে। চারদিকে তাকিয়ে ঝরা পাতা বা দু-একটি ভাঙা গাছের ডাল বাদে আর কোনো কিছুই নজরে পড়েনি।
ভন ট্রাপ লজের আশপাশের দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ আর এর প্রান্তে বনের মাথায় রঙের ছোপ, ম্যানসফিল্ড পর্বতের গায়ে গাছেদের রংবদল, আর স্টার্লিং পন্ডের সৌন্দর্য দেখলে সৃষ্টিকর্তার কথা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মনে পড়ল, ট্রাপ লজের পাশের মাঠের এক প্রান্তে একটি বেঞ্চের হেলান দেওয়ার জায়গায় উৎকীর্ণ ছিল :
I will lift up my eyes to the hills,
where does my help come from?
My help comes from the Lord, the maker of heaven and earth.
[Psalm 121:1]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.